#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১০
#ইশরাত_জাহান
🦋
নীরা বই পড়ছে আর আড় চোখে দ্বীপকে দেখছে।দ্বীপ তার মতো বইয়ের পাতা দাগিয়ে যাচ্ছে।হঠাৎ করে নীরার চোখ আটকে যায় দ্বীপের চোখের দিকে।চারকোনা আকারে চশমার ভিতর দ্বীপের চোখ যেনো আকর্ষণীয় লাগছে তার কাছে।দ্বীপের খোঁচা খোঁচা দাড়ির মাঝে ছোট্ট একটি তিল দেখা যাচ্ছে যেটা নীরা আজ খুব ভালো ভাবে পরখ করছে।নীরার অজান্তেই নীরা তাকিয়ে ছিলো দ্বীপের দিকে।হঠাৎ নীরার পড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দ্বীপও তাকায় নীরার দিকে।দ্বীপ বুঝতে পারে নীরার চাহনির মানে।মোহিত হয়ে যাচ্ছে নীরা।হবে নাই বা কেনো!তারা তো স্বামী স্ত্রী তাদের হক আছে এই ভাবে একে ওপরের প্রতি মোহিত হওয়ার।কিন্তু কাল নীরার পরীক্ষা।ওকে এখন একটু মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে।দ্বীপ চায় না নীরা তার উপর নির্ভর করে চলুক।দ্বীপ চায় নীরা একজন সফল নারী হোক।সে তার বউকে তার চন্দ্রপাখিকে একজন ভালো আদর্শ সফল নারী বানাতে চায়।ভালোবাসার মানুষ একজন সফল মানুষ হবে এই অনুভূতিটি ভিন্ন।নীরার ভিতর এই সবকিছুর প্রতিভা আছে কিন্তু নীরা নিজেকে হেলায় উড়িয়ে দিয়েছে।এসব ভেবে দ্বীপ নীরার মাথায় দিলো এক টোকা।নীরার ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটলো।দ্বীপ নীরাকে বলে,”বরকে দেখার জন্য সারা জীবন পরে আছে কিন্তু ইন্টারের রেজাল্ট একবারই আসবে।আমি যেনো দ্বিতীয়বার ইন্টার এক্সাম দিতে না দেখি।”
“বুঝতে পেরেছি।”
বলেই পড়তে শুরু করে নীরা।মনে মনে একটু লজ্জা পায় সে।কিন্তু প্রকাশ করলো না।
সকাল বেলা দ্বীপের আগে ঘুম থেকে ওঠে নীরা।মিনিকে সোফায় ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।হামি তুলে নীরা তাকালো দ্বীপের দিকে।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,”ঘুমানোর সময় কেউ চশমা চোখে রাখে!কি আজব ক্যাডার সাহেব আমার।চশমা খুলে ঘুমালে কি হয়?”
বলেই ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
কেয়া আজ নিজের মতো কলেজে যাবে।নীরা দ্বীপের সাথে যাবে।কেয়ার ভালো লাগছে না নীরা তার সাথে নেই বলে।আনমনে হাঁটতে থাকে কেয়া।ঠিক তখনই পিছন থেকে শুনতে পায়,”এই চশমিশ।”
কেয়া তাকালো পিছনে। রিককে দেখতে পেলো। রিককে দেখে ভালো লাগলো কেয়ার কিন্তু চশমিশ নামটি বলার কি খুব দরকার ছিলো!চশমা কি আর সে ইচ্ছা করে পড়ে।তার অসুবিধা আছে বলেই তো চশমা নেওয়া লাগে। প্রতিবাদ করে কেয়া বলে,”আমাকে চশমিশ বললেন কেনো?”
“কারণ তোমাকে চশমা পড়া দেখতে আমার ভালো লাগে তাই।লম্বা চওড়া মুখে চিকন চিকন চোখে চশমা যেনো আলাদাভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।তুমি সাইন্স নিয়ে পড়াশোনা করলে বলতাম ডাক্তার হও।একদম পারফেক্ট লাগবে।”
“আপনি ডাক্তার হতে বললে আমি ডাক্তার হতাম?”
“জানি না,তবে আমি আমার মনের বাসনা না হয় বলেই দিতাম।সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব তোমার।”
“হুম।”
“আমার বাইকে করে চলো।কলেজে পৌঁছে দেই।”
“আপনি কি আমার ড্রাইভার হওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন?নীরা আমার সাথে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে আপনি আমাকে কলেজে নিয়ে যাওয়া আসা করেন।এগুলো কেনো করেন?”
“এখনও বুঝতে পারোনি?নাকি বুঝেও না বোঝার অভিনয়!”
বিষম ওঠে কেয়ার।সে তো খুব ভালোভাবেই জানে এই সাদা বিলাই তার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে। সেও তো সাদা বিলাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।কথা এড়াতে কেয়া বলে,”আমি কি জানবো? আর আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।পরীক্ষা আজ আমার।চলুন কলেজে যাই।”
বলেই রিকের বাইকে উঠলো কেয়া।রিক স্মিত হাসলো। কেয়াও হাসলো এটা রিক দেখতে পেলো।বাইকের আয়নাতে কেয়ার হাসি দেখে রিকের ভালো লাগলো।রিক মজা করে বলে,”আমার চশমিশের হাসি অনেক সুন্দর।”
প্রতিউত্তর করে না কেয়া।মনে মনে খুশি হয়েছে।রিক তাকে নিজের করে বলছে।
নীরা রেডি হয়ে ব্যাগ গোছাচ্ছে। ব্যাগগুলো দীপান্বিতা নিয়ে যাবে।তিনদিন হয়ে গেছে আজ শশুর বাড়িতে যাবে নীরা।পরীক্ষা দিয়ে সোজা শশুর বাড়ি।কিন্তু নীরার মনে খারাপ লাগার আভাস নেই।সে খুব ফুরফুরে আছে।খারাপ আর লাগবে কিভাবে?শশুর বাড়ি আর বাবার বাড়ি তো পাশাপাশি। ব্যালকনিতে দাড়ালেই তার ঘর দেখা যায় আবার দীপান্বিতার ঘরের দিকে গেলে নীরবের ব্যালকনি।মা বাবাকে সারাদিন দেখতে পাবে।
দ্বীপ বারবার নীরাকে বলছে,”পরীক্ষা মনোযোগ দিয়ে দিবে।যেটা পারবে না ওটা বাদ দিয়ে অন্যগুলো লিখবে।যেহেতু টেস্ট পরীক্ষা আপাতত পাশ মার্কস হলেই হবে।যেগুলো পড়িয়েছি মাথায় ভালোভাবে রাখবে।”
নীরা এবার বিরক্ত।দ্বীপের দিকে তাকিয়ে কোমরে হাত দিয়ে বলে,”এখন আমরা বের হবো।আপনি কি আমাকে এখনও এসব ভাষণ দিবেন?দেশে মনে হয় আমি সেই মেয়ে যে কিনা স্যারকে বিয়ে করে বইয়ের বিদ্যা নিয়ে ঘুরছে। কোথায় বিয়ে করলাম নতুন নতুন এখন আরো বরের সাথে ঘুরবো ফিরবো তা না।পরীক্ষা এই করো ওই করো।”
দ্বীপ নীরার কাছে আসলো।তারপর বলে,”এই স্যারকে স্বামী রূপে তুমি নিজেই গ্রহণ করতে পারবে না।যেখানে কাজটি তোমার দ্বারা সম্ভব না সেখানে কেনো বারবার এসব কথা বলো।আমি তোমার উপর কোনো প্রেসার ক্রিয়েট করতে চাই না।তুমি যেদিন মন চাইবে সেদিন এই স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক পূর্ণ হবে।কিন্তু এখন আপাতত পড়াশোনা মন দিয়ে করো।তোমাকে একজন আদর্শ সন্তান আদর্শ বউ আদর্শ বউমা আর ভবিষ্যতে আদর্শ মা হতে হবে।”
‘আদর্শ মা’ কথাটি শুনেই যেনো নীরার মন অন্যরকম হয়ে গেলো।লজ্জায় আর কিছু বলল না।দ্বীপ তাড়াহুড়া দিতে থাকলো।অবশেষে সবাইকে বিদায় দিয়ে কলেজে চলে গেলো নীরা ও দ্বীপ।
দ্বীপ আজ তাদের নিজস্ব গাড়ি নিয়েছে।আপাতত নীরা ও দ্বীপের ব্যাপারে কলেজে কেউ জানে না।দ্বীপ জানায়নি কারণ নীরার পরীক্ষার ভিতর ওর ফ্রেন্ডরা ওকে নিয়ে প্রশ্নের পাহাড় তুলবে।অনেকে বলবে বর এই কলেজের স্যার আর বউ ছাত্রী নীরার রেজাল্ট তো এমনি ভালো হবে।এতে করে নীরার ওপর প্রভাব পরবে।দ্বীপ চায় না নীরা আপাতত এসব ফেস করুক।অন্তত ইন্টার পরীক্ষা শেষ করে তারপর সবাই জানুক।এজন্য গাড়ি করে যেয়ে গেটের পাশে দিয়ে নীরাকে নামিয়ে সে ভিতরে চলে যাবে।এতে করে কেউ তাদের একসাথে দেখবে না।
পরীক্ষা শুরু হয়েছে।ছাত্র ছাত্রী সবাই সবার সিটে বসেছে।পরীক্ষা শুরু হওয়ার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে নীরা এসেছে।এসেই কেয়াকে জড়িয়ে ধরে।নীরা ও কেয়ার সিট সামনে পিছনে। স্যার এসেছে সাথে সাথে সবাই চুপচাপ পরীক্ষায় মনোযোগী হতে থাকে।
দেড় ঘণ্টা পরীক্ষা দেওয়ার পর নীরা দেখে সে অনেক কিছুই লিখেছে।গুনতে থাকে কত মার্কস হতে পারে।প্রায় চল্লিশ মার্ক মানে পাশ মার্কের উপরে আছে।টেস্ট পরীক্ষা পাশ মার্কস হলেই হবে।ক্যাডার সাহেব তো এটাই বলেছিলো।তাহলে আর কি খাতা জমা দিয়ে দিলেই হয়।নীরার পিছনে কেয়া বসেছে।নীরা কেয়ার বেঞ্চে হেলান দিয়ে বলে,”দোস্ত কত মার্কের উত্তর দিয়েছিস?”
“পাশ মার্কস উঠে গেছে দোস্ত।তুই কত মার্কসের উত্তর দিয়েছিস?”
“আনুমানিক পঞ্চাশ হবে কিন্তু মনে কর দুই এক মার্ক কাটলে চল্লিশ।বলছি এটা তো টেস্ট এক্সাম।আমার ক্যাডার সাহেব বলেছে পাশ মার্কস উঠলেই হবে।চল খাতা দিয়ে ফুসকা খেতে যাই।”
“আচ্ছা দোস্ত চল।এমনিতেও ভালো লাগছে না লিখতে।”
বলেই দুজনে খাতা জমা দিয়ে বের হয়ে যায়।বাইরে এসে নীরা ও কেয়া আরামছে ফুসকা ইনজয় করে।তারপর দুজনে মিলে লেকের পাড়ে এসে বসে।দুজনে মন খুলে গল্প করতে শুরু করে।গল্প করতে করতে অনেক সময় হয়ে যায়।দ্বীপের ডিউটি অন্য ডিপার্টমেন্টে ছিলো।ডিউটি শেষ করে সে নীরাকে খুঁজতে লাগলো। কোথাও পেলো না।অবশেষে নীরাকে কল দিলো।নীরা কল রিসিভ করে বলে,”জি বলুন।”
“কোথায় তুমি?”
“আমি আর কেয়া লেকের পাড়ে এসেছি।”
“কখন গেছো তোমরা?”
“এই তো ঘণ্টা দুই হবে।”
“পরীক্ষা কখন দিয়েছো?”
“পরীক্ষা দিয়ে পাশ মার্কস উঠিয়ে তারপর এসেছি।আপনি না বললেন পাশ মার্কস উঠলেই হবে।”
দ্বীপের মাথায় হাত।এই মেয়েকে সারাদিন রাত পড়িয়েছে সকালে একটু টেনশন মুক্ত করার জন্য ওই কথাগুলো বলেছিলো। আর এদিকে সে কি না পাশ মার্কস এসেছে বলে নাচতে নাচতে ঘুরতে গেছে।সাথে সাথে দ্বীপ বলে ওঠে,”আমি কি বলেছিলাম পাশ মার্কস উঠিয়ে বাইরে চলে যাবা?আচ্ছা থাকো ওখানে আমি আসছি।”
“আচ্ছা।”
কল কেটে দিলে কেয়া নীরাকে জিজ্ঞাসা করে,”কি হয়েছে?”
“উনি আসছে আমাকে নিতে।”
“এই উনি টা কে?”
“ঢং!তুই মনে হয় জানিস না?আমার ক্যাডার সাহেব তোদের আদনান কবির দ্বীপ স্যার।”
“তাহলে আর কি আমিও চলে যাই বাসায়।”
“তোর সাদা বিলাইকে কল দে।আসুক তোরা গল্প কর।”
“আইডিয়া মন্দ নয়।কিন্তু আমার লজ্জা করছে।”
“আর লজ্জা পেতে হবে না।ভালো যখন দুজন দুজনকে বেসেছিস দেরি না করে বলে ফেলা ভালো হবে।”
বলতে বলতে দ্বীপ গাড়ি নিয়ে হাজির।নীরা দ্বীপের গাড়ির দিকে তাকালো তারপর কেয়ার হাত থেকে কেয়ার ফোন নিয়ে রিককে এসএমএস দিলো,”আমি লেকের পাড়ে আছি।আপনি যদি চান একসাথে আজকে আমরা কফি ডেট করতে পারি। আমি দশ মিনিট অপেক্ষা করলাম আপনি না আসলে চলে যাবো।”
লিখেই ফোনটি কেয়ার হাতে দিয়ে দিলো।কেয়া এসএমএস দেখে অবাক হলো।বলে,”এটা কি লিখেছিস!এখন উনি কি ভাববে বলতো?আমি কি করবো এখন?”
নীরা ভেংচি কেটে বলে,”তোর সাদা বিলাই কিছুই ভাববে না।উল্টো খুশি হয়ে চলে আসবে। দশ মিনিট সময় দিয়েছি।দেখ কি করে।”
এর ভিতরে দ্বীপ এসে বলে,”কাকে দশ মিনিটের ভিতরে আসতে বলেছো।”
“আসলেই দেখতে পাবেন এক সাদা বিলাই।”বলেই হেসে দেয় নীরা।”
কেয়া সাথে সাথে দ্বীপকে বলে,”আসসালামু আলাইকুম,স্যার।
নীরা ভ্রু কুচকে বলে,”উনি এখন তোর স্যার না।উনি তো এখন তোর জিজু। স্যার তো কলেজে।শুনুন আমাদের কেয়া প্রেমে পড়েছে এক সাদা বিলাইয়ের।তার জন্য অপেক্ষা করতে বলেছি।আমরা তো চলে যাচ্ছি ও এবার ঘুরুক ওর মতো।”
বলতে না বলতেই রিক হাজির।দৌড়ে এসেছে সে।দ্বীপকে দেখতে পায়নি।হাফাতে হাফাতে বলে,”আগে বলবে না তুমি এখানে এসেছো। ক্লাসেই ঢুকতাম না তাহলে।পিছনের গেট দিয়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে।”
বলেই দেখতে পেলো দ্বীপকে।ভয়তে ঢোক গিলতে থাকে রিক।নীরা আবারও রিককে বলে ওঠে,”ভয় পাবেন না ভাইয়া।উনি তো এখন আপনাদের স্যার না উনি এখন আপনাদের জিজু।”
দ্বীপ চোখের চশমা ঠিক করে গাড়ির দিকে যেতে যেতে বলে,”তাড়াতাড়ি আসো বাড়িতে যেতে হবে।”
বলেই চলে যায়।কেয়া সাথে সাথে ব্যাগ থেকে পানি বের করে খেতে থাকে।এতক্ষণ ভয়তে ছিলো।নীরা ওদেরকে বিদায় জানিয়ে দৌড়ে উঠলো গাড়িতে।
বাড়িতে এসে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নেয় নীরা ও দ্বীপ।একসাথে ঘরে এসে দ্বীপ গল্পের বই হাতে নেয়।বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বলে,”আমি যদি সবার জিজু হই তাহলে তোমার কি হবো?”
নীরা মিনিকে নিয়ে খেলা করতে থাকে।দ্বীপের এমন কথা শুনে চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।দ্বীপ চশমা ভালোভাবে সেট করে বলে,”কি হলো বউ!বলো কি হই আমি তোমার?”
মিথ্যে হামি তুলতে তুলতে নীরা বলে,”আমি এখন ঘুমাবো। কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি আমার।”
বলেই মিনিকে নিয়ে কম্বল মুড়ি দেয় নীরা।
চলবে…?