#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৭
#ইশরাত_জাহান
🦋
সকাল সকাল বাইরে থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভেংগে যায় দ্বীপ ও নীরার।ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে নীরা বসে।তারপর বলে ওঠে,”সকাল সকাল শশুর বাড়িতে ডাকাত পরলো নাকি।শশুর বাড়িতে আসতে পারলাম না প্রথম দিনই ঝগড়া ঝাটির শব্দে ঘুম ভাঙলো।”
পাশে বসা দ্বীপ চোখের চশমা পরে নিলো।তারপর দ্বীপ ও নীরা একসাথে বের হলো ঘর থেকে।নীরার পোশাক ঠিক ছিলো।কিন্তু শাড়িটা একটু বেকে আছে,কপালের টিপ উল্টে গেছে,চোখে দেওয়া চিকন কাজল লেপ্টে গেছে,লিপস্টিক হালকা উঠে গেছে।এগুলো ভালোভাবে পরখ করলো দ্বীপের দাদী মিসেস শিউলি।
মিসেস শিউলি এসে নীরাকে বলে ওঠে,”কি গো নাতবৌ!আমার নাতি বিড়াল টিরাল মারতে পেরেছিলো ঠিকমতো?”
সদ্য ঘুম থেকে ওঠা নীরা সরল সহজ মনে অন্য কিছু ভেবে বলে ওঠে,”অনেক জোরে মেরেছে দাদী।ব্যাথা পেয়েছে খুব।”
অবাক হলেন মিসেস শিউলি।বলে ওঠে,”কি কও তুমি?এ কেমন বিড়াল মারা যেখানে সে নিজেই ব্যাথা পায়!”
টনক নড়লো নীরার।ওর যে কাল বাসর ছিলো আর এই বুড়ি তারই সূত্র ধরে বিড়াল মারার কথা বলছে এখন বুঝতে পারলো।জিহ্বায় কাপড় দিলো সাথে সাথে।পাশে তাকিয়ে দেখে দ্বীপ তার দিকেই তাকিয়ে আছে।নীরা দাত বের করে দেয় এক হাসি।দ্বীপ মুড নিয়ে বলে ওঠে,”ইডিয়েট।”
নীরা কথা এড়াতে বলে ওঠে,”আচ্ছা দাদী বাড়িতে ডাকাত পড়েছে ইয়ে না মানে এত চিল্লাচিল্লি কেনো?”
মিসেস শিউলি হামি তুলে বলে,”ডাকাতই পরেছে নাতবৌ,নাটক তো সবে শুরু হলো। সাদে কি আর তোমাদের বিয়ে এত তাড়াতাড়ি করে দেওয়া।ওই যে সুপার গ্লু আঠা তোমার বরের পিছনে লাগছে।এখন তুমি গরম পানি হইয়া তোমার বরের থেকে ওরে ছাড়াও।”
মিসেস শিউলির কথার আগা মাথা বুঝলো না নীরা।দ্বীপ বুঝতে পেরেছে কি হয়েছে।তাই আর সে বাবা মায়ের ঘরে গেলো না।চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ দ্বীপের বাবা মায়ের ঘর থেকেই আসছে।দ্বীপ ড্রয়িং রুমের সোফায় বসেছে।নীরা দ্বীপের বাবা মায়ের ঘরে গেলো।
নীরাকে দেখে সবাই চুপ হয়ে যায়।ভালোভাবে দেখে নেয় সবাই নীরাকে।এর ভিতরে একটি মেয়ে নাম পিংকি বলে ওঠে,”এই দেখো মা এই মেয়েটি সেই কাল নাগিন।যে আমার থেকে আমার দ্বীপ বেবীকে নিয়ে নিয়েছে।”
পিংকির কথা শুনে পিংকির মা মিসেস সাদিয়া মিস্টার সমুদ্রকে বলে ওঠে,”এটা তো তোমাদের প্রতিবেশী ভাই।এই মেয়ে তো এসএসসি তে ডাব্বা খাওয়া।বয়সেও কম আমাদের দ্বীপের থেকে।এর থেকে আমার পিংকি কত ভালো।একটা ক্লাসেও ফেইল করেনি।তারউপর বয়সে দ্বীপের সাথে মানাতো। আমার মেয়েটা সেই ছোটবেলা থেকেই দ্বীপকে ভালোবাসে। আর তুমি কি না আমার মেয়ের সাথে বিয়ে না দিয়ে এক ফেলটুশের সাথে বিয়ে দিলে!”
মিসেস সাদিয়া আর মিস্টার সমুদ্র ভাই বোন।না,আপন ভাই বোন না।মিস্টার সমুদ্রের বাবার দ্বিতীয় বউয়ের সন্তান মিসেস সাবিনা।যেহেতু বাবার দ্বিতীয় বিয়েতে মা কিছু বলেনি তাই মিস্টার সমুদ্র চুপ থাকতেন।মিসেস সাদিয়ার মাকে ছোট মা বলেই ডাকতেন।একই বাড়িতে বেড়ে ওঠা মিস্টার সমুদ্র ও মিসেস সাদিয়া ভাই বোন হয়েই বড় হয়।মিস্টার সমুদ্রের মনে বাবার জন্য অভিমান থাকলেও কখনও প্রকাশ করেনি।বাবার মৃত্যুর আগে তাকে ওয়াদা করতে হয় যে সে কখনও মিসেস সাদিয়াকে অবহেলা করবে না।তাই এখনও ভাই বোনের সম্পর্ক অটুট আছে।মিসেস সাদিয়ার মা ছোটবেলায় মারা গেছেন।এজন্য মিসেস শিউলি তাকে বড় করেছেন।কিন্তু মিসেস সাদিয়া হয়েছে একদম তার মায়ের মত কুচুটি ও লোভী।এজন্য মিসেস শিউলি এদের মন থেকে পছন্দ করে না।মৃত স্বামীর দেওয়া ওয়াদা পালন করেন শুধু।তানাহলে মিসেস সাদিয়ার সম্পত্তি আলাদা করে সে কবেই নিজের মত থাকতে পারতো।
মিসেস সাদিয়ার ন্যাকা কান্না সহ্য হয় না মিস্টার সমুদ্রের।তারপরও তিনি নম্র কণ্ঠে বলে ওঠে,”আমাদের নীরা একবার এসএসসি তে ফেইল করলেও পরেরবার কিন্তু ও A+ পেয়েছে।শুধু একবার ফেইল করেছে বলে ওই দুই সাবজেক্টটিতে হায়ার মার্কস উঠাতে পারেনি।বাকিগুলো কিন্তু ওর সব আশির উপরে মার্কস। আর বয়স আমাদের কাছে বড় ফ্যাক্ট না।আমাদের সবার মনে নীরার জন্য আলাদা জায়গা তৈরি হয়েছে।আমরা শত চেয়েও পারিনি দ্বীপের জীবনে অন্য মেয়েকে আনতে।আমার সাবিনা আমার কাছে কখনও কিছু চায়নি।এই প্রথম বলেছে সে তার পুত্রবধূ হিসেবে নীরাকে চায়।আমিও না করতে পারিনি।বউয়ের একটাই চাওয়া এটি তো পূরণ করতেই হবে।”
অবাক হলেন মিসেস সাবিনা।শুধু তার একার চাওয়া! আর কারোর চাওয়া ছিলো না!কি সুন্দর নিজেকে বাঁচাতে বউয়ের নামে দোষ।কিছু বললেন না তিনি এখন।রাতে একা পেলে বেটাকে বোঝাবে মিথ্যা দোষ দেওয়ার মজা কি?
নীরা ইমোশন হয়ে মিসেস সাবিনাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আণ্টি তুমি আমাকে এত ভালোবাসো?আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি।”
মিসেস সাবিনা জড়িয়ে ধরে নীরাকে।মনে মনে বলে,”ওরে মা তোকে আমরা যত ভালোবাসি তার থেকে বেশি ভালো তোকে তোর ক্যাডার সাহেব বাসে।এজন্যই তো পিংকি দশ দিনের জন্য বাইরে ঘুরতে যাওয়ার সাথে সাথে তোর ক্যাডার সাহেব আমাদের হাতে পায়ে ধরে তোদের বিয়ে দেওয়ায়।”
মনের কথা মনে রাখলেন মিসেস সাবিনা।নীরাকে আপাতত জানানো যাবে না দ্বীপ যে তাকে ভালোবাসে।এই মেয়ে যে পড়া চোর।যদি জানতে পারে তাহলে দ্বীপকে ভালোবাসার ব্লাকমেইল করে পড়াশোনা বাদ দিয়ে নাচতে শুরু করবে।
পিংকি এসে বউ শাশুড়ির ভালোবাসা দেখে ভেংচি কাটে।বলে ওঠে,”ঢং দেখলে বাঁচি না।”
অভ্র ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলো।পিংকির কথা শুনে বলে ওঠে,”আসো তোমার নাক টিপে ধরে রাখি।শ্বাস আটকে মারা যাবে সাথে সাথে।তাহলে আর ঢং দেখতে হবে না।”
দীপান্বিতা সাথে সাথে অভ্রর মুখ চেপে ধরে বলে,”ছিঃ বাবা,এসব বলতে নেই।”
মিসেস সাদিয়া অভ্রকে সহ্য করতে পারে না।উটকো ঝামেলা মনে করে এই অভ্রকে।তাই তিনি বলে,”এই আসছে আরেক হ”ত”ভা”গা। যার জন্মের ঠিক ঠিকানা নেই সে আবার আমার মেয়েকে মারতে চায়।”
তেতে ওঠে দীপান্বিতা।সাথে সাথে বলে,”মুখ সামলে কথা বলো ফুফু।আমি মানছি ছোট মানুষ এর ভিতর কথা বলে ভুল করেছে।কিন্তু আমার ছেলেকে নিয়ে একটা বাজে কথাও বলবে না।আমি এসব সহ্য করবো না।ও কোথায় কিভাবে হয়েছে তোমাকে না দেখলেও চলবে।এর জন্য ওর নানু নানী মা মামা এরা আছে।”
“আমিও আছি,অভ্রর মামী।”হাত উচু করে বলে নীরা।
বেশি তর্ক করতে গেলে পরিবার বিচ্ছেদ হয়ে যাবে।এর ফলে নিজের স্বার্থ হাসিল হবে না।তাই মিসেস সাদিয়া চুপ হয়ে যায়।এমনিতেও পিংকিকে এই বাড়িতে থাকতে হবে।পড়াশোনার জন্য ঢাকায় মামার বাড়িতে থাকে পিংকি।
মিস্টার সমুদ্র বলে ওঠে,”আচ্ছা এসব কথা এখন বাদ সন্ধায় বৌভাত অনুষ্ঠান হবে।অনুষ্ঠানটি আমাদের ছাদে করা হবে।সেসবের আয়োজন শুরু করা হোক।দ্বীপের ছুটি খুব কম।তাড়াতাড়ি শেষ করে ওকে আবার কলেজ যাওয়া লাগবে।”
সবাই সম্মতি জানিয়ে যে যার মতো কাজে চলে যায়।নীরা বের হবে কিন্তু কিছু একটা ভেবে পা থামিয়ে পিংকির দিকে তাকিয়ে ভালোভাবে পিংকিকে দেখে নেয়।মনে মনে অনেক কিছুই একে ফেলে নীরা।তারপর প্রস্থান করে নিজের ঘরে।
ঘরে এসে নীরা ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমের দিকে যায়।তখনই দ্বীপ বের হয় ওয়াশরুম থেকে।দ্বীপের গায়ে একটি টাওয়াল থাকে শুধু।নীরা দ্বীপকে দেখেই অন্য দিকে ফিরে চোখ বন্ধ করে নেয়।তারপর বলে,”বেলজ্জা পুরুষ মানুষ।ঘরে যে আপনার বউ এসেছে এটা কি ভুলে গেছেন?”
দ্বীপ আলমারি থেকে কাপড় নিতে নিতে বলে,”ঘরে বউ এসেছে এটা ভুলিনি।তবে ঘরে যে বউ রূপে বেগানা রমণী ঢুকেছে এটা ভুলে গেছি।কি দিন আসলো!বউয়ের থেকেও না কি নিজেকে প্রোটেক্ট রাখতে হবে?”
‘বউ’ শব্দটি নীরার কানে বাজতে থাকে।মূলত কবুল বলার পরপরই এই ক্যাডার সাহেবকে কেমন অন্যরকম লাগছে তার কাছে।ক্যাডার সাহেব বদলায়নি।বদলেছে তো নীরার মন।এতদিন এই ক্যাডার সাহেব ছিলো তার শিক্ষক এখন এই ক্যাডার সাহেব তার তিন কবুল বলা বৈধ স্বামী।ভাবতেই মনের ভিতর দিয়ে শীতল হওয়া বয়ে নিয়ে যায়।
নীরার চোখ বন্ধ অবস্থায় ফিল করতে পারে দ্বীপ তার নিকটে এসেছে।অতি নিকটে এসে দ্বীপ বলে,”চোখ খোল।”
নীরা না বোধক মাথা নাড়ায়।তারপর বলে ওঠে,”আপনি উলংগ।পোশাক দ্বারা নিজেকে আবৃত করে নিন।তারপর চোখ খুলবো।”
দ্বীপ নীরার মাথায় আলতো চাটি মারে।ব্যাথা পেয়ে চোখ খুলে নীরা।দেখে দ্বীপ পোশাক পরেছে।দ্বীপ বাইরে যেতে যেতে বলে,”যত্তসব আলতু ফালতু চিন্তা মাথায় ঘুরপাক করে তাই না!ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে আসো সকালের খাবার দুপুরে খাওয়া আমি পছন্দ করি না।”
দ্বীপ যেতেই নীরা নিজের মাথায় নিজেই বারি দিয়ে বলে,”আই হেট মাই মাইন্ড।”
ফ্রেশ হয়ে দীপান্বিতার কথাতে একটি গোলাপী শাড়ি পরলো নীরা।তারপর দীপান্বিতা নীরাকে নিয়ে এলো ড্রয়িং রুমে।সবাই একসাথে সকালের খাবার খাবে বলে অপেক্ষা করছে।দ্বীপ এসে খাবার টেবিলে বসেছে।প্রায় সবাই বসে আছে।নীরাকে দ্বীপের পাশে বসাতে যাবে তার আগে পিংকি এসে দ্বীপের পাশে বসেছে।সবাই পিংকির এই কাজ দেখে ক্ষিপ্ত হলো।শুধু মিসেস সাদিয়া বাদে।
বসতে বসতে পিংকি বলে ওঠে,”খুব খুদা লাগছে মামী।তোমাদের বউমার জন্য কত অপেক্ষা করতে হয়!এখন খাবার দেও।
দ্বীপ হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে চেয়ার ছেড়ে উঠতে যায় তার আগে নীরা বলে ওঠে,”কি কপাল আমার!নতুন বিয়ে করা জামাই বউ আমরা। কোথায় এখন বর বউ একসাথে বসে খাবো তা না মাঝখানে দেওয়াল হয়ে বসে আছে আমার ফুফাতো ননদ।বলি বরের যদি তার বোনের পাশে বসেই খেতে হয় তাহলে বিয়ে করেছিলো কেনো?আমাকে শোপিস হিসেবে সাজিয়ে রাখবে বলে!”
এটুকু বলেই নীরা পিংকির হাত ধরে উঠিয়ে আবার বলে,”আমার দুষ্টু ননদ,ভাবী কিন্তু তোমার এসব কাজে অনেক মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনিয়ে দিবে।তাই সময় থাকতে বিবেগবোধ গুলোকে জাগ্রত করো।যেখানে যেই সম্পর্ক বিদ্যমান সেখানে সেভাবেই থেকো।”
দ্বীপ খুশি হয় নীরার কথা শুনে।দ্বীপ ভেবেছিলো নীরা কিছু বলবে না তাই নিজে উঠতে চেয়েছিলো।কিন্তু তার বউ যে সম্পর্কের মূল্য ধরে রাখবে এটা বুঝে উঠতে পারেনি।পিংকি ভেবেছিলো নতুন বউ মুখ ফুটে কিছু বলতে পারবে না।তাই সে দ্বীপের পাশে বসে।কিন্তু এই মেয়েতো লাগামহীন কথাবার্তা শুনিয়ে দিলো।এদিকে সবাই আবার এ জন্য খুশি হয়েছে।এটা সবার মুখ দেখলে বোঝা যায়।তাই না পেরে পিংকি তার মায়ের পাশে বসে।
চলবে…?