#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৬
#ইশরাত_জাহান
🦋
কে ধাক্কা দিলো দেখার জন্য পিছনে তাকালো দ্বীপ।তাকিয়ে দেখতে পেলো গাঢ় খয়েরী রঙের শাড়ি পরিহিতা এক মেয়ে।মেয়েটি আর কেউ না নীরা। নীরা দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খায়। কার সাথে ধাক্কা খেলো তাই দেখতে যেয়ে দেখতে পেলো দ্বীপকে।
দ্বীপ নীরাকে দেখে বলে,”তুমি না পালিয়েছো?পালিয়ে ঠিক তার কাছেই এলে যাকে বিয়ে করবে না।”
নীরা পিছনের দিকে তাকিয়ে আশেপাশে ভালো করে দেখে নিলো।তারপর বলে,আসলে আমি নিজেকে বাঁচাতে দৌড়াচ্ছি।”
“মানে?”
“একটু আগে আমি একা একা স্টেশনে বসেছিলাম।মনের সুখে আপনাকে এসএমএস করতে থাকি।একেতো শীতের সন্ধ্যা তার উপর মশা কামড়ায়।আমি বারবার কেয়াকে কল দিতে থাকি ও কল রিসিভ করে না।হঠাৎ এক চিকনা শুটকি মাছের মত গুন্ডা আমার কাছে আসে।
আমাকে বলে,”সুন্দরী বাড়ি থেকে পালিয়েছো বুঝি!অনেকক্ষণ ধরে বসে আছো। বয়ফ্রেন্ড আসছে না।ওই বয়ফ্রেন্ড আর আসবে না।তাতে কি আমি তো আছি। চল আমি তোমাকে নিয়ে যাব।”
বলেই আমার হাত ধরে টানতে থাকে।আমি কোনো মতে তার হাত কামড়ে চলে এসেছি।”
হাপাতে হাপাতে বলে নীরা।তারপর আবার বলে ওঠে,”আপনি এখানে কেনো?”
“আমিও পালিয়েছিলাম।”
“মানে কি?”
“মানে বিয়ে যেহেতু তুমি করবে না তাই আমিও এখানে আসি।”
“ওহ আচ্ছা,তার মানে আমরা দুজনে বাসা থেকে পালিয়েছি।আগে যদি জানতাম আপনি পালাবেন তাহলে আমি আর পালাতাম না।”
“এখন কি করবে?”
“কি আর করব!কেয়া ফোন ধরলে ওর বাসায় থাকব।”
ওদের কথার ভিতর সেখানে হাজির হয় চারজন লোক।তারা এসে জিজ্ঞাসা করে,”তোমরা এখানে এই অসময়ে কি কর?”
নীরা ও দ্বীপ একে অপরকে চাওয়া চাওয়ি করে।লোকগুলো উত্তর না পেয়ে আবার বলে ওঠে,”দুজনেই তো বিয়ের সাজ।কি কি আছে তোমাদের কাছে?”
ভয় পেয়ে যায় নীরা।দ্বীপ কিছু বলতে যাবে তার আগে নীরা বলে,”আমরা তো চন্দ্রবিলাশ করতে এসেছি।”
“পাগল মনে হয় আমাদের!তোমাদের সাজসজ্জা দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় তোমরা বর বউ!সাথে আরো কিছু থাকতে পারে।”
“ওই তো বিয়ে করেই বর বউ হাঁটতে হাঁটতে এখানে এসেছি।আবার হাঁটতে হাঁটতে বাসায় যাবো।”
“তোমাদের কাছে কি কি আছে?”
ভয়তে এবার নীরা দ্বীপের পিছনে যায়।দ্বীপ ফিসফিস করে বলে,”আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম।তার আগে কেনো পাকনামি করতে গেলে?”
“আপনি তো এসব বিষয় অকর্মা।তাই ভেবেছিলাম আজকেও মুখে তালা মেরে বসে থাকবেন।”
লোকগুলোর ভিতর একজন বলে ওঠে,”ওই দেখো ফিসফিস করে প্ল্যান করছে।এই এদের এখনই ধরে নিয়ে চল।”
নীরা দ্বীপকে খোঁচাতে থাকে।বলে,”স্যার চলেন বাড়ি যাই। পালান এখান থেকে।বিয়ে হলে হবে কিন্তু এরা ধরে নিয়ে কোথায় গুম করে দিবে কে জানে!তাড়াতাড়ি চলেন পালাই।”বলে নীরা নিজেই দ্বীপের হাত ধরে দেয় দৌড়।ওদের পিছনে লোকগুলোও দৌড়াতে থাকে।
ওরা ওখান থেকে চলে যাওয়ার পর পিছনের গাছ থেকে বেরিয়ে আসে দুইজন মানব।তারা আর কেউ না কেয়া ও রিক।সাথে সাথে কেয়া মিসেস নাজনীনকে কল দিয়ে বলে,”আণ্টি,প্ল্যান সাকসেসফুল।ওরা এখন নকল গুন্ডাদের দৌড়ানি খেয়ে চলে যাচ্ছে কমিউনিটি সেন্টারে ।”
মিসেস নাজনীন হালকা হেসে ফোন কেটে দেয়।সাথে সাথে মিস্টার রবিনকে বলে,”কাজী ডাকো নীরার বাবা।ওরা বর বউ একসাথে গুন্ডাদের তারা খেয়ে এদিকে আসছে।”
বলতে না বলতে হাজির হয় নীরা ও দ্বীপ।ওদেরকে দেখে মিস্টার সমুদ্র বলে ওঠে,”কাজী বসে আছে বেয়াইন।আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।আমার বউমা নিজ দায়িত্বে নিয়ে এসেছে আমার ছেলেকে।এবার বিয়ে সম্পূর্ণ হবে।”
অগত্যা বর বউয়ের স্থানে বসতে হলো নীরা ও দ্বীপকে।কাজী এসে বিয়ে পড়ালেন তাদের।নীরা ও দ্বীপ একে অপরকে তিন কবুল বলে বিয়ের বন্ধনে জড়ালো।তারপর তারা রেজিস্ট্রি পেপারে সই করে।
বিয়ের কাজ শেষ হলে কেয়া ও রিক আসে সেখানে।কেয়া নীরার কাছে বসে বলে,”দোস্ত,মন খারাপ করিস না।জাস্ট চি…”
আর বলতে দিলো না নীরা।এবার নীরা নিজেই বলে,”এবার নিশ্চয়ই বলবি,দোস্ত কবুল বললেই তো আর বিয়ে হয় না!ভুলেও এখন এই পাপের কথা বলিস না।তিন কবুল বলে আমি ফেঁসে গেছি ক্যাডার সাহেবের বিদ্যা সাগরে।”
নীরার এই কথা শুনে হেসে দেয় বিয়ে বাড়ির সবাই।ঠিক সেই সময় উপস্থিত হয় ওই পাঁচ জন গুন্ডা।একজন যে নীরাকে একা পেয়ে হাত ধরে টান দিয়েছিলো। আর বাকিরা যারা নীরা ও দ্বীপকে একসাথে ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো।
কেয়া ওদেরকে দেখিয়ে বলে,”পাগল নাকি!আজ আর বলতাম না যে কবুল বললেই বিয়ে হয় না।আসলে এতদিন আমি যা কিছু করেছি আন্টির ইন্সট্রাকশন মেনে।কয়দিন আগে বাড়ির সামনে বখাটে নান্টুকে তুই টাকা দিয়ে রেখেছিলি আর বলেছিলি যে আজ তুই পালাবি ওটা আণ্টি দেখে নেয়।তাই তো আণ্টি আমাকে সব সময় বলে দিতো তোকে কোথায় কখন কিভাবে রাখবো। আর ওই যে লোকটি তোকে স্টেশনে টিচ করে উনি হলো এই কমিউনিটি সেন্টারের দারোয়ান।আর এই যে চারজন তোদের তাড়া করেছে এনারা হলো বাবুর্চি।আণ্টি টাকা দিয়ে তোদের সাথে এই কাজ করেছে।”
নীরা একবার তাকায় কেয়ার দিকে আরেকবার তাকায় মিসেস নাজনীনের দিকে।মিসেস নাজনীন নীরার কাছে এসে বলে,”তুমি চল ডালে ডালে,আমি চলি পাতায় পাতায়।তোমারই তো মা আমি।কি করবে না করবে সব কিছুরই খোঁজ খবর রাখতে হয়।এজন্য তো আজ সারাদিন নজরে নজরে রেখেছি তোমাকে।”
মুখ ভোতা করে বসে আছে নীরা।এরা সব তার শত্রু।তাকে বানিয়ে দিলো বিদ্যা সাগরের বউ।তবে নীরা নিজেও কম না।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,”এই ক্যাডার সাহেবকে যদি আমি বিদ্যাসাগর থেকে না সরিয়েছি আমার নামও ‘মুনজেরিন নীরা’ না।”
কেয়া এবার খাবারের দিকে যায়।রাত অনেক হয়েছে।এখন খুদা লেগেছে তার।খাওয়ার জন্য টেবিলে বসতে যাবে রিক এসে বলে,”তো বেয়াইন সাপ প্ল্যান সাকসেসফুল হল।এবার কি আমরা বন্ধুত্ব করতে পারি?
“বন্ধুত্ব করাই যায়।খারাপ হবে না।”
“তাহলে বেয়াইন সাপের নাম্বার দেন মাঝে মাঝে খোঁজ খবর নিব।”
কেয়া দিলো নাম্বার রিককে।তারপর একসাথে খেতে বসে তারা।
বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ করে সবাই বাড়ি ফিরে।নীরাকে দীপান্বিতার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।ভালো করে সাজিয়ে দিয়ে তারপর দ্বীপের ঘরে আনা হয়।দ্বীপ এখনও আসেনি।নীরা ঘরটি ভালো করে দেখতে থাকে।তার প্রিয় হলুদ গোলাপ ও সাদা কাঠগোলাপ দিয়ে সাজানো খাট।নীরার কাছে সুন্দর লাগে।বিয়ের সবকিছুই নীরার কাছে সুন্দর লাগে।শুধু ওই বর ছাড়া।এমন থাপ্পড় থেরাপি দিতে থাকলে তাকে কি বর বানানো যায়?এমনিতে তার ক্যাডার সাহেব দেখতে মাশাল্লাহ।কোনো হিরোর থেকে কম না।ওই যে একটা গোমড়া মুখ আর কথায় কথায় থাপ্পড় থেরাপি এই জন্য অপছন্দ নীরার কাছে।দ্বীপ এসেছে রুমে।দ্বীপকে দেখার সাথে সাথে সবাই রুম ত্যাগ করে।
সবাই চলে যাওয়ার পর দ্বীপ দরজা লাগিয়ে দেয়।নীরা শুকনো ঢোক গিলতে থাকে।কিন্তু দ্বীপ নীরাকে পাত্তা না দিয়ে আয়নার সামনে যেয়ে হাত থেকে ঘড়ি খুলতে থাকে।চোখের চশমা হালকা ঝুঁকে নাকের দিকে আসে।নীরা তাকিয়ে থাকে দ্বীপের চেহারার দিকে।এই লোকটি এখন তার বর।ভাবতেই গায়ে হালকা শিহরণ দিয়ে গেলো নীরার।
দ্বীপ এসে বিছানায় শুতে যাবে ওমনি নীরা বলে ওঠে,”আপনি এই খাটে ঘুমাবেন?”
“এছাড়া কোথায় ঘুমাবো?”
“আপনি খাটে ঘুমালে আমি কোথায় ঘুমাবো?”
“আমি কি জানি? বনে জঙ্গলে সমুদ্রে যেখানে মন চায় ঘুমাও।আমি এখন ক্লান্ত ঘুমের দরকার আমার।”
বলে দ্বীপ শুতে যাবে নীরা আবার বলে ওঠে,”না আপনি বিছানায় ঘুমাবেন না।আগে আমার তিনটি শর্ত আছে।এগুলো শুনবেন তারপর আপনি ঘুমাতে পারবেন।”
“এই রাতে আবার কিসের শর্ত।প্রচুর ক্লান্ত আমি ঘুমাতে হবে।”
“ইহ আসছে আমার ঘুম পাগলা।কি মনে করেন আপনি?আপনার একার ঘুম আছে আমার ঘুম নাই।আমারও ঘুম আছে।কিন্তু এখন যদি এই কথাগুলো না বলি তাহলে আর বলতে পারব না বললেও শুনবেন না আপনি এটা আমি ভালো করেই জানি।তাই ভালোয় ভালোয় কথাগুলো শুনুন।না শুনলে এখন আমি দিবো এক চিৎকার।আমার চিৎকার শুনে কেউ না আসলেও তাদের মাইন্ড কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছেন!সবাই বলবে ওই দেখো বই পাগলা ক্যাডার সাহেব এক রাত হতে পারলো না বউ পাগলা হয়ে গেছে।”
“কি শর্ত বল?”
“আমার শর্ত তিনটি হলো,
১.আপনি বিছানার ওই কোনায় থাকবেন আর আমি এই কোনায়।আমার ধারেকাছেও আসবেন না।
২.আমাকে মাসে মাসে প্রচুর কসমেটিকস ও ড্রেস কিনে দিতে হবে।আফটার অল আমি আপনার একমাত্র বউ(ভাব নিয়ে)।
৩.ক্লাসে আমি পড়া না পারলে,বই না নিলে,বেশি বেশি গল্প করলে আমাকে বকাঝকা করতে পারবেন না।
বলুন রাজি?”
“মামার বাড়ির আবদার পেয়েছো!প্রথম শর্ত মানা যায় যদি দ্বিতীয় শর্তের কথা না বলতে।বউয়ের কাছে যেতে পারবো না আবার বউকে কি না মাসে মাসে আমার কসমেটিকস আর ড্রেস কিনে দিতে হবে।আবার ক্লাসে পড়া না পারলে কি না কিছু বলা যাবে না।”
“আমি স্কুলের ছাত্রী না যে আপনি আমাকে বকাঝকা করবেন,পানিশমেন্ট দিবেন? শর্তে রাজি না হলে বলুন আমি দিচ্ছি এক চিৎকার।”
বলেই যেই নীরা হা করে ওমনি দ্বীপ বলে ওঠে,”আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে রাজি আমি।সবগুলো শর্তে রাজি।”
“গুড ভেরি গুড।কিন্তু এই মুনজেরিন নীরা তো কারো মুখের কথা বিশ্বাস করে না।এক কাজ করুন নিজের হাতে এখানে তিনটি শর্ত লিখে নিচে লিখুন আমি এগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।”
মান সম্মানের কথা ভেবে দ্বীপকে খাতা কলম বের করে লিখে নিজের সই সহ দিতে হলো।
নীরাকে কাগজটি দিয়ে বলে,”এই জীবনে প্রথম বাসর হচ্ছে যেখানে বউ তার স্বামীকে দিয়ে সই করিয়ে নিলো।তাও আবার কি শর্ত?মাসে মাসে তাকে কসমেটিকস আর ড্রেস কিনিয়ে দেওয়া ও ক্লাসে পড়া না পারলে বকা যাবে না।”
“এটা আমাদের ডিজিট্যাল স্যার ও ছাত্রীর ডিজিট্যাল ওয়েতে বাসর।”বলেই মুখের বত্রিশ পাটি বের করে নীরা।
দ্বীপ কথা না বাড়িয়ে ঘুমিয়ে পরে। নীরাও তার মত করে খাটের ওপর প্রান্তে ঘুমায়।রাতের বেলা হঠাৎ করে দ্বীপ অনুভব করে তার মুখে কি যেনো সুড়সুড়ি দিতে থাকে।দ্বীপ ঘুমের ঘোরে মুখে হাত দিয়ে ছোট নরম তুলতুলে মুখ পেয়ে ভয়তে লাফ দিয়ে ওঠে।উঠে দেখে নরম তুলতুলে জিনিসটি আর কেউ না মিনি।রেগে মেগে দ্বীপ মিনিকে হাতে নিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে মারে।মিনি কান্না করতে থাকে।মিনির কান্নার শব্দ পেয়ে নীরার ঘুম ভেংগে যায়।উঠে দেখে দ্বীপ মিনিকে ছুড়ে ফেলেছে।রেগে গিয়ে নীরা বলে ওঠে,”আপনি আমার মিনিকে মারলেন কেনো?”
দ্বীপ নীরার দিকে তাকিয়ে বলে,”আসলে বাসর রাতে বিড়াল মারতে হয় তো।তাই আমি বাসরের বিড়াল মারতে না পারলেও আসল বিড়াল মারলাম।এবার হয়েছে শান্তি!”
নীরা কিছু না বলে মিনিকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে ঘুমিয়ে পরে। দ্বীপও নিজের মত করে ঘুমিয়ে যায়।
চলবে…?