#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৫
#ইশরাত_জাহান
🦋
আজ নীরা ও দ্বীপের মেহেদী অনুষ্ঠান।সবাই আজ নীরাদের বাসায় এসেছে।নীরার দুই হাতে পার্লারের মেয়েরা মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে।নীরা দুইপাশে হাত পেতে বসে আসে।সামনে সবাই নাচগান করতে থাকে।
নীরার খুব ভালো লাগে এই পরিবেশটা।নীরা কেয়াকে বলে ওঠে,”নিজেকে আজ সম্রাট শাহজাহানের বেগম মমতাজ মনে হচ্ছে। আহ দুই পাশ থেকে দুজন আমার হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে,সামনে কিছু মানুষ নাচগান করে ইনজয় করছে আর কিছুক্ষণ পর পর তুই এসে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছিস।”
“তোর শাহজাহান কিন্তু আমাদের এই আদনান কবির দ্বীপ স্যার।”
নীরা কিছু বলতে যাবে তার আগে রিক আসে।রিক সবাইকে বলে ওঠে,”এখানে অনেক মানুষ আছে।আমরা সব একই এলাকার।সেই কারণে আমরা একটু কনফিউজড আছি যে কে বরপক্ষ আর কে কন্যাপক্ষ।তাই আমরা নিজেরা সিলেক্ট করলে ভালো হয় কে কোন পক্ষ।”
সাথে সাথে কেয়া বলে,”যেহেতু আমি নীরার বেস্ট ফ্রেন্ড তাই আমি কন্যাপক্ষ”
কেয়ার উত্তরে রিক হালকা হেসে বলে,”তাহলে আমি বরপক্ষ।”
“ওকে,তাহলে আপনি আমাদের অপজিটে। কন্যাপক্ষরা সব একদিকে হও আর বরপক্ষরা আরেকদিকে।”
“যো হুকুম বেয়াইন সাপ।”বলেই পক্ষ ভাগাভাগি করা হয়।
সবাই মিলে একসাথে এবার নাচগান করতে থাকে।নীরার মেহেদী দেওয়া শেষ।পার্লারের মেয়েটা জিজ্ঞাসা করে,”বরের নাম কি দিবো?”
নীরা কিছু বলে না।কেয়া বলে ওঠে,”বরের পুরো নাম আদনান কবির দ্বীপ।আপনি দ্বীপ লিখে দেন।”
নীরা চোখ বড় বড় করে তাকায় কেয়ার দিকে।কেয়া শুকনো ঢোক গিলে বলে,”দোস্ত মেহেদী তো উঠে যাবে কয়েকদিন পর।এক সপ্তাহের ব্যাপার তো।একবার একটু আন্টির দিকে তাকা।এখন যদি তুই নাম লিখতে বাধা দিস আমি শিওর আন্টির হাতে মিষ্টির পাত্র আর থাকবে না।ওই মিষ্টির পাত্রের জায়গায় আসবে বিছানা ঝারার ঝাড়ু। আর তুই শাহজাহানের ওই তাজমহল না পেয়ে জায়গা পাবি ফুটপাত।তাছাড়া মেহেদী দিলেই তো আর বিয়ে হয় না।”
নীরা তাকালো মিসেস নাজনীনের দিকে।মিসেস নাজনীন এদিক ওদিক সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করছেন আর নীরার দিকে বারবার তাকাচ্ছেন।ভয়তে নীরা আর কিছু বলে না।নীরা না পেরে তার বাবার দিকে তাকায়।মিস্টার রবিন চোখের চশমা ঠিক করে অন্য দিকে ফিরে।এই দেখে নীরা বলে ওঠে,”বউ পাগলা বাপ আমার।”
কথাটা কেউ না শুনলেও কেয়া শুনে ফেলে।কারণ কেয়া নীরার ডান পাশে গা ঘেসে বসে ছিলো।বাবার নামে এমন বাক্য শুনে হেসে দেয় কেয়া।কেয়া জানে মিস্টার রবিন বউ বলতে কতটা পাগল আবার ভয়ও পায় বউকে।
কেয়ার হাসির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রিক।কেয়াকে হাত ইশারা করে দেখিয়ে বলে,”কিলার হাসি।”
কেয়া লজ্জা পায় একটু।রিকের থেকে মুখ সরিয়ে নীরার দিকে তাকায়।
রাতে নীরা তার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে।এই হাতে এখন ইংরেজিতে লেখা আছে ‘Deep’
সকালে~~~~~~
সবার চিল্লাচিল্লির শব্দে ঘুম ভেংগে যায় নীরার।বিয়ে বাড়িতে কি আর ঘুম হয়?ঘুম থেকে উঠে একটা হামি তোলে নীরা।পাশে থাকা মিনিকে কোলে নিয়ে বলে,”জার বিয়ে তার খোঁজ নেই পারা পড়শীর ঘুম নেই।”
ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে গেলো নীরা।নীরা দেখলো নীরার মা সোফায় বসে শাড়ির অচল দিয়ে চোখ মুছছেন।পাশে বসা রিকের মা শান্তনা দিচ্ছেন,”আহা এভাবে করলে কি আর মেয়ে বিদায় দেওয়া যায়?মেয়েকে তো এক সময় বিয়ে দিতেই হবে।তুমি নিজেকে শক্ত রাখো।নীরব নেই তো কি হয়েছে?আমার রিক তো আছে।ও পালন করবে নীরার ভাইয়ের জায়গা।”
নীরা বুঝলো তার বিয়ে দেওয়ার জন্য যেমন লেগে আছে ঠিক তেমন কষ্টও পাচ্ছে মিসেস নাজনীন।
গায়ে হলুদের স্টেজ সাজানো হয়েছে।দুপুরে সবাই বিভিন্ন শ্রী সাজাতে ব্যাস্ত।রিক ও কেয়া মিলে ফুল দিয়ে স্টেজের কাজ করছে।দীপান্বিতা শ্রী সাজাতে থাকে।দ্বীপের মা মিসেস সাবিনা আলপনা আঁকাতে পারেন অনেক সুন্দর।তাই যেখানে দ্বীপ ও নীরাকে হলুদের জন্য বসানো হবে তার সামনে নিজ দায়িত্বে তিনি আলপনা আঁকেন।
সন্ধায় হলুদের আয়োজন শুরু করা হয়।দ্বীপ ও নীরাকে বসানোর একটি স্টেজ করা হয়। আর তাদের সামনে নাচ গান করার একটি স্টেজ করা হয়।নীরাকে হলুদের শাড়ি ও ফুলের গহনা পড়ানো হয়।নীরার প্রিয় হলুদ গোলাপের সাথে রজনীগন্ধার মিশ্রণ করে মালা,টিকলি,কানের দুল ও ভিন্ন গহনা যেগুলো কেয়া ও রিক মিলে বানায় সেগুলো পড়ানো হয় নীরাকে।বিয়েতে রাজি না হলেও নীরার এই সাজ যেনো ভালো লাগে।নীরা নাচতে নাচতে বিয়ে করত।যদি এই বিয়ের পাত্র আদনান কবির দ্বীপ না থেকে অন্য কেউ থাকত।কিন্তু এই ক্যাডার সাহেব যে বিয়ের পর রোমান্স না করে পড়াশোনা নিয়ে জ্ঞান দিতে থাকবে।এগুলো ভাবলেই বিয়ে করার স্বাদ মিটে যায় নীরার।
স্টেজে বসানো হয়েছে নীরাকে।পাশে দ্বীপকে নিয়ে আসে দীপান্বিতা।দ্বীপের পরনে হলুদ পাঞ্জাবী ও কালো জিন্স। হাতা ফোল্ড করা চোখে চশমা চুলগুলোতে জেল দিয়ে স্পাইক করা।নীরা আড় চোখে তাকিয়ে যেনো ক্রাস খায়।ভালোভাবে যখন দ্বীপের দিকে তাকালো দেখতে পেলো দ্বীপ মুড নিয়ে বসে আছে। আর তাকালো না নীরা এই গোমড়ামুখর দিকে।বিয়ে করতে এসে কি না মুড দেখাচ্ছে।
হলুদে সবাই এসে নীরা ও দ্বীপের মুখে মিষ্টি দিয়ে যাচ্ছে।যেই আসছে সেই খালি মিষ্টি,পায়েস আর কেক খাইয়ে দিতে থাকে।টানা এক ঘন্টা এমন চলার পর না পেরে নীরা বলে ওঠে,”আরে আণ্টি,আমাকে কি আপনার খাদক মনে হয়!সেই ধরে খালি মিষ্টি আইটেমগুলো খেয়েই যাচ্ছি।আমি এমনিতেই মিষ্টি মেয়ে।আমার আশেপাশে একজন তেতো লোক আছে তাকে ভরে ভরে মিষ্টি খাওয়ান।যদি একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করে।”
সবাই হেসে দেয় নীরার কথায়।দ্বীপ গলা খাকারি দিয়ে ওঠে।দীপান্বিতার কানে কানে মিসেস সাবিনা বলে,”তোর ভাইয়ের জন্য এই মেয়েই উপযুক্ত।সারাজীবন আমাদেরকে মুড দেখিয়ে চলতে দেখেছি।এখন থেকে দেখবো কিভাবে মুড থাকে ওর।”
পাশে দাঁড়ানো মিসেস নাজনীন শুনে ফেলেন কথাগুলো।সেও খুশি হয়।তার মেয়েকে উপযুক্ত একটি পরিবারে বিয়ে দিতে পারছে বলে।
কেয়া এসে নীরা ও দ্বীপকে হালকা হলুদ ছোঁয়ালো।তারপর হাটা দেয় স্টেজের দিকে নাচ করবে তাই।ঠিক তখনই চারপাশ থেকে লাইট বন্ধ হয়ে যায়।কেয়ার পিছন থেকে হঠাৎ বেজে ওঠে,
“এই যে বিয়ান সাপ।”
শুনতে পেয়ে কেয়া তাকায় পিছনে।দেখতে পায় রিক এসেছে ডিজের লোকজন নিয়ে।লাল আর হলুদের মিশ্রণে পাঞ্জাবি পরা রিক।কেয়া পরেছে হলুদ ও লালের মিশ্রণে একটি শাড়ি।
রিক এসে কেয়ার হাত ধরে স্টেজে নিয়ে যায়।তারপর তারা নাচতে শুরু করে।’বেয়ান সাপ আপনার জন্য ঢাকা থেকে ডিজে আনছি’ গানে।
নীরা এদের নাচ দেখে খুশিতে হাত তালি দিতে থাকে।কিসের ক্যাডার সাহেব!সে তো ভুলেই গেছে কার সাথে তার বিয়ে হচ্ছে।হলুদের সাজ গা থেকে কাচা ফুলের গন্ধ আবার সামনে প্রিয় মানুষগুলোর নাচ এগুলো দেখে সেও যেনো নাচতে শুরু করে।কেয়া ও রিক এসে নীরাকে স্টেজে নিয়ে যায়।বিয়ের বউ নিজে নাচতে থাকে।সবাই যেনো এতে আরও খুশি হয়।অভ্র এসে নীরার সাথে তাল মেলাতে থাকে।
নাচ শেষ করে কিছু মানুষ গান গাইতে থাকে।সবার গান শেষে নীরা বলে,”আমিও গান গাইতে চাই।”
নীরার যে ভাঙা গলার স্বর!এটা ভেবেই মিসেস নাজনীনের মাথায় হাত।দীপান্বিতা নীরার হাতে মাইক দেয়।নীরা গাইতে থাকে,
আমার মায়ের কথা শুইনা,
অল্প বয়সে করমু বিয়া।(২)
ক্যাডার সাহেব হবে আমার ছাইয়া,
থাপ্পড় খাইতে থাকমু আমি গাল ভইরা।(২)
কেউতো বুঝে না আমার জ্বালা,
আ আ আ..
আর গাইতে পারলো না নীরা।মিসেস নাজনীন মাইক নিয়ে নিলেন।সবাই মিটমিট হাসতে থাকে।নীরা যে ঘাড় তেরা এটা প্রতিবেশী সবাই জানে।মিস্টার রবিন খুকখুক কাশতে থাকেন।মিস্টার সমুদ্র গান হজম করতে না পেরে জায়গা ছেড়ে পালিয়ে যায়।মিসেস সাবিনা ও দীপান্বিতা দ্বীপের দিকে তাকিয়ে মিটমিট হাসতে থাকে।তার ছেলেকে উচিত শিক্ষা দিয়েছে এই মেয়ে।
অভ্র সে তো এতক্ষণ নীরার ভাঙ্গা রেডিওর সাথে তাল মিলিয়ে নাচতে থাকে।গান বন্ধ হওয়ায় বিরক্ত হয় অভ্র।তাই বলে,”কি হলো মামী?”
“তোমার নানু মাইক নিয়ে নিয়েছে।”মুখ গোমড়া করে বলে নীরা।
রাত দশটা বাজতেই অনুষ্ঠান শেষ করে সবাই বাসায় যায়।ক্লান্ত হয়ে নীরা ঘুমিয়ে পরে।
বিয়ের দিন~~~~~~
বিকাল বেলা নীরাকে বউ সাজাচ্ছে পার্লারের লোকজন।কেয়া পাশে বসে আছে।নীরা এবার রেগে আছে কেয়ার উপর।কোনো আইডিয়া তো দিলো না উল্টো নিজে সাজতে থাকে।
পার্লারের মেয়েটা চলে গেলে নীরা বলে ওঠে,”একটু পর আমার বিয়ে।এই বিয়ে ভাঙার কি কোনো ব্যাবস্থা আছে? কাল এতো পাগলামি করলাম কিন্তু কেউ বিয়ে ভাঙলো না।আমি আর কত চেষ্টা করব?”
নেইল পলিশ পরতে পরতে কেয়া বলে,”আরে ইয়ার চিল কর।দরকার হয় পালিয়ে যাবি।বউ সাজলেই তো আর বিয়ে হয় না।”
“পালিয়ে কোথায় যাবো আমি?”
“আপাতত স্টেশনের কোথাও যেয়ে লুকিয়ে থাক।সন্ধার দিকে কল দিবি আমি যেয়ে চুপটি করে আমাদের বাসায় নিয়ে আসবো।”
“কাজ করবে আইডিয়া?”
“খুব ভালোভাবে।”
বিয়ের সময় হয়ে গেছে।কাজী এসে বসে আছে।কিন্তু বউ নেই সেই জায়গায়।সবাই বলাবলি করতে থাকে,”বউ পালিয়েছে বউ পালিয়েছে।
প্রিয় ক্যাডার সাহেব/অপ্রিয় আদনান কবির দ্বীপ স্যার,
আপনাকে বিয়ে করবো না বলে অনেক প্ল্যান করেছি।আমি জানি আপনিও আমাকে বিয়ে করতে রাজি না।আপনার গোমড়া মুখ দেখলেই বোঝা যায়।আপনি তো কোনো কাজের না।খালি পারেন বিদ্যা সাগর হতে।ক্ষমতা থাকলে আপনার বইগুলোর সাথে আপনার বিয়ে দিতাম।ভেবে দেখেন তো একসাথে কতগুলো বউ পেতেন!বইগুলো একেকটি হতো একে অপরের সতীন।আপনার বেনিফিট আছে এতে। মানুষ সতীন হলে চুল ছেরাছেরি করে কিন্তু বই সতীন হলে আপনাকে সবাই একসাথে বিদ্যা দিবে।আইডিয়াটা কিন্তু ভালো আছে।পারলে এখনই বিয়ে করুন আপনার বইগুলোকে,আমি পালাই।
ইতি
আপনার অপ্রিয় ছাত্রী প্লাস না হওয়া বউ,
ডাব্বা খাওয়া নীরা
এতবড় চিঠি আকারে এসএমএস পড়ে স্মিত হাসলো দ্বীপ।মনে মনে নীরাকে বলে ওঠে,” পাগলী।”
ঠিক তখনই পিছন থেকে কেউ তাকে ধাক্কা দেয়।
চলবে…?