#লাজুকপাতা
#পর্ব-১২
মনির জেদ কে হার মানতে হলো থানা পুলিশের কাছেও। সে কিছুতেই থাকবে না। উল্টো মায়ের নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ করলো। মারের চিহ্ন গুলোও দেখালো। শেষ অবধি পুলিশও হার মানলো। মনির বয়স জন্ম নিবন্ধন পত্রে উনিশ বছর। সেই হিসেবে এখন আর ও নাবালিকা নয়। বাবা, মা চাইলেই ঘরে আটকে রেখে মারতে পারে না।
পুলিশ চলে যাবার পর মামা এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন। স্ট্যাম্পে মনির সই নিলেন। সেই সঙ্গে শিল্পী আক্তার লাভলী আর তার চাচীরও স্বাক্ষর নেয়া হলো। ভবিষ্যতে কোনো ঝামেলা হলে তারজন্য এই পরিবারের কেউ দায়ী থাকবে না।
আম্মা হাপুস নয়নে কাঁদলেন। আশ্চর্য ব্যাপার হলো তার মেয়ে এই কদিনের প্রেম ভালোবাসায় এতটাই আচ্ছন্ন যে মায়ের চোখের জলে কিছু যায় আসেই না যেন। মনি ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো। নিজের যা ছিলো সব নিয়ে গেল। মা, বাবার কাকুতি মিনতিতে কোনো কাজ হলো না। নাবিদ একবার কঠিন গলায় বলল,
“আরও একবার ভেবে দেখ, এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে আর কিন্তু ফিরতে পারবি না। ”
মনি মুখ ঝামটা দিয়ে বলল,
“হুহ! না ফিরতে পারলে মইরা যাব না। ”
আম্মার কান্না দেখে শিল্পী আক্তার এলেন সান্তনা দিতে। আম্মা তাকে একটা ধাক্কা মারলেন। রুক্ষ গলায় বললেন,
“দূরে সর নটি বেটি। ”
তাতে অবশ্য শিল্পী আক্তার লাভলীর কোনো ভাবান্তর হলো না। সে বেহায়ার মতো বলল,
“খালাম্মা গো, একদিন এই বেটিরে আপনে বুকে জড়ায়ে কানবেন। আজকে তো আপনের মাথার ঠিক নাই। ”
মনি চলে গেল। কী ভেবে যেন আমাকে বলে গেল,
“ভাবী যাই, দোয়ায় রাইখেন। ”
আমি বিস্মিত হবার সুযোগ পেলাম না। এতসব কান্ড ঘটে গেল! নতুন করে বিস্ময়ের কিছু নেইও আসলে।
***
বাড়ির পরিবেশ থমথমে রইলো দুদিন। অবশ্য বাইরের পরিবেশ এখনো গরম। নিচতলার ভাবী আমাদের দেখলেই একগাল হেসে জিজ্ঞেস করেন,
“মনির কোনো খবর আছে? কি করে ওইখানে যেয়ে। ”
আমরা বড় লজ্জায় পড়ে যাই। ওনার মুখ মামীর মতো উজ্জ্বল ঠেকে। জানিনা, মনির সঙ্গে কিংবা আমাদের সঙ্গে তার কী শত্রুতা। মুক্তার কাছে শুনলাম ওনারা এখানে আট বছর ধরে থাকেন।
সবকিছু নিয়মমাফিক চলে। জামিল ভাই কাজে যান, নাবিদ অফিসে। মুক্তা কলেজে যায়। বাবা টাপুর টুপুর কে স্কুল থেকে নিয়ে এসে ওদের সঙ্গে কার্টুন দেখে। আম্মা আগের চেয়ে আরও বেশি কপাল কুঁচকে থাকেন।
সব আগের নিয়মে চলে।
***
আমার দিনগুলো কাটে বিষন্নতায়। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে। সামনে রিনি, সিয়ামের পরীক্ষা। এই সময় বাড়িও যাওয়া যায় না। পরী আপা কিভাবে যেন আমার অস্থিরতা টের পেয়ে যায়। নাবিদ কে ফোন করে ওদের কাছে যেতে বলে। নাবিদ শুক্রবারের অপেক্ষায় থাকে। আমি একটু শান্তি পাই। আপার কাছে গিয়ে একটু স্বস্তি পাওয়া যাবে।
শুক্রবার আসার আগে আমি নাবিদ কে বলি,
“একটা অনুরোধ করব তোমাকে?”
নাবিদ চমকে ওঠে। বলে,
“এরকম করে বলছ কেন জরী? ”
আমি হেসে বলি,
“আমি যদি দুটো দিন আপার ওখানে থাকি তাহলে কী তুমি রাগ করবে?”
নাবিদও হাসে। বলে,
“এই ব্যাপারও তোমার এমন করে আমাকে বলতে হলো জরী!”
“তুমি তাহলে রাগ করবে না ”
“দুই দিনের বেশী থেকো না প্লিজ। ”
আমি নাবিদের দিকে তাকাই। ও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবি, সংসারে জটিলতা যাই থাকুক, এই মানুষ টা ঠিক থাকলে জীবনে আর কিছুর দরকার নেই আমার।
***
শুক্রবার সকালে নাবিদ আর আমার সঙ্গে টাপুর টুপুরও সেজেগুজে তৈরী হয়ে গেল। ওরাও বেড়াতে যাবে। জামিল ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ওদের নিয়ে গেলে সমস্যা নেই তো?
জামিল ভাই বললেন, কী বলো জরী! ওরা তোমার সঙ্গে যাবে তাতে আবার সমস্যা কিসের!
পরী আপা থাকেন মুন্সীগঞ্জে। বাস থেকে নামার পর রিকশা করে যেতে মিনিট দশেকের মতো লাগে। আপার দুই রুমের ছোট্ট বাসা। দুলাভাই ভালো মানুষ। আপার অবশ্য শ্বশুর বাড়ির ঝামেলা তেমন নেই। শ্বশুর শাশুড়ী কেউ বেঁচে নেই। দুলাভাই ভাই বোনেদের মধ্যে সবার ছোট। সবাই যে যার নিজেদের মতো থাকে। আপার নির্ভেজাল সংসার। টাকা, পয়সা কম হলেও শান্তিটুকু নিখাত।
আমাদের জন্য দুলাভাই অনেক বাজার করলেন। আপাও জমিয়ে রান্না করলেন। গরু, খাসি, রুই, পাবদা, ইলিশ, চিংড়ি সব আছে। নাবিদ খুব বেশী খেতে পারলো না। আপা খুব আফসোস করলেন। দুলাভাই এর সঙ্গে নাবিদের গল্পও হলো খুব। নাবিদ তো স্বভাবসুলভ চুপচাপ শুনলো। দুলাভাই ই নিজের মতো গল্প করলো।
নাবিদ যাবার সময় টাপুর টুপুর কে নিতে চাইলেও ওরা যেতে চাইলো না। নোটনের সঙ্গে ওদের ভাব হয়ে গেছে। নোটনও লক্ষি বাচ্চার মতো ওদের সঙ্গে খেলনা শেয়ার করছে।
আপাও টাপুর টুপুর কে রাখতে চাইলে নাবিদ আর না করলো না। যাবার সময় ও আপাকে বলে গেল, আমাকে যেন গাড়িতে উঠিয়ে দেয়। আমার মনে হলো নাবিদের একটু মন খারাপ হচ্ছে, আমারও একটু মন খারাপ হলো।
***
দুলাভাই বাড়িতে নেই। অফিসের কাজে শ্রীমঙ্গল গেছেন। আমার বেড়ানোটা আরও ভালো হলো। আপা আমার পছন্দের সব রান্না করেন। সকালে ঘুম থেকে ওঠার তাড়া নেই। ঘুম ভাঙে দেরি করে। ঘুম থেকে উঠতেই গরম গরম রুটি কিংবা চিতই পিঠা সামনে পাওয়া যায়। দুপুরে আপার রান্নার সময় আমি বসে বসে তেঁতুল মাখা খাই। সন্ধ্যে হলেই গরম চায়ে চালভাজা ভিজিয়ে খেতে খেতে ভাবি কী ভালো ভাগ্য আমার! এমন একটা বড় বোন আমার জীবনে আছে।
দুদিনের জায়গায় চারদিন থাকা হলো। আপা আরও রাখতে চাইলেন। নাবিদের ফোনকলে অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন বলে পারলেন না।
ফেরার দিন আমি আপাকে একটা শাড়ি দিলাম। আপা শাড়িটা হাতে নিয়ে বললেন,
“তুই কিনছিস? আমার জন্য? ”
শাড়ি খুলে দেখে আপা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। বললেন,
“এই জরী তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এতো দামী শাড়ি আনলি ক্যান? ”
আমি হাসলাম। আপা শাড়ি হাতে নিয়ে বসে রইলেন। আমি জানি এই শাড়িটা আপার আলমারিতে থাকা শাড়িগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দামী শাড়ি। আমার উপার্জন আর জমানো টাকায় কেনা। এই শাড়িটা কেনার জন্য আমি আর কারোর জন্য কিছু কিনিনি।
আপা আবারও বললেন,
“এতগুলা টাকা খরচ করলি ক্যান? এই শাড়ি দোকানে ফেরত দিলে নিবে?”
আমি হাসি। আপা আবারও কপট রাগ দেখায়। সারা রাস্তা এই শাড়ির গল্প চলতে থাকে।
গাড়িতে উঠে আপাকে হাত নেড়ে বিদায় জানাই। আপা হাত নাড়েন, তার চোখভর্তি পানি। টাপুর টুপুর কে আরও কদিন না রাখতে পেরে অভিমানে নোটন ভেউভেউ করে কাঁদছে।
আমি আমার পরী আপাকে দেখি তখনও। আমার ফর্সা মায়ের দুধ সাদা এক মেয়ের জন্মের পর দাদীজান নাম রাখলেন পরী। এমন সুন্দর পরীর মতো মেয়ে সে দেখেন নি। সেই পরীর মতো সুন্দর মেয়েটার ছয় বছর বয়সে কী এক রোগ হলো। ডাক্তার, কবিরাজ কেউই রোগ ধরতে পারে না। চামড়া পঁচে যাচ্ছে। শহুরে ডাক্তার রা অনেক দিন ধরে চিকিৎসা করে। মা যখন তার সেই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরে তখন সবাই হা হুতাশ করে। আহারে! এমন সুন্দর মেয়ের কী অবস্থা!
ব্যাহ্যিক সুন্দরের হিসাব করলে লোকে হয়তো আমাকে এগিয়ে রাখবে। কিন্তু সুন্দর মনের মানুষ, সেটা শুধু আমার পরী আপা’ই। আমি জীবনেও অমন হতে পারব না।
চলবে….