#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-১৩
নিখিলেশবাবু খবর পেয়ে অন্দরমহলে ছুটে এলেন। স্ত্রী’র স্বভাব তার বেশ জানা আছে। অনিকেতকে নীচু অথচ শীতল কণ্ঠে বলল,
-‘এই মেয়েটাকে নিয়ে তোর রুমে যা। বাড়িটা ফাঁকা হোক। তারপর এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করব আমরা। রেণুবালাও রাগে কাঁপতে কাঁপতে অনিকেতের পিছু পিছু ওদের ঘরে ঢুকে গেল। তার আসলে মাথা কাজ করছে না। কেমন পাগল পাগল লাগছে। একবার মনে হচ্ছে অনিকেতকে ইচ্ছেমতো পিটাতে তো আরকবার মনে হচ্ছে এই মেয়েটার চুলের মুঠি ধরে ঘুরাতে। অনিটার বয়স কম, পড়াশোনা শেষ হয়নি, ইনকাম করে না। মেয়েগুলোও যাতা অবস্থা। কী দেখে যে এই সব কম বয়সী বেকার ছেলেপুলের হাত ধরে ঘর ছাড়ে কে জানে! তবে রেণুবালা এই বিয়ে কিছুতেই মেনে নেবে না। রেণুবালা খাটে হেলান দিয়ে বসল। মেয়েটা ঘরের এক কোণে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদম পুতুল পুতুল টাইপ সুন্দর চেহারা। সাধারণত এত সুন্দর মানুষ সচরাচর এই গ্রামে দেখা যায় না। পশ্চিম আকাশের লাল রঙা সূর্যটা জানালার ফাঁক গলে মেয়েটার সারামুখে লুটিয়ে পড়েছে। সিঁদুর রাঙা সিঁথি দেখতে কী যে ভাল লাগছে। অনিকেত মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে তার সদ্য বিয়ে করা বউয়ের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হাত-পা একটু একটু কাঁপছে।
রাতে অনিকেতের ঘরে বিশাল বৈঠক বসল। নিখিলেশবাবু, অনিকেতের মুখোমুখি বসল। বলল,
-‘মেয়েটার নাম কী?
-‘পরী।
-‘কতদিনের চেনাজানা?
-‘দেড় বছর।
-‘কী এমন হয়েছিল। যে বলা নেই কওয়া নেই। তুই বিয়ে করে সরাসরি বাড়িতে এনে উঠালি?
-‘আজ রাতে পরীর বিয়ে ছিল। তাই আমি আর রিস্ক নেইনি।
রেণুবালা উত্তেজিত হয়ে ঠাস ঠাস করে অনিকেতের গালে দুটো থাপ্পড় মারল। চিৎকার করে বলল,
-‘অসভ্য, জানোয়ার, তোর বিয়ের বয়স হইছে? তুই তো নিজেই বাপ, ভাইয়ের টাকায় ফুটানি করে চলিস। তোর বউকে খাওয়াবি কী? আজকের পর থেকে তোর সমস্ত হাতখরচা দেওয়া বন্ধ। আমিও দেখব, এই লুতুপুতু বিয়ে বিয়ে নাটক কতদিন টিকে।
নিখিলেশবাবু বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘আহ্ রেণু আমি কথা বলছি তো?
-‘তুমি আর কী বলবা? ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে দুইটাকে বাড়িছাড়া করব আমি।
-‘চুপ…মহিলা।
নিখিলেশবাবু এত জোরে ধমক দিল। রেণুবালা কেঁপে উঠল। আঁচলে মুখ গুঁজে শব্দ করে কাঁদতে লাগল।
নিখিলেশবাবু, মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘তোমার বাবার জাতি ব্যবসা কী?
মেয়েটা মাথা নীচু করে সরল মনে বলল,
-‘মলমূত্র পরিষ্কার করা।
নিখিলেশবাবু চমকে উঠল। রেণুবালার মাথা ঘুরে উঠল। অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘তুমি মেথরের মেয়ে? ছিঃ ছিঃ অনি শেষে কী না তুই আমাদের বংশের মান ডুবালি? এত নীচু জাতের মেয়ে কেউ বিয়ে করে? আমার তো ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠছে। এই মেয়ে সরে দাঁড়াও। তোমার গা থেকে গু গু গন্ধ বের হচ্ছে। ওয়াক..ছিঃ
মেয়েটি এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার আর চুপ থাকতে পারল না। বলল,
-‘মাফ করবেন। আমরা নীচু জাত হতে পারি। তবে অমানুষ না। আপনি আমাকে দেখে এমন করছেন কেন? তাকিয়ে দেখুন আমার গায়ের রঙ আপনার থেকেও ফর্সা। আর আমার গা দিয়ে গু’র গন্ধ না বরং আপনার গা থেকে জর্দার বাজে গন্ধ আসছে!
রেণুবালা রেগে গেল। বলল,
-‘এই মেয়ে কী বললি তুই? দুইদিনের ছুড়ি। নাক টিপলে দুধ পরে। এই বয়সে না*ঙ ধরা শিখে গেছো।
অনিকেত ইশারায় পরীকে চুপ থাকতে বলল। এই ছটফটে মেয়েটা সে কথা শুনলে তো! দু’পা এগিয়ে গিয়ে রেণুবালার মুখোমুখি দাঁড়াল। বলল,
-‘বেশ তো আমার নাক টিপে দুধ বের করুণ আপনি? আমিও দেখি কত কেজি দুধ বের হয়।
রেণুবালার জ্ঞান হারানোর জোগাড় হয়েছে। অনিকেতকে বলল,
-‘এই নীচু জাতের মেয়েকে নিয়ে এক্ষুনি এই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবি তুই।
পরী বলল,
-‘কেন যাব আমরা? এটা যেমন আপনার স্বামীর ঘর। তেমন আমারও স্বামীর ঘর। আপনি যদি আমাকে বেশি জ্বালান তাহলে আমি থানায় গিয়ে বধূ নির্যাতনের মামলা ঠুকে দেব।
-‘এই মেয়ে তোমার বয়স কত? তোমার এত বড় সাহস তুমি আমাকে পুলিশের ভয় দেখাও?
-‘আমার বয়স চব্বিশ বছর। আপনার ছেলের থেকে গুনে গুনে দুই বছরের বড়।
রেণুবালা আবারও অনিকেতের গালে থাপ্পড় মারল। চেঁচিয়ে বলল,
-‘শেষে কী না তুই এই নীচু জাতের পাকনা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসলি?
অনিকেত পইপই করে পরীকে বারণ করেছে। ভুলেও তোমার বয়স বেশি এই বাড়ির কাউকে বলবে না। এই মাথামোটা মেয়েটা সে কথা কানেই নেয়নি।
নিখিলেশবাবু হতাশ বোধ করলেন। একে তো তার ছেলে পরের মেয়ে বের করে নিয়ে এসেছে। তার উপর মেয়েটার নীচু বংশ। কী যে লজ্জা লাগছে তার। তিনি যে এখন কী করবেন ভেবেই পেল না। অনুপম এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। বাবাকে চুপ থাকতে দেখে, নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘কী ভাবছ বাবা?
-‘এখন কী করব বড়খোকা? মাথা কাজ করছে না।
-‘অনিটা ছোট বাবা৷ একটা ভুল নাহয় করেই ফেলেছে। ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া ঠিক হবে না।
-‘তাহলে মেয়েটার কী হবে?
-‘ওর বাড়ির লোকজনকে খবর দেওয়া হোক। তারা আসুক। কথা বলে দেখা যাক। কী হয়!
পরীকে বিভিন্ন ভাবে ভয় দেখিকে পরীর বাবার নাম্বার নেওয়া হলো। অনুপম নিজের পরিচয় দিতেই লোকটা অনুপমকে একগাদা কটুকথা শুনিয়ে যা তা ভাষায় অপমান করে ফোন রেখে দিল। পরী নামের না কী তার কোন মেয়ে নেই। একটা মেয়ে ছিল আজ থেকে মৃত। অনুপম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবাকে সবটা জানাল। রেণুবালা আগেই জানিয়ে দিয়েছে অনিকেতের বউকে নিয়ে সে কিছুতেই খাবে না। বাবা, অনিকেতকে বলল,
-‘তোর বউকে নিয়ে সংসার করবি আমার কোন সমস্যা নেই। তুই এই বাড়িতেই থাকবি তবে আজ থেকে আমাদের হাঁড়ি আলাদা। পারলে রোজগার করতে শিখ। বিয়ে যখন একা একা করেছিস। বউয়ের চাহিদা, সংসার খরচ নিজের টাকায় করতে শিখ। আমার পক্ষে দুটো সংসার টানা সম্ভব না।
হঠাৎ অনিকেতের জ্যাঠা বলে উঠল।
-‘আজ থেকে অনিকেত বউকে নিয়ে আমাদের সাথে খাবে। আমরাও ওদের দুইজনকে নিয়ে আলাদা সংসার পাতব। এবং আমার যাবতীয় টাকাপয়সা আমি অনিকেতের নামে রেখে যাব। বুড়ো বয়সে আর যাযাবর হয়ে আমাদের বুড়ো, বুড়ির ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগছে না। আমরা এক জায়গায় থিতু হতে চাই।
-‘দাদা..?
-“হ্যাঁ নিখিলেশ তোর বউ অসুস্থ। আমাদের দুজনের জন্য বাড়তি রান্না করতে তারও কষ্ট হয়। এদিকে তোর বৌদি কোন কাজই করতে পারে না এখন আর। সবকিছু বিবেচনা করেই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অনিকেত পড়তেছে পড়ুক। আমি ওকে ঠিকই একটা না একটা সরকারি চাকুরী পাইয়ে দেব দেখিস। এখন থেকে ওদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার দায়িত্ব আমাদের।
অনিকেত হাফ ছেড়ে বাঁচল। এই কথার পর আর কারো কোন কথাই থাকে না।
এই তো সেদিন মাথা ভর্তি সিঁদুর পরে, আলতা রাঙা পায়ের ছাপ ফেলে, মাধু এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিল। আজ তাদের বিয়ের একযুগ বেড়িয়ে গেল। প্রাপ্তির খাতায় আরও একজন নতুন মুখ যোগ হয়েছে। হ্যাঁ মাধু অনুপমের আরও একটি ফুটফুটে মেয়েবাবু হয়েছে। মেয়েটার সবে মুখে বুলি ফুটেছে। গুটিগুটি পায়ে সারাবাড়ি হেঁটে বেড়ায়। আর ছেলেটার গেছে মাসে এগারো বছর পূর্ণ হলো। আজ অনুপম, মাধুর বারো বছরের ‘বিবাহবার্ষিকী’। সেই উপলক্ষে অনুপম বিশাল আয়োজন করেছে। অনুপমের অফিস কলিগরা ভরপেট খেয়েদেয়ে বিদায় নিতেই অনুপম মাধুকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরল। মাধু ছটফটিয়ে উঠল। অনুপম মাধুর গালে গাল ঘষে বলল,
-‘তোমাকে এখনো স্পর্শ করলে সেই প্রথম দিনের মতো অনুভূতি হয় মাধুসোনা।
মাধু, অনুপমের একটু একটু ভুঁড়ি উঁকি দেওয়া পেটে গুতো দিয়ে বলল,
-‘ইশ, বুড়োর ঢঙ দেখে বাঁচি না। ছাড়ো তো! বাচ্চাগুলো ঐ ঘরে কী করছে। দেখে আসি!
অনুপম আর একটু শক্ত করে মাধুকে চেপে ধরল। মাধুর গালে নাক ঘষে বলল,
-‘আজ রাত শুধু তোমার আমার। বাচ্চাগুলোকে তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়িয়ে দাও। তারপর শুধু তুমি আর আমি…
-‘উফ, ছাড়ো তো। এই বয়সেও এত প্রেম কোত্থেকে আসে তোমার?
অনুপম, মাধুর হাতটা নিজের বুকের মাঝে রেখে বলল,
-‘এখান থেকে মাধুসোনা।
মাধু, অনুপমের কাছ থেকে নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে লাজুক হেসে চলে গেল।
দিনগুলো যখন দুষ্টু, মিষ্টি ঝগড়া, খুনসুটি, মান-অভিমান, ভালোবাসায় কেটে যাচ্ছিল।
তখনই সেই ভয়াবহ খবরটা এলো। একটা ফোনকল, একটা চিরসত্য। একদম সবাইকেই ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল। এমনটা কী আদৌও হওয়ার কথা ছিল? হয়ত ছিল। হয়ত ছিল না।
(চলবে)