লজ্জাবতী পর্ব-১২

0
490

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-১২

মাধু, শাশুড়ীর চাউনি দেখে, কুণ্ঠিত বোধ করল। মুখে হাসি টেনে বলল,
-‘আন্টির কাছে আছে। আমি নিয়ে আসছি!
মাধু চলে যেতেই রেণুবালা, অনুপমকে বলল,
-‘এ কেমন কথা বড়খোকা? বলি, তোর বউয়ের বোধবুদ্ধি এখনো হলো না। ওতটুকু বাচ্চাকে কেউ আরেকবাড়ি দিয়ে রাখে? যদি বদনজর লেগে যায়?
-‘আরে কিছুই হবে না মা। আন্টি খুব ভাল মানুষ।
-‘ভাল হলেই ভাল।
রেণুবালা পুরো বাসা ঘুরে ঘুরে দেখল। এত জিনিসপত্র দেখে ভেতরে ভেতরে জ্বলে গেল। মাধু বাবুকে এনে মায়ের কোলে তুলে দিল। রেণুবালা কোলে নিয়ে নাতীর কপালে চুমু খেল। খুশিমনে বলল,
-‘একদম আমার বড়খোকার মতো দেখতে হয়েছে।
মাধুকে বলল,
-‘এত বাড়তি জিনিসপত্র কিনে, শুধু শুধু এত টাকা নষ্ট করেছ কেন বড়বৌমা? আমার ছেলের কষ্টের রোজকার। একটু হিসেব করে চলতে শিখো।
মাধু বুঝতেই পারল না। বাড়তি কী এমন জিনিস কেনা হয়েছে! তবে মুখে কিছু বলার সাহস পেল না৷ বলল,
-‘মা হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নিবেন, চলুন?
মাছের বড় মাথা, মুরগির রান রেণুবালার পাতে তুলে দিল মাধু। রেণুবালা খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছে। হঠাৎ অনুপমের, মাধুকে নিজের থালা থেকে তুলে জোর করে খাইয়ে দেওয়ার দৃশ্য দেখে, রেণুবালার মনটা তিক্ততায় ভরে গেল। দুজনের আদিখ্যেতা দেখে, রাগে শরীর চিড়বিড়িয়ে উঠল। খাওয়ার রুচি চলে গেল। শুকনো কণ্ঠে বলল,
-‘এভাবে খাইয়ে দিলে নিজের পেট ভরে না কী? তুই খেয়ে নে। বড়বৌমা পরে খাবেক্ষণ।
-‘একদম খেতে চায় না মা। তোমার বৌমার না খেতে খেতে দেখেছ, শরীরের অবস্থা কী করেছে? মাধু হা করো তো?
শাশুড়ীর সামনে এভাবে খেতে মাধুর খুব লজ্জা লাগছে। এই ঘাড়ত্যাড়া ছেলেটা সে কথা বুঝতে তো।
বিয়ের এত বছরেও অনুপমের বাবা এভাবে রেণুবালাকে সাথে নিয়ে খায়নি। নিজের অপ্রাপ্তি গুলো একে একে চোখের পাতায় ভেসে উঠতেই মনটা বিষণ্নতায় ভরে গেল।
অনুপম খেয়েদেয়ে সবার এঁটো থালাবাসন চট করে গুছিয়ে ফেলল। মাধু সোফায় বসে বাবুকে ব্রেস্টফিডিং করাচ্ছে। রেণুবালা ছিঃ ছিঃ করে উঠল। বলল,
-‘এসব কী বড়খোকা? আর কত অধঃপতন দেখব এই চোখে? ব্যাটাছেলে হয়ে তুই এগুলো করছিস কেন?
অনুপম থালাবাসন মাজতে মাজতে বলল,
-‘মা তুমি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। এগুলো তোমাকে দেখতে হবে না। বাবুর ঠাণ্ডা লাগবে। এই ভয়ে, আমি যতক্ষণ বাসায় থাকি। মাধুকে আমি জলের কোন কাজই করতে দেই না। মাধু এতটুকু ডিজার্ভ করে মা।
রেণুবালা, মাধুর পাশে গিয়ে বসল। চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘আমার ছেলেটাকে ভালোই বশ করেছ! এই দিনও দেখার বাকি ছিল আমার? তোমাকে বাচ্চা নিতে কে বলেছে? একটা বাচ্চা পালতে গিয়ে আমার ছেলেটাকে পুরো নাজেহাল করে ফেলেছো। আর আমরা চার-পাঁচটা বাচ্চা নিয়েও সংসারের সব কাজ নিজের হাতে করেছি। আমাদের সময় বাচ্চা নিয়ে, এত ঢঙ করার সময় ছিল না বাপু।

রাতে মাধু বাবুকে ঘুম পাড়িয়ে উঠে বসতেই। অনুপম একহাত দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিল মাধুকে। মাধুকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ ডুবিয়ে আবেশে দুচোখ বুজে ফেলল অনুপম। মাধু মলিন কণ্ঠে বলল,
-‘মা যতদিন থাকবে। তুমি আর একটাও কাজ করবা না। কষ্ট হলেও আমিই করে নেব কেমন?
অনুপম, মাধুকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে, গালে হাত রেখে বলল,
-‘কেন মা তোমাকে কিছু বলেছে?
-‘না। বলতে কতক্ষণ?
-‘বোকার মতো কথা বলো না মাধু্। মায়ের ভয়ে আমি তোমাকে হেল্প করব না? মা সেকেলে মানুষ। যাই বলুক, তার কথা ধরে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। তাছাড়া আমি অফিসে চলে গেলে সব কাজ একহাতে তো তোমাকেই করতে হয়।
মাধু, অনুপমের বুকে মাথা রেখে হু..হা করে গেল। আজ সারাদিনে খুব ধকল গেছে। ক্লান্তিতে পুরো শরীর ম্যাচম্যাচ করছে। ঘুমে দু’চোখ বুজে আসছে।

ছেলে অফিস চলে গেছে। অথচ বউয়ের এখনো ঘুম থেকে ওঠার নাম নেই। সে বাবুকে বুকের মাঝে নিয়ে কী আরামেই না ঘুমাচ্ছে। রেণুবালার সহ্য হলো না। মাধুর ঘরে এসে চিৎকার করে মাধুকে ডাকল। কাঁচা ঘুম ভাঙতেই মাধু ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। পুরো মাথা ফাঁকা। মাধু ঘুম ঘুম চোখে শাশুড়ির রক্তলাল চোখের পানে তাকাল। আঁৎকে উঠে বলল,
-‘কী হয়েছে মা?
-‘কী হয়নি তাই বলো? আমার ছেলেটাকে তো ঘোড়া বানিয়ে রেখেছ! বলি, তুমি কোন নবাবের বেডি গো? যে এত বেলা পর্যন্ত পরে পরে ঘুমাও? ছেলেটা বাঁশি মুখে সক্কাল সক্কাল বের হয়েছে।
-‘আসলে মা। ছেলেটা রাতে এত জ্বালায়। তারউপর একটু পর পর উঠে ব্রেস্টফিডিং করানো লাগে।
-‘আমাকে কোন অজুহাত দেখিও না বৌমা। ভুলে যেও না। আমরাও বাচ্চা পেলেপুষে বড় করে তবেই এই পর্যন্ত এসেছি। নাতীকে আমি দেখতেছি। অভি দাদুভাই আসো আমার কাছে। অভি কোল বাছে না। হাসিমুখে রেণুবালার কোলে গেল। মাধু সকালের বাঁশি কাজকর্ম সেরে শাশুড়ীকে কলা, রুটি, ডিমসেদ্ধ খেতে দিল। শাশুড়ী শুকনো মুখে খেতে খেতে বলল,
-‘তোমার এখানে তো সারাজীবন পরে থাকব না আমি। ডাক্তার দেখিয়েই চলে যাব। বলি, যে দুটোদিন আছি। আমার পাতে গরম গরম নুচি আর ডাল দিও বড়বৌমা। এসব সাহেবী খাবার আমার মুখে রোচে না গো।
মাধু, রেণুবালার তিক্তবাক্যে শুকনো ঢোকের সাথে হজম করে নিল। মানুষটা এক বিন্দুও পরিবর্তন হয়নি। অভিকে একটু কোলে নিয়েই কোমড় ব্যথার অজুহাতে মেঝেতে নামিয়ে দিল রেণুবালা। ছেলেটা আপনমনে হামাগুড়ি দিয়ে খেলছে। মাধু রান্নার ফাঁকে এসে দেখল। অভি মেঝেতে বসে আছে। মাধু বলল,
-‘মা ওকে দোলনায় শুইয়ে দিন। কেবলই ঠাণ্ডা, জ্বর থেকে উঠল ছেলেটা।
-‘আমাকে এত জ্ঞান দিতে এসো না বড়বৌমা। তোমার থেকে এই বিষয়ে আমার একটু হলেও অভিজ্ঞতা বেশি। এত পুতুপুতু করো দেখেই বাচ্চার অসুখ সাড়ে না।
বেশি বুঝদার মানুষের সাথে তর্ক করা বৃথা। মাধু আর কিছু না বলে, অভিকে কোলে তুলে নিল। তারপর দোলনায় শুইয়ে দিয়ে বাকি রান্নাটা সেরে ফেলল। রেণুবালা কড়া কন্ঠে বলল,
-‘দুপুরে বড়খোকা খেতে এলে আবার নির্লজ্জের মতো সাথে বসে যেও না। তোমাকেই তো সব খাবার খাইয়ে দেয়। হয়ত আমার ছেলেটার পেটই ভরে না।

অনুপম দুপুরে খেতে এসে। মাধুকে খাওয়া নিয়ে জোর করল। মাধু বিরক্ত হয়ে ওদের খাবার বেড়ে দিয়ে সরে গেল। একজন ভালোবাসা দেখাবে, আরেকজন কথা শোনাবে। মাধুর ঢের শিক্ষা হয়েছে। অনুপম খেয়েদেয়ে উঠে বলল,
-‘মা বিকালে রেডি থেকো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। সিরিয়াল দিয়ে এসেছি।আর মাধু তোমরাও রেডি থেকো আমরা মাকে ডাক্তার দেখিয়ে ঘুরতে যাব।

অনুপম মাকে ডাক্তার দেখিয়ে সিএনজি ভাড়া করে, চারজন মিলে শিশুপার্কে ঘুরতে গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুসকা, চটপটি, বাদাম, আইসক্রিম খেল। সারাটা রাস্তা অভি, অনুপমের কোলে চড়ে ঘুরে বেড়াল। ভুলেও মা বা মাধুর কাছে দিল না অনুপম। রেণুবালা মনে মনে বেজায় খুশি। মশলা দেওয়া পানের খিলি মুখে পুরে ছেলে, বউ, নাতীর সাথে মনের সুখে ঘুরে বেড়াল। দুই যুগেরও বেশি সময় খাঁচায় বন্দী জীবন কাটিয়ে দেওয়া মানুষটা।

রেণুবালা যাওয়ার দিন বলল,
-‘আমি ঠাকুরের কাছে মানথ করেছি। নাতীর মুখেভাতের অনুষ্ঠান বাড়িতেই করো কেমন?
-‘আচ্ছা।
-‘দিন তো চলে এলো বলে, কত মানুষকে নেমন্তন্ন করতে হবে। কত কাজ। বৌমা তুমি বরং আমার সাথে চলো?
অনুপম বলল,
-‘না মা। মাধুকে আমিই সাথে করে নিয়ে যাব। প্রয়োজনে বেশি করে ছুটি নিয়ে নেব।
-‘আমার কোমড়ের হাড়ে ক্ষয় ধরেছে। সে খেয়াল তো তোর নেই। এই বয়সে আমাদের সেবা যত্ন কে করবে? আর কতদিন বউকে নিজের কাছে রাখবি। আমরা আর বাঁচব কয়দিন। নাতী নিয়ে বড়বৌমা বাড়িতে থাকলে কী এমন ক্ষতি হবে?
-‘প্রয়োজনে আর একজন কাজের লোক রেখে দেব মা। তোমাকে আর কষ্ট করে রান্না করতে হবে না।
-‘তাও তুই বউকে রেখে আসবি না?
-‘না।
-‘আমাদের শখ করে না নাতীর সাথে সময় কাটাতে?
-‘বেশ তো তাহলে আর কিছুদিন থেকে যাও? দরকার হলে, আমি ছুটি পেলেই ওদের নিয়ে বাড়িতে বেড়াতে যাব।
-‘ভালোই বশ করেছে।
-‘মা…
-‘একদম চোখ রাঙাবি না বড়খোকা। আমাদের সংসারে কী ঝগড়া লাগত না। কত শাশুড়ীর হাতে মাইর খেয়েছি, কটুবাক্যে শুনেছি। কখনো কী আলাদা সংসার করার কথা স্বপ্নেও ভেবেছিলুম? আর এখন কী যুগ এলো। একটুকিছু হলেই তোরা কত সহজে আলাদা সংসার পেতে বসিস। শেষের কথাগুলো বলে রেণুবালা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনুপমেরও খারাপ লাগছে। তবে কিছুই করার নেই। বউ, বাচ্চা ছাড়া থাকা এখন অনুপমের ক্ষেত্রে অসম্ভব। ওরা বেড়াতে গেলেই তো অনুপমের একা বাসায় দম বন্ধ.. দম বন্ধ অনুভূতি হয়।

‘অভির’ মুখেভাতের অনুষ্ঠানে শ্যাওলা পরা, মরিচা ধরা দু’তলা পুরোনো বাড়িটা আবারও রব রব সাজে মেতে উঠেছে। মাধুর বাবার বাড়ির দিকের আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে অনুপমের মামা, মাসি, পিসি সবাই এসেছে। শুধু আসেনি রিধীকা। অনুপম নিজে গিয়েছিল বোনের বাড়ি নেমন্তন্ন করে বোনকে নিয়ে আসতে। কিন্তু জয়ন্ত কোন আগ্রহ দেখায়নি। ফলে অনুপম নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছে।
নিখিলেশবাবু সাদা, ধুতী, পাঞ্জাবি পরে নাতীকে কোলে নিয়ে প্রথম মুখে ভাত দিল। উলুধ্বনির আওয়াজে চারপাশ মুখরিত। উঠানে পুরো গ্রামের মানুষকে নেমন্তন্ন করে পাত পেড়ে খাওয়ানো হচ্ছে।
এর মাঝেই বাড়িতে বিশাল এক কাণ্ড ঘটল। একটি অল্পবয়সী মেয়ে, শুধু মাথা ভর্তি সিঁদুর পরে, অনিকেতের হাত ধরে বাড়িতে এসে উঠল। রেণুবালা বড় বড় চোখ করে বলল,
-‘মেয়েটা কে অনি?
অনিকেত মাথা নীচু করে বলল,
-‘আমরা বিয়ে করেছি মা।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে