লজ্জাবতী পর্ব-১১

0
501

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-১১

অনুপমের রুমমেট তৌহিদ আর দিপু কোচিং শেষ করে আপনমনে এ’গল্পে, সে’গল্পে বাসায় ফিরছিল। অনুপমদের নতুন ফ্ল্যাটের মেইন দরজার সামনে, মাধুকে ওইভাবে পরে থাকতে দেখে, ওরা এগিয়ে গেল।
মাধুকে নীচু কণ্ঠে বার কয়েক ডাকল।
-‘বৌদি..? কী হয়েছে? মাধুর কোন হেলদোল নেই। সাড়াশব্দ না পেয়ে ওরা ভয় পেল। তাড়াহুড়ো করে পকেট থেকে ফোন বের করে, অনুপমকে সংক্ষেপে মাধুর বর্তমান অবস্থা জানাল। অনুপম বেসামাল হয়ে গেল। অজানা ভয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। ফোন রেখে ছেলেদুটো ওভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারল না। পাশের ফ্ল্যাটের দুজন মহিলার সাহায্যে মাধুকে গাড়িতে তুলে, নিয়ে গেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। একজন মহিলা মাধুর হাত-পা ঘষে দিচ্ছে। আরেকজন চোখে, মুখে জলের ছিটা দিয়ে মাধুকে মৃদু কণ্ঠে ডাকছে। ধীরে ধীরে মাধুর জ্ঞান ফিরতেই আবারও পেটের চিড়বিড়ে ব্যথাটা ফিরে এলো। মাধু পেট চেপে ধরে শব্দ করে কেঁদে দিল। বাচ্চার মাথা দেখা যাচ্ছে। একবার উঁকি দিচ্ছে তো আরেকবার ডুবে যাচ্ছে। তীব্র ব্যথায় মাধুর সুন্দর মুখখানা শুকিয়ে লাল হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এ যাবৎ কাল পর্যন্ত ছোট, বড় যত ব্যথা পেয়েছে মাধু্। মাতৃত্বের ব্যথা সব ব্যথার উর্ধ্বে। মাধুর মনে হচ্ছে এরচেয়ে মরণ যন্ত্রণাও ঢের ভাল। হাসপাতালের ও.টি তে নিতে নিতে মাধুর বাচ্চা নরমালেই হয়ে গেল। বাচ্চার মাথা পুরোপুরি বেড়িয়ে গেছে। নার্সরা দিক দিশা না পেয়ে একটা রুমে নিয়ে নরমাল ডেলিভারি করে ফেলল। বাচ্চার কান্নার শব্দে চারপাশ মুখরিত। তারপরও নার্স বাচ্চার পিঠে আলতো হাতে থাপ্পড় দিল। বাবুটা তারস্বরে আরও বেশি শব্দ করে কেঁদে দিল। তারপর মাধুর বুকের উপরে বাবুকে শুইয়ে দিল। মায়ের বুকের ওম পেয়ে বাবুর কান্না ধীরে ধীরে থেমে গেল। ক্লান্তিতে মাধুরও ঘুমে দু’চোখ বুজে এলো।
অনুপম খবর পেয়ে ছুটে এলো। ছেলেটার ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা। দুই হাঁটুর উপর হাতদুটো রেখে হাঁপাচ্ছে। নার্স বলল,
-‘আপনি পেশেন্টের কী হন?
-‘আমার ওয়াইফ।
-‘আপনার ছেলেবাবু হয়েছে।
খুশিতে অনুপমের চোখের কোণে জল জমেছে। মুখে হাসি টেনে মাধুর মাথায়, মুখে হাত বুলিয়ে দিল। নার্সকে বলল,
-‘বাবুকে কোলে নেব?
-‘এখন না। বাবু মায়ের বুকের ওম নিচ্ছে। থাকুক আর একটু মায়ের বুকে।
মাধুর হাতে স্যালাইন চলছে। অনুপম মা, ছেলের পাশে অনেক অনেকক্ষণ একভাবেই বসে রইল। মহিলা দুজন অনুপমকে বলে বাসায় চলে গেছে। ছেলে দুটো একগাদা ফল, কলা, রুটি, কিনে নিয়ে এলো। দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,
-‘দাদা আসব?
-‘আয় ভেতরে আয়।
ওরা এসে ফলমূল, বাসার চাবি অনুপমের হাতে দিয়েই চলে যেতে চাইল। অনুপম পিছু ডেকে বলল,
-‘ভাই কত খরচ হয়েছে। আমি তো জানি না। এই মূহুর্তে এত টাকাও আমার কাছে নেই। তোদের টাকাটা আমি বাসায় গিয়ে পরিশোধ করে দেব, কেমন?
ওরা লজ্জা পেল। বলল,
-‘আচ্ছা তোমার যখন খুশি তুমি তখন দিয়ো তো।
মাধুর বাবা, মা, বড়দি, অনুপমের বাবা খবর পেয়ে রওনা দিয়েছে।
নার্স এসে বাবুকে বেশ কায়দা করে ধরে মায়ের বুকে শালদুধ খাইয়ে দিল। অনুপমকে বলল,
-‘আজ বিকালেই নিয়ে যেতে পারবেন। মা-বাচ্চা দুজনই সুস্থ আছে। তবে অনেক আগে মল ভেঙে গিয়েছিল। আরও দেরি করে এলে, হয়ত নরমালে হওয়ার কোন চান্স থাকত না।
অনুপম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মাধুর স্যালাইন শেষ হতেই অনুপম মাধুকে ধরে উঠিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। মাধুর এলোমেলো চুলগুলো হাত খোঁপা করে দিল। তারপর বাবুকে নিজের কোলে তুলে নিল। দুজনের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
-‘একটু রুটি,কলা খেয়ে নাও।
মাধু মলিন হেসে বলল,
-‘আপনি খুশি তো?
-‘আমাকে খুশি করতে গিয়ে তুমি কত কষ্ট সহ্য করলে। আমি খুব স্যরি মাধুসোনা!
মাধু, অনুপমের হাতখানা নিজের গালে রেখে বলল,
-‘মন খারাপ করবেন না। বাবুটা আর একটু বড় হোক। তখন আমরা আবারও বাবু নেব কেমন? তখন মেয়েবাবু হবে। দেইখেন?
অনুপম হেসে দিল। বলল,
-‘একটাতে শখ মিটেনি তোমার?
-‘না মানে আপনার তো মেয়েবাবু পছন্দ।
অনুপম, মাধুর মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে নাক টেনে দিল। বলল,
-‘ধুর বোকা। আমি তো এমনিই মজা করে বলেছিলাম। ছেলে হলেও আমার বাচ্চা। মেয়ে হলেও আমারই বাচ্চা। একটাই আগে পেলেপুষে বড় করো না।
মাধুও মিষ্টি করে একটুখানি হাসল। বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে নতুুন এক সুখ সুখ অনুভূতির সাথে পরিচয় হলো মাধু। মনটা আত্মতৃপ্তিতে ভরে গেল। এই পুতুল পুতুল ছেলেটা মাধুর? ইশ, ভাবতেই তো একরাশ আনন্দ হচ্ছে।
অনুপম, মাধুকে নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে উঠল। ঝর্ণারানীরা সবাই রাতের ট্রেনে এলো। ঝর্ণারানী এসেই স্নান সেরে নাতীকে কোলে তুলে নিল। বড়দি রাতের রান্না চাপাতে গেল। রাতে প্রদীপ জ্বেলে সর্ষের তেল গরম করে নাতীর সারা শরীরে মালিশ করে দিল। গ্রামের মানুষ বাচ্চা হলে বাচ্চাকে একমাস না গেলে ধরে না। একঘরে থাকে না। ঝর্ণারানীও সেই প্রচলিত নিয়মের বাইরে না। মাধুকে বলল, একমাস অন্যঘরে আর যাবি না। এইঘরেই থাকবি। অনুপম বলল,
-‘মা এইসব কুসংস্কার আমি মানি না। মাধু সারাবাসা ঘুরে বেড়াবে। ওর যা খুশি তাই করবে। আপনি প্লিজ বাঁধা দিবেন না। যেখানে স্বয়ং জামাই মানে না। সেখানে আর কিছু বলার থাকে না। রাতে অনুপম লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে বড়দিকে বলল,
-‘মাধু বরং আমার সাথে ঘুমাক?
বড়দি মুখ টিপে হেসে দিল। বলল,
-‘একটু ধৈর্য ধরো ভাই। এত তাড়া কিসের?
-‘না মানে মাধুর খুব হাত-পা চাবায়। টিপে না দিলে একদম ঘুমাতে পারে না।
-‘তারজন্য আমরা আছি তো ভাই। এই একমাস তুমি তো বউকে কাছে পাবে না। মা থাকবে মাধুর সাথে।
অনুপম অবাক হয়ে বলল,
-‘কেন, আমার বউ আমি নিয়ে ঘুমাতে পারব না কেন? কোন আইনে লেখা, বাচ্চা হলে বউকে তার মায়ের সাথে ঘুমাতে হয়? এই নিয়ম আমি মানি না।
বড়দি খুব মজা পেল। বলল,
-‘না মানে আমরা দুএকদিন থেকেই মাধুকে নিয়ে যাব তো।
অনুপম আঁৎকে উঠল। বলল,
-‘অসম্ভব। আমার বউ, বাচ্চা আমি দেব না।
-‘তা বললে তো হবে না ভাই। তখন তো তুমিই বলেছিলে!
-‘তখন তো কথার কথা বলেছিলাম।
বড়দি শব্দ করে হেসে দিল। বলল,
-‘ইশ, কী প্রেমরে বাবাহ্। শোন, বউকে যেতে দাও আর না দাও রাতে বউ পাবে না। কারণ মাধু যে ঘুমকাতুরে। ও একবার ঘুমালে বাচ্চা সারারাত খিদেয় কান্না করলেও ঠিক পাবে না। মা একটু পর পর ওকে ডেকে তুলে ব্রেস্টফিডিং করিয়ে দেবে। তাছাড়া অনেক মেয়েলী ব্যপার আছে। ও তুমি বুঝবে না।
অনুপমের খুব মন খারাপ হলো। এটা কোন কথা হলো? অনুপম বিড়বিড় করে বলল,
-‘বউ আমার, বাচ্চা আমার। অথচ আমিই না কী একমাস ওদের সাথে রাতে ঘুমাতে পারব না। ধেৎ ভাল্লাগে না।

বাবুটা দিনভর পরে পরে ঘুমালেও রাতে শুরু হয় কান্নাকাটি। রাত একটা/দেড়টা পর্যন্ত তাকে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করা লাগে। একটু বসলেও কেঁদেকেটে অস্থির। মাঝে মাঝে মাধুর এত বিরক্ত লাগে। প্রায় সময়ই মায়ের কাছে থাকে। তারপরও রাত জাগলেই মাধুর মাথা গরম হয়ে যায়। মন মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। ঝর্ণারানী মেয়েকে চোখ রাঙানী দেয়। বলে,
-‘তুই তো তাও সুখেই আছিস। আমি আছি, অনুপম আছে। আর আমাদের বেলায় সাথে কেউ থাকত না। অসুস্থ শরীরে সারাদিন, রাত বাচ্চা নিয়ে একা একা পরে থাকতাম।
বৃহস্পতিবার অফিস ছুটির পর অনুপম বাসায় না ঢুকে সরাসরি ছাদে গেল। মাধু একা একা বাবুর শুকনো কাপড় তুলছিল। অনুপম আচমকা পেছন থেকে মাধুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মাধু ভয়ে এক চিৎকার দিতেই অনুপম তাড়াহুড়ো করে মুখ চেপে ধরল। অনুপম বিষণ্ণ গলায় বলল,
-‘আজকাল আমার স্পর্শও চেনো না তুমি?
-‘এভাবে জড়িয়ে ধরলে ভয় পাব না?
-‘তোমার মা কবে যাবে মাধু?
-‘এ আবার কেমন কথা?
-‘তো আর কী বলব? নিজের বাসায় নিজের বউয়ের সাথে আজ আঠারোদিন যাবৎ রাতে যোগাযোগ বিছিন্ন। তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার একটুও ভাল লাগছে না। বলি, তুমি রাতের বেলাও তো একটু চুপিচুপি আমার ঘরে আসতে পারো।
-‘কীভাবে আসব? আপনার গুনধর ছেলে তো গভীর রাত জেগে গোটা বিল্ডিং পাহারা দেয়। মা জেগে থাকে। মায়ের সামনে দিয়ে আপনার ঘরে যেতে লজ্জা করে না বুঝি?
-‘ইশ, ‘আমার লজ্জাবতী লাজুকলতা’। আজকাল আমিও যে তুমি বিহীন একদম ঘুমাতে পারছি না। সে খবর কী তুমি রাখো?
অনুপম, মাধুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-‘আজ রাতে হবে না কী একবার?
-‘ধুর..ধুর…ধুর। সরুণ তো আপনি!
অনুপম ব্যকুল হয়ে বলল,
-‘আজ রাতে তোমাকে একবার আসতেই হবে। নাহয় আমিই তোমার রুমে চলে যাব। এটা কোন জীবন হলো?
মাধু লজ্জায় গুটিয়ে গেল। এই মানুষটার আজকাল কিছুই মুখে আটকায় না। দিনদিন কেমন বেহায়া হয়ে যাচ্ছে। মাধু কাপড়চোপড় নিয়ে নেমে যেতে লাগল। অনুপম পথ আটকাল। চোখে চোখ রাখল। মাধু তিরতির করে কাঁপছে। অনুপম কী মনে করে মাধুর ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। মাধু ছটফটিয়ে উঠল। সরে যেতে চাইল। অনুপম আর একটু নিবিড় ভাবে নিজের কাছে টেনে নিল। এভাবে কতক্ষণ কাটল কেন জানে! অনুপমের হাত আলগা হতেই মাধু চলে যেতে নিল। অনুপম পেছন থেকে মাধুর শাড়ির আঁচল টেনে ধরল। তারপর সময় লাগিয়ে নিজের মুখটা আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে মাধুকে ছেড়ে দিল। মাধু লাজুক হেসে চলে গেল। অনুপম মাথা চুলকে কতক্ষণ ছাদে হাঁটাহাঁটি করল। ফুলের রেণুতে হাত বুলিয়ে দিল। তারপর সেও নীচে নেমে গেল।
মা যতদিন কাছে ছিল। মাধু একদম বুঝেনি। ছোট বাচ্চা একা একা পালা কী যে কষ্টকর। বাসায় থাকলে অনুপম হাতে হাতে মাধুর সবকাজ করে দেয়। সে অফিস চলে গেলেই মাধু খুব অসহায় বোধ করে। বাবুকে একা রেখে বাথরুমে যেতে পারে না। কোন কাজ ঠিক ভাবে করতে পারে না। খেতে বসলেও বাবু পট্টি করে দেয়। মাধু জাস্ট পাগল পাগল হয়ে গেছে। এই নিয়ে প্রায়ই অনুপমের সাথে ঝগড়া লাগে। যদিও সব সময় ঝগড়াটা মাধু একাই করে। অনুপম, মাধুর সব অভিযোগ মন দিয়ে শুনে। তারপর গভীর ভাবে মাধুকে বুকে টেনে নেয়। যতক্ষণ না মাধুর রাগ পরে ওভাবেই জাপ্টে ধরে রাখে। ওদের দিনগুলো দুষ্টুমিষ্টি ভালোবাসায় কেটে যাচ্ছিল। অনুপম প্রায়ই ছুটি পেলে গ্রামের বাড়িতে ঘুরে আসে। মাধু সবার জন্য অনেককিছু কিনে অনুপমের সাথে দিয়ে দেয়।
এবার না কী রেণুবালাও অনুপমের সাথে ঢাকা আসছে। শাশুড়ী এই প্রথম আসবে। মাধু বাবুকে আন্টির কাছে রেখে এসে, রান্না করছে। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে ঘরটাও গুছিয়ে ফেলল। কলিংবেল বাজছে। তারা বোধহয় এসে পরেছে। মাধু দরজা খুলে দিয়ে শাশুড়ীমায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। মাধুকে দেখে, রেণুবালা চোখ, মুখ কুচকে ফেলল। বলল, -‘আমার নাতী কোথায়?’

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে