#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০৯
মাধু সেই যে মন খারাপ করে, ছাদে গিয়ে চুপটি করে বসে আছে। অনুপম ছাত্র জীবনে শখের বশে বিভিন্ন ফুল গাছের ছোট ছোট চাঁড়া কিনে এনে, ছাদ বাগান করেছিল। অনুপমের অনুপস্থিতিতে অনিকেত বাগানের দেখাশোনা করে। গাছে নিয়ম করে দুবেলা জল দেয়। আবার শখ করে কিছু সাদা রঙের পায়রা পুষে। পায়রাগুলি ফুলগাছের ডালে বসে মনের সুখে ডানা ঝাঁপটায়। খিদে পেলে, চিকুন ঠোঁট দিয়ে কুট কুট করে গম খায়। মাধু বাগানের বাহারি রঙের ফুলের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনুভূতি শূণ্যে হয়ে তাকিয়ে আছে। মাধুকে খুঁজতে খুঁজতে বড়দি ছাদে এলো। বলল,
-‘মাধু ঘরে চল। অনুপম এসে গেছে।
মাধুর বুকের ভেতর চাপা কষ্টে ধুকপুক করে উঠল। মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেল। কী জানি! মানুষটা আবার মাধুকে ভুল বুঝে, দূরে না ঠেলে দেয়। মাধু বসা থেকে উঠে পরল। বড়দি বলল,
-‘যাই হয়ে যাক। তুই কিন্তু ভেঙে পড়বি না। মাধু, বড়দির হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। আজ বাড়িতে সারাদিনেও উনুন জ্বালানো হয়নি। নিখিলেশবাবু বাইরে থেকে খাবার কিনে এনেছে। সবাই অল্প কিছু খেলেও শুধু রেণুবালাকে কেউ খাওয়াতে পারেনি।
অনুপম বাড়িতে ঢুকেই প্রথমে শ্বশুরের সাথে কুশলাদি বিনিময় করল। মাধুর সাথে একটু চোখাচোখি হলো। মাধু লজ্জায় বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। অনুপম হাসার চেষ্টা করে বলল,
-‘আপনারা গল্প করুণ। আমি একটু মায়ের ঘর থেকে ঘুরে আসি।
রেণুবালা শুয়ে ছিল। অনুপমকে দেখে, আবারও উঠে বিলাপ শুরু করল। অনুপম ঘরে ঢুকে মাকে একহাতে জড়িয়ে ধরল। চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল,
-‘মা.. মা দয়া করে কান্না বন্ধ করো। তোমার মাধুকে নিয়ে কী কী অভিযোগ আছে। বলো? আমি শুনব। তার আগে কিছু খেয়ে নাও। বিন্দুমাসি খাবার এনে দিল। অনুপম নিজে হাতে মাকে খাইয়ে দিল।
রেণুবালা ভরপেট খেয়ে, চোখের জল মুছে সত্যি, মিথ্যা মিলিয়ে মাধুর নামে একগাদা অভিযোগ করল। অনুপম সব শুনে বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
-‘তোমার বলা শেষ? না আরও কিছু বলার আছে মা?
-‘ আমি আর ঐ হতচ্ছাড়ি মেয়েমানুষ নিয়ে কিছুতেই সংসার করব না বড়খোকা। হয় এই বাড়িতে তোর বউ থাকবে আর নাহয় আমি থাকব। তুই একবার চিন্তা কর! ওর কত বড় কলিজা। ও ওর বাপ, বোনকে খবর দিয়ে, বাড়ি বয়ে নিয়ে এসে আমার নামে মিথ্যে অপবাদ দেয়। আমি না কী তোর বউকে খেতে দেই না। এটা কোন কথা? শুধু যা খেলে বাচ্চার ক্ষতি হবে। সেসব খাবার খেতে যা একটু বারণ করি। ওর ভালোর জন্যই তো বলি।
অনুপম বলল,
-‘মা.. মাধুর গর্ভে আমার সন্তান আসার পর থেকে আমি সংসারে টাকা দেওয়া বাড়িয়ে দিয়েছি। বলো দেইনি?
-‘হ্যাঁ দিয়েছিস।
-‘তারপরও তুমি কেন মাধুকে খাওয়ার কষ্ট দিয়েছ?
রেণুবালা বিষম খেল। বলল,
-‘বড়খোকা? বুঝেছি বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই তোর বউ আমার নামে তোর কানও ভারী করেছে। সেই.. এখন বউই আপন। মা পর।
অনুপম নিজের গলায় দুটো আঙুল দাবিয়ে বলল,
-‘মা..ভগবানের দিব্যি কেটে বলছি, মাধুর সাথে এই বিষয়ে একটা কথাও হয়নি আমার। আমি শুরু থেকেই জানি মা। তুমি মাধুকে খাওয়ার কষ্ট দাও। ইনিয়েবিনিয়ে কটু কথা শোনাও। ওর সব কাজেই খুঁত ধরো। এতক্ষণ ধরে যে মেয়েটার নামে তুমি আমার কাছে একগাদা নিন্দে করলে, ওই মেয়েটা শুধুমাত্র তুমি কষ্ট পাবে বলে, এই বিষয়ে আমাকে এতদিন কিছুই বলতে দেয়নি। সত্যিই নারীরা কত বিচিত্র হয়। তাই না মা?
রেণুবালা কিছুই বলল না। অনুপম একটু বিরতি নিয়ে আবারও বলল,
-‘তারমানে তুমি আমার বউ নিয়ে ভাত খাবে না এই তো?
-‘না খাব না।
-‘বেশ। এবার চলো আমার সাথে?
বসার রুমে এসে সবাই জড়ো হয়েছে। থমথমে পরিবেশ। মাধু এক কোণে ভয়ে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। অনুপম মাধুর বড়দি আর বাবার অভিযোগও মন দিয়ে শুনলো। তারপর মাধুকে ডেকে বলল,
-‘এখানে আসো?
মাধু মাথা নীচু করে এগিয়ে এলো। বুকের ভেতর মৃদু ব্যথা। অনুপম বলল,
-‘তুমি কী চাও মাধু? বাবার সাথে ওই বাড়িতে গিয়ে থাকতে চাও? না এই বাড়িতে থাকতে চাও? আর না আমার সংসার করতে চাও?
রেণুবালা মাঝখানে ফোড়ন কেটে বলল,
-‘ও, এই বাড়িতে থাকলে কিন্তু আমি থাকব না বড়খোকা।
মাধু আঁতকে উঠল। কিছু বলার সাহস পেল না। অনুপম দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মাধুর দিকে একহাত বাড়িয়ে দিল। বলল,
-‘কোন শ্বশুরবাড়ি না। কোন বাবার বাড়ি না। তোমাকে কোথাও কারো বোঝা হয়ে থাকতে হবে না। তুমি কী আমার সাথে যাবে মাধু?
মাধুর জানে প্রাণ ফিরে এলো। মনটা সুখ সুখ অনুভূতিতে ভরে গেল। রেণুবালা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। বলল,
-‘এই মেয়েমানুষ নিয়ে তুই সংসার করবি?
-‘মা এখন যুগ পাল্টেছে। সত্যি, মিথ্যা যাচাই না করে মায়ের একবাক্যে আমি বউ ছেড়ে দেব না। একদিকে তুমি যেমন আমার জন্মদাত্রী মা। অন্যদিকে মাধু আমার নবাগত সন্তানের মা হতে চলেছে। এই মূহুর্তে ওর হাত ছেড়ে দেওয়া নয় বরং ওকে বেশি বেশি সময় দেওয়া দরকার আমার। মা আমি এতটাও অক্ষম হয়ে যাইনি। আমার অনাগত সন্তানের মাকে খাওয়ার অভাবে মাসের পর মাস তার বাপের বাড়ি ফেলে রাখব। হ্যাঁ মাধু যাবে। তবে নিয়ম মেনে সাত মাসের অনুষ্ঠান শেষে তার মায়ের কাছে যাবে। যদি ও মন থেকে যেতে চায় তবেই। মাধু ব্যাগ গুছিয়ে নাও। আসার পর ফিরতি দুটো ট্রেনের টিকিট কেটে এসেছি।
বড়দি মনে মনে খুব খুশি হলো। বিড়বিড় করে বলল,
-‘সাব্বাশ.. এই না হলে পুরুষ মানুষ। একদম মহিলার উচিৎ শিক্ষা হয়েছে। ভগবান মুখ তুলে চেয়েছে। এতদিন পর যদি আমার বোনটা একটু সুখের মুখ দেখে! মাধুর বাবাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
মাধু শ্বশুরের দিকে এক পলক মুখ তুলে তাকাল। তিনি ইশারায় মন ভরে আশীর্বাদ করলেন। মাধুকে, অনুপমের সাথে চলে যেতে বললেন। এইসব অনাচার দেখতে দেখতে তার আর ভাল লাগে না।
বাবা আর বড়দিকে বিদায় দিয়ে, মাধু মনের সুখে ব্যাগ গুছাচ্ছে। অনুপম পাশে বসে মুগ্ধ চোখে মাধুকে দেখছে। এই মেয়েটার চঞ্চল চাউনি, ছটফটে স্বভাবের প্রেমেই তো অনুপম প্রথম পড়েছিল। দুরুদুরু বুকে, দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে, স্বামীর হাত ধরে, মাধু হাসিমুখে বেড়িয়ে গেল। গাড়িতে উঠে একটুখানি বাড়িটার দিকে মায়া মায়া চোখে তাকাল মাধু। মন ভরে, দুচোখ জুড়িয়ে দেখে নিল। এই বাড়িতে মাধুর তিক্ত কিছু সময় কাটলেও অনুপমকে ঘিরে কত যে সুখের, ভালোবাসার চরম মূহুর্ত কেটেছে। সেসব ভেবেই মনটা আত্মতৃপ্তিতে ভরে গেল। মাধু জানে না। ‘স্বামী’ নামক এই মানুষটা মাধুকে কোথায় নিয়ে যাবে, রাখবে কোথায়, খাওয়াবে কী? শুধু জানে আজকের পর থেকে মাধুকে আর মানুষটার কথা ভেবে, মন খারাপ করে, কেঁদেকেটে বালিশ ভেজাতে হবে না। রোজ রাতে মানুষটার মুখ দেখে মাধু ঘুমাবে আবার রোজ সকালে প্রিয় মানুষটার মুখ দেখেই মাধুর জীবনে নতুন সকাল আসবে। মাধুর ছোট্ট জীবনে এতটুকুই তো চাওয়া ছিল।
অনুপম, মাধুকে নিয়ে ট্রেনের কেবিনে উঠল। ফোনটা অফ করে দিয়ে মাধুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেল।
মাধুরা চলে যেতেই বাড়িতে আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটল। রাতেই আঁধারে কাউকে কিছু না বলে রিধীকা একা একা চলে এসেছে। শাড়ি এলোমেলো, হাতে, পিঠে, পেটে মাইরের দাগ। কপাল ফেঁটে রক্ত পরছে। বাড়িতে ঢুকেই রিধীকা গা কাঁপিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। রিধীকার অস্বাভাবিক আচরণ দেখে, সবাই খুব ভয় পেল। মেয়েটার বিয়ের ছয়মাসও ঘুরেনি। কী এমন হলো! যে এভাবে কাঁদছে? নিখিলেশবাবু মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। অনিকেত পাগলের মতো অনুপমের নাম্বারে ফোন দিল। ফোন বন্ধ বলছে। রেণুবালাও মেয়ের কান্না দেখে ভয় পেয়ে কেঁদে দিল। হঠাৎ রিধীকার শ্বশুরবাড়ি থেকে ফোন এলো। ফোনটা করেছে রিধীকার বর। নিখিলেশবাবু ফোন রিসিভ করতেই ভদ্রলোক চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘আমার বাড়ির দরজা আপনার মেয়ের জন্য সারাজীবনের জন্য বন্ধ। ভুলেও ওই অলক্ষ্মী মেয়েকে আর আমার সংসারে পাঠাবেন না। আমি খুব শীঘ্রই এই বিষয়ে উকিলের সাথে কথা বলব। কী হয়েছে! আপনার মেয়ের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে নেবেন। শুধু জেনে রাখেন, আপনার সো কল্ড স্ত্রী’র কূটবুদ্ধির জন্যই আজ আমাদের সংসারটা ভেঙে গেল।
নিখিলেশবাবু ফোন রেখেই রেণুবালার দিকে আগুন চোখে তাকাল। চিৎকার করে বলল,
-‘রিধীকা কেন এভাবে চলে এলো, বলো আমাকে?
রেণুবালা শুকনো ঢোক চিপল। সোফায় বসে, রিধীকা মুখ ঢেকে হাপুস নয়নে কাঁদছে। কেন যে রিধীকা মায়ের বুদ্ধি শুনতে গিয়েছিল। মায়ের কূ’বুদ্ধি শুনে একে একে সব হারাতে বসেছে রিধীকা।
(চলবে)
(সবাই গল্পে রেসপন্স করবেন।)