#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০৮
মালা বদল করে, সাত পাঁক ঘুরে, সিঁথি ভর্তি বরের দেওয়া সিঁদুর পরে, রিধীকার বিয়ে হয়ে গেল। দেবু আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। পোড়া মন, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ভেজা চোখ, মুছতে মুছতে চলে গেল।
একমাত্র ননদের বিয়ে। মাধু খুব ছোটাছুটি করছিল। কাজের যেন শেষ নেই মেয়েটার। একটা কাজ শেষ হতেই রেণুবালা আরেকটা কাজ ধরিয়ে দেয়। গভীর রাত হয়ে যায়। অথচ মাধুর এখনো ঘরে আসার নাম নেই। অনুপম অধৈর্য হয়ে গেল। মাধুকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে পেল। মাধু, নতুন বর, বউয়ের খাওয়া এঁটো থালাবাসন গুচ্ছাছিল। অনুপম চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘তুমি এতরাতে এগুলো করছো কেন? ঘরে চলো?
-‘আপনি যান। আমার প্রায় হয়ে গেছে।
অনুপম, মাধুর হাতদুটো টেনে ধরে, নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘আমি একা ঘরে চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছি। আমার ইমোশনের কোন দাম নেই তোমার কাছে? মাধু আমার হাতে ছুটি কম। আমাকে দুদিন পর চলে যেতে হবে। দিনে না হোক। রাতে তো অন্তত তুমি আমাকে সময় দেবে?
মাধু লজ্জা পেল। দৃষ্টি মাটির দিকে রেখে, বসা থেকে উঠে পরল। বিয়ের ছয়মাস হতে চলল। অথচ এখনো অনুপমের আবেগময় কথায় মাধুর হৃদয়ে কাঁপন ধরে। মাধুর জন্য এত অস্থির মানুষটা? শুনতে বেশ লাগে। অনুপম, মাধুকে কোলে তুলে নিল। মাধু ছটফটিয়ে উঠল। অনুরোধ করে বলল,
-‘দয়া করে, আমাকে নামিয়ে দেন? কেউ দেখলে কেলেংকারী হয়ে যাবে।
অনুপম মুচকি হেসে, মাধুকে আর একটু শক্ত করে চেপে ধরল। মাধু, অনুপমের বুকে লজ্জায় মুখ লুকাল। অনুপম, মাধুকে চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে গেল। খাটের মাঝখানে বসিয়ে দিল। নিজেও হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে, মাধুর দুইহাত আলতো করে ধরল। চোখে চোখ রেখে গাঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘আজকের এই মায়াবী রাত, আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ, অদূরে ঝিঁঝি পোকার মায়াময় ডাক আর আমার চোখে দেখা, পৃথিবীর সবচেয়ে লক্ষ্মীমন্ত, লজ্জাবতী রমনী।’ আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, আজকের রাতটা আমাদের জীবনে খুব স্পেশাল স্মরণীয় রাত হয়ে থাকবে। এই সুন্দর রাতকে ঘিরে, আমাদের দুজনের সুখ সুখ অনুভূতিকে আমরা জীবনেও ভুলব না। প্রমিস করো লক্ষ্মী?
মাধুর কাজল কালো চোখের কোণে জল জমেছে, কাঁপা কাঁপা হাত অনুপমের বাড়িয়ে রাখা হাতে রাখল। অনুপম, মাধুর চিবুকে ঠোঁট ছোঁয়াল।
অনুপমের তীব্র ভালোবাসার উষ্ণ স্পর্শে মাধুর শরীরে বসন্তের শিমুল ফুলের মতো আগুন লেগেছে। মায়া, ভালোবাসা, একে অপরকে ঘিরে সুখ সুখ অনুভূতিতে একটু করে কেটে গেল, রাতের আঁধার।
দিনের আলো ফুটতেই মাধু ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। আয়নায় নিজেকে দেখে আঁতকে উঠল। চোখে কাজল লেপ্টে গেছে, ঠোঁটের চারপাশে লিপস্টিকে মাখামাখি, সিঁথিতে সিঁদুর লেপ্টে গেছে, ভারী শাড়ি এলোমেলো। বিয়ে বাড়ি। এতক্ষণে বাড়ির অনেক মানুষই উঠে গেছে। মাধুর খুব কান্না পেল। এই বেশে মানুষের সামনে কী করে যাবে মাধু? পাশে অনুপম গভীর ঘুমে মগ্ন। মাধু আস্তে আস্তে ডাকাডাকি করল। অনুপম উঠল না। ঘুমে ব্যঘাত ঘটায় বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে শুলো। মাধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে গেল। মাথায় বড় ঘোমটা টেনে গুটিগুটি পায়ে, ছাদ থেকে নেমে গেল। সিঁড়ির শেষ মাথায় এসে রেণুবালার সাথে দেখা হলো। রেণুবালা মাধুর এই বেশ দেখে, ছিঃ ছিঃ করল। রাগী অথচ চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘বাড়িতে তোমার ননদের বিয়ে উপলক্ষে বাড়ি ভর্তি মানুষজন গিজগিজ করছে। দুদিন অন্তত তোমাদের এই বেহায়াপনা না করলে হতো না বড়বৌমা? মুখের কী অবস্থা করেছ? গুরুজনদের সামনে একটু লজ্জা নিয়ে চলতে শিখো?
মাধু মাথা নীচু করে, হাত মোচড়াচ্ছে। শাশুড়ীর তীব্র বাক্যবাণ শুনে চোখদুটো ছলছল করে উঠল। রেণুবালা ধমকে উঠল।
-‘আমার সামনে একদম ন্যাঁকা কান্না কাঁদবে না। দেখতে খুব বিরক্ত লাগে।
-‘কী হয়েছে মাওইমা? মাধুকে ধমকাচ্ছেন কেন?
মাধুর বড়দি এগিয়ে এলো। রেণুবালা শুকনো হাসার চেষ্টা করল। মুখ বলল,
-‘না কিছু না। ওই আরকি?
-‘আপনি আমার গুরুজন। কিছু মনে করবেন না মাওইমা। আমি আপনাদের কথা কিছুটা শুনে ফেলেছি। আমার বোনের এই অবস্থা একা একা হয়নি। এতে যতটা ওর দোষ। ঠিক ততটাই আপনার ছেলের দোষ। তাছাড়া ওরা বিবাহিত দম্পতি। ওরা কখন কী করবে, না করবে সেইটা ওরাই ভাল বুঝবে। এখানে ওকে বকা বা শাষণ করার কিছুই নেই। আপনার দেখতে এতই যখন দৃষ্টিকটু লাগে। আপনার ছেলেকে সরাসরি বলবেন। বউয়ের সাথে রাতে থাকবি না।
মাধু চল আমার সাথে স্নান করবি! বড়দি কথাগুলো বলেই মাধুকে নিয়ে চলে গেল। নেহাৎ বিয়েবাড়ি। না হলে দুই দিনের ছুড়ি রেণুবালাকে অপমান করে? এতক্ষণে রেণুবালা লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে নিত। মাধু পুকুরে পাড়ে গিয়ে সাবান দিয়ে মুখ ধুলো। বড়দি সিঁড়িতে আনমনা হয়ে বসে ছিল। মাধু বলল,
-‘শুধু শুধু ওনাকে এতগুলো কথা শুনালি বড়দি?
-‘তুই কিছু বলিস না দেখেই তোর মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায়, এই মহিলা। কেন মাধু অন্যায় দেখেও চুপ থাকিস? তুই তো এমন ছিলি না?
-‘আমার চুপ থাকায় যদি সংসারে শান্তি বজায় থাকে। তাহলে চুপ থাকতে মন্দ কী! একসাথেই যখন থাকতে হবে। তখন ঝগড়া, অশান্তি, বিবাদ করে কী লাভ? বলুক না ওনি যা খুশি। এতে আমার শরীর খয়ে যাবে না।
-‘অনুপমকেও তো বলতে পারিস?
-‘ও ওর মাকে খুব ভালোবাসে। একই সঙ্গে আমাকেও প্রচণ্ড ভালোবাসে। একজন ভালোবাসার নারীর মুখ থেকে আরেকজন ভালোবাসার নারীর বদনাম শুনতে ওর একটুও ভাল লাগবে না বড়দি।
-‘আমাদের সেই ছোট্ট মাধু কবে এতটা বড় হয়ে গেল রে?
উত্তরে মাধু একটুখানি হাসল।
বিদায়বেলা রিধীকা খুব কাঁদল। রেণুবালা মেয়েকে বুকে আগলে ধরে বিলাপ করছে। মায়ের বুক থেকে জোর করে রিধীকাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গাড়িতে বসানো হলো। ঐ দূরের ছাদ থেকে আরেক জোড়া তৃষ্ণার্ত চোখ, চাতকপাখির মতো তাকিয়ে আছে।
ভালোবাসার মানুষটা পুরোপুরি অন্যের হয়ে যাওয়ার সময় যে ভালোবাসা মনে উদয় হয়। সেই ভয়ংকর, সর্বনেশে ভালোবাসা কারো জীবনে না আসুক।
মেয়ের বিয়ের পর বাড়িতে যে কী পরিমাণ কাজ জমে যায়। মাধু, বিন্দুমাসি পুরো বাড়ি ছাড়ু দিয়ে প্রায় অর্ধেক বেলা লাগিয়ে মুছলো। দুজন কাজের মানুষ নিয়ে থালাবাস ধুয়ে ঘর গুছিয়ে নিল। কাল আবার বৌভাত। ওই বাড়িতে যেতে হবে। ওনারা নেমন্তন্ন করে গেছে।
বিকালে ঘরে এসে দেখল, অনুপম মন খারাপ করে বসে আছে। মাধু পাশে বসল। অনুপম, মাধুর ঘাড়ে মাথা রাখল। বলল,
-‘মা তোমার সাথে এত খারাপ ব্যবহার করে, কখনো আমাকে বলোনি কেন মাধু?
-‘কে বলল আপনাকে এসব কথা?
-‘মা তোমাকে দিনের পর দিন ভাল মাছ দিয়ে খেতে দেয় না। মাঝে মাঝে ভাত ফুরিয়ে গেলে শুধু মুড়ি খেয়ে থাকো। রাতে তোমার খিদের জ্বালায় ভাল ঘুম হয় না। তুমি ছটফট করো, কাঁদো। সকালে কান্না লুকিয়ে মেকি হাসিমুখে সবার সব ফরমায়েশ করে দাও। এই কথাগুলো আমাকে কেন অন্য মানুষের মুখ থেকে শুনতে হবে? তোমার বর হয়ে, এই কথা গুলো কী তোমার মুখ থেকে শোনার অধিকার রাখি না আমি?
মাধুর কণ্ঠে ভেঙে এলো। বলল,
-‘আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।
অনুপম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
-‘আমার বাবা ওই বয়সে সংসারের প্রতি উদাসীন ছিলেন। বুঝ হবার পর থেকেই দেখে এসেছি। আমার মা এই সংসারে এসে খাওয়া, পরা নিয়ে অনেক কষ্ট করেছে। কাজে একটু ভুল হলে কখনো কখনো আমার কর্তামা মায়ের গায়েও হাত তুলল। কর্তামায়ের কথায় পুরো সংসার চলত। সবসময় ভাল ভাল খাবার কর্তামা, বাবা, জেঠুদের পাতেই পড়ত। আমরা ছেলে বলে, ভাল খাবার পেতাম। তবে আমাদের মা, জেঠিকে গাধা খাটুনি খাটিয়ে দিনশেষে দুবেলা মেপে মেপে খেতে দিত। আমরা যদি নিজেদের ভাগের খাবার মায়ের পাতে তুলে দিতাম। তাহলে পরদিন আর আমাদের ভাগে ভাল খাবার জুটত না। তখন ছোট ছিলাম। ভাল খাবারের লোভে মাকে আর নিজের খাবার থেকে ভাগ দিতাম না। বছরের পর বছর মায়ের সাথে অমানবিক অত্যাচার করে, আমায় মায়ের সুন্দর মনটা অস্বচ্ছতায় ভরে দিয়েছে আমার কর্তামা। হয়ত সেখান থেকে মা এখনো বের হতে পারেনি। যুগ পাল্টেছে। তার মনোভাব এখনো সেকেলে রয়ে গেছে। সে ভাবে আমি এই সংসারে এসে এত কষ্ট সহ্য করেছি। এখন আমার সুখের সময়। আমার বৌমাকেও এই একই কষ্ট সহ্য করতে হবে। শুধুমাত্র এই মনোভাবের জন্যই শাশুড়ীরা খারাপ হয় জানো?
মাধু মাথা নাড়ল। তার বলার কিছুই নেই। এই বাড়িতে এসে মাধু খাওয়া নিয়ে খুব কষ্ট করে। মাধুর বাবা-মা কখনো মাধুদের দুবোনকে বৈষম্য করে বড় করেনি। তাই খিদের কষ্টটা মাধু মেনে নিতে পারে না। মাঝে মাঝেই বড়দিকে বলে। বড়দি মাকে জানানোর পর থেকেই মা, বাবার সাথে খুব রাগারাগি করেছে। অনুপমকে জানাতে চেয়েছে। মাধুর রিকুয়েষ্টে কিংবা মেয়ের সুখের কথা ভেবে জানানো হয়নি। বড়দিটা মাধুর একটা কথাও শুনে না। শেষমেশ ঠিকই অনুপমকে জানিয়ে দিল। মানুষটা খুব কষ্ট পেয়েছে। মানুষটা সামান্য কষ্ট পেলেও মাধুর ভাল লাগে না। বুকের ভেতর ভেঙেচুরে যায়।
মাধু ইদানীং কিছুই খেতে পারে না। যা খায়, সাথে সাথে বমি হয়ে যায়। মাছ, মাংস’র গন্ধও সহ্য হয় না। অল্প কাজকর্ম করেও হাপিয়ে যায়। শরীর সায় দেয় না। অনুপম জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার টেস্ট দিল। রিপোর্টে জানা গেল। মাধু আড়াই মাসের গর্ভবতী। অনুপমের খুশি যেন ধরে না। রেণুবালা শুনেও বেশ খুশি। তার বংশে প্রথম নাতী-নাতনী আসতে চলেছে। ছেলের সামনে মাধুকে খুব আদর করে রেঁধে বেড়ে খাওয়াল। অনুপম কর্মক্ষেত্রে চলে যেতেই, আবারও শুরু হলো মাধুর সাথে খাওয়া নিয়ে শারীরিক অত্যাচার। মাধু যাই খেতে যায়। রেণুবালা তাতেই ফোড়ন কাটে। শুধু ভাত ছাড়া অন্যকিছু খেতে দিতে চায় না। শুধু ভয় দেখায়। এটা খাওয়া যাবে না, ওটা খাওয়া যাবে না। বাচ্চার ক্ষতি হবে। পেটের ভেতর বাচ্চা বড় হয়ে যাবে। মাধুর এত বিরক্ত লাগে। মাঝে মাঝে মাধুর ভয়ংকর সব ইচ্ছে করে। দিন গুলো যে কী দূর্বিসহ ভাবে কাটছে, বলার মতো না। গর্ভবতীকালীন সব সময় ভাত খেতে ভাল লাগে না। কত বাহারি পদের খাবারই যে খেতে ইচ্ছে করে। অভুক্ত থাকতে থাকতে মেয়েটার শরীর ভেঙে গেছে। চোখ মুখ গর্তে বসে গেছে। একদিন না জানিয়ে বড়দি আর বাবা মাধুকে দেখতে এলো। মাধুর এই অবস্থা দেখে, বাবার মনটা কষ্টে নীল হয়ে গেল। তখন মাধুর প্রেগন্যান্সির চারমাস চলছিল। বাবা, নিখিলেশ বাবুকে ডেকে বলল,
-‘কিছু মনে করবেন না। আমার মেয়ে আমি নিয়ে যাব। এই সময়টা ও বরং ওর মায়ের কাছে থাকুক। নিখিলেশবাবু খুব লজ্জা পেল। বড়দি বলল,
-‘তুই ব্যাগ গুছিয়ে নে মাধু।
রেণুবালা বলল,
-‘আমাদের বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী সাতমাসে অনুষ্ঠান করে মেয়েকে নিয়ে যেতে হয়।
-‘এখনই যে আমার বোনের অবস্থা হয়েছে। সাতমাস পর এসে হয়ত ওকে আমরা জীবিতই পাব না।
-‘কী বলতে চাইছ? তোমার বোনকে আমরা খেতে দেই না?
বড়দি বলল,
-‘সে তো আপনারাই ভাল জানেন।
রেণুবালা বলল,
-‘আমার বাড়ির বউকে আমি এইভাবে নিয়ে যেতে দেব না।
-‘তবে কী আমরা ওর মরাদেহ নিয়ে যাবার জন্য অপেক্ষা করব?
রেণুবালা রেগে গেল। বলল,
-‘কী শিক্ষে দিয়েছেন? বিয়াইমশাই আপনার বড় মেয়েকে? গুরুজন মানে না। মুখে মুখে তর্ক করে। আমার পেটের মেয়ে হলে না চাপকে সোজা করে দিতাম।
-‘ভাগ্যিস আমি আপনার পেটের মেয়ে হইনি। যে মহিলা নিজের পুত্রবধূকে খেতে দেয় না। সারাক্ষণ খাওয়া নিয়ে খোঁটা দেয়, কটুকথা শোনায়। স্বামীর সাথে একান্ত সময় কাটালে যার সহ্য হয় না। এরকম মা আমার না হওয়াই শ্রেয়।
রেণুবালা বলল,
-‘বেয়াদব মেয়ে কোথাকার। দেখি কী করে আমার পুত্রবধূকে নিয়ে যাও। বড়বৌমা..?
মাধু এতক্ষণ মাথা নীচু করে ছিল। শাশুড়ীর ডাকে চমকে উঠল। রেণুবালা আবারও বলল,
-‘আজ যদি তুমি তোমার বাবার সাথে নিয়ম ভঙ্গ করে চলে যাও। তবে মনে রেখ, এই যাওয়াই তোমার শেষ যাওয়া। আমার ঘরের দরজা তোমার জন্য সারাজীবনের মতো বন্ধ।
নিপেনবাবু এবার মুখ খুললেন। বললেন,
-‘কিছু মনে করবেন না বেয়ান। আমি তো আপনাকে দেখে, আমার মেয়ে বিয়ে দেইনি। আপনি একটু আগে যে কথাগুলো বললেন। এই একই কথা আপনার ছেলেকে বলতে হবে। আমার মেয়েরা আমার কাছে কিন্তু অভিশাপ না বরং আশীর্বাদ। পেলেপুষে বড় যখন করতে পেরেছি। একভাবে না একভাবে ওদের ভরণপোষণও জোটাতে পারব। আর যাই হোক। বাপের ঘরে না খেয়ে দিন পার করতে হবে না।
রেণুবালা বলল,
-‘ও… এই ব্যাপার? তারমানে আপনার ছোটমেয়েও কম যায় না। আমার নামে আপনাদের কাছে কান ভারী করেছে?
-‘ও তো মিথ্যে কিছু বলেনি? আপনিই বলুন তো এই যুগে কোন শাশুড়ী আছে? যে পুত্রবধূ গর্ভবতী হলে খেতে দেয় না?
-‘ছিঃ ছিঃ আমি খেতে দেই না? বড়বৌমা এতবড় মিথ্যে অপবাদ আমার নামে দিতে পারলে?
মাধু কী করবে, কী বলবে কিছুই বুঝতে পারল না। পরিবেশ খুব বেশি জটিল হয়ে গেছে। মাধু তো তার মা আর বড়দিকে খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে শুধু বলেছিল। তারা যে না বলেকয়ে মাধুকে নিতে আসবে। কে জানত?
রেণুবালা বিলাপ করে কাঁদছে। বড়দি আর বাবা মাধুর ঘরে শুকনো মুখে বসে আছে। অনুপমকে খবর দেওয়া হয়েছে। রাতের ট্রেনে আসবে। অনুপম এলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে রেণুবালা মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে বসলেন। তিনি আর এই বউ নিয়ে কিছুতেই খাবেন না। হয় এই বাড়িতে মাধু থাকবে, আর নাহয় সে থাকবে।
(চলবে)