লজ্জাবতী পর্ব-০৭

0
543

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০৭

বাড়িতে দুটো ফোন। একটা বাবার, আরেকটা জেঠুর কাছে থাকে। রাতে ঢাকা পৌঁছে অনুপম বাবার নাম্বারে ফোন দিল। ফোনটা অনিকেতের কাছে ছিল। রিসিভ করে অনিকেত বলল,
-‘ বড়দাভাই ভাল ভাবে পৌঁছে গেছিস তুই?
-‘হ্যাঁ। সবাই কী ঘুমিয়ে গেছে অনি?
-‘জানি না। তবে মা-বাবার ঘর থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনে হয়, ঝগড়া লেগেছে।
-‘আজ আবার কী নিয়ে লাগল?
-‘কী জানি বাবা।
-‘অনি এক কাজ কর?
-‘কী?
অনুপম গাল চুলকে ইতঃস্তত করে বলল,
-‘তুই বরং ফোনটা তোর বৌদিমণির কাছে দিয়ে আয়!
-‘দাঁড়া দিচ্ছি।
অনুপম ফোনের ওপাশে অপেক্ষা করছে। অনিকেত বই খাতা বন্ধ করে উঠে গেল।

রাতে ওই ঘটনার পর থেকে মাধু মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়েছে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদছে মেয়েটা। যতটা না অনুপমের অনুপস্থিতিতে খারাপ লাগছে, তার থেকেও বেশি খারাপ লাগছে, শাশুড়ীর তিক্ত ব্যবহারে! মানুষটা তখন মাধুকে রাক্ষসী বলল? ইশ, এই কষ্ট কোথায় লুকাবে মাধু?
-‘বৌদিমণি…?
কে ডাকে? মাধু চট করে চোখের জল মুছে নিল। মাথায় ঘোমটা টেনে উঠে বসল। অনিকেত ঘরে এসে, মাধুর হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-‘লাইনে বড়দাভাই আছে। কথা বলো?
মাধু ফোন হাতে নিল। একটু কেশে কণ্ঠ স্বাভাবিক করে নিল। অনিকেত চলে যেতেই মাধু বলল,
-‘কেমন আছেন? যেতে কোন অসুবিধে হয়নি তো?
-‘তোমার কণ্ঠ এমন লাগছে কেন মাধুসোনা?
-‘কই না তো।
-‘না..না। কেমন যেন কণ্ঠ বসে গেছে। তোমার কী কোন কারণে খুব মন খারাপ মাধুসোনা? কিংবা খুব কেঁদেছ?
অনুপমের আবেগী কথা শুনে, মাধু মুখ চেপে কান্না আটকাল। শরীর ফুলে ফুলে উঠছে। মন বলছে, রাতের ঘটনা বলে দেই! মস্তিষ্ক বিদ্রোহ করছে। ছোটবেলা থেকেই মাধু দেখে এসেছে, মাধুর বাবা দূরে কোথাও গেলে , সংসারে যতই ঝগড়াঝাটি, ঝামেলা হোক। মাধুর মা ভুলেও স্বামীকে বলত না। মানুষটা দূরে আছে। কী দরকার শুধু শুধু মানুষটাকে পারিবারিক অ’শান্তির কথা জানিয়ে, মন খারাপ করে দেওয়া বা চিন্তায় ফেলা। তাছাড়া মাধুর বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই ঝর্ণারানী, মাধুর মাথায় হাত বুলিয়ে খুব বোঝাত। তোমার শাশুড়ীমা যাই বলুক। হয়ত তার সব কথা তোমার ভাল লাগবে না। তাই বলে, কখনো বরের কাছে তার মায়ের নামে বদনাম করবে না। এক সংসারে ঘটি,বাটি থাকলেও তো ঠোকাঠুকি লাগে। সেখানে তো আমরা মেয়েজাতি।
-‘কোথায় হারিয়ে গেলে, ‘মাধুসোনা’?
এই মানুষটা গাঢ় কণ্ঠে ‘মাধুসোনা’ বলে ডাকলে প্রশান্তিতে মাধুর কলিজা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। একটু একটু পেটও কাঁপে। মাধু হেসে দিল। মন ভাল করা হাসি। বলল,
-‘খেয়েছেন?
-‘না। এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।
-‘সেকি! না খেলে শরীর খারাপ করবে তো।
-‘তোমার মন খারাপের কারণটা কী কোন ভাবে ‘আমি’ মাধুসোনা?
মাধু ঠোঁট নেড়ে বিড়বিড় করে বলল,
-‘আপনি বুঝেন না?’
অনুপম শুনতে পেল না। বলল,
-‘বলো না বউ?
-‘কী বলব?
অনুপম মন কেমন করা গলায় বলল,
-‘আমার না একটুও ভাল লাগছে না। ইচ্ছে করে সবকিছু ফেলে, একছুটে তোমার কাছে চলে যেতে। বিয়ে করে নতুন বউকে যদি কাছেই না পাই…অনুপম আর কথা বলতে পারল না। চাপা কষ্টে গলা বুঁজে এলো। মাধুর বুকের ভেতরও কাঁপন ধরেছে।
অনুপম আনমনে বলল,
-‘আমরা কেউ কাউকে কিছুদিন আগেও চিনতাম না, জানতাম না। অথচ এখন ছেড়ে থাকতেও খুব কষ্ট হচ্ছে। ভগবান, স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্কে কী এক অপার মায়া দিয়েই না বেঁধে রেখেছে। আচ্ছা মাধু তুমি কী আমাকে ‘ভালোবাসো?’
-‘জানি না।
-‘আমি বোধহয় তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। চোখ বুজলেও তোমাকে দেখছি, চোখ খুললেও তোমাকেই দেখছি।

নতুন কপোত-কপোতী প্রায় অর্ধরাত জেগে ফোনে কথা বলে কাটিয়ে দিল। কত না বলা গল্প, কত সুখ, দুঃখের গল্প যে দু’জনের মনের ভেতর জমেছিল!
একে তো অভ্যাস নেই। তারউপর রাত জাগার কারণে মাধুর মাথাব্যথা করছে। তবুও ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে গেল। বাড়িটা কেমন নীরব, নিস্তব্ধ। মনে হয় রেণুবালা এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। শুধু কলতলায় বিন্দুমাসির বাসনকোসন মাজার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
টুলু ঘুম ঘুম চোখে হাতে কাঁচি নিয়ে মাঠে যাচ্ছিল। মাধুর সামনে পড়তেই মাধু বোকা টুলুদাদাকে ক্ষ্যাপানোর জন্য, আঙুল নাচিয়ে নাচিয়ে, সুর করে বলল,

টুলু, টুলটুলিয়ে যায়।
টুলু হালকা দুদু খায়
টুলুর গলায় মাদুলি
টুলু, টুলটুকিয়ে যায়, টু….

টুলু ক্ষেপে ফেলে। রাগী চোখে তাকাল। মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ দিল। বিন্দুমাসি হেসেই উড়িয়ে দিল। টুলু কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,
-‘বৌদিমণি খুব খুব পঁচা।

মাধুর দিনগুলো এভাবেই কাটছিল। হাসি, মজা কখনো শাশুড়ী মায়ের কটু কথা শুনে, তীব্র মন খারাপ। অনুপম মাঝে মাঝে আসে দু’রাত থেকেই চলে যায়। বাবা কথায় কথায় একবার অনুপমকে বলেছিল, মাধুকে সাথে নিয়ে যেতে। মা যেন বাড়িতে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে নিয়েছিল।
রীতিমতো কেঁদেকেটে, না খেয়েদেয়ে অনশনে গিয়েছিল। সে এই সংসারের জন্য অনেক কষ্ট করেছে। আজ যখন একটু সুখের মুখ দেখেছে। পরের মেয়ে ঘরে এসে যখন দুটো ভাত রেঁধে খাওয়ায়। তখনই অনুপমকে বাবা-মায়ের কথা না ভেবে বউ নিয়ে যেতে হবে? রেণুবালা সারাদিন মাধুকে শাপশাপান্ত করত। পরে ভয় পেয়ে মাধুই আর অনুপমের সাথে যাওয়ার সাহস পায়নি।
ঘটা করে ছেলে দেখা হচ্ছে। ছেলে, ছেলের বাড়িঘর দেখে, সবার পছন্দ হয়েছে৷ খুব শীঘ্রই রিধীকার বিয়ে। দিনক্ষণ দেখে, ছেলেকে স্বর্ণের চেইন দিয়ে আশীর্বাদ করে এসেছে। ছেলে সরকারি চাকুরী করে। মাইনে ভাল। বেশ মোটা দাগের যৌতুক দিতে হবে। তাতে কী! মেয়েটা সুখী হলেই হয়।
রিধীকার গতকাল মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আজ বিয়ে।

নরমালি আমি কোন বিয়ে বাড়ি-টারি যাই না। তবে আমাদের পাড়ায় আজ, বিশাল ধুমধাম করে, রিধীকার বিয়ে হচ্ছে। ওদের বাড়ির চারপাশ ঘিরে, ডেকোরেশনের লোকেরা কী সুন্দর করে সাজিয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে পড়ার টেবিলে বসে কিংবা ছাদে গিয়ে, গাছ-গাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে, রিধীকাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সানাই বাজছে। বাঁশির করুণ সুর আমার ঘরের জানালা ভেদ করে মস্তিষ্কে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। পোলাও, ইলিশ মাছ, রোস্টের গন্ধ্যে চারপাশ ম ম করছে। রিধীকা আর আমি সেই ছোটবেলা থেকে একসাথে পুতুল খেলে, বড় হয়েছি। যদিও আমি ওর থেকে গুনে গুনে চার বছরের বড়। তবুও ও আমাকে তুই, মুই বলে ডাকে। যদিও আমার নামের শেষে ‘দা’ যোগ করে দেয়। কাকিমা মানে রিধীকার মা বার বার আমাকে বিয়েতে যেতে বলেছে।
দিনে যেতে একটু একটু লজ্জা লাগলেও রাতে যখন ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো বরের গাড়ি এসে ওদের গেইটের সামনে থামল। তখন আমি ঘর থেকে বের হলাম। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওদের ‘জামাইবরণ’ উৎসব দেখতে লাগলাম। রিধীকার বৌদিমণি, দিদিরা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরে নতুন জামাইবরণ করতে এসেছে। রিধীকার বর সাদা ধুতি, খয়েরী রঙের পাঞ্জাবি পরেছে, হাতে কালো ঘড়ি, কপালে চন্দনের ফোঁটা, মাথায় টোপর পরেছে। দেখতে খুব একটা মন্দ লাগছে না। বরযাত্রীরা গেইট দিয়ে ঢুকেই বউ দেখে, খাবারের টেবিলে চলে গেল। ভাবটা এমন! যেন তারা গাণ্ডেপিণ্ডে গিলতেই এসেছে। আমি নতুন বউকে যে ঘরে বসানো হয়েছে। সেই ঘরে গিয়ে খাটের এক কোণায় চুপটি করে বসলাম। রিধীকাকে মা দূর্গার মতো দেখতে, সুন্দর লাগছে। লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি পরেছে। গা ভর্তি সোনার গহনা। মাথায় টিকলি, নাকে নথ, কপালের মাঝখানে বড় লাল টিপের চারপাশে তিলকের নকশা আঁকা। চিকুন সরু ঠোঁটে খুব যত্ন করে লাল রঙা লিপস্টিক আঁকা। বড় বড় মায়াবী দু’চোখে মোটা করে কাজল টেনেছে। মাথায় বড় করে বউ ঘোমটা দেওয়া। হাতে শাঁখা, পলা। রিধীকাকে এই নতুন রুপে দেখে, বার কয়েক শুকনো ঢোক চিপলাম আমি। মনের ভেতর উত্তাল ঢেউ, বুকের ভেতর অসম্ভব কাঁপা-কাঁপি। কই আগে তো, ওর জন্য আমার এই রকম অনুভূতি হয়নি? রিধীকা আমাকে দেখে, একটুখানি মিষ্টি করে হাসল। দুষ্টুমি করে বলল,
-‘কী রে দেবুদা? তুই পড়ার টেবিল ছেড়ে এখানে কী করিস?
আমি লজ্জা পেয়ে চোখদুটো নামিয়ে নিলাম। পায়ে পা ঘষছি। ভাবখানা এমন। যেন আমার খুব শীত লাগছে! ভাল ছাত্র হওয়ার জন্য এলাকার মা, কাকিমাদের কাছে যেমন সুনাম আছে। তেমন কেউ পড়া না পারলে, আমাকে, আমার সমবয়সী সবার সাথে তুলনা দেয় দেখে, ওরা আড়ালে আমার বদনামও করে খুব। তাদের দলে রিধীকাও আছে।
ওর দাদারা রিধীকাকে আলপনা আঁকা পিঁড়িতে বসিয়ে, পান পাতা দিয়ে মুখ ঢেকে, বিয়ের আসরে নিয়ে গেল। আমিও পিছু পিছু গেলাম। পৌরোহিত মশাই মন্ত্র যপ করছে। রিধীকার বাবা কণ্যা সম্পদান করে উঠে গেল। রিধীকা যখন ওই লোকটার সাথে মালা বদল করল, তখন আমার বুকের ভেতর একটু একটু করে ভেঙে এলো। আমার এত কান্না পাচ্ছে। আর একটু হলেই জোরে কেঁদে দিতাম। কত কষ্টে যে নিজের আবেগ লুকিয়েছি! এখন মনে হচ্ছে বিয়েতে না এলেই ভাল হতো। এই মেয়েটাকে আমি কবে এতটা ভালোবেসে ফেলেছি?

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে