#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০৬
মাধু সারা বাড়িতে ধূপগন্ধী দেখিয়ে, রাতের রান্না সেরে, ঘরে যেতে যেতে রাত আটটা বেজে গেল। মাধু কোমড়ে আঁচল গুজে, ব্যাগ থেকে শাড়িগুলো নামাতে নামাতে বলল,
-‘মা খেতে ডাকে। তুমি চট করে খেয়ে আসো। আমি বরং এই দিকটা গুছিয়ে ফেলি।
অনুপম পেছন থেকে মাধুকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। মাধুর ঘাড়ে মুখখানা রেখে বলল,
-‘ এত দেরি করলে কেন, মাধুসোনা? তুমি চোখের আড়াল হলে, আমার আকুল হৃদয় বড্ড ছটফট করে যে!
মাধু মুখ টিপে বলল,
-‘ঢঙ।’
রাতে অনুপম ভরপেট খেয়েদেয়ে, ফুলবাবু সেজে, পাড়ার গলিতে, ব্যাডমিন্টন খেলতে গেল।
প্রায় ঘন্টাদুই যাবৎ অনুপম চোখের আড়াল হয়েছে। ওই ওতটুকু সময়ে, একা ঘরে মাধু কেঁদেকেটে একাকার অবস্থা। এই মানুষটা চোখের আড়াল হলেই মাধুর কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে। কিছুই ভাল লাগে না। মাধু কত করে মানা করল। কাল তো চলেই যাবেন! আজ আর কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। অবাধ্য মানুষটা মাধুর কথা শুনলে তো! এতটুকু সময়ে অনুপম দৃষ্টির অগোচরে গেলে সহ্য হচ্ছে না। অনুপম চলে গেলে, একা ঘরে কী করে থাকবে মাধু? মানুষটা তিনদিনে কী এমন জাদু করল মাধুকে?
রাতে ঘামার্ত শরীরে ঘরে ঢুকল অনুপম। জামা, জুতা টেনে টেনে খুলল। মাধু শুয়ে ছিল। অনুপমকে দেখে, ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। আড়চোখে অনুপমের খালি শরীরের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। ইশ, মানুষটা কেমন ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা। অনুপম, হাতমুখ ধুয়ে এসে মাধুর শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছল। মাধুর খুব অভিমান হলো। একদিকে যেমন অনুপমকে এত কাছে পেয়ে ভাল লাগছে। অন্যদিকে আগামীকাল চলে যাবে ভেবে, খুব কান্না পাচ্ছে। অনুপম, মাধুর হাতদুটো চেপে ধরতেই মাধু মোচড়ামুচড়ি করে ছাড়িয়ে নিয়ে পাশ ফিরে শুলো। অনুপম, মাধুর মুখের উপর ঝুঁকে পড়ল। মাধুর গালে ঠাণ্ডা হাত রেখে, গাঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘কী হয়েছে মাধু?
মাধুর কী যে কান্না পেল। অভিমান করে বলল,
-‘ছাড়ুন। আমি ঘুমাব।
অনুপম, মাধুর গালে নাক ঘষে বলল,
-‘উহুম..ছাড়ব না। বলো আগে, কী হয়েছে?
-‘কী হবে?
-‘বলো না মাধুসোনা?
-‘কাল তো চলেই যাবেন। এত করে মানা করলাম। আমার কথা উপেক্ষা করে, এতরাতে চলে গেলেন!
-‘রাগ করে না মাধুসোনা। এইতো আমি এসে গেছি।
মাধু চোখের কোণ মুছে বলল,
-‘সেই! আপনার প্রয়োজনে আপনি শুধু আমার কাছে আসেন।
-মাধু…তাকাও আমার দিকে?
মাধু পদ্মপুকুরের মতো মায়া কাড়া চোখ মেলে তাকাল। কারেন্ট নেই। মেঝেতে মোমবাতি জ্বলছে। মোম বাতির উষ্ণ আলোতে অনুপমের সুন্দর মুখপানে তাকিয়ে থাকতে কী যে ভাল লাগছে মাধুর। এই মানুষটা চোখের সামনে থাকলেই মাধুর সব অবসাদ, ক্লান্তি ম্যাজিকের মতে দূর হয়ে যায়। মাধু বিড়বিড় করে বলল,
-‘হে ভগবান.. আমার সবটুকু আয়ু দিয়ে এই মানুষটাকে বাঁচিয়ে রেখো তুমি।
কিশোরী মন। প্রথম প্রেম। সারাক্ষণ অনুপমকে নিয়ে কতকিছু ভেবে যায় মাধু।
ভাবনাতেও যেন সুখ সুখ অনুভূতি লুকিয়ে আছে।
রাতে খুব গভীর ভাবে মাধুকে নিজের করে পেতে চাইল অনুপম। স্বামী নামক মানুষটার সাথে যতই রাগ, অভিমান থাকুক। এত আকুল ভাবে ডাকলে, সারা না দিয়ে থাকা যায়? মাধুও নিজের বোকা বোকা রাগ, জেদের কাছে হেরে গিয়ে, অনুপমের ডাকে ধরা দিল, অন্যরুপে। গভীর ভালোবাসা ও কিশোরীর আকুতি ভরা অভিমান মিলেমিশে কেটে গেল দীর্ঘ রজনী।
পরদিন ঘুম থেকে উঠতে, মাধুর বেশ বেলা হয়ে গেল। একে তো অনুপমের ভালোবাসার তীব্র অনলে জ্বলতে জ্বলতে গভীর রাতে ঘুমিয়েছিল মাধু। তার উপর অনুপম কিছুতেই ভোরবেলা মাধুকে ছাড়তে চাইল না। মাধুকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে, মাধুর চুলে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে অনুপম। মাধু নড়াচড়া করতেই অনুপম বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘এত ছটফট করো না মাধুসোনা। আজ চলেই তো যাব। একটু বেশি সময়, আমার কাছে থাকো নাহয়!
এই কথার পর, আর কোন কথা চলে না।
মাধু খুব ভয়ে ভয়ে পা টিপে টিপে ঘরের দরজা খুলে নীচে নামল। রেণুবালা, মাধুর জন্যই মনে হয়, উঠোনে বসে অপেক্ষা করছিল। মাধুকে দেখে, ছুটে এলো। ছিঃ ছিঃ করতে করতে বলল,
-‘তুমি কেমন ধারা মেয়েমানুষ গো? আকাশে রোদ উঠে গেছে, অথচ তোমার বরের বিছানা ছাড়তে মনে চায় না। বেহায়া মেয়েমানুষ কোথাকার! আমার শাশুড়ী আমাদের সূর্য উঠার আগেই ঘুম থেকে তুলে দিত। একটু দেরি হলেই মুখে যা আসত, তাই বলত। বলি, এতবেলা করে, বরের কাছে শুয়ে থাকলে, বরের অমঙ্গল হয়। সে শিক্ষা দেয়নি? তোমার মা তোমাকে? ছিঃ ছিঃ তোমার বেহায়াপনা দেখে, আমারই নজ্জা (লজ্জা) করছে। যাও শিগগিরই স্নান সেরে রন্ধনঘরে যাও। বিন্দু বলে দেবেক্ষণ। কী কী রাঁধতে হবে।
রেণুবালা কথাগুলো কড়া কণ্ঠে বলেই পাড়া বেড়াতে চলে গেল। মাধুর খুব মন খারাপ হলো। লজ্জায় শাশুড়ীমায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেও সাহস পায়নি। মানুষটা কেন যে মাধুকে চোখ পেতে দেখতে পারে না। কে জানে!
অনুপম যাওয়ার সময়, মাধুকে সবার অগোচরে জড়িয়ে ধরেতেই, মাধু অনেকক্ষণ কাঁদল। অনুপমেরও মাধুকে ছেড়ে যেতে খুব খারাপ লাগছে। মাধুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘এই পাগলী এভাবে কাঁদে কেউ? আমি ছুটিতে আবার আসব তো! তখন তোমাকে নিয়ে হানিমুনে যাব।
-‘আমার কোথাও যাওয়া লাগবে না। শুধু আপনি পাশে থাকলেই হবে।
-‘আমার মনটা তো তোমার কাছেই রেখে যাচ্ছি মাধুসোনা।
অনুপম নীচু হয়ে গাল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘এখানে একটা ফাস্ট ক্লাস চুমু খাও তো মাধুসোনা..?
মাধু লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিল। বলল,
-‘ধেৎ,
-‘তুমি বিয়ের পর থেকে, এখন পর্যন্ত নিজে থেকে একবারও আমাকে আদর করোনি মাধুসোনা। আমি চলে গেলে কিন্তু খুব আফসোস করবা!
-‘উফ, চুপ করুণ তো আপনি।
-‘তাহলে আমার কথা রাখো?
-‘ না।
-‘বেশ তবে চলে গেলাম।
মাধুর বুকের ভেতর চাপা ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠল। অনুপমের শার্টের কোণা টেনে ধরল। অনুপম মুচকি হাসল। আবারও গাল বাড়িয়ে দিল। মাধু লজ্জাবতী পাতার মতো টলে গেল। ফিসফিস করে বলল,
-“চোখ বুজুন?
-‘ওকে মহারাণী।
অনুপম চোখ বুজতেই মাধু আলতো করে চুমু এঁকে দিল। অনুপম শক্ত করে মাধুকে জড়িয়ে ধরল। কপালে চুমু খেয়ে বলল,
-‘আসি বউ..?
মাধু, অনুপমের পিছুপিছু বাড়ির গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল। অনুপম বাবা-মাকে প্রমাণ করে সিএনজিতে উঠে বসল। মাধুর চোখদুটো ছলছল করছে। চোখের ঘন কালো পাপড়ি গুলো ভিজে উঠেছে। অনুপম চোখের আড়াল হতেই কী এক শূণ্যতা অনুভব করল মাধু। এই কষ্ট একজন নতুন বউই বুঝে। ভাঙা মন, মাথায় ভোতা অনুভূতি নিয়ে ঘরে ফিরল।
মাধু শুয়ে ছিল। রেণুবালা, মাধুর ঘরে এসে বলল,
-‘পরে পরে শুধু ঘুমালেই হবে বড়বৌমা? কত কাজ পরে আছে। বলি, সে খেয়াল আছে?
মাধুর এই মানুষটাকে দেখতেই ইদানীং খুব বিরক্ত লাগে আবার ভয়ও লাগে। মুখে কিছু বলল না। রেণুবালা বলল,
-‘নীচে গিয়ে সবাইকে খেতে দিয়ে দাও। তারপর আমার পা দুটোতে একটু তেল মালিশ করে দেবে।
মাধু মাথা নেড়ে উঠে গেল। মাথায় ঘোমটা টেনে বাবা, জেঠু, অনিকেত, রিধীকাকে খেতে দিল। দুদিন যাবৎ জেঠিমা বাবার বাড়ি বেড়াতে গেছে। জেঠুর এক ছেলে, বউ বাচ্চা নিয়ে বিদেশে থাকে। জেঠু সরকারি চাকুরীজীবি ছিলেন। অনেকবছর দেশের বিভিন্ন জেলা ঘুরে চাকুরী করেছে।
রিটায়ার্ড হওয়ার পর, মাস ছয়েক পৈতৃক ভিটায় এসে জেঠিকে নিয়ে থাকছে।
মাধু একহাতে সবার খাবার বেড়ে দিলেও নিজের খাবার বেড়ে খাওয়ার ভাগ্য হলো না। সবাই চলে যেতেই, রেণুবালা মাধুকে নিয়ে খেতে বসল। মাছের বড় মাথাটা গামলায় জ্বলজ্বল করছে। মাধুর খুব লোভ হলো। জিহবা ভিজে উঠেছে। রেণুবালা কেবলই মাথাটা নিজের পাতে তুলে নিতে যাবে। মাধু লজ্জামাখা কণ্ঠে বলল,
-‘মা.. মাথাটা আমায় দিবেন?
রেণুবালা ঠাস করে মাছের মাথা পাত্রে রাখল। মাধুর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাল। রাগে চিড়বিড়িয়ে বলল,
-‘মাছের মাথা খাবে কেন? এক কাজ করো, তুমি বরং আমার মাথাটাই খেয়ে ফেলো। তুমি এত লোভী ছিঃ.. তোমার মা তোমাকে ভালমন্দ খেতে দেয়নি কোনদিন? শ্বশুরবাড়িতে আসার আগে নিজের লোভী নোলাটা কেটে রেখে আসতে হয়।
মাধু অতিরিক্ত লজ্জায়, অপমানে একটা ভাতও আর খেতে পারল না। টপটপ করে ভাতের উপরে চোখের জল পরছে। এদিকে খাওয়া ফেলে উঠে যাওয়ারও সাহস পাচ্ছে না। আজ এই মুহূর্তে রেণুবালার তিক্ত কথাগুলো এতটাই আলোড়ন তুলল কিশোরী মনে। মনে মনে শপথ করল,
-‘ভগবানের দিব্যি, আর জীবনেও মাধু মাছের মাথা খেতে চাইবে না।
রেণুবালা, মাধুর সামনে বসে, বড় বড় হাঁ তুলে মনের সুখে মাছের মাথাখানা চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে।
মাধু ডাল বেগুন ভাজা আর ছোট একপিস মাছ দিয়ে কয়েক লোকমা ভাত বহুকষ্টে জল দিয়ে গিলে খেলো।
নিখিলেশবাবু মনের ভুলে খাবার ঘরের টেবিলে চশমাটা ফেলে গিয়েছিল। নিতে এসে দেখল। মাধুরা বউ, শাশুড়ী একসাথে বসে খাচ্ছে। হাসিমুখে এগিয়ে এসে দেখল, নিজের গিন্নী বড় মাছের মাথা ও একপিস মাছ নিয়ে গাপুসগুপুস খাচ্ছে। আর মাধু ছোট একপিস মাছ দিয়ে ভাত খাচ্ছে। খাচ্ছে কম নাড়াচাড়া করছে বেশি। নিখিলেশের মনটা তিতা বিষে ভরে গেল। বলল,
-‘বৌমাকে এত ছোট একপিস মাছ দিয়েছ কেন রেণু? বড় একপিস মাছ দাও?
রেণুবালা থমথমে গলায় বলল,
-‘কী বড়বৌমা দেব না কী আর এক পিস?
-‘না মা।
-‘দেখেছ তো ও খাবে না। আমি তোমার মায়ের মতো না। যে বাড়ির বউকে মাছ খেতে দেব না। আজ তো খুব খবরদারি করছ? যখন দিনের পর দিন আমরা মাছ ছাড়া ভাত খেতাম। কত রাত, ভাত ফুরিয়ে গেছে, বউদের জন্য আবার উনুন জ্বালা হবে না কী! এই অজুহাতে ভরপেট জল খেয়ে পার করতে হতো। তখন কোথায় ছিলে তুমি? কোনদিন তো তোমার মায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখিনি। আজ তবে তোমার ছেলের বউয়ের জন্য এত দরদ উথলে উঠছে কেন? ওর তো তাও ভাগ্য ভাল। কপালে মাছ জুটেছে। আর আমরা! রেণুবালা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল।নিখিনেশবাবু উত্তরে কিছু বলতে চাইল! মাধু হাত জোর করে, কিছু না বলার জন্য অনুরোধ করল।
আজ বাড়িতে যে মাধুর জন্য দুজনের মাঝে বিশাল ঝগড়া লাগবে। বেশ বোঝা যাচ্ছে। রেণুবালা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-‘এক রাক্ষসী মরতে না মরতেই আমার সোনার সংসারখানা, নিজের হাতের মুঠোয় নেওয়ার জন্য আরেক রাক্ষসী উদয় হয়েছে।
(চলবে)