#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০৫
মাধু, অনুপমের কাঁটা হাতখানা টেনে নিল। তাতে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল। ‘ইশ কতোখানি কেটে গেছে!’ মাধুর মায়াবী চোখদুটো ছলছল করে উঠল। ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকাল। অনুপম এতক্ষণ গভীর দৃষ্টি মেলে মাধুকেই দেখছিল! ঠোঁট নেড়ে দুটো লাইন গেয়ে উঠল।
”মধুর কিছু সময় যে জীবনে আসে”
গুন গুন করে ওঠে মন কত আবেশে”
ইশ, মাধু লজ্জায় শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখখানি ঢেকে ফেলল। অনুপম শোয়া থেকে উঠে বসল। কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা। আস্তে করে মাধুর মুখের উপর থেকে শাড়ির আঁচল খানা সরিয়ে দিল অনুপম। তারপর ডান হাতের একটা আঙুল দিয়ে ধীরে ধীরে মাধুর গালে আঁকিবুঁকি করল। অজানা উত্তপ্ত শিহরণে মাধুর সারা অঙ্গ জ্বলে গেল। মুখটা হেমন্তের ধান পাতার মতো আবেশে তিরতির করে কেঁপে উঠল। অতিরিক্ত লজ্জায় মাধুর দু’গাল ফুলে লাল টুকটুকে হয়ে গেল। অনুপম, মাধুর গালে ঠোঁট রেখে দীর্ঘ চুমু খেল। মাধু ছটফটিয়ে সরে যেতে চাইল। মাধুর যে ইদানীং কী এক অসুখ হয়েছে। এই মানুষটা দূরে গেলেও জ্বালা। আবার এত কাছে এলেও জ্বালা। মাধু, দিকদিশা না পেয়ে অনুপমকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে, ‘ওর’ পুরুষালি বুকে মুখ ডুবিয়ে, নিশ্বাসে টেনে নিল সেই মন কেমন করা বুনো ঘ্রাণ। অনুপম, ওই ভাবেই মাধুকে টেনে নিয়ে শুয়ে পরল। হাত বাড়িয়ে লাইটটা বন্ধ করে দিল। মাধুর কানের কাছে মুখ নিয়ে আবেগী কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
-‘আজ তোমাকে নতুন এক ভালোবাসার গোপন অধ্যায়ের সাথে পরিচয় করাব মাধু। প্রত্যেকটা স্বামী-স্ত্রী’র জীবনে এই অধ্যায়টা খুব স্পেশাল। এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করে। আশা করি, আমার উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে, আমার ভালোবাসার মর্যাদা দেবে তুমি। আজ যদি তুমি আমার সাথে গতকাল রাতের মতো বা বিয়ের রাতের মতো সিনক্রিয়েট করো, বাজে ব্যবহার করো। ভগবানের দিব্যি কেটে বলছি, আমি এই ভাবেই চলে যাব। আর জীবনেও এমুখো হবো না। মাধু মাথা নীচু করে রইল। খুব অনুশোচনা হচ্ছে! এই মানুষটা চলে গেলে, মাধু যে অর্ধপাগল হয়ে যাবে। সে খবর কী মানুষটা রাখে? রাখে না বোধহয়। রাখলে মাধুকে এত কঠিন কঠিন কথা বলতে পারত না। অনুপম আর সময় নিল না। মাধুকে পরিচয় করাল, নতুন এক ভালোবাসার গোপন অধ্যায়ের সাথে। এত স্বামী সুখও বুঝি মাধুর কপালে লেখা ছিল? ছিল তো। এই যেমন, অনুপমের অসহ্য ভালোবাসার আবেশে কিংবা তীব্র নীল ব্যথার মিশেলে মাধু নিঃশব্দ কাঁদছে।
খুব ভোরে মাধুর গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। মাধু অর্ধচেতন হয়ে বিছানায় পরে আছে। অনুপম খুব ভয় পেল। কাউকে ডাকারও সাহস পাচ্ছে না বেচারা। এদিকে বিছানায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে আছে। অনুপম নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘এ্যাঁই মাধু..? খুব বেশি কী খারাপ লাগছে তোমার? তুমি না ভোরে উঠে যাও? এভাবে শুয়ে থেকে, আমার ভয় আর বাড়িও না বউ?
মাধু চোখ পিটপিট করে তাকাল। অতিরিক্ত লজ্জায় অনুপমের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না বেচারি। লাজুক হেসে বলল,
-‘বিয়ে করলে এত কষ্ট পেতে হয় জানলে, জীবনেও বিয়ে করতাম না। পুরো শরীর ব্যথায় নীল হয়ে গেছে।
অনুপম ফিসফিস করে বলল,
-‘জীবনে প্রথমবার তো। তাই এমন লাগছে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
উত্তরে মাধু কিছু বলল না। শুয়েই রইল।
অনুপম কিছুক্ষণ মাধুর পাশে বসে থেকে, দরজা খুলে চলে গেল। খানিকবাদে বড়দি এলো। মাধুর কপালে হাত রেখে, বলল,
-‘প্রথম রাতেই জ্বর বাধিয়ে নিলি?
মাধু অভিমান করে বলল,
-‘তোর জন্যই তো। আমার এতবড় সর্বনাশ হয়ে গেল।
বড়দি রিনরিনে কণ্ঠে খিলখিলিয়ে হেসে দিল। বলল,
-‘কিছুদিন যাক। তারপর বুঝবি। এই পিরিতি কতটা মধুর।
-‘বড়দি….?
-‘বল?
-‘আগে মনে হতো, ওকে ছাড়া আমি থাকতেই পারব না। এখন মনে হচ্ছে, ও যত তাড়াতাড়ি ঢাকা চলে যাবে। ততই আমার জন্য ভাল।
-‘আহা..স্বামী কাছে না থাকলে কেমন শূণ্যতা যে লাগে বুনু। স্বামী কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পরেই বুঝবা। কতরাত যে ঘুমবিহীন জেগে জেগে, চোখের জল ফেলে কাটিয়ে দিতে হবে। তার কোন হিসেব নেই।
-‘ধেৎ. তুই একটু বেশি বেশি বলিস।
-‘নে এবার উঠে পর। জল গরম দিয়েছি। তুই স্নান সেরে নে। আমি চট করে চাদরটা ধুয়ে দেই। ততক্ষণে তুই কিছু খেয়ে, জ্বরের ও ব্যথার ঔষধ খেয়ে নে।
-‘আচ্ছা।
বড়দি চাদর ধুয়ে এসে মাধুকে জলখাবার দেওয়ার পর, এক গ্লাস গরম দুধ খেতে দিল। তারপর নিজে হাতে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে বলল,
-‘তুই বরং একটু ঘুমিয়ে নে। আমি একবাটি আঙুর ফল ধুয়ে দিচ্ছি।
নিয়ম অনুযায়ী, অনুপমের আজ জামাই বাজার করার কথা। তবে অনুপম সে ঝামেলায় গেল না। মাধুর হাতে হাজার বিশেক টাকা তুলে দিল। মাধু সেই টাকা নিয়ে বাবার হাতে তুলে দিল। বাবা নিতে চাইল না। বলল, -‘ তোর কাছে রেখে দে মা।’ মাধু জোর করে বাবার পকেটে টাকা গুলো গুঁজে দিল। মাধুর মা আশেপাশের সবগুলো বাড়ি দুপুরে জামাই বাজার খাওয়ার জন্য নেমন্তন্ন দিয়ে এলো।
রিধীকা, ঝর্ণারানীর পাশে বসে গল্প করছে। অনুপম উঠানে চেয়ারে বসে রোদ পোহাচ্ছে। টুলু বাবার সাথে বাজারে গেছে। আর মাধু বড়দির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। পাশে বড়দির ছোটবাবুটা মৃদু নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
বাবা বাজার থেকে অনেককিছু কিনে নিয়ে এলো। বড় বড় কাতলামাছ, দেশী ছোট মাছ, ইলিশমাছ, খাসির মাংস, সাতটা আস্ত মুরগী কেটে এনেছে, সব ধরনের সবজি, দুধ, গুড়। আর কতকিছু।
দুপুরে সবাই জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া করল।
বিকালে মাধুর বান্ধবীরা সব দলবল বেঁধে গল্প করতে এলো। মাধুকে সুন্দর শাড়ি, গহনা পরে রাণীর মতো সেজেগুজে থাকতে দেখে বলল,
-‘মাধু বিয়ের পর তুই অনেক পাল্টে গেছিস রে!
মাধু চোখ বড় বড় করে বলল,
-‘মোটেও পাল্টে যাইনি আমি।
-‘নারে মাধু.. তুই সত্যিই পাল্টে গেছিস। বিয়ের পর সবাই কেন পাল্টে যায় বলত?
-‘বললাম তো আমি পাল্টে যাইনি রে বাবা।
-‘তাহলে প্রমান দে?
-‘ কী প্রমাণ চাই, তোদের বল?
-‘ওই বড় মাঠে গিয়ে আমাদের সাথে লাফঝাঁপ খেলবি।
মাধু, অনুপমের দিকে এক পলক তাকাল। অনুপম ইশারায় খেলতে মানা করল। মাধু মলিন হেসে বলল,
-‘অন্য একদিন খেলব কেমন?
-‘ঠিক ধরেছিলাম। তুইও বাকি সবার মতো পাল্টে গেছিস। আচ্ছা এসব কথা ছাড়। তুই সুখে আছিস তো মাধু?
মাধু মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলতে চাইল! হঠাৎই রেণুবালার কথা মনে পড়ে গেল। মানুষটা হয়ত সবার সামনে মাধুকে কিছুই বলে না। তবে সবার অগোচরে অনেক কটুকথা শোনায়, ভালমন্দ রান্না হলেও খেতে দেয় মেপে মেপে। রেণুবালার করা ব্যবহারে মাধু খুব কষ্ট পায়। তবে লজ্জা বা ভয়ে কাউকে কিছু বলার সাহস পায় না।
মুখে বলল,
-‘আমি অনেক সুখে আছি রে।
সন্ধ্যা পর্যন্ত আড্ডা চলল। তারপর যে যার বাড়ি চলে গেল।
আজ রাতে আর মাধুকে জোর করা লাগল না। মাধু নিজে থেকেই অনুপমের ডাকে সারা দিল। দুটো সত্যার প্রেম বিনিময় হলো গভীর ভাবে। স্বর্গ সুখ কিংবা সুখের সাগর বুঝি একেই বলে। দুজনের মনেই উষ্ণতার আবেশের রেশ থেকে যায় অনেক, অনেকক্ষণ।
মাধুরা আজ চলে যাবে। ঝর্ণারানী রান্নাবান্নার চাপে দুদণ্ড মেয়েকে সময় দিতে পারেনি। সকাল থেকেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে চোখ মুছছে। মাধুটা সারাক্ষণ হৈ হৈ করে বাড়ি মাতিয়ে রাখত। মেয়েটা চলে যাওয়ার পর থেকেই ঝর্ণারানীর কিছুই ভাল লাগে না। মাধু পেছন থেকে আচমকা মাকে জড়িয়ে ধরল। ধরে রইল অনেকক্ষণ। ঝর্ণারানী চোখ মুছে বলল,
-‘দেখি সর..?
-‘না।
-‘মাধু..?
-‘শাশুড়ীরা কখনো মা হয় না। তাই না মা?
ঝর্ণারানী চিন্তিত মুখে বলল,
-‘হঠাৎ একথা বলছিস কেন? কিছু কী হয়েছে?
-‘না মা। এমনিই বললাম।
-‘মাধু.. কিছু হয়ে থাকলে আমাকে বল?
-‘কী হবে?
-‘কিছু তো অবশ্যই হয়েছে।
-‘ আরেহ্.. তুমি যা ভাবছ তা নয়। ওই আমি কাজ না পারলে একটু বকাঝকা করে।
-‘ওহ.. এই ব্যপার! সে তো আমিও করতাম।
-‘তুমি আমাকে বকলে আমার একটুও খারাপ লাগত না। কিন্তু ওনি আমাকে অল্প একটু বকলেও আমার খুব খারাপ লাগে। কান্না পায়।
-“নারী জাতটা হলো, জলের মতো তরল পদার্থ মা। তাকে যখন যে পাত্রে রাখা হয়। সে তখন সেই রুপ ধারণ করে।” তারাই এখন তোমার আপনজন। তাদের মন থেকে আপন করে নে। দেখবি আর খারাপ লাগবে না।
মাধু আনমনে সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকাল।
আজও মাধু বিদায়বেলা প্রচুর কাঁদল। ঝর্ণারানী চোখের জলে মেয়েকে বিদায় দিল। এই চেনা পথঘাট, চেনা নদী, চেনা বাড়িঘর গুলো একটু একটু করে চোখের আড়াল হতেই মাধুর কিশোরী অবুঝ মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেল। অনুপম সারাটা পথ মাধুর একহাত শক্ত করে ধরে রইল।
বাড়িতে এসে যে যার ঘরে চলে গেল। মাধু একটু বিশ্রাম নিয়ে নীচে নামতেই রেণুবালা বলল,
-‘খুব তো বেড়ালে মা। এবার সন্ধ্যে নামার আগে আগে রাতের রান্নাটা সেরে ফেলো তো বাপু!
অনুপম, মাধুকে খুঁজতে খুঁজতে নীচে এসে বলল,
-‘মাধু তুমি এখানে কী করছ? আমি কাল ঢাকা ফিরব। শিগগিরই ব্যাগ থেকে তোমার শাড়িগুলো নামিয়ে ফেলো। আমি জামা-কাপড় গোছাব।
রেণুবালা একগাল হেসে বলল,
-‘আর বলিস না। কত করে বললাম, বড়বৌমা সবে এলে একটু বিশ্রাম নাও। না সে না কী এখন রাঁধবে! তোর বউকে নিয়ে আমি আর পারি না বাপু। যাও.. যাও.. সোয়ামী ডাকলে হাতের কাজ ফেলে জলদি যেতে হয়। আমার আবার কোমড়ের ব্যথাটা বেড়েছে।
অনুপম বলল,
-‘আচ্ছা তুমি তাহলে রাতে আমাকে ব্যাগ গুছিয়ে দিও। এখন মায়ের হাতে হাতে রান্নাটা সেরে নাও।
(চলবে)