লজ্জাবতী পর্ব-০৪

0
526

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০৪

অনুপম, মাধুকে নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক বোঝাল, হাত টানাটানি করল। মাধু কিছুতেই অনুপমের সাথে যাওয়ার সাহস পেল না। অনুপম চট করেই মাধুকে কোলে তুলে নিল। কণ্ঠে রাগ ঢেলে বলল,
-‘ বেশি ছটফট করলে এক আছাড় মেরে ফেলে দেব কিন্তু?
মাধু পদ্মপুকুরের মতো স্বচ্ছ টলমলে চোখে, অনুপমের মুখপানে তাকাল। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে একরাশ মুগ্ধতা।
অনুপম নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে, ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। মাধু আঁতকে উঠল। আবারও অনুপমকে এত কাছে পেয়ে, সেই চিড়বিড়ে শরীর কাঁপানো শিহরণে মাধুর মস্তিষ্ক বিবশ হয়ে গেল। কই, আগে তো কারো জন্য মাধুর এত অস্থির লাগেনি? মাধুর পনেরো বছরের জীবনে, এই প্রথম নতুন সুখ সুখ অনুভূতির সাথে পরিচিত হলো মাধু। কে জানে এর শেষ কোথায়?
অনুপম আলমারি খুলে কী যেন বের করল। তারপর হাত দুটো পেছনে লুকিয়ে মাধুর খুব কাছে চলে এলো। যতটা কাছে এলে, একে অপরের গরম নিঃশ্বাসের আবেশে মাতাল হওয়া যায়। ঠিক ততটা কাছে। মাধু হাত দিয়ে শাড়ি মুঠো করে চেপে ধরল। দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। অনুপম, মাধুর মুখে আলতো করে ফুঁ দিল। মাধু আবেশে চোখদুটো বুঁজে ফেলল। অনুপম ফিসফিস করে বলল,
-‘আমি না বলা পর্যন্ত চোখদুটো খুলবে না, প্লিজ?
মাধু ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা ঝাকাল। খোলা জানালার ভেতর দিয়ে এক ঝাপটা বাতাস এসে মাধুর চোখেমুখে উপচে পরল। মাধুর চোখের পাঁপড়ি তিরতির করে কেঁপে উঠল বোধহয়। রীতিমতো অতিরিক্ত লজ্জায় মাধুর ভেতরে ভুমিকম্প শুরু হয়েছে।
কোত্থেকে একঝাঁক রঙিন প্রজাপ্রতি মাধুর কানে কানে বলে গেল।
”অনুপমের তীব্র ভালোবাসার স্বর্গসুখে তুই মরেই যাবি রে মুখপুরী।”
অনুপম প্রথমে মাধুর ডামহাত টেনে নিল। তারপর মধ্যেমা আঙুলে একটা স্বর্ণের আংটি পরিয়ে দিয়ে তাতে গভীর চুমু এঁকে দিল। মাধুর দুইহাতে দু’মুঠো লাল টুকটুকে রেশমি চুড়ি পরিয়ে দিল। হাত ছেড়ে দিয়ে, হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসে পরল। মাধুর এক পা নিজের হাঁটুর উপরে রাখল। মাধু একচোখ খুলে খুব সাবধানে তাকাল। অনুপম দেখার আগে আবারও চোখদুটো শক্ত করে বুঁজে ফেলল। অনুপম, মাধুর দু’পায়ের আঙুলে রুপোর দুটো আংটি পরিয়ে দিল। এক পায়ের পাতায় চুমু খেতেই, মাধু তাড়াহুড়ো করে পা সরিয়ে নিল। মুখে হাত চেপে ধরে বলল,
-‘ছিঃ ছিঃ কী করছেন? আমার পাপ হবে তো?
অনুপম মাছি তাড়ানোর মতো মাধুর কথা হেসেই উড়িয়ে দিল। বলল,
-‘ধেৎ, এগুলো কুসংস্কার বউ। কোথাও শুনেছ, স্বামীর আদর সোহাগে বউয়ের পাপ হয়?
উত্তরে মাধু কিছু বলতে চাইল! অনুপমের বলার ধরণে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল।
অনুপম খাটে আরাম করে বসল। মাধুকে একটানে নিজের কোলের মাঝে বসিয়ে দিয়ে দু’হাতে শক্ত করে কোমর জড়িয়ে ধরল। মাধুর ঘাড়ে মুখ রেখে বলল,
-‘হাতে ছুটি কম। কালই আমরা অষ্টমঙ্গলায় শ্বশুরবাড়ি যাব। এখানে তো তোমাকে শত ডাকাডাকি করেও কাছে পাওয়া যায় না। আমাদের জীবনের এত মূল্যবাণ সময় আমি হেলায় ফেলায় শেষ করতে চাই না।
-‘আপনার মাকে বলেছেন?
-‘বাবাকে বলেছি।

বাবার বাড়ি যাবে। সেই আনন্দে সারারাত মাধুর ঘুম হলো না। দুদিন মাধু বাড়ি ছাড়া। অথচ মনে হচ্ছে, দুইযুগ পেরিয়ে গেছে। অনুপম গভীর রাতে মাধুকে কাছে টানল। অনুপমের তীব্র ভালোবাসার প্রতিফলণ দেখে, মাধু খুব ভয় পেল। সরে যেতে চাইল। অনুপম আর একটু শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরল। মাধু দিক-দিশা না পেয়ে অনুপমের ঘাড়ে, হাতে, জোরে কামড় বসিয়ে দিল। এত জোরে কামড় দেওয়াই রীতিমতো হাত কেটে রক্ত পরছে। মাধু শব্দ করে কেঁদে দিল। অনুপম অভিমান করে মাধুকে ছেড়ে দিল। কাঁটা জায়গা হাত বুলিয়ে পাশ ফিরে শুলো। মাধু আর অনুপমকে ডাকার সাহস পেল না। ইশ,মানুষটার কতোখানি হাত কেটে গেছে। মাধুই বা কী করবে? এত জোরে চেপে ধরায় মাধুর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মাধু টিভিতে দেখেছে, মুভিতে ভিলেনরা এইভাবে নায়িকার সাথে ধস্তাধস্তি করে। নায়িকার শাড়ি খুলে লজ্জা হরণ করে। অনুপম, মাধুর ‘বর’ হয়ে কেন মাধুর সাথে এত খারাপ আচরণ করবে? কাল বাড়ি গিয়ে এই বিষয়ে বড়দিকে বলতে হবে। এত কিছুর পরও মানুষটা মাধুর থেকে আঘাত পেল। কেন যেন একটুও ভাল লাগছে না। খুব কান্না পাচ্ছে।
আজও খুব ভোরে মাধুর ঘুম ভাঙল। ঘুম থেকে উঠেই একা একা পুকুরপাড়ে গিয়ে স্নান সারল। অনুপম যদিও গতকাল মানা করেছিল! বুঝ হওয়ার পর থেকেই পুকুরে স্নান করার অভ্যাস মাধুর। তোলা জলে স্নান করতে ইচ্ছে করল না। মাধু যখন ভেজা কাপড়ে চুপিচুপি বাড়ি ঢুকল। বিন্দুমাসি কলতলায় বাসনপত্র মাজাঘষা করছিল। মাধুকে দেখে লজ্জামাখা হাসি দিল। মাধুও একটু হাসি বিমিময় করে। স্নানঘরে গিয়ে কাপড় পাল্টে নিল।
অনুপমদের পুরোনো আমলের দুইতলা বাড়িটা গ্রামে ঢোকার মুখেই পরে। বাড়ির সামনে বিভিন্ন ফুল, ফলের বাগান। বাগানের মাঝখান দিয়ে একটু হেঁটে গেলেই বড় গেইট। গেইটের সামনে ইট বিছানো রাস্তা। বাড়ির পেছনে বিশাল খেত। খেতে সব ধরনের ফসল ফলে। বর্ষায় জোয়ারের পানি এসে যদিও খেতগুলো সব ডুবে যায়। পানি শুকিয়ে পলিমাটি জমলে কৃষকরা মনের সুখে বিভিন্ন শস্যর বীপ বপন করে।
বাড়ির অনেকখানি উঠোন জুড়ে পাঁকা করা। বিকালে সব মেয়ে বউরা দলবল বেঁধে গল্প করতে আসে। ধান, সরিষা শুকাতে আসে। মাধু তার সাজার সরঞ্জাম নিয়ে গিয়ে পা’দুটো মেলে রোদে বসল। মুখে ক্রীম মেখে, মাথা ভর্তি সিঁদুর পরল, কপালের মাঝখানে লাল টিপ পরে, খোঁপা খুলে লম্বা চুলগুলো রোদে শুকাতে দিয়ে, পায়ে সময় নিয়ে আলতা পরল।
রেণুবালা উঠোনে এসে বলল,
-‘শুধু পটের বিবি সাজলেই হবে বড়বৌমা? রন্ধনঘরে কতকাজ পরে আছে। সে খেয়াল আছে?
-” কী করতে হবে মা?
-‘বলে বলে তোমাকে কয়টা কাজ করাব মা? সকালে ডাল, নুচি (লুচি) করতে হবে। ডাল রেঁধে নুচি ভেজে ফেলো। আর হ্যাঁ আজ তো তোমরা অষ্টমঙ্গলায় যাবা। উনুন নিভিয়ে দিও না। একটু ফুলকপি দিয়ে রুইমাছের পাতলা ঝোল, চালতা দিয়ে টকডাল, আর ছোট মাছের চচ্চড়িটাও রেঁধে ফেলো তো বাপু। যদিও তোমার রাঁন্ধা খুব একটা ভাল হয় না। তবে খাওয়া চলে! আমার আবার কোমড়ের ব্যথাটা খুব বেড়েছে। নাহলে এ আর এমন কী কাজ! আমিই করে নিতুম!
-‘বিন্দু..?
-‘গিন্নীমা আমারে ডাকিয়াছেন?
-‘তুই বরং উনুন জ্বেলে দে! বৌমাকে কী কী রাঁধতে হবে, বলে দিয়েছি। তুই সব কেটেকুটে রেডি করে দে। এই ফাঁকে আমি একটু পাড়া বেড়িয়ে আসি।
বিন্দু বিড়বিড় করে বলল,
-‘ইতিহাসের পূর্ণাবৃত্তি হইতেছে।

শীতেরদিন, ছোট বেলা। এতকিছু রাঁধতে রাঁধতে বেলা বারোটা বেজে গেল। ভাগ্যিস মা সেই ছোটবেলা থেকে সবকাজ মাধুকে হাতে ধরে শিখিয়েছিল। তাছাড়া মাধুর গায়ের গড়ন সুন্দর। ওর যে এতকম বয়স বোঝা যায় না। তবে বোধ-বুদ্ধিতেই যা একটু পিছিয়ে।
অনুপমের সাথে রাতের পর আর কথা হয়নি। সকালে খেতে এসে এক’দুবার চোখাচোখি হয়েছিল। মাধু তাকাতেই অনুপম চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। মানুষটার মুখটাও কেমন শুঁকনো। খাওয়ার সময় মাধুর খাওয়া হয়েছে না কী একবারও খোঁজ নেয়নি। মাধুও জেদ করে সকালের জলখাবার খেলো না। দুপুরে বউ, শাশুড়ী মিলে সবাইকে খেতে দিয়ে, মাধুরা তিনজন শেষে খেতে বসল। মাধু, রেণুবালা আর বিন্দুমাসি। আজকে অবশ্য মাধুর ভাগ্যে মাছ জুটেছে। তবে লেজের আগের ছোট পিস। মাধু ক্ষুধার্ত পেটে তাই দিয়ে সোনামুখ করে খেয়ে নিল। কোণা চোখে একবার শাশুড়ী মায়ের থালার দিকে তাকাল। মাছের বড় লেজটা আর একপিস মাছ নিয়ে কী তৃপ্তি করেই না খাচ্ছে মানুষটা। মাধুর প্রচণ্ড লোভ হলো। ইশ, এভাবে বড় বড় দু’পিছ মাছ নিয়ে, যদি মাধুও খেতে পারত! মাধুর আজও খুব মন খারাপ হলো। মা সব সময় বলত,
‘শাশুড়ীরা মায়ের মতো হয়। তাদের সব সময় সম্মান দিয়ে কথা বলবি। তারা যা-ই বলুক! বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নিবি। কখনো মুখে মুখে তর্ক করবি না। কখনো যদি শ্বশুরবাড়ি থেকে তোর নামে নালিশ আসে। তোর বাবা কিন্তু জীবনেও ওমুখো হবে না।” শাশুড়ীরা যদি সত্যিই মায়ের মতো হয়! তাহলে কেন সে কখনো মাধুকে ভাল খাবার খেতে দেয় না? সব সময় বৈষম্য করে। কাল বিকালে মাধুকে ঘর মুছতে দিয়েছিল। মাধু পরিষ্কার করে মুছতে পারেনি দেখে, বলল,
-‘তুমি এত নোংরা কেন বড়বৌমা? তোমার মা কিছু শিখায়নি? মাধু একটাও কথা বলেনি। মাথা নীচু করে তার অভিযোগ গুলো শুনেছে। মাধুর সেই চঞ্চল, ছটফটে সত্যাটাও যেন ধীরে ধীরে কোথায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
রেডি হয়ে বের হতে হতে বিকাল গড়িয়ে গেল। মাধুর সাথে অনুপম, রিধীকা, আর টুলু গেল। অনুপমের ছোট ভাই অনিকেত এবার ইন্টার ফাস্ট ইয়ারের পরীক্ষা দিচ্ছে। ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও সাথে যাওয়া হলো না। রিধীকা পড়ে ক্লাস টেনে আর টুলু ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ে, পড়াশোনা বাদ দিয়েছে। ওর না কী পড়তে একটুও ভাল লাগে না। একটু সহজসরল তবে লাজুক। যে যা বলে চট করেই বিশ্বাস করে নেয়। বয়স আনুমানিক সতেরো বছর। অনুপমের বাবা অনেক ফল মিষ্টি কিনে টুলুর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। একটা সিএনজিতে করে ওরা সবাই মাধুদের বাড়ি যাচ্ছে।

অনুপম গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে যখন মাধুদের উঠানে দাঁড়াল। তখন মাধুর সব বান্ধুবী, কাকাতো, জ্যাঠাতো ভাই, বোনেরা অনুপমকে ঘিরে ধরল। হাসিমুখে বলল,
-‘নতুন জামাইকে তো খালি হাতে ঘরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।
অনুপমও মজা করে বলল,
-‘আমি কিন্তু কোন টাকা দিতে পারব না শালীরা..!
-‘সেক্ষেত্রে দুটো অপশন আছে।
-‘দ্বিতীয় অপশনটা তাহলে বলুন, শুনি?
-‘আগে এখানে বসুন তো!
সুন্দর নঁকশা আঁকা পিঁড়িতে মাধু, অনুপম বসল। উঠানেও খুব সুন্দর করে আলপনা দেওয়া হয়েছে। বরণডালা, ফল মিষ্টি সবই আছে। মাধুর মা, কাকীমা জামাইকে ধান, দূর্বা দিয়ে বরণ করে, নবদম্পতিকে মন ভরে আশীর্বাদ করল। মুরুব্বিরা সরে যেতেই আবারও মাধুর বোনেরা ঘিরে ধরল অনুপমকে। একটা বেগুন অনুপমের সামনে রেখে বলল,
-‘এই বেগুনটা এক কোপে তিন টুকরো করলেই আর কোন টাকা দিতে হবে না। বউকে কোলে নিয়ে তড়তড়িয়ে শ্বশুরবাড়ি ঢুকে যাবেন। অনুপম ভেবে ভেবে অস্থির। এক কোপে কীভাবে বেগুন তিন টুকরো করা যায়। অনুপমের কেন যে একটা বড়বোন নেই। জামাইবাবুরা এই ব্যপার গুলো খুব ভাল বুঝে। অনুপম তার বন্ধুদের বিয়েতে গিয়ে দেখেছে, জামাইবাবুরা চট করেই একটা সমাধান দিয়ে দেই। অনুপম অনেক ভেবেও যখন ঠাহর করতে পারল না। তখন ভাবাভাবিই ছেড়ে দিয়ে। চুপচাপ বসে বসে দুটো মিষ্টি খেলো। মাধু, অনুপমের পেটে গুতো দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-‘সামান্য কয়টা টাকাই তো চেয়েছে। দিয়ে দেন না। এভাবে বসে থাকতে পা ব্যথা করছে।
-‘ওকে। আমার বউ যখন বলেছে, তখন দিতেই হয়। তবে এক শর্তে!
সবাই একসাথে চিল্লিয়ে বলে উঠল।
-‘কী শর্ত জামাইবাবু?
-‘এই বেগুনটা তোমরা এক কোপে তিনটুকরো করে দেখাও। তবেই টাকা দেবো।
মিতালি এগিয়ে এলো। একটা স্টিলের গ্লাস নিয়ে বেগুনের মাঝখানে চেপে ধরল। খুব সহজেই বেগুনটা তিনটুকরো হয়ে গেল।
অনুপম বিড়বিড় করে বলল,
-‘ডেঞ্জারাস। কেবল তো শুরু। কে জানে সামনে আরও কী কী অপেক্ষা করছে।

বাড়িতে প্রথম নতুন জামাই এসেছে। সেই উপলক্ষে মাধুর মা ঝর্ণারানী কতকিছু যে রান্না করেছে তার কোন হিসেব নেই। প্রথমে পাঁচ পদের পিঠা, পায়েস, দই মিষ্টি খেতে দিল। এগুলো খেতেই তো অনুপমদের পেট ভরে গেল। ভাত খাবে কী! শ্বশুরবাড়িতে এসে অনুপম, মাধুকে নিয়ে এক থালায় খাচ্ছে। অথচ নিজের বাড়িতে মাধু কী খেল না খেলো খোঁজও নেয় না অনুপম। মাধুও মায়ের হাতের বানানো পিঠেপুলি খুব তৃপ্তি করে খেলো। রাতে ভাত খেতে বসে মনে হলো, কতগুলো দিনপর মাধু মাছের বড় টুকরো দিয়ে ভাত খাচ্ছে। মাত্র দুইদিন ছয়বেলা মাধুকে, রেণুবালা খেতে দিয়েছে। তাতেই এমন অনুভূতি হচ্ছে।
মাধুরা দুইবোন। কোন ভাই নেই। বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। মাধু ছোটবেলা থেকেই কখনো খাওয়া, পড়ার অভাব বুঝেছি। হয়ত অনুপমদের মতো অতবড় বাড়ি নেই, অত টাকাও নেই মাধুদের। তবে মা-বাবা খুব আদর করে দুবোনকে পেলেপুষে বড় করেছে। বড়দিরও বছর পাঁচেক আগে বিয়ে হয়েছে। এক বছরের একটা ছেলেবাবুও আছে। জামাইবাবু বিয়েতে থাকলেও অষ্টমঙ্গলায় থাকতে পারেনি। ছুটি নেই দেখে বড়দিকে রেখে চলে গেছে। জামাইবাবু বিজিবিতে আছে। বড়দি শ্বশুরবাড়িতে বাচ্চা নিয়ে থাকে।
মাধু বড়দির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। কালরাতে অনুপম, মাধুর সাথে কী কী করেছে। সব খুলে বলল। অনুপমকে নিয়ে তার মনোভাব কী তাও বলল। সব শুনে বড়দি হেসে দিয়ে বলল,
-‘তুই কী পাগল মাধু? এভাবে বরের হাত কামড়ে কেউ রক্তাক্ত করে দেয়? তোর বর কী তোকে ফুলদানিতে সাজিয়ে রেখে, তিনবেলা পূজা করার জন্য, বিয়ে করেছে? তারও তো তোকে ঘিরে কিছু চাওয়া পাওয়া আছে। পুরুষ মানুষের মন ঘুরে যাওয়ার আগেই পুরুষ মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে হয় রে মুখপুরী। তার মন ঘুরে গেলে, পরে কেঁদেও কূল পাবি না। সে তোকে ভালোবেসেই কাছে টেনেছিল। তার ভালোবাসাকে তুই কেন পায়ে ঠেলে দিলি?
-‘আমিই বা কী করব? ওমন করে কাছে আসলে ভয় করে। খুব লজ্জাও করে।
-‘আর সুখ?
মাধু আনমনে বলল,
-‘তাকে দেখলেই তো আমার দু’চোখ জুড়িয়ে যায়। সব সময় তার আশেপাশে থাকলে সুখ সুখ অনুভূতি হয়।
বড়দি বলল,
-‘আর এই ভুল করিস না। অনুপম তোকে যেভাবে, যে রুপে চাইবে। তুই তাকে সেই ভাবে, সেই রুপেই ধরা দিবি। স্বামীকে নিজের সবটা উজার করে দেওয়ার মাঝেই তো মেয়েদের প্রকৃত সুখ লুকিয়ে আছে।

মাধুকে, বড়দি খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। ঘরে গিয়ে দেখল, অনুপম চোখের উপরে একহাত রেখে শুয়ে আছে। মাধু পায়ে ছন্দ তুলে সারাঘর হাঁটল। রিনিঝিনি নূপুরের শব্দে অনুপমের তন্দ্রা ভাব ছুটে গেল। মাধুর দিকে এক পলক পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। মাধুকে এই রুপে দেখে, অনুপমের মাথা ঝিমঝিম করছে। চোখ ফেরানো দায়। মাধু, অনুপমের গা ঘেঁষে বসল। মুখে মিষ্টি হাসি টেনে বলল,
-‘আমাকে কেমন লাগছে? প্রশান্তিতে
অনুপমের দু’চোখ জুড়িয়ে গেল, মন ভরে গেল। বুক দুরুদুরু করছে। ধেৎ পুরুষ মানুষের আবার বুক ধুকপুক করে না কী? অনুপমের করছে তো! ঠোঁট নেড়ে বিড়বিড় করে বলল,
-‘এত অস্থির ভাবে বধূসাজে কেউ?’

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে