বাসায় এসে দ্রুত হাতে ভেজা কাপড়গুলো ধুঁয়ে পরিস্কার কাপড় পরে নামাজে দাঁড়ান জামান সাহেব।
‘ হে আমার প্রতিপালক, যে লজ্জা থেকে আজ ঐ অপরিচিত মেয়েটা আমায় বাঁচিয়েছে তাকে আপনি দুনিয়া এবং আখিরাত দুই জাহানে সম্মানিত করবেন। আর আমাকে আপনি সুস্থ করে দিন।’
নামাজ শেষে মেয়েটার দেয়া কার্ডের পেছনে লেখা নাম্বারে ফোন দেন জামান সাহেব। সন্ধ্যা সাতটায় এপয়েন্টমেন্ট পান ডা সালেহীনের সাথে।
আটষট্টি বছরের জামান সাহেব থাকেন তার ছেলের সাথে ছেলের তিন বেডরুমের আধুনিক এপার্টমেন্টে। বছর দুয়েক আগে স্ত্রী মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি আলাদা বাসা নিয়েই থাকতেন। কিন্তু একবার একাকী বাসায় হঠাৎ করে পরে গিয়ে মাথায় ব্যথা পাওয়ার পর থেকে ছেলে এক প্রকার জোর করেই তার বাসায় নিয়ে এসেছে। নতুন জায়গায় সেভাবে কারো সাথে বন্ধুত্বও হয়ে ওঠেনি। অন্য কোন বড় ধরনের শারিরীক অসুবিধা না থাকায় কোন ঔষধপত্রও খেতে হয়না তাকে। ছেলের বৌ লুবনা মেয়ে হিসেবে বেশ ভালো। নিজের অফিস, সংসার সামলেও শ্বশুরের সব যত্নআত্তি ও বলতে গেলে নিজ হাতেই করে।
নানা শহরে ঘুরে ঘুরে চাকুরীর কারণে ছেলের সাথে কখনোই খুব একটা কাছের সম্পর্ক কেন যেন হয়নি জামান সাহেবের। এমন না যে ছেলে বাবার খোঁজ করেনা বা কোনরকমে দায়সারাভাবে বাবার সাথে থাকে। তবু কোথায় যেন একটা দূরত্ব কাজ করে যেটা জামান সাহেব নিজেকে দিয়েই বোঝেন। এই যে ওনার প্রস্রাবের সমস্যাটা গত দু বছর ধরেই তা ছেলেকে বলতে পারলেন কই? রাতে এতোবার উঠে টয়লেটে যেতে হয়, দিনেও কি স্বস্তি মেলে। দৌড়ঝাঁপ দিয়ে যদিও টয়লেটে যান কিন্তু প্রস্রাব হয় সামান্যই। ডায়াবেটিস কিনা ভেবে নিজে নিজেই মোড়ের কেমিস্টের কাছে গিয়ে চেক করে এসেছেন। না ব্লাড সুগার নরমাল এসেছে। কাছে একটা প্যাথলজী আছে সেখানে একবার প্রস্রাবও চেক করে এসেছেন। বলেছে কোন সমস্যা নেই। তাই আর তেমন একটা মাথা ঘামাননি। রাতে এতোবার উঠতে হয় দেখে ঘুমের অসুবিধা এড়াতে নিজে একটা বোতল কাছে এনে রেখেছেন। সকালে একবারে গোসল করে নেন নামাজের আগে। কোন ডাক্তার কে দেখাবেন, কে করবে এর চিকিৎসা ভেবে ভেবেই দিন পার করে দিয়েছেন এতোদিন।
সেদিন শুনলেন কাজের মেয়েটা বৌমাকে বলছে জামান সাহেবের ঘরে প্রস্রাবের গন্ধ। বৌমা যদিও মেয়েকে ধমকে থামিয়ে দিয়েছেন কিন্তু জামান সাহেব তো জানেন কি কারণ। গত কয়েক সপ্তাহ যাবত কাপড় ভিজে যাচ্ছে মাঝে মাঝেই। আর অবহেলা করে নিজেকে থামিয়ে রাখার আজ চূড়ান্ত ফল পেলেন জনসমক্ষে কাপড় ভিজিয়ে। ব্যাংকে গিয়েছিলেন টাকা তুলতে। লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ইতিউতি করে টয়লেট খুঁজতে খুঁজতে কখন যে কাপড় ভিজে গেছে বুঝতেই পারেননি। আজীবন সম্মানিত চাকুরী করা একজন মানুষ চারদিকে কটাক্ষ আর বিদ্রুপাত্মক হাসিমাখা মুখ দেখে আরো বেশী দিশেহারা হয়ে উঠেছিলেন। সুমাইয়া নামে মেয়েটা এগিয়ে এসে তাকে একটা সিএনজি তে না তুলে দিলে উনি বোধহয় আজ পথ ভুলে অন্য কোথাও চলে যেতেন।
নির্ধারিত সময়ে ডাক্তার তাকে ডাকেন তার রুমে। সব পরীক্ষা করে বলেন তার নাকি প্রোস্টেট নামক গ্রন্থিতে সমস্যা। পরিবারে আর কে আছে জেনে জানান ছেলের সামনে কথা বলতে চান। ছেলেকে কিভাবে বলবে কি সমস্যা সেটা নিয়ে দ্বিধায় থাকা জামান সাহেব এ বেলা ছেলেকে ফোন দেন। বেশ কিছু নতুন ঔষধ নাকি বাজারে এসেছে যাতে বেশ উপকার হয় এই রোগের কিন্তু ডাক্তার জামান সাহেবের অবস্থা বিবেচনায় অপারেশনের ওপরই জোর দেন। ছেলে সাথে সাথেই সব আয়োজন করে কাগজপত্র পূরণ করে দেয় বাবার জন্য।
ফেরার পথে জামান সাহেব লজ্জায় কোন কথা বলতে পারছিলেন না। একে ছেলে দারুন ব্যস্ত থাকে সবসময় তার ওপর এমন একটা বাজে রোগ। আজীবন মোটামুটি সুস্থ থাকা জামান সাহেবের হঠাৎ করে অপারেশন করতে হবে এ ধরনের একটা খবরে খুব চিন্তিতবোধ করতে থাকেন। না জানি এবার বিছানায় পরে থাকতে হয়।
– বাবা, এতোদিন ধরে সমস্যা পুষে রেখেছো আমায় কিছু বলোনি কেন?
এমন একটা লজ্জার কথা কিভাবে বলি তাই বুঝতে পারছিলাম না। তার ওপর তোকে ঝামেলায় ফেলতে চাইনি। তারপর বলে যান আজ দুপুরের ঘটে যাওয়া ঘটনাটুকুও।
– বাবা এটা তো তোমার লজ্জা না। এটা আমার লজ্জা। আমি কেন ছেলে হিসেবে তোমার এই খবরটুকু রাখিনি। আমি আজই আমার সব বন্ধুদের সাথে এই নিয়ে কথা বলবো। আর কারো বাবা যেন কখনো এরকম লজ্জার মুখোমুখি না হয়।
ছেলের হাত ধরে জামান সাহেব শিশুদের মতে কেঁদে উঠে বলেন, ‘আমিও আমার পরিচিত সবাইকে বলবো, শরীরের কোন অসুখই লজ্জার নয়। সময় থাকতে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে।’
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস
(পুনশ্চ: কাজে এক বুড়ো রোগী ফ্লোর ভিজিয়ে ফেলেছে। সংবেদনশীল এদেশেও অনেকেই মুচকী হেসেছে, কেউবা বিরক্তি দেখিয়ে সরে গেছে। আমাদের সবার বাবারা ভালো আছে কি না সে খবর রাখার দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই।)