রোমান্টিক_ডাক্তার পার্ট: ১৮

0
3700

রোমান্টিক_ডাক্তার

পার্ট: ১৮

লেখিকা: সুলতানা তমা

হঠাৎ কারো কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙলো, আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি কাব্য একটু দূরে চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছে আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কতোক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা মনে তো হচ্ছে এখন গভীর রাত, দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালাম রাত দুইটা বাজে। হুট করে বাচ্চার কথা মনে পড়ে গেলো, একটা হাত আস্তে আস্তে পেটের উপর নিয়ে রাখলাম। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু কাঁদতে পারছি না, আমি কাঁদলে যে কাব্য আরো ভেঙ্গে পড়বে।
আমি: ডাক্তারবাবু (আমার ডাক শুনে কাব্য তাড়াতাড়ি পিছন ফিরে চোখের পানি মুছে নিলো, আমাকে লুকাতে চাইছে হায়রে পাগল)
কাব্য: ঘুম ভেঙেছে?
আমি: হুম। (আমার পাশে বসে পেটের উপর রাখা আমার হাতটা ওর হাতের মুঠোয় পুরে নিলো তারপর আমার হাতে একটা চুমু খেলো)
কাব্য: এইতো তুমি সুস্থ হয়ে গেছ দেখো আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি: আচ্ছা তুমি এতো সুন্দর করে কষ্ট লুকাতে পারো কিভাবে (কাব্য মুখে হাসির রেখা টানার বৃথা চেষ্টা করে আমার বুকের উপর ওর মাথা রাখলো। একটা হাত ওর চুলের মধ্যে রাখলাম, জানিনা আর কতো কষ্ট পেতে হবে ওকে)
কাব্য: তিলো আমাকে ক্ষমা করে দিও প্লিজ।
আমি: কেন কি করেছ তুমি?
কাব্য: এইযে তুমি ভয় পাওয়ার পরও জেদ করে কক্সবাজার গেলাম, আর তোমাকে চোখে চোখে না রেখে সবার সাথে আনন্দ করছিলাম।
আমি: আমি ছোট বাচ্চা নাকি যে আমাকে চোখে চোখে রাখবে, এতে তো আমারো দোষ আছে। আমি কেন তোমার থেকে দুরে ছাদের অন্যপাশে গিয়েছিলাম, না গেলে তো এমন হতো না।
কাব্য: মানুষের জীবনে কখন কি ঘটে তা তো আগে থেকে বলা যায় না, যা হবার ছিল তা হয়ে গেছে। এখন তুমি নিজেকে শক্ত করো প্লিজ আর তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠো।
আমি: হুম। আচ্ছা কে করিয়েছে এসব জানতে পেরেছ?
কাব্য: না চিন্তা করো না খুব শীঘ্রই জানতে পারবো। আর যেই করুক ওকে এমন শাস্তি দিবো দেখো আর কখনো কারো ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না।
আমি: হুম।
কাব্য: তিলো জানো হিয়া আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।
আমি: কেন?
কাব্য: আমি নাকি আমাদের সন্তানকে ইচ্ছে করে মেরে ফেলেছি। আচ্ছা তুমি বলো কোনো বাবা কি নিজের সন্তানকে খুন করতে পারে। আমি তো জানতাম না তুমি প্রেগন্যান্ট, বুঝতেই পারিনি, জানলে তো জেদ করতাম না আ…
আমি: আম্মু আব্বুর সাথে তুমি ঝগড়া করে ওকে নিয়ে বাসা থেকে চলে এসেছিলে এই ধারণা নিয়েই তো ও ছোট থেকে বড় হয়েছে, তাই তোমার প্রতি ওর মনে কিছুটা রাগ জমে আছে আর এখন এই ঘটনার পর ওর রাগটা আরো বেড়ে গেছে তুমি কেঁদো না দেখো হিয়া একদিন ঠিক তোমায় বুঝবে।
কাব্য: হুম তুমি এখন ঘুমাও।
আমি: তোমার চোখ দুটু লাল হয়ে আছে তুমি একটু ঘুমাও।
কাব্য: না ঘুমুতে ইচ্ছে করছে না।
আমি: ঠিক আছে ঘুমাতে হবে না এখানে শুয়ে আমার বুকে মাথা রাখো আমার ভালো লাগবে (কাব্য শুয়ে পড়লো তারপর আমার বুকে মাথা রাখলো। ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়লো। ওর মাথায় একটা চুমু দিয়ে বললাম)
আমি: চিন্তা করোনা ডাক্তারবাবু আমি তোমার সব কষ্ট দূর করে দিবো। সুস্থ হয়ে আমার প্রথম কাজ হবে আব্বু আম্মুকে খুঁজে বের করা। সবার রাগ অভিমান ভাঙিয়ে আমরা সবাই একসাথে থাকবো।

কাব্যর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বাচ্চাটার কথা ভাবছিলাম। এমন না হলে তো ও আস্তে আস্তে আমার মধ্যে বেড়ে উঠতো আর একদিন আমাদের ঘর আলো করে ও আমার কোলে আসতো। হঠাৎ কাব্য’র ফোন বেজে উঠলো, এতো রাতে আবার কে ফোন দিলো। একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে, কাব্য গভীর ঘুমে এখানে কথা বললে সমস্যা হবে না তাই ফোনটা রিসিভ করলাম। আমি কিছু বলার আগেই অপর পাশ থেকে কথা বলতে শুরু করলো।
–কি কাব্য তোমার বউয়ের এমন অবস্থা কে করলো এইটা ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছ নাতো? ছাড়ো আমিই বলছি তাতে তোমার কষ্টটা অনেক গুণ বেড়ে যাবে আশা করছি। কাব্য মনে আছে তোমার অতীতের কথা? তুমি না বড্ড বোকা কাব্য তাই তো অতীতটা একেবারে ভুলে বসে আছ। এভাবে ভুলে গেলে হয় বল?
আমি: (নিশ্চুপ)
— কথা বলছ না যে? ওহ চমকে উঠেছ ভাবছ আমি কেন এসব করছি। যা করেছি আমার স্বার্থে করেছি এইটা নিয়ে আর ভেবো না ভুলে যাও। যদি আমাকে খুঁজার চেষ্টা করো তাহলে কিন্তু তোমার তিলো পাগলীর চেয়ে খারাপ অবস্থা হবে তোমার বোন হিয়ার (ওর কথা শুনে চমকে উঠলাম, কে এই মেয়ে? ও তো দেখছি আমাদের সম্পর্কে সবকিছু জানে)
— কি বিশ্বাস হচ্ছে না আমি যে হিয়ার ক্ষতি করবো? চলো আমিই বিশ্বাস করিয়ে দিচ্ছি, হিয়াকে একবার ফোন দিয়ে বলো ওর রুমের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে তাহলেই ও দেখতে পাবে আমার দুজন লোক ওকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখছে। হিয়া যখন দেশে ফিরেছে মানে এয়ারপোর্ট থেকেই ওর পিছনে আমার লোক লাগিয়ে দিয়েছি সো কাব্য চৌধুরী বুঝতেই পারছ আমি যেকোনো সময় তোমার বোনের ক্ষতি করতে পারি। আগেই ওয়ার্নিং দিয়ে দিচ্ছি যা হয়েছে ভুলে যাও এক বাচ্চা নষ্ট হয়েছে আবার বাচ্চা হবে কিন্তু এই বাচ্চার কথা ভেবে বোনের জন্য বিপদ ডেকে এনো না কারণ বোন মারা গেলে আর বোন পাবে না আর আমি জানি হিয়ার কিছু হলে তুমি এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে। (আর শুনতে পারলাম না ফোনটা কেটে দিলাম। মেয়েটার কথা শুনে ভয়ে আমার সারা শরীর ঘামছে। মেয়েটা কতোটা ভয়ঙ্কর সেটা ও একবার প্রমাণ করে দিয়েছে এখন যদি ও হিয়ার কোনো ক্ষতি করে… আমি হিয়ার কোনো ক্ষতি হতে দিবো না আমি ওকে আগলে রাখবো)

কাব্য’র ফোন থেকে নাম্বারটা ডিলিট করে ফেললাম, আমি চাই না কাব্য এই বিষয় নিয়ে আর খুঁজাখুঁজি করুক আর হিয়ার বিপদ ডেকে আনুক। কাব্য মেয়েটাকে শাস্তি দিতে গেলে যদি হিয়ার কোনো ক্ষতি করে বসে তখন? হিয়া তো কাব্য’র সব, হিয়ার কিছু হলে কাব্য শেষ হয়ে যাবে। আমি আমার জন্য ওদের ভাই বোনের কোনো ক্ষতি হতে দিবো না। কিন্তু মেয়েটি কে যেকিনা আমাদের সম্পর্কে সবকিছু জানে? শুভ্রা যে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত কারণ কন্ঠটা শুভ্রার ছিল না তাহলে মেয়েটি কে?

কাব্য: তিলো উঠো (কাব্য’র ডাকে সকালে ঘুম ভাঙলো)
কাব্য: কিছু খেয়ে ওষুধ খেয়ে নাও তারপর আবার ঘুমিয়ে যেও সমস্যা নেই।
আমি: বাসায় যেতে পারবো কবে?
কাব্য: এই অবস্থায় তুমি বাসায় চলে যেতে চাইছ?
আমি: এখানে তো তুমিই সেবা করছ তাহলে বাসায় এই সেবাটা করলে দোষ কোথায়?
কাব্য: তোমার সাথে কথায় পারবো না, আচ্ছা এক সপ্তাহ পর বাসায় নিয়ে যাবো।
আমি: আরো এক সপ্তাহ।
কাব্য: তুমি ভালো করে সুস্থ নাহলে হবে বলো, তোমার যদি কিছু হয়ে যায় আমি কি নিয়ে বাঁচবো (কাব্য আমার গালে একটা হাত রেখে বললো, ওর দুচোখ দিয়ে পানি ঝরছে। কতোটা ভয় পায় ও আমাকে নিয়ে)
আমি: বাসায় যাওয়ার কথা আর বলবো না একেবারে সুস্থ হয়েই বাসায় যাবো। (কাব্য’র হাতের উপর আমার একটা হাত রাখলাম ও মুচকি হেসে আমার মুখে খাবার তুলে দিলো)
আদনান: কাব্য আসবো?
কাব্য: হুম আয়।
আদনান: ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই রিপোর্ট ভালো এসেছে।
কাব্য: সত্যি?
আমি: কিসের রিপোর্ট? (আদনান কাব্য’র দিকে তাকিয়ে রিপোর্টটা রেখে বেড়িয়ে গেলো)
কাব্য: আমরা ভয় পেয়েছিলাম এতো বড় আঘাতের পর তুমি যদি মা হবার…
আমি: ওহ বুঝেছি (আমি আবার মা হতে পারবো এইটার রিপোর্ট ভালো এসেছে আমি তো ভেবেছিলাম আমার বাচ্চাটা বুঝি বেঁচে আছে)
কাব্য: তিলো আমি বুঝতে পারছি তুমি কি ভেবে খুশি হয়েছিলে, মন খারাপ করোনা দেখো আল্লাহ্‌ আবার আমাদের কোলজোড়ে সন্তান দিবেন।
আমি: হুম।

বালিশে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছি, কাব্য দূরে চেয়ারটায় মন খারাপ করে বসে আছে। কাব্য’টার উপর দিয়ে বার বার ঝর বয়ে যাচ্ছে কবে যে ও একটু সুখের দেখা পাবে।
হিয়া: ভাবি আসবো?
আমি: হ্যাঁ এসো। (হিয়া কাব্য’র দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আমার পাশে এসে বসলো)
হিয়া: ভাবি আ…
আমি: তোমার ভাইয়ার সাথে কথা বলোনা কেন?
হিয়া: কোনো জেদি লোকের সাথে কথা বলার ইচ্ছে আমার নেই (কথাটা শুনে কাব্য হিয়ার দিকে তাকালো তারপর চোখের পানি মুছতে মুছতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো)
আমি: ভুল করছ হিয়া, এসবে ওর কোনো দোষ নেই।
হিয়া: তোমার বেবিটা নষ্ট হয়ে গেছে তারপরও তুমি ভাইয়াকে দোষ দিচ্ছ না?
আমি: না দিচ্ছি না কারণ কোনো বাবা তার সন্তানকে মেরে ফেলতে চায় না। এসবে কাব্য’র কোনো দোষ নেই, হ্যাঁ ও একটু জেদ করেছিল কক্সবাজার যাওয়ার জন্য ব্যাস এইটুকুই।
হিয়া: তুমি ভাইয়াকে খুব ভালোবাস তাই না?
আমি: যে মানুষটা একটা অচেনা মেয়েকে প্রথম দেখায় এতোটা ভালোবাসতে পারে তাকে ভালো না বেসে কি থাকা যায়। আর হ্যাঁ একদিন তুমিও সব রাগ অভিমান ভুলে তোমার ভাইয়াকে ভালোবাসবে আমি জানি।
হিয়া: আমি তো ভাইয়াকে ভালোবাসি অনেক ভালোবাসি কিন্তু…
আমি: এই কিন্তুটা আমি দূর করে দিবো। আমাকে সুস্থ হতে দাও আমি তোমাদের সবার রাগ অভিমান ভাঙিয়ে আবার সবাইকে এক করবো (হিয়া আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে)
হিয়া: সসসবাই মামামানে?
আমি: হুম আব্বু আম্মুকে খুঁজে বের করবো দেখো তুমি।
হিয়া: সত্যি বলছ?
আমি: হ্যাঁ, যদিও আমি জানিনা কিভাবে খুঁজা শুরু করবো তা…
হিয়া: আমি তোমাকে একটা সূত্র দিতে পারি, আমি আব্বু আম্মুকে চাই প্লিজ তুমি এনে দাও।
আমি: কি সূত্র?
হিয়া: ভাইয়া ডায়েরি লিখে, কখন লিখে আর ডায়েরিটা কোথায় রাখে সেটা বলতে পারবো না। মাঝে মাঝে দেখতাম রাতের বেলা ভাইয়া ডায়েরি লিখতো আর কাঁদতো কিন্তু ডায়েরিটা কোথায় রাখে সেটা কখনো দেখিনি। আমি সিওর না তুমি ডায়েরি থেকে কিছু পাবে কিনা কিন্তু আমার মন বলছে এই ডায়েরি থেকেই একটা সূত্র পেয়ে যাবে।
আমি: কোথায় আমি তো ওকে কখনো ডায়েরি লিখতে দেখিনি।
হিয়া: বাসায় ফিরে ভাইয়ার উপর নজর রেখো তাহলেই দেখতে পারবে।
আমি: ঠিক আছে।

চুপচাপ শুয়ে আছি কাব্য পাশে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। ভাবছি হিয়ার কথা কি সত্যি? কিন্তু আমি তো কাব্য’কে কখনো ডায়েরি লিখতে দেখিনি। আর যদি সত্যি লিখে তাহলে কি ডায়েরি থেকে কিছু পাবো?
কাব্য’র দিকে নজর পড়লো একমনে ল্যাপটপের স্কিনে তাকিয়ে আছে, এতো মনোযোগ দিয়ে কি এমন কাজ করছে কে জানে। হঠাৎ একজন সিস্টার তাড়াহুড়ো করে রুমে ঢুকলো।
সিস্টার: স্যার ওই পেসেন্ট’টার অবস্থা খুব খারাপ (কাব্য ল্যাপটপ হাত থেকে রেখেই দৌড়ে চলে গেলো)
কাব্য এতো মনোযোগ দিয়ে কি এতো কাজ করছিল দেখার জন্য ল্যাপটপ এর দিকে তাকালাম, স্কিনে একটা ছোট্র বাবুর ছবি দেখে বুকটায় ব্যথা শুরু হয়ে গেলো। তারমানে কাব্য কোনো কাজ করছিল না বসে বসে এই বাবুটার ছবি দেখছিল। এতোক্ষণ তো কষ্টটা একটু কম হচ্ছিল এই ছবিটা দেখে বুকের বাম পাশে ব্যথা শুরু হয়ে গেলো। কাব্য আমাকে সাহস দেয়ার জন্য সব কষ্ট লুকিয়ে আমার সামনে দিব্বি হাসে কিন্তু আড়ালে ও কতোটা কষ্ট পাচ্ছে এই ছবি না দেখলে তো বুঝতেই পারতাম না। আবার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে আর বলতে ইচ্ছে হচ্ছে “কেন হলো আমাদের সাথে এরকম”

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে