রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব-১৫+১৬

0
1069

#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব-১৫
____________
–“এই-যে দিয়ে পাঁচটা প্রশ্ন!তাও উনার চোখে তাকিয়ে!অসম্ভব।”
বিড়বিড় ভঙ্গিতে আওড়ায় তাহুরা।হাতের চুড়িতে মনোনিবেশ করে।সাদা পাথরের উপর মেজেন্ডা রঙের চুড়ি।অত্যধিক সৌন্দর্য বর্ধন করে তাহুরার শুভ্র হাতে।তার বাবার দেওয়া চুড়িগুলো।পরিহিত কামিজে হাত বুলিয়ে মাথায় ঘোমটা টানে।পিন দিয়ে আটকে দেয় নিখুঁতভাবে।তার মুখশ্রীর সম্মুখে কিছু চুল দোদুল্যমান।কানে ভারী দুল।নাকে আজ নতুন অলংকার পড়েছে।পাথরের নাকফুল।পরিপাটি হলো আজ সে একা।অধরে লেপন করা লিপস্টিক পুনরায় ঠিক করে নিজেকে শেষ বার আয়নায় পরখ করে।সব মন মতো।বোন ছাড়াও মেয়েটা নিজেকে তৈরি করেছে অপ্সরীর ন্যায়।বোন তার পার্শ্ববর্তী পার্লারে।

হাতের ছোট পার্স নিয়ে কামরা হতে বেরোয় তাহুরা। মা-বাবা কিছু একটা নিয়ে কথায় ব্যস্ত।তাহুরা সেথায় গেলে মুন্সী কথা থামায়।মেয়েকে ডাকে ইশারায়।আদুরে ভঙ্গিতে তাহুরা গেলে মেয়ের কাঁধে হাত রাখে মুন্সী,
–“সামনের মাসে সুনেরার বিয়ের পরপর রেজাল্ট দিবে।ভর্তি হবে কোথায়?”
–“আমাদের কলেজে।অনার্স কলেজ থেকে করতে চাই বাবা।”
তাহুরা জবাব দেয়।

–“উত্তম সিদ্ধান্ত।আর শুনো,আজ অনুষ্ঠানে একটু সাবধানে থাকবে।কোনো বাইরের পোলা এসে কিছু বলতে চাইলে,কথা শুনবে না।মহিলাদের কেউ বিয়া নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে বলবা,তুমি পড়বা।অনার্স শেষ করবা। বুঝলা?”
ক্ষেপে উঠে মুন্সী।বাঁধ সাধে শিউলি,
–“অনার্স একেবারে শেষ করতে হবে বলে কথা নেই।আমার মেয়েকে আমি আরো কয়েক বছর রাখবো বাসায় এটাই মূর্দা কথা।”
–“ঐ একই।”
মুন্সী ফের বলে।

তাহুরা মাথা নাড়ে।তার বিয়ে নিয়ে কাহিনী হলো নিশ্চয়।প্রস্তাব এসেছে নাকি?প্রশ্ন করার সাহস নেই তাহুরার।সে ভাবুক ভঙ্গিতে বাবার নিকট বসে।সুনেরা এলে রওনা দিবে সকলে।বাহিরে জুবায়েরের পাঠানো গাড়ি অপেক্ষারত।
তাহুরার যতো ভাবনা উমাইরের পাঁচটা প্রশ্ন নিয়ে।বাদবাকি বিয়ের ব্যাপারে সে সুনিশ্চিত।বাবা মা অতিদ্রুত তাকে আলাদা করবে না নিজ হতে।মিনিট দশেক পার হচ্ছে,তাহুরা একে একে প্রশ্ন সাজায় অন্তরে।প্রথমে ভেবেছে,কেমন আছেন?কি করছেন?এমন প্রশ্ন করে কেটে পড়বে।পক্ষান্তরে মনে জোর লাগায় মেয়েটা।প্রশ্নের স্তূপ গড়ে তোলে। উমাইরকে আজ কিছু প্রশ্ন করবে,যা তাহুরার অন্তরকে পীড়া দেয় ক্ষণে ক্ষণে।

–“সুনেরাকে ফোন দাও।আসবে নাকি জিজ্ঞাসা করো!আর কতক্ষণ বসে থাকবো?”
মুন্সীর গর্জনে নিজ দুনিয়ায় ফিরে তাহুরা।পার্স হতে মোবাইল বের করে।সুনেরাকে ফোন দিতে গিয়ে খেয়াল করে উমাইরের বিশাল মেসেজ,
–“আজ বেশি ঘুরঘুর করলে কান টানবো তোমার।অনুষ্ঠানে থাকবে ঠিক,কিন্তু চুপচাপ এক জায়গায় অটুট থাকো যেনো।অপরিচিত কেউ কথা বলতে আসলে কথা বলবে না।হেসে কথা বলার দুঃসাহস দেখালে,হাসি বন্ধ করেবো তোমার।আমার আত্মীয় হোক,বেশি আদিখেত্য দেখালে তোমার খবর আছে। ভালোমানুষি দেখানোর দরকার নেই কোনো।”

বিশাল হুমকি!হলো কি আজ?বাবাও হুশিয়ারি দিলো,আবার উমাইরও।জবাব পাঠানোর পূর্বে বাবা ফের তাড়া দেয়,
–“আম্মা,মোবাইল নিয়ে বসে থাকতে বলিনি।ফোন লাগাও বোনকে।”
–“দিচ্ছি বাবা।”
মেসেজ হতে বেরিয়ে দ্রুত বোনকে ফোন দেয় তাহুরা।কথা শেষে বাবাকে জানায়,গলির মোড় হতে সুনেরাকে তুলে নিতে।

নির্দেশনা অনুযায়ী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তারা।
এর ফাঁকে উমাইরকে মেসেজ দেয় তাহুরা,
–“কি হয়েছে?”
মোবাইল ব্যাগে পুরে তাহুরা।মোবাইল নিয়ে সময় কাটানো তার বাবার অপছন্দ কাজ। পাছে যদি বাবা বকুনি দেয়,এহেন খুশির দিনে হজম হবে না তাহুরার। কেঁদেকুটে খুশির দিন নষ্ট করবে।

সুনেরাসহ তারা ঐ বাড়িতে পৌঁছায়।জুবায়ের প্রধান ফটকের কিনারায় দাঁড়িয়ে।প্রেয়সী গাড়ি হতে নামলে দ্রুত এগিয়ে আসে।হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার জোগাড়।মুন্সীর পানে এক নজর দৃষ্টি দিয়ে তাড়াহুড়োয় চেপে ধরে সুনেরার হাত।সে ছুটাতে চাইলেও হাত ছাড়েনি জুবায়ের।কুশল বিনিময় সমাপ্ত করে ভেতরের দিকে অগ্রসর হয়।

বিষয়টা দারুণ লাগলো তাহুরার।বোন তার ব্যাপক ভাগ্যবতী।

বাহিরে তেমন মানুষ না থাকলেও,ভেতরে আত্মীয়দের ছড়াছড়ি।নিজের দুই চাচাকে দেখলো তাহুরা।নানু বাড়ির সকলে এখনো অব্দি আসলো না।চারিদিকে নজর ঘুরিয়ে দেখছে সে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখার সখ জেগেছে মনে। প্রাণে হাহাকার তার।

সুনেরাকে ঘিরে আসর পেতেছে।তাহুরা বোনের কাছে নিজ অবস্থান জারি করে।কৌশলে মেসেজ দেখার জন্যে উদ্যত হয়।কিন্তু, লাভ হয়নি।মেসেজ আসেনি কোনো।

উমাইরের মামী দূরে অবস্থিত।তার পাশে দাঁড়ানো ছেলেটাকে ইশারায় দেখালো তাহুরাকে।পরক্ষণে মুখ খুলে,
–“দেখলে কেমন মেয়েটা?”
–“হুম।দেখলাম।তার বাবা কিছু জানিয়েছে?”
নম্রতার ভাইয়ের ছেলে প্রশ্ন করে।
–“নাহ, তুনাজ।জানায়নি।উনি ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করেছেন যেনো। আপাকেও বলে লাভ হয়নি।”
নম্রতা কেমন মিইয়ে জবাব দেয়।
–“মেয়েটার সাথে কথা বলে দেখি।ভাব হয় কিনা।”
হেসে উত্তর দেয় তুনাজ।
——————–
–“আব্বা,নিচে সবাই এসেছে।ছাদে উঠবে এখন।তুমি তৈরি?”
দরজায় টোকা দিয়ে প্রশ্ন করে মেঘলা।

উমাইর গায়ে পারফিউম স্প্রে করা অবস্থায় দরজা খুলে।মা ভেতরে প্রবেশ করে।ছেলের গম্ভীর মুখশ্রী অবলোকন করে ফের মেঘলা বলে,
–“আমার ছোট বউকে আজ পরীর মতো লাগছে।”

ঘাড় বাঁকিয়ে উমাইর মায়ের পানে তাকায়।পরিহিত কালো শার্টের হাতা কব্জি অব্দি টেনে বোতাম মারে,
–“সে এইভাবেও পরী।”
–“তুনাজ আশেপাশে ঘুরছে?”
জবাব দিয়ে প্রশ্ন করে মাকে।
–“নাহ।আপাতত দেখিনি।তোমার মনের রাণীকে তোমার দেখে রাখতে হবে।দ্রুত আসো।”
বলে উঠে মেঘলা।

–“আসছি।”
কথা খানা শেষে মায়ের পেছন পেছন বেরোয় উমাইর।নাকের আগায় আঙ্গুল ডলে।সর্দি ভাব তার। সিঁড়ি যোগে নামতে নিলে স্তব্ধ হয় দৃষ্টি।নজর আটকে যায় সুনেরার নিকট বসে থাকা ঘোমটা দেওয়া মানবীতে। মেয়েটা মিষ্টি হাসছে।কেনো হাসছে?ভরা মানুষকে তার দেওয়ানা করা রূপ দেখাতে?হিংসে হচ্ছে উমাইরের।অথচ,এইখানে কিছু নেই হিংসার।

সকলের কাছাকাছি গেলে উমাইর,নম্রতা হেসে বলে,
–“উমাইর এসেছে।এখন যাওয়া যাক।”

কলকল ছলছল ভঙ্গিতে উৎসবের সহিত সকলে ছাদের পানে যাচ্ছে।তাহুরা লুকায়িত দৃষ্টিতে উমাইরের অবয়বে মত্ত।মেঘলার ধারে হাঁটছে উমাইর।একটা বারের জন্যে তাহুরার পানে তাকিয়েছে কিনা জানা নেই মেয়েটার।তবে,তাহুরা সন্তুষ্ট।লোকটাকে সে দু চোখ ভরে যে দেখছে!

ছাদে সুন্দর সাজানো।সাদা,হলুদ রঙের আলোর আলোড়ন।কৃত্রিম কিছু গাছেও লাইট ঝুলছে।খাবারের জন্যে একপাশে কয়েকটা টেবিল বসানো।পারিবারিক অনুষ্ঠান হওয়ায় এইখানে কেবল দুই পরিবারের নিকট আত্মীয়ের আগমন।চোখ জোড়া কেবল উমাইরের খোঁজে।ঐযে দেখা যাচ্ছে তার মনের রাজাকে।উল্টো দিকে ফিরে কথা বলছে কার সাথে। হয়তো তার কোনো আত্মীয়!বুকটা নড়ে উঠে তার। ভালো লাগায় ছেয়ে যায় অন্তর।

তাহুরা বসে ছিল আয়মা,শায়নের নিকট।এর মাঝে আসে নম্রতা।জাফরান তার কোলে।এক প্রকার জিদ করছে বাচ্চাটা।তাহুরাকে দেখে জাফরান নেমে দাঁড়ায়।তাহুরার হাঁটুতে হাত লাগিয়ে আহ্লাদ করে।
নম্রতা ঝেড়ে কাশে,
–“জাফরানকে আপার রুমে নিয়ে যাবে?তুমি ছাড়া কারো সাথে যাবে না জাফরান।আমার এইখানে অনেক কাজ।ছেলেটার ঘুম পেয়েছে নিশ্চয়।তোমাকে এমন কথা বলতেও সংকোচ লাগছে।নতুন আত্মীয় তুমি।কিন্তু,আমার ছেলেটা তুমি বলতেই অজ্ঞান।”
অগোছালো কথার খেয় খুঁজে পায়নি তাহুরা। তাও সাড়া দেয় নম্রতার কথায়।জাফরানের হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নেয়,
–“সমস্যা নেই,মামী।আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
স্নেহপূর্ণ বাক্য বিনিময় শেষে মাকে জানায় ঘটনা।শিউলি সায় দেয়। তবে,মনে মনে আহত।নতুন আত্মীয় বলে মুখ ফুটে মানা করাটাও মান্য নয়।মুন্সীকে ব্যাপারটা জানানো হলে,সেও সায় দেয়।

তাহুরা,জাফরানকে সাথে নিয়ে নিচে নামতে উদ্যত হলে মেঘলা এসে পথ আটকায়,
–“কই যাচ্ছো মা?”
–“মামী বললো,জাফরানকে আপনার রুমে ঘুম পাড়িয়ে দিতে।”
তাহুরা সহজ ভাষায় বলে।
–“নম্রতাও না!কোনো দরকার নেই।আমি নিয়ে…”
–“নাহ আন্টি।আপনি এইখানে থাকুন।আমার কোনো প্রবলেম নেই।জাফরানের সাথে থাকতে আমারও ভালো লাগে।”
মেঘলাকে থামিয়ে জবাব দেয় তাহুরা।

অতঃপর জাফরানকে সঙ্গী বানিয়ে কক্ষের পানে ছুটে তাহুরা।দুই তলা জনমানবহীন।আফিয়াকে দেখলো কামরা হতে মাত্র বেরুতে।তাহুরাকে কেমন উপেক্ষা করে চলে যায় সে।
হঠাৎ তাহুরা অনুভব করে জাফরানকে কেউ কোলে তুলে নেয়।

প্রথমে উমাইর ভাবলেও,অন্য ছেলেকে দেখে পিলে চমকে উঠে তাহুরার।জাফরান নিশ্চুপ হেসে যায় ছেলেটার সহিত।এর মানে ছেলেটাকে চিনে জাফরান।

তাহুরার মুখের ভাষা ফুরিয়েছে।ছেলেটা প্রথমে মুখ খুলে,
–“আমি তুনাজ।জাফরানের কাজিন।”
বিনিময়ে কি জবাব দিবে তাহুরা খুঁজে পায়নি।
তুনাজ আবারো বলে উঠে,
–“ইউ আর প্রিটি।”
ধপ করে উঠে তাহুরার ছোট্ট হৃদয়।আবার সেই জ্বলন্ত হৃদয়ে শান্তি মিলে তুনাজ নামক ছেলের পিছে উমাইরকে আসতে দেখে। চলমান অবস্থায় লোকটা তার মাথার চুল ঠিক করছে।

উমাইরের ভাবভঙ্গি কঠোর।

–“তুনাজ,তোমাকে মামী বললো জাফরানকে নিয়ে রুমে যেতে।অলরেডি ঘুমাচ্ছে ও তোমার কাঁধে।”
কণ্ঠস্বর ব্যাপক গম্ভীর উমাইরের।যেনো ক্ষিপ্ত কথাগুলো ভদ্র ভাষায় পেশ করছে সে।
–“কিন্তু,আন্টি আমাকে তাহুরার সাথে…”
–“যাও।”
কাঠকাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে উমাইর।তার চেয়ে বয়সে ছোট তুনাজ বেয়াদবি না করে রুমের পানে এগিয়ে যায়।তুনাজ এও জানে,এখন তার বসে বসে পাহারা দেওয়া লাগবে জাফরানকে।মনের দুঃখে হাত মুঠ হয়ে আসে তার।আঁখিতে ভেসে উঠে তাহুরার আদুরে মুখখানা।

মেঘলা বেগম ছেলেকে সাথেসাথে ব্যাপারটা জানিয়ে স্বস্তি পাচ্ছে।যাক কাহিনী বিগড়ে যায়নি।তার ছোট ছেলেকে ব্যবস্থা করে দিয়েছে মনের পরীর সাথে কথা বলার।উপরে সকলকে মেঘলা ভালোই সামলে নিবে। দূর হতে দৃশ্য অবলোকন করে ছাদে ফিরে মেঘলা।
———————
উমাইর নিভু দৃষ্টিতে তাহুরাকে পর্যবেক্ষণ করে।হাত ধরে শক্ত ভঙ্গিতে।মুহূর্তে সারা সত্তায় উম্মাদনায় ছেয়ে যায় তাহুরার। উমাইরের লম্বা কদমের সহিত সে কেবল দৌড়ে যাচ্ছে।উমাইর তাকে গলির আড়ালে দাঁড় করায়।সাহস আছে উমাইরের।প্রেয়সীর নাক উঁচু বাবা উপস্থিত আছে জেনেও আগুনের সাথে খেলছে সে।
তাহুরা অবাক,বিমোহিত।উমাইরকে অশান্ত দেখাচ্ছে।উমাইর তার হাত ছাড়লে তাহুরা প্রশ্ন করতে চাইলে,উমাইর তার কপালে টোকা দেয়,
–“ভালোমানুষি দেখাতে মানা করেছি?”

উত্তর নেই তাহুরার।প্রসঙ্গ এড়াতে ভাবে কিছুক্ষণ তাহুরা।অতঃপর বলে,
–“পাঁচটা প্রশ্ন করি?”

–“নাহ।”
উমাইরের শক্ত জবাব।
–“তাহলে আমি যাই?”
–“নাহ।”
ঘাড়ত্যাড়া উত্তর উমাইরের।
–“কি করবো তাহলে?”
ঠোঁট উল্টে প্রশ্ন করে তাহুরা।দৃষ্টি তার উমাইরের বুকে।লোকটার আঁখিতে আঁখি আটকে কথা বলাটা এভারেস্ট জয়ের মতো।

–“চেস্ট থেকে দৃষ্টি তুলে আমার দিকে তাকাও।সবসময় খেয়াল করি সেখানে তাকিয়ে থাকতে।কি দেখো এতো?”
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে উমাইর।

লজ্জায় রক্তিম হয় তাহুরা।লাজে বেষ্টিত হয় তার সারা তনু।লোকটা কথাটা কিভাবে পেশ করলো!
–“জ্বী?”
অদ্ভুত প্রশ্নের সহিত তাহুরা দৃষ্টি তুলে তাকায়।

উমাইরের নজর পরখ করা কষ্টের।লোকটা কি ক্রোধে মত্ত?
–“পাঁচটা প্রশ্ন করো।রাইট নাও!নজর নিচে ফেললে খবর আছে তোমার। ”
সেকেন্ডে কথা শেষ করে উমাইর।

তাহুরাকে জাদু করে উমাইরের অন্যরকম দৃষ্টি জোড়া।হুরহুর করে তাহুরা বলে,
–“এই-যে আপনি কি অন্য কাউকে শাসন করেন? যেমনটা আমাকে করেন?”
–“এই-যে আপনি আমাকে এমন অবহেলা কেনো করেন মাঝে মাঝে?”
–“এই-যে আপনি কি আমি ছাড়া অন্য কাউকে যত্ন করেন?”

বাকি প্রশ্ন শোনার ক্ষমতা নেই উমাইরের।গাঢ় লিপস্টিকে আবৃত অধর তাকে আকৃষ্ট করছে চুম্বকের লাহান।বেসামাল হচ্ছে উমাইর।তাহুরার দুই অধর তার দুই আঙ্গুলের সাহায্যে চেপে ধরে।মেয়েটা তার নিকট মাদক।বেশিক্ষণ কাছে থাকলে নেশাক্ত হয়ে পড়ে উমাইর।

কিঞ্চিৎ কাছে গেলে তাহুরা তার দুই হাত উমাইরের বক্ষে রাখে।মেয়েটা ভীত।পা জোড়ার জোর হারাচ্ছে।
উমাইরের এই দৃষ্টিটা তাহুরার সহ্য হয় না।

–“আর একটা কথাও বলবে না।”
উমাইর সোজা হয়ে দাঁড়ায়।তাহুরা প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়।ডান দিকে মাথা নাড়ে।কথা না বলার হলেও উত্তর জানতে আগ্রহী তাহুরা।

উমাইর উপরে মুখ করে কপালে আঙ্গুল ঠেকানো।লোকটার উত্তর জানতে তাহুরার ভেতরে উত্তাল।মনে সহস্র উত্তেজনা।অতঃপর ধীর স্বরে মেয়েটা প্রশ্ন করে বসে,
–“এই যে,উত্তর দিবেন না?”

–“উত্তর দিবো বলেছি আমি?প্রশ্ন করতে বলেছি,প্রশ্নের উত্তর দিবো এমনটা বলিনি!”
উমাইরের জবাবে মনঃক্ষুণ্ণ হয়।

কতো আশা নিয়ে প্রশ্নগুলো তৈরি করেছিলো মেয়েটা।আঁখি ভরে আসে।মনে মনে আওড়ায়,
–“আপু তোমার দেবর একটা জলদস্যু!”
অথচ এই বাক্য যদি উমাইরের সম্মুখে আসে,উমাইর নিশ্চিত হাড় ভাঙবে তাহুরার।

প্রেয়সীর ছলছল নয়নে দাগ কাটে উমাইরের পাষাণ হৃদয়ে।দৃষ্টি পৌঁছায় মেয়েটার হাতে।ওড়নার কোণায় আঁখি পুচছে সে।তাহুরার বাম হাতের আঙ্গুল টেনে নিজের দিকে টানে উমাইর,
–“দুহাত থেকে দুটো চুড়ি নিচ্ছি।”

নিজ দায়িত্বে উমাইর চুড়ি খুলে তার।ডান হাতের মুঠোয় রাখে।পরক্ষণে নাক টানে সে তাহুরার,
–“না কেঁদে উপরে যাও।আপুদের পাশে বসো।”

উত্তর বিহীন তাহুরা চলে যেতে নিলে উমাইর গলার স্বর বাড়ায়,
–“চিন্তা করো না,ভয় পায় না।তুনাজ বা অন্য ছেলে আর কাছে আসবে না তোমার।আসলে তোমার বাবার সামনে তাদের ধোলাই দিবো আমি।”

তাহুরা পেছন ফিরে।উমাইর তার চুড়ি জোড়া শার্ট উঁচিয়ে প্যান্টের পকেটে রাখছে।খানিক্ষণ আগের ক্রোধে মত্ত উমাইর এখন কেমন শান্ত।মুখশ্রী জ্বলজ্বল তার।উমাইর মাথা সোজা করলে দুজনের ফের দৃষ্টি মিলে।ভ্রু কুঁচকে যায় উমাইরের।
সম্মুখে অগ্রসর হয়ে আসা অবস্থায় বলে,
–“আমি ছাড়া কি হাঁটতেও পারো না?দ্রুত আসো।”

তাহুরা হাসে উমাইরের আড়ালে।অশ্রুর পানি শুকনো।লোকটার দুই রূপ ভারী ঝামেলা।বোঝা মুশকিল।উমাইরের সুঠাম দেহের পশ্চাতে তাহুরা আয়েশী ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে।মন মাতোয়ারা ঘ্রাণ ধাক্কা খেলো তাহুরার নাকে।লোকটা আশেপাশে থাকলে তার বড্ড সুখ সুখ লাগে সর্ব দুনিয়া।তাহুরা বুঝতে পারে,এই রাগী কলেজের স্যারটা এখন তার সারা মনে বসবাস করে।সেথায় একমাত্র রাজা তার এই যে,তার উমাইর।

ছাদে পৌঁছে উমাইর ফোন কানে চেপে অন্যদিকে যায় তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে।তাহুরা এগোয় বোনের পানে।সুনেরা বোনকে কাছে পেয়ে ছবি তুলে বেশখানেক।টিস্যু দিয়ে বোনের নাকে সরে যাওয়া মেকাপ মুছে বলে,
–“তোর নাকের মেকাপ নষ্ট করেছে কে?মা বললো জাফরানের সাথে রুমে তুই।জাফরান করেছে?”
তাহুরার হাত হাত পৌঁছে নাকে।কি সাংঘাতিক লোকটা! ছলেবলে মেকাপ নষ্ট করেছে তার।অথচ বুঝতে দেয়নি।
–“নাহ আপু।জাফরান করেনি।”
জবাব দেয় তাহুরা।

–“সে যায় হোক,জাফরানের মামাতো ভাই থেকে দূরে থাকবি। ঐ ছেলের জন্যে বাবার কাছে তোর প্রস্তাব দিয়েছে মামী।বাবা রেগে আছে।ছেলেটাকে তোর আশপাশ দেখলে আবার সমস্যা করবে বাবা।”
বোনের আড়ালের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে তাহুরা।ধীর কণ্ঠে বলে,
–“আচ্ছা।”

কাহিনী এতদূর এগিয়েছে!অথচ কেউ বলেনি তাকে কিছু।উমাইর জানে বুঝি কথাগুলো?তাই তুনাজ নামের ছেলেটা হতে তাকে বাঁচিয়েছে!আবারো তাহুরার উৎসুক নজর খুঁজতে থাকে উমাইরকে।পেয়েও যায় দ্রুত।ইমনের সাথে দাঁড়িয়ে উমাইর।তাহুরার পানেই চেয়ে সে।দৃষ্টি মিললে,হতভম্ভ তাহুরা অন্যদিকে ফিরে।পলক ফেললে ভেসে উঠে উমাইরের অবয়ব,অনুভব করে তার সুঘ্রাণ। বুকে হাত চাপে তাহুরা।আপন সুরে আওড়ায়,
–“তোমার দেবর একটা রাগী,পাষাণ আবার ভালো জলদস্যু,আপু!”

চলবে…..

#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব-১৬
___________________
–“উমাইর!সমস্যা নেই,বাবা।এমন মেজাজ গরম করতে নেই।তাহুরার বাবা রাজি হয়নি তুনাজের প্রস্তাবে।”
পিঠে হাত বুলিয়ে ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টায় মেঘলা বেগম।ছেলে তার চুপচাপ থাকলেও,একবার মেজাজ চটলে হুঁশ খুইয়ে ফেলে।কিছু কাজে নিজ রুমে যায় উমাইর ক্ষণিকের জন্যে। ফের ছাদে এসে অবলোকন করে তুনাজের মা’সহ, তুনাজ মুন্সীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে।তারা হেসে কথা বলছে কিন্তু মুন্সীর মুখশ্রী গম্ভীর।নজর ঘুরিয়ে সে তাহুরাকে দেখে নেয় একবার।মেয়েটা মায়ের সাথে লেপ্টে।কিছুটা অস্বস্তি তার চোখে মুখে।প্রেয়সীর জড়তা হজম হচ্ছিলো না উমাইরের।তার মাকে প্রশ্ন করে ঘটনার ব্যাপারে।ঘটনা জানলে ক্রোধে মত্ত হয় মানব।তুনাজের পানে ছুটে যেতে চাইলে সামলায় মেঘলা।

বাঁক ফিরে উমাইর। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে জবাব দেয়,
–“বুঝলাম না মা,বারবার মানা করা সত্ত্বেও ওরা মা ছেলে দমছে না কেনো?”

–” বিয়ে শাদীর বিষয়টি এমন।প্রস্তাব যারা দেয় ওরা নাছোড়বান্দা হয়।আমাদেরও হতে হবে। মুন্সী সাহেবের ছোট মেয়েটাকে এতো সহজে দিবেন না উনি।”
ছেলেকে মেজাজ ঠান্ডা করার ইশারা করেন মেঘলা।

উমাইর কাঁধ নাড়ায়। ঘাড়ের ট্রিম চুলে হাত বুলায়,
–“নাছোড়বান্দা না।আমি উঠিয়ে আনবো মুন্সী সাহেবের ছোট মেয়েকে।”

উমাইর সম্মুখে অগ্রসর হয়।তার বলা বুলি যেনো একেবারে সাধারণ মনোভাব।অথচ দুই পরিবারের মান সম্মান জুড়ে আছে সেই বাক্যে।মেঘলা দ্বিধায় ভুগে। স্যার,ছাত্রীকে তুলে আনলে দৃশ্যটা সমাজে কেমন রূপ ধারণ করবে?কিভাবে সেই দিনগুলোর সাথে লড়াই করবে মেঘলা জানেনা।তার ছোট ছেলেটা বড্ড জেদী।ভালো তে ভালো।তবে,একবার জিদ চাপলে মস্তিষ্ক তার নড়বড়ে।মেঘলা নিজ ভাবনায় লক্ষ্য করে তুনাজের মা এবং তুনাজ ভোঁতা মুখে প্রস্থান করছে মুন্সী হতে।

খানিক বাদে মুন্সী তাড়া দেয় বাড়ি ফেরার তাগিদে।ঘোষণা জারি করে দ্রুত নিচে নামে মুন্সী।পরিবারের সকলে মন্থর গতিতে যেতে প্রস্তুত।কুশল বিনিময়ের অন্তিম পর্ব সারছে তারা।অবশেষে পর্যায়ক্রমে একে একে আত্মীয়রা নামতে থাকে।

সুনেরা,জুবায়েরের ফটোসেশনের সমাপ্তি হলে তাহুরা বোনকে ধরে সাবধানে হাঁটে সকলের শেষে।তাদের পিছনে উমাইর এবং জুবায়ের।এমতাবস্থায় প্রিয়তমার নিকটে যেতে সুযোগ লুফে নেয় জুবায়ের।টেনে ধরে সুনেরার দোপাট্টা,
–“আমার সাথে হাঁটো।”

তাহুরা ব্যাপারখানা বুঝে নিজে উপরে উঠে এক সিঁড়ি।উমাইর আরো দুই সিঁড়ি উপরে দাঁড়িয়ে।

প্রিয়তমার হাতের মাঝে নিজ হাতের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটায় জুবায়ের।হবু বউকে সামলিয়ে সাবধানে নামতে থাকে।

উমাইর তাহুরার সিঁড়িতে আসে।পাশাপাশি চলে দুজন।তাহুরার আর নজর উমাইরের বক্ষ অব্দি সীমাবদ্ধ।অথচ উমাইর তার প্রেয়সীর বাম দিকের দৃশ্যমান সৌন্দর্যে মত্ত। মেয়েটার নাকে জ্বলজ্বল করছে নাকফুল। সেথায় উমাইরের নামে কিঞ্চিৎ বড় নাকফুল পড়লে নিশ্চয় তাহুরাকে উমাইরের বউ বলে মনে হবে।কবে আসবে সেই দিন? ভাইয়ের বিয়ের পরপর কেনো মেয়েটাকে নিজের করে নিতে পারবে না সে!মনের অবস্থা নাজেহাল উমাইরের।
———
উমাইরদের গাড়ি করে পাঠানো হয় তাহুরাদের।যাওয়ার আগে তুনাজের মায়ের কার্যক্রম দৃষ্টি হতে মুছে যায়নি উমাইরের।স্পষ্ট দেখলো তুনাজের মা তাহুরার হাতে কাগজ গুঁজে দেয়।

বাসা ভর্তি মানুষের সামনে কিছু বলতে না পারলেও সঙ্গে সঙ্গে তাহুরাকে মেসেজ পাঠায়,
–“তুনাজের মা যা দিয়েছে খুলে দেখারও দরকার নেই।”
মেসেজ ডেলিভার্ড হয়েছে। তাহুরা দেখেনি এখনো।

কক্ষে ফিরে উমাইর। ছোট মামীর সাথে তুনাজের বিষয় নিয়ে কথা বলবে কিনা তা নিয়ে ভাবনায় মশগুল।পুনরায় মোবাইল চেক করলে দেখে তাহুরা অনলাইনে কিন্তু উত্তর নেই। চটে যাওয়া মেজাজে আগুন জ্বলে উমাইরের। দ্রুত ফোন লাগায়। এনাদার কল ভেসে উঠে স্ক্রিনে।বসা হতে উঠে দাঁড়ায় সে। তার ধারণা কি সত্যি হচ্ছে?তুনাজ তাহুরাকে ফোন দেয়নি তো?তাহুরা যদি তুনাজের সহিত কথা বলে তবে উমাইর জানেনা,সে নিজ হুঁশ খুইয়ে কি করবে।

হাতের মুঠোয় ফোনে বল প্রয়োগ করে উমাইর।বাচনভঙ্গি শক্ত।ক্ষিপ্ত সুরে আওড়ায়,
–“কলের বিপরীতে যদি তুনাজ থাকে, বোকা পাখি তোমার ভঙ্গুর ডানা আমি একেবারে ভেঙে দিবো।”

মোবাইল ছুঁড়ে সে বিছানায়। ডান পাশের ট্রিম করা ছোট চুলে আঙুল চালায় দ্রুত।মেয়েটা এতো ব্যস্ত কথা বলতে যার দরুণ উমাইরের মেসেজ দেখলো না! এতো সাহস?

মিনিট পাঁচেক পার হয়।মেসেজের টোন বেজে উঠে।উমাইর বিছানায় উবু হয়ে শোয়,মোবাইল বিছানায় পড়া অবস্থায় মেসেজ চেক করে,
–“আমি কাগজটা ফেলে দিয়েছি অনেক আগে।কি ছিলো সেটাও দেখিনি।আপনি ফোন দিয়েছিলেন?মা,নানুর সাথে কথা বলছিল আমার মোবাইলে।আপনাদের মেহমান আছেন সবাই নাকি চলে গেলো?”

শান্ত হয় উমাইরের টগবগে তনু,মস্তিষ্ক। শীতলতা অনুভব করছে এখন তার দেহ।তাহুরার মেসেজের জবাব দেয়নি সে আর।নিশ্চিন্ত মনে আঁখি বুঁজে।
—————–
সুনেরার বিয়ের ডালা পাঠাবে আজ উমাইরের পরিবার হতে।সেই উপলক্ষে জাফরানের মা, জাফরান,তার বাবা সকলে উপস্থিত।ডালা নিয়ে যাবে কেবল উমাইর,জাফরান এবং আফিয়া।বসায় ঘরে সারি সারি ডালা।হরেক রকম জিনিস তাতে।সবটা সুনেরার।ছোট মামীকে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উমাইর সেদিকে যায় নিঃশব্দে।গলার স্বর নামিয়ে বলে,
–“মামী,কিছু কথা ছিলো।”

নম্রতা একটু অবাক হয়।মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,
–“হ্যাঁ,উমাইর বলো।”
–“তুনাজের পরিবারকে যেহুতু তাহুরার পরিবার মানা করেছে তাই এই কথাটা শেষ হলে ভালো।তাহুরাকে দেখে তুনাজ বা ওর পরিবারের কেউ গিয়ে কথা বললে,তাহুরার মন খারাপ হবে।এমনটা হওয়া স্বাভাবিক।আপনি ওদেরকে মানা করবেন এমনটা যেনো না করে।”
সাবলীল বাচনভঙ্গি উমাইরের।

–“তাহুরার ফ্যামিলি কিছু বলেছে?”
নম্রতা প্রশ্ন করে
–“বলেনি।তবে বলতে কতক্ষণ?তুনাজ ওকে হ্যারেস করতে দেখলে মুন্সী আঙ্কেল মেবি তুনাজকে কটু কথা বলতে পারে।”
–“হুম।বিষয়টা নিয়ে আমিও ভাবছিলাম কিছুদিন।তুনাজ বেশি পছন্দ…”
নম্রতা বলতে নিলে কথায় ফরণ কাটে উমাইর,
–“তুনাজের পছন্দ নিয়ে কেউ ভাবছে না তাহুরার বাসায়। তারও ভাবা উচিত নয়।”

ভিড়ের মাঝে মাকে খুঁজে নেয় উমাইর।নম্রতা কিছু বলতে চাইলেও সেদিকে মন দেয়নি।মাকে চিল্লিয়ে ডাকে।মা কাছে এলে মুখ খুলে,
–“টিফিন দিও না আজ।আমি রনির সাথে দেখা করবো লাঞ্চ টাইমে।”
–“ঠিকাছে আব্বা।তোমার জন্যে প্রোগ্রাম রাতে সেট করেছি।দেরী করবে না।”
–“আচ্ছা।”
উমাইর হাতের চতুর্ভুজাকৃতির ব্যাগ নিয়ে হনহনিয়ে চলছে।

তার সুঠাম কাঁধের পানে দৃষ্টি নিবিদ্ধ অবস্থায় নম্রতা মেঘলাকে জিজ্ঞাসা করে,
–“উমাইর আজকে নিজ থেকে আউট টপিকে কথা বললো আপা।”
–“কি নিয়ে?”
মেঘলা প্রশ্ন করে।
নম্রতা খুলে বললে ঘটনা মেঘলা বিষম খায়।ছেলেকে এতো মানা করেও সামলানো যায় না।মেঘলা মৃদু স্বরে বলে,
–“বিয়েটা ঠিকভাবে হোক,ঝামেলা ছাড়া তাই উমাইর এমনটা বলেছে।বাড়তি ঝামেলা ও পছন্দ করে না।তুমি জানো নম্রতা।”

–“আমার অন্য কিছু মনে হচ্ছে আপা।”
হাসে নম্রতা।
–“মনে হোক আর যায় হোক,এখন কাজে হাত বাড়াও।তুমি সুন্দর ডালা সাজাও নম্রতা। লেহেঙ্গার ডালা তুমি রেডি করো।”
বিপরীতে হেসে প্রস্থান ঘটে মেঘলার।বুঝেও কিছু বুঝেনি নম্রতা।
————-
সূর্যের দেখা নেই।তবে ভ্যাপসা গরম।পরপর চারটি ক্লাস শেষে হাঁপিয়ে উমাইর।তার কেবিনে স্টাফ লেমন জুস দিয়ে যায়।চারটি ক্লাসের দুইটিতে আধ ঘন্টা করে পরীক্ষা নেয় তো বাকি দুই ক্লাসে সম্পুর্ণ পাঠদান করে।জুসের গ্লাস খালি করে রনিকে ফোন দেয়।লালখান বাজারে অবস্থিত “বার্গারিটা” রেস্টুরেন্টে আসার আহ্বান জানায়।

ঘড়িতে দুপুর সাড়ে তিনটা।উমাইর তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যায় কলেজ হতে।রনির সাথে দেখা করতে কলেজের পাশের রেস্তোরা ঠিক করলেও,গত রাতে তাহুরার দেওয়া মেসেজ নোটিফিকেশান বার থেকে পড়ে নেয়।তাহুরা জানিয়েছে সে জরুরি কাজে বান্ধুবির সাথে অত্র রেস্টুরেন্টে যাবে।কি কাজে,কেনো যাচ্ছে তা উমাইর নিজ চোখে অবলোকন করতে সিদ্ধান্ত বদলায়।

গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরায় সে,বাড়ায় গাড়ির স্পীড।
দুই তলায় অবস্থিত রেস্টুরেন্টে। সিঁড়ি ভেঙে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে উমাইর।লোকজন ভালোই। বাম পকেটে হাত রেখে দৃষ্টি ক্ষীণ করে। কোণার দিকে টেবিলে তাহুরা সাথে অন্য মেয়ে বসে।পাশের মেয়েটাকে চিনে উমাইর। তারই ছাত্রী।চৈতালি।মেয়েটা ফোনে ব্যস্ত।

উমাইর তাদের বিপরীতে দেখা না যাওয়ার মতো চেয়ারে বসে।ততক্ষণে রনিও আসে।খোশ গল্পে মেতে উঠলো দুই মানব।তবে,উমাইরের শান্ত মেজাজ বেশিক্ষণ শান্ত থাকেনি।তাহুরাদের মাঝে অচেনা ছেলের উপস্থিতি তার অপছন্দ হলো ঢের।
ছেলেটা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চৈতালি উঠে পড়ে।অনুরোধের সুরে তাহুরাকে বলে,
–“তুই এইখানে বস এক ঘন্টা।আমি ওর সাথে একটু যাচ্ছি।একটা ছোট কাজ সেরে আসি।”

বিপাকে বদ্ধ তাহুরা। এইভাবেও বাসায় খুব কষ্টে ম্যানেজ করেছে সে আজ।চৈতালিকে কথা দিয়েছিল সে বহুপূর্বে।কাকতালীয় আজই দুই কাজ একসাথে পড়লো তার।কিন্তু,এমন কিছু হবে ভাবেনি তাহুরা।সে কেবল এসেছিল চৈতালির সাথে কিছু সময় কাটাতে।বাড়িতে বহু কাজ।তাও মেয়েটা সইয়ের নিকট কথার খেলাফ করেনি।

–“তুই…আমাকে ফেলে…আমি একা কিভাবে!”

–“আপু প্লিজ কিছু মনে করবেন না।আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।একটু পর এনে দিবো।”
ছেলেটা আর দেরী করলো না।চৈতালির হাত ধরে বেরিয়ে যায় হনহন করে। তাড়াহুড়ই খেয়াল করেনি উমাইরকে।চৈতালির ব্যাগটাও রয়েছে তাহুরার নিকট।

তাহুরা ভিড়ের জায়গায় বড্ড বেকাদায় পড়ে।আজ সে চরম একা।কি করবে সে একা এইখানে!চৈতালি কেনো করলো তার সাথে এমন?ভরা রেস্টুরেন্টে কি করবে?চৈতালির ব্যাগ ফেলে চলে যাওয়া সম্ভব না।ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করে তাহুরা কি নিবে,ওর অর্ডার কি?

নিশ্চুপ তাহুরার কোলে অশ্রু পড়ে দুফোঁটা। এর মাঝে তার প্রিয় কণ্ঠ শুনতে পায় মেয়েটা,
–“রেস্টুরেন্টে মানুষ খেতে আসে, কাঁদতে না।”

তাহুরা মাথা উঠিয়ে চায়।মুহূর্তেই মনে হলো,অচেনা দুনিয়ায় মোহনীয় পুরুষটা তাকে রক্ষা করতে এসেছে।
উমাইরের গভীর দৃষ্টি তাহুরাতে।ইতিমধ্যে নাকের রঙের পরিবর্তন হয়েছে।পল্টিবাজ বন্ধুর সাথে দেখা করার মানে নেই কোনো,যদি অপর বন্ধু নিতান্তই সহজ সরল হয়।

–“ফাইভ মিনিটস পরে আসুন।”
ওয়েটারকে বললে,উনি চলে যান।উমাইর তার কব্জির দিক হতে বোতাম খুলে শার্টের হাতা গোটানো অবস্থায় বলে,
–“আরেকটু যাও।আমি বসবো।”

–“জ্বী?”
হতভম্ব তাহুরা প্রশ্ন করে।

–“কান্না করে কি কানেও কম শুনছো?”
তাহুরা দুদিকে মাথা নেড়ে একটু চেপে বসে।পরপর উমাইরের আওয়াজ শুনতে পায়,
–“রনি আয়।”

রনি এসে লম্বা সালাম দেয় তাহুরাকে।মেয়েটা সালাম গ্রহণ করে মৃদুস্বরে।উমাইর বেশ আয়েশ করে বসে তাহুরার নিকট।মাঝে অবশ্য দূরত্ব।উমাইর ফিরে তাকায় তাহুরার পানে।মেয়েটা রনিকে লজ্জা পাচ্ছে নিশ্চিত। অতঃপর তাহুরাকে সে বলে,
–“আমার ফ্রেন্ড রনি।বি ইজি।সে চলে যাবে একটু পর।”

–“আমি ঠিক আছি।”
নম্র উক্তি তাহুরার।

রনি শুনে হাসলো।ওয়েটার এলে অর্ডার দেয়।মোবাইল সম্মুখে ধরে। অধরে দুষ্টুমির হাসি।
অন্যকিছু চলছে তার মস্তিষ্কে।

বুঝে সব উমাইর।মোবাইলে নোটিফিকেশান আসলে উমাইর বুঝেও দেখেনি।টেবিলে বারি দেয় মৃদু,
–“নাটক বন্ধ কর।”

–“আমি মুখে লাগাম দিয়ে আছি আঙ্কেল।বাকি দুইজন এলে নিশ্চয় চুপ থাকতো না।ভালো লাগছে তো।”
ইশারায় বুঝায় তাহুরাকে উমাইরের পাশে মানিয়েছে।
–“রনি!”
মেকি রাগ দেখায় উমাইর।রনি দুই হাত তুলে।রসিকতার সুরে আওড়ায়,
–“আচ্ছা আচ্ছা।ঝিপ করলাম লিপ।”

খাবার এলে রনি দ্রুত খেয়ে বেরিয়ে যায়।তাহুরা এখন হাফ ছেড়ে বাঁচে।মিনিট চল্লিশ পার হলেও আসেনি এখনো চৈতালি।চেয়েও তাহুরা রিল্যাক্স হয়ে বসতে পারছে না। একটু উনিশ বিশ হলে উমাইরের বাহুতে হাত লাগবে শতভাগ নিশ্চিত।এইদিকে উমাইর নড়ছে না পাশ হতে।

উমাইর ঘুরে তাহুরার পানে।মেজাজ তার বিগড়ানো,যা এতক্ষণ প্রকাশ করেনি রনির সম্মুখে।গম্ভীর তবে ধিম শব্দে তাহুরাকে সে বলে,
–“মেয়ে ফ্রেন্ড নিয়ে ঢং করতে এসেছো? ও জানেনা, তুমি কেমন?আমি না এলে কি করতে এতক্ষণ?ভরা মানুষকে তোমার ছিঁচকাদুনে স্বভাব দেখাতে?”

কেঁপে যায় তাহুরার সত্তা।তিরতির করে দু হাত।কি জবাব দিবে!
–“ও এমন করবে আমি ভাবিনি।”

–“তুমি বোকা দেখে তোমাকে চুজ করেছে সে।মেয়েটা তো জানে,ঘণ্টার পর ঘণ্টা তুমি এইখানে বসে থেকে কাঁদলেও প্রতিবাদ করবে না।তোমার মাথায় ঘিলু নেই।”
উমাইর চেয়ারে গা এলিয়ে বসে।এক হাত তার তাহুরার চেয়ারের উপর। তাহুরা আরেকটু চেপে যায়।কান্না পাচ্ছে তার।কেনো পায় এতো কান্না!এখন কাঁদলে উমাইর আবার রসিকতা করবে নাহলে কড়া কথা শুনাবে।

–“ভাগ্যিস আমি এসেছিলাম।আর কোনোদিন এমন দিলদরিয়া কাজ করতে যেনো না দেখি তোমাকে।”
ধমকের সুরে বলে উমাইর।

সেই ধমকে তাহুরার হাত নড়ে।সসে ডুবন্ত চিকেন লেপ্টে যায় গালের কিনারায়।
–“ইজি,ইজি।আচ্ছা ধমক দিচ্ছি না। ধীরে খাও।”

তাহুরা নিজ কপালের কিনারায় হাত রাখে।চোখ খিঁচে বলে,
–“সরি।”
তাহুরার অধরের নৃত্যে দিশেহারা উমাইর।টিস্যু নিয়ে গালে ঘষে তাহুরার।ভেতরকার সত্তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে দমাচ্ছে সে।দ্বিগুণ রাগী কণ্ঠে আওড়ায়,
–“সরি বললে ভুল জিনিস সঠিক হয় না,মাথামোটা।”

সশব্দে ফোন বাজে তাহুরার।মুন্সীর নাম দেখে আরো ঘাবড়িয়ে যায়।দুই বাঘ আজ তাহুরাকে শিকার করবে নিশ্চিত।বাবাকে কি বলবে এখন?

তাহুরা উমাইরের পানে তাকায়।দৃষ্টি মিলে দুজনের।মেয়েটার নজর স্পষ্ট পর্যবেক্ষণ করে প্রেমিক পুরুষ।তার প্রেয়সী ভয়ে আড়ষ্ট।নিজের ভাবভঙ্গি নরম করে উমাইর।কিঞ্চিৎ কাছে যায় তাহুরার।মাথায় হাত রাখে।সেথায় আঙ্গুলের সহিত টোকা দেয়,
–“ফোন ধরো।বাবাকে বলো দশ মিনিটে বাসায় যাচ্ছো।”

তাহুরা কম্পিত সুরে বাবাকে জবাব দেয়।বিল মিটিয়ে ফেলে উমাইর।

বসা হতে উঠে দাঁড়ায়।তাহুরা ভয় পায়।উমাইর তাকে ফেলে চলে যাবে?আড়ষ্ট সুরে আবারও সে উমাইরকে বলে,
–“এই যে,আপনি কি আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছেন?”

“এই যে” ডাকটা শুনলে উমাইর নিজ সত্তাকে খুঁজে পায় না।গায়ে জ্বলন হয়।মাথার কাপড়ে আবৃত মেয়েটার কপালে চুল ভাসমান।সেই চুলের মধ্যখানে ভ্রু উচাঁনো আকুতি ভরা দুই আঁখি। উমাইর এই মেয়েকে ফেলে যাবে!মোটেও না, কক্ষনো না।উমাইর পারছে না,এখনি মেয়েটাকে কাছে টেনে কিছু প্রিয় কথা বলুক!

–“মাথামোটাকে ভরা মজলিশে ফেলে যাবো?আমি তোমার মতো বোকা না।”
নিজ ভাবনাকে আড়াল করে জবাব দেয় উমাইর।

–“ওরা আসেনি এখনো।”
তাহুরা বলে।
–“না আসুক।জিনিসপত্র উঠিয়ে নাও।দেরী হচ্ছে তোমার।”
উমাইরের কথার খেলাফ কিভাবে কি করবে বুঝলো না তাহুরা।চটজলদি করতে নিলে তার ব্যাগ ছুটে পড়ে ফ্লোরে।

–“আরে, আস্তে করো।আমি আছি তো।”
উমাইরের কথার প্রত্যুত্তরে তাহুরা হাতে তুলে সব।
চৈতালির ব্যাগের কথা জিজ্ঞাসা করলে,উমাইর সেটা রিসিপশনে জমা দেয়।সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ব্যাগের মালিককে চিনে, তারা ব্যাগ নিতে আসলে তাদের ব্যাগ ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে বেরিয়ে আসে রেস্টুরেন্ট হতে।

কি-বাক্সে বিদ্যমান বাটন টিপে গাড়ি আনলক করলে তাহুরা একটু ভাবুক হয়।এই সময়ে উমাইরের গাড়ি করে যাওয়া ঠিক হবে না।আব্বা যদি কোনোভাবে দেখে,ব্যাপক বকবে।তাহুরা পূর্বের মতো এলাকার আগে করে নামলে সমস্যা হবে না।তাও তাহুরা গোলমাল করতে চায় না কিছু।

উমাইর গাড়িতে উঠতে নিলে তাহুরা বলে উঠে,
–“এইযে শুনুন না!”
পা থামে উমাইরের।বক্ষের গতি অস্বাভাবিক।মেয়েটা তাকে অসুস্থ করে ফেলবে?ভালোবাসার অসুখটা যে মারাত্মক!

–“হুম?”
উমাইর ঠাঁই দাঁড়িয়ে।
–“বাবা,এইভাবে যদি আপনার সাথে আমাকে দেখে ভুল বুঝবে।আজ বাবা এলাকায় আছে।দোকানে নেই।আমি রিক্সা নিয়ে যায়।”
তাহুরা আনচান মনে উত্তর দেয়।

উমাইরের অন্তরে শান্তি মিলে না।এই বাবা মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতে তার জীবনে আর উন্নতি আসবে না।ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে উমাইরের।দ্রুত হেঁটে বাহু চেপে ধরে তাহুরার।বিস্ফোরিত নজরে মেয়েটা রাগে টগবগে উমাইরকে পর্যবেক্ষণ করতেই বুকটা ভারী হয়।কি খারাপ বললো সে?

মনের ভাবনা পূর্ণ হতে না হতে প্রিয় মানুষটার শান্ত কিন্তু ভয়ানক কথায় জমিন হতে পা সরে তাহুরার।

উমাইর ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে বলে,
–“তোমার তিরিক্ষি মেজাজের বাবার জন্যে কি তোমার সাথে এক গাড়িতে বসতেও পারবো না আমি?এই তোমরা বাবা মেয়ে আমাকে কি করতে চাও?তোমাকে গাড়ি করে তোমার বাড়ি দিয়ে আসবো,আমার বাড়ি এখন নিচ্ছি না।পারবো না আমি তোমাকে রিক্সায় যেতে দিতে।”

তাহুরা হাওয়ায় ভাসছে।উমাইর তার হাতের তালুতে আঙ্গুল গুঁজে।গাড়ির দরজা খুলে তাহুরাকে বসায়।পরপর নিজে এসে ড্রাইভিং সিটে বসে।এক মিনিট জোরে শ্বাস নিয়ে তাহুরার গালে নিজ হাতের উল্টোপিঠ ছুঁয়ে দেয়,
–“আজ তোমার বাবা দেখুক,উল্টাপাল্টা ভাবুক।দেখি কোন অঘটন করেন উনি।আমি তোমার বাবা কি,আমার বাবাকেও ভয় পাই না।উমাইরের জীবনে তুমি না চাইতেই চলে এসেছো,তাহু।আর যাওয়ার পথ নেই কোনো।”

চলবে……..
কপি করা নিষেধ।কেমন হয়েছে সবাই জানাবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে