রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব-৯+১০

0
1168

#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব-৯
______________
–“সুনেরার বিয়ের পরপর তাহুরার বিয়ে দিবো।ছেলে ঠিক করা আছে।আমার শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়।”
গর্জে উঠে মুন্সী মিয়া।তাহুরা কেঁদে উঠে শব্দ করে।উমাইরকে ইশারা করে।অথচ উমাইর কিছু করতে পারলো না।তার হাত পা যেনো বাঁধা। তখনই কক্ষে এক পুরুষালি অবয়ব ভেসে আসে।অবয়বটি তাহুরার পানে যাচ্ছে। ভীত,অশ্রুসিক্ত তাহুরা পিছপা হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে।শব্দ করে বলে,
–“এই যে দেখুননা,লোকটা আমার দিকে ভয়ংকর ভাবে আসছে।”
উমাইর সম্মুখে এগোতে চায়।তার পা আটকে।মেঝেতে দৃষ্টি ফেলে।অদ্ভুত সকল দৃশ্য।তার পায়ে শিকল বাঁধা।আবার মেঝেটা মাটির।পা নাড়াতে অক্ষম সে।শব্দ করতে চাইলো মুখ দিয়ে।পারলো না। ঠোঁটে হাত রাখে,তার দুঠোঁট যেনো চিপকে আছে একসাথে।আচমকা লোকটা গলা চেপে ধরে তাহুরার।মেয়েটা আর্তনাদ করলো না,মুখ ফুটে কিছু বললো।বুঝলো না উমাইর। তবে অনুভব করলো লোকটা তাহুরাকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে তার থেকে।

এলার্মের টিটি শব্দে মুখরিত কক্ষ। উমাইরের চোখ জোড়া এক নিমিষে খুলে। উপরিভাগের সাদা সিলিং দৃশ্যমান।পর্দার অন্তরালে ভেদ করছে কঠিন আলো। মোটা দামী পর্দাখানা আলো ঠেকাতে হিমশিম খায়।অকারণে ঘেমে আছে সে।অথচ কম পাওয়ারে এসি চলছে।
এই মুহূর্তে তার মস্তিষ্কে চলমান একটাই বাক্য “তাহুরা”। স্বপ্ন দেখেছে উমাইর।বিশ্রী এক স্বপ্ন। জোরে শ্বাস ফেলে।উদাম শরীর হতে কম্বল সরায়। তর্জনী,বৃদ্ধাঙ্গুল সহিত কপাল চেপে ধরে।বুকের উঠানামা দ্রুত।এমন বাজে স্বপ্ন না দেখলেও হতো। বালিশের পাশ হতে মোবাইল হাতড়ে নেয়। ঘড়িতে সকাল ছয়টা বেজে চার মিনিট।প্রভাতে বাহিরে দৌড়ানো তার দৈনন্দিনকার রুটিন। মোবাইল হাতের মুঠোয় নিয়ে আধ শোয়া অবস্থায় বসে।

হোয়াটস অ্যাপে ঢুকে।দু’দিন মেয়েটার দেখা পায়নি উমাইর। এতে এমন অস্থিরতা সৃষ্টি হলো যে,একেবারে বিভৎস এক স্বপ্ন দেখেছে।না খুন ছিলো,না কোনো নৃশংসতা!তাও স্বপ্নটা বিভৎস।তাহুরা উমাইর থেকে দূরে যাবে,এটা বিভৎসতা নয় তো কি?
মোবাইলে নজর বুলায় উমাইর।শেষ মেসেজটা তাহুরা দিয়েছিলো,
–“আপনার চারা কাল পেয়ে যাবেন।এখন ঘুমায়।খোদা হাফেজ।”
মেসেজ পাঠানোর সময়কাল রাত দুটো। বোনের শ্বশুর বাড়ির জন্যে প্রস্তুতি নিতেই হয়তো রাতের অনেক সময় অব্দি কাজ সেরেছে তাহুরা।
উমাইর কাল রাতে জলদি ঘুমিয়েছিল।ফলস্বরূপ এখন সে মেসেজ পাঠায়,
–“দেখা যাক কবে পায় চারা। এতো রাতে অনলাইনে ছিলে কেনো?”

উমাইর মোবাইল রেখে দু হাত উপরে উঠিয়ে কোমর বাঁকিয়ে কিছুক্ষণ অনুশীলন করে।অধরে তার হাসি লেপ্টে।স্বপ্নের জন্যে তার মোটেও কোনো দ্বিধা নেই।বরংচ মেয়েটার উপর সে আরো গভীর নজর জারি করবে। অন্য কারো অবয়বের পবন অব্দি লাগতে দিবে না তার রূপসীর অবয়বে।বিছানা হতে নামতে নামতে সে আপনমনে বলে,
–“দুঃস্বপ্ন বলতে কিছু নেই,কেবল আছে একটাই স্বপ্ন।তুমি আমার বাহুডোরে আবদ্ধ হবে সারাজীবনের জন্যে।এই স্বপ্নটাকে আমি বাস্তবে রূপ দিবো,প্রাণ।”

আলগোছে নিজের বিছানার চাদর পরিপাটি করে গায়ের পাতলা চাদর গুছিয়ে রাখে পায়ের কাছটায়।পরক্ষণে টিশার্ট এবং থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট নিয়ে বাথরুমে যায়।আজ আটটা থেকে তার ক্লাস।কিছুক্ষণ এক্সারসাইজ করে আবার অফিসে ছুটতে হবে।অবশ্য আজ তার কলেজ ছুটিও তাড়াতাড়ি হবে।

জগিংয়ে যাওয়ার সময়ে নিচতলা ফাঁকা হলেও এখন আবার কাজের লোক হতে শুরু করে চাচী,মাকে দেখা যাচ্ছে।বাগানে নিবরাসকেও দেখেছিল উমাইর।
সিঁড়ির নিকট এলে তার সম্মুখে আসে মেঘলা বেগম।ছেলেকে অনুরোধের সুরে বলে,
–“আজ জলদি আসবে?”
–“হ্যাঁ।ক্লাস কম আজকে।ধরো বারোটার আগে ফ্রি হবো।”
উমাইর ক্লান্ত মুখে জবাব দেয়।
–“তাহলে সোজা ঐবাড়িতে এসে যাবে?”
–“নাহ।আগে বাসায় আসবো।দেরী হচ্ছে আমার।নাস্তা দাও।”
কথা বাড়ায় না আর উমাইর।দ্রুত পায়ে উপরে উঠে। আফিয়াকে অবলোকন করে সে।তবে আফিয়ার আগানো দেখেও থামেনি উমাইর। তৈরি হবে সে।

শার্টের বাটন ঠিক করে,চুলে চিরুনী চালায় উমাইর। গতদিন ট্রিম-শেভ করার দরুণ গালে খোঁচা দাড়ি।হাতের ঘড়ি ঠিক করে মোবাইল চার্জ হতে ছুটায়।আলো জ্বললে সেথায় ভেসে উঠে তাহুরার মেসেজ।উমাইর কক্ষ হতে বেরুনো অবস্থায় মেসেজ চেক করে।মেয়েটা মিষ্টি একখান মেসেজ দিয়েছে,
–“আপনাদের বাড়ির সকলের জন্যে আয়োজনে ব্যস্ত ছিলাম,তাই মেসেজ দিতে পারিনি। পরে আপনার মেসেজের উত্তর দিতে এসেছিলাম।আপনি আসছেন আজকে?”
বাঁকা হাসে উমাইর।মাথায় ত্যাড়া উত্তর কিলবিল করে।হাঁটা অবস্থায় মোবাইলে দৃষ্টি রেখে লিখে,
–“কেনো?আমি আসলে কি হবে?আমার আসা কি ফরজ?”
উমাইরের অধর প্রসারিত হয়।নিশ্চয় মেয়েটা এই মেসেজ দেখে বিচলিত হবে।উমাইর কি বুঝাতে চেয়েছে এটা ভেবে মাথা চেপে বসবে!
—————-
তাহুরা ঘরের সকল কাজ শেষ করেছে দ্রুত।সকালে উঠেছে জলদি।রাতে দেরীতে ঘুমিয়ে ফের উঠে যাওয়াতে মাথা ধরেছে মেয়েটার।অথচ কাউকে বুঝতে দেয়নি সে।অতিথিদের আপ্যায়নের জন্যে সবটা গুছিয়ে নিচ্ছে মা বোনের সহিত।কাজ মুটামুটি আয়ত্বে এলে তাহুরা মায়ের নিকট যায়।মা বিছানার চাদর ঠিক করছে।রান্নার সকল আয়োজন গতদিন থেকে আজ পর্যন্ত মিলে সব শেষ।
তাহুরা চারা কিনতে যাবে।কলেজের সম্মুখে নার্সারি থেকে সদা চারা কিনে সে।মাকে সে ভাবলেশহীন বলে,
–“মা,আমি একটু কলেজ যাবো।”
–“এখন?বারোটা বাজে।মেহমানরা আসবে।”
শিউলি বিরক্ত।
–“উমাইর স্যারের জন্যে চারা কিনতে হবে।উনি চাচ্ছিলেন।”
তাহুরা হাতে হাত ঘষে জবাব দেয়।

উমাইরের নাম শুনলে নিভে যায় শিউলি।মানা করার বদলে হুশিয়ারি স্বরে বলে,
–“জলদি আসবি।তোর বাবা যেনো টের না পায়।আর হ্যাঁ,দেখে শুনে ভালো চারা কিনবি।”
–“আচ্ছা।”
তাহুরা ব্যাপক খুশি। মা সহজে মেনে যাবে,ভাবেনি মেয়েটা।শিউলি কেবল তাকে গাড়ি ভাড়াটুকু দেয় হিসাব করে।
তাহুরা বোনের বোরকা পড়ে।মাথায় কালো হিজাব বাঁধে।মুখ উন্মুক্ত।কলেজ ব্যাগে রাখা চারার আলাদা টাকা মায়ের দেওয়ার ভাড়ার সাথে অন্য ছোট পার্সে নেয়। তাড়াহুড়োয় বেরিয়ে পড়ে।বাবা আসবে দোকান হতে বেলা আড়াইটায়। অসময়ে বিনা কারণে মেয়েকে বাহিরে যেতে দেখলে চিল্লিয়ে ঘর মাথায় তুলবে মুন্সী। কারো কথার ধার ধারবে না।

দোয়া দরুদ পড়ন্ত তাহুরা বাসে উঠে।মোবাইল নিয়ে আসেনি ভুলে।এই নিয়ে মনে শঙ্কার দানা বাঁধে।বাস থামলে সোজা যায় ফুলের দোকানের সামনে।আশ্চর্য হলেও পরিচিত দোকানে আজ গোলাপের চারা ফুরিয়েছে। বিচলিত মেয়েটা আরো হাঁটতে থাকে।কলেজের গেট বরাবর শেষ দোকানে গোলাপের চারা দেখে সে।তবে দাম আকাশচুম্বী।হঠাৎই দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ বুঝেনি। তাহুরা ধীর স্বরে জিজ্ঞাসা করে,
–“আগে এমন দাম ছিলো না।আজ দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ?”
–“আরে আপা,গোলাপের মার্কেট দাম বাড়ছে।সেজন্যে দাম বাড়লো।”
দোকানির কথায় ভাবুক হয় তাহুরা। হিসাবকৃত টাকা থেকে আরো পঞ্চাশ টাকা লাগবে।যা তাহুরার আসার ভাড়া।দোকানে ভিড় বাড়লে মেয়েটা নুয়ে যায়।সাত পাঁচ না ভেবে তার উমাইর স্যারের জন্যে চারা গাছ কিনে নেয়।

তাহুরা দোকান থেকে বেরুলে,বিপত্তি ঘটে। ফুলের দোকানের পাশের দোকান আবার বড় গ্রোসারি শপ।একই সময়ে উমাইরের অবয়ব বেরিয়ে আসে অত্র দোকান হতে।তাহুরার হাত হতে চারা পড়তে নিলেও সে সামলে নেয়।উমাইর তাহুরাকে দেখেনি।সে সোজা নিজ প্রাইভেট কারের দিকে এগোচ্ছে।
তাহুরা নিজে উমাইরের পানে ছুটে।একে, বোনকে ফোন করতে সুবিধা হবে,নাহলে আবারও কলেজে গিয়ে কোনো স্যার,ম্যাডাম থেকে বোনকে ফোন করতে হতো।তার তো দোকান হতে ফোন দেওয়ারও পয়সা নেই।এছাড়াও অজানা লোক হতে ফোন করতে ভয় করে মেয়েটা।
আর দ্বিতীয়ত, উমাইরকে ফুল গাছ এখানে দিতে পারবে।

–“এই যে!শুনুন?”
মিষ্টি মধুর ডাক। উমাইরের অন্তর শীতল হয়।হাতের প্যাকেট পেছনে সিটে রাখে।তৎক্ষণাৎ সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
পেছনে বাক ফিরলে বক্ষদেশে ধাক্কা অনুভব করে।তাহুরার হাসিমুখ।মেয়েটার আঁখিদ্বয়‌ও হাসে। রৌদ্রের তেজে মেয়েটার নাকে ঘামের আস্তরণ।
হিজাবে কেমন পরিপূর্ণ লাগছে তাহুরাকে।অত্যধিক মোহনীয় মেয়েটা পুরোটাই!

উমাইর নিজেকে সামলে নেয়।থমথমে গলায় প্রশ্ন করে,
–“তুমি?এইখানে?”
পরপর লক্ষ্য করে মেয়েটার হাতের ফুলের চারা।এটা কিনতে এসেছে?
–“চারাটা নিন। মাত্র কিনলাম।”
উমাইর নেয়নি।চেয়ে রয় কেবল। হুঁশ হারাচ্ছে সে‌।

রোদের তাড়নায় হাঁসফাঁস করছে তাহুরা। বোরকার হাতায় নাক মুছে।

–“গাড়িতে উঠো।”
নির্দেশনা দিয়ে উমাইর দ্রুত গতিতে বসে।তাহুরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।সে কেনো গাড়িতে বসবে?আপুকে ফোন দিয়ে বলবে মিনিট দশেক পর ঘরের দরজার নিকট ভাড়া নিয়ে দাঁড়াতে।সে সিএনজিতে আসবে।মা জানলে বকবে আবার!

তাহুরা উমাইরের জানালার ধারে যায়।সেথায় ঠকঠক করলেও কাঁচ নামায়নি উমাইর।কালো কাঁচ ভেদ করে কিছু দেখা যাচ্ছে না।অতঃপর তাহুরা হেঁটে অপরপাশে দরজা খুলে বসে।গাড়ি সম্মুখে অগ্রসর হয়।

কলেজের এলাকা পেরিয়ে প্রধান সড়কে গাড়ি উঠলে তাহুরা বলে,
–“গাড়ি থামাবেন?”
উমাইর গাড়ি থামায়।অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
–“কোনো সমস্যা?”
–“আপনার মোবাইলটা দিবেন?আপুকে একটা ফোন করবো।”
ভীত সুর তাহুরার।উমাইর আবার না বকে বসে।উমাইর সুনেরার নাম্বার তুলে স্ক্রিন লক করে দেয়।মেয়েটার ছবি ডিসপ্লেতে।

–“আপু তুমি দশ মিনিট পর,একশো টাকার মতো নিয়ে গেটের সামনে এসো।আমার টাকা শেষ। লোকাল গাড়িতে আসতে পারবো না।তাই সিএনজিতে আসবো।মাকে বলবে না কিছু।”
তাহুরা ফোন রাখে কথা শেষে।দ্রুত মোবাইল নেয় উমাইর।ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
–“মোবাইল নেই,টাকা নেই,ঘর থেকে বেরিয়েছো কেনো?রাস্তায় রাস্তায় মানুষ থেকে সাহায্য খুঁজতে?”
কথাখানা কেমন অপমানিত করলো তাহুরার হৃদয়কে।আঁখি জলে ভরে।সে কখনো অচেনা কারো থেকে সাহায্য এইভাবে নিতো না। উমাইর তাকে সাহায্য করে খুব বিরক্ত?

–“আমি নেমে যাবো।গাড়ি স্টার্ট দিবেন না প্লিজ।”
তাহুরা নাক টেনে বলে।কেমন আঘাত করলো উমাইরের বাক্যগুলো।
উমাইর পুনরায় গাড়ি স্টার্ট দেয়।সে যেমন বেখবর।পরপর কড়া শব্দে সে তাহুরাকে ভস্ম করে,
–“আর কখনো এমন হুঁশ জ্ঞান ছাড়া বের হবে না বাসা থেকে।বাহিরের সবাই ভালো সাহায্য করে না।মাথামোটা।”
–“আমি ইচ্ছে করে এমনটা করিনি।”
ততক্ষণে তাহুরার নাক রক্তিম, গালে অশ্রুপানি।
–“ইচ্ছে করে না হোক।তুমি দুনিয়া সম্পর্কে কি জানো না?”
–“আমি কলেজ থেকে আপুকে ফোন করবো ভেবেছিলাম।”
–“ভাবতে থাকো।”
উমাইর আর উত্তর দেয়নি।তাহুরা মিনিট পাঁচেক পর নিজেকে শান্ত করে।নিজে ফের বলে,
–“চারা নিবেন না?”
–“না নিলে খুঁজেছি?”
উমাইর কেমন ধমকে উঠে।তাহুরা কিঞ্চিৎ কাঁপে।ফিচেল কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
–“আপনি আমার সাথে রেগে?”
–“কেনো?রাগলে কি রাগ ভাঙাবে?”
তাহুরা উপর নিচ মাথা নাড়ে।সে ভাবে উমাইর খেয়াল করেনি ব্যাপারটা।কিন্তু,উমাইর খেয়াল করেছে।মূলত তার মাথায় অন্য কিছু চলছে আজ।তাহুরার প্রতি মায়ায় পরিপূর্ণ উমাইর নিজেকে সংযত রাখতে হিমশিম খায়।কারণবশত আজ কারণে অকারণে মেয়েটাকে ধমকে নিজেকে শান্তি দিচ্ছে।

তাহুরার কোলে পড়ে থাকা শুভ্র হাতটা ধরতে মনটা অস্থির হয়ে উঠে উমাইরের। তাহুরাদের বাড়ির রাস্তার কাছাকাছি এলে উমাইর গাড়ি থামায়,
–“নামো।”
–“জ্বী?”
প্রশ্ন করলে তাহুরা তার পানে ফিরে উমাইর।দুজনের দৃষ্টি মিলে।তাহুরার ভীত হৃদয়ে উমাইররের মুখশ্রী দাগ কাটে মুহূর্তে।লোকটার প্রতি অদ্ভুত মায়ায় পড়ছে সে।ধমক দিলেও লোকটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে তার।ভুলেও যায় সে,উমাইর তার কলেজের স্যার!

–“বাড়ি যাও।”
ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে জবাব দেয় উমাইর।
–“আপনি যাবেন না?”
তাহুরার প্রশ্নে উমাইর মলিন হাসে অন্তরে।মেয়েটা হয়তো সকালের মেসেজ দেখেনি তার।ফের এমন প্রশ্নে উমাইর শক্ত মুখে জবাব দেয়,
–“চারা নিয়ে বাসায় যাও।”
তাহুরা আর কি বলবে ভেবে পায়নি।যাওয়ার পূর্বে ঝুঁকে বলে,
–“আমার জন্যে রাগ করে থাকলে সরি।প্লিজ রাগ করবেন না!”

উমাইর না ফিরলো,না কিছু বললো।রোবটের মতো বিনা উত্তরে গাড়ি নিয়ে ছুটে।তাহুরা ব্যথিত মনে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে।

উমাইরের অন্তর শান্ত নেই।চোখ জোড়া আজ বড্ড বেসামাল হচ্ছিলো।কই আগে এমন বেসামাল হতো না।এখন তাহুরাও উমাইরের সাথে সহজ হতে চাইছে বলে মনটাকে সামলানো এমন কষ্টের হচ্ছে?চুলে হাত বুলায় উমাইর,
–“বোকাটা এমন মন কাড়ে,বেসামাল না হয়ে উপায় কি?”

বাড়িতে কেউ নেই।বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ড হতে জানে,সবাই মাত্র বেরিয়েছে।

উমাইর ফের গোসলের সিদ্ধান্ত নেয়।

ভেজা চুলে তাওয়াল চালিয়ে শুকাতে ব্যস্ত উমাইর।পড়নে কালো রঙের জিন্স প্যান্ট।উদাম শরীর হতে পানির বিন্দুকণা পুছতে গেলে আফিয়ার গলার আওয়াজ শুনে। উমাইরের নাম ধরে আর্তনাদ।
আফিয়া যায়নি?কোনো বিপদ হয়েছে কি?উমাইর শার্ট জড়িয়ে বেরোয় রুম হতে। সিঁড়ির রেলিং ঘেঁষে হাঁটার সময় কাউকে দেখেনি নিচতলায়।আফিয়ার রুমের দরজায় হাঁক দিলেও খুলেনি দরজা।যেই ধাক্কা দিলো দরজা ,অমনি খুলে যায় দরজা।মেঝেতে গোলাপের পাপড়ি,রুমে কড়া ঘ্রাণ।আফিয়া বিছানায় বসে আপত্তিকর অবস্থায়।বুঝতে বাকি রইলো না উমাইরের।ক্রোধে অন্ধ বনে সে।কপালের রগ দপদপ করছে।গলা ফাটিয়ে গর্জন করে,
–“খালা!”

আফিয়া এমনটা আশা করেনি।সে উঠে কাপড় জড়াতে গেলে উমাইর চিল্লিয়ে উঠে ফের,
–“বেহায়া, স্লাট কোথাকার!”
অন্তরখানা পুড়ে ছাই হয় আফিয়ার।পা থমকে যায়।ততক্ষণে দৌড়ে আসে খালা।আফিয়ার অবয়বে নজর গেলে মুখ ফুটে বলে,
–“আস্তাগফিরুল্লাহ্।”
–“ও চিলাচ্ছিল তখন আসেননি কেনো?আমি ডেকেছি আর হাজির?আফিয়া মানা করেছে?কেনো করেছে দেখেছেন?মা,চাচী আসলে মুখ খুলবেন নিজ থেকে।”
উমাইরের কণ্ঠ ঝলসে দেওয়ার মতো প্রখর।অর্ধ বয়সী রুজি নেতিয়ে। লোভে পড়ে এখন বিপদে ঠেকেছে।
–“দুঃখিত সাহেব…”

–“থামুন।মা,চাচী আসলে নিজ থেকে সবটা বলবেন এই মেয়ের কান্ড সম্পর্কে।আপাতত মানসিক রোগীকে দেখে রাখুন।নাটকের শেষ নেই এর।”
রাগে জ্বলন্ত উমাইরের প্রস্থান ঘটে।আফিয়া কেঁদে যাচ্ছে।রুজি আহম্মকের মতো চেয়ে আছে অর্ধ নগ্ন বেহায়ার পানে।ভাইকে হাত করতে এমন নষ্টামি!
——————
মেহমান আসলে তাহুরা কাজে নিমজ্জিত হয়।নানু বাড়ির সকলেও এসেছে।এক মামা তার।খালা নেই।মামী তাকে সাহায্য করছে। চাচার পরিবারকে দাওয়াত করলেও কেউ আসেনি। ভীষণ ব্যস্ত তারা।সুনেরা পরিপাটি হয়ে সকলের সাথে কথায় মগ্ন।উমাইরের মামা,নানু এরাও এসেছে।বলতে গেলে উৎসব মুখর পরিবেশ। অনেকে বসার ঘর ছেড়ে শোয়ায় ঘরগুলোতে বসেছে।জায়গা হচ্ছে না,এমনটা ভাবতে দিচ্ছে না কেউ। ঘর মাঝারি,ঠিক আছে।আজ কেবল মানুষের আগমন বেশি।আফিয়া না আসায় তাহুরার পরিবার বেশ কয়েকবার শুধায় তার কথা।বিনিময়ে আফিয়ার মা জানায়,তার মেয়ে অসুস্থ।তাহুরা আফসোস করে বেশ। আপুটাকে তার ভালো লেগেছিল।গতবার যখন এসেছিল তখন কতো আলাপ হয়েছে।

উমাইরের মামার ছেলে জাফরান।বয়স চার।ছেলেটা বড্ড পটু এবং চঞ্চল।তার মা সোফায় বসলেও ছেলেটা দূরন্ত।বারংবার ডাইনিংয়ে এসে উঁকি দিচ্ছে।তাহুরা অবশ্য ছেলেটার সাথে হাসি বিনিময় করছে।উমাইরের এক মামার এক পুত্র।

নাস্তা পরিবেশনের পর তাহুরা এবং তার মামী ডাকে নতুন আত্মীয়দের।বাড়তি চেয়ার সমেত টেবিলে বসে সবাই।জাফরান অযথা মাকে বিরক্ত করছে।তাহুরা সেদিকে নজর বুলিয়ে কাছে ডাকে জাফরানকে,
–“আপু খাইয়ে দিই তোমাকে?আমরা পুকুরঘাটে আরাম করে খাবো।কেমন?”
তাহুরার কথায় জাফরান খুশি হয়।হাত উঁচিয়ে বলে,
–“কোলে নাও আমাকে।”
তাহুরা ভারী শরীরের জাফরানকে কোলে তুলে।হাঁপালেও দেখায়নি মুখে।তার একহাতে প্লেটে নাস্তা তুলে দেয় শিউলি।

তাহুরা নিজেকে সামলে নেয়।এরমাঝে নিবরাস দ্রুত হাঁটে।তার মা কারণ জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেয়,
–“উমাইর ভাইয়া এসেছে।গেইট খুলতে বললো।”
–“আমি যাচ্ছি!”
ইমন বললে,নিবরাস ফের বলে,
–“ইটস ওকে,ব্রো।”

তাহুরার হৃদয়ে প্রশান্তি।যাক লোকটা এসেছে তবে।জাফরানকে নিয়ে হাঁটতে গেলে বুঝে কদম আস্তে ফেলতে হবে।জাফরান তার কোলে মিটমিট হাসছে এটা সেটা বলছে।তাহুরা আলগোছে কেবল হেসে যাচ্ছে।

উঠানে জুবায়েরদের হাইয়েছ,ইমনদের গাড়ি।তেমন একটা জায়গা নেই আর উঠানে।তবে উমাইরকে মোটর বাইক নিয়ে প্রবেশ করতে দেখে চমকায় তাহুরা।হেলমেট খুলে এলোমেলো চুল ঠিক করে সে।মুখশ্রী শক্ত তার।রেগে আছে মনে হচ্ছে।নিবরাস ভাইয়ের করুণ মুখ দেখে প্রশ্ন করে,
–“কি হয়েছে? সব ঠিকঠাক?রেগে আছো?”
তাহুরা প্রশ্ন শুনে সেদিকে যায়নি আর।উমাইরের কঠোর দৃষ্টি,শক্ত চোয়াল কেমন ভয়ার্ত।সুদর্শন লোকটা রাগে কেনো এমন?

উমাইর তাহুরাকে অবলোকন করে।মেয়েটা বাহিরে কেনো?তাও জাফরানকে কোলে নিয়ে।স্পষ্ট দেখলো কেমন হাঁপিয়ে যাচ্ছে সে। হেলমেট ধরিয়ে দেয় সে নিবরাসের হাতে,
–“নাহ।আমি ভেতরে পরে যাচ্ছি। একটু পুকুরপাড়ে বসবো।আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে,আমি জাফরানের সাথে আছি।”
উমাইর আবার বাচ্চা পছন্দ করে।জাফরান তাদের বাড়ি এলে তাকে নিজ রুমে বসিয়ে রাখে,কোলে নিয়ে গেমস খেলে।তাই ব্যাপারটা সাধারণ লাগলো নিবরাসের।

প্লেট পুকুরের দুধারে অবস্থিত সিমেন্টের বেঞ্চে রেখে জাফরানকে বসানোর চেষ্টায় তাহুরা।ইতোমধ্যে তার ওড়না,কামিজের বেহাল অবস্থা।উমাইর আসে ঠিক তখন।জাফরান তাহুরার জামা আঁকড়ে ধরলে নখের আঁচড় লাগে তাহুরার বুকে।খামচি কেটে যায় সেথায়।মেয়েটা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে,
–“আস্তে বসো,ভাইয়া!”

–“জাফরান তুমি নিজে বসতে জানো না?”
উমাইরের কণ্ঠে তাহুরা নিজেকে সামলে নিতে চায়।কিন্তু, ওড়নার উপর জাফরান বসে।লজ্জায় তাজ্জব তাহুরা।ওড়না নিয়ে টানাটানি করলে উমাইর জাফরানকে কোলে উঠিয়ে অন্য বেঞ্চে বসে।ওড়না নিয়ে দ্রুত ঘোমটা টানে তাহুরা।কিন্তু,লাভ হয়নি।উমাইরের মস্তিষ্ক জ্বলছে।যা দেখার দেখেছে সে।ভাগ্যিস অন্যকেউ ছিলো না! আফিয়ার ব্যাপারে এইভাবে তার মেজাজ বিগড়ে ছিলো।তাহুরা প্লেট নিয়ে তাদের নিকট আসে।জাফরানের মুখে খাবার তুলে দেয় তাহুরা।
সাথে শুনতে পায় সে উমাইরের গগণ বিদারক ধিম শব্দ,
–“কখনো যেনো মাথার কাপড় না পড়ে।যে কাজ পারো না,করতে যাও কেনো? জাফরানকে আলগাতে তোমার আরো ওজন বাড়ানো লাগবে।স্টুপিড।”
তাহুরা অধর চেপে রইলো।বললো না কিছু।কেনো উমাইর তাকে এমন অবজ্ঞা করে!

জাফরানকে খাওয়ানো শেষ হয় দ্রুত।হয়তো বাচ্চাটার খিদে পেয়েছে।তাহুরা হেসে তাকে বলে,
–“আরেকটু আনবো ভাইয়া!”
জাফরান মাথা নাড়ে,
–“না।না।”
তাহুরা মিষ্টি হাসে।উমাইরের অধর প্রসারিত হয়।মেয়েটা তার মন ভালো রাখার হাতিয়ার।উমাইর তাহুরাকে অবলোকন করতে করতে আফিয়ার ঘটনা ভুলেছে।কমেছে তার ক্রোধ।
উমাইরের দিকে না তাহুরা তাকিয়ে উঠতে নিলে উমাইর তাহুরার গাল চেপে ধরে,
–“আমি শুধু তোমার বানানো খাবার খাবো।বাহিরের কিছু দিবে না।”
চেপে থাকা গালে তাহুরা উত্তর দেয়,
–“আচ্ছা।”

–“নিজের ওড়না,কামিজ সামলে রাখবে সবসময়।তোমার হেয়ালিপনা আমি মোটেও সহ্য করবো না। চেস্টে বার্ন করলে অয়েনমেন্ট লাগিয়ে নিও।”
গাল ছেড়ে দেয় উমাইর।

তাহুরা অপেক্ষা করেনি আর।বিস্ফোরিত নজরে কেবল এক ছলক উমাইরের দিকে তাকিয়ে দ্রুত ঘরে প্রবেশ করে।সত্যি তার বুকে জ্বলছে প্রচুর।বল প্রয়োগ করে খামচি দেয় জাফরান। চামড়া উঠেছে মনে হয়। উমাইর সবটা লক্ষ্য করেছে! কি শরমের ব্যাপার!তবে তাহুরা খেয়াল করে,তার বুকের জ্বলনের চেয়ে তীব্র অশান্ত।সেথা হতে অনবরত শব্দ আসছে, ধুকধুক। জোরে শ্বাস ফেলে তাহুরা।উমাইরের অধিকারমূলক শাসনের কথায় কেমন আপন মনে হচ্ছে তাকে। লজ্জায়ও মেয়েটার আঁখি ভরে আসে।

তাহুরা যেতে কোলে থাকা জাফরানকে নিয়ে উঠে পড়ে উমাইর।সম্মুখে অগ্রসর হওয়া অবস্থায় উমাইর জাফরানের কান ধরে।হিংসুক সুরে বলে,
–“আমার তাহুর গায়ে আমি দাগ বসানোর আগে তুমি দাগ বসিয়েছো।দুষ্টু বাচ্চা।আমার আদরের কোলে আর উঠবে না।”
উমাইরের হিংসা জাফরান বুঝলো না কিছু।পোকা খাওয়া ফোকলা দাঁত দেখিয়ে হাসে কেবল।

চলবে……

#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব-১০
_________________
–“তাহু বুকে কি হলো?খামচি লেগেছে নাকি?দেখি দেখি।”
মামীর চিন্তিত বাক্যে ঘাবড়ে যায় তাহুরা।এত সময় মাথায় কাপড় থাকার দরুণ বুকের অংশ ঢাকা ছিলো।রান্নাঘরের তীব্র গরম এড়াতে সে ওড়না ভি শেইপে সেট করে,আর এতেই মামী তার বক্ষস্থলের ক্ষত দেখতে পায়।
তাহুরা শুকনো ঢেঁকুর গিলে।নিচের অধর চেপে শ্বাস নেয়।মিনমিন কণ্ঠে জবাব দেয়,
–“জাফরান বাচ্চাটাকে বেঞ্চে বসাতে গিয়ে ওর নখ লেগেছে।”
–“জ্বলছে নাকি তাহু?কেমন লাল ডগডগে দেখাচ্ছে।যা তো মলম লাগিয়ে আয়।মেয়েটা এমন খামখেয়ালী করে সবসময়!”
আফসোসের বার্তা শোনা যায় মামীর। তাহুরা ইতস্তত হাসে। চুলায় বিদ্যমান তরকারি নাড়াচাড়া করে,
–“জ্বলছে না।এখন কাজ ফেলে নিজের সেবা করতে গেলে মায়ের বকুনি খেতে হবে।মেহমানদের দুপুরের খাবারে দেরী হচ্ছে।”
–“আচ্ছা কাজ শেষে লাগিয়ে নিস।হেলাফেলা করবি না নিজেকে নিয়ে।”
তাহুরা ঘাড় ঘুরায়।মুচকি হাসে,
–“আচ্ছা মামী।”
তাহুরার মামী তার মাথায় হাত বুলায়।এই লক্ষ্মী মেয়েটার জন্যে কেমন মায়া মায়া অনুভব করে সে।ইমনের নিজস্ব পছন্দ না থাকলে,শিউলির সাথে কোমর বেঁধে ঝগড়া করে হলেও এই লক্ষ্মী তাহুরাকে নিজের ঘরে তুলতো।নিজের মনের কথা মনে রেখে মামী সালাদ করতে বসে।

মেহেমানদের খাবারের জন্যে তোড়জোড় চলছে।প্রায় সকলে বাহিরে তাদের পুকুর ঘাটে।আলাপে মগ্ন,সৌন্দর্য দেখছে প্রাকৃতিক।অনেক আবার শোয়ার রুমে।তাহুরা রুমের সকলকে ডেকে বাহিরে যাচ্ছে অন্যদের ডাকতে।মায়ের নির্দেশনা।

ডাইনিং এরিয়া অতিক্রম করে বসার ঘরে গেলে সোফায় আধ শোয়া উমাইরকে দেখতে পায় তাহুরা।উমাইর কি ঘুম?লম্বা মানুষের লম্বা পা।সেগুলো কেমন বেঁকে রেখেছে। হয়তো অসুবিধা হওয়া সত্ত্বেও মুখ খুলছে না।নতুন আত্মীয়ের বাড়ি বলে কথা।বাহিরে যাওয়ার পূর্বে তাহুরা ধীর গতিতে উমাইরের ধারে যায়।
উমাইর একহাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বারা মাথা ঠেকিয়ে আছে। লাজে মুড়িয়ে গেলেও তাহুরা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না উমাইরের খোঁজ নিতে।
উমাইরের পেছনে দাঁড়িয়ে সে বড্ড দ্বিধার সহিত প্রশ্ন করে,
–“আপনি কি ক্লান্ত?”
উমাইর ঘাড় বাঁকিয়ে পেছন ফিরে।ঘর্মাক্ত মেয়েটার কপালে কিছু চুল লেপ্টে।শ্বাস ফেলছে গভীর।ক্লান্ত বেশ?

সোজা হয়ে বসে উমাইর।গম্ভীর স্বরে বলে,
–“আমি কেনো ক্লান্ত হবো?ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে।”
–“নাহ,আমি ঠিক আছি।আপনি খেতে আসুন।সবাইকে ডেকে আনছি।”
তাহুরা হাসে।উমাইর স্পষ্ট বুঝে মেয়েটার ক্লান্তি।নিশ্চয় নাস্তা ঠিক মতো করেনি মেহমানদের সেবায়।
–“তুমিও একসাথে খেতে বসবে।”
উমাইর দাঁড়িয়ে পড়ে।ভেতরকার রুমের আত্মীয়দের কেউ কেউ বসার ঘরে আসলে তাহুরা বলেনি কিছু।কেবল দুদিকে মাথা নাড়ে।অর্থাৎ সে খাবে না।
রাগী দৃষ্টিতে উমাইর তাকে অবলোকন করলে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে তাহুরা।মেহমানদের অ্যাপায়ন না করে কিভাবে বসবে খেতে?লোকটা স্যার অথচ বিবেকে এই প্রশ্নটা আসেনি?

আপনমনে হাসে মেয়েটা।বাহিরে যায়।সকলকে বলে খাবার খেতে আসতে।এত মানুষের জায়গা না হলেও প্রধান অতিথিবৃন্দদের খাবার টেবিলে ব্যবস্থা করা আছে আর বাকি বাড়ির আত্মীয়রা শোয়ার ঘরে, বসার ঘরে মিলেমিশে বসবে খেতে।তাহুরার ডাকে সকলে সাড়া দেয়।ভেতরে যাচ্ছে হাসিমুখে।উমাইরের মা ভেতরে যেতে নিয়ে গেলো না।সটান দাঁড়িয়ে পড়ে তাহুরার সম্মুখে।তার চিবুকে হাত রেখে আদুরে সুরে বলে,
–“ইস,মেয়েটার সাথে দেখা হয়নি আজ তেমন।বেশি কষ্ট দিচ্ছি আন্টিরা এসে?”

তাহুরা বাম হাত তুলে ডানে বামে ঘুরায়।অধর প্রসারিত করে,
–“মোটেও না আন্টি।উল্টো আমি দুঃখিত,আপনাকে আজ পুকুর ঘাট দেখাতে পারিনি।আসলে আম্মুর হাঁটুর ব্যথা বাড়ে বেশি হাঁটাচলা করলে,তাই আমি যা একটু সাহায্য করি।”
–“সুনেরা মা দেখিয়েছে আমায় সব।তোমাদের এইখানে এলে আমার যেতে মন চায় না।কেমন সুখ আর শান্তি অনুভব করি।”
তাহুরার কপালের উড়ো চুল ঠিক করে জবাব দেয় মেঘলা বেগম।
–“যখন মন ছুটে চলে আসবেন আমাদের বাসায়। পরোয়া করবেন না কারো।”
মাথায় ঘোমটা ঠিক করে তাহুরা।
–“একদম আসবো।আমার ছোট ছেলে বসেছে?”
–“বলেছিলাম আন্টি।হয়তো বসেছে।চলুন।”
ভেতরে যাওয়ার ইশারা করলে মেঘলা সম্মুখে কদম বাড়ায়।পেছন পেছন আসে তাহুরা।

খাবারের পরিবেশ রমরমা। তাহুরার কাঁধে আবারও জাফরানের দায়িত্ব পড়ে।ছেলেটা তার হাতে খাওয়া ব্যতীত খাবে না জানাচ্ছে। উমাইর আরচোখে লক্ষ্য করে সব।তাহুরাকে বেশ নাজুক দেখাচ্ছে।এইভাবে সকাল হতে বসে নেই মেয়েটা।তার জন্যে ফুলের চারা কিনতে গিয়েও নিশ্চয় রোদে ঘুরেছে অনেকক্ষণ।তার উপর বাড়ির এতসব রান্না,কাজ।আর এখন জাফরান তার হাতে খাবে বলে বাহানা করেছে।
তাহুরার ক্লান্তি মুখের নাজুক নজরের হাসিটা উমাইর ঠিক উপলব্ধি করে।মেয়েটার এমন করুণ হাসিতে অন্তরে প্রশান্তি নেই উমাইরের।

জাফরানের খাবারের প্লেট নিয়ে তাহুরা বসার ঘরে যায়।উমাইর ক্রোধে বলেনি কিছু।মেয়েটার কান্ড-জ্ঞান তার পছন্দ না।নিজের খেয়াল রাখতে জানেনা তাহুরা। খাবার শেষে উমাইর উঠে পড়ে হুট করে।হাত ধুয়ে মাকে বলে,
–“তারিখ ফাইনাল করে বাসায় এসো।আমি বেরুচ্ছি।কাজ আছে।”
–“কি বলো?হঠাৎ চলে যাচ্ছো?”
মেঘলা বিস্মিত।
–“বললাম কাজ আছে।বাসায় যাবো না।এমনি বের হচ্ছি।”
উমাইর গটগট পায়ে সম্মুখে আগায়।মুন্সী এবং শিউলিকে কেবল মুখে সালাম দেয়।

বসার ঘরে বাঁকা নজরে পর্যবেক্ষণ করে পায়নি তাহুরা এবং জাফরানকে। ঘরের সদর দরজা হতে শব্দ আসছে জাফরান এবং তাহুরার।উমাইর সেথায় উপস্থিত হলে তাহুরা নিজের অট্টহাসি থামায়।অমায়িক হেসে বলে,
–“খেয়েছেন? এতো জলদি শেষ?”
–“না খেয়ে বসে থাকবো?তোমার মতো মানব দরদী না আমি।”
উমাইর তার মোটর বাইকের নিকট যায়।নিবরাস হেলমেট সিটের সাথে সেট করে রেখেছিলো।সেটা হাতে নিয়ে সিটে বসলে তাহুরা এগিয়ে আসে জাফরানকে নিয়ে।জাফরানের খাওয়া শেষ অতিদ্রুত।

–“আপনি চলে যাচ্ছেন?”
অবাকের সুর তাহুরার।
–“নাহ।আসলাম মাত্র।”
ভ্রু কুঁচকে জবাব দেয় উমাইর।
তাহুরা বুঝতে পারে লোকটা চটেছে।কিন্তু কেনো?ভেতরে কিছু হলো?
–“কি হয়েছে?বলুন আমাকে।”
আতংকিত মেয়ের।
–“কেনো?তুমি সব সমস্যা সমাধানের পথে কাজ করো?তাহলে নিজের সমস্যা সল্ভ করা উচিত তোমার।”
উমাইর হেলমেট পড়ে।তাহুরা বুদ্ধি হারিয়ে উমাইরের মোটর বাইকের সামনে হাত রাখে।ভ্রু যুগল সমান করে নরম কণ্ঠে বলে,
–“রেগেছেন কেনো?”

–“আমার কথা না শুনলে আমি এমন রাগী।কারণ জেনেছো!এখন বলো কি করবে?”
বাইক স্টার্ট দেয় উমাইর।তাহুরা বুঝতে পারে খাবারের ব্যাপার নিয়ে রেগেছে।কিন্তু,এমনটা করার কি দরকার ছিল?সকল আত্মীয় খেয়ে উঠলে তো খেতে বসতো সে।

তাহুরা কিছু বলার পূর্বে জাফরান তার ওড়নার অংশ ধরে টানে,
–“আপু,কোলে নাও!”
উমাইর তার হেলমেটের কাঁচ উচুঁ করে।জাফরানকে কোলে নিতে গেলে চিল্লিয়ে উঠে উমাইর,
–“জাফরান!মানা করেছি না কোলে উঠতে?যাও ভেতরে।”
ধমকে মুচড়ে যায় জাফরান।ভারী স্বাস্থ্য নিয়ে বাচ্চাটা কেঁদে ভেতরে দৌড় দেয়।

তাহুরার অন্তর ক্ষুণ্ণ হয়।জাফরানের জন্যে বরাদ্দ ধমকে তারও আঁখি ভরে আসে।ভাতের প্লেট এক হাতে ধরে অন্যহাতে আঁখি মুছে,
–“ওকে বকলেন কেনো?”
উমাইর তার ছিঁচকাদুনির পানে চেয়ে।পরক্ষণে হেলমেটের কাঁচ নামিয়ে দ্রুত ছুটলো সটান খুলে রাখা প্রধান গেইটের বাহিরে বিনা উত্তরে।

তাহুরার অন্তর যেনো ছিন্ন হলো।মেয়েটা মুষড়ে যায়।
মুখে আঁধার লেপে জাফরানের নিকট ফিরে।উমাইর থেকে উত্তর পাওয়ার আশাটা উচিত হয়নি তার।লোকটা কখনো তাহুরাকে দাম দিবে না।

বিয়ের তারিখ ঠিক হয় আগামী মাসের বিশ তারিখ। হাতে আর বাইশ দিন সময় আছে।এই সময়কালে অবশ্য জুবায়ের তার বাবার ব্যবসায় যোগ দিবে।সে আর প্রবাসে ফিরছে না।
যাওয়ার সময় তাহুরা এবং তার পরিবারবর্গকে দাওয়াত করে উমাইরের পরিবার।

শান্তিপূর্ণ মেয়ের বিয়ের তারিখ পড়েছে বিধায় আরাম অনুভব করে মুন্সী।তার হাসিতে আজ গোটা ঘর জ্বলজ্বল করছে।

উমাইর চলে যাওয়ার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যে ছেলেটার কথা ভুলেনি তাহুরা। কই আগে তো তাহুরা কখনো কারো ব্যাপারে ভাবেনি।কিন্তু,উমাইর তাকে নিজ ব্যাপারে ভাবতে বাধ্য করে। উমাইরকে ভয় পাওয়া,তার কথা মান্য করা,প্রথমে তাহুরা স্যার হিসেবে মেনে চলতো। তবে এখন,ঘটনা ব্যতিক্রম।তারা উভয়ই আত্মীয়,কুটুম। এছাড়া উমাইর তার জন্যে যেসব নির্দেশনা দিয়েছে,সেসব অন্য কাউকে দিয়েছে কিনা জানা নেই তাহুরার।মূলত উমাইরের কাজকর্ম,তাহুরার প্রতি তার সকল উপদেশ তাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে তাহুরাকে।মনের মাঝে উমাইরের জন্যে অন্য এক অনুভূতি অনুভব করে মেয়েটা।

আজ উমাইর হুট করে চলে যাওয়া নিয়ে খুন হচ্ছে মেয়েটার অন্তর।তাহুরার জীবনে প্রথম,উমাইর থেকে সে নিজের জন্যে উপদেশ পেয়েছে,আবার সেটা পালনও করছে। তাহুরার মতো সরল মানুষের কাছে জীবনে প্রথম এহেন উপদেশ পাওয়া মনে অন্য অনুভূতি জাগানোর জন্যে যথেষ্ট।
উমাইরের আগে এমন কাজ কেউ করেনি বলে,সরল তাহুরা বারংবার উমাইরের সেই কথাগুলো ভেবে অস্থির হয়,বুকে অন্য রকম ব্যথা অনুভব করে।

বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে থাকা তাহুরার হুট করে মনে আসে চারার কথা! উমাইর চারা নেয়নি। ঘাড় উচুঁ করে দেখে,রুমের এক কিনারায় যত্নে রাখা চারাটার অবস্থান।

তাহুরা উঠে ড্রয়ার হতে মোবাইল বের করে।সারাদিনের কাজে পায়ে ব্যথা তার।তাও মুখ ফুটে বললো না কাউকে।উমাইরকে মেসেজ দেয়,
–“আপনি রেগে চলে গেলেন।চারা নেননি।”
ভাবুক তাহুরার কেনো জানি কান্না পায়।উমাইর কেনো এমন রাগ করে ওর সাথে?মোবাইল বুকে চেপে আবারও বিছানায় শুয়ে পড়ে সে।মনের অবাস্তব অনুভূতিতে শান্ত মেয়েটা কেমন অশান্ত হয়ে পড়ে আচমকা।
———————–
উমাইর বাড়ি ফিরেনি।আফিয়ার কারণে তার বাড়ি ফিরতে ঘৃণা হচ্ছে।আগে বাড়ির সকলে একটা বিহিত করুক বেয়াদব মেয়েটার।ফের বাড়ি থেকে ফোন এলে,বাড়ি ফিরবে। সচরাচর সিগারেট দ্বারা অধর পোড়ায় না উমাইর।বন্ধুদের সাথে থাকলে বা নিজ ইচ্ছায় সে সিগারেট ফুঁকে।বিক্ষিপ্ত মেজাজে আজ নিয়ন্ত্রণ হয়নি তার। পুরুষালি অধরে চেপে ধরে সিগারেট। তাহুরার মেসেজ এসেছে দেখেও খুললো না বার্তা। সিআরবির ভেতরের দিকটায় একাকী মোটর বাইকে বসে আছে ।মনটাও কেমন দোটানায়।বিদায় বেলায় তাহুরাকে কাছে টেনে অদ্ভুত এক কাজ করতে ইচ্ছে করলো তার।মেয়েটাকে দেখলে তার মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণে থাকতে চায় না।

হয়তো অনেকে বলবে,উমাইর তার স্টুডেন্টের প্রেমে পড়েছে,ভালোবাসে।কিন্তু,ব্যাপারটা এমন নয়।তাহুরা তার শিক্ষার্থী হওয়ার পূর্ব হতে ভালোবাসে সে মেয়েটাকে।অত্র কলেজে শিক্ষক পদে আসাটা উমাইরের ভাগ্যে ছিলো। এছাড়া তাহুরা তার কাছের আত্মীয় হবে হুট করে এমনটাও সে ভাবেনি ইহকালে।সব যেনো তাকদীরের খেলা।
উমাইর যেটা ভেবে রেখেছিলো তাহুরাকে নিজের জীবনে আনার, তার কিচ্ছুটি প্রকাশ হয়নি।বরং নিয়তি ওদের অন্য নিয়মে কাছে টেনেছে।নিজের পরিকল্পনার চেয়ে নিয়তির পরিকল্পনা উমাইরের বড্ড পছন্দ হলো।

ভবনায় ব্যাঘাত ঘটে মায়ের ফোনে।নিশ্চয় সবাই জেনেছে সবটা।ফোন কানে দিলে তার মায়ের আতংকিত কণ্ঠ শুনে সে,
–“বাবা,বাসায় আসো।এক্ষুণি!”
–“আসবো না।”
উমাইরের সহজ জবাব।
–“তুমি আমাদের আগে বলোনি কেনো কিছু?”
মেঘলা বেগম কেঁদে অস্থির।
–“কি বলবো?বেহায়াপনার কথা বলবো মা বাবাকে?চাচা চাচীকে?তাও ঘরের মেয়ের?”
শক্ত হচ্ছে তার কন্ঠ।
–“আচ্ছা শান্ত হ‌ও।আসো বাসায়।বাবা ডাকছে।”
–“আসবো দেরী হবে।একটু বাহিরে থাকি। ঐ মেয়েকে শাসাও ঠিকভাবে। পরেরবার আমি থেমে থাকবো না।গাল ফাটিয়ে দিবো।”
ক্রোধে ফোন কাটে উমাইর।

মেজাজ তার শীর্ষে।পরপর মেসেজ চেক করে সে তাহুরার। এতো ক্রোধেও তার অধর প্রসারিত হয়।মেয়েটা একনাগাড়ে তিনটা মেসেজ দিয়েছে,
–“আপনি রেগে চলে গেলেন।চারা নেননি।”
–“আমার সাথে রেগে আছেন?”
–“আচ্ছা সরি। সব কথা শুনবো আপনার।”

মেসেজগুলো তার হৃদয়ে শীতল পবনের হানা দেয়।তারপরও মেয়েটাকে জ্বালানোর সিদ্ধান্ত নেয় উমাইর।গোটা অক্ষরে লিখে,
–“শুনতে হবে না। চারা তোমার মাথায় লাগাও।”
সিগারেটের শেষ অংশ মেঝেতে ফেলে। দেরীতে বাড়ি ফেরার ইচ্ছা মরে যায়।মোটর বাইকে চেপে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় উমাইর।

সুনসান তাদের বাড়ি।ভেতরে গেলে নিবরাস তাকে বোনের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করে।উমাইর কিছু জানায় না। ঐ মেয়ের জন্যে ভাইয়ের দুঃখ প্রকাশ মানতে নারাজ।বিশাল বসার ঘরে বাড়ির গুরুজনেরা বসে।আফিয়ার মা কেমন লজ্জিত।উমাইর এক নজর দেখে আর ফিরেনি।নিজ কামরায় যায়।

মিনিট দশেক বাদে মেঘলা বেগম ছেলের রুমে আসে।উমাইর মাত্র ব্যালকনি থেকে কক্ষে ফিরে।

সোফায় বসে মেঘলা ছেলেকে কাছে ডাকে। উমাইর মায়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে।মেঘলা আহত সুরে ছেলেকে বলে,
–“আজ এই জন্যে কি ঐ বাড়ি থেকে কাজের বাহানা দিয়ে বেরিয়েছিলে?”
–“নাহ।”
উমাইরের সহজ জবাব।

মা তার দিকে প্রশ্নবোধক চেহারায় তাকালে পুনরায় জবাব দেয়,
–“আফিয়া আমার কাছে ম্যাটার করে না যে, ওর জন্যে আমি আমার লাইফে কোনো কাজ করবো!সি ইজ নাথিং টু মি।না আমার বোন না আমার কোনো সম্পর্ক।”
–“মাথা ঠাণ্ডা করো আব্বা।ছেলেমানুষী করে ভুল করেছে…”
–“ওর সাফাই গাইতে এসেছো?”
মাকে থামিয়ে প্রশ্ন করে উমাইর।
–“নাহ।আসলে আব্বা…তাহুরার জন্যে চলে এসেছিলে আজ?”
মায়ের সরাসরি এহেন প্রশ্নে কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্থ হয় উমাইর।ঝেড়ে কাশে সে,
–“হুম।তুমি কিভাবে জানলে?”
–“তাহুরা ফোন দিয়েছিল।তুমি চারা নাওনি বললো। আমি ড্রাইভার দিয়ে আনিয়েছি চারা মেয়েটার থেকে।মেয়েটাকে এমন জ্বালাচ্ছো কেনো উমাইর?সে খুবই সরল একটা মেয়ে।”
মায়ের কথায় উমাইর কোনো অভিব্যক্তি দেখালো না।তবে,মনের গহীনে তার হরতাল চলে।সরল প্রেয়সীর প্রতি মনটা আন্দোলনে ফেটে পড়ে।
–“জানি মা।আমি এইভাবে কাল চারাটা নিতাম।”

–“মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ।কেমন মন জিরিয়ে যায় মেয়েটাকে দেখলে।দুই ছেলের বউ যদি সেই পরিবার থেকে আনা হয়!”
মেঘলা গাল ভরে হাসে।উমাইর মায়ের চালাকি বুঝে ঠিক।সে মায়ের সাথে সায় দেয়,
–“সরল মেয়েটাকে আমার অনেক আগে থেকে পছন্দ।যখন থেকে না আমি ওর স্যার ছিলাম,না ও আমার কোনো আত্মীয় ছিলো!শুধু আমার কাঁদুনে তাহুরা ছিলো ও।”
কয়েক সেকেন্ড থেমে আবারও উমাইর বলে,
–“তোমার ছোট ছেলের হবু বউ তাহুরা।দেখে শুনে রেখো। কারো নজর যেনো না পড়ে।”

পায়ের গতি বাড়ায় উমাইর।দরজার নিকট গেলে মেঘলা প্রশ্ন করে,
–“কই যাচ্ছো আব্বা?”
–“চারা নিয়ে আসি।”
উমাইর দাঁড়ায় না দ্রুত কদম ফেলে।

মেঘলা মোনাজাত তুলে।উপরে তাকায়।হাসিমুখে দোয়া করে,
–“আল্লাহ্ তুমি সব ঠিক রেখো।আমার দুই ছেলের মনের আশা পূরণ করো।”
.
সুনেরা মার্কেট যাবে। তাহুরাও সাথ দিবে বোনের।বিয়ের কেনাকাটা করতে দেরী আছে এখনো। সুনেরাকে দেখতে এসে এবং বিয়ের কথা পাকাপাকি করতে এসে যে বকশিস দিয়েছে,সেই টাকায় আজ বোনকে নিয়ে কেনাকাটা করতে যাবে সুনেরা।বোনকে ছাড়া তার চলে না।মুন্সীকে আগে বলে রাখে তাহুরা।মুন্সী আবার তাহুরার কথা দাম দেয় বেশি।মেয়েটা বড্ড শান্ত ভাবে জিনিস বুঝাতে পারে।

অন্যদিকে একটু উনিশ বিশ হলে সুনেরা চিৎকার চেঁচামেচি করে। এতে শিউলি, মুন্সী ক্ষেপে উঠে দ্বিগুণ। তাই মা বাবাকে মানাতে হলে তাহুরা উত্তম।

কালো রঙের কামিজের সাথে লাল রঙের দোপাট্টা।সুন্দর সুতার কাজ।লাল ওড়না মাথায় দেয় তাহুরা।ইদানিং মাথায় কাপড় দেওয়াটা অভ্যাসে পরিণত।অবশ্য এর পিছে উমাইরের হাত।লোকটার কড়া চাহনি মনে আসলেই মন পিঞ্জিরা অশান্ত হয়।

সন্ধ্যার পর বের হয় ওরা।বাড়ির কাছে মার্কেট।চকবাজারে অবস্থিত।এলাকা থেকে বেরিয়ে সুনেরা রিক্সা ডাকে।তাহুরা হাঁটতে অসঙ্গতি জানায়।
রিক্সায় উঠে হুড ঠিক করে রিক্সা চালক।তাহুরা এদিক সেদিক তাকিয়ে বোনকে প্রশ্ন করে,
–“জুবায়ের ভাইয়া আসবে?”
–“নাহ।সে অফিসে।কাজে নেমেছে বাবার সাথে।তোদের দাওয়াত দিবে এই সপ্তাহে।”
সুনেরা জবাব দেয়।
–“আমি যাবো না আপু। তোমাকে ছাড়া ঐ বাড়িতে গেলে কেমন লাগবে বলো!”
তাহুরা মুখ কুঁচকে বলে।তার আসল ভয় উমাইর।আজকাল উমাইর তাকে একটু বেশি শাসন করে,এটা সেটা সম্পর্কে হুশিয়ারি দেয়।তবে এসবের মাঝে সে উমাইরের বাণী হুমকির চেয়ে যত্ন হিসেবে গ্রহণ করে।ভয় পেলেও অন্তর গহীনে লোকটার হাস্যোজ্বল চেহারায় মন গলে।

–“যেতে হবে।আয়মা,শায়ন,ইমন ভাইয়া সবাই যাবে।চাচাতো ভাইবোনদের বলবো।গেলে যাবে না গেলে নেই।”
সুনেরার কণ্ঠে রাগ।সে বোনের জবাবে মিনমিন করে উত্তর দেয়,
–“আচ্ছা।”

চকবাজারে একসাথে অনেকগুলো মার্কেট।সুনেরা তার পরিচিত দোকানে যায়।মা,বোন আর নিজের জন্যে কেনাকাটা করে।তার আর তাহুরার জন্যে কেনা কামিজগুলো বেশ কারুকাজ খচিত।ব্যাপক সুন্দর।

তারা ফুচকার দোকানে এগিয়ে যাচ্ছে।সুনেরা ধীরে হাঁটছে তাহুরার জন্যে।মেয়েটার মান্থলি সার্কেল।বোনের কষ্ট বুঝে সুনেরা।একটু বেশি নুয়ে যায় তাহুরা অত্র সময়।কাপড় কিনে সেলানোর ব্যাপার থাকে,তাই আজ না গিয়ে পারলো না সুনেরা।সামনে নতুন বাড়ি হতে মেহমান আসবে ঢের বা তার বোনকেও যাওয়া লাগবে সেই বাড়িতে।কোনো অংশে কম থাকতে চায় না সুনেরা।সবসময় পরিপাটি একটা ভাব পছন্দ তার। সেই হিসেবে বোনকেও নিজের মতো বানিয়েছে মেয়েটা।দুইবোন বেশ পরিপাটি থাকে সদা।

ফুচকার দোকানের সামনে এলে ফোন বাজে সুনেরার।রিসিভ করে মেয়েটা গর্জে উঠে,
–“তোমাকে আসতে কে বলেছে?”
–“চিল্লাও কেনো?আমি তোমার পিছে।”
সুনেরা মাথা ঘুরিয়ে পেছন ফিরে।উমাইর,জুবায়ের,আফিয়া এবং নিবরাস উপস্থিত।সুনেরা রাগতে গিয়েও রাগলো না।

তাহুরা বোনের পাশে তার ওড়নার একাংশ ধরে দাঁড়িয়ে।এরা আবার কেনো আসলো?

–“আসসালামুয়ালাইকুম ভাইয়া।কেমন আছেন?নিবরাস,আফিয়া কেমন আছো?”
সুনেরা ভদ্রতার সহিত বলে।

–“ওরা ভালো আছে।আমিও ভালো আছি।আসলে আমরা বের হচ্ছিলাম।ভাবলাম তোমাদের দুজনকে নিয়ে যায়।সারপ্রাইজ দিলাম আরকি।”
মাথা চুলকে হাসে জুবায়ের।

উমাইর ভাব বিনিময় করে।সুনেরার পিছে অনেকটা লুকায়িত তাহুরা।তার কি হলো?উমাইর লাল দোপাট্টায় আবৃত প্রেয়সীকে অবলোকন করে তাতেই ডুবে যায়।

ফুচকা খায় মেয়েরা।আফিয়া বেশি খায়নি।নষ্ট করেছে।জুবায়ের,নিবরাস অন্যকিছু খেলেও উমাইর কিছু খায়নি।সে এমন দোকানের খাবার কম খায়।।জুবায়ের,উমাইর ফোন করে মুন্সীকে।ম্যানেজ করে মেয়েদের রাগী বাবাকে।মুন্সী নারাজ হলেও পরে রাজি হয়।ছেলে দুজনকে চোখ বুঁজে বিশ্বাস করতে দ্বিধা নেই মুন্সীর।

তারা গন্তব্যে যাওয়ার পূর্বে জুবায়ের ফট করে বলে,
–“জান,তুমি আমাকে একটু সাহায্য করো।মার্কেট প্লেসে যখন এসেছি আমি চাই মা এবং তোমার মায়ের জন্যে সেম শাড়ি কিনি।”
সুনেরা বোনের পানে তাকায়।ইতিমধ্যে আতংক দেখা দিচ্ছে তাহুরার মুখে। মার্কেটে যেতে আরো গভীরে হাঁটতে হবে।
–“তাহুরা যেতে পারবি?”
বোনের প্রশ্নে ইতস্তত মাথা নাড়ায় তাহুরা,
–“পারবো।”
–“ওর সমস্যা হলে,থাকুক।আমি,উমাইর ভাইয়া,
আফিয়া আপু আছি।”
মন্দ লাগেনি প্রস্তাব খানা।তাহুরা আলগোছে হাসে।যাক বেশি হাঁটতে হবে না তার,
–“ঠিক আছে,নিবরাস।”

সুনেরা বোনের সাথে আলাদা কথা বলে জুবায়েরের সাথে যায়।

উমাইর আফিয়ার উপস্থিতিতে সন্তুষ্ট নয়।শক্ত চোয়ালে সে ভাবলেশহীন। তাহুরা,আফিয়ার সাথে কথা বলছে এটাও যেনো সহ্য হচ্ছে না উমাইরের।নিবরাস ব্যাপারখানা লক্ষ্য করে আফিয়াকে বলে,
–“আপু,আমাকে অ্যাপেল ওয়াচ কিনে দিবে বললে তুমি।খবর নেই তার।আজ চলো দেখি।ভালো লাগলে কিনে দিবা।উমাইর ভাইয়া থাকুক।তাহুরা যাবি?”
–“হুম চল।তাহুরা চলো যায়।”
আফিয়া হাসিমুখে বলে।

–“ও যাবে না।তোমরা যাও নিবরাস।”
উমাইর কথা খানা বেশ ঘৃণার সহিত বলে।
–“ওকে ওকে ভাই।”
নিবরাস বোনকে নিয়ে যাচ্ছে।চেয়েও অপেক্ষা করেনি নিবরাস।হাজার হলেও আফিয়া তার বোন।আফিয়ার প্রতি উমাইরের ঘৃণিত দৃষ্টি সহ্য হয়নি ভাইয়ের।বাদ বাকি,উমাইর তাহুরাকে সামলে নিবে জানা আছে নিবরাসের।

–“পার্কিংয়ে আসো।”
বেশ দ্রুত হাঁটছে উমাইর।মানুষের ভিড় আছে মুটামুটি।তাহুরা উমাইরের লম্বা কদমে হিমশিম খায়।পাশ ফিরে তাহুরাকে না দেখলে নজর ঘুরায় উমাইর।লাল ওড়না,কালো কামিজে আবৃত মেয়েটা ভিড়ের মাঝেও তার নজের চকচক করছে।ইচ্ছে করছে, বুকের সাথে মিশিয়ে নিতে তার লাজ কন্যাকে।

–“এনি প্রবলেম?শরীর খারাপ?”
তাহুরার পাশাপাশি ধীরে হেঁটে প্রশ্ন করে উমাইর।
–“গাড়ি দূরে বেশি?”
পাল্টা প্রশ্নে উমাইর বুঝে মেয়েটার হাঁটতে ভালো লাগছে না।সে কি কোলে নিবে আদুরে পুতুলকে?
–“সামনে।”
বলতে বলতে চলে আসে তারা গাড়ির নিকট।

গাড়ি পেয়ে হেলান দেয় তাহুরা।কোমর হতে পা অব্দি যেনো অবশ হয়ে আসছে।
হঠাৎ,উমাইর সর্বপ্রথম তাকে ধমকে উঠে,
–“সন্ধ্যায় মেসেজ দাওনি কেনো?”
কিঞ্চিৎ নড়ে তাহুরা।ভাঙা গলায় বলে,
–“আপুর সাথে ছিলাম।”
–“বাসায় গিয়ে দেখাবা আমাকে,কি কি কিনেছো।”

–“আচ্ছা।”
ধীর সুর তাহুরার।

উমাইর মোবাইল বের করে মনোযোগ দেয় সেথায়।
তাহুরার পা ভেঙে আসছে যেনো।একটু বসা দরকার তার।পাশ ফিরে উমাইরকে দেখে সে।লম্বাকৃতির মানুষটা কি অমায়িক লাগে নজরে।চুলগুলো কি সুন্দর করে সেট করা!বুকটা মুহূর্তে হরতাল শুরু করে।
নিজেকে দমিয়ে তাহুরা উমাইরকে বলে,
–“এই যে,আমি একটু বসবো।”
নিজ হতে আবদার কখনো করেনি তাহুরা।আজ হঠাৎ কি হলো মেয়েটার?
উমাইর গাড়ির চাবির সাথে অ্যাটাচ বাটনে ক্লিক করলে অটোমেটিক গাড়ির লক খুলে। সামনের দরজা টেনে ধরে বসতে নির্দেশনা দেয়,
–“আসো।”

উমাইর গাড়ির জানালার দিকে অনেকটা ঝুঁকে।তাহুরাকে প্রশ্ন করে,
–“পায়ে ব্যথা করছে?”
তাহুরা দুদিকে মাথা নাড়ে।যে সমস্যা তার সেই সমস্যা উমাইরকে কিভাবে বলবে?তাহুরার নিশ্চুপ নিরবতা,পেট চেপে বেঁকে বসে থাকা অবলোকন করে বুঝতে বাকি রইলো না মেয়েটার সমস্যা কি!উমাইর তো ছোট বাচ্চা নয়।অন্য সমস্যা হলে তাহুরা নিশ্চয় বলতো কিছু।গরম কিছু খাওয়া দরকার মেয়েটার।এমন সময়ে ফুচকা কে খায়? উমাইরের শিরায় উত্তেজনা হানা দেয়,
–“তুমি জানো তুমি সিক।ফুচকা খাওয়া দরকার ছিলো?এটা ভালো জিনিস?”

তাহুরার আঁখি ছানাবড়া।লোকটা বুঝে গেলো? এই শরমে মাটিতে ঢুকে পড়বে সে?
–“মাথামোটার মতো চেয়ে থাকো আর আমাকে অস্থির করো।বসো।আমি আসছি।”
গমগমে বাক্য বিনিময়ে প্রস্থান ঘটে উমাইরের।ফিরেও আসে দ্রুত। হাতে চায়ের ওয়ান টাইম কাপ।তাহুরার দিকে এগিয়ে দিলে তাহুরা জানায়,
–“খাবো না।”

উমাইরের মেজাজ চটে।সে কাপ কাত করে চা ফেলতে নিলে তাহুরা আঁতকে উঠে,
–“খাবো।দিন।”
উমাইর কাপ এগিয়ে দেয়। গাড়িতে বসে।তাহুরার পাশাপাশি।মেয়েটা সময় নিয়ে চা খাচ্ছে। করুণা হয় উমাইরের।তাহুরার কপালের সম্মুখে দোদুল্যমান চুল জ্বালাতন করলে সেগুলো কানে গুঁজে দেয় উমাইর বিনা প্রশ্নে।

তাহুরা চমকিত, হচকিত।বিস্মিত নজরে উমাইরের পানে চাইলে সে তাহুরার মাথায় হাত রাখে,
–“বেশি খারাপ লাগলে যেও না।বাসায় দিয়ে আসবো?”

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে