রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় ৭+৮

0
1102

#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব -৭
________________
–“উমাইর ভাইয়া গরুর মাংস খায় না,তাহুরা।ওর এলার্জি আছে।”
নিজ খাওয়ার মাঝে সবটা খেয়ালে রেখেছে আফিয়া। উমাইরের প্রতি তার আলাদা দরদ প্রকাশ করছে বারংবার।তাহুরা নিজের হাতটা যেমন বাড়িয়েছিল উমাইরের প্লেটের দিকে,ঠিক তেমন আবার গুটিয়ে নেয়।
উমাইর খাওয়া থামায়।প্লেটে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে জবাব দেয়,
–“এক পিস দিলে চলবে।”
আবারও খেতে আরম্ভ করে উমাইর।তাহুরা ভীত।গরুর মাংস দিবে নাকি দিবে না এই নিয়ে দ্বিধা।একে তো আফিয়া বললো উমাইরের এলার্জি আছে,আবার উমাইর সজ্ঞানে গরুর মাংসের একটা পিসের জন্যে আবদার করছে।কি করবে সে এখন?চুপ দাঁড়িয়ে থাকা তাহুরার পানে উমাইর ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালে,মেয়েটার দ্বিধান্বিত মুখশ্রী অবলোকন করে।
–“দাও।”
প্লেট সামান্য চেপে দেয় সে তাহুরার দিকে। তাহুরা চামচে এক টুকরো তুলতুলে গরুর মাংসের টুকরো প্লেটে দেয়। উমাইর নিঃশব্দে খাওয়াতে মন রাখে।
আফিয়া আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়।উমাইর তাকে নিচু করার জন্যে এলার্জির কথাও ভাবেনি।এমন ঘৃণা করে সে আফিয়াকে?দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে তার।খুব করে আফসোস করে উমাইর কেনো তার চাচাতো ভাই হলো?

খাবার সমূহের মাঝে প্রায় সবটা তাহুরার রান্না করা।মেয়েটা রান্নার কাজে পটু।হাত দারুণ তার।সকলে খাবারের ছলে তাহুরার প্রশংসা করে।তাহুরা,শিউলি,
তাহুরার মামী এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে সকলকে।মেঘলা বেগম চুপচাপ খেলেও তার নজর ছোট ছেলের অবয়বে।এই বাড়িতে আসার পর হতে উমাইর না ব্যস্ততা দেখিয়েছে,না কোনো ভনিতা দেখিয়ে চলে গিয়েছে।সুন্দর ভাবে এই বাড়িতে হজম হচ্ছে তার ছেলে।সন্দিহান এই বিষয়।ঘুরে ফিরে মেঘলা বেগম তাহুরাকে অবলোকন করে।তার ছেলের এমন স্থায়ী থাকা যদি তাহুরা হয়,তাহলে এমন পরিবর্তনে মেঘলা বেগম বেজায় খুশি।তাহুরা মেয়েটাকে অদ্ভুতভাবে নিজের মনে হচ্ছে মেঘলা বেগমের। অমায়িক ব্যবহার,আকর্ষিত মুখশ্রীর মেয়েটা অন্তরে দাগ কাটে মহিলার।ঘোর কাটে মেঘলার তখন,যখন তাহুরা মাছের মাথার পিস মেঘলার প্লেটে দেয়,
–“পুরোটা শেষ করবেন আন্টি।ধীরে সুস্থে খাবেন।দরকার হলে আমি কাঁটা বেছে দিবো।”
তাহুরা মিষ্টি হাসে।গালের দুধারে সৃষ্ট গর্তের কারণে ঝলসে যায় মেঘলার নজর।কি অপরূপ হাসি মেয়েটার!মেঘলা বেগম হাসি বিনিময় করে,
–“আচ্ছা ঠিকাছে।”

রাতের খাবার পর্বের সমাপ্তি হলে তাহুরা চট জলদি মিষ্টি জাতীয় খাবার পরিবেশন করে।বসার ঘরে উমাইর প্রথম যায়।বাকিরা খেয়ে হালকা হাঁটাচলা করছে ঘর জুড়ে।তাহুরাদের ঘরটা বেশ পরিপক্ক,গোছানো। নিজের খাওয়ার কথা ভুলেছে তাহুরা।বসার ঘরের চওড়া ছোট আকৃতির টেবিলে রাখে রসমালাইয়ের বাটি।জন কয়েক এসে বসছে বসার ঘরে।সবাই নিজেদের মাঝে কথায় মগ্ন।ইমন সাহায্য করছে খাবার সকলের হাতে হাতে দিতে।কাকতালীয়ভাবে আজ উমাইরের নিকট বারবার যেতে হচ্ছে তাহুরাকে।এইযে এখনো রসমালাইয়ের বাটিটা এগিয়ে দিচ্ছে সে উমাইরের হাতে।দৃষ্টি মিললে উমাইরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বাদ যায়নি তাহুরার নজর হতে। বাটি নিয়ে ঝাঁঝালো তবে ধীর কণ্ঠে সে বলে উঠে,
–“এই মুহূর্তে খেতে যাবে।ইমন আছে সবার জন্যে।”

–“কাজ আছে তো।”
তাহুরা ভাবলেশহীন বলে।উমাইরের কড়া চাহনিতে ভস্ম হয় মেয়েটা। উমাইরের এহেন কান্ড যত্ন ধরে আহ্লাদ করতে চাইছে তার বেপরোয়া মন।
–“বাটি তোমার মাথায় ভাঙবো। এখনি যাও।”
রুদ্ধ স্বর উমাইরের।অন্তর নড়ে যায় তাহুরার।
ইতোমধ্যে সবাই এসেছে বসার ঘরে।তাহুরাকে তার মা ইশারায় ডাকে।কাছে গেলে মাও বলে,
–“খেয়ে নে।আবার শরীর খারাপ করবে।”
তাহুরা মাথা নাড়ায়।খিদে না লাগলেও এখন উমাইরের ধমকে তার খিদে যেনো আকাশসম।
যাওয়ার পথে পুনরায় অজানা কারণে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে।উমাইর তার পানে তাকিয়ে।দৃষ্টি জোড়া বুঝেনি তাহুরা।মাথা নত করে ছুট দেয় খাবার ঘরে।

তাহুরা ভীষণ ধীরে ভাত খায়।সে খাওয়া অবস্থায় সকলের যাওয়ার প্রস্তুতি শুনতে পায় আলগোছে।সুনেরা এসেছে তাকে ডাকতে।এখনো তাহুরার অর্ধেক ভাত বাকি।হাত ধুয়ে উঠে পড়ে সে।মেঘলা বেগম দুই বোনকে জড়িয়ে ধরে।আবদারের সুরে বলে,
–“কাল জানাবো কবে বিয়ের তারিখ ঠিক করতে আসবো।”
সুনেরা লজ্জা পায়।তবে,তাহুরা হাস্যোজ্জ্বল,
–“আন্টি দিনের বেলায় আসবেন।আপনি তো পুকুর ঘাটে গেলেন না আমাদের।”
–“আসবো মা।”
মেঘলা বেগম হাত বুলায় তাহুরার মাথায়।

বসার ঘরে সবাই বিদায় জানালেও অনুপস্থিত উমাইর।তাহুরা ছটফট ভঙ্গিতে এদিক সেদিক তাকায়।ফলাফলের উন্নতি নেই।মেঘলা বেগম শিউলির সাথে আলাপ সারছে।দিলরুবা তাহুরার মামী,নানীর সমেত ব্যস্ত।সুনেরা তাহুরার হাত ধরে বলে,
–“বাইরে চল।তোর ভাইয়া বাইরে।”
মুন্সী মিয়া জয় এবং আলমের সঙ্গে মেয়ের ভালো দিক তুলে ধরার চেষ্টায়।মোক্ষম সুযোগ পেয়ে বেরিয়ে যায় দুইবোন।

তাহুরাদের উঠানের মধ্যবর্তী দাঁড়ানো উমাইরের গাড়ি।সে তার ভাইয়ের সাথে কিছু নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।নিবরাস,আফিয়া,ইমন অন্যদিকে।তাহুরা বুঝলো দুই ভাইয়ের আলোচনায় ঢুকতে তারা সাহস পাচ্ছে না।
তবে, সুনেরা এতসব বুঝেনা।জুবায়েরকে কিছু বলার আছে।তাই বোনের হাত টেনে সেদিকে যায়।কিছুটা দূরত্ব থেকে তাহুরা শুনতে পায় উমাইরের প্রত্যেকটা শব্দ,
–“আমার গাড়িতে আফিয়া উঠতে পারবে না মানে পারবে না,আর কয়বার বলবো?তুমি জিদ করলে যেও না আমার গাড়িতে।আফিয়াকে নিয়ে বাবাদের গাড়িতে উঠো।”
–“উমাইর রাগছিস কেনো ভাই?”
জুবায়ের ইতস্তত।
–“আমার রাগ থেকে জিজ্ঞাসা করো।”
উমাইর বিরক্তিতে চোখ কুঁচকে নেয়। এর মাঝে উপস্থিত হয় দুইবোন।সুনেরা বিনা দ্বিধায় জুবায়েরকে বলে উঠে,
–“তুমি বাসায় গিয়ে সোজা আমাকে ফোন করবে।নাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

দুইভাই তর্ক থামায়।উমাইর পেছন ফিরে।সম্মুখে তাকায় না।জুবায়ের হাসির চেষ্টা করে আওড়ায়,
–“দিবো জান।”
–“এহ,শরমের মাথা খেয়েছো?ভাইবোন সামনে।”
লজ্জায় নেতিয়ে যায় সুনেরা।

তাহুরা অবাক।ভাইয়া আপুকে নিশ্চয় খুব বেশি ভালোবাসে!নিঃসন্দেহে তার আপু ভাগ্যবতী।
সুনেরা চুপচাপ উমাইরকে বলে,
–“ভাইয়ার কি হলো?রেগে কেনো?আবার আসবেন কিন্তু আমাদের বাসায়।”
উমাইর সম্মুখে ফিরে।তাহুরা ঘাড় উঁচিয়ে লোকটাকে দেখে।কম পাওয়ারের শুভ্র আলোতে উমাইরের থমথমে চেহারা দৃশ্যমান।রেগে আছে তাহুরা নিশ্চিত।সেই রাগী চেহারার লোকটা ঠোঁট নাড়িয়ে চোখ না হাসিয়ে অধর প্রসারিত করে,
–“আসবো ভাবী।না এসে উপায় কই?”
–“হ্যাঁ,এসো।”
সুনেরা জবাব দেয়।

তাহুরা পর্যবেক্ষণ করে উমাইরকে।লোকটার হাসি দুই ধরনের।একটা সন্ধ্যার সময়কালের প্রাণৌচ্ছ্বল হাসি।আরেকটা এখনকার।গম্ভীর হাসি।দুই হাসিতে লোকটা দুইরকম।কিন্তু,অন্তরে ফুল সৃষ্টির ন্যায়।
উমাইর যেই তাহুরার পানে চোখ নামাতে গেলো,তাহুরা দৃষ্টি ফেরায় অন্যদিকে।উমাইর দেখে তার মনের হত্যাকারীকে।জ্বলজ্বল করছে মেয়েটার অবয়ব।এই হালকা আলোটা মেয়েটার সামনে ফিকে।আফিয়া আবদার না করে এই মেয়েটা আবদার করুক তার গাড়িতে উঠার জন্যে।উমাইর নিঃসন্দেহে অনুমতি দিবে।পারলে নিজ কোলে উঠিয়ে বসাবে।

আফিয়ার কথা ভাবতেই উমাইর ফের চটে।গাড়ির দরজা খুলে উঠে পড়ে।তার দেখাদেখি নিবরাস গাড়ির নিকট আসে।তাহুরাকে হেসে বলে,
–“বাঙালি আত্মীয়রা বিদায়কালে ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে দেয়।দেখ না এখনো আসছে না।”
–“আসবে।তুই কার সাথে যাবি?”
তাহুরা প্রশ্ন করে।
–“আমার ভাইদের সাথে।”
–“ওহহ।আফিয়া আপু তোদের সাথে যাবে না?”
তাহুরার প্রশ্ন শেষ হওয়ার সময়কালে এসে পড়ে ভেতরের মানুষজন।
নিবরাস গাড়িতে উঠতে উঠতে বলে,
–“জানিনা।উমাইর ভাই চটেছে।ওকে বকেছেও।আমার বোন কি করেছে খোদা জানে।উমাইর ভাই হুদাই কাউকে বকে না।”
তাহুরা জবাব দিতে পারেনি।উমাইর শব্দ করে গাড়ি স্টার্ট করে। সুনেরার হাত ধরে পেছনে যায় খানিকটা।আফিয়া উমাইরের গাড়িতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বাবাদের সাথে অন্য গাড়িতে উঠে।
প্রথমে তাদের বাড়ি হতে বেরিয়ে যায় উমাইরের গাড়ি।পরপর বেরিয়ে যায় তাদের অন্য গাড়িটিও।
——————–
মায়ের সাথে দুইবোন মিলে মধ্যরাত অব্দি কাজ খতম করে।তাহুরাদের বাড়ির মেহমান ছেলে পক্ষ যাওয়ার পরপরই বিদায় জানায়। সুনেরা আগে ভাগে রুমে যায়।ফোন বাজছে তার।তাহুরা বাবা মায়ের বিছানাও গুছিয়ে দিচ্ছে।মায়ের পায়ে ব্যথা বেড়েছে।তার বাবা শিউলির পায়ে মালিশ করা অবস্থায় বলে,
–“কাজ বেশি করেছে আমার ছোট মেয়ে আর ব্যাথা করছে তার মায়ের পা।”
মুন্সীর আহ্লাদে বলা কথায় তাহুরা খিলখিল করে হাসে,
–“মোটেও না বাবা।মা সাহায্য না করলে আমি কিছু করতে পারতাম কি?”
মুন্সী মাথা নাড়ে।শিউলি সন্তুষ্ট।তার জামাইয়ের এমন খুনসুটি কথাবার্তা সে খুশি হলে তবে শোনা যায়।নিশ্চয় মুন্সী মেয়ের প্রস্তাব খানায় বেজায় খুশি।
–“এমন পরিবার আমাদের মেয়ের জন্যে আসবে।আমি ভাবিনি কোনোদিন।”
শিউলির সন্তুষ্টি।
–“আল্লাহ্ মালিক।আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যে করেন।”

তাহুরা শুকরিয়া আদায় করে অন্তরে।আল্লাহ্ দোয়া কবুল করেছে তার।পরিবারের সকলে সন্তুষ্ট।রুমে ফিরে সে।সুনেরা কথা বলছে ফোনে।তাহুরা বোনকে প্রাইভেট সময় দিতে বসার ঘরে যায়।অত্যধিক ক্লান্ত থাকায় সোফায় ঘুমিয়ে পড়ে সে।ভুলে যায় উমাইরের বলা শর্তটুকু।
.
নির্ঘুম রাত কাটে উমাইরের।তাহুরা মেসেজ দেয়নি তাকে।আজ শুক্রবার। কলেজ নেই।সাত-সকালে তন্দ্রাসক্ত উমাইর আবারও মোবাইল দেখে।নাহ মেসেজ নেই কোনো।মেয়েটাকে ধমক না দিয়ে ভুল করেছে সে।মাথাটা দপদপ করছে।আশা জিনিসটা বড় খারাপ।একবার আশা করলে,সেই আশা পূরণ না হলে অন্তরে ক্ষত হয়।আক্রোশে উমাইর শোয়া থেকে উঠে।ঘুমের প্রয়োজন তার।উদোম শরীর ঢাকে সে শার্ট দ্বারা।এলোমেলো পা ফেলে রুম হতে বেরোয়। দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির নিকট গিয়ে থামে। হাঁক ছাড়ে মাকে,
–“মা?রং চা দাও।”
মেঘলা বেগম রান্নাঘরে ছিলেন। ভোর হতে মহিলা সংসারের কাজে নামে। হ্যালপিং হ্যান্ড থাকলেও মহিলা নিজের পরিবারের জন্যে খাবার নিজ হাতে রান্না করে।বাড়ির সকলে আবার সদা ভারী নাস্তা খায়।

উমাইর মায়ের শব্দ না পেয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামে। রান্নাঘর হতে সামান্য দূরত্বে দাঁড়িয়ে ফের বলে,
–“মা?”
–“উমাইর!ডাইনিংয়ে বস।আসছি।”
মায়ের কণ্ঠে উমাইর ফের বলে,
–“মাথা ধরেছে।চা দাও।”
উমাইর হাঁটতে আরম্ভ করে। রান্নাঘর হতে ভালো ব্যবধানে ডাইনিং রুম।সেথায় চেয়ার পেতে বসলে ঘরের সার্ভেন্ট এসে নিউজ পেপার দিয়ে যায় উমাইরকে।
উমাইর কয়েক পাতায় চোখ বুলায়।মেজাজ বিগড়ে আছে।তাহুরাকে সামনে পেলে কাঁদিয়ে অস্থির করবে।উমাইর বড্ড উৎসুক ছিলো মেসেজের জন্যে।দুহাতে সে মাথা চেপে ধরে।অগোছালো চুলে আঙুল বুলায়।বিড়বিড় করে শুধায়,
–“মেসেজ না দেওয়ার বদলে কান্না করবে তুমি।আমি করাবো তোমাকে কান্না।মাথামোটা একটা।”

পরক্ষণে তার অন্তর শীতল হয়।মেয়েটা তাকে কি বলে সম্বোধন করবে এটা ভেবে হৃদয়স্থলে ঝড় উঠে।ভারী মাথার মস্তিষ্কে ভেসে উঠে গতদিনের তার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো।
চায়ের কাপ এবং প্লেট ভর্তি বিস্কিট রাখে মেঘলা বেগম।চেয়ার পেতে বসে,
–“আপাতত খা এগুলো।নাস্তা হবে একটু পর।এতো জলদি উঠেছিস কেনো? কোথাও যাবি?ঘুম যাসনি?চোখ লাল দেখাচ্ছে।

উমাইর গরম চায়ের কাপে চুমুক দেয়। বিস্কিট নেয়,
–“ঘুমাতে পারিনি।মাথা ধরেছে।”
–“ওহ।কেনো ধরেছে?বিশেষ কোনো কারণ? কাল কিছু হয়েছে আমার ছেলের!”
মুখ টিপে হাসে মেঘলা।
–“কেনো? কাল কিছু হওয়ার কি?”
উমাইর খেতে ব্যস্ত।
–“কিজানি বাবা। জুবায়েরের শালী কিন্তু ব্যাপক আদুরে।কেমন লক্ষ্মী মেয়েটা।”
–“কি বলো?কেমন লক্ষ্মী?”
ঠাট্টা করে উমাইর।
–“তুই দেখিসনি?”
–“দেখার কথা ছিলো?”
ছেলের পুনরায় প্রশ্নে বোকা বনে মেঘলা।বাহুতে চড় দেয় আলতো হাতে,
–“ফাজলামো করিস?মায়ের চোখ থেকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব।মায়ের চোখে সব আসে।”
–“দেখে রাখো তবে। সময়ে আমাকে সাপোর্ট করবে।ঘুমাবো দেখি।”
এক শ্বাসে পানি শেষ করে উমাইর।লম্বা কদমে সম্মুখে অগ্রসর হয়।
মেঘলা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে ছেলের পানে।ছেলেটা তার বিশাল ইঙ্গিত দিয়ে গেলো।সাথে যোগ হলো অন্য এক বড় দায়িত্ব।আদরের ছেলের জন্যে এই দায়িত্বটা পালন করা এখন জীবনের অন্যতম লক্ষ্য মেঘলা বেগমের।
————
উমাইরের তন্দ্রা ছুটে ঠিক দুপুর একটায়।চারিদিকে মিষ্টভাষী খুতবা।ধড়ফড়িয়ে বাথরুমে যায় উমাইর।তাড়াহুড়োয় গোসল সেরে পাঞ্জাবি জড়িয়ে নামাজে যায়।নামাজ শেষে দেখা হয় ভাইয়ের সাথে।মসজিদ তাদের এলাকার। হেঁটে আসা যাওয়া করা সহজ।জুবায়ের ভাইয়ের সাথে হাত অবস্থায় সুনেরার সহিত কথা বলে।প্রথমত উমাইর জানতে পারে,নিবরাস আর তার পরিবার নানা বাড়িতে।তাই আজ তারা ডেট ফিক্সড করতে কবে যাবে সেটা জানাবে না।দুইদিন পর সময় নির্ধারণ করে তাদের খবর দেওয়ার।সাথে উমাইর স্পষ্ট শুনে তার ভাই গাড়ি কিনবে।সঙ্গে যাবে হবু ভাবী।ফোন রেখে জুবায়ের ভাইকে বলে,
–“তোর গাড়িতে একটু লিফট দিবি?আমার বউ আর শালী যাবে সাথে।”
–“এমন ফর্মালিটির কি আছে?হঠাৎ এমন চেঞ্জ?”
উমাইর সরাসরি প্রশ্ন করে।

–“আরে আমার শ্বশুরবাড়ির লোক।তোর আবার যদি সমস্যা হয়? কাল যা বকা দিলি আফিয়াকে।আমার শালীকে এমন বকা দেওয়া যাবে না।”
জুবায়ের হেসে বলে।
–“দেখা যাক।আফিয়া আর তোমার শালী এক না।আফিয়ার হাবভাব নষ্ট।”
উমাইর পাঞ্জাবির পকেটে হাত গুঁজে।
–“আফিয়ার সাথে সমস্যা কি তোর জানিনা।কিন্তু আমার শালী একদম সহজ একটা মেয়ে।সে আগে কোনোদিন আমার সাথেও ভালো করে কথা বলেনি।এইযে কাল দেখা হলো তখন যা কথা বললো।”
ভাইয়ের কথায় উমাইর বিড়বিড় করে,
–“ভালো করেছে।”
পরক্ষণে সে ভাইকে বলে,
–“লাঞ্চের পর বের হবো তবে।”
–“ঠিক আছে।”
জুবায়ের জবাব দেয়।
…………….
সকাল হতে ভেবে অস্থির হয়েছিল তাহুরা কি নাম দেওয়া যায় উমাইরকে।তাই মেসেজ পাঠানো হয়নি তার। রাতও কাটে তার ঘুমে।এখনো মেয়েটা ভেবে যাচ্ছে তৈরি হওয়া অবস্থায়। বোন বলেছে একটু বের হবে জুবায়েরের সহিত,সঙ্গে জানিয়েছে দুইদিন পর খবর দিবে কবে তারা বিয়ের ডেট দিতে আসবে।

সুনেরা বোনকে ছাড়া যেতে চায় না।বাধ্য হয়ে তাহুরা যাচ্ছে, পাছে যদি বোন কষ্ট পায়!শেষমেশ তৈরি হয়ে মোবাইল হাতে বসে বিছানায়।বোনের বিয়ে নিয়ে ব্যাপক চিন্তিত তাহুরা।যেভাবে হোক,বোনের বিয়েতে কোনো বাঁধা আসতে দিবে না।দুইদিন সময়টা তাহুরার জন্যে পিছিয়েছে কিনা এই নিয়েও ভাবনা তার।

একটা নাম কল্পনা করতে চেয়েও পারছে
না।
“ধূর্ত,চালাক,গম্ভীর,রাগী,সুদর্শন” ঘুরে ফিরে এগুলো মাথায় আসছে।এমন নাম দিলে উমাইর আস্তো রাখবে না তাহুরাকে।
অতঃপর না পারতে একটা কথা ভাবে। নামটা উত্তম মনে হয়।কোনো রিস্ক নেই।হোয়াটস অ্যাপে গিয়ে উমাইরকে খুঁজে বের করে।সালাম দিয়ে মেসেজ পাঠায়। উমাইরের লাস্ট সিন দেখাচ্ছে তিনটা বিশ।চার মিনিট আগে একটিভ ছিলো সে।ফোন রেখে তাহুরা তার বোনকে গত রাতের চেপে থাকা প্রশ্ন উগ্লিয়ে বলে,
–“উমাইর স্যারকে তুমি চিনতে আগে থেকে?”
–“হ্যাঁ,কেনো চিনবো না?কিন্তু ও তোর কলেজের স্যার ছিল এটা জানতাম না।উমাইর ভাইয়া অনেক ট্যালেন্টেড আর আত্মনির্ভরশীল।বাবার বিজনেস থাকা সত্বেও জব বেছে নেয়।”
সুনেরা উত্তর দেয়।তাহুরা আচমকা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
–“জুবায়ের ভাইয়া শান্ত অনেক।কিন্তু উমাইর স্যার উনার বিপরীত কেনো?”
–“এইযে যেমন আমরা।তুই শান্ত আর আমি রাগী।ছোট ছেলেদের জিদ বেশি থাকে।উমাইর ভাইয়া নাকি একবার রেগে গিয়ে গাড়ির আয়না ভেঙেছিলো কলেজে পড়ুয়া অবস্থায়।”
আবারও জবাব দেয় সুনেরা।সবটা তার জুবায়ের হতে শোনা।
–“হায় আল্লাহ্!”
অবাক হয় তাহুরা।

কাছাকাছি এলে জুবায়ের ফোন করে সুনেরাকে।মাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়ে দুজন।গেটের কিছু দূরে দাঁড়িয়ে গাড়ি।ঘোরাতে সহজ হয়।উমাইর ড্রাইভিং সিটে,পাশে জুবায়ের।দুবোন পেছনে উঠে বসে।সুনেরা সালাম দেয় উমাইরকে।তাহুরা সালাম দেয় তার হবু দুলাভাইকে।কুশল বিনিময় করা অবস্থায় নিজেদের গন্তব্যে ছুটে তারা।

গাড়ির শোরুমের সম্মুখে গাড়ি থামলে নেমে যায় চারজন।জুবায়ের তাহুরাকে প্রশ্ন করে,
–“এইখানে যাবে নাকি উমাইরের সাথে সামনের রেস্টুরেন্টে বসবে?”
–“আমার সাথে থাকুক তাহুরা।”
সুনেরা বলে।উমাইর নীরব দর্শক।তার ধারণা তাহুরা রাজি হবে না। বোন আর বোনের জামাইয়ের একা সময় কাটানোর জন্যে রেস্টুরেন্টে বসতে চাইবে।হলো তা।তাহুরা ডান হাত নাড়িয়ে বোনকে জবাব দেয়,
–“তোমরা যাও।আমি রেস্টুরেন্টে বসবো।”
উমাইরের অধর প্রসারিত হলে নিজেকে সামলে নেয় সে।
সুনেরা বোনের কাঁধে হাত রাখে,
–“আয় না।”
–“আপু আমি উনার সাথে থাকবো।সমস্যা হবে না।উনি ভালো মানুষ।আমি চুপ করে বসে থাকবো এক দিকে।”
ফিসফিসিয়ে কানে কানে জানায় তাহুরা।
সুনেরা উমাইরকে অনুরোধ করে,
–“ভাইয়া একটু দেখে রাখবেন ওকে।”
–“আচ্ছা।”
উমাইরের একবাক্যের জবাব।

তারা দুজন ভেতরে গেলে উমাইর গাড়িতে উঠে।তার দেখাদেখি তাহুরা পিছে উঠতে নিলে দেখে পেছনের দরজা বন্ধ।সে সামনের জানালায় এসে হালকা ঝুঁকে,
–“ওটা লক। খুলতে পারছি না।”
–“সামনে বসো।”
উমাইর ভ্রু কুঁচকে বলে।
তাহুরা মাথা নাড়িয়ে বসে। জড়তায় তার সত্তা কুঁচকে।উমাইর কেবল গাড়ি ঘুরিয়ে রাস্তার অপর পাশে পার্ক করে,
–“আসো।”
তাহুরা উমাইরের পিছু হাঁটছে।রেস্টুরেন্ট আট তলায়।সম্পূর্ণ বিল্ডিংয়ে নানান প্রতিষ্ঠান।লিফটে আবার ভিড়।মানুষের সমারহ।উমাইর একপাশে দাঁড়ায় তাহুরা সমেত।একটু কাছে সরে আসে উমাইর।তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আশপাশ স্ক্যান করছে।তার নিকটে দাঁড়ানো রূপসীর দিকে অনেকের নজর।উমাইর বিরক্ত হয়।ধীর গতিতে তাহুরার সম্মুখে দাঁড়ায় তাকে আড়াল করে।

ভিড় খানিক কমলে দুজনে উঠে লিফটে।

অবেলায় রেস্টুরেন্টে মানুষ কম। রেস্টুরেন্টের একপাশে মানবশুন্য জায়গায় বসে তারা।
ওয়েটার এলে অর্ডার করে খাবার।তাহুরা হালকা কিছু অর্ডার করতে চাইলে উমাইর নিজস্ব ইচ্ছায় অর্ডার করে।তাহুরার হালকা চাওয়ায় যেনো কিছু হবে না।
ওয়েটার গেলে উমাইর চেয়ারে হেলান দেয়।তাহুরার দিকে তাকায়।প্রথমেই উমাইর বলে উঠে,
–“ভাইয়া,ভাবীর বিয়ে তাহলে অনেক দেরীতে হচ্ছে।আফসোস।”
আঁতকে উঠে তাহুরা।কেনো দেরীতে হবে?তাহুরা জবাব তো দিয়েছে।এছাড়া আজ তারা বিয়ের তারিখ ঠিক করার জন্যে কোনদিন আসবে সেটার জবাব দিচ্ছে না নিবরাসের পরিবারের জন্যে।তাহলে আবার কেনো পিছাবে?ছোট্ট স্বরে সে বলে,
–“কেনো?”
–“শর্ত ভুলেছো?বেশি দেরী করলে আবার সমস্যা বাড়বে।”
উমাইর দুহাত বুকে গুঁজে।তাহুরার ছলছল আঁখি পছন্দ হচ্ছে তার।
অধর কেঁপে উঠছে তাহুরার।ধীর কণ্ঠে বলে,
–“মেসেজ দিয়েছি বেরুনোর আগে। কাল রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম কবে মনে নেই।ক্লান্ত ছিলাম অনেক।”
ইতিমধ্যে কান্নায় ছেপে যাচ্ছে তাহুরার গাল। নাক রক্তিম হচ্ছে।

–“মোবাইল চেক করা হয়নি ড্রাইভিংয়ে ছিলাম।সরাসরি বলো এখন।”
উমাইর ব্যাপক গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে।

তাহুরা ভারী লজ্জায় নিমজ্জিত।কিভাবে বলবে সে!মেয়েটা ভেবে কূল পায় না।উমাইর নাছোড়বান্দা।সে গাড়ির চাবি নিয়ে টেবিলে ঘুরপাক দিচ্ছে।পাশে তার মোবাইল অবহেলিত।তাহুরার পানে চেয়ে উমাইর ফের বলে,
–“কি বলো?আমিও চাই ভাবী জলদি আমাদের ঘরে আসুক।এখন তুমি যদি না বলো…”

–“বল…বলবো।”
তাহুরার আঁখিতে জল। গালে জল।হাতের উল্টপিঠে অশ্রু মুছে।উমাইর সরাসরি তাহুরার পানে ফিরে।মেয়েটার এমন বোকা কান্না তার অতিপ্রিয়।তাহুরাকে চুপ থাকতে দেখে উমাইর আওড়ায়,
–“অনেক বড় নাম?বলতে এতো সময় নিচ্ছো কেনো?”
–“এ…ই যে।আমি কলেজের বাইরে আপনাকে “এই যে” বলে ডাকবো।”
এক নিঃশ্বাসে উত্তর দেয় তাহুরা।নিজের কন্ঠ তার অন্যরকম লাগছে।কেনো লাগছে?আচ্ছা,তাহুরা কারো সামনে কখনো এমন লজ্জামাখা কান্নারত সুরে কথা বলেনি তাই!

উমাইরের শরীরে উষ্ণতা ভিড় করে।লজ্জা আর কান্নার মিশ্রণে মেয়েটার সুর অন্যরকম।তার বলা ডাক,কথা উমাইরের ভেতরকার অস্থিরতাকে নাড়িয়ে দেয়।উমাইর পাঞ্জাবির কলার টানে।সোজা হয়ে বসে,
–“আবার বলো।একটা প্রশ্ন করো আমাকে।”
–“এই যে,আপনি কি…”
–“স্টপ!আর কিছু বলবা না।চুপ।”
উমাইর সামলে নেয় নিজেকে।মেয়েটা মাঝে মাদক আছে,সেই আসক্তিকে মত্ত হয়েছে উমাইর।এমন কণ্ঠ,সুর,তার দেওয়া নাম কেমন মনকাড়া।আপন আপন ভাব।উমাইর খুশি সাথে তার ভেতরে দ্বন্দ্ব।মেয়েটার এমন মধুর কণ্ঠ,আদুরে ডাক সবটা উমাইরের জন্যে বরাদ্ধ।

উমাইর টেবিলের উপর খানিক ঝুঁকে।তাহুরার চিবুকে আঙ্গুল স্পর্শ করে মুখ উপরে তুলে।ভালোবাসাময় মিশ্রিত শাসনের সুরে বলে,
–“এমন লজ্জামাখা কণ্ঠের কান্না,কথা বলা, কেবল আমার সামনে করবে।অন্যের সামনে এইরূপ যেনো কখনো না দেখাও,তাহুরা।নাহলে আমি কি করবো, তুমি ভাবতেও পারবে না। খারাপ উমাইরকে চেনা তোমার ঢের দেরী।আপাতত ভালো উমাইরকে দেখো।”

পরক্ষণে উমাইর নিজ চেয়ারে বসে।তির্যক হেসে বলে,
–“বারবার বলছি তাহুরা,কলেজের বাহিরে আমি তোমার স্যার না।কলেজের বাহিরে আমি কেবল উমাইর,তোমার এই যে!”

চলবে……..

#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব- ৮
______________
–“তুই আমার শালীকে কাঁদিয়েছিস,উমাইর?”
তাহুরার ফুলে থাকা মুখশ্রী অবলোকন করে প্রশ্ন করে জুবায়ের।
তাহুরা ইতস্তত ভঙ্গিতে হাসে।সুনেরা বোনের কাঁধ চেপে দাঁড়িয়ে।উমাইর গাড়ির সম্মুখে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাহুরার পানে তাকিয়ে আছে।সে ভেবেছে তাহুরা নালিশ করবে বোনকে।কিন্তু,মেয়েটা হাসছে।উমাইর গাড়ির দরজার সম্মুখে যায়।ভ্রু কুঁচকে ভাইকে জবাব দেয়,
–“তোমার শালী মিটমিট হাসছে।দেখছো না?”

–“ভাইয়া, ও কাঁদলে আলাদা বুঝা যায়।”
সুনেরা বোনকে নিয়ে চিন্তিত।তার বোন সহজ সরল বেশ।মুখ ফুটে তার কম।অন্যের দোষ ঢাকতে উস্তাদ মেয়েটা।

–“আপু,আমি ঠিক আছি।আসলে রেস্টুরেন্টে একটু অকোয়ার্ড লাগায় ভুলে কান্না এসেছিলো।উনার দোষ নেই।”
দৃষ্টি মিলে তাহুরা,উমাইরের।তাহুরার উত্তরে মনটা কেমন নড়ে উঠে মানবের।মুর্দা কথা,উমাইর কাঁদিয়েছিলো তাহুরাকে।তাও বিনা কারণে,ইচ্ছাকৃত।

জুবায়ের শব্দ করে হাসছে।সুনেরার চেহারার চিন্তিত ভঙ্গি কেটেছে।বোনের উত্তরই তার জন্যে যথেষ্ট।

–“তুইও না।জুবায়ের সিএনজি ঠিক করে দাও আমাদের।তোমাদের ঝামেলায় আর না ফেলি।”
সুনেরার কথায় রেগে যায় জুবায়ের।সে তার হবু বউয়ের বাহুতে হাত রাখে,
–“নতুন গাড়ি করে ড্রপ করছি। আমার গাড়ি ছেড়ে সিএনজিতে যাবে কেনো?”
–“শুনো জুবায়ের তুমি বেশি কথা বাড়াচ্ছো।”
সুনেরা বলে উঠে।
–“তুমি বেশি করছো,জান।আমার মেজাজ ঠাণ্ডা ছিলো।এখন গরম।যাবে কিনা বলো?”
কেমন তেঁতিয়ে উঠছে জুবায়ের।

তাহুরা ভীত হয়। পাছে বোন রাগ করে যদি ভাইয়ার সাথে মনোমালিন্য করে! তার বোন রেগে গেলে আবার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সে তার বোনকে বলে,
–“ভাইয়ার সাথে যায়,চলো।”
–“ওকে,তোমরা যাও তবে।আমি বাসায় যাচ্ছি।”
উমাইর ফোড়ন কেটে বলে। সেও চায় না ঐ দুজনের মাঝে কোনো ঝামেলা হোক।উমাইর গাড়ির দরজা খুললে এমতাবস্থায় কেশে উঠে জুবায়ের।সে অনুরোধের সুরে তাহুরাকে শুধায়,
–“প্রিয় শালী,তুমি উমাইরের সাথে আসো।আমি তোমার আপুকে নিয়ে যায়?সমস্যা হবে তোমার?”

ফের উমাইর!এই লোকটা কি বলে কাঁদাবে আবার তাকে?উমাইর মানুষটা তার পিছু ছাড়ছে না কোনোভাবে।বাস্তবিক বা জল্পিত কোনো না কোনো ভাবে উমাইরের সাথে তার সঙ্গ দিতে হচ্ছে।সুদর্শন লোকটা তাহুরার মনের মাঝে অস্থিরতা সৃষ্টি করলেও,
ভয় ছড়িয়ে রাখে সর্বক্ষণ।
তাহুরা উমাইরের অবয়বে দৃষ্টি রাখে।লোকটা তার সাথে যেতে চায়?উমাইর বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাহুরা জবাব দেওয়ার পূর্বে বলে,
–“হারি আপ,তাহুরা।”

তাহুরার উত্তর শোনার অপেক্ষা করেনি উমাইর।গাড়িতে বসে।সুনেরা প্রশ্নবোধক চেহারায় বোনকে দেখলে,তাহুরা উত্তর দেয়,
–“সমস্যা নেই ভাইয়া।”
তাহুরার মিষ্টি হাসিতে মন গলে সুনেরার,
–“আচ্ছা আয় তবে।জুবায়ের তুমিও না,বেশি করছো ইদানিং।”
–“বেশি করার সময় এখন ডার্লিং।”
এক চোখ টিপে জুবায়ের।অভিমান অল্প কমে সুনেরার।মুচকি হেসে তাহুরাকে গাড়িতে উঠতে বলে।সে উঠলে নিজেও বসে জুবায়েরের নতুন গাড়িতে।গাড়ির সকল ফর্মালিটি,টেস্টিং, সার্ভিসিং সবকিছু কমপ্লিট করানো।

ঘড়ির কাঁটা রাত আটটায়।আবহাওয়া শীতল।উমাইরের গাড়ির স্পিড ভালো।রাস্তাঘাটে আজ কম ট্র্যাফিক। জানালা বন্ধ।সেথায় মাথা ঠুকে বাহিরে দৃষ্টি দেয় তাহুরা।মনে কেমন ঝড় তার।পাঞ্জাবি পরিহিত উনাইরকে নিয়ে তার অন্তর ভাবুক হতে চায়। তাহুরা কুঁকড়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে।উমাইর এই ব্যাপারে জানলে তাকে কেটে হয়তো নদীতে ভাসাবে।কিন্তু,তাও।আজ মনটা কেমন ছন্নছাড়া।রাগী উমাইর,হাস্যোজ্বল উমাইর,আবার অন্য এক রূপ দেখেছে উমাইরের সে।কেমন জড়তায় ঘেরা।দৃষ্টিতে ছিল উমাইরের আলাদা আকাঙ্খা।সকল রূপে লোকটা অন্তরে জ্বলনের সৃষ্টি করছে তার। কলেজের স্যার উমাইর,তাহুরা সে কথা ভুলতে বসেছে। উমাইর নিজে বললো,কলেজের বাহিরে সে তার স্যার না।

–“ভাইকে মিথ্যে বলেছিলে কেনো?”
গাড়ির তুখোড় শব্দে উমাইরের গম্ভীর স্বরে ধ্যান ছুটে তাহুরার,
–“জ্বী?”
সোজা হয়ে বসে তাহুরা।আড় চোখে উমাইরকে দেখে।
–“আমি তোমাকে কাঁদিয়েছি ইজিলি বলতে পারতে। মিথ্যে বলার কি দরকার ছিলো?”
উমাইরের দৃষ্টি সোজা।

–“মিথ্যে বললাম কই?আমি এইভাবেই কান্না করেছি।যদিও কান্না করার কোনো কথা আপনি বলেননি।একটু সহজে কাঁদি আমি। তাই এখানে আপনার দোষ দেখছি না।”
অধর প্রসারিত করে তাহুরা।
–“ওহ আচ্ছা।সমস্যা নেই,এখন থেকে ভালো করে কান্না করাবো।এমনি এমনি কান্না আসবে না।আমি খুব ধমকাবো তোমাকে।”
তির্যক হাসে উমাইর।তাহুরা নিশ্চয় মুখে আঁধার মেখেছে।মেয়েটা অযথা ভয় পায় সর্বক্ষণ। তাহুরার দিকে ফিরতে চেয়েও ফিরলো না উমাইর।মেইন রোডে গাড়ি চালাতে হয় সুরক্ষিত ভঙ্গিতে।

উমাইরের ধারণা অনুযায়ী ঠিকই তাহুরা দমে যায়। উমাইরকে প্রশ্ন করে,
–“কেনো?”
–“আমার ইচ্ছা।জানো,আমি আমার ইচ্ছাকে দাম দিই বেশ।”
–“অনেক ধমকাবেন?”
ভীতু প্রশ্ন তাহুরার।
–“দেখি।আমি যা বলি শুনবে কিন্তু। চারা কবে দিবে?”
উমাইর জবাব দেয়।
–“আপনি যখন বলেন।”
–“বাসায় গিয়ে মেসেজ দিবে আমাকে।আমি বলবো কবে নিবো।”
স্টিয়ারিং ঘুরায় উমাইর দক্ষ হাতে।
তাহুরা ভোঁতা মুখে জবাব দেয়,
–“আচ্ছা।”

বাড়িতে পৌঁছায় তারা পৌনে নয়টার দিকে।তাহুরার আঁখিতে জল।ঘরের কাছাকাছি এসে ব্যাপক ট্র্যাফিকে পড়েছিল তারা।উমাইরকে বলেছিল,
–“নেমে যায় আমি?সামনেই তো বাসা।”
জবাবে উমাইর ধমকে উঠে,
–“এতো পাকনামি কিসের? ট্রাফিকে আটকে থাকা সকলকে তোমাকে দেখাতে চাইছো?নাকি নিজে দেখতে চাইছো?”
ব্যস এতটুকু কথায় তাহুরা কেঁদে অস্থির।লোকটাকে বাসায় আসতে বললেও বিনা উত্তরে চলে যায় সে।কি অভিমান লোকটার!

কোনোভাবে নিজেকে শান্তনা দেয় তাহুরা।ওড়নার কিনারায় অশ্রুজল মুছে। মা এসে চা দেয়। প্রশ্ন করলেও উত্তর দেয়নি সে। শিউলি কাজের তাড়নায় মাথা না ঘামিয়ে চলে যায়।।সুনেরা বাবার সাথে আলোচনা করছে।জুবায়ের কিছু কথা বলে তাকে বিয়ে সম্বন্ধে।সেই ঘটনা বাবাকে বলছে বড় মেয়ে।

তাহুরা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ব্যাগ হতে জমানো টাকা বের করে।উমাইরের জন্যে চারা কিনতে হবে।নাহলে দেখা যাবে আবারও দাঁতে দাঁত চেপে কথা শুনিয়েছে তাকে।আগেভাগে টাকা তুলে রাখে তাহুরা।আবার যদি খরচ হয়ে যায়! চারার টাকা অন্য পকেটে রাখে ব্যাগের।মনে আসে উমাইর বলেছিলো,মেসেজ দিতে।

সেই নির্দেশনা অনুযায়ী তাহুরা মোবাইল হাতে নেয় দ্রুত। উমাইরের দেওয়া মেসেজ দেখে সাথে সাথে,
–“এই যে,নামটা সুন্দর।আমি ছাড়া অন্য ছেলের সাথে যেনো মেসেজে বা ফোনে কথা না বলো।বুঝেছো?”

এমন আবদার!এমন উপদেশ!তাহুরার জীবনে উমাইর ব্যতীত কেউ বলেনি।এহেন উপদেশে টান খুঁজে পায় তাহুরা।অনুভব করে বুকের শীতল অনুভুতি। গালের জ্বলন।তার আবার হলো কি?
দুই অধর চেপে জোরে শ্বাস নেয় তাহুরা।আঁখিতে ভেসে উঠে উমাইরের হাসি,তার রাগী চক্ষুদ্বয়,তার সুঠাম স্বাস্থ্য। অনেক্ষণ ভেবে চিন্তে তাহুরা উমাইরকে মেসেজ পাঠাতে গেলে গ্রুপকল আসে।তাড়াহুড়োয় রিসিভ করে কল।

একে একে স্বাগতা,চৈতালি কথার ঝুড়ি খুললে তাহুরা মন দিয়ে সব শুনে উত্তর দেয়।পরক্ষণে বোনের বিয়ের সুসংবাদ দেয়,
–“আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। কার সাথে জানিস?”
–“ওহ মাগো।কবে বিয়ে?আমি উড়ায় নাচবো।”
চৈতালির হাসির সুর।

–“আমি তোদের বাসায় তিনদিন থাকবো, তাহু।”
স্বাগতা বিনা দ্বিধায় বলে।
অট্টহাসি শোনা যায় তাহুরার। বান্ধুবিদের সহিত ব্যাপক উল্লাস করবে সে।হাঁটু গুঁজে বসে সে বিছানায়।লম্বা কেশ স্থুপাকারে হেলিয়ে পড়ে বিছানায়,
–“অবশ্যই।আসল কথা শোন।উমাইর স্যারের ভাইয়ের সাথে বিয়ে হচ্ছে আপুর।আপন ভাই।”
জবাব শুনে দুই বান্ধবীর হুঁশ যায় যায় অবস্থা।চৈতালি গর্জে উঠে,
–“মাগো,কি কথা?স্যার?আমরা নাচবো কেমনে উনার সামনে?”
–“ধুর,লজ্জার কি? আমাকে বল আগে, অ্যারেঞ্জ নাকি লাভ ম্যারেজ?”
চৈতালি প্রশ্ন করে,
–“লাভ।এখনো বিয়ের তারিখ পড়েনি।দুইদিন পর পড়বে।স্যারের দিক স্যার থাকবে,আমরা আমাদের মতো থাকবো।”
তাহুরার সহজ জবাব।
–“হুম ঠিক ঠিক।খুব মজা হবে ভাই।”
চৈতালি বলে।
–“একদম।”
হাসিমাখা উত্তর দেয় তাহুরা।আরো কিছুক্ষণ আলাপ শেষে ফোন কাটে।
…………
তাহুরা বিছানায় শুয়ে পড়ে।মোবাইলের আলো জ্বলছে এখনো। উমাইর আরো দুইটা মেসেজ পাঠিয়েছে,
–“মেসেজ দেখেও উত্তর দাওনি কেনো?”
–“রিপ্লাই দাও।বাড়ি যাওয়ার আগে আমার মেজাজ খারাপ করেছো তুমি।”
মেসেজগুলো পড়ে নিস্তেজ হয় তাহুরার তনু।লোকটা এমন ছটফট করার কারণ কি?

উত্তর ভেবে মোবাইলের কিবোর্ডে আঙ্গুলের নৃত্য চলে তাহুরার।উমাইরের মেসেজের বিনিময়ে পাঠায়,
–“ফ্রেন্ড কল দিয়েছে।বাইরের কারো সাথে কথা বলি না আমি,স্যার।আপনার মেজাজ খারাপ করার জন্যে সরি।”

উত্তর পাঠিয়ে ভাবুক হয় তাহুরা।উমাইরের রাগ কমেছে কিনা জিজ্ঞাসা করবে কি?বেশি হয়ে যাবে আবার?
ভেবেচিন্তে একটি মেসেজ নিজ হতে পাঠায়,
–“আপনার রাগ কমেছে কি?”

ঘরের রিডিং রুমে ল্যাপটপে ইন্টারের প্রশ্ন সেট করছিলো উমাইর।অনবরত হোয়াটস অ্যাপ নোটিফিকেশন লক্ষ্য করে ল্যাপটপ বন্ধ করে।চেয়ারে হেলান দেয়।চোখ হতে রিডিং চশমা খুলে।অত্যধিক টাইপিংয়ের সময় মাথা ব্যথা এড়াতে রিডিং চশমা ব্যবহার করে সে।
তাহুরার মেসেজ দেখে শরীরটা যেনো হালকা হয় তার। বোকা মেয়েটা তার আয়ত্বে আসছে ধীরে ধীরে।অধরে তার তৃপ্তির হাসি।

আলগোছে সে তাহুরাকে মেসেজ পাঠায়,
–“স্যার মানে?তুমি এখন কলেজে?”

উমাইরের মেসেজের অপেক্ষায় ছিলো তাহুরা।এমন প্রশ্ন দেখে দাঁত দ্বারা জিভ কাটে সে।জবাবে পাঠায়,
–“সরি।আর বলবো না।”
–“গুড। চারা তোমাদের বাড়ি এলে সেদিন নিবো।কিনে রেখো।”
উমাইর ফের মেসেজ দেয়।
–“আচ্ছা।আমি এখন যায়।বাসায় কাজ আছে।আসসালামুয়ালাইকুম।”
তাড়াহুড়োয় তাহুরা মেসেজখানা পাঠিয়ে দৌড় দেয়।তার মা ডাকছে।বিছানার চাদর পরিবর্তনের দায়িত্বে ছিলো মেয়েটা।ভুলে গিয়েছিল হুট করে। মা ডাকলে হুঁশ হয়।
উমাইরের উত্তর পরে দেখবে সে।আগে মায়ের বকুনি হতে বাঁচতে হবে।

উমাইর আর জবাব দেয়নি।মনে মনে সালাম গ্রহণ করে।

মোবাইলের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করতে থাকা “স্টুপিড রূপসী” নামটাতে আঙ্গুল বুলায়।এই রূপসী ধীরে ধীরে নিজের বশে আনার উত্তেজনায় অশান্ত তার হৃদয়।তারপরও মনে সন্তুষ্টি।মেয়েটা তার আহ্বানে সাড়া দিতে আরম্ভ করেছে।
মোবাইল পকেটে ঢুকায় উমাইর। ঘাড়ের নিচে দুইহাতের তালু আড়াআড়িভাবে রাখে।স্মৃতিতে ভাসমান তাহুরার মুখশ্রীর ছুটাছুটি।ব্যাকুল মনে বলে,
–“বোকাপাখিটা আমার প্রতি সহজ হচ্ছে ধীরে ধীরে।পাখিটাকে আমার খাঁচায় বন্ধী করবো সারাজীবনের জন্যে।এই পাখিটা শুধু আমার মন পিঞ্জিরাতে আবদ্ধ হতে বাধ্য।”

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে