#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব-৫
________________
–“আপু তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে।চৈতালি আসছে।আমি একা যাবো না।কালকের পর থেকে একেবারেই না।”
তাহুরার চটপটে অনুরোধ বোনকে।স্থির নেই সে।রুমের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছটফটিয়ে হাঁটছে।
–“সমস্যা কি তোর?গতকাল ফিরলি ফোলা মুখ নিয়ে,তাও স্যারের গাড়ি করে এসেছিস ইমন ভাইদের অনেক আগে।আবার আজ বলছিস তোর সাথে যেতে। তোর কথার আগা মাথা কি?”
সুনেরা অকপটে ভঙ্গিতে বিছানায় বসে।শরীর খারাপ করছে বলে গতকাল ইমনদের আসার পূর্বে তাহুরা বাড়ি ফিরে।তাহুরার কলেজের স্যার বাড়ির নিচে নামিয়ে দেয় তাকে।ইমন অবশ্য ফোন করে জানিয়েছিল ব্যাপারটা।কলেজের স্যার,সাথে ঐ ক্লাবের মালিকদের মাঝে একজন হওয়ার সুবাদে সুনেরা সায় দেয় উমাইরের তাহুরাকে ড্রপ করার ঘটনাকে।ইমন কেবল কলেজের স্যার সম্বোধন করেছিলো, উমাইরের নাম উল্লেখ করেনি।
তবে,ফিরতি তাহুরার রক্তিম নাক,মুখ দেখে সুনেরা হাজার প্রশ্ন করলেও তাহুরা জবাব দেয়,
–“ঐখানে বিরক্ত লাগছিলো তাই কান্না চলে আসে হঠাৎ।”
নিজের বোন সম্পর্কে অবগত সুনেরা।তাই ঘটনা আর ঘাটলো না।কিন্তু,এখন ঘটনা সন্দেহজনক।
তাহুরা নিরুত্তর।কেমন ভাবলেশহীন।সুনেরার ভ্রু কুঁচকে আসে।সে তাহুরাকে সজোরে বলে,
–“ঐ,ঘটনা কি সাফসাফ বল।”
নিরুত্তর তাহুরা ভাবুক হয়।মনটায় ব্যাকুলতা ঘিরে ধরে। ইমনদের খেলা শেষ হতে অনেক সময়ের দরকার হলে উমাইর নিজে প্রস্তাব দেয় ইমনকে সে তাহুরাকে বাড়িতে নামিয়ে দিবে।ঠিকানা নিয়ে সেই কাজ করে উমাইর।তাহুরা উমাইরকে সালাম দিয়ে নামলে গাড়ি থেকে,উমাইর গম্ভীর কণ্ঠে তাকে বলে উঠে,
–“বড় বোন ছাড়া কোথাও গেলে,খুব খারাপ রূপটা দেখবে আমার।যা যা বলেছি অফিস রুমে সব কথা শুনবে।আর শুধু আমার কথা মেনে চলবে,অন্য কারো কথায় কোনো কাজ করার দরকার নেই।”
তাহুরা কেবল মাথা নাড়ে।দৌড় দিয়ে গেইটে প্রবেশ করে।
উমাইর স্যারের সেই করুণ ধমকের কথা সুনেরাকে বলা অসম্ভব।অতঃপর তাহুরা মলিন মুখে বলে,
–“কাল একা একা আমি ভয় পেয়েছি অনেক।তুমি চলো না আপু।কোনো বাড়তি কাহিনী নেই।আমার তোমাকে ছাড়া যেতে ইচ্ছে করছে না।”
বোনের হাত ধরে অনুরোধ করে তাহুরা।
–“ভীতুর ডিম একটা।যা রেডি হো।আমি যাচ্ছি তোর সাথে।”
মুহূর্তেই সকল বিষাদ উবে যায় তাহুরার।হাস্যোজ্জ্বল চিলিকে মেয়েটার মুখ জ্বলজ্বল।তাহুরা নেচে উঠে আলগোছে।বোনের গালে ঠোঁট ছোঁয়ায়,
–“পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো বোন তুমি।”
সুনেরা হাসে।বোনের মাথায় হাত বুলায়।
খয়েরী রঙের লং-কামিজে নিজেকে আবৃত করে তাহুরা।কয়েক গোছা চুল কপালের সামনে মুক্ত করে বাকি চুলে খোঁপা বাঁধে।ওড়না বুকের উপর সমান্তরালে ছড়িয়ে বোনের সাথে বেরোয় তাহুরা।তাদের মাঝে যোগ দেয় আয়মা,শায়ন।
যেহুতু ইমনদের বাড়ি রক্ষণশীল এলাকায় আর অনেকটা উঁচু রাস্তা,তাই প্রাইভেট কার ব্যতীত তেমন একটা যানবাহন প্রবেশ করে না। রিক্সা মেলাও বড় দায় এই এলাকায়।
বিকালের শেষভাগ প্রায়। গগণের আলো হালকা গোলাপী আবার কমলা। ছটাক ছড়াচ্ছে ধরণীতে।চারিদিকের বিল্ডিং বেশ শান্ত এই আলোয়।তাহুরার হাত ধরে শায়ন।এদিক সেদিন ইঙ্গিত দিয়ে এটা সেটা বুঝাচ্ছে সে তাহুরাকে।তাহুরা মিষ্টি হেসে শায়নের কথা বুঝে নিচ্ছে আলগোছে।
চৈতালি দাঁড়িয়ে মোড়ে।মিনিট দুই হাঁটলে তারা মোড়ে পৌঁছে।চৈতালি এগিয়ে আসে জড়িয়ে ধরে তাহুরাকে,
–“দেখা মিললো তোর।সুনেরা আপু কেমন আছো?”
–“এইতো ভালো।তোমার অবস্থা কি?”
সুনেরা প্রশ্ন করে।
–“ভালো।আর আজকে মহা ভালো।তোমার বোনকে দেখেছি অনেক অনেক দিন পর।”
চৈতালি বেশ হাসিখুশি।
–“হয়েছে ভাই। কোথায় যাবি বল?”
তাহুরা হেসে জিজ্ঞাসা করে।
–“রাস্তার ঐপারে চল।খুলশী মার্ট যাবো।”
চৈতালি বলে।
–“আচ্ছা।”
সুনেরা শায়ন এবং আয়মাকে নিয়ে রাস্তা পার হয়। চৈতালির হাত ধরে রাস্তা অতিক্রম করে তাহুরা।
সুনেরা বাকি দুইজনকে নিয়ে আগে হাঁটছে।তাহুরা চৈতালির সাথে।খানিক বাদে চৈতালি তার মুখ এগিয়ে নেয় তাহুরার কান বরাবর।ফিসফিস করে,
–“তুই জানিস,আর দুই গলির পর উমাইর স্যারের বাসা।উনাকে কতদিন দেখিনি।আজ যদি উনার দেখা পায়, সোনায় সোহাগা হবে।এতক্ষণে উনি নিশ্চয় কলেজে নেই।”
ধ্বক করে উঠে তাহুরার বুকখানা। কাল সেসকল হুমকি ধমকি শুনে মেয়েটার অন্তর খানখান।আজ আর সেই মানবের দেখা চায় না তাহুরা। চৈতালিকে নিজ হতে দূরে সরায় সে। নাক কুঁচকে বলে,
–“উফ,উমাইর স্যার তোদের মাথা কিনে নিয়েছে।যখন তখন এই স্যারের নাম নিবি না।”
–“এমা,হলো কি তোর?উমাইর স্যারের চার্ম এখনো তোর নজরে আসেনি।যেদিন আসবে সেদিন তুই চেয়েও উনার কথা না ভেবে পারবি না। ইস,একটা বার যদি দেখা পেতাম উনার!উমাইর স্যারের ঘরের দুয়ারে আছি আল্লাহ্,একবার উনার সুদর্শন মুখখানা দেখতে চাই।”
চৈতালি দোয়া করে সুর তুলে।
খুলশী টাউনে প্রবেশ করেছে তারা।চৈতালির মিনমিন দোয়া এখনো শ্রবমান তাহুরার কর্ণ গহীনে। তাহুরা ভেবে পায় না,এমন দোয়া করার কি দরকার! ভাগ্যে থাকলে এইভাবেই দেখা হবে।যেমনটা কাল তার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে উমাইর স্যারের।কই তাহুরা তো দোয়া করেনি একদন্ড!তাও দেখা হয়েছে। সেদিকে আর ভাবেনি তাহুরা।
সুন্দর সুন্দর জিনিসের দিকে তার নজর ছুটে। নিচ তলায় কিছু সময় ঘুরে তারা টপ ফ্লোরে যায় ফুড কার্টে।নাম করা এক দোকানেও বসে।অর্ডার করে খাবার।সেখানে পিজ্জা দেখে তাহুরার গতদিনের স্মৃতি ভেসে উঠে মস্তিষ্কে। তার জন্যে উমাইরের বলা যত্নদায়ক কথা আবার উপদেশ আবার হুমকি সবটা ভাসমান স্মৃতিতে। কেনো যেনো উমাইরের ধমক বা হুমকি থেকেও তার যত্নের কথাটা মাথাচাড়া দিচ্ছে।
সাথে এও মনে পড়ে,গতকাল উমাইর তাহুরার সম্মুখে রাখা পিজ্জার প্যাকেট হতে পিজ্জা নেওয়ার সময় দুজনের হাতের সাইজ পরখ করে তাহুরা।উমাইরের হাতের উপরিভাগে রগ ভাসমান। আঙ্গুলগুলো বেশ লম্বা আবার সুন্দর।পরিপাটি হাত।
পরক্ষণে তাহুরা বাস্তবতায় ফিরে।কি ভাবছে সে! দ্রুত টেবিলে বিদ্যমান কোকের গ্লাসে চুমুক দেয়।মনে মনে আওড়ায়,
–“তওবা তওবা।কি ভাবছি আমি?”
খাকিক্ষণ ঘুরে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরোয় সকলে।না চাওয়া সত্বেও তাহুরার দৃষ্টি এদিক সেদিক হেলা ফেলা করে।একজনকে খুঁজে।তাকে খুঁজতে ভয় অনুভব করলেও,মন মানছে না আজ।হঠাৎ,বোনের দিকে দৃষ্টি থামে তাহুরার।সুনেরা গোপনে সেই এলাকার ছবি তুলছে।অনেকটা আড়ালে। যার কারণে তাহুরা বোনকে জিজ্ঞাসা করেনি কিছু।
দুইদিন কেটে যায় তাহুরাদের। হাসিখুশিতে ভালো ছিলো দিন।তবে বিপত্তি ঘটে সুনেরার।মেয়েটার মুখে আঁধার। ইমনের বন্ধু প্রস্তাব দেয় সুনেরার জন্যে।ছেলেটা নাছোড়বান্দা।আজ বিকালে পরিবার নিয়ে আসবে জানিয়েছে।তাহুরার বাবা মা দুপুরে আসবে। ভোর ছয়টা মাত্র।গত রাতে কথা ফাইনাল হয়।সুনেরা দিগ্বিদিকহীন।সহজে কান্না না করা মেয়েটা কেঁদে অস্থির।তার ফোঁপানোর শব্দে তন্দ্রা ছুটে তাহুরার।বোনকে কাঁদতে দেখে বুকটা ধরফর করে তার। এইভাবেও গতরাত থেকে বোনের মুখে অমাবস্যা নজর এড়ায়নি তাহুরার।
পেছন থেকে জড়িয়ে নেয় সে বোনকে,
–“আপু চলো বাড়ি যায়।তুমি বাসায় বলো ভাইয়ার কথা।”
–“ও আসছে আজ রাতে।জুবায়ের ছাড়া কারো সামনে যাবো না আমি।”
সুনেরা ফোঁপায়।অন্তর জ্বলে তাহুরার।তার শক্ত মনের বোনের কান্না আহত করছে তাহুরার হৃদয়কে।বোনকে ছেড়ে তাহুরা ঝটপট উঠে,
–“বাসায় যাবো।চলো।”
সুনেরা ফ্যালফ্যাল নজরে বোনকে দেখে।অতঃপর সেও মেনে নেয়।তাড়াহুড়োয় ব্যাগ গুছিয়ে নানু থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বেরোয় ছয়টা ত্রিশে।এতো ভোরে ঘরের কেউ উঠেনি।নানুকে বলেছে তাহুরা বাড়ির জন্যে মন খারাপ করছে,থাকতে চাইছে না। এতো ভোর বেলা দুই নাতনীকে যেতে দিতে মন সায় দিচ্ছিলো না বৃদ্ধার।কিন্তু,তাহুরার নিকট হেরে যায় নানু।বৃদ্ধা এই ভোর বেলায় বিছানা ছেড়ে কাউকে ডাকার শক্তি পেলো না।
রাস্তায় মানুষের আনাগোনা স্বাভাবিকের ন্যায়।এলাকা জুড়ে জোয়ান,বুড়ো।কেউ দৌড়াচ্ছে বা কেউ দ্রুত হাঁটছে।কেউ কেউ দলবদ্ধ ব্যায়াম করছে। মানুষজনের উপস্থিতিতে মনে প্রশান্তি পায় দুবোন।
সিএনজি পেয়ে যায় তারা সহজে।ব্যাগ উঠিয়ে সুনেরা বসে সিএনজিতে।তাহুরা উঠতে গেলে তার দৃষ্টি আটকে যায় খানিকটা দূরে দাঁড়ানো উমাইরের পানে।ট্রাউজার,টিশার্ট পড়নে।কপালে চুলের ছড়াছড়ি।দৌড়িয়ে হাপাচ্ছেন কি?উমাইর অদ্ভুত নজরে চেয়ে আছে তাহুরার অবয়বে।উমাইর তার নিকট আসছে অনুভব করলে দ্রুত সিএনজিতে বসে তাহুরা।
সিএনজি চলতে আরম্ভ করে।তাহুরার উত্তেজিত হৃদয়ের শব্দ স্পষ্ট।ভয় সাথে ভালো লাগা।যাওয়ার পূর্বে উমাইরকে দেখতে পাবে এমনটা সে কস্মিনকালে ভাবেনি। তাহুরা আঁখি বুঁজে।বোনের কাঁধে মাথা রাখে।নয়নে পরিষ্কার উমাইরের প্রতিচ্ছবি।পরক্ষণে সেই দৃশ্য ভুলতে জোর পূর্বক পলক ঝাপটায় মেয়েটা।
_____________
–“এতো বড় সাহস?সাত সকালে বাসায় একা আসার সাহস কে দিলো?কারণ কি?”
মুন্সী মিয়া ক্রোধে উন্মত্ত। সুনেরার মাথা নিচু।কান্না করছে না সে।তাহুরা ছলছল নয়নে একবার বাবাকে দেখছে তো আবার বোনকে দেখছে।মা তেড়ে আসতে নিলে সুনেরা বলে,
–“আমার পছন্দ আছে।আমি ইমন ভাইয়ার ফ্রেন্ডের সামনে যাবো না।”
–“এতো ভালো সম্বন্ধ ফেলে তুই এইখানে ছুটেছিস?সাহস দেখছি অনেক তোর।”
মা চেঁচিয়ে উঠে।
মুন্সী মিয়া মাথায় হাত চেপে সোফায় বসে।বাবার পায়ের ধারে বসে সুনেরা।হাঁটুতে হাত রেখে শুধায়,
–“তাদের পরিবার অনেক ধনী।সেও ভালো ছেলে।ভালো সেটেল।আমেরিকায় থাকে।আজ আসবে।”
–“ধনী মানে,অধিক ধনী হলে আমরা কিভাবে সামলাবো?আমরা মধ্যবিত্ত ভুলেছিস তুই?”
হুংকার ছাড়ে মুন্সী মিয়া।
–“বাবা,দেখবে আপুর পছন্দের তুলনা হবে না কোনো।সবাই ভালো হবে,দেখো তুমি।”
বাবাকে শান্ত করার চেষ্টায় তাহুরা।
–“পরশু যেনো এই বাড়িতে আসে তারা। সেদিন না এলে আর কোনোদিন আসতে পারবে না।মেয়ের পড়ালেখা শেষ।মেয়েকে তাদের জন্যে বসিয়ে তো রাখবো না।”
শেষ বাক্য বিনিময়ে দাঁড়ায় মুন্সী।বউকে নির্দেশ দেয়,
–“তোমার ভাইকে কিছু একটা বলে ইমনকে ঐ প্রস্তাবটা সামলে নিতে অনুরোধ করবে।ভুলেও যেনো আমার মেয়ের পছন্দের কথা কিছু না বলো।পরশু যদি মেহমান আসে তবে তোমার পরিবারকে দাওয়াত করবে।”
–“নাস্তা খেয়ে যাও।”
শিউলি বলে।
–“ইচ্ছে নেই।খোকাকে পাঠাবো দুপুরে। ঐ ছেলের ঠিকানা দিবে খোকাকে।গেলাম।”
পাঞ্জাবি পরিহিত মুন্সী হেঁটে যাচ্ছে।সুনেরা শক্ত কাঠ।মেয়েটা অনুভূতিহীন।তাহুরা মায়ের দিকে তাকালে,মা হুংকার ছাড়ে,
–“দুইবোন নাস্তা গিলবি নাহলে এই বয়সে আমার মাইর পড়বে তোদের।”
শিউলি দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে।
সুনেরার ক্লান্ত মুখশ্রী অবলোকন করে তাহুরা বোনকে উঠায় মেঝে হতে।এক হাত জড়িয়ে আশ্বাস দেয়,
–“চিন্তা করো না আপু,সব ঠিক হবে।আল্লাহ্ আছেন।”
————————
এয়ারপোর্টে ভিড় করেছে উমাইর সাথে তার পরিবারবর্গ।জুবায়ের দেশে নেমে নিজের বাংলাদেশী সিম চালু করে।অপেক্ষারত পরিবারকে জানায় আর পাঁচ মিনিটের মাঝে বাহিরে আসছে সে।উৎসুক সকল তার দেখা পায় ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায়।মেঘলা বেগম ছেলেকে জড়িয়ে সে কি কান্না! শর্তও দিয়েছে রীতিমত,ছেলে আর বিদেশ ফিরতে পারবে না।
উমাইর ভাইয়ের সাথে আলিঙ্গন করে।কাছের রেস্টুরেন্টে ফ্যামিলি ডিনার সেরে যার যার গাড়িতে উঠে সকলে।উমাইর,জুবায়ের এবং নিবরাস একসাথে যাচ্ছে উমাইরের প্রাইভেট কারে।
জুবায়ের এর ফোন মেসেজের টুংটাং শব্দ বাকি দুইজনও শুনছে।একেরপর এক মেসেজের বৃষ্টি যেনো।মাঝে মাঝে ফোন কানে লাগায় জুবায়ের তবে অপরপক্ষ ফোন ধরছে না।
বিরক্ত হয় উমাইর।এক সময় প্রশ্ন করে,
–“পাত্তা না পেলে ইগনোর করো।এমন ডেসপারেট হচ্ছো কেনো?”
–“ভাই,কেলেঙ্কারি হয়েছে।”
জুবায়েরের আহত কণ্ঠ।
–“ডিটেইলস বলো বড় ভাই।”
নিবরাস বলে।
–“তোকে আমি বলেছিলাম উমাইর আমার পছন্দের মেয়ে আছে।তাকে অন্য পরিবার দেখতে আসতে চাচ্ছিলো তাই সে বাসায় জানায় আমার কথা।তার নাক উঁচু বাপ বলে,পরশু যেনো স-পরিবার যায় সেই বাড়িতে।নাহলে….”
–“বাড়িতে গিয়ে মাকে জানাও।”
উমাইর ভাইকে কথা শেষ করতে না দিয়ে পরামর্শ দেয়।
–“তুই বলিস।আমি এইভাবে বললে..”
–“বিয়ে করবে তুমি,আমি কেনো বলবো?ভালোবাসার মানুষকে পেতে হলে একটু নির্লজ্জ হতে হয়।”
গাড়ির স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে জবাব দেয় উমাইর।
ঘড়িতে রাত আড়াইটা।চিন্তিত জুবায়ের মিটিং বসিয়েছে বাসায় আসা মাত্রই।তার মা চেয়ারে বসলে সাথে সাথে সে মুখ খুলে,
–“আমি বিয়ে করবো।মেয়ে পছন্দ আছে।চকবাজার বাসা।পরশু দেখতে যেতে হবে।নাহলে বিপদ।”
ছেলে মাত্র বিদেশ থেকে এসে বিয়ের কথা বলবে বলে ভাবেনি কেউ। উমাইরের বাবা জয় হুংকার ছাড়ে,
–“কি যা তা বলছো?”
–“ভাই বিয়ে করবে বলছে।বিয়ে মোটেও যা তা নয়।”
উমাইর জবাব দেয় বাবাকে।সকলে বসলেও সে পিলারে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে।বাবার চোখে চোখ পড়লে সেট করা চুলের পাশে হাত বুলায় সে।এর মানে,বাবার কথা সে তোয়াক্কা করে না।শিক্ষক মানুষ হলেও,উমাইর বাবা মায়ের আদরের জিদওয়ালা ছোট সন্তান।
–“উমাইর ঠিক বলেছে।বিয়ে করবে আমার বড় ছেলে,এরচেয়ে খুশির সংবাদ আর কি বা আছে? যাবো আমরা।বিয়ে ফাইনাল করে ফিরবো।”
মেঘলা বেগম বেজায় খুশি।
–“মেয়ের বাবা কি করে?আমাদের স্ট্যান্ডার্ড এর সাথে ম্যাচ করে কি?”
জয় আবার প্রশ্ন করে।
–“চকবাজারে মুদি দোকান আছে সুনেরার বাবার।নাম মুন্সী মিয়া।”
জুবায়ের উত্তর দেয়।এই উত্তর উমাইর,তার মা,চাচী,নিবরাস ছাড়া আর কারো পছন্দ হয়নি।চাচা আলম নাক সিটকায়,
–“ওহ মাই গড! মিডেল ক্লাস ফ্যামিলি।যায় আমাদের সাথে?”
–“সংসার ওরা দুইজন করবে।আমরা না চাচা।তাই যায় নাকি যায় না এটা ভাই আর ওর পছন্দের মেয়েটা বুঝে নিক।আপনি বা বাবা চিন্তা করবেন না।”
উমাইর সোফায় বসে।তার বিপরীতে আফিয়া।উমাইর তাকে উপেক্ষা করে।অতএব উমাইর ডান পাশে চেয়ে।দৃষ্টি সেদিক হতে কিঞ্চিৎ নড়ছে না।
মেয়ের পরিচয় শুনে নিবরাস হিসাব কষতে ব্যস্ত।হিসাব মিললে খুশি হয় ব্যাপক।চাচীর নিকট গিয়ে জড়িয়ে ধরে,
–“তুমি শুনে খুশি হবে তোমার ছেলের বউ মারাত্মক হতে চলেছে।যেমন সুন্দর তেমন ভালো মেয়ে।পরিবার ভালো।উনার ছোটবোন আমার ক্লাসমেট।দুইবোন যেনো রত্ন।আমাদের স্নেহে কোনো কমতি রাখবে না।”
উমাইরের আঁখি জোড়া চকচক।চকবাজার এবং মুন্সী মিয়ার নাম শুনে তার প্রথমে খেয়াল আসে তাহুরার বাড়ির কথা।এইদিকে আবার নামেরও মিল তার ভাইয়ের পছন্দের মেয়ের সমেত।এখন নিবরাসের কথা শুনে অন্তরে কেমন ঠাণ্ডা অনুভব করছে।সকালে তাহুরাকে দেখেছে উমাইর।অস্থিরতায় নিমজ্জিত ছিল মেয়েটা। উমাইরকে দেখেই কেমন পালালো।কিন্তু এখন?উমাইর আর পালাতে দিবে কি মেয়েটাকে?জীবনেও না।এমন মোক্ষম সুযোগ আসছে তাদের জীবনে ভাবেনি উমাইর।মেয়েটার সাথে তার সম্পর্ক যে বদলাবে।সেই সম্পর্ক থেকে সবচেয়ে পবিত্র সম্পর্ক বানাবে সে।অধর জোড়া প্রসারিত হয় উমাইরের।
মেঘলা বেগম বড় ছেলের পানে ইশারা করে উত্তর নিয়ে ছোট ছেলের পানে নজর দেয়।সে অবাক হয়।তার গম্ভীর ছেলেটা মুচকি হাসছে।
ভাইয়ের বিয়েতে উমাইর খুব বেশি খুশি কি?
আচমকা মায়ের দিকে দৃষ্টি মেললে উমাইর দেখতে পায়,তার মা চেয়ে আছে।মাকে ইশারায় “হ্যাঁ” জানালে ভদ্র মহিলা জামাইকে উদ্দেশ্য করে আওড়ায়,
–“ওগো তুমি শুনেছো তো?আমাদের নিবরাস চিনে ওদের পরিবারকে।এরচেয়ে বড় বিষয় আমার ছেলে পছন্দ করে মেয়েটাকে।আমরা সবাই সেই বাড়িতে যাবো পরশু।এটাই শেষ সিদ্ধান্ত আমার।”
উমাইরের বাবা,চাচা আর কিছু বলেনি।সদা তারা পরিবারের খুশি চেয়েছে।পরিবার খুশি তো,তাদের নারাজির কিছু নেই।মন ভার করে তারা নিজ কামরায় ফিরে।তাদের দেখাদেখি বাকিরাও নিজেদের রুমে যায়।
উমাইর নিজ কক্ষের দরজা বন্ধ করে।গায়ের গাঢ় নীল রঙের শার্ট খুলে।অধরে এখনো তার স্মিত হাসি বিদ্যমান।সময়ের তালে সে হাসি প্রগাঢ় হয়।ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে উমাইর।দুইহাতে চুলের গোছা পেছন সরিয়ে সশব্দে বলে উঠে,
–“এখন কই পালাবে তুমি বোকাপাখি?আল্লাহ্ আমার পথ সুন্দর করে বানিয়ে দিলো।আমার ভয়,ভীতি,
যত্ন,ভালোবাসা সবটা দিয়ে আগলে নেওয়ার সময় এসে পড়েছে তাহু।ভালোবাসতে তুমি আমার থেকে শিখবে।এর পূর্বে তোমাকে একটু ভয় দেখায় কেমন!”
প্যান্টের পকেট হতে মোবাইল নিয়ে সেথায় তাহুরার ছবিতে গভীর মনযোগ দেয় উমাইর।মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে থাকা হাসিমাখা তাহুরার ছবিতে অধর ছোঁয়ায়।মোবাইল বক্ষদেশে রাখে।আলগোছে সে ফের বলে,
–“খুব বেশি না সামান্য কান্না করাবো তোমায়।বিশ্বাস করো তাহু,আমি হয়তো প্রথম প্রেমিক হবো যে তার প্রিয়তমার কান্নার প্রেমে পড়ে শতবার।তোমাকে যতবার কান্না করাবো,ততবার সেই কান্না আমি যত্ন দিয়ে পুষিয়ে দিবো।”
পরপর সে মোবাইল উঠায় বক্ষঃস্থল হতে।তাহুরার ছবিতে আঙ্গুল বুলায়,
–“তোমার সহজ সরলতায় আমায় মুগ্ধ করেছে,প্রাণ।এই সহজ সরল, বোকা স্নেহময় মেয়েটা শুধু আমার, উমাইরের।তোমার সব দায়িত্ব আমি একা নিলাম,তোমাকে না জানিয়ে।ভালোবাসি খুব।”
চলবে……..
#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব- ৬
_______________
–“তাহুরা তোর বোনের সম্পর্কের কথা তুই জানতি?তারা অনেক ধনী।আমাদের ধারার বাহিরে।”
কেমন আফসোসের সুর মুন্সী মিয়ার।সুনেরার পছন্দের ছেলেটা ভালো চরিত্রের,তার কলেজ- ভার্সিটিতে গিয়েও খোঁজ নেয় বাবা।সবদিকে ছেলেটা যথেষ্ট উত্তম।তবে,পারিবারিক দিক দিয়ে তেমন সন্তুষ্ট নেই মুন্সী।ছেলের পরিবার উচ্চবিত্ত।নিজেরা ঠিক কতোটা দিয়ে খুশি করতে পারবেন ছেলের পরিবারকে এই নিয়ে যতো দ্বিধা তার।মেয়ের বিয়েতে নিজের সাধ্যমতো খরচ করবে সে,এক টাকাও ধার নেওয়ার নিয়ত নেই।
তাহুরা বাবার প্রশ্নে তাজ্জব বনে। মিথ্যে সে বলতে পারে না।শুরু থেকে না জানলেও বোনের গোপন প্রেমের সম্পর্কে সবটা জানে। তবে,পারিবারিক কোনো সূত্র জানেনি তাহুরা কখনো।আলগোছে সে বাবাকে বলে,
–“জানতাম বাবা।”
–“ছেলেটা অনেক বড় ঘরের।তোর মনে হয় না আমাদের সাথে ওরা যায় না!”
মুন্সীর দীর্ঘশ্বাস।
–“এটা জানতাম না বাবা।যেখানে ওরা দুজন দুজনকে পছন্দ করে,সেখানে পারিবারিক দূরত্ব দিয়ে কি হবে বাবা?ধরো আমাদের পরিবারের সাথে মিল রেখে তুমি জোর করে আপুকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়েছো,
সেখানে আপুই অসুখী হবে। কাল উনারা আসুক,দেখবে সব ঠিক।”
তাহুরা হাসার চেষ্টায়।
বাবাকে কোনোভাবে রাজি করাটা যেনো বড় কাজ এখন।বাবা মেয়ে দুজনে পুকুরঘাটে বসে।মুন্সী মিয়া মেয়ের কথা মনোযোগ সহকারে শুনে।কথাগুলো আমলে নেওয়ার মতো।ঠিকই,মেয়ের অমতে বিয়ে দিলে সারাজীবন কষ্ট তার মেয়ে পাবে।বাবাকে শত্রু ভাববে।
আকাশের পানে দৃষ্টি দেয় মুন্সী।খুব করে দোয়া করে আল্লাহ্ এর নিকট,কাল সবটা যেনো ঠিক হয়।দুই পরিবারের মাঝে একটা মিল বন্ধন হোক।
–“দেখা যাক, মা।সুনেরা খুশি থাকলে আমি খুশি।”
–“ভেতরে চলো বাবা।রান্নার আয়োজনে কম রাখা যাবে না।মা আর আমি লিস্ট বানাবো।চলো।”
বাবার হাত ধরে উঠে পড়ে তাহুরা।মুন্সীর আঁখিতে জল আসলেও চেপে যায় সে।মেয়ের হাত আকড়ে হাঁটতে শুরু করে।তাহুরাদের সেমি পাকা ঘরটা ব্যাপক পরিপাটি।সেই পরিপাটির উপর আরো কিছু নতুন ফুলদানি, নতুন সোফা কভার,নতুন টেবিল শিট দিয়ে সাজায় শিউলি। কাল এতসব কাজের মাঝে এই কাজগুলো আগে সামলানো দরকার।
মুন্সী মিয়া খানিক ইতস্তত।এই প্রস্তাবে মত না দিলেও এখন নিজের সবটা উজাড় করতে চায় বড় মেয়ের খুশির জন্যে। বাজারের লিস্টের কথা বলতে গেলেও জড়তায় তার গলা জড়িয়ে আসে। তাহুরা বাবার অবস্থা বুঝে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সে মুখ খুলে। অযথা সোফা কভার ঠিক করার বাহানায় মাকে বলে,
–“মা,বাজারের লিস্ট করবো। কাল রান্না বান্না অনেক।আজ থেকে কিছুটা কাজ এগিয়ে নেওয়া যাক।”
মুন্সী মিয়া মেয়ের পানে চায়।তার সহজ সরল মেয়েটা বড্ড আবেগী।বাবার দ্বিধা বুঝে নিলো কতো সহজে!
শিউলি ঘর মুছতে ব্যস্ত।মেয়ের কথা তার ঠিক মনে হয়।দ্রুত উঠে সে।ডাইনিং রুমের চেয়ারে বসে,
–“খাতা,কলম নিয়ে আয় জলদি।”
–“আনছি।মা তুমি বাবাকে বলো কি কি রান্না করতে চাও কালকের জন্যে।”
তাহুরা হেসে নিজ কামরায় ফিরে। খাতা-কলম খুঁজে নেয়। সুনেরা জুবায়েরের সাথে ফোনে কথা বলছিলো।তাহুরাকে দেখে ফোন কাটে।তাহুরার হাসিখুশি মুখশ্রী সুনেরার আতঙ্ক কাটতে সাহায্য করে।সে সহসা বোনকে প্রশ্ন করে,
–“বাবা মত দিচ্ছে?”
–“না দিয়ে যাবে কই?”
অধর প্রসারিত হয় তাহুরার।টেবিলে পরিপাটি খাতার ভাঁজ হতে খাতা নেয় সে।হাত উঁচিয়ে বোনকে দেখায়,
–“বাজারের লিস্ট করছি।ভাইয়ার পছন্দের খাবার কি?”
–“গরুর কালাভুনা।বেশি পছন্দ ওর।তুই করিস এটা রান্না।তোর হাতেরটা ভালো হয়।”
নিসংকোচ আবেদন বোনের।তাহুরার অন্তরে আনন্দের জোয়ার।যাক অবশেষে পরিবারের সবাই নিজেদের মতামত প্রকাশ করছে।কালকের দিনটা খুব ভালো কাটুক,তাহুরার অন্তঃস্থলের দোয়া।
–“আমি ছাড়া আর কে করবে?করবো আপু।চিন্তা করো না।”
খাতা,কলম বুকে জড়িয়ে তাহুরা আনন্দের সহিত বাবা মায়ের নিকট যায়।তার বাবা-মা বাজার নিয়ে আলোচনা করছে।বাবাও জড়তা ছেড়ে মায়ের সাথে আলাপে মগ্ন।তাহুরা ধীরে এগিয়ে যায় সেইদিকে।খাতা রাখে টেবিলে,
–“আলোচনা শেষ?লিস্ট বলো।লেখি।”
–“আমি লেখছি।তুই গিয়ে গরুর মাংস বের কর ফ্রিজ থেকে।মাংস আছে পর্যাপ্ত।”
শিউলি বলে।
–“যাই তবে।”
হাস্যোজ্বল তাহুরা গলা হতে ওড়না সরায়। বুক,কোমরে ওড়না বাঁধে।ঝুঁকে ফ্রিজ খুলে।মাংসের পোটলায় বরফ জমে।শক্ত পোটলা টেনে হিঁচড়ে বের করে পানিতে ভেজায়। দুচোখে তার স্বপ্ন।বোনকে সুখের রাজ্যের রাণী হতে দেখার স্বপ্ন।
——
সকালে বেরিয়ে যায় উমাইর।একেবারে পরিপাটি সে।কালো ডোরাকাটা দাগের শুভ্র রঙের শার্টে আবৃত তার সুঠাম তনু। দুপুর দুইটায় তার কলেজের কাজ শেষ হবে।অন্যরা সবাই একটার দিকে তাহুরাদের বাড়িতে পৌঁছাবে জানালে,উমাইর জানায় তার পৌঁছাতে তিনটা কি চারটা বাজবে।রাস্তাঘাটে জ্যামের বিশ্বাস নেই।
ঝরঝরে মেজাজে পুরোটা সময় পার করলেও তার মেজাজ বিগড়ে যায় শেষ ক্লাসে। অযথা কথা বলায় এক ছেলেকে শাসন করে উমাইর।সে ছেলে নিজ পরিবারের দাপট দেখিয়ে বুক ফুলিয়ে তর্ক করে তার সাথে।এটাই ছিলো ছেলেটার ভুল। উমাইর গর্জে উঠে। একদফা চিৎকারে তার সকল রাগের সমাপ্তি হয়নি।ছেলেটার অভিভাবককে আসতে বাধ্য করলো।সেই ছেলের অভিভাবকের সাথে কথা বলে এবং ছেলেটির উচিত বিচার করে শান্ত হয় উমাইর।তারপরও মেজাজের খুঁতখুঁত ভাব কমেনি।
ইন করা অবস্থা হতে শার্টকে সাধারণ অবস্থায় ফেরায়।মোবাইল ফোন অনবরত বাজলে,তখন ধরেনি।
এইবার মোবাইল বেজে উঠলে উমাইর ফোন তুলে।ঝাঁঝালো কণ্ঠে নিবরাসকে বলে উঠে,
–“এতো ফোন দিচ্ছো কেনো?কলেজে আছি জানো না?”
–“তোমার কাজ শেষ হয়নি এখনো?”
নিবরাস প্রশ্ন করে।
–“শেষ।কি হয়েছে?”
উল্টো প্রশ্ন করে উমাইর।
–“আমরা সবাই বাসায়।তোমার অপেক্ষায়।জুবায়ের ভাইয়া তোমাকে ছাড়া যাচ্ছে না।”
নিবরাস ভনিতা ছাড়া উত্তর দেয়।
–“কেনো?ভাইয়া কি ছোট?দুপুরের কথা বলে এখনো যায়নি কেনো?ওরা আমাদের অপেক্ষা করছে না?ভাইয়ের এতো নাটক করতে হয় কেনো?”
উমাইর ব্যাগ হাতে অফিস হতে বেরোয়।
–“এমন চিল্লাচ্ছিস কেনো উমাইর?বাসায় আয় জলদি।”
জুবায়ের বলে।
–“স্পিকারে রেখে তামাশা করছো সবাই?”
রাগান্বিত স্বর উমাইরের।
–“তামাশার কি?এমন করছিস কেনো?”
জুবায়ের বিরক্ত।
–“রাখো ফোন।আসছি।কথা দিয়ে ভনিতা করো।আজব।”
উমাইর ফোন কাটে।গাড়িতে উঠে ঘড়ি দেখে চারটা বাজতে আঠারো মিনিট বাকি।বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে আসে।গাড়ি স্টার্ট দেয়।গন্তব্য তার বাড়ি।
মিনিট পনেরো বাদে বাড়ি ফিরলে উমাইর অবাক হয়।সকলের তৈরি কিন্তু যায়নি কেনো? উমাইরের গাড়ি দেখলে সকলে নিজেদের গাড়িতে উঠে যায় দ্রুত।উমাইরের গাড়িতে বসে জুবায়ের,নিবরাস এবং আফিয়া।
আফিয়ার কান্ডে দাঁতে দাঁত চাপে উমাইর।চোখ বুঁজে লম্বা শ্বাস নেয়।সব বিরক্ত আজ একসাথে প্রকাশিত হচ্ছে যেনো।অথচ উমাইর কতোটা উত্তেজিত ছিল আজকের দিনের জন্যে ব্যাপারটা কেবল তার জানা।
চলন্ত গাড়িতে উমাইর মস্তিষ্ক সচল রাখার চেষ্টায়।তার বোকাকে বিরাট সারপ্রাইজ দেওয়ার প্রত্যাশায় মনটা শীতল হয়।আচমকা খেয়াল করে তার ডানদিকে না চাওয়া স্পর্শ।তার পিছের সিটে আফিয়া বসে। উমাইরের বুঝতে দেরি হয়নি।মুহূর্তেই সে চিল্লিয়ে উঠে,
–“আফিয়া,ধাক্কা দিয়ে বের করবো গাড়ি থেকে?বেয়াদব।”
আফিয়া কেঁপে উঠে হুংকারে।তার বুকের উপর বিশাল পাথর চাপা দিয়েছে যেনো।জুবায়ের, নিবরাস অবাক হয়ে চেয়ে।নিবরাস ভ্রু নাচিয়ে বোনকে জিজ্ঞেস করে,
–“কিরে কি হলো?”
–“বেয়াদব হয়েছে ও।আমাদের ভাইবোনের মতো না মেয়েটা। অদ্ভুত বিরক্তিকর।”
উমাইর নাক সিটকে বলে।
অপমানে আফিয়ার আঁখি ভিজে।উমাইর কেনো বুঝে না আফিয়া তাকে ভাইয়ের দৃষ্টিতে দেখতে পারবে না কোনোদিন!কেনো এতো ধমকায় সে?বুকে টেনে নিতে পারে না?
উমাইরের দৃষ্টি জোড়া কঠোর।স্টিয়ারিং শক্ত হাতে ধরা।আফিয়াকে গাড়িতে একদন্ড সহ্য হচ্ছে না তার।মেয়েটাকে গাড়ি হতে ছুঁড়ে ফেলাটা এখন যেনো তার একমাত্র লক্ষ্য! ক্রোধে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে উমাইর।
———
সকাল হতে নানান কাজে মুখরিত ছিলো তাহুরা।অস্থিরতায় সুনেরা বারবার তাহুরাকে ডেকে হয়রান।তবে স্বস্থি মিলে যখন শুনে জুবায়েরদের আসতে দেরী হবে।সুনেরাকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে শুনে তাদের কিছু সংখ্যক আত্মীয় আসে।ইমনদের পরিবারের সবাই এলেও মুন্সী এখনো জানায়নি কাউকে সুনেরাকে দেখতে আসা পরিবার কে বা কারা।মুন্সী নিজের পারিবারিক অবস্থা নিয়ে ছোট হতে চায় না পূর্বেই। বাড়ির সকলে নিশ্চয় এই প্রস্তাব মুন্সীর জন্যে চ্যালেঞ্জ ভাববে।আপাতত তাই চুপ করে রয় সে।
তাহুরা বোনকে তৈরি করে।গোলাপী শাড়িতে সুনেরার উজ্জ্বল ফর্সা ত্বক শোভিত। হালকা প্রসাধনীতে খুব লাগছে মনোরম মেয়েটাকে।
সুনেরা জুবায়ের হতে জানে তাদের আসতে আর মিনিট পাঁচেক বাকি।তাহুরা সেই সুযোগে বাথরুমে ঢুকে।সকালে একবার গোসল সারলেও,ঘরের আত্মীয় সামলিয়ে আবারও ঘামে চুপচুপ সে।তাই ফের গোসলের সিদ্ধান্ত নেয়।
কলাপাতা রঙের সুতির থ্রিপিস নিয়ে গোসলে যায় মেয়েটা।
তাহুরা গোসল শেষে বেরুলে দেখে কক্ষে কেউ নেই।রুমের অবস্থা পরিষ্কার।বাহির হতে শব্দ আসছে প্রচুর।জানালা দিয়ে উঁকি দেয় তাহুরা।উঠান জুড়ে দুইটা গাড়ি দাঁড়িয়ে।একটা গাড়িতে তাহুরার দৃষ্টি আটকে।পরিচিত এই গাড়িটা।কোথায় দেখেছে ঠিক মনে আসছে না।ভাবুক হয় সে। উমাইরের গাড়ি হুবহু দেখতে এমন।মনের উপর জোর দেওয়ার পূর্বে তার মা ঢুকে রুমে হুড়মুড়িয়ে।তাহুরার মাথা হতে ভেজা তাওয়াল খুলে।তাহুরার চুল মুছার ভঙ্গিতে বলে,
–“তোকে ডাকতে আসতে পারিনি।সুনেরাকে দেখতে এসেছে।তোর নানু বললো আগে সুনেরাকে নিয়ে যেতে।এরপর তোকে ডাকতে।”
–“উনারা এসেছেন?এসে আপুকে দেখতে চেয়েছে নাকি!”
–“হ্যাঁ।কথাবার্তা হচ্ছে।নাস্তা পানির আগে তাদের মেয়ে দেখা চায়।বিশেষ করে ছেলের মা।সুনেরাকে নিজের পাশে বসিয়ে আদর যত্ন করছে।আন্তরিক বেশ।”
চুল মোছা শেষ হয় শিউলির।
–“ভালো তো।বাবা কই?খুশি?”
তাহুরা প্রশ্ন করে।
–“দেখে খুশি মনে হচ্ছে।দেখা যাক কি হয়।চল নাস্তা ঠিক করবি।এরপর ওদের গিয়ে একটা সালাম দিস।”
–“দিবো মা।”
মায়ের কথায় সায় দেয় তাহুরা।
ভেজা চুল আঁচড়িয়ে মাথায় কাপড় টানে তাহুরা।বসার ঘর হতে তাদের কক্ষ স্পষ্ট।তাই দ্রুত পায়ে রান্নাঘরের পানে ছুটে সে।
দ্রুত ছুটেও লাভ হয়নি।উমাইরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আবদ্ধ হয় মেয়েটার সত্তা।কলাপাতা রঙের ওড়নায় আবৃত মেয়েটাতে ঘোর লেগে যায় উমাইরের।লম্বা চুলগুলো ভেজা ছিলো তখনো।উমাইর খেয়াল করে বেশ।দৃষ্টি জোড়া যেনো সারাদিনের তিক্ততায় ফিরে পায় একফালি তৃপ্তি।
—————
টেবিলে নাস্তা সাজায় তাহুরা।তার মামী সাহায্য করে তাকে।এরমাঝে ডাক পড়ে বাড়ির ছোট মেয়ের।তাহুরা লজ্জায় আড়ষ্ট।এইভাবে সে নতুন মানুষদের সামনে যেতে নারাজ।তবে এই পরিবারের সামনে না গেলে আপু কষ্ট পাবে।মনঃক্ষুন্ন হবে বোনের।মাথার কাপড় ঠিক করে তাহুরা ধীরে আসে বসার ঘরে নতজানু হয়ে।দৃষ্টি তার মেঝেতে।ছোট করে সালাম দেয়,
–“আসসালামুয়ালাইকুম।”
–“ওয়ালাইকুম আসসালাম, তাহু।”
নিবরাস হাসিমুখে বলে।মুহূর্তে হাসির রোল ছড়িয়ে পড়ে।
নিবরাসের কণ্ঠে তাহুরা অবাক হয়।দৃষ্টি তুলে তাকায়।নিবরাস,তার পাশে উমাইর বসে।উমাইরের খেয়াল আছে কি নেই বুঝেনি তাহুরা।উমাইর নিজের মোবাইলে মগ্ন। দৃষ্টি ডানে বামে ঘোরালে তার বোন,বাবা,বোনের পাশে বসা ছেলেটা সম্ভবত জুবায়ের।অনেকটা তাদের উমাইর স্যারের মতো চেহারা।কাহিনী কি আয়ত্বে আসছে না তাহুরার।এরা দুইজন ভাই?তার আপু কখনো জুবায়েরের ভাইয়ের ব্যাপারে কিছু বলেনি।তাহুরা কখনো জানতে চায়নি।আচ্ছা উমাইর কি জানতো সুনেরার কথা বা এতসব কাহিনীর কথা?প্রশ্নে প্রশ্নে ছেয়ে যায় তাহুরার ছোট্ট হৃদয়।
তার ভাবনার মাঝে উমাইরের চেহারার সাথে মিল রাখা এক মহিলা কাছে ডাকে তাহুরাকে,
–“এইদিকে আসো তাহুরা।ভাই সাহেব আপনার দুই মেয়ে কিন্তু একদম ফুলের মতো।আমি কথা ফাইনাল হওয়ার পরে কিন্তু চা পানি খাবো।এর আগে না।বিয়ের তারিখ আমরা অন্যদিন এসে দিবো।”
মুন্সী মিয়া নিঃশব্দে হাসে।অত্র বাড়ির সকলে অমায়িক।আসছে পর্যন্ত সুনেরাকে “মা” ব্যতীত কথা বলছে না।
–“জ্বী মুন্সী সাহেব,আপনাদের উত্তর হ্যাঁ চাই।”
হো হো করে হাসে জয়।মুন্সীদের ব্যবহারে লোকটা তার সকল ব্যবধান ভুলেছে।এমন একটা শান্তির নীড় হতে মেয়ে নিতে পারলে তাদের পরিবারে প্রশান্তি ছড়িয়ে যাবে বিনা স্বার্থে।
তাহুরা মেঘলা বেগমের সম্মুখে গেলে মহিলা হাত টেনে তার পাশে বসায় তাহুরাকে। আড় চোখ জোড়া কেবল উমাইরের পানে যাচ্ছে।লোকটা ভাবলেশহীন।নিজের কাজে ব্যস্ত।
মেঘলা বেগম তাহুরার হাতে হাত রাখলে তাহুরা মিষ্টি হাসে,
–“ভালো আছেন আন্টি?”
–“আলহামদুলিল্লাহ্ মা।তুমি নাকি আমাদের উমাইরের স্টুডেন্ট।কি অপরূপ তুমি,মা শাহ্ আল্লাহ্।আমি চেয়েছিলাম আমার শেষ সন্তান মেয়ে হোক,কিন্তু হলো কি?এইযে আমার আদরের জিদওয়ালা উমাইর।”
বসার ঘরে এক পরশ অট্টহাসির বিচরণ হয়।তাহুরা নিজেও হেসে কুটিকুটি।তার উমাইর স্যারের বড্ড জিদ,এটা পুরো কলেজ জানে।এরই মাঝে ভেসে এলো উমাইরের গম্ভীর কণ্ঠ,
–“মা,ভাইয়ের জন্যে মেয়ে দেখতে এসেছি।আমার জিদের বিবরণ দিচ্ছো কেনো?”
–“সরি সরি বাবা।তো ভাই সাহেব আমরা কথা পাকা করছি তবে।”
মেঘলা বেগম বলে।
–“সুনেরা তুই রাজি?”
মুন্সী উত্তর জানা সত্ত্বেও প্রশ্ন করে মেয়েকে।
সুনেরা উপর নিচ মাথা দোলায়।মেঘলা বেগম সহ সকলে বেজায় খুশি হয়। বাক্স হতে আংটি পড়ায়,চেইন দেয় সুনেরাকে। উমাইরের চাচা কিছু নগদ টাকা দেয় তাদের হবু বউকে।হাসি ঠাট্টা পর্যায় শেষে শিউলি অনুরোধ করে সকলকে,
–“চলুন চলুন,নাস্তা করবেন।আজ কিন্তু ভাত না খাইয়ে ছাড়বো না।”
কি আন্তরিক,কি অমায়িক আহ্বান! জয় বেজায় খুশি।নিজ বোন না থাকায় কখনো এমন আবদারের সম্মুখীন হয়নি।এই যেনো বোনের আবদার।
খুশিতে আত্মহারা জয় জবাব দেয়,
–“খেয়ে যাবো আপা।অবশ্যই খেয়ে যাবো।”
সকলে উঠে ডাইনিংয়ে যায়।মেহমানরা অনায়াসে বসতে পারে।সুনেরাও বসে জুবায়েরের পাশে। জয় মুন্সী মিয়া,ইমনের বাবা এবং তাহুরার নানুকে বসতে জোর করে।
মুন্সী তাহুরাকে নির্দেশ দেয়,
–“মা,ভেতরের রুম থেকে কয়েকটা এক্সট্রা চেয়ার নিয়ে আয়।ইমন সাথে যা তো বাবা।”
ইমন,তাহুরা যেতে নিলে সেদিকে দৃষ্টি মেলে উমাইর।আচানক তার মাঝে পাহাড়সম তিক্ততা জমে।বেহুদা সে নিচু স্বরে নিবরাসকে বলে,
–“তোমার ফ্রেন্ডকে গিয়ে হেল্প করো।বা আমাকে বলো হেল্প করতে যেতে।”
নিবরাস এমন খাবার দাবার সেরে উঠতে নারাজ।তাই সে সহসাই জোরে বলে,
–“উমাইর ভাই,তুমি গিয়ে সাহায্য করো তাহুরাকে।”
সচরাচর উমাইরকে কেউ নির্দেশনা দেয় না।নিবরাসের এমন উক্তিতে ভয়ানক নজরে তাকে ঝলসে ফেলছে তার মা বাবা।
–“উমাইর যা বাবা।”
মেঘলা বেগম বলে।
–“নাহ নাহ,ওরা নিয়ে আসবে।”
শিউলি বললেও উমাইর ততক্ষণে উঠে পড়ে।নিবরাসের মা ভয় পায় অন্তরে।তার ছেলেকে উমাইর খারাপ কিছু না বলে বাড়ি ফিরলে!
ইমন সাহসা দুইটা কাঠের চেয়ার দুই হাতে তুলে বেরোয় রুম হতে। উমাইরকে দেখে থামে ইমন,
–“ভাই,কই যাচ্ছো?”
–“কোথাও না।চেয়ার নিয়ে যাও।”
ইমন সম্মুখে এগোয়। উমাইর দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়ালে তাহুরা খুব কষ্টে দুই চেয়ার মেঝেতে ঘষে আনছে।মাথার কাপড়টা কাঁধে।উমাইর লম্বা কদমে তাহুরার দুহাতে বিদ্যমান চেয়ার আলগোছে নেয়।বিড়বিড় করে বলে,
–“ইমন বেয়াক্কেল।”
–“আপনি..আমি নিচ্ছি।”
তাহুরা যেনো হাঁপিয়ে।
তার বাক্য উহ্য করে উমাইর। কাঠকাঠ শব্দে ঝাঁঝিয়ে উঠে,
–“মাথায় কাপড় দিয়ে সামনে আসবে সবার।”
–“জ্বী?”
তাহুরার প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে আসে উমাইরের,
–“মাথামোটা।”
গটগট পায়ে চেয়ার নিয়ে যাচ্ছে উমাইর।ইমন এলেও থামেনি।তবে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে অবলোকন করে দৃশ্য।তাহুরা মাথায় কাপড় জড়িয়ে ইমনকে উপেক্ষা করে তার পিছুপিছু আসছে।মন শান্ত হয় উমাইরের।বরফের ন্যায় শীতলতা অনুভব করছে সে।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হয়। সন্ধ্যার পূর্বে সুনেরা, জুবায়েরকে বাহিরে কথা বলতে পাঠানো হয়।সূর্যের তেজ এখনো বিদ্যমান।সাথে বেরোয় উমাইর,তাহুরা,আফিয়া,ইমন এবং তার ছোট ভাইবোন।
পুকুর পাড়ে ভিড় করে সকলে।সুনেরার হাসিতে মুক্ত ঝরে।সে জানতো না ভালোবাসার পূর্ণতা খুব সহজে পাবে।আল্লাহ্ এর নিকট মেয়েটা বারংবার শুকরিয়া আদায় করছে।তাদেরকে ঘিরে ইমন এবং বাকিরা আড্ডা দিলে তাহুরা ব্যস্ত তার ফুলের গাছে পানি দেওয়ায়,উমাইর আপাতত চারিদিকে দেখছে।তাহুরাদের একা বাড়ি, গাছাছালিতে ভরপুর।বেশ পরিচ্ছন্ন।
পুকুর পাড়ের ঠিক বিপরীতে অনেক ফুলের সমাহার।সবটা তাহুরার প্রিয়।উমাইর গাড়িতে হেলান দেওয়া হলেও দৃষ্টি তার সরলতার প্রেয়সীতে আবদ্ধ।
তাহুরা তার ফুল গাছের পরিচর্যাকালে তার নিকট আসে শায়ন,আয়মা। আয়মা তাকে জিজ্ঞেস করে,
–“আপু,একটা গোলাপ নিবো আমি?”
–“ছোট এখনো। বড় হলে অবশ্যই দিবো।খুব সুন্দর রং হয়।একদম লাল।”
তাহুরার হাসিতে উমাইরের দুনিয়ায় জেগে উঠে সহস্র আলোর মিছিল।
শায়ন হাত দুদিকে নাড়িয়ে জবাব দেয়,
–“ওয়াও।”
উমাইরকে এগোতে দেখে তাহুরা অনেকটা বিচলিত হয়।স্যার এখন তার অন্য আত্মীয় হতে যাচ্ছে।কিভাবে সম্মুখীন হবে সে এই মানুষটার! আড়ষ্ট হচ্ছে তাহুরা।হাত হতে পানির মগ পড়ে যায়।আফিয়া ভাবে উমাইর তাদের নিকট আসছে।উৎসুক ভঙ্গিতে নিজেকে পরিপাটি করলে,মনে আধাঁর নামে তার।উমাইর তাহুরার নিকট স্থির হয়।আফিয়া প্রথমে বিস্ময়মুখে তাকালেও পরে তাদের কথোপকথন শুনে শান্ত হয়।
–“একটা গোলাপের চারা লাগবে।আমারটা শেষ।বাতাসে ভেঙেছে।”
উমাইর সহজে বলে।
উমাইর প্রকৃতি প্রেমী,সাথে তার প্রিয় গাছ এবং ফুল।সেই ভেবে বাকিরা নিজেদের কাজে মন দেয়।উমাইর,তাহুরার কথায় আর ঘাটেনি।
তাহুরা উঠে দাঁড়ায়।দৃষ্টি তার উমাইরের বুকে স্থগিত।উপরে উঠানোর সাহস নেই।কিছুক্ষণ থেমে তাহুরা জবাব দেয়,
–“সেই গাছে ফুল হতো?”
–“হতো।”
ছোট উত্তর উমাইরের।
–“আচ্ছা কিনে দিবো,স্যার।”
কি সাবলীল ভাব তাহুরার।উমাইর হেসে উঠে।দুলে তার সর্বাঙ্গ।তাহুরার উৎসুক মন,উৎসুক নজর,ঘাড় উচুঁ হয় অনেকটা।উমাইরকে দেখে।এই যেনো অন্য উমাইর।অন্য মানুষ।বুকে ধাক্কা লাগে তাহুরার।শীতলতা হানা দেয় অন্তরে।শুভ্র শার্টে আবৃত মানবটা অদ্ভুত সুদর্শন ঠেকলো তাহুরার নিকট। একপল দুইপল কতো পল চেয়ে রইলো তাহুরা,জানে না।
হঠাৎই গম্ভীর হয়ে উমাইরের মুখশ্রী।খুব গম্ভীর গলায় বলে,
–“এটা কলেজ?স্যার কে?”
–“তাহলে..কি বলবো?”
তাহুরা প্রশ্ন করে।
–“তুমি জানো।”
উমাইর দু পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়ায়।আয়মা যেনো তাদের সব কথা শুনেছে।সে অকপটে তাহুরাকে বলে,
–“ভাইয়া বলবে।”
–“ভা..ভাই..”
পূর্ণ হয় না তাহুরার বাক্য।এরপূর্বে উমাইর জবাব দেয়,
–“তুমি বোন না আমার।মোটেও না।”
–“তাহলে?”
–“তুমি জানো।”
উমাইর ঘাড় ফিরায়।
তাহুরা অনেকক্ষণ ভাবে।তার ভাবান্তর মুখশ্রী ঠিকই উমাইরের দেওয়া “স্টুপিড রূপসীর” সাথে মিলে যাচ্ছে।দুজনের দৃষ্টি মিললে ভাবুক তাহুরা জবাব দেয়,
–“বুঝছি না তো।”
–“বুঝতে পারলে একটা মেসেজ দিও।যতদিন উত্তর দিবে না,ততদিন চারা নিবো না।যতদিন চারা নিবো না,ততদিন তোমার আপুদের বিয়ে পিছনে যাবে।”
–“আপু চায় বিয়েটা জলদি হোক।”
–“উত্তরটাও জলদি দিও।”
–“আমি তেমন একটা মোবাইল চালায় না।”
–“ভেরি গুড।কিন্তু,শুধু আমাকে মেসেজ দেয়ার জন্যে চালাবে।নাহলে,ফলাফল ভুগবে।আজ রাতের ভেতর উত্তর দিলে ভালো হয়।”
উমাইর বাড়ির ভেতরে ঢুকে।তাহুরা সেদিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় কেবল।মনে বিশাল ভাবনা।যতটুক আয়ত্বে এসেছে,আপুর দ্রুত বিয়ের জন্যে এই ধূর্ত মানবকে আজ রাতে উত্তর পাঠাতে হবে।
চলবে…..