রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব-৩+৪

0
1069

#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব -৩
________________
–“আমি কোনো কথায় শুনবো না।তাহুরা দুইদিন কলেজ যায়নি,আরো দুইদিন যাবে না। ঐ অতুলের কথা লুকানোর সাহস কিভাবে হলো আমার মেয়ের!আজ যদি উল্টাপাল্টা কিছু হতো?আমার মেয়েকে পেতাম?”
রুদ্ধশ্বাস মুন্সী মিয়ার।লোকটা মেয়েদের আদরে রাখলেও ব্যাপক শাসন করেন।সেদিন বাড়ি ফিরে আতঙ্কে,ভয়ে তাহুরার জ্বর আসে।স্নেহের মেয়ের জ্বরের সময়কালীন বাবা, মা,বোন তিনজনই আগলে রেখেছিল তাহুরাকে।জ্বরের ঘোরে মেয়েটা হাটে হাঁড়ি ভাঙে।দূর্বল কণ্ঠে সবটা বলে দেয় অতুলের ব্যাপারে।চোখ বুঁজে কেঁদেছিল বাবার হাত জড়িয়ে।তার একটাই আকুতি, অতুল যেনো তাকে আর উত্যক্ত না করে।মুহূর্তে গর্জে উঠে মুন্সী মিয়া।রাত তখন এক’টা কি দুই’টা!ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে সুনেরার পানে তাকালে সে শুরু থেকে সবটা বলে। তুখোড় মেজাজে বাড়ি হতে বেরুতে নিয়ে শিউলি আটকায়।সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে।অথচ সকাল হলে তারা শুনে অতুল নেই।দলবদ্ধ মাদক সেবনের আড্ডা হতে পুলিশ তাকে সহ অনেককে গ্রেফতার করে।

যদিও এখন অতুলের ভয় নেই,তাও মুন্সী মিয়া মেয়েকে বাড়ি হতে বেরুতে দিতে নারাজ।তবে,সুনেরার জন্যে এই নীতি নেই। দিব্যি সে ভার্সিটির শেষ বর্ষের ক্লাস করছে।যতো নীতি সব তাহুরার জন্যেই।মেয়েটা যে বড্ড নাজুক।

তাহুরা বাবার পানে চেয়ে রয়।কলেজে যায়নি দুইদিন। কতো জরুরি শিট পায়নি সে।সাথে তা বুঝে নেওয়ারও ব্যাপার আছে।তাহুরা ধীরে উঠে বিছানা হতে।বাবার হাত ধরে,
–“আমার পড়া বাদ যাচ্ছে আব্বা।”
–“যাক।আমার মেয়ের চেয়ে কি পড়ালেখা বড়?”
মুন্সী তাও রাগী।

–“উফ বাবা, ঐ অতুল জেলে।তাছাড়া সেদিন তাহুরার স্যার নাকি ওকে শাসিয়েছে।সে আর উত্যক্ত করবে বলে মনে হয় না। কাল তুমি তাহুরাকে কলেজে যেতে দিবে।”
বোনের পক্ষ হয়ে কথা বলে সুনেরা।
–“বাবা কলেজে যায়?প্লিজ?তুমি দিয়ে আসবে?”
অনুরোধ করে তাহুরা।বাবার দাড়ি ভর্তি গাল টানে।মেয়ের আদুরে ভঙ্গিতে কথা বলা দেখে হাসে মুন্সী মিয়া।মেয়ের কাঁধ জড়িয়ে বলে,
–“আচ্ছা।আমি নিয়ে যাবো।তোর ঐ স্যারকেও একটা ধন্যবাদ জানাবো।”
মুন্সী মিয়া বউকে সাথে নিয়ে বেরোয়।এইদিকে তাহুরার কান যেনো বাবার কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কার সাথে কথা বলবে বাবা?উমাইর স্যারের সাথে?কেমন প্রতিক্রিয়া দিবেন স্যার?খুব বকবে কি তাহুরাকে?বাবাকেও মানা করার জো নেই।বাবা মানবে না।
পিছ ফিরে সে সুনেরার সম্মুখে বসে। সুর টেনে বলে,
–“আপু? ও আপু?”
–“হুম বল।”
মোবাইলে মগ্ন সুনেরা।

–“বাবা যে স্যারের সাথে কথা বলবে বললো,উনি ভীষণ রাগী।আমার ভয় করছে।”
তাহুরার মুখশ্রী আতঙ্কে ছেপে যায়।
–“আজব ব্যাপার তো! অভিভাবক স্যারদের সাথে কথা বলতেই পারে।এখানে তোর ভয়ের কি?এই ভয় ভয় করে সময় অসময়ে জ্বরে ভুগিস।”
–“তাও।আমার না কেমন কেমন লাগছে।”
আহত সুর তাহুরার।
–“কেমন কেমন লাগার কোনো দরকার নেই।টিভি দেখ নাহলে মোবাইল দেখ।অযথা ভয় পাস না।”
সুনেরার বক্তব্যে তাহুরা মাথা নাড়ে।দু হাঁটু বুকে গুঁজে বসে। ঘাড়ের উপর বড় খোঁপা।উমাইর বিরক্ত হয়ে ক্লাসে সকলকে ধমক দেওয়ার দৃশ্য তার মস্তিষ্কে ঘূর্ণায়মান।কেমন ভ্রু কুঁচকে ফেলে সে সুদর্শন মানব!ভাবতেই বুকের স্পন্দন বাড়ে।বাবা যেনো মান সম্মানে বাড়ি ফিরে আসে এমনটা দোয়া করলো সে মনের গহীনে।

পরক্ষণে অন্তরের ভাবনা ছুটে।উঠে যায় সে মায়ের কক্ষে।কি যেনো ভেবে মাকে বললো,
–“একটা শাড়ি দাও?একটু পড়ি।”
–“এই সময়ে শাড়ি পড়ে?”
মা খানিকটা অবাক হয়।
–“ইচ্ছে করছে মা।”
কেমন মিনতি ভরা কণ্ঠ।শিউলি মেয়ের জন্যে আলমারি হতে জামদানি একখান শাড়ি বের করে।পুরোনো হলেও এখনো নতুনের মতো চকচকে।তাহুরার দাবি নতুন নয়,মায়ের পুরাতন শাড়ি পড়বে।

মিনিট পাঁচেক এর মাঝে শিউলি মেয়েকে শাড়ি পড়িয়ে দেয়।চিবুকে হাত রেখে বলে,
–“মেয়ে আমার বড় হয়ে গেলো।”
–“ছোট থেকে যাবো নাকি মা?”
গাল ভরে হাসে তাহুরা।মুহূর্তে ফের বলে,
–“আপুকে দেখিয়ে আসি।”
খুশিমনে সে ছুটে বোনের নিকট।সুনেরা বোনকে দেখে শোয়া থেকে উঠে।বিস্ফোরিত নজরে চেয়ে বলে,
–“বাব্বাহ,কি রূপসী!ড্রেসিং টেবিলের সামনে যা।লিপিস্টিক দিয়ে দিবো।”
–“আচ্ছা।”
মেয়েটা ব্যাপক আনন্দিত।সুনেরা তাকে লিপস্টিক লাগিয়ে চুলের খোঁপা খুলে দেয়,
–“এমন থাক।ভালো লাগছে।”
–“আচ্ছা আপু বাসায় যদি চুল খোলা রাখি বা লম্বা বেণী করে রাখি, তবে কি জ্বীন আমাকে ধরবে?”
তাহুরার বোকা প্রশ্নে সমন্তলার ভ্রু কুঁচকে আসে সুনেরার,
–“কি উদ্ভট প্রশ্ন?জ্বীন কি যেখানে সেখানে মানুষকে ধরে নাকি?”
–“ধরে না?”
আবারও প্রশ্ন করে তাহুরা।
–“নাহ ধরে না। গাঁধা একটা।”
সুনেরা আহ্লাদী কণ্ঠে বলে।
–“বুঝলাম।”
ঠোঁট উল্টে বলে তাহুরা।যদিও বোনের কথা বিশ্বাস করেছে সে।তারপরও কলেজে গেলে আর পেছনে দিবে না বেণী।উমাইর স্যার যেটা বলেছে সেটা কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো না।তাহুরার আবার ভুত,প্রেত, জ্বীনের ভীতি আছে।

–“দেখি বিছানার পাশে দাঁড়া।কয়েকটা ছবি তুলে দিচ্ছি।”
আকাশে পেখম মেলে যায় তাহুরার।চেহারায় জ্বরের ক্লান্তি।সেই সাথে হালকা সাজগোজে মলিন মুখটা কেমন মোহনীয়।তাহুরা দ্রুত তাদের কক্ষের ফেইরি লাইট জ্বালায়।রুম ঝলমলে সাথে সেখানে জ্বলজ্বল করে দূর্বলতায় তুষ্ট তাহুরার হাস্যোজ্বল চেহারা।
————-
রাত দেড়টা।হালকা শীতের আবেশ ধরণীতে।উমাইর তার ব্যালকনিতে বসে।পড়নে হাফ হাতা টিশার্ট।ঠান্ডার প্রকোপ তাকে ছুঁতে পারছে না।মনের দহনে সারা শরীর উত্তপ্ত।উমাইরের দৃষ্টি সুদূরে খেলার মাঠে।সেই মাঠ এবং তাদের ঘরের মাঝে বিদ্যমান রাস্তায় দ্রুতগামী গাড়ির আনাগোনা।সেদিনের পর তাহুরার দেখা পায়নি উমাইর।যদিও স্বাভাবিকভাবে তাদের সাথে রোজ ক্লাস পড়ে না,তাই দেখাও সবসময় হয় না।কিন্তু,সমস্যাটা অন্যদিকে।সেই ঘটনার পর তাহুরার অবস্থা কি?মেয়েটা ঠিক আছে?আকস্মিক ভয়ে দূর্বল হয়নি তো মেয়েটা?এছাড়া আরো কিছু কথা আছে যা সেদিন উমাইর তাহুরাকে বলতে পারেনি।ভেবেছে কলেজে আসলে বলবে ছলেবলে।অথচ মেয়েটা আসলো না।
সন্ধ্যা বেলায় তাহুরার একা একা রাস্তায় বেরুনো কেমন যেনো সায় দিতে পারলো না উমাইর।সেদিন ঐ অতুল ছিল, কাল অন্যকেউ হতে পারে।এমনটা ভাবনায় গত দুইরাত ধরে সে নির্ঘুম। উমাইর অতুলকে সনাক্ত করতে পেরেছে বলে একটা গতি করেছে প্ল্যানিং করে।

তবে,সবসময় তাহুরাকে উমাইর রক্ষা করতে পারবে এর গ্যারান্টি কি?উমাইর সেদিন কাকতালীয় উপস্থিত ছিলো কেবল।তাহুরার নাম্বার আছে তার নিকট।কিন্তু,ফোন দেওয়াটা ভালো দেখায় না।নিবরাসকেও কিছু জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছে নেই তার।উমাইরের ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না,সে ছোট ভাইকে কোনো মেয়ে স্টুডেন্টের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করুক।এমন অনেক স্টুডেন্ট তো কলেজ মিস দেয়।দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে উমাইর।অন্তরে এক জ্বালা।উমাইর এবং তাহুরার, দুইজনের মাঝে বিশাল দেওয়াল।এই দেওয়াল ভাঙতে অনেকটা সময়ের দরকার।

আলগোছে উঠে উমাইর।ডিজিটাল দেওয়াল ঘড়িতে লাল রঙা সময় দেখে।সকালে আটটা থেকে কলেজ।মাথা ভর্তি চিন্তা নিয়ে বিছানায় উবুত হয়ে শোয়।পলক ঝাপটায়।ঘুম আসে না।আঁখিজোড়াও বুঁজে না।তাহুরার একেক দিনের একেক প্রতিচ্ছবি ভেসে বেড়ায় মস্তিষ্কে।মানুষের স্মৃতি বড্ড পীড়াদায়ক।অতঃপর সোজা হয় সে।কম্বল টেনে নেয়।টিশার্ট খুলে বিছানার পাশেই রাখে।কপালে একহাত বিলিয়ে আপন মনে দোয়া করে,
–“বোকাটা যেনো কাল কলেজে আসে।আমার সাথে কথা বলে।দম বন্ধ লাগে রে বোকাপাখি।”

সহসা অ্যালার্মের শব্দে সজাগ হয় উমাইরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়।এছাড়াও দরজায় এক শব্দ। খট খট।উমাইর চাদর সরায়। এতো জলদি মা ছাড়া আর কে হবে?বিনা প্রশ্নে দরজা খুললে মেজাজ বিগড়ে যায় তার।আফিয়া দাঁড়িয়ে।অদ্ভুত ভঙ্গিতে।আকৃষ্ট করার চেষ্টায়।সটান করে খুলে রাখা দরজার ফাঁক এখন বন্ধপ্রায়। হুংকারের সাথে ধমকে উঠে উমাইর,
–“কি চায়?”
–“আমাকে ভার্সিটিতে দিয়ে আসবে আজ?”
আফিয়া হেলেদুলে জবাব দেয়।
–“আমাকে ড্রাইভার লাগে?বেয়াদবের মতো আমার রুমের সামনে আসবে না।”
উমাইর প্রচুর ক্ষেপেছে।
–“একই রাস্তায় তো যাও।আমাকে ড্রপ করে দাও না।দুজনে সময় কাটালে দুরত্ব ঘুচবে।”
–” অসভ্যতামি বন্ধ করবে, আদারওয়াইজ চড় দিয়ে গাল ফাটিয়ে দিবো।বংশের কলঙ্ক একটা।”
গগণ বিদারক অপমানে দরজা বন্ধ করে উমাইর শব্দ করে।রাগে গা রি রি করছে।এটা তার ছোট বোন?কি ছিলো তার পোশাক?একবার ভুলে দৃষ্টি দিলেও সেদিকে আর ফিরে দেখেনি উমাইর।ফের যদি এই মেয়ে কিছু বলে তাকে,তোয়াক্কা করবে না।বাড়ি ভর্তি সকলের সামনে নিয়ে এক চড়ে গাল ফাটিয়ে দিবে পুনরায়।

নিবরাসকে রেখে কলেজে যায় উমাইর।তাদের ক্লাসের সময়কালে বিলম্ব আছে ঢের।সকালের সেই ঘটনায় মেজাজ এখনো চটে আছে।সে বন্ধুদের সাথে কিংবা ভাই-ব্রাদারের সাথে প্রাণপনে আড্ডায় জমলেও শোরগোল বা অহেতুক মেয়েদের সাথে মশকরাতে না থাকার চেষ্টা করে।মেয়েগুলো তার কাকাতো,মামাতো বোন হলেও তার মনোভাবে আড্ডার ভাব আসে না।তাদের দূর থেকে কুশল বিনিময় করে এটা যেনো উত্তম তার নিকট।
উপরোক্ত ভাবে উমাইর তার মেয়ে কলিগদের সাথেও তেমন খোলামেলা ব্যবহার করে না।মাঝে মাঝে লাঞ্চ টাইমে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্যে বরাদ্দ ক্যান্টিনে বসতে হয়।কিছু ফরমাল কথা শেষে একেবারে নীরব থাকে উমাইর।যত্ন সহিত নিজের খাবার খায়।

নিজের কেবিনে ব্যাগ রেখে এটেনডেন্স ফাইল হাতে বেরোয় সে।তার বিক্ষিপ্ত মেজাজে আজ অনেকেই ঝলসে কয়লা হবে।
——–
বাবার সাথে সিএনজি সমেত কলেজে আসে তাহুরা।ক্লাস শুরুর আধা ঘণ্টা আগে এসেছে।বাবা নাছোড়বান্দা।উমাইরের সাথে তার কথা বলা ফরজ।তাহুরা আগে হাঁটছে তো বাবা পিছে।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশে পাশের পরিবেশ লক্ষ্য করছে।ইংরেজি ডিপার্টমেন্ট নিচ তলায়।সরু গলির উপরিভাগে বড় অক্ষরে “English Department” লেখা।গলির দুই ধারে একেকটা টিচারদের কেবিন।তাহুরা বাবাকে বলে,
–“তুমি দাঁড়াও।আমি দেখে আসি স্যার আছে কিনা।ক্লাস চললে আবার থাকবে না।”
–“আচ্ছা যা।”
মুন্সীর ছোট জবাব।

কেবিনের সামনে যেতে যেতেই তাহুরার বেহাল দশা।স্যার বকবে না তো আবার?বদ্ধ দরজায় টোকা দিলে ভেতর হতে শব্দ আসে,
–“কাম ইন।”(ভেতরে আসুন)।
হালকা ধাক্কায় দরজা খুলে তাহুরা।উমাইর দরজার পানে চেয়ে।দুজনের নজর মিলে।ভয়ে হতভম্ভ হয় তাহুরা।তবে,উমাইর যেনো দৃষ্টির তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। মলিন মুখশ্রী,বা দিকে লম্বা ঝুলন্ত বেণী,মাথায় কাপড় দেওয়া, ভীত চোখ জোড়ায় দ্বিধা নিয়ে তাহুরা দরজায়।উমাইরের হৃদয়ের মিছিলে অনুভূতিরা আরো প্রগাঢ় হয়।
কাঁপা ঠোঁট নাড়িয়ে তাহুরা জিজ্ঞাসা করে,
–“স্যার,আপনি কি ফ্রি আছেন?”

উমাইরের দৃষ্টি সরে সন্তর্পনে।তার কঠোর চেহারা অবলোকন করে তাহুরা একটুও বুঝলো না তার সম্মুখে বসা লোকটা ঠিক কতোটা স্নেহের,ভালোবাসার নজরে পর্যবেক্ষণ করলো তাকে।
–“বলো।”
একরোখা জবাব দেয় উমাইর।
–“বাবা…”
তাহুরা বাক্য শেষ করার পূর্বে উমাইর ফের তাকায় তার পানে।থেমে যায় তাহুরা।দু সেকেন্ড পরে আবারও বলে,
–“বাবা আপনার সাথে কথা বলতে চায়।আসতে বলবো?”
–“পাঁচ মিনিট হাতে আছে।”
উমাইর তার ল্যাপটপে মন দেয়।অনার্সের পরীক্ষার প্রশ্নের কাজ চলছে।

তাহুরা দৌড়ে বাবাকে ডেকে আনে।উমাইরের নির্দেশে মুন্সী মিয়া বসলে,তাহুরাকে উমাইর বলে,
–“ক্লাসে যান।”
–“জ্বী স্যার।”
পরপর সে আবারও বলে,
–“বাবা আমি তোমাকে ফোন দিবো ক্লাস শেষে। বাসে উঠেও ফোন দিবো।চিন্তা করো না।বাসায় একসাথে দুপুরের খাবার খাবো।তুমি বাসায় আসার সময় আমার জন্যে দুইটা আচার আনবে। ভাতে মেখে খেতে মন চায়।”
অনর্গল কথাগুলো ব্যক্ত করে তাহুরা বেরিয়ে যায়।

বিস্ফোরিত উমাইরের দৃষ্টি,স্তব্ধ হলো তার পরিবেশ। বাবাকে নিঃসংকোচ আবদারের সময় মেয়েটাকে পুতুল মনে হচ্ছিলো।জলজ্যান্ত পুতুল।উমাইর বুঝলো,তাহুরার মাঝে বাহিরের মানুষের সাথে কথা বলতে যতো জড়তা কাজ করে,আপনজনদের নিকট সে ততটাই প্রাণোচ্ছ্বল। উমাইরের হৃদয়ে লোভ জাগে।সে চায় তাহুরা তার সাথেও এমনটা খোলা মনে কথা বলুক।আর এমন দিন উমাইর ঠিকই আনবে তাদের জীবনে।

–“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ,আমার মেয়েকে বাঁচানোর জন্যে।”
মুন্সী মিয়ার সহজ স্বীকারোক্তি।
–“সেদিন আমি ছিলাম বলে রক্ষা করতে পেরেছিলাম।কিন্তু,তাহুরার এমন সন্ধ্যা বেলায় একা ঘুরাঘুরি করার ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন।সে অত্যন্ত ভীতু প্রকৃতির।”
এতদিনের জমানো কথা সোজা তাহুরার বাবাকে বলে শান্তি পাচ্ছে উমাইর।

–“ও শুধু কোচিংয়ে যায় সন্ধ্যায়।কোচিং আমাদের বাড়ির একেবারে কাছে।জামালখান তার বোনের সাথে যাওয়ার কথা।কিন্তু একটু বেশকম হয়ে গেলো।”
–“জ্বী।তবে,দেখে রাখবেন।কোচিংয়ে আসা যাওয়ার ব্যাপারে তার সাথে অন্যকেউ থাকলে ঝামেলা হবে না।”
অমায়িক হাসে উমাইর।সেই হাসিতে অন্তরে সুখ মেলে মুন্সী মিয়ার।যাক,কলেজে তার মেয়েকে নিয়ে চিন্তা নেই।নিশ্চয় এই স্যারের মতো বাকি সবাই এমন সুমিষ্টভাষী!

আর মিনিট দুয়েক আলোচনা করে বেরিয়ে আসে মুন্সী মিয়া।
নিজ ভাবনা মুন্সী মিয়াকে জানাতে পেরে উমাইরের সুখের অন্ত নেই।
–“আমার সরল রূপসী এখন নিরাপদে থাকবে।দুদিনের কষ্টে কেমন ছারখার হচ্ছিলো আমার মন।অথচ এখন আমি সুখী।কষ্টের পরে সুখের অনুভুতি কি এমন তৃপ্তিকর হয়!
প্রাণখুলে হাসে উমাইর।দুহাতে চুলগুলো পিছে ঠেলে।তার এই হাসির সাক্ষী কেবল সে একাই।
——
সামনে টেস্ট পরীক্ষা।কয়েকদিন পর হতে ক্লাস বন্ধ থাকবে।গত দিনের ইংরেজি ক্লাসের শিট নেই তাহুরার।এই ব্যাপারে বেখবর সে।ক্লাস শেষে সকলে চটপটির দোকানের সম্মুখে দাঁড়িয়ে। হাতে ধোঁয়া উঠা চটপটি।টক,ঝাল,মিষ্টি মিশ্রিত খাবার তাহুরার আবার বেশি প্রিয়।
নিবরাস কলেজ হতে বেরুলে চৈতালি তাকে হাতের ইশারায় ডাকে।হেয়ালি নিবরাসের দৃষ্টি মাথা নিচু করে খাওয়ায় ব্যস্ত স্বাগতার পানে।ঝালে মেয়েটা অস্থির।
চৈতালির কথা শোনার পূর্বে সে স্বাগতাকে খোঁচা মেরে বলে,
–“খেতে পারে না ঝাল,আবার দেমাগ দেখায়।এই তোরা খাচ্ছিস কি?স্বাগতাকে দেখ।নাকের পানি বাটিতে পড়ছে মনে হয়।”
স্বাগতা রেগে গেলেও হেসে উঠে তাহুরা,
–“অমৃত এটা।তুই খাবি?”
–“নাহ।আমি কেনো আমার বাড়ির কেউ খায় না এগুলো।উমাইর ভাইয়া এইসবের ঘোর বিরোধী।”
নিবরাস মুখ কুঁচকায়।
–“কেনো?চটপটি খুবই মজার খাবার।স্যার আর তোরা সবাই স্বাস্থ্য সচেতন তাই হয়তো জাঙ্ক ফুড এভয়েড করিস!”
একচমচ চটপটি গালে পুরে তাহুরা।
বাকি জনদের কিছু বলতে না দিয়ে চৈতালি বলে উঠে,
–“থাম তোরা।আমি তোকে বিশেষ কারণে ডেকেছি নিবরাস।”
–“কি দরকার?জলদি বল।আমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।”
প্রশ্ন চৈতালিকে করলেও দৃষ্টি তার স্বাগতার পানে।

–“উমাইর স্যার থেকে তাহুরার জন্যে গতকালের নোট কালেক্ট করে দে।”
সোজা উত্তর চৈতালির।

নোটের কথা শুনে বিষম খায় তাহুরা।নিজেকে সামলে বলে,
–“স্যার নোট দিয়েছে? বললি না কেনো আগে?”
–“মনে ছিলো না।হঠাৎ মাইন্ডে আসলো তাই বললাম।দেখলি না,নিবরাসকে ডাকলাম।”
চৈতালি উত্তর দেয়।
–“আমি কি করবো?উমাইর স্যার কেমন জানোস না?শিট নিয়ে উনার কাছে সাইন করতে হয়।যেনো কেউ বলতে না পারে,স্যার শিট পাই নাই তাই পড়া হয় নাই।ফাউল ডিসিশন তোর!”
নিবরাস দুপকেটে হাত গুঁজে।

–“কেমন স্যারের ভাই হইলি ব্যাটা!”
ক্ষিপ্ত হয় চৈতালি।

তাহুরা দোটানায় পড়ে।কোনোভাবে চটপটির বাটি রেখে পলক ঝাপটে বলে,
–“আমার সাথে একটু ভেতরে যাবি?”
–“অবশ্যই যাবো।”
হাসিমুখ স্বাগতার।

–“ওকে তোরা যা।আমি গেলাম।”
লম্বা কদমে সম্মুখে এগোয় নিবরাস।

পুনরায় তিনজন হেঁটে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে যায়।উমাইর ভেতরে আছে তার কেবিনে।ভেতরে গেলো না স্বাগতা এবং চৈতালি।তারা উঠানে দাঁড়ায়। লনে দাঁড়িয়ে অযথা ভিড় করার নিয়ম নেই।
তাহুরা সকালের ন্যায় নক করে ভেতরে আসে উমাইরের নির্দেশনা পেয়ে।আবারও তাহুরাকে আশা করেনি উমাইর।যদিও আজ তার সাথে ক্লাস ছিল না,তাও খুব করে গতরাতে দোয়া করেছিলো সে তাহুরার দেখা পাক।হলো তা।দুই দুইবার দেখা হলো।
উমাইরের প্রশ্নাত্বক মুখশ্রী ভাবায় তাহুরাকে।সে নিজেই বলে,
–“গত ক্লাসের শিট লাগবে স্যার।”
–“আসা হয়নি কেনো?”
প্রশ্ন করে উমাইর।

তাহুরা ওড়না খিচে দাড়ায়।একটু ধুকধুক করছে তার বুক।উমাইর হঠাৎ প্রশ্ন করছে কেনো?বকবে!
সরল ভঙ্গিতে সে বললো,
–“জ্বর ছিলো স্যার।”
উমাইর আলগোছে তাকায় মেয়েটার পানে।তার ধারণা সঠিক ছিলো।তার চেহারার ক্লান্তি,জ্বরের ক্লান্তি।

–“ঐদিনের ঘটনার ভয়ে জ্বর এসেছিলো?”
উমাইরের প্রশ্নে উপর নিচ মাথা নাড়ায় তাহুরা।
–“এখন থেকে সন্ধ্যায় একা বের হবে না।যদি কখনো কেউ ফলো করে বা বিরক্ত করে বাসায় জানাবে।বাসায় জানাতে সমস্যা হলে আমাকে বলবে।”
উমাইরের উত্তর অপ্রত্যাশিত।তাহুরা ভাবুক।উমাইর কি বলছে?উনি কি সেইজন,যে ক্লাসে সকলকে নাস্তানাবুদ করে রাখে!অথচ লোকটা দয়ালু,মহান।কিন্তু কাউকে তার এই রূপ দেখায় না কেনো?
–“বলবো,স্যার।”
তাহুরা হাসার চেষ্টা করে।

সেই হাসি বিঁধে উমাইরের মনের ঘরে। ছিন্ন হয় তার অন্তরের প্রত্যেকটা অংশ।গালের দুপাশে সৃষ্ট ছিদ্র উমাইরকে বেসামাল করে।কেশে উঠে উমাইর।ড্রয়ারে দৃষ্টি দেয়।শিট বের করে,
–“নাও।”
পরপর এগিয়ে দেয় সাইন করার জন্যে কাগজটি,–“সাইন হেয়ার।”(এইখানে সাইন করো)।

উবুত হয়ে সাইন করে তাহুরা।শিট হাতে বেরুতে নিলে বেখেয়ালিতে ব্যাগ আটকে যায় তার চেয়ারের সাথে।পা মচকে আধ বসা হয়। উমাইর আতঙ্কে হুট করে চিল্লিয়ে উঠে,
–“আরে দেখে হাঁটবে তো!স্বাভাবিক চলা যায় না?”

কেঁপে উঠে তাহুরার সত্তা।নিজেকে সামলানোর আগে দৌড় দেয়।যেতে যেতে কান্নারত কণ্ঠে আওড়ায়,
–“সরি,স্যার।”
হঠাৎ ধমক আশা করেনি তাহুরা।সরল মেয়েটার গালে অশ্রু ছেপে যায় নিমিষে।তাহুরার মনের ভাবনা,উমাইর এখনো রগচটা।তার মাঝে আন্তরিকতা নেই একদণ্ড।

তাহুরার গাল মুছে কেবিন ত্যাগ করাটাও নজর এড়ায়নি উমাইরের।মন খারাপ হয়নি তার,তুষ্ট সে বৈকি।
উমাইর চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়।আজকের দিনটা তার মনে এমন প্রশান্তি দিবে আশা করেনি মানব। প্রেয়সীর এতসব রূপ উপভোগ করাটা অবিশ্বাস্য ছিলো। উঠে এগিয়ে যায় জানালার পানে। তাহুরা হেঁটে যাচ্ছে সইদের সমেত। চোখ,নাক মুচছে নিশ্চয়।উমাইর নিঃশব্দে হাসে।বুকে হাত রাখে,
–“তোমার প্রত্যেক রূপে আমি বুদ হয়ে রই,তাহু।তোমার হাসির চেয়েও,কান্নাটা বেশি অন্তরে লাগে।আদুরে ছিঁচকাদুনে একটা।”

চলবে……

#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব -৪
________________
–“আমার প্ল্যানিং একদম স্ট্রেইট।তাহুরা অনার্সে পড়াকালীন সোজা প্রস্তাব পাঠাবো বিয়ের।এর আগে অবশ্য পটানোর চেষ্টা করবো বা ইশারা ইঙ্গিতে বুঝাবো আমি ওর দেওয়ানা।”
সোজা জবাব উমাইরের। তাহুরাকে দেখার পর হতে উমাইরকে তার তিন বন্ধু নানান প্রশ্নে জর্জরিত করে।এইযে আজও তারা আড্ডায় মত্ত হলে রনি প্রশ্ন তুলে,কিভাবে উমাইর তাহুরাকে বিয়ে করার প্ল্যানিং করছে!বাধ্য হয়ে একপ্রকার উত্তর দেয় উমাইর।
তার উত্তরে বন্ধুমহল সন্তুষ্ট।
উমাইর শান্ত সমুদ্রে নজর ফেরায়।জোয়ার নেই।থেমে থেমে পানি দুলছে কেবল।হাতের জ্বলন্ত সিগারেট অধরে চাপে। বন্ধু তিনজন তার দৃষ্টির অগোচরে ইশারা করছে তা দেখেও যেনো দেখছে না উমাইর।
মিনিট এক পর রকি ঝেড়ে কাশে।উমাইরকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“তুই কি রনির বিয়েতে যাবি না?”
–“চিটাগংয়ে করতে বল অনুষ্ঠান।”
দৃষ্টি উমাইরের এখনো স্থির।
–“আজব মানুষ তুই,ঢাকায় যেতে সমস্যা কি?বিয়েটা পিছানোর কারণে ঢাকায় যেতে হচ্ছে। অন্তরার নানী অসুস্থ।উনি যেনো শেষ বয়সে বিয়েটা দেখতে পারে নাতনির।তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া।”
আহত কণ্ঠ রনির।
–“ভাই আসছে তোর বিয়ের দিন।মা অজ্ঞান হবে আমি বাড়িতে না থাকলে।দুই ছেলেকে একসাথে দেখা মায়ের জন্য ফরজ।”
সিগারেটের শেষ টান দিয়ে উমাইর বালির উপরে ফেলে জুতো দ্বারা চেপে ধরে তা।

–“সবাই যাচ্ছে দোস্ত। তুইও চল না।”
অনুরোধ করে বাপ্পি।
–“বললাম তোদের। রিসিপশন চট্টগ্রামে করিস।আসবো শিউর।”
ভাবলেশহীন উত্তর উমাইরের।বাতাসের প্রত্যেকটা ঝাপটায় তার মস্তিষ্কে তাহুরার স্মৃতি চলমান।

–“আমি জানি তুই তাহুরার জন্যে যাচ্ছিস না।”
ফট করে বলে উঠে বাপ্পি।ভ্রু কুঁচকে যায় উমাইরের।কিসের মাঝে কি টানছে বাপ্পি?
শার্টের কলার ঠিক করে উমাইর কাঠকাঠ গলায় বলে উঠে,
–“ওর সাবজেক্ট কেনো আমাদের মাঝখানে?”
–“তুই ওর জন্যে শহর ছাড়ছিস না।বুঝেছি আমরা।”
রনিও যোগ দেয়।
–“বাজে এক্সকিউজ তোদের।ওকে আমি এইভাবেই দেখিনি অনেকদিন।এইচএসসি পরীক্ষার কারণে।ওর জন্যে শহর না ছাড়ার কি?পারলে যেতাম ঢাকায়।”
নিজ বক্তব্য পেশ করে সমুদ্রের ধারে বিরাজমান ডাবওয়ালাকে ইশারায় ডাকে উমাইর।সে কাছে এলেই বলে,
–“চারটা ডাব দিবেন। স্ট্র আমার সামনে আবারও পানি দিয়ে ধুবেন।”
ডাব বিক্রেতা উমাইরের কথা অনুযায়ী কাজ করে।

–“তুই চল না ভাই।গেলে ভালো লাগতো।”
রনি ফের বলে।
–“কেনো আমাকে আদর করবি তুই? যার কারণে তোর ভালো লাগবে?”
উমাইরের খোঁচামূলক কথায় বাকি দুই বন্ধু হাসে।বাদ যায়না ডাব বিক্রেতা।

উমাইর নিজেও নিঃশব্দে হাসে।তার হাসি বড্ড স্নিগ্ধ।সহজে ধরা দেয় না।
–“আস্তাগফিরুল্লাহ্ মার্কা কথা বলোস কেনো?তুই যাবি না ফাইনাল?”
রনি হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে।
–“হুম ফাইনাল।রিসেপশনে দেখা হবে।আর একটা কথা।মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট।”
অনেকটা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উমাইর।ততক্ষণে ডাব বিক্রেতা তার দিকে ডাব এগিয়ে দেয়।সেটা হাতে নেয় উমাইর।তার বন্ধুরা চাতক পাখির মতো অপেক্ষায়।
–“বল কি হইলো আবার?”
বাপ্পির একান্ত প্রশ্ন।

–“কোনো বিষয়ে আমার তাহুরাকে টানবি না।”
গম্ভীর,গভীর এক দৃঢ় কণ্ঠ উমাইরের।সেই কণ্ঠের গভীরতা যাচাই করে বাকি তিন বন্ধু।তারা উমাইরের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অবগত।ছেলেটা এতদিন তাহুরার কথা গোপনে রেখেছিলো।তাই এখন এমন খোলামেলা আলোচনায় তাহুরাকে টানা উচিত হয়নি তাদের।উমাইর নিশ্চয় এই ব্যাপারটা পছন্দ করেনি।

রনি উমাইরের কাঁধে হাত রাখে ফিচেল কণ্ঠে বলে,
–“ছোট্ট ভাবীকে অনেক ভালোবাসিস?”
–“অনেক।”
উমাইরের সহজ উত্তর।
মুখ টিপে হাসে বাকি তিন বন্ধু।রনি তার কাঁধ চাপড়ে আবদার করে,
–“ছোট্ট ভাবী মানে আমাদের উমাইরের বউয়ের সাথে সাক্ষাতের অপেক্ষায়।”
–“ইন শাহ্ আল্লাহ্।”
রকি সায় দেয় রনির সাথে।

উমাইর মানিব্যাগ হতে টাকা বের করে।ডাবের দাম চুকায়।হাত ঘড়ির দিকে দৃষ্টি পড়লে মনে আসে ক্লাবে অপেক্ষা করছে নিবরাস।অতঃপর সে বড় ছাতার নিচে অবস্থানরত লম্বাটে বেঞ্চ হতে উঠে।প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে জবাব দেয়,
–“আমি আসছি।ক্লাবে যাবো।খেলা আছে।”
–“চারটা বাজে মাত্র।”
রকি বলে।

–“পাঁচটা থেকে ম্যাচ।তোরা থাক।”
–“ওকে ব্যাটা যা। রিসিপশনে দেখা হবে তাহলে।আমাকে ছাড়া হ্যাংআউট করবি না,ওকে?”
রনির আহত সুর।
–“ওকে ওকে।যাচ্ছি তবে।”
সকলের সাথে হ্যান্ডশেক করে উমাইর।দ্রুত এগিয়ে যায় নিজ গাড়ির উদ্দেশ্যে।গাড়ি অনেকটা দূরে পার্ক করা।

গাড়িতে উঠে উমাইর মোবাইল বের করে। লক খুলতেই এক ঝলমলে ছবি ভেসে উঠে স্ক্রিনে।তাহুরা হাসছে।মায়াময়ী হাসি।কপালের দুই ধারে দুইটা লম্বা চুলের গোছা।মাথায় ঘোমটা টানা।আঁখি পল্লবে ঘন পাপড়ি।কি অপরূপ সৌন্দর্যের ফোয়ারা এই মেয়ে!
উমাইর চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ।মেয়েটার জন্যে মন ভালো নেই তার।কতদিন দেখেনি!আরো অনেকদিন বাকি মেয়েটার দেখা পাওয়ার।তাহুরার ছবি মূলত সে “হোয়াটস অ্যাপ” হতে পায়। তাহুরার একাউন্ট আছে।উমাইর তার নাম্বার সেভ রাখায় মেয়েটার প্রোফাইল হতে ছবি পেয়ে যায় সহজে।
তাহুরার ভাবনা একপাশে রেখে উমাইর নিবরাসকে ফোন করে।
—————-
তাহুরা ব্যাপক খুশি। এইচএসসির পর মামা বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হলো।মামাতো ভাই ইমন নিতে আসছে তাকে আর সুনেরাকে। দশদিন থাকবে সেখানে তারা।তাহুরার মামারা আবার বিত্তশালী ঠিক তার চাচাদের মতো।চাচার বাসায়ও হেঁটে ঘুরে এসেছে এই কয়েকদিন।কিন্তু থাকেনি।মামা বাসায় নানু এসেছে, যার কারণে আদরের নাতনী দুইজনের ডাক পড়ে। মুন্সী মিয়া মেয়েদের একা ছাড়তে নারাজ হলেও,শাশুড়ির ভরসায় পাঠাচ্ছে।শাশুড়িকে মেয়েদের দেখাশোনার বিরাট দায়িত্ব দিয়ে নিজে তুষ্ট হোন।

তাহুরা হেসে খেলে নিজের কাপড় গুছিয়ে নেয়।বোনের কাপড় জোড়াও গোছায় সে।হাত মুখ ধুয়ে এসে তৈরি হতে নিলে মোবাইল বেজে উঠে।চৈতালির নাম ভেসে উঠে স্ক্রিনে। তাহুরা মোবাইলের ব্যাপারে তেমন মনোযোগী না। তার হোয়াটস অ্যাপ সুনেরার খুলে দেওয়া।এমনকি প্রোফাইল চেঞ্জও সুনেরা করে দেয়।তাহুরা এটাও খবর নেয়নি,তার হোয়াটস অ্যাপে কে বা কারা আছে?উমাইর স্যারের নাম্বারটা যে তার ফোনে আছে, এই ব্যাপারে সে কখনো ভাবেনি।তাকে কেবল স্বাগতা এবং চৈতালি ফোন করে সদা।বাদবাকি কাজিনদের সাথে মোবাইলে আড্ডা দেয় না।কেবল সরাসরি দেখা হলে যতো সখ্যতা প্রকাশ করে মেয়েটা।

–“হ্যালো,বল।”
তাহুরা মোবাইল কানে চেপে বিছানায় বসে।
–“তুই ফেসবুক খুলবি কিনা বল!হোয়াটস অ্যাপ এ মেসেজ দিলেও দেখিস না।শুধু ফোন করলেই, হ্যালো বল।কি সমস্যা তোর?”
চৈতালি রেগে।
–“আরে বাবা,আমার ভালো লাগে না মোবাইল নিয়ে বসে থাকতে।কিভাবে পারিস তোরা ছোট এই যন্ত্র নিয়ে দিনরাত বসে থাকতে?”
প্রশ্ন করে তাহুরা।
–“ফেসবুক খুল আসল মজা বুঝবি। টিভি দেখে সারাদিন কিভাবে কাটাতে হয় তোর থেকে শেখা উচিত।”
–” আজ এমন উত্তেজিত কেনো তুই?কি হলো?”
–“সব ফ্রেন্ড নিয়ে পোস্ট করেছি,তুই ছাড়া।সবার আইডি ট্যাগ করলেও তোরটা করতে পারিনি। তোর ফেসবুক নেই।”
দীর্ঘশ্বাস চৈতালির।

–“পাগল মেয়ে।ভালো করেছিস।আমার ছবি না দিলে ভালো।”
মুখে হাত রেখে হাসে তাহুরা।
–“তুই কি কোনোদিন আমাদের মতো ফেসবুক চালাবি না?তোর ছবিগুলো কি সুন্দর হয়,আর তুই এগুলো না দেখিয়ে বসে থাক।”
চৈতালি ফের বলে।
–“কাকে দেখাবো?আমার এতো দেখানোর শখ নেই।”
–“তা থাকবে কেনো?কিন্তু শুন।তুই এখন নিজেকে লুকিয়ে রাখ,তবে আমার মনে হয় তোর জীবনে যে আসবে সে তোকে হরেক রকমে দেখবে।তুই যতটা লজ্জা পাস,তোর জামাই দেখবি ততটা নির্লজ্জ হবে।তখন জামাইকে সব দেখাবি।কেমনে বাঁচবি তখন?”
হু হা করে হেসে উঠে চৈতালি।তাহুরা ভারী লজ্জায় পড়ে।গালের দু ধারে রক্তিম। বজ্জাত মেয়ে বলে কি?
–“ছি!এইসব হবে না।”
তাহুরা লজ্জা নিবারণের চেষ্টায়।

–“হবে হবে।মিলিয়ে নিস।এমন আশিকের হাতে পড়বি,যে তোকে রোমান্টিক অত্যাচারে জর্জরিত করবে।আমি দোয়া করি এমন একজনের হাতে পড় তুই।জামাইয়ের অতিরিক্ত আদরে দিশেহারা হবে আমাদের তাহুরা।”
চৈতালি গড়গড় করে বলতেই থাকলো তার কথা।এইদিকে নাকে বিন্দু ঘাম তাহুরার। পাজি মেয়েটার মুখ বন্ধ করা উচিত।তাই আলগোছে তাহুরা বলে উঠে,
–“ধুর,আমি মামা বাড়ি যাচ্ছি।”
–“খুলশীতে?”
–“হ্যাঁ।”
–“বাহ ইমন ভাইয়ের বাসায়!আমার বাড়ি থেকে পনেরো মিনিটের রাস্তা।আমি কাল আসবোনি।দুইজনে মিলে ঘুরবো একটু।”
–“আচ্ছা।আমি রাখছি তবে।”

কথা শেষে তাহুরা ঝটপট তৈরি হয়।সুনেরা তাড়া দিচ্ছে। ইমনও এসেছে দ্রুত।তাদের নাকি ক্লাবে খেলা আছে। তাহুরা তার ঘন কালো চুল পিঠে বিলিয়ে দেয়। ঘর হতে ঘরে যাবে।তাই ভয় নেই।তবে মাথায় ঘোমটা টেনেছে। সাবধানের আবার মার নেই।

ব্যাগপত্র নিয়ে বসার ঘরে গেলে ইমন সুনেরার হাত থেকে ব্যাগ দুইটা নেয়।দ্রুত সুরে আওড়ায়,
–“গাড়িতে আয়।জলদি।”
–“নাস্তা করেছো ভাইয়া?”
প্রশ্ন করে তাহুরা।
–“নাস্তার সময় নেই।জলদি আয়।”
ইমন বেরিয়ে যাচ্ছে।ভাইয়ের ছেলেকে এতো বলেও বসাতে পারেনি।শিউলি দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে,
–“সাবধানে থাকবি।আর তোর আব্বাকে ফোন করবি অবশ্যই।টাচ মোবাইল নেই আমাদের,ভিডিও কলে দেখতে তো পারবো না।কিন্তু এমনি ফোন করবি।”
সুনেরা হাসে।মাকে জড়িয়ে বলে,
–“আমার ফোন রেখে যাবো?”

ভাবুক তাহুরা বোনের জন্যে চিন্তিত হয়।রাতে জুবায়ের ভাইয়া যদি তাকে ফোন দেয়!মা জেনে যাবে সবটা।তাই নিজে মাকে প্রস্তাব দেয়,
–“আমার ফোন রেখে যাচ্ছি।ফোনে আমি কিছু করিনা।”
মা দুই মেয়ের আন্তরিকতা দেখে শান্ত হয়।মেয়ে দুটো তার রত্ন।দুইমেয়ের গালে দুহাত রেখে শিউলি শুধায়,
–“কোনো দরকার নেই।যা যা ইমন দাঁড়িয়ে আছে।ছেলেটা আবার রাগ করবে।আমি আর তোর বাবা একদিন গিয়ে দেখে আসবো তোদের।”
পরক্ষণে হর্ণের আওয়াজ ভেসে আসে।তাহুরা এবং সুনেরা পুনরায় মাকে জড়িয়ে বেরিয়ে যায়।তাদের উঠানে অবস্থানরত ইমনের লাল গাড়িটা দৃশ্যমান।উঠে পড়ে তারা।ইমন ফুফুর সাথে কুশল বিনিময় শেষে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
————
তাহুরার মামার বাড়ি বেশ রক্ষণশীল এলাকায়।অবশ্য এই এলাকায় আগে তাদের বাড়ি ছিলো না।কয়েক মাস পূর্বে এসেছে তারা এই স্থানে।মা,সুনেরা এই বাড়িতে আসলেও তাহুরা পরীক্ষার কারণে আসেনি।বাবার সাথে বাড়িতে থেকে পড়েছে সারাটা দিন।বিকালেও ঘুমায়নি।একা ঘুমাতে দ্বিধা মেয়েটার।রাতে সুনেরা আর মা ফিরলে মেয়েটা বোনকে জড়িয়ে আয়েশ করে ঘুমিয়েছে।
সরু গলির একপাশে বড় বড় সব অট্টালিকা।বাহারি আলোতে জ্বলজ্বল করছে সন্ধ্যা বেলায়ও। বারো তলা বিশিষ্ট ভবনের সম্মুখে থামে ইমনের গাড়ি।এইবার ব্যাগ নেয় বাড়ির কেয়ার টেকার।ইমন তাদের হাঁটার ইশারা করে আওড়ায়,
–“তাহু আমার সাথে আয়।”
তাহুরা ভাইয়ের পাশাপাশি যায়।নিজ বড় ভাই না থাকলেও,ইমন ছেলেটার নিকটে থাকলে কখনো সে অনুভব করে না তার বড় ভাই নেই। লিফটে উঠে সাত চাপে ইমন।কাঙ্ক্ষিত ফ্লোরে এলে লিফট বরাবর এপার্টমেন্টের দরজা খোলা দেখতে পায় তাহুরা।
সেই দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তার নানু,মামাতো বোন আয়মা,ছোট মামাতো ভাই শায়ন আর মামী।এক প্রকার দৌড়ে যায় তাহুরা তাদের নিকট।জড়িয়ে ধরে।পরপর সুনেরা আসে।

লিভিংরুমে তাদের কথাবার্তার পর্বে ইমন একেবারে রেডি হয়ে আসে।তাকে অবলোকন করে দুই ভাইবোন বায়না করে।আয়মা কেঁদে বলে,
–“আমাকেও নিয়ে যাও ক্লাবে।প্লিজ,আমি খেলা দেখবো।”
–“কি আজব ব্যাপার।তুই কেনো যাবি?”
ইমন প্রশ্ন করে।
–“শুধু ও না।আমিও যাবো ভাইয়া।”
ফাইভে পড়ুয়া শায়ন দুরন্ত।
–“তাহুরা আর সুনেরা আপুকেও নিয়ে যায় চলো।একটু ঘুরেফিরে একসাথে খাবার খাবো কোথাও।”
আয়মার প্রস্তাব মন্দ নয়।
–“আমি যাবো না।তাহুকে নিয়ে যাও।ভিড় সেখানে বেশি?”
সুনেরার প্রশ্নে ইমন বলে,
–“ঐখানে ব্যাপক মজা হবে।তাহুরা বোর হবে না।”
তাহুরাও খুশি।ভাইবোনদের সাথে ঘুরতে যাবে এটা কম কিসে! ক্লাব কাছেই।হেঁটে যাবে তারা।

নিচে নেমে উত্তর দিকে হাঁটতে থাকে সকলে।খানিক বাদে বিশাল সাইনবোর্ড দেখে তাহুরা। বড় অক্ষরে লেখা “The warrior’s sports club” দৃশ্যমান।হাসি মুখে আসলেও ভেতরে যাওয়ার পরপর সেই হাসি গায়েব হয় তাহুরার।অনেক ছেলে মেয়ের উপস্থিতি এইখানে।পোশাকে ব্যাপক আধুনিকতা।এছাড়া মেয়েদের কাপড়ে শালীনতার অভাব ঢের। ইমন তাদের এক জায়গায় বসাতে চাইলে তাহুরা বিচলিত ভঙ্গিতে বলে,
–“ভাইয়া,আমি এইখানে বসবো না।এত মানুষ! জানলে আমি আসতাম না।সব ছেলে দেখো না।”
চতুর্ভুজাকৃতির মাঝারি সাইজের কৃত্রিম মাঠ আছে তিনটা।চারিদিকে মানুষের সমারোহ।কেউ খেলছে আর কেউ খেলা দেখছে।বহিরাগত কেউ নেই।সবাই কার্ড দেখিয়ে ঢুকে।কার্ডের উত্তরাধিকাররা তাদের সাথে দর্শক আনার নির্দেশনা আছে।
ইমন তার কাঁধের স্পোর্টস ব্যাগ রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।তার এই বোন বড্ড লাজুক।কিন্তু,এইভাবে বসবে না মাঠে সেটা ভাবেনি ইমন।
আয়মা,শায়নকে বসিয়ে সে তাহুরাকে বললো,
–“আমার সাথে চল।”
তাহুরা ভাইয়ের পিছে পিছে যায়।কয়েকটা চেঞ্জিং রুমের সারি।সেথায় নক করে ঢুকে পড়ে ইমন।হেসে বলে উঠে,
–” কি অবস্থা উমাইর ভাই?অনেকদিন পর দেখা পেলাম।নিবরাসের সাথে দেখা হলেও তোমার দেখা পাই না।”

নাম দুখানা শুনে তাহুরা চমকিত,দৃষ্টিতে তার অবিশ্বাস্য।কিন্তু,সত্য। তার সম্মুখে উমাইর,তার পাশে নিবরাস।উমাইরের পড়নে হাফ প্যান্ট, জার্সি।রং সাদা কালো।উমাইরের দু’কান রক্তিম।দৃষ্টি এখনো তাহুরাতে বিদ্যমান।তাহুরা একবার তার পানে চেয়ে আর তাকায়নি সেদিকে।কোন জায়গায় এসেছে সে!উমাইর স্যার এইখানে?
–“তাহুরা? ও এখানে কেনো ইমন?”
কেমন রেগে যাচ্ছে উমাইর। নিবরাসও সমান অবাক।
–“আরে বলো না।তাহুরা আমার ফুফাতো বোন।আমার ভাইবোনের সাথে এসেছে আমাদের ম্যাচ দেখতে।কিন্তু,বেচারা ভিড় দেখে আর বসতে চাইলো না সেখানে।তোমার ড্রেসিং রুমে বসতে পারবে?”
ইমন ইতস্তত হয়ে বলে।

–“পারবে অবশ্যই।ভাইয়া,আমি তোমার সাথে খেলবো আবার।উমাইর ভাই তুমি তাহুরাকে অফিস রুমে বসাও।”
নিবরাস খুশি ব্যাপক।
–“তাহুরা তুই কমফোর্ট ফিল করিস।উমাইর ভাইয়া অনেক ভালো ছেলে।”
ইমন কথা খানা বললে তাহুরা বলে উঠলো,
–“উনি আমার স্যার ভাইয়া।”
–“ওহ গ্রেট।আমি যায় তাহলে।চলো নিবরাস।”
ইমন,নিবরাস চলে যায়।

–“ডেস্কের উপর বসো।”
দাঁতে দাঁত চেপে উপদেশ দেয় উমাইর।

তাহুরা ওড়না চেপে বসে ডেস্কে।আরচোখে তাকায় উমাইরের অবয়বে। তাদের স্যারকে অন্যরকম লাগছে।ঠিক গতকাল যে বর্ণনা দিয়েছে স্বাগতা সেই রকম উমাইরের অবয়ব।চুলের কাটিং, খরশান চোয়াল অদ্ভুত সৌন্দর্যতা ভিড় করছে যেনো।উমাইরের হাতের বাহু সবসময় আবৃত দেখেছে তাহুরা।এই প্রথম সে অবলোকন করে উমাইরের ফুলে-ফেঁপে থাকা বাহুদ্বয়।

এতদিন বাদে উমাইর তাহুরার দেখা পেয়েও নারাজ।মেয়েটার এমন বিদ্ধস্ত পেরেশানি মুখমন্ডল উমাইরকে শান্তি দিচ্ছে না,বরং অন্যরকম অনুভূতিতে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।মেয়েটা অধরে অধর চেপে মাথা নিচু করে।থেকে থেকে উমাইরকে দেখছে।উমাইরের জন্যে তার মনের অন্তঃস্থলে নিষিদ্ধ অনুভুতি আসার চেষ্টায়।এইভাবে আজকাল “উমাইর” নামটা শুনলে অস্থির লাগে তাহুরার।অন্তর কাঁপে। ভয়ে নাকি অন্য কোন কারণে জানেনা তাহুরা।

উমাইর অশান্ত।কি দরকার ছিলো,এই মেয়ের এইখানে আসার?কম ছেলে আছে এইখানে?উমাইর মুখে,ঘাড়ে পানি দ্বারা ভেজায়।মিনি তাওয়াল দিয়ে পানি মুছে তাহুরার সম্মুখে দাঁড়ায়,
–“চলো।”
অকপটে বসে থাকা তাহুরা বুঝেনি উমাইরের কথা।সে প্রশ্ন করে,
–“জ্বী?”
–“চলো।অফিসে বসবে।”
ড্রেসিং রুমে এসি নেই।কাপড় চেঞ্জ আর ওয়াশরুম ব্যবহার করা যায় এইখানে।তাহুরাকে অস্বস্তিতে রেখে উমাইর তার কাপড় পরিবর্তন করেনি। জার্সি,শর্ট প্যান্ট পরিহিত অবস্থায় উমাইর বেরিয়ে আসে তাহুরা সমেত।অফিস রুমে যায়।

তাহুরা ঘেমে অস্থির। মনের জ্বালা,সাথে অন্যরকম ভয়।উমাইর তাকে ধমক না দেওয়ার দোয়া করে মনে মনে।উমাইরের মুখশ্রীতে রাগ স্পষ্ট।এসি চালু করে উমাইর।চেয়ারে বসে তাহুরাকে বলে,
–“তুমি আমার স্টুডেন্ট না এখন।রিল্যাক্স হও।”

তাহুরা ওড়না দ্বারা ঘাম মুছে নাকের।উমাইরের দিকে দৃষ্টি মেলে।মেয়েটার চোখ অত্যধিক আকর্ষণীয়।সাথে সেই চোখে ভয় বিরাজ করলে আরো মন কাড়ে।

তাহুরা ছোট সুরে আওড়ায়,
–“ঠিকাছি আমি।”
–“এক্সাম কেমন হয়েছে?”
–“ভালো।”
তাহুরা একটু হাসার চেষ্টায়।
তার হাসি অবলোকন করে উমাইর নিজের অধর প্রসারিত করে।পুনরায় হাত মুঠো করে টেবিলে রাখে,
–“এমন জায়গায় ফের আসবে না। বড় বোন এসেছে কেউ?”
তাহুরা দুদিকে মাথা নাড়ে,
–“আয়মা ক্লাস এইটে পড়ে আর শায়ন ফাইভে।”
–“মানে তুমি এদের সাথে একা বেরিয়েছো? সাহস দেখছি অনেক তোমার।”
উমাইরের কণ্ঠে জেদ।
–“আমি ভাবতে পারিনি এইখানে এমন মানুষ হবে।”
তাহুরার ভীত সুর।
–“যা ভাবতে পারো না, তা করতে যেও না।এইখান থেকে সোজা বাড়িতে যাবে।ইমনের বাসায় কে আছে আর?”
ফের প্রশ্ন করে উমাইর।
–“ইমন ভাইয়ার মা,বাবা, আয়মা,শায়ন।আমার নানু আর আপু।”
এসির ঠান্ডায়ও কেমন ঘেমে যাচ্ছে তাহুরা।আবারও নাকে ওড়না স্পর্শ করে। ঘাম মুছে।মেয়েটার সরলতায় উমাইর হাসে গোপনে।টিস্যুর বক্স এগিয়ে দেয়।উমাইরের ইশারা বুঝে টিস্যু নেয় তাহুরা।সেটা নাকে চেপে ধরে।

–“তোমার আপুর সাথে থাকবে সবসময়।ইমনের সাথে একা কোথাও যাবে না।ঠিকভাবে থাকবে। বুঝেছো?”
উমাইর নির্দেশনা দিলে তাহুরা মাথা নাড়ায় উপর নিচ।

তাহুরার পানে দৃষ্টি স্থির রেখে উমাইর খাবার অর্ডার করে।তাহুরা প্রথমে নারাজি হলেও, পরে উমাইরের তীক্ষ্ণ চাহনিতে রাজি হয়। পিজ্জায় কামড় দিয়ে হাসিখুশি ভঙ্গিতে সে উমাইরকে বলে,
–“স্যার,আপনি খাবেন না?”
কি নিঃসংকোচে প্রশ্ন!অন্তরে প্রশান্তির জোয়ার বয়ে যায় উমাইরের।উমাইর কল্পনায় ডুবে।”স্যার আপনি খাবেন না?” এর স্থলে যদি “উমাইর,আপনি খাবেন না?” কথাটা বলে তাহুরা,উমাইর তো সুখেই শান্তিরাজ্যে চালান হবে।

–“খাবো।তুমি খাও।”
মনে তার বেহাল দশা হলেও।মনের হামলাকারীকে কিছু বুঝতে দিচ্ছে না উমাইর।মেয়েটাকে জর্জরিত করতে তার ভালো লাগে।সুখ অনুভব হয়।এছাড়া এখন,ভালোবাসা প্রকাশের সময় আসেনি।সময় এলে সব ঘাটতি একেবারে পূরণ করবে উমাইর।এই বোকাপাখিটাকে উমাইর কাউকে দিবে না।নিজের মনের পিঞ্জিরায় আটকে নিবে তাকে সারাজীবনের জন্যে হালাল করে।

তাহুরার সহিত উমাইর খাওয়া শুরু করে।উমাইর খেয়াল করে পিজ্জার স্লাইস সে তিনটা খেলেও,তাহুরা এখনো সেই প্রথম স্লাইস যত্নের সাথে খাচ্ছে।মেয়েটার সবকিছু উমাইরের আদর লাগে।তবে,উমাইরের বলিষ্ঠ দেহ অপেক্ষা তাহুরা বেশ ছিমছাম গঠনের।মনোরম মেয়েটার প্রত্যেকটা ভঙ্গি।

উমাইর মোবাইলে দৃষ্টিপাত করলে, হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা চেক করতে যায়।সেখানে অন্যজনকে খুঁজতে গিয়ে তাহুরার নাম্বারে চোখ পড়ে উমাইরের।গলা শুকিয়ে আসে মুহূর্তে।
তার বোকারাণী শাড়ি পরিহিত। মেয়েলী অবয়বের প্রত্যেকটা খাঁজ স্পষ্ট।আকর্ষিত করছে উমাইরকে। তাহুরা এমন ছবি কেনো দিয়েছে? রাগ নিবারণ করা দায় তার।নিশ্চয় তার ভাই সকলের নাম্বার আছে মেয়েটার মোবাইলে!সবাই মেয়েটার এমন রূপ দেখবে তা মানতে নারাজ উমাইর।
টেবিলে সজোরে আঘাত করলে কেঁপে উঠে তাহুরা। ভীত দৃষ্টিতে উমাইরের পানে তাকালে উমাইর তার দিকে মোবাইল তাক করে,
–“হোয়াট ইজ দিস?”(এটা কি?)
তাহুরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।স্যারের কাছে এই ছবি কেমনে?এছাড়াও হালকা দৃষ্টিকটু লাগছে তাকে দেখতে।স্যার কি তাহুরাকে বাজে মেয়ে ভাবছে?তার আপু ঘুরে ফিরে এই ছবি দেওয়ার কথা তো না।ইমন আসলে তাড়াহুড়োয় কি সুনেরা ভুল ছবি দিয়েছে!হ্যাঁ,এমনটাই হবে। ছবিটায় কেবল আঁচল সামান্য চেপে থাকায় কিঞ্চিৎ কটু লাগছে,বাদবাকি তাহুরাকে ভালো দেখাচ্ছে।তবে,উমাইরের নিকট এই কিঞ্চিৎ কটু যেনো আকাশসম।

–“এটা…কই পেলেন স্যার?”
–“হোয়াটস অ্যাপের প্রোফাইল তোমার!মোবাইল দাও।”
তাহুরা লক খুলে ঝটপট স্যারকে দেয়। সন্ধ্যায় তাহুরা রেডি হওয়ার সময় সুনেরা তার মোবাইল নিয়েছিলো, তখন মনে হয় এই প্রোফাইল সেট করে!
উমাইর সর্বপ্রথম তাহুরার প্রোফাইল সরিয়ে সাধারণ ছবি দেয়।নাম্বারে লিস্টে তার নাম্বার সহ আটজনের নাম্বার পেলো।তাও কেনো যেনো শান্ত হতে পারছে না।আঁখিতে ভেসে উঠে তাহুরার সেই ছবি।নিবরাসের নাম্বারও আছে।

তাহুরাকে মোবাইল ফিরিয়ে দেয় উমাইর।সঙ্গে সঙ্গে ধমকে উঠে,
–“এমন ছবি ফের দিবে না।নিবরাস আছে তোমার কন্ট্যাক্ট লিস্টে। সময় এলে শাড়ি পড়ে কূল পাবে না।”
–“দি না তো স্যার।আপু,ভুলবশত দিয়েছে মনে হয়।ইমন ভাইয়া এসেছিলো সন্ধ্যায়।তখন আপু তাড়াহুড়োয় ভুল ছবি প্রোফাইলে দিয়েছে আর খেয়াল করেনি হয়তো।”
দ্বিধাযুক্ত স্বীকারোক্তি তাহুরার।মেয়েটার কান্নারত উক্তি ভালো লাগছে উমাইরের। বোকা বোকা কান্না।

কখনো মেয়েটা জরুরি কিছু নিয়ে কান্না করলে হয়তো উমাইর সেই কান্না উপভোগ করতে পারবে না। প্রেয়সীর অশ্রুতে তখন উমাইরের অন্তর ক্ষুন্ন হবে ঠিক।
বস্তুত এই মুহুর্তে উমাইর তাহুরার রক্তিম নাক,চোখ উপভোগ করছে।

তাহুরা ওড়না দ্বারা চোখ মুছতে গেলে,উমাইর পুনরায় ধমকে উঠে,
–“টিস্যু দেখো না?”
–“ভুলে, স্যার।”
মেয়েটা ভাঙা গলায় জবাব দেয়।

–“তোমার সব ছেলে কাজিনদের সাথে ফর্মালিটি অনুযায়ী কথা বলবে।অযথা ঘুরাফিরা করতে দেখলে খবর করে ছাড়বো।তুমি আমার দৃষ্টিতে বন্ধী।”
উমাইরের উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে তাহুরা দমে যায়।কেনো উমাইরের দৃষ্টিতে সে বন্ধী এই প্রশ্ন করা হয়নি তার।আর না কখনো করা হবে।দেখা যাবে,তর্ক করার জন্যে উমাইর তাহুরাকে দুকান ধরিয়ে মাঠে দাঁড় করিয়ে রাখবে!বোনকে ছাড়া কারো সাথে ঘুরতে যাবে না সে কোনোদিন।ভাইয়ারা জোর করলেও,আপুকে সঙ্গে নিয়ে যাবে সে।
–“আপুকে নিয়ে যাবো সব জায়গায়,স্যার।”
হিচকি উঠে তাহুরার।

উমাইর পানি এগিয়ে দেয় তাহুরার পানে।নিজে চেয়ার ছাড়ে।তাহুরার নিকট দাঁড়িয়ে টেবিলে একহাত রেখে হালকা ঝুঁকে সে,
–“পানি খাও।”
তাহুরা তার কথামতো কাজ করলে উমাইর আবারও আওড়ায়,
–“কলেজের বাহিরে আমি তোমার স্যার না,তুমিও আমার স্টুডেন্ট না।আমার কথা যেভাবে মেনে চলো,সেভাবে কারো কথা শুনে চলার দরকার নেই।বাহিরের ছেলেপেলেদের সাথে কথা বললে সেখানেই বেঁধে রাখবো, আমার বাড়ি নিয়ে যাবো।বারবার বলছি,আমার বিশেষ নজর আছে তোমার উপর।”

–“বলি না,স্যার।”
বোকা মেয়েটার গাল ভেসে যায় অশ্রুজলে। এতো ইঙ্গিতের কিছুই টের পাচ্ছে না তাহুরা।মেয়েটার মাঝে এখন উমাইরের ভয় কাজ করছে।উমাইর সেটা জানে এবং বুঝে।তার বোকাপাখির অন্তরে জায়গা দরকার উমাইরের। ধীরে ধীরে উমাইর সেটা হাসিল করবে।তাই এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে উমাইর তাহুরাকে নরম সুরে বলে,
–“আমার কথাগুলো মাথায় সেট করে নাও।উমাইরের জীবনে তোমাকে স্বাগতম।এটা কিন্তু অন্যরকম ওয়েলকাম।”

তাহুরা পাশ ফিরে মাথা উঁচু করে তাকায় উমাইরের পানে।সুদর্শন লোকটা তাহুরাকে আজ কেনো এমন যত্ন করছে আবার বকছে?উত্তর জানেনা তাহুরা।এইসব কথা আবার কাউকে বলা যাবে না।ভারী লজ্জার ব্যাপার।
তাহুরা পলক ঝাপটে জবাব দেয়,
–“বুঝিনি স্যার।”
–“মাথামোটা তুমি,বুঝবে কিভাবে? খাবার শেষ করো।সব খাবে।”
এতো খাবার তাহুরার একা খাওয়া অসম্ভব।তাও তাহুরা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে।

উমাইর আবারও তাহুরার সম্মুখ চেয়ারে বসে।মেয়েটা ফুঁপিয়ে খাচ্ছে।এক মিনিট বাদে এই ফোঁপানো বন্ধ হবে উমাইর জানে।মেয়েটার কান্নারত রূপে আবারও ঘায়েল হয় প্রেমিক পুরুষ।মনে মনে আওড়ায়,
–” স্টুপিড রূপসী।”

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে