রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব-০২

0
1206

#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব:২
_______________
–“উমাইর সাহেব,এই ভাঙা মোবাইলটা কি ফেলে দিবো?”
রুমে অবস্থানরত সোফায় বসে সু ঠিক করছিলো উমাইর।অত্র প্রশ্ন শুনে ঘাড় তুলে তাকায়।তাদের বাড়ির পুরাতন গৃহকর্তা আজিম দাঁড়িয়ে ভাঙা বাটন মোবাইলের দুই টুকরো নিয়ে।গত রাতে প্যান্টের পকেট হতে ভাঙা টুকরোদ্বয় ল্যাম্পশেডের টেবিলে রেখে আর সরানো হয়নি।ভাঁজ পড়ে তার মসৃণ ললাটে।ভারী স্বরে বলে,
–“নাহ। ঐখানে রেখে দিন।”
আজিম মাথা নাড়ায়।বাকি কাজ শেষ করে।তার প্রস্থান হলে উমাইর তার অফিস ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়ায়।
ইন করা শার্ট পুনরায় ঠিক করে।সুয়ের খটখট শব্দে এগিয়ে যায় ল্যাম্পশেডের টেবিলের সম্মুখে।সেটার আলাদা ড্রয়ার খুলে ভাঙা মোবাইল খানা রাখে।

গতকাল ইচ্ছাকৃত মোবাইলটা নিয়ে আসে সে।বহুদিন ধরে তাহুরার কিছু না কিছু জিনিস সংরক্ষণের চেষ্টায় ছিলো উমাইর।যাতে মেয়েটার সুবাসের অস্তিত্ব পায় তারই রুমে।তবে বিফল হলো।মোবাইল ফোন হতে সুবাস আসার ক্ষমতা নেই।তাও সন্তুষ্ট উমাইর।গোলাপ গাছের পর কোনো একটা জিনিস পেলো তাহুরার।হৃদয়ে সুখ মিলে উমাইরের।

চুলগুলো পুনরায় আঁচড়িয়ে হাতে ঘড়ির অস্তিত্ব রেখে বেরিয়ে পড়ে কামরা হতে।নাস্তা না নিয়ে বেরুনোর সিদ্ধান্ত তার।দেরী হচ্ছে সাথে মাঝরাস্তায় “রিও কফি” হতে একটা কফি কিনবে বলে ভেবেছে।
পথিমধ্যে দিলরুবাকে দেখে সে শুধায়,
–“নিবরাস কই?”
–“সে তো ঘুম।”
–“ওকে,আমি বেরুচ্ছি।”
উমাইর সোজা আসে গ্যারাজে।

গ্যারাজ হতে গাড়ি বের করতে গিয়েও করেনি।বাইকের দিকটা টানছে তাকে।হেলমেট হাতে নিয়েছে তখনই পাশে এসে দাঁড়ায় নিবরাস। হাঁপাচ্ছে সে।চমকিত গলায় প্রশ্ন করে উমাইর,
–“তুমি ঘুমিয়েছিলে না?”
–“মা না দেখে কথা বলে।রেডি হয়েই তো দৌড় দিলাম।”
হাঁটুতে দুহাত ভর দিয়ে বলে নিবরাস।
–“উঠে পড়ো।”
হেলমেট মাথায় মোটর বাইকে উঠে উমাইর।দেখাদেখি নিবরাসও একই কাজ করে।
রাস্তায় গাড়ির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে গতিবেগ বাড়ায় উমাইর।ফ্লাইওভারের এই পথে মোটর বাইক চালানো অন্যরকম এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি।

উমাইর মাঝরাস্তায় আর বাইক থামায়নি।দ্রুত কলেজের পানেই ছুটলো।অবাধ্য ট্র্যাফিক যেকোনো পরিকল্পনা ধ্বংস করতে যথেষ্ট।কলজে গেইটে পৌঁছালে লাফিয়ে নামে নিবরাস।পিঠের উপর ব্যাগ ঝুলিয়ে লম্বা কদমে সম্মুখে অগ্রসর হয়।
পার্কিং শেষে উমাইর তার চতুর্ভুজাকৃতি ব্যাগ নিয়ে মাঠের দিকে আসতে থাকে।ছাত্র ছাত্রীর কেউ কেউ তাকে “গুড মর্নিং,স্যার” বললেও মাথা নাড়ানো ব্যতীত অন্য শব্দ বের করেনি।খানিক দূরত্বে গেলে নজর থমকে যায় উমাইরের।তাহুরা তার সামনে।পিঠে বিদ্যমান লম্বা বেণী দুলছে। নৃত্যরত কোমরের উপর দোদুল্যমান বেণী বড্ড আকর্ষণীয়।নজর সরিয়ে নেয় সে মুহূর্তে।কিন্তু,বাকি সবাই কি নজর সরাচ্ছে? আশে পাশে দৃষ্টি ফেলে।অনেকে মেয়েটার হাঁটার দিয়ে চেয়ে।মেয়েটা এমনই যে।বোকাসোকা হলেও মারাত্মক চোখে লাগে।
কিছু একটা ভেবে উমাইর ফোন বের করে পকেট হতে।অতঃপর দ্রুত গতি বাড়ায় পায়ের,
–“লম্বা চুলের প্রতি জ্বীনদের আকর্ষণ বেশি।বেণী টেনে গায়েব করে।”

কড়া সুবাসে নাক বিমোহিত হয় তাহুরার।উমাইরের কণ্ঠ তার পরিচিত।এছাড়া তার সুঠাম অবয়ব দেখে নিশ্চিত হলো।ফর্সা লম্বাকৃতির লোকটা কানে ফোন চেপে চলে যাচ্ছে। তাহুরার টনক নড়ে।উমাইরের বলা বাক্যে ভেতরটা হাহাকার করে। জ্বীন তাকে দেখেছে কি? মিছেমিছি ঘটনা অহেতুক ঘটার পূর্বে পেছনের লম্বা বেণী টেনে বুকের বাম পাশে ছড়িয়ে দেয়। আওড়ায়,
–“আল্লা-হু লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল ক্বাইয়্যুম।লা তা’খুযুহু সিনাতুঁ ওয়ালা নাঊম….”(আয়তুল কুরসীর অংশবিশেষ)
দোয়া পড়তে পড়তে সে ক্লাসে যায়।চৈতালি,নিবরাস কথায় ব্যস্ত।সাথে ক্লাসের আরো দুইটি ছেলে- মেয়ে।
তাদের উপেক্ষা করে স্বাগতার নিকট বসে।

দোয়াটা পড়া মাত্রই শেষ করেছে।স্বাগতা তাকে দেখে প্রশ্ন করে,
–“ওরে বাবা,কি বলছিস?”
–“দোয়া পড়ছিলাম রে।”
তাহুরা মিষ্টি হেসে জবাব দেয়।চৈতালি যেনো তাদের কথায় কান দেওয়া।সে টেবিলের সামনে এসে বলে,
–“কিসের দোয়া?”
–“আমাকে জ্বীন না ধরার।”
তাহুরার সাবলীল বাক্যে নিবরাস এবং ক্লাসের কয়েকজন হেসে উঠলে মেয়েটা লজ্জা পায়।সাথে অস্বস্তি হয়।হাসি থামিয়ে নিবরাস হাত উঁচু করে,
–“হয়েছে গাইজ।চুপ কর এইবার।”
অনেকের হাসি থেমেছে অনেকের থামেনি।
নিবরাস সেই টেবিলে এসে হাত রাখে।স্পর্শ হয় স্বাগতার মোলায়েম হাতের সমেত।দ্রুত স্বাগতা হাত সরালেও নিবরাস সরায়নি।স্বাগতার লজ্জায় রক্তিম মুখশ্রী অবলোকন হলে অন্তরে তুফানের আভাস হয়।তাও নিজেকে সামলে নেয়।তাহুরার উদ্দেশ্যে বলে,
–“দিনদুপুরে জ্বীন আসবে না বোন।ভয় পাস না।”
–“পাচ্ছি না।”
তাহুরা জবাব দেয়।অধর প্রসারিত হয় তার।অমায়িক সেই হাসি দেখে পিছের এক ছেলে কেশে উঠে।অতএব বিলীন হয় তাহুরার হাসি।নিবরাস পিছে ফিরে বলে,
–“দিবো এক ঘুষি।”
–“থাক না।বাদ দে।”
ভীত সুরে বলে তাহুরা।পরপর সকলে নিজের বেঞ্চে বসে।স্যারের খোঁজ নেই।নিশ্চয় নোট প্রিন্ট করতে সময় নিচ্ছে।

সে চুপ থাকলেও চৈতালি এক বিশাল প্রশ্ন ছুঁড়ে,
–“আচ্ছা,উমাইর স্যারের সাথে কি আমাকে মানাবে?”

কি সাংঘাতিক প্রশ্ন!তাহুরা ভেবে অস্থির,এই স্যারের মাঝে সবাই কি পায়?ধমকের ভয়ে কি ওদের বুক কাঁপে না?যেমনটা তাহুরার কাঁপে?স্বাগতা কিছু বলার পূর্বে তাহুরা বলে,
–“স্যারকে তোর ভয় করে না!”
–“করলেও কি?এমন সুদর্শন ছেলের জন্যে ভয়ের চেয়ে ভালোবাসা বেশি পায়।”
–“তুই যা বেটে উনার পাশে তোকে পুচকি লাগবে।তাহুরার হাইট সুন্দর পাঁচ’তিন”।টল ফিগার উমাইর স্যারের সাথে তাহুরার উচ্চতার মেয়েই দরকার।মেয়ে উনার বুক সমান হবে কিন্তু দেখতে খুবই আদুরে।”
স্বাগতা হেসে উঠে।
কান গরম হয় তাহুরার।কিসব মিলাচ্ছে তারা?গাল জোড়া কেমন জ্বলছে তার।স্বাগতার হাত চেপে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
–“ছি!এমন বলিস না।”

–“এই একদম ছি বলবি না।তারিফ শুনে কোন মেয়ের ভালো লাগে না?তোকে উমাইর স্যারের পাশে মানাবে বলছে মানে বুঝছিস তুই?”
চৈতালি কপট রাগী।তার চোখে চোখ রাখে তাহুরা।বুঝবে না কেনো?তাহুরা কি খুঁকি?সরল মনের বলে এইসব কথা কি বুঝেনা?।ঠিকই বুঝে,বেশ ভালো বুঝে।তাই বলে উমাইর স্যারের সাথে তার তুলনা!
–“বুঝবো না কেনো?উনি ছাড়া অন্যকেউ হলে আমি মানতাম।কিন্তু এই রাগী স্যারের মাঝে কি পাস তোরা?সুন্দর বলেই কি তার রাগী ভাব তোদের ধরা দেয় না?”
উত্তেজিত তাহুরা ফটাফট কথা বলে।এইভাবে কিন্তু মেয়েটা যথেষ্ট শান্ত।

–“রাগী ছেলের মাঝে আলাদা অ্যাটিটিউড থাকে।ওরা আবার কেয়ারিং হয়।আমার বিশ্বাস উমাইর স্যার নিশ্চয় কেয়ারিং হবে উনার বউয়ের প্রতি।”
উত্তর দেয় স্বাগতা।
চৈতালি কিছু বলতে চায়।থামায় তাকে তাহুরা,
–“আর না।এখন স্যার আসবে হয়তো।বই বের কর।”
আর ডানে বামে তাকায়নি মেয়েটা।ব্যাগ হতে বই বের করে সেথায় নজর দিলেও মনটা শান্ত নেই।কিসের সাথে কি মিলিয়ে ফেললো বদ মেয়েগুলো?কোথায় উমাইর স্যার,আর কোথায় তাহুরা! বোকা মেয়েটা ব্যক্ত করতেও পারলো না,উমাইরকে দেখে তার হাঁটু কাঁপে।এইবুঝি গম্ভীর স্বরের কড়া এক ধমকে তাহুরা অজ্ঞান হবে!

প্রথম দুই ক্লাস হলেও শেষের ক্লাস হয়নি তাদের।অগত্য ক্যান্টিন হতে কিছু ভাজাপোড়া খাবার নিয়ে তাহুরা,চৈতালি এবং স্বাগতা বসলো মাঠের কিনারায় আম গাছটার নিচে।ভাজাপোড়া খেয়ে বেরিয়ে পড়বে তারা বাড়ির উদ্দেশ্যে।বিকালে আবার কোচিং আছে।এলোমেলো পবনে তাহুরার অবাধ্য চুলের বেহাল দশা।তার উপর বেণী সামনে রাখায় ব্যাপক বিপত্তিতে সে।কোনোভাবে বেণী একদিকে সরিয়ে কামড় দেয় সিঙ্গারায়।তার ছটফটে ভাব দেখে স্বাগতা শুধায়,
–“বেণী পিছে দে!”
মাথা নাড়ে তাহুরা।উমাইরের বলা জ্বীনের কথাটা চেপে গেলো।তবে স্মরণ করলো মনে মনে। মিছে হেসে বলে,
–“খারাপ লাগছে দেখতে?”
বাক্যে মেয়েটার আঁখিতে হানা দেয় দোটানা।

–“নাহ।তোকে আর খারাপ লাগবে!তুই যেমন থাকিস তেমনই সুন্দর লাগে।অদ্ভুত মোহনীয় এক ব্যাপার আছে তোর মাঝে।”
চৈতালি বলে।
তাহুরা মুখে বললো না কিছু।তার ভাষা ফুরায়।নিজের তারিফ শুনেও কেউ স্তব্দ হয়!

উমাইরের ব্যস্ত দিন আজ।অনার্সের ক্লাস আছে তার বিকাল চারটা অব্দি। দশ মিনিটের ব্রেকে বন্ধু রনির সাথে কথা বলতে বারান্দার দিকে আসে।ছেলেটা ফোন দিয়েছে বেশ কয়েকবার।উমাইর আবার ক্লাসে থাকাকালীন ফোন নিয়ে এতো ভাবে না।এক হাত রেলিংয়ে ঠেকিয়ে অপরহাতে মোবাইল কানে চেপে ধরে।রনি ফোন ধরতেই জানায় আজ বিকালের আড্ডার কথা।সবাই মিলে “জামালখান” দেখা করবে। সাড়ে চারটার পর থেকে আসবে সবাই।টাইমিং মেলার কারণে উমাইর সায় দেয়।

ফিরতে গেলে আঁখি আটকে যায় আম গাছের নিচে পা বটে বসে থাকা রমণীর পানে।ঠোঁটে হাত চেপে হাসছে মেয়ে।বেণী একপাশে দেওয়ার দরুণ ফুলে আছে সেই পাশ।মাঝে মাঝে আবার মুখে পড়া চুল কানে গুঁজছে। উমাইরের দ্রুতগামী হৃদয়ের শব্দ স্পষ্ট। বেণীকে হিংসে হচ্ছে তার।মেয়েটার রূপ এমন ঝাঁঝালো কেনো?পেছন থেকে বেণীটা সামনে এসেও রক্ষা পেলো না।উমাইর মিনিট এক ধরে চেয়ে রয়।পরক্ষণে খেয়াল করে তাহুরা উঠে দাঁড়ায়।ব্যাগ কাঁধে চাপে।
চৈতালি তাকে অনুরোধের সুরে বলে,
–“আরেকটু থাক?মেলায় যাবো।পাশেই হচ্ছে।”
–“মেলা আমার ভালো লাগে না দোস্ত।অনেক ভিড় হয়।আমার অসহ্য লাগে।”
তাহুরার সহজ জবাব।
–“তুই এমন কেনো?মেলায় ভিড়টা তো আসল মজা।”
মুখ কুঁচকে বলে স্বাগতা।
–“অচেনা লোকদের সমাগমে আমি আনইজি ফিল করি ভাই।আমি বাসায় ঠিক আছি।কোচিং আছে বিকালে।গেলাম।”
অধর প্রসারিত করে তাহুরা।হাসলে মেয়েটার চোখ বুঁজে সামান্য।কি মনোরম দৃশ্য!চৈতালির মনটা নরম হয়।এমন আদুরে হাসলে কেউই রাগতে পারবে না বলে গ্যারান্টি দেয় সে।তাহুরার গাল টেনে বলে,
–“কোচিংয়ে দেখা হবে তবে।”
ধীরে সুস্থে হাঁটতে আরম্ভ করে তাহুরা।

উমাইরের নজর তার অবয়বে নিবদ্ধ।

চৈতালি এবং স্বাগতা উমাইরকে লক্ষ্য করলে ফোনে তাকিয়ে সরে পড়ে সে বারান্দা হতে।একতলার বারান্দায় দাঁড়ানোর কারণে সবটাই স্পষ্ট শুনেছে সে। ঐ তিন রমণী আড্ডায় ব্যস্ত হওয়ায় খেয়াল করেনি তাকে।তবে যখন চৈতালি,স্বাগতা খেয়াল করেছে উমাইরকে তখন তারা সেই রাগান্বিত উমাইর স্যারকেই দেখলো।তারা জানেই না,সেই স্তব্দ গম্ভীর মুখশ্রীর অধিকারী উমাইরের অন্তরে এখন উত্তেজনা।
ঘাড়ের উপরের ট্রিম করা চুলে হাত বুলায় উমাইর।হৃদয়ের শব্দ এখনো শ্রবমান।নিজ কেবিন রুমে ঢুকতেই বিড়বিড় করে সে বলে,
–“সরল,রূপসী,তাহুরা আমার ডিকশনারির সবচেয়ে প্রিয় তিন শব্দ।”
.
দুপুরের খাবার মায়ের হাতে খেলো তাহুরা।কলেজ হতে এসে এনার্জি তার শূন্য। বাসে যাতায়াত তার পূর্বে পছন্দ না হলেও,সময়ের সাথে মেনে নিয়েছে।আজ প্রচুর ট্রাফিক ছিল।ফলস্বরূপ মাথা ব্যথায় জর্জরিত সে। মা খাইয়ে তাকে বিছানায় শোয়ায়।ধীরে মাথা মালিশ করে বলে,
–“খারাপ লাগে মা?”
–“একদম না।”
তাহুরা জড়িয়ে ধরে মায়ের কোমর। সেই সময় রুমে আসে সুনেরা। হাতে প্যাকেট।তাকে দেখে শিউলি বলে,
–“এসেছিস?হাত মুখ ধুয়ে নে। খাবার দিচ্ছি।”
–“আচ্ছা।”
মাকে জবাব দিয়ে সুনেরা পুনরায় তার বোনকে বলে,
–“এই উঠ।”
হেলেদুলে উঠে তাহুরা।ভ্রু নাচিয়ে বোনকে প্রশ্ন করে,
–“কি আপু?”
–“তোর জন্যে।”
প্যাকেট এগিয়ে দেয় সে তাহুরার পানে।খুশিতে আহ্লাদী তাহুরা ঝটপট প্যাকেট নেয় আর খুলে।
অত্যধিক সুন্দর কামিজ সেট।খুশিতে গদগদ হয় মেয়েটা,
–“অনেক সুন্দর তো আপু!”
–“তোর জন্যে নিলাম।তুই পড়লে আমার শান্তি লাগে।কোচিং শেষে জামালখান আসিস।আমি ভাত খেয়ে জামালখান যাচ্ছি,কাজ আছে।আমি থাকবো সেখানে। টেইলার্সে যাবো একসাথে।”
–“বরাবর সাড়ে পাঁচটায় থাকবে কিন্তু।”
অনুরোধ করে তাহুরা।
–“ওকে তাহু।”
সুনেরা ওয়াশরুমে চলে গেলেও তাহুরা বিছানা হতে নেমে আয়নার সম্মুখে দাঁড়ায়।কাপড় খানা গায়ের সাথে লেপ্টে রাখে।কি দারুণ কারুকার্য!খয়েরী রঙের উপর সোনালী জরি সুতোর কাজ।ওড়নার কাজটাও সুন্দর।মাথায় ঘোমটা দিয়েও দেখে সে। জামা সেটটি তার প্রিয় তালিকায় যুক্ত হলো।

তাহুরার কোচিং চকবাজারে।বাড়ি হতে দশ মিনিটের পথ হলেও,অলিগলি অনেক পার করতে হয়।তাই হেঁটেই যায়।রিক্সা নিলে ঝামেলা।চকবাজার ব্যাপক হট্টগোলের এলাকা।যেমন গাড়ির ঝামেলা তেমন মানুষের ছোটাছুটি।

কোচিং শেষে তাহুরা বোনকে ফোন দেয়।ততক্ষণে রিক্সায় চড়ে তাহুরা।রাস্তা ফাঁকা থাকায় দ্রুত পৌঁছাতে থাকে জামালখান।সুনেরা রাগ করে বোনের কাজে।মেয়েটা তাকে ফোন করে বের হওয়া দরকার ছিলো।জামাখানে কাজ জলদি শেষ হওয়ায় বাড়ি ফিরে আসে সুনেরা।ভেবেছে তাহুরা ফোন দিলে একত্রে আসবে।যায় হোক,বোনকে অনুরোধ করে বলে জামালখান নেমে মোড়ে দাঁড়াতে।দ্রুত বেরুচ্ছে সে।
—-
আড্ডা জমেছে উমাইরদের।একেকজনের কথায় হেসে কুটিকুটি সকলে। হাতে ওয়ানটাইম কাপ।আড্ডার মাঝে চা অবশ্যই জরুরি।মূলত চারজন তারা।উমাইর,রনি,বাপ্পি,রকি।তারা বহুকাল ধরে বন্ধু।একযুগ পেরিয়েছে।বাপ্পি,রকি বিবাহিত।রয়ে যায় উমাইর এবং রনি।তারা বৃত্তাকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে।চারিদিকে মানুষের আনাগোনা একটু কম এই সাইডে।অথচ একটু সামনে মানুষের যতো ভিড়।সেই ভিড় উপেক্ষা করতে বাপ্পির গাড়ির সম্মুখে আড্ডার জন্যে স্থান নির্ধারিত করে।সোডিয়াম আলোতে ব্যাপক ঝলমল পরিবেশ।সন্ধ্যা নামার পূর্বে কৃত্রিম আলোয় মুখরিত হয় এলাকা।
উমাইর অফিসের বেশে নেই।ইন করা শার্ট সমান্তরাল করেছে প্যান্টের উপরে। বটে রাখা ফুল স্লিভ কব্জি পর্যন্ত টেনেছে। সোডিয়াম আলোতে তার গাল,হাত চকচকে।
আড্ডার এক পর্যায়ে হাসে বাপ্পি।খোঁচা মেরে বলে,
–“রনির বিয়ে সামনে।শুধু আমাদের উমাইর রয়ে গেলো। কিরে সমস্যা কি তোর?”
–“কিসের সমস্যা?”
চায়ের কাপে চুমুক দেয় উমাইর।
–“মানে প্রেম করস না,বিয়েও করতেছস না।তোর কি ইন্টার্নাল প্রবলেম আছে কোনো?”
রকি প্রশ্ন করে।সে একটু সিরিয়াস।

–“লাইক হোয়াট?”(মানে কেমন?)
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে উমাইর।বিরক্ত হচ্ছে খানিকটা।
–“ধুর ব্যাটা রকি।আমাদের উমাইর গভীর,গম্ভীর। শালাটা মেয়ে ঠিক করে রেখেছে আমি শিউর।একশো পার্সেন্ট।”
আড্ডায় সিরিয়াস অবস্থা জাহির হয় রনির কথায়।
–“কাহিনী কি বল তো?হঠাৎ আমার পিছে লাগলি কেনো?”
চা শেষে উমাইর কাপ রাখে গাড়ির সম্মুখ পার্টে।
–“তোর বিয়ে খেতে চাই।”
তিন বন্ধু একসাথে বলে উঠে।

তাদের বিচলিত ভঙ্গি দেখে হেসে উঠে উমাইর।ঘাড় উচুঁ করে হাসে।অট্টহাসিতে মুখরিত।তার চাপ দাড়িতে আবৃত চোয়ালের চামড়া দুদিকে প্রশস্থ হয়,
–“এই কথা বলতে এতক্ষণ?”
–“বল না,তোর মনে কি চলে?”
বাপ্পি জিজ্ঞাসা করে।
–“কি চলবে?”
উল্টো প্রশ্ন করে উমাইর।
–“আরে শালা কাহিনী করস কেন?বল না।”
–“আর দুই বছর আছে হয়তোবা।”
ভাবলেশহীন উত্তর দেয় উমাইর রকির কথায়।

–“এরমানে তুই ঠিক রেখেছিস সবটা।”
বাপ্পি বলে।
–“আমি জানতাম এই ব্যাটা তলে তলে কাজ চালায়।কে সে?আমাদের ব্যাচের নাকি জুনিয়র?”
রকির প্রশ্নে উত্তর দেয় না উমাইর।কেবল বাঁকা হাসে,
–“ভার্সিটি ক্যাম্পাসে যাকে দেখেছিলাম! শব্দ করে কাঁদছিলো।ফুচকার ঝালে অতিষ্ট হয়ে নাকের পানি চোখের পানি এক করে অস্থির হওয়া মেয়েটা।”
সহজ,গম্ভীর,পবিত্র স্বীকারোক্তি উমাইরের।তিন বন্ধু অবাক।কি বললো উমাইর?অবশ্য ভার্সিটির সেদিনের কথা আজও মনে আছে তাদের।উমাইর সেদিন অদ্ভুত প্রশ্ন করেছিলো,
–“দোস্ত, ঐ থ্রিপিস পড়া মেয়েটার কান্না কি তোদের সুন্দর লাগছে?”
যেই ছেলের আশপাশ সুন্দর ম্যাচিউর রমণীর আগমন,সেই ছেলে যখন প্রথম এমন কথা বলে অত্র দিন কিভাবে ভুলবে তারা?এরপর হতে বন্ধু মহল প্রায় ঠেস মেরে কথা বলতো উমাইরকে।কিন্তু সে রেগে যাওয়ার বদলে মুচকি হাসতো।তখন কেউ কিছু না বুঝলেও আজ সব জলের মতো পরিষ্কার।

–“ঐ কাঁদুনে মেয়েটা?খুঁজে পেয়েছিস?আমাদের চেয়ে বেশি ছোট না?”
বাপ্পি প্রশ্ন করে।
–“হ্যাঁ।সেদিন হতে পাঁচদিন পর খোঁজ পেয়েছিলাম।বাড়ির নাম,তার নাম,কিসে পড়ে এটাই যথেষ্ট আমার জন্যে।”
গুছিয়ে জবাব দেয় উমাইর।
–“বাড়ির মানুষজনের খোঁজ নেসনি?”
–“তার বাড়ির মানুষের কথা আমার কাজ কী জেনে?আমার ওকে দরকার,ওর বাড়ির মানুষকে না।”
আবারও বলে উঠে উমাইর রকির কথায়।

–“তুই মামা সেরা।পুচকি মেয়ের প্রেমে আমাদের উমাইর।ঊনত্রিশ বছরের জীবনে উমাইর এই প্রথম সুখবর দিয়েছে।”
রনি হাসে।তার হাসিতে আড্ডার পাল্লা ভারী হয়।উমাইরকে জেঁকে ধরে তারা।
.
–“আপু,আমি একটু গলির ভেতরে।অতুল ভাই আমাকে বিরক্ত করছে।”
তাহুরার চোখে পানি।
–“হ্যাঁ আসছি।বেরুনোর সময় ওড়না ছিঁড়েছে দরজার সাথে লেগে। ঐ অতুলের বাচ্চাকে আমি শিক্ষা দিবো।ভয় পায় না। কারো পাশে দাঁড়া।লাইন কাটিস না।”
সুনেরা যতদ্রুত বেরুনোর চেষ্টায়।কিন্তু,দুর্ভাগ্য যে আজ যেনো সময় ফুরাচ্ছে না।

হঠাৎই কাধে স্পর্শ করলে কেউ তাহুরা চিৎকার দেয়,
–“আপু!”
সুনেরা শুনলো না।সে বাথরুমে,খেয়াল হলো তার হাতের তালুতে কাদা।ওড়না ছিঁড়লে তা ঠিক করার সময় মাটিতে পড়ে আর সেটা নিতে গিয়েই হাতে কাদা লাগে।

মেয়েলি আর্তনাদ আর কণ্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকায় ওরা চারজন।কিছুদূরে ল্যাম্পপোস্টের নিচে দৃশ্যমান তাহুরার অবয়ব।পিছে এক অজানা ছেলে।উমাইরের মাথা কাজ করা বন্ধ হয়।কিছু না জানিয়ে সে ধুপধাপ পা ফেলে সম্মুখে যাচ্ছে।

রনি অস্ফুট সুরে বলে,
–“সেই পুচকি মেয়েটা না?”
–“আমাদের উমাইর মামার রূপসী।মেয়েটা ব্যাপক সুন্দরী হয়েছে।আগের মতো চেহারা হলেও,এখন ম্যাচিউরিটি স্পষ্ট।”
সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে উত্তর দেয় রকি।
–“দাঁড়িয়ে দেখি।উমাইর আবার রাগ করবে ওর কাজে হাত দিলে। ঐ পেছনের শালার কপালে দুঃখ আছে।”
বাপ্পি বলে।

–“তাহুরা?”
উমাইর নিজে প্রশ্ন করে নিজেই তাহুরাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে।কান্নারত তাহুরা হুট করে উমাইরের পিছের শার্ট খামচে ধরে।তাড়াহুড়োতে বোনের ফোন কেটেছে তার হদিস নেই মেয়েটার।এইদিকে কোচিং থেকে বেরিয়ে ফোন জেনারেল করেনি সে,তাই জানেও না সুনেরা ফোন দিচ্ছে। জামালখানে অনেক অলিগলি। সুনেরা এই এলাকায় এসেও বুঝতে পারছে না জামালখানের কোনদিকে আছে তার বোন।লোকেশন কাজ করবে বলে মনে হয় না।গলির সংখ্যা প্রচুর।

–“আপনি কে?এই তাহুরা লোকটা কে?”
অতুলের কণ্ঠে তেজ।তাহুরাকে উমাইরের পেছন হতে বের করতে চাইলে উমাইর অতুলের হাত চেপে ধরে,
–“আপনি কে?”
ভয়ঙ্কর কণ্ঠ উমাইরের।
–“তাহুরার সাথে আমার সম্পর্ক…”

–“নাহ। মিথ্যে কথা।আমাকে ডিস্টার্ব করে লোকটা।”
গালে জল ছেপে যাচ্ছে তাহুরার।উমাইরের মাথার রক্ত টগবগে।ঘাড় চেপে ধরে অতুলের,
–“ওর মতো মেয়ের ডেফিনেশন তোর থেকে নিবো?ভাগ!নাইলে আস্তো রাখবো না।”

–“মেয়েটাকে আমার…”
অতুল কিছু বলতে নিলে ঘুষি পড়ে তার নাক বরাবর।উমাইর ফের ঘুষি দেওয়ার জন্যে উদ্যত হয়েও দেয়নি,
–“আর কোনোদিন যদি এই মেয়ের থেকে তোর নামে অভিযোগ পাই সোজা জেলে যাবি।আর এখন জনগণের হাতে ছেড়ে দিবো?”
আশেপাশের লোকের সমাগমকে উদ্দেশ্য করে বলে উমাইর।ভয় পায় অতুল। এইভাবেও সে ভীতু প্রকৃতির।
–“ডিস্টার্ব করবো না আর।”
প্রস্থান ঘটে অতুলের।আজকের দিনটা সে কখনো ভুলবে না।কি অপমানজনক!
অতুল গেলে ভিড় কমে।

উমাইর দূরে দাঁড়ানো বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে তাহুরাকে বলে,
–“এইখানে কি?”
–“আপু আসবে।”
কম্পিত কণ্ঠে উত্তর দেয় তাহুরা।উমাইর পকেট হতে টিস্যু বের করে।এগিয়ে দেয়,
–“কাঁদে না। সব ঠিকাছে।একা যেতে পারবে?”
টিস্যু নেয় তাহুরা। নাক মুছে।মাথা নাড়িয়ে বহু কষ্টে বলে,
–“সরি স্যার।”
উমাইর হালকা শব্দ করে হাসে।তাহুরা মাথা উঠিয়ে তাকায়।এই গেটআপে কখনো দেখেনি সে উমাইরকে।অন্যরকম লাগছে তাদের স্যারকে।সোডিয়াম আলোতে স্যারের জ্বলজ্বল দৃষ্টিটাও প্রখর। লম্বাটে আকৃতিটা মন চুরির জন্যে যথেষ্ট হলেও বোকা তাহুরা ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে ফের বলে,
–“যাচ্ছি আমি।”
পরক্ষণে মনে আসে আপু ফোনে ছিল।মোবাইলে তাকিয়ে দেখে ফোন আসছে আবারও।রিসিভ করার পূর্বে উমাইর বলে উঠে,
–“ছেলেটার ব্যাপারে চিন্তা করো না আর।আমি দেখে নিবো সবটা।অ্যান্ড চলো,আমি দিয়ে আসি তোমাকে।”
–“সরি স্যার,আমার জন্যে আপনার কষ্ট হলো।”

অতঃপর উমাইরের উত্তরের অপেক্ষা না করে বোনের ফোন রিসিভ করে দৌড়িয়ে যেতে যেতে বলে,
–“আপু অতুল ভাইকে আমার স্যার মেরেছে।গলিতে এসো না।আমি মোড়ে আসছি।”

উমাইর অপলক চেয়ে আছে ঘোমটা দেওয়া শুভ্র মেয়েটার পানে।তাহুরা গেলে উমাইর ফিরে বন্ধুদের নিকট।
–“তোকে থ্যাঙ্ক ইউ না বলে সরি বলেছে কেনো?”
বাপ্পির কথায় তির্যক হাসে উমাইরের,
–“সরি বলেছে আমার কষ্ট হয়েছে মনে করে।তবে,কষ্ট এখন হবে।আমার না ঐ ছেলেটার।”
পরক্ষণে তার মুখশ্রীর ভঙ্গির পরিবর্তন হয়।কণ্ঠে আক্রোশের আভাস। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–“আমার বোকাপাখিকে জ্বালাতন করার অধিকার শুধু আমার।আর কারো না।”

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে