রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব-৩৩+৩৪

0
1217

#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব-৩৩
__________________
–“তুমি এমন অবস্থায় ঘুরতে যাওয়ার বায়না করছো আপু?সাথে আমাকে নিতে চাচ্ছো!বাবা জানলে বকবে।”
বোনের মাথায় তেল মালিশ করা অবস্থায় জবাব দেয় তাহুরা।মূলত সুনেরার তীব্র ইচ্ছা ঘুরতে যাবে দূরে কোথাও।তাই সে বোনকে আবদার জারি করলো।জুবায়েরকে রাজি করানো তার মিনিটের ব্যাপার।যতো সমস্যা করে সব তার ছোট বোন।তাই ইনিয়ে বিনিয়ে বোনকে রাজি করানোর চেষ্টায় সুনেরা।তবে,বাঁধ সাধে তাহুরা।মেয়ের মনে বাবার ভীতি।

–“ধুর,বাবা বকার কি?আফিয়া, নিবরাস,মা,বাবা,চাচা, চাচী সবাই যাবে আমার বিশ্বাস।”
সুনেরা বলে উঠে।
–“তোমার দেবর যেতে দিবে আমায়?”
প্রশ্ন করে তাহুরা।সাথে ঘড়ির পানে তাকায়।উমাইর আসার সময় এখন।আজ তাহুরার ছুটি হয়েছে দুপুরে।তাই সে আগে ফিরে।
বোনের বিরক্তির শব্দে তাহুরার দৃষ্টি নড়ে।শুনতে পায় বোনের কথা,
–“উমাইর ভাইয়া যাবে।উনি ট্রিপ পছন্দ করে অনেক।আর আমরা যাবো কাপ্তাই। খুব কাছে।একদিন ঘুরতে গেলে দুনিয়া অশুদ্ধ হবে না।”
বোনের খিটখিট জবাবে তাহুরা হাসে।বোনের মাথার তালুতে আঙুল ঘষে,
–“আচ্ছা বেশ।আমার সমস্যা নেই।ঘুরতে যেতে আমি খুব পছন্দ করি আপু।তুমি কিন্তু জানো।শুধু মানুষগুলো আমার বেশ কাছের হওয়া প্রয়োজন।”
বোনকে মন খুলে উত্তর দেয় তাহুরা।

সুনেরা হাসে।আদরের বোনকে রাজি করাতে পেরে বড্ড খুশি সে।আহ্লাদিত সুরে বলে,
–“ইয়েস।সবাই যাবো,খুব মজা হবে।”
–“হ্যাঁ,আপু।”
তাহুরা বোনের মাথা মালিশের কাজ শেষ করে।হাত ধুয়ে ফের বিছানায় বসলে উমাইরের সুর ভেসে আসে,
–“তাহুরা…”

বোনের পানে দৃষ্টি তাহুরার। সুনেরা আলগোছে বলে উঠে,
–“যা।ভাইয়াকে কিন্তু এখন জানাবি ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে।”
–“আচ্ছা।”
মৃদু স্বরে জানায় সরল মেয়েটা।

মাথায় ওড়না চাপে তাহুরা।দ্রুত কদম ফেলে।কক্ষে প্রবেশ হলে অবলোকন করে উমাইরের থমথমে মুখশ্রী।তাহুরার উপস্থিতি টের পেয়ে উমাইর ইশারায় তাকে কাছে ডাকে।তাহুরা ইশারার পালন করে।

নিকটে এলে তাহুরার হাত টেনে ঠেকায় তার শার্টের বোতামে।রোজের ন্যায় তাহুরা শার্টের বোতাম খুলে দেওয়া অবস্থায় জিজ্ঞাসা করে,
–“নাস্তা এইখানে করবেন?নাকি নিচে?”

উমাইর সটান দাঁড়িয়ে।তাহুরার ঘোমটার আড়ালে বিদ্যমান ঘাড়ে হাত ছোঁয়ায়,
–“নিচে।মামী আসবে,মা আর মামী বেরুবে।মামীর সামনে নিজেকে অবিবাহিত দেখানোর দরকার নেই। রুমে বিনা দ্বিধায় আসবে।”
–“মামী জানলে আপনার সমস্যা…”
কথা পূর্ণতা পাওয়ার পূর্বে তাহুরার অধরের দখলদার উমাইর হয়।সাধ পূরণ হলে সেথায় উমাইর আরো দুখানা প্রেমময় স্পর্শের বিচরণ ঘটায় আবারও,
–“আমার বউ আমার সুখ।সমস্যা না।”
পরক্ষণে কপালে টোকা দেয় সে,
–“নাস্তা দাও।”

তাহুরা উমাইরের কোমরের দিকে শার্ট খিঁচে রয় তখনও।হুটহাট আক্রমনে অভ্যস্ত হলেও সামলানো দায় তার।লোকটার স্পর্শ ভারী স্পর্শ।
উমাইর হাসে।মোলায়েম ভঙ্গিতে প্রেয়সীর গালে হাত রাখে,
–“লজ্জা পেলে,লজ্জা ভাঙার উপায় বলবো?”
তাহুরা বুঝে।দু’কদম পেছনে আগায়।দ্রুত দরজার পানে ছুটে,
–“আমি নাস্তা দিচ্ছি।নিচে আসুন।”

উমাইর চেয়ে দেখে তার বউয়ের প্রস্থান।কক্ষের বাহিরে যাওয়ার সময় ঘোমটা টানতে ভুললো না তাহুরা। ঘাড়ে হাত বুলায় উমাইর।নিঃশব্দে অন্তর আওড়ায়,
–“আমার আদুরে।”
.
জাফরানের আগমনে ঘরের ভেতরকার অবস্থা রমরমা।সে এক দৌড়ে একূল,ঐকূল ছুটে যাচ্ছে।সাথে আছে তাহুরা।সে না দৌড়ালেও,জাফরানের সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়েছে।কাজ সেরেছে মেঘলার সমেত।তাহুরাকে এই বাসায় দেখে নম্রতা অবাক হয়ে বেশ প্রশ্ন করলো। যার অনেকটা জবাব মেঘলা দেয়।মেঘলা তাকে সাবধান করে উমাইরের সম্মুখে যেনো তাহুরা এই বাড়িতে আসার ব্যাপারে কিছু না বলে।নম্রতা সব স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় মেনে নেয়।
উমাইর ড্রইং রুমে মামার সাথে নিউজ দেখতে ব্যস্ত।টুকটাক আলোচনা করছে তারা নানান বিষয়ে। আড় দৃষ্টিতে অবশ্য সে তাহুরার অবস্থান বুঝে নিচ্ছে নিভৃতে।তার বউ জাফরানের সহিত যেনো আরেকটা বাচ্চা।দুষ্টু,নরম বাচ্চা।অধরে ভেসে উঠে তির্যক হাসি।এর মাঝে লক্ষ্য করে জুবায়ের আসে সেথায়।তৈরি সে পরিপাটি।মামার সাথে আলাপের সমাপ্তিতে ভাইকে শুধায়,
–“বাহিরে যাচ্ছি তোর ভাবীর সাথে।তাহুরা আর তুই যাবি?”

উমাইর মাথা নাড়ায় দুদিকে।গম্ভীর মুখে জবাব দেয়,
–“যাবো না ভাই।কলেজের কাজ আছে কিছু।”
–“তাহুরাকে দিবি আমাদের সাথে?”
জুবায়ের আবারও জিজ্ঞাসা করে।
–“নাহ।বাসায় থাকুক।”
উত্তরের সমাপ্তিতে আবারও উমাইর টিভির পানে মনোনিবেশ করে।

–” তোকে আমি কাপ্তাই ট্রিপের কথা বলেছি,সেখানে যেতে হবে অবশ্যই।”
ভাইয়ের কথায় উমাইর জবাব দেয়,
–“একবার বলেছি যখন যাবো,তখন অবশ্যই যাবো ভাই।”
উমাইর সহসা বলে উঠে।

–“তাহু আপু, সরি সরি।আর পানি ফেলবো না।”
জাফরানের আদো বুলিয়ে মনোযোগ ভাঙে উমাইরের। বসার ঘর হতে দৃষ্টিতে আসে তাহুরা জাফরানকে কোলে নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছে।কামিজের ডান পাশ ভিজে।তার অপর হাতে আবার পানির গ্লাস।তার চলনের গতিতে উমাইর বিরক্ত হয়।হাঁটতে তার অস্বস্তি হচ্ছে।মামার পাশ হতে উঠে পড়ে সে আলগোছে।

তাহুরা,জাফরানের সমেত পৌঁছে ডাইনিং এরিয়ায়।

আফিয়া এবং তার মা উমাইরকে আসতে দেখে অন্যদিকে যায়। মা চায় না,আফিয়া উমাইরের রাগী ভাষার শিকার হোক।তার ভাবভঙ্গি কঠোর।হয়তো এখন তাহুরাকে না সে বকে বসে। দিলরুবার আবার তাহুরার প্রতি মায়া আছে।সেই মেয়েটা যে নিতান্তই শান্ত এক পক্ষী।

–“সমস্যা নেই বাবু।কিছু মনে করিনি আপু।”
জাফরানকে চেয়ারে নামিয়ে কপালে চুমু দেয় তাহুরা।কিঞ্চিৎ হাঁপিয়ে সে।জাফরানের স্বাস্থ্যর উন্নতি হয়েছে পূর্ব হতে।

–“পানি খাও মাথামোটা।মেজাজ কেনো বিগড়াও আমার?হাঁপাচ্ছো কিভাবে!”
পেছন হতে হুমকি আসাতে নড়ে উঠে তাহুরা। উমাইরের অবয়ব স্পষ্ট।টিশার্ট এবং ট্রাউজারে আবৃত মানব বড্ড মোহনীয়।ফুলে থাকা বাহু কেমন আর্জি জানাচ্ছে সেথায় লুটিয়ে পড়তে!
পলক ফেলে তাহুরা।উমাইর তাকে বকছে আর সে অত্র লোকের রূপে মোহিত।
বুকে হাত রাখে মেয়েটা। হাঁপিয়ে জবাব দেয়,
–“আমি ঠিকাছি।”
–“দেখছি কতো ঠিক আছো।জাফরান বেবি তুমি কেনো আমার বউকে কষ্ট দাও?”
উমাইর গাল টানে জাফরানের।

জাফরান যেনো চকমিত।সে পরপর আওড়ানোর চেষ্টা করে,
–“বউ!”
–“পঁচা বাচ্চা।”
উমাইর নাক টানে জাফরানের।
–“কামিজ চেঞ্জ করো যাও।”
উমাইর নির্দেশনা দেয় তাহুরাকে।মেয়েটা দাঁড়ালো না আর এক সেকেন্ড। হতদন্ত পায়ে ছুটে।পেছন হতে উমাইর আবারও চেঁচায়,
–“আস্তে যাও।”

বুকের গতি অস্বাভাবিক।ধকধক শব্দে আলোড়িত।কেমন হুংকার করে লোকটা।কামিজ পরিবর্তন করে তাহুরা নতুন সুতির কামিজ জড়ায়।মিনমিনে সুরে শুধায়,
–“জলদস্যু শুধু চেঁচায়।”
পরক্ষণে আয়নায় নিজের বুকের উপরের দিকে দাগ নজরে এলে লাজে আড়ষ্ট হয়।সেই জলদস্যুর কিঞ্চিৎ ছোঁয়া,যত্ন,ভালোবাসার জন্যে তো মেয়েটার মন প্রাণ ছিন্ন হয় সর্বক্ষণ।রক্তিম হয়ে থাকা গালে হাত বুলায় সে।আপনমনে বলে,
–“আপনি আমার প্রাণপ্রিয় জলদস্যু,উমাইর।”

দরজায় ঠকঠক শব্দ হলে,উমাইর ভেবে তাহুরা দরজা খুলে জিজ্ঞাসা না করে।সম্মুখে মামীকে অবলোকন করলে আঁধার নামে তার মুখে।নম্রতা বেশ অবাক যেনো।মূলত মেঘলার কক্ষ হতে সে উমাইরের কক্ষে এসেছে একবার চেক করতে,জাফরান উমাইরের সাথে এই রুমে কিনা।তাহুরাকে এমন অবস্থায় লক্ষ্য করে নম্রতা প্রশ্ন করে,
–“তুমি কি করছো এই রুমে?উমাইর,জাফরান আছে?”
মেয়েটা কেবল মাথা নাড়ে। মিথ্যে বলতে সে জানে না।কি জবাব দিবে!
–“বলো তাহুরা,তুমি একা এই রুমে কি করছো?”

–“আমার বউ,আমার রুমে থাকবে না তো কই যাবে,মামী?”
উমাইরের সহজ জবাব।জাফরান তার মায়ের কোলে যায়।নম্রতার অবাক হওয়ার ভঙ্গি আকাশ স্পর্শী।যেনো বিশ্বাস করতে বিরাট কষ্ট,
–“কি বলছো?আমি জানিনা কেনো?আপা কিছু বলেনি আমাকে।আপাও কি জানে না?উমাইর এইসব কি ঠিক?”

–“মা থেকে ঘটনা জেনে নিবেন মামী।অ্যান্ড, আই হোপ,আপনি কথাটা নিজের মাঝে রাখবেন।ডিসেম্বরে এইভাবেও অনুষ্ঠান হলে তখন সবার জানা হবে।”
উমাইর মামীর উত্তরের অপেক্ষা করে না।সোজা কক্ষের ভেতর আসে।
নম্রতা অবাকের পাশাপাশি খুশি হয়।তবে,অভিমান করে মেঘলার উপর।কিভাবে এতোবড় সুখবর সে জানালো না তাকে!নম্রতা তার ব্যাগ হতে হাজার টাকার নোট বের করে।গুঁজে দেয় তাহুরার হাতে,
–“আপাতত এটা রাখো আমাদের উমাইরের বউ।আমি মেঘলা আপার সাথে হিসাব কষবো বাহিরে।এখন চুপ করে থাকি।”
নম্রতা হাসিমুখে জবাব দিয়ে প্রস্থান ঘটায়।

তাহুরা অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে।মামী ব্যাপারটা কিভাবে নিলো তার আয়ত্বে এলো না।দরজা খোলা রাখলো।টাকাটা উমাইরের দিকে এগিয়ে দেয় সে,
–“মামী দিলো।”
–“খাও।”
উমাইর তার কিছু শিটস বের করছে ব্যাগ হতে।
তাহুরা টাকা নিজের পানে ফেরায়,
–“টাকা কিভাবে খাবো?”
তাহুরা হাসে।ভাবলো বিনিময়ে উমাইর হাসবে।কিন্তু হাসলো না।বরং শক্ত ভঙ্গিতে তার গাল চেপে ধরে,
–“পরের বার যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে এই রুমে কি করছো তুমি,উত্তরে যেনো আমি আজ যেটা বলেছি সেটা শুনি।নয়তো ভালো হবে না।”
পরপর উমাইর হাত সরায় মুখ হতে।তাহুরা ছলছল নয়নে চেয়ে রইলে আগমন হয় সুনেরার। উমাইরের শেষ বাক্য শুনেছে সে।

–“তাহু,আমি বেরুচ্ছি তোর ভাইয়ার সাথে।তোকে এতো করে বললাম যাচ্ছিস না।”
সুনেরা জানায়।
–“যা..ও আপু।সাবধানে থেকো।”
উমাইর ততক্ষণে শিট নিয়ে স্টাডি রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটে।

সে যেতেই সুনেরা বোনকে বলে,
–“তুই নিজের কথাগুলো অন্যকে সাহস নিয়ে জবাব দিবি।ভাইয়া তোকে কতো শেখায়।আর শুন,জুবায়ের উমাইর ভাইয়াকে ট্রিপের কথা জানিয়েছে।আমরা উনার সুবিধা মতো বৃহস্পতিবার বিকালে রওনা দিবো।আমি বাবা থেকেও মায়ের মাধ্যমে পারমিশন নিয়ে ফেলবো কাল।আমি অনেক হ্যাপি।”
বোনের খুশিতে ভরা আঁখিতে হাসির ঝিলিকের দেখা মিলে তাহুরার।সবকিছু ভুলে সে বোনকে জড়িয়ে ধরে,
–“তোমার খুশিতে আমার খুশি আপু।”
……………..
রাতের খাবারের সময় উমাইর স্টাডি রুম হতে বেরুলো না। দিলরুবাকে সে জানালো পরে খাবে।তাহুরা বেশ কয়েকবার ঘুরঘুর করলো স্টাডি রুমে।উমাইর তার প্রশ্ন তৈরিতে ব্যস্ত।চশমায় আড়ালে প্রিয়তমাকে পরখ করলো ঠিক।অধরে লেপ্টে থাকা হাসিটা আবছায়ায় রাখলো প্রেয়সীর সম্মুখে।আজ মেয়েটা বড্ড অধিকার দেখাক!
ঘড়িতে রাত এগারোটা। উমাইরের কাজ শেষের পথে।তাহুরার উপস্থিতি বুঝতে বেগ পেতে হলো না তার।মেয়েটা তার পিঠ বরাবর দাঁড়িয়ে।অবশেষে কাঁধে স্পর্শ অনুভব করে সে। ঘাড় বাঁকিয়ে ফিরলে তাহুরার নিষ্পাপ মুখশ্রী ভেসে উঠে।

মেয়েটা নরম সুরে প্রশ্ন করে,
–“খাবেন না?”
–“না খেলে সমস্যা আছে?”
উমাইর পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে।
–“আমিও খাইনি।”
তাহুরা জবাব দেয়।
–“আমি খেতে নিষেধ করেছি?”
–“খাইয়ে দিই?”
সহজ আবদার।কিভাবে নিষেধ করবে উমাইর?
মেয়েটা উমাইরের দূর্বল স্পট ধরতে সক্ষম।
কাঁধে রাখা তাহুরার হাত ধরে সে।নিজ গালে স্পর্শ করে তার তুলতুলে হাত,
–“রুমে নিয়ে আসো।আমি রুমে যাচ্ছি।”
তাহুরা বড্ড খুশি হয়।তার হাসিতে উমাইরের ভেতরকার সত্তা নড়ে।পুরুষালি মনোভাব আঁকড়ে ধরে।মেয়েটার হাসি নেশাক্ত।নিজেকে সামলায় উমাইর।
তাহুরা অপেক্ষা করে না আর।দ্রুত ছুটে।

ভাতের প্লেট নিয়ে রুমে আসে তাহুরা।দুজনের জন্যে একই প্লেটে খবর আনে সে।উমাইর সোফায়।সকল কাগজ, শিট,প্রশ্ন ঠিক করে ব্যাগে রাখছে।সেথায় যায় তাহুরা।হাসিমুখে খাবার শেষ করে দুজনে।আজিমকে ডাকলে উমাইর,উনি এসে প্লেট-গ্লাস নিয়ে যায়। তাহুরা হাত ধুয়ে কাজে লেগে পড়ে। উমাইরের কিছু শার্ট ব্যালকনি হতে এনে গুছিয়ে কাবার্ডে রাখে।
মেয়েটা তার হেয়ালি ভাবনায় খেয়াল করছে না,সোফায় বসা লোকটা বিভোর হয়ে তাকে দেখছে।

সুতির কামিজ উমাইরের বউয়ের তনুয় লেপ্টে।ওড়না পড়ে রয় বিছানায়।মেয়েটাকে এখন ছোঁয়াটা ঠিক হবে না।দৃষ্টি সরায় উমাইর।মোবাইলে মন দিতে চায়।হচ্ছে না।নজর আজ বেসামাল।মেয়েটার বুকে, ঘাড়ে তার দেওয়ার চিহ্ন।তাকেই যেনো ডাকছে।
হঠাৎ শব্দ হয় বাহিরে।অনেকটা বাজির ফুটার তীব্র আওয়াজ।তাহুরা মাত্র সোনালী রঙের বাতি জ্বালিয়ে বিছানায় যাচ্ছিলো।সেই শব্দে তার আত্মা বাহির হওয়ার জোগাড়।বেখেয়ালি তাহুরা এক দৌড়ে সোফায় বসে থাকা উমাইরের কোলে বসে।দুপা গুঁজে লেপ্টে যায় তার বুকে।জোরালো সুরে আওড়ায়,
–“কিসের শব্দ হলো?”
জবাব আসেনি কোনো।

উল্টো অনুভব করলো অন্য আকর্ষণ।উমাইর তার হাত ধরে মিশিয়ে নেয় নিজ সত্তায়।সোনালী আলোয় কক্ষের পরিবেশ উত্তাল।চারিদিকে কেমন রশ্মি ছড়াচ্ছে।সেই আলোয় উমাইর বিভোর হয় প্রেয়সীর মোহনীয়তায়।তার বউয়ের অবয়বে হারিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

–“কন্ট্রোল করছিলাম।কিন্তু,তুমি শেষ করলে সব।”
উমাইরের গলার স্বর পরিবর্তিত।এমন গভীর মোলায়েম শব্দে তাহুরার শিরদাঁড়া বেয়ে নতুন অনুভূতির স্রোত নামে।সে দ্রুত মাথা উঠায়।বুঝতে পারে উমাইর তার পানে নতুন নজরে চেয়ে।দুই বক্ষদেশের মিলন ঘটে।তাহুরার হাত অস্থির। কাঁপছে কি?হ্যাঁ। বুকটায় হরতাল শুরু।
তাকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় উমাইর।আতংকে তাহুরা তার ঘাড় খাঁমচে ধরে।শব্দ করে বলে,
–“আল্লাহ্,আমি পড়ে যাবো।”

উমাইর হাসে।তবে,আঁখির ভাষা অন্যরকম।আসক্তির প্রকোপে ছেলেটার আঁখি নিভু নিভু।
–“পড়তে দিবো না,জান।”
উমাইর তার গলার গভীর ভাঁজে স্পর্শ করে।জিহ্বার ছোঁয়ায় মাতাল করে তার শুভ্র প্রেয়সীকে।তাহুরার হাত পৌঁছে উমাইরের চুলে।সেথায় টানলে উমাইর অস্পষ্ট শব্দ করে,
–“আহ্,নিজেই আমাকে প্রভোক করছো,বউ।”

–“আপনি আমাকে নামিয়ে দিন না।”
নজর মিলে দুজনের।ভালোবাসার চাহিদায় হালাল প্রেমিক যুগল মাতোয়ারা।উমাইর তাকে নামায় না,বরং অধরের সহিত অধরের নতুনত্বের লীলা শুরু করে।তাহুরা বেহাল।উমাইরের এহেন ভঙ্গিমা তার সহ্যের বাহিরে।ছেলেটার হাত আজ ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে যেনো।পীড়ায় মেয়েটার আঁখিতে অশ্রুর আগমন।

তাহুরার পিঠ ঠেকে বিছানায়।বস্ত্রের অবস্থা নাজুক।উমাইর নিজ টিশার্ট খুলে।স্পর্শ করে মেয়েটার সত্তা।বক্ষদেশের পীড়ায় তাহুরা কেঁদে উঠে গভীর সুরে।উমাইর থামে,নিজ গাল দ্বারা স্পর্শ করে অশ্রু নিঃসরিত বউয়ের গালে,
–“আজ থেকে এইসবই হবে।সহ্য করো প্লিজ জান।”
–“ভ….য় করছে উমা…ইর।”
উমাইর নিজেকে সামলানোর কথা ভুলেছে।সে আরো এগিয়ে আসে।অধর ছোঁয়ায় তাহুরার আঁখির উপরিভাগে,
–“কিসের ভয়?আমি সব সামলে নিবো বউ।”
–“আমার খুব..।”
–“হুম জান?তুমি মানা করলে হবে না কিছু।কিন্তু,আমি শেষ হবো আজ।জান…বেবি…”
উমাইর কপাল ঠেকায় তাহুরার কপালে।ভারী নিঃশ্বাসের সবটা তাহুরার মুখে বিচরণ করে।মিষ্টি সুবাসে তাহুরার মস্তিষ্ক ভার হয়।হাত বুলায় উমাইর তাহুরার চুলের গভীরতায়। উমাইরের ব্যাকুলতা তাহুরা বুঝে।সম্পর্ক তাদের হালাল।শরীরের চিনচিন ব্যথার বদলে,প্রিয়তমের সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করার ডিসিশন নেয় তাহুরা। নাক টানে সে। উমাইরের পিঠে হাত রাখে আলগোছে।

ফ্যাচফ্যাচ সুরে সে বলে,
–“ভালোবাসি উমাইর।”
প্রিয়তমার ইশারায় উত্তর বুঝে উমাইর।মাথা সরায় না সে।আরো কিছুক্ষণ সময় সেভাবেই রয় সে।পরক্ষণে পূর্বের অবস্থায় ফিরে প্রেমিক পুরুষ।প্রেয়সীর অধরে দীর্ঘ চুমুর আলিঙ্গন শেষে কোমরে হাত পেঁচিয়ে নেয় সে।অস্থির জড়িত কন্ঠে বলে উঠে,
–“আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙানোর শাস্তি পাও বউ। আই লাভ ইউ,বেইবি।”

চলবে…….

#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব-৩৪
___________________
–“আমি কলেজে।তুমি আজ বাসায় থাকো।শরীর বেশি খারাপ লাগছে?”
মোবাইল হাতে নিলে প্রথমত মেসেজখানা নজরে আসে তাহুরার।নবীন অনুভূতির তাড়নায় জর্জরিত সে।কক্ষের আলো টিমটিম।পর্দা জড়ানো জানালায়।কঠোর রোদ সেই পর্দার বাহিরে অপেক্ষারত।উঠে বসে তাহুরা।ভারী ভাব তনুয় ।চুলের মাঝে ভেজা আভাস।মুচকি হাসি অধর জুড়ে।বিছানা হতে নেমে আড়মোড়া ভাঙে মেয়েটা।ধীরে বিছানা গোছায়।ঘড়িতে নজর বুলায় কাজের ফাঁকে।সকাল এগারোটা।বুকের মাঝে তীব্র শব্দ।কেউ এখন অব্দি ডাকতে আসেনি তাকে?নাকি এসেও ফেরত গেলো!কি ভাবছে বাড়ির সবাই?
লাজে পুরো সত্তায় কিঞ্চিৎ কাঁপন।আঁখিতে ভাসে গত রাতের মধুর স্মৃতি।উমাইরের সেই উন্মাদনায় নিজেকে তার নিকট ব্যক্ত করেছে সারাজীবনের জন্যে।

ঘড়ির পানে ফের নজর দিয়ে দ্রুত তৈরি হয় সে।ওড়নার আবরণে ঢাকে মাথা সহ গলা, ঘাড়।পিন দিয়ে আটকে নেয় কিছুটা।ভালোবাসার চিহ্ন এখনো তাজা।মন পিঞ্জিরার অস্থিরতা এখনো কমলো না।কেবল ভেতরটায় উথাল পাথাল আভাস।

ধীর কদমে হাঁটে।আফিয়ার সাথে দেখা হয় মাঝরাস্তায়।আফিয়ার মুখশ্রী অন্যরকম। কেঁদেছে কি?তাহুরা কিছু জিজ্ঞাসা করবে ভাবলো,এর পূর্বে সুনেরা ডাকে তাকে।ঐযে বোন দাঁড়িয়ে কিছুটা দূরে,
–“উঠেছিস?নাস্তা করবি আয়।”
–“আসছি আপু।”
তাহুরা উল্টো পথে হাঁটে।
বোনের নিকট গেলে তার কপালে হাত রাখে সুনেরা,
–“ঠিক আছিস এখন?উমাইর ভাইয়া কলেজ যাওয়ার আগে বললো তুই একটু অসুস্থ,তোর নিজ থেকে ঘুম ভাঙা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে।”
–“ঠিক আছি আপু।”
ভনিতা ছাড়া উত্তর দেয় তাহুরা।লোকটা পারেও বটে।

পথিমধ্যে সুনেরা নানান আলোচনা করে।তারা কাপ্তাই গিয়ে কি করবে,না করবে সব ঠিক করেছে বোন।তাহুরা বোনের সকল কথা উৎসুক ভঙ্গিতে শুনে।জবাব দেয়।সে ঘুরতে বেশ ভালোবাসে।
পরমুহুর্তে মনে পড়ে সে উমাইরের পাঠানো মেসেজের বিপরীতে জবাব দেয়নি কোনো।

ডাইনিংয়ে বসলে,মেঘলা তাকে নাস্তা এগিয়ে দেয়।মাথায় হাত বোলায়,
–“সব শেষ করতে হবে।”
–“জ্বী মা।”
হাসে তাহুরা।মাথা নিচু ভঙ্গিতে মোবাইলের কিবোর্ডে আঙুল চালায় সে,
–” ঠিক আছি।আপনি নাস্তা করেছিলেন সকালে?”
বার্তা পাঠিয়ে নিজের কাজে মন দেয় তাহুরা।বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে।নজর ঘুরিয়ে বোনকে প্রশ্ন করে,
–“কাল কখন ফিরেছিলে?”
–“দেরী হয়েছে।আমি ডাকতে চেয়েছিলাম তোকে,কিন্তু পরে আর আসিনি।”
সুনেরা জবাব দেয়।

–“ওহহ।ভাইয়া অফিসে?”
–“হ্যাঁ।মাথা ব্যথা করছে তোর?চোখ ফুলে আছে অনেকটা।আয় ম্যাসাজ করে দিবো।”
মুশকিল।মহা মুশকিল।মাথার কাপড় পড়লে সর্বনাশ। সত্যি অর্থে তার মাথায় বড্ড পীড়া।তবে,সহ্য করে নিবে।নিজের লাজের কারণ বড় বোনকে দেখানো বড্ড বিব্রতকর হবে নিশ্চয়।
তাহুরা ডানে বামে মাথা নাড়ে,
–“উহু।ঠিক আছি।ঘুম কম হয়েছে তাই হয়তো এমন মনে হচ্ছে।”

–“আচ্ছা।”
বোনকে আরেকটা পরোটা এগিয়ে দেয় সুনেরা।তাহুরা বোনের পানে চায়।মুচকি হাসে বোন,
–“খেয়ে নে।তোর এনার্জি দরকার।”
এবার অট্টহাসিতে রূপ নেয় সুনেরার হাসি।তাহুরা ফ্যালফ্যাল চেয়ে রয়।ঘটনা বুঝে দমে খানিকটা।অতঃপর মুখ খুলে,
–“তুমি খাও।”
মুখ বাকায় তাহুরা। সুনেরার হাসি থামে না।বরংচ উঠে বোনকে জড়িয়ে ধরে।মাথার তালুতে আদুরে স্পর্শ করে,
–“বড় বোনেরা সব বুঝে।আমার তাহুরা বড় হয়ে গেলো।”
তাহুরা মিনমিন সুরে জবাব দেয়,
–“অনেক আগেই।”

দুপুরের খাবারের আয়োজনে সকলের সাথে টুকটাক কাজ করে তাহুরা।গরমের তাড়নায় অল্পতে ঘেমে অস্থির।ভোরে স্নান করলেও,এখন আবার স্নানের দরকার শতভাগ।ঘামযুক্ত জবজবে অবস্থা তার অত্যন্ত অপছন্দ।মেঘলাকে জানিয়ে সে রান্নাঘর হতে নিজ কক্ষে ফিরে।তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে গোসল সাড়ে।বালতিতে ভেজা কাপড় নেয়।বাসার সকল সহযোগী নিচ তলায়।অতঃপর সে সিদ্ধান্ত নেয় ছাদে নিজেই যাবে কাপড় শুকাতে দিতে।

যাওয়ার পূর্বে মোবাইলে নোটিফিকেশনের শব্দ হয়।বালতি রাখে মেঝেতে। উমাইরের মেসেজ স্পষ্ট,
–“পেইন হচ্ছে কোনো?আমি চারটা করে আসবো।লাঞ্চ করবো বাসায়।”
সঙ্গে সঙ্গে তাহুরা মেসেজের বিপরীতে পাঠায়,
–“আচ্ছা।”
–“প্রথম মেসেজ দেখো না মাথামোটা?চোখে সমস্যা আছে বলে মনে হয় না।”
তাহুরা কোমরের একপাশে হাত রাখে।লোকটার কোনো কথা উপেক্ষা করার জো নেই একদম।
–“একটু হচ্ছে।”
–“লাঞ্চ করে মেডিসিন নিও,বউ।ক্লাসে ঢুকছি এখন।”
–“জ্বী।সাবধানে আসবেন।”
তাহুরা উত্তর পাঠিয়ে আবারও আবৃত করে নিজেকে ওড়না দ্বারা। বালতি তুলে ছাদের পানে হাঁটতে আরম্ভ করে।

তীব্র রোদ গগণে। হলুদাভাবে চারিদিক চিকচিক।বাড়ির ছাদ বেশ পরিচ্ছন্ন এবং ফুলের গাছে সম্মুখ দিকের রেলিংয়ের অংশের দিকে আবৃত কিছুটা।তাহুরা রোদের প্রকোপ হতে বাঁচতে ঝটপট কাপড় ঝুলায় রশিতে।বালতি নিয়ে ফের ফিরতে নিলে আফিয়ার কণ্ঠ শুনতে পায়।
তার নাম ধরেই ডাকলো,
–“তাহুরা ভাবী,একটু আসবে এইদিকে?”
আফিয়ার মুখে ভাবী ডাক শুনে তাহুরা চমকিত,
বিস্মিত।আফিয়া ঠিক আছে তো?যদিও উমাইর তার সহিত কথা বলতে নিষেধ করেছে।কিন্তু, এমন অসহায় আবদার অবজ্ঞা করতে পারলো না তাহুরা।দ্রুত ছাদের অপর পাশে গেলে দেখতে পায় দোলনায় বসা আফিয়া।চোখমুখ বেশ রক্তিম।
তাহুরার নরম মন গলে পানি।সে আফিয়ার সম্মুখে থামে।পূর্বের কথা স্মরণে এলে তাকে সান্তনা দেওয়ার সাহস পায় না মেয়েটা।ভাঙা গলায় শুধায়,
–“আফিয়া আপু,আপনি ঠিক আছেন?এমন রোদে বসে আছেন কেনো?”

–“আমি খুব বাজে মেয়ে বুঝলে!নিজের কাজিনকে ভালোবাসা এক জিনিস,আর তাকে পাওয়ার জন্যে নষ্টামি করা অন্য জিনিস।আমি নষ্টামি করেছি।উমাইর ভাইয়াকে পাওয়ার লোভে আমি নিজেকে বাজে নেয় বানিয়েছিলাম।কিন্তু,সময়ের সাথে আমি পরিবর্তিত হলেও উমাইর ভাইয়াকে ভুলতে পারিনি।আমার জন্যে অনেক প্রস্তাব আসে, সবই আমি ওর জন্যে না করে দিই।জানো তাহুরা,একবার বাসায় কেউ ছিলো না।আমি আমার বডি উপস্থাপন করে এমন বাজে কাপড় পড়েছিলাম শুধু উমাইর ভাইয়াকে আকৃষ্ট করতে, সেদিনও পারিনি আমি ওকে হাত করতে।উল্টো ওর মুখে বেহায়া, স্লাট শুনেছি।অথচ তুমি।কখনো অশালীন কি,কিঞ্চিৎ অগোছালো রূপে আমি তোমাকে দেখিনি।সেই তোমাতেই উমাইর ভাইয়া জান দিয়ে দেয়।ভালোবাসা পেতে লজ্জার আবরণ লাগে, নির্লজ্জদের কেউ পছন্দ করে না।”
আফিয়ার আঁখি ছলছল।

তাহুরা হতভম্ভ।আফিয়া এমন জঘন্য কাজ করেছে উমাইরকে পেতে?শরীর খানা ঝিমঝিম করছে।উমাইর কখনো তাকে এইসব বলেনি।এমনকি বাড়ির কেউই বলেনি। বলেও কি হবে?তাহুরা নিতান্তই শান্ত মেয়ে।আফিয়া উমাইকে পছন্দ করতো এতটুক জানে,কিন্তু এমন খারাপ কিছু করতে হয়েছে আফিয়ার কেবল উমাইরকে পাওয়ার আশায়?
রাগের বদলে তার করুণা হচ্ছে আফিয়ার জন্যে।

–“আপু পুরাতন কথা ভুলে যান। কাঁদবেন না।”
আফিয়াকে মুখে সান্তনা দেয় তাহুরা।আফিয়া দোলনা হতে সরে।হাত টেনে নেয় তাহুরার,
–“হ্যাঁ আজ থেকে সব ভুলে যাবো।মায়ের অনুরোধে সকালে উমাইর ভাইয়া আমাকে নানান কথা বুঝিয়ে বলেছে সবার সামনে।উমাইর ভাইয়াকে নিয়ে আমার মনে কোনো বাজে চিন্তা নেই।সে কেবল আমার ভাই এখন।নিবরাসের মতো।উমাইর ভাইয়া আগেও বুঝিয়েছিলো,কিন্তু বুঝিনি আমি।তবে,আর না।তোমাদের সুখী সংসারটা আরো সুখের হোক।যে আমার হবে না,তাকে নিয়ে সব ভাবনা শেষ।সিদ্ধান্ত নিয়েছি পরের বার ভালো প্রস্তাব পেলে ছেলের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করবো,কথা বলবো।”
চোখ টিপে আফিয়া।কান্না মুখে হেসে উঠে।
মন ভালো হয় তাহুরার।এইবার সে সাহস পায় আফিয়াকে মন খুলে কিছু বলার।ধীর স্বরে সে বলে উঠে,
–“আপনার ভাইয়া নিশ্চয় আপনার ভালো চায় আপু।আমি যদি কোনো ভুল করি তাহলে সত্যি মন থেকে সরি বলছি,আফিয়া আপু।”
আফিয়া উঠে বসা হতে।জড়িয়ে ধরে তাহুরাকে,
–“তুমি ভালো,লক্ষ্মী মেয়ে তাহুরা ভাবী।আমরা আবারও আগের মতো হয়ে গেলাম তাহলে।ঠিক আছে ভাবী?”
–“হ্যাঁ আপু।”
খুশি হয় মেয়েটা।এতদিন একটা চিন্তায় থাকতো কিভাবে আফিয়া তার সাথে স্বাভাবিক হবে!আর আজ সব চিন্তা আকাশে উড়লো।
বাঁধন ছুটে দুজনের।আফিয়া গাল টানে তাহুরার,
–“ভেতরে চলো।লাল হয়ে যাচ্ছে তোমার গাল।”

তাহুরা,আফিয়ার সহিত নিচে নামে।একত্রে তাদের নিচে নামতে দেখে সুনেরা,দিলরুবা এবং মেঘলা বড্ড অবাক হয়।আফিয়াই প্রথমে তাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
–“মুভ অন করার সময় এখন।খেতে দাও আমাকে।”
দিলরুবা মেয়েকে আগলে নেয়।যত্ন করে খেতে বসায়।মেঘলা তাহুরার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
–“সব ঠিকঠাক?”
–“হ্যাঁ, মা।”
————————
উমাইর বিকালে আসবে তাই তাহুরা মেডিসিন খেয়ে আর উপরে গেলো না।নিচ তলায় উমাইরের জন্যে অপেক্ষা করে বসার ঘরে।সেথায় আগে থেকে উপস্থিত ছিলো নিবরাস এবং আফিয়া। নিবরাস কথা বলছিলো স্বাগতার সহিত।আফিয়ার পাশে নিঃশব্দে বসে তাহুরা প্রহর গুনে।কবে আসবে লোকটা?ভোর রাতে উমাইরের বক্ষদেশে বিভোরে ঘুমানোর পূর্বে দেখেছিলো,আর দেখা নেই লোকটার।কলেজে যাওয়ার পূর্বে ডেকে দিলে কি এমন হতো?
–“ভাই কখন আসবে রে?”
ফোন কাটে নিবরাস।
–“চারটার দিকে আসবে বললো।”
নিবরাসের কথার জবাব দেয় তাহুরা।

–“আজকে একটা জবরদস্ত ম্যাচ আছে।উমাইর ভাই না থাকলে একটুও জমবে না।ভাইয়ার প্রিয় শত্রুর দলের সাথে খেলা।”
–“উনার শত্রু?”
তাহুরা অবাক হয়।
–“হ্যাঁ।মুরাদ হাসান।জানে দুশমন না আবার।ওদের ভার্সিটি লাইফ থেকে মুরাদ ভাইয়ের সাথে উমাইর ভাইয়ার একটু ঝামেলা লেগে থাকতো আরকি।”
–“ওহহ।”
তাহুরা ছোট্ট সাস ফেলে।

–“তোরা দেখতে যাবি আজকের খেলা?আপু যাবা?”
প্রশ্ন করে নিবরাস।
–“উমাইর ভাইয়া নিবে? ওর শত্রুর সাথে ম্যাচ হবে,সেই ম্যাচ ভাবীকে দেখাতে নিবে? বাহ,কি লজিক।”
হাসে আফিয়া।

হাসি ফুটে তাহুরার অধরেও।একবার এমন খেলা দেখতে গিয়ে বড্ড বিপদ হয়েছিলো। উমাইরের ধমকে কি কেঁদেছিলো সরল মেয়েটা!
–“আমি বাবা এইসব খেলা দেখায় নেই।বলতে গেলেও তোর উমাইর ভাইয়া আমাকে ফুটবল বানিয়ে ফেলবে।”
তীব্র হাসিতে বসার ঘর আলোড়িত।তাহুরার গালে পীড়া হয় হাসির দরুণ।

–“এতো হাসির কি?”
গম্ভীর সুরে আওড়ায় উমাইর।মুহূর্তে হাসি থামে তিনজনের।তাহুরা উঠে দাঁড়ায়।গত রাতের পর তাহুরা এখন দেখলো তার প্রিয় মানবকে।শার্টের হাতা কুনুই পর্যন্ত বটানো।চুলের অবস্থা পরিপাটি।ভ্রু জোড়া সমান্তরাল।নজর মিললে তাহুরা দৃষ্টি সরায়।
–“আরে কিছু না ভাই।তোমাকে মিস করছিলাম আমি।”
নিবরাস বলে।
–“অসভ্য।”
উমাইর হালকা হেসে জবাব দেয়।

–“ভাই,আজকে কিন্তু ম্যাচ আছে।মুরাদ ভাইয়ের টিম।তুমি ছাড়া জমবে না।”
–“অফকোর্স আমি খেলবো। ম্যাচ শুরুর আগে চলে আসবো।”
উত্তর দিয়ে পরপর উমাইর তাহুরার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
–“খাবার দাও।”
–“দিচ্ছি।”
উমাইরের পিছে হাঁটে তাহুরা।পরক্ষণে খেয়াল করে উমাইর স্থির।ততক্ষণে তাহুরা তার স্থানে আসে,
–“ফ্রেশ হয়ে নিন।”
তাহুরা ঘাড় উচুঁ করে। উমাইর আশপাশ কি যেনো পরখ করে।অতঃপর হুট করে ঝুঁকে তাহুরার গালে অধর ছোঁয়ায়,
–“পেইন কমেছে?”

–“আরে…কেউ দেখলে?”
তাহুরা কিঞ্চিৎ দ্বিধায় ভুগে।
–“উত্তর যেটা জানতে চায়,সেটা দিলে বেশি ক্ষতি হয়?”
গাল চেপে ধরে সে তাহুরার।

তাহুরা ভ্রু কুঁচকায়।মাথা নাড়িয়ে বলে,
–“হু।”
–“গুড,মাথামোটা।”
তির্যক হাসে উমাইর।দ্রুত পায়ে অগ্রসর হয় সম্মুখে।
__________________
তাহুরাকে বাড়ির সাহায্যকারী বাকি কাজ সেরে নিবে বলে জানান দেয়।উমাইর তার অপেক্ষায় ছিলো ডাইনিং এ।তাকে আসতে দেখে এগিয়ে যায়। হাতের মুঠোয় নেয় প্রেয়সীর নরম হাত।নিজেদের কক্ষে পৌঁছালে তাহুরা ঘোমটা সরায়।চুলগুলো ছড়িয়ে দেয় পিঠে।উমাইর অফিস ব্যাগ হতে কিছু বের করে।উল্টো হেঁটে বউয়ের নিকট আসে।হাঁটু গেড়ে বসে তার সামনে।
হাতের ছোট বাক্স এগিয়ে দেয়,
–“কালকের জন্যে গিফট।কালকে দিতে পারিনি কিছু।”
তাহুরা বাক্স নেয়।খুলে সেটা।সুন্দর একটা আংটি।উমাইর নিজেই তাকে পড়িয়ে দেয়।ওষ্ঠ ছোঁয়ায় আঙ্গুলে,
–“পছন্দ হয়েছে?”

তাহুরা আবেগপ্লুত।দুহাত এগিয়ে জড়িয়ে নেয় তার অর্ধাঙ্গকে,
–“এত্তগুলো পছন্দ হয়েছে।”
–“কোনো অস্বস্তি হচ্ছে তোমার জান?”
উমাইর পিঠে হাত রাখে মেয়েটার।
–“নাহ।চিন্তা করবেন না।”
উমাইরের চুলের ভাঁজে আঙুল দ্বারা বিলি কাটে সে।
–“এক মিনিট,তাহু।”
উমাইর ফের তার অফিস ব্যাগ হতে আবারও জরুরী জিনিস নেয়।পানির গ্লাস হাতে তাহুরার নিকটে আসে।বলে উঠে,
–“সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট কাজটা ভুলে গিয়েছি।”

তাহুরা ভ্রু নাড়ায়,
–“কি কাজ?”
উমাইর তাহুরার মুখে ট্যাবলেট রাখে।পানি এগিয়ে দেয়,
–“খাও।”
পানি দ্বারা ট্যাবলেট গলধঃকরণ করে তাহুরা প্রশ্ন করে,
–“কি এটা?”
–“মুন্সী আঙ্কেল যেনো ডিসেম্বর পর্যন্ত জেনে থাকে,উমাইর বেশ ভদ্র ছেলে।এক কথার মানুষ।”

তাহুরা বুঝে উঠতে সক্ষম না হলেও,মিনিট এক বাদে বুঝতে পেরে কুঁকড়ে উঠে।মুখে হাত দিয়ে হাসে,
–“আপনি এমন ফাজিল!”
অট্টহাসির শব্দ হয় উমাইরের।
–“মুন্সী আংকেলের মেয়ের জন্যে,উনাকে দেওয়া কথাটা রাখতে পারলাম কই? ধেত!”
উমাইর তার টিশার্ট খুলে হ্যাঙ্গরে রাখে।মেয়েটা বুঝতে পারে উমাইর ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।সকালে ঘুমিয়েছে কই?
তবে মেয়েটার মন ভঙ্গুর হয়। উমাইরের পিঠে নখের ছাপ।তাহুরা নিজের নখের পানে তাকায়।জ্বলছে কি উমাইরের পিঠ?

–“শুনুন?আপনার পিঠে…”
–“আই’ম ফাইন,বউ। ডোন্ট প্যানিক।”
তাহুরাকে থামিয়ে জবাব দেয় উমাইর।বিছানায় উঠে। হাত টেনে তাহুরাকে নিজের বক্ষ পিঞ্জিরায় জড়িয়ে নেয়।দৃষ্টি তার লাজে আড়ষ্ট প্রেয়সীর পানে।ধীর ভঙ্গিমায় তাহুরার কামিজের আড়ালে অবস্থান নেয় উমাইরের হাত।দুজনের দৃষ্টি মিললে উমাইর হালকা ভঙ্গিমায় অধরে অধর ছোঁয়ায়,
–“আফিয়া কোনো খারাপ কিছু বলেছে?”
তাহুরা আঁখি বুঁজে।প্রিয়তমের সন্নিকটে সুখ অনুভব করে,
–“উহু,আপু বললো উনি এখন বিয়ের জন্যে প্রস্তুত।”
–“যাক,পাগলের পাগলামি থেমেছে এটাই ইনাফ।”
উমাইর হাসে।তাহুরা আলতো চড় দেয় উমাইরের পিঠে,
–“এভাবে বলবেন না।”
–“ওকে ওকে,জান।”
তাহুরা অনুভব করে তার প্রিয়তমের মোলায়েম স্পর্শ। এতো প্রশান্তিতে তারও চোখ বটে আসে যেনো।
…………………….
একদিন পর,
–“বাবা তোকে বাড়ি ফিরতে বলছে।”
সুনেরা অকপটে জবাব দেয়।
–“হঠাৎ?কাপ্তাই যাওয়ার কথায় বাবা কি রাজি হয়নি?”
তাহুরা প্রশ্ন করে।ফিরে যাবে সে বাড়িতে?উমাইর বন্ধুদের সহিত বাহিরে গেলো এখনো আসেনি।তার ফিরতে দেরী হবে।সন্ধ্যায় উমাইর তাকে নিয়ে বেরিয়েছিলো মার্কেটে।কাপ্তাই যাওয়া উপলক্ষে কিছু কেনাকাটা করেছে।বিয়ের পর একসাথে ঘুরতে যাবে কোথাও,তাই উমাইর বেশ খুশি।অথচ তাকে কিনা ফিরতে হবে?

–“বলিস না আর।মা ফোন করেছে। ঐ শয়তান জাফর তোকে আর উমাইর ভাইয়াকে মার্কেটে দেখেছে একসাথে।এই নিয়ে বাড়িতে তার মাকে বুঝিয়ে বলে,একসাথে আমাদের বাড়ি আসে তারা।বড্ড কথায় শোনায় তারা বাবা,মাকে।”
সুনেরার জবাবে তাহুরার আঁখি বিস্ফোরিত হবে এমন ভাব।বাবা ঠিক আছে তো?
আঁখিতে কালো মেঘ জমে।তাহুরা বোনের হাত ধরে,
–“বাবা ঠিক আছে আপু?”
–“আছে।বাবা ওদের সাথে শক্ত ভাষায় কথা বলেছে।এও জানিয়েছে তোর আর উমাইর ভাইয়ার বিয়ে ঠিক করা আছে।তাও ওরা নাকি মন্দ কথা বলছিলো।বাবা জানিয়েছে তোকে এখনই পাঠিয়ে দিতে।মা জাফরের মাকে আগে বললেও তোদের কথা, তাদের আক্কেলের বড় অভাব।”

সুনেরার জবাবে মুখে হাত চাপে তাহুরা,
–“ওদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।তাও কেনো আমাদের জীবনে ওরা…”
আর জবাব দিতে পারলো না সরল মেয়েটা।কেঁদে অস্থির।মেঘলা শান্ত করে তাহুরাকে,
–“আমি উমাইরকে ফোন করছি।তাহুরা তুমি উমাইরকে বলো বাসায় এসে যেনো তোমাকে দিয়ে আসে।আমি বললে আমাকে হাজারটা প্রশ্ন করবে।তুমি ওকে বুঝিয়ে বলো।”

তাহুরার অন্তর কাঁপে।লোকটা তার কান্নারত কণ্ঠ শুনলে মোটেও শান্ত থাকবে না।তাহুরা কিছু বলার পূর্বে উমাইরকে ফোন করে মেঘলা,
–“বাবা,তাহুরার সাথে কথা বল।”
তাদেরকে কথা বলার সুযোগ করিয়ে দিয়ে মেঘলা বেরিয়ে যায় সুনেরাকে নিয়ে।

অন্যদিকে উমাইর “হ্যালো,হ্যালো” করলেও উত্তর দিচ্ছে না তাহুরা।কান্নার দরুণ মেয়েটার গলা কম্পনরত। নাক টানার শব্দ বুঝলে উমাইর তেতিয়ে উঠে,
–“কি হয়েছে জান?প্রবলেম হচ্ছে কোনো?”
–“বা..বা বলেছে এখন বাসায় ফি..রতে।আপনি আসুন বাসায়।আমাকে দিয়ে আসবেন?”
থেমে জবাব দেয় তাহুরা।

–“এখন কেনো?কি সমস্যা?”
উমাইর ঝাঁঝালো সুরে আওড়ায়।
–“কিছু না।আপনি দিয়ে আসবেন প্লিজ?”
তাহুরা চোখ মুছে।
–“তোমার যাওয়ার দিন আজ না।আজকে যাওয়ার কারণ বলো।”
উমাইর নাছোড়বান্দা।
–“আমি…কিছু না,উমাইর।আপনি আসুন না।”
–“বুঝলাম অহেতুক কারণে কাদঁছো মাথামোটা।আসছি বাসায়।কারণ বলবে আগে।কারণ যদি আমার পছন্দ হয়,তবে বাসায় দিয়ে আসবো।আর যদি না হয়,তাহলে মুন্সী আংকেলের সাথে একটা বিরাট বৈঠকে বসতে হবে।”
তাহুরা হেঁচকি তুলে। উমাইরের মেজাজ বিগড়েছে বেশ বুঝলো সে।তাহুরা কিছু বলার পূর্বে শুনতে পায় উমাইরের সতর্ক বার্তা,
–“কান্না বন্ধ করো,মাথামোটা।সত্যিটা বলার সাহস করো আমি আসা অব্দি।”

চলবে………
কপি করা নিষেধ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে