রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব-৩১+৩২

0
1163

#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব- ৩১
_________________
–“উঠেছো তাহুরা?শরীর ঠিক আছে,মা?”
মৃদু কন্ঠে তাহুরার সম্পূর্ণ ঘুম উবে যায়।পাশে বসা মেঘলা বেগম।উমাইর রুমে নেই!কবে বাহিরে গেলো লোকটা?তাহুরা কেনো এমন মরার মতো ঘুমে মগ্ন ছিলো!কি ভাবলো সবাই?লাজে অন্তর ভাঙে তাহুরার।সে দ্রুত উঠে বসে।খেয়াল করে গায়ের ওড়না ঐযে হ্যাঙ্গারে রাখা।যাওয়ার পূর্বে উমাইর ওড়না রেখে যাবে না তার পাশে!ইতস্তত তাহুরা কম্বল খানা একটু উঁচিয়ে নেয়,
–“আমি কি খুব বেশিক্ষণ ঘুমিয়েছি আন্টি?”

–“এখন ছয়টা বাজে,তাহু।উমাইর থেকে তোমার কথা শুনে খুব কষ্ট লেগেছে।নম্রতা ভীষণ লজ্জিত তার কাজে।তাই সে জানিয়েছে নয়টা করে এই বাসায় আসবে।তোমাকে দুঃখিত বলবে।”
মেঘলা হাত তুলে তাহুরার আঙুল,কানের নিচের ক্ষত দেখে।উমাইর যা বলেছে তার সাথে হাজার শতাংশ মিল।
–“আন্টি,এইসবের কোনো দরকার নেই।আমার কোনো অভিযোগ নেই কারো প্রতি।ভুল বুঝাবুঝি ছিলো,কেটে গিয়েছে সব।আপনার ছেলেকে বলুন মামীকে ফোন করে সরি বলতে।”
তাহুরা শংকিত।আত্মীয়ের মাঝে ঝামেলা হোক,এটা তাহুরার সর্বকালের অপছন্দ।সে ছলছল নয়নে মেঘলার অবয়বে চেয়ে।

মেঘলা তাহুরার চুল ঠিক করে।এমন মলিন,স্নিগ্ধ মেয়ের গায়ে হাত কিভাবে তুললো নম্রতা ভেবে পায় না,মেঘলা।মুচকি হাসে ভদ্র মহিলা,
–“মানা করে কিছু হবে বলো?উমাইর যা বলার সেটা বলেছে তার মামীকে।নম্রতা না এলে উমাইর তার মামীর সাথে ফের কখনো যোগাযোগ করবে বলে তোমার মনে হয়?আমার ছেলেটার প্রাণ যে তুমি! তোমার ব্যাপারে সামান্য উলোট পালোট হলে আমার ছেলে কিছু সহ্য করবে না।”
তাহুরা আবারও কিছু বলতে নেয়।তবে থামে।উমাইর এসেছে রুমে।কানে ফোন চেপে।তাকে অবলোকন করে মেঘলা উঠে দাঁড়ায়।দুজনের উদ্দেশ্যে বলে,
–“নিচে আসবে দ্রুত।একসাথে নাস্তা করবো সবাই।”
তাহুরা মৃদু সুরে আওড়ায়,
–“আচ্ছা,আন্টি।”

উমাইরের ভাবভঙ্গি অনড়।সে মোবাইল কানে চেপে ব্যালকনির দিকে এগোয়।মেঘলা তাহুরার গালে হাত বুলায়।আয়েশ করে শুধায়,
–“এখন তুমি আমার ছেলের বউ।যতদিন তোমাকে এই বাড়িতে উঠে না আনা হচ্ছে,ততদিন একান্ত সময় থাকলে আমাকে ‘মা’ বলে ডাকবে।কেমন?”
অমায়িক আবদার।নিজ মায়ের পর,মেঘলা নামক মহিলাটার কাছে তাহুরা মাতৃত্বের সুভাস,আভাস সব পায়।মুহূর্তে অধর প্রসারিত হয় রমণীর।মেঘলার হাত ধরে আদুরে ভঙ্গিতে আওড়ায়,
–“জ্বী, মা।”
মেঘলা হাসে প্রশান্তির হাসি।তাহুরার গায়ে হাত বুলিয়ে কক্ষ হতে বেরোয় ভদ্র মহিলা।

মেঘলা যেতেই তাহুরা নিজেকে কম্বলের আবরণ হতে মুক্ত করে।বিছানা হতে নামার পূর্বে উমাইরের পা জোড়া লক্ষ্য করে তাহুরা।উমাইর মোবাইল পকেটে পুরে। দাঁড়ানো অবস্থায় হাত এগিয়ে তার গলার ডান সাইডের কিঞ্চিৎ নিচে আঙুল স্পর্শ করে উমাইর।অদ্ভুত ভঙ্গিতে ব্যাপক জ্বলন হয়।তাহুরা ভ্রু কুঁচকে নেয়।অস্ফুট স্বর ভাসে তার কণ্ঠে।

উমাইর হাঁটু ভেঙে বসে তার সম্মুখে।পরপর গলার কিনারায় অধর দ্বারা বর্ষণ ঘটায়।তাহুরা পেছনের দিকে সরতে নিলে উমাইরের দানবীয় হাত আটকে নেয় তার পিঠ।এহেন মুহূর্তে উমাইর শরীর দুলিয়ে হাসে।তাহুরার গালে টোকা দেয়,
–“আমার মাকে দেখাচ্ছিলে,তার ছেলে কিভাবে তোমার গলার নিচে দাগ বসিয়েছে?যাও,আরো ডিপলি দাগ বসিয়েছি।”
তাহুরা হাত চেপে ধরে সেথায়। এতো চিনচিন ব্যথা হচ্ছিলো!
–“কি?আন্টির সামনে…!আল্লাহ্,উনি কি ভাবলেন?আপনি…এমন কেনো?আল্লাহ্?”

–“আমি অনেক জঘন্য।শুধু তোমার বেলায়।আমার এতো সাধের বউ তুমি।”
উমাইর নিজ ঘাড়ে হাত রাখে।পর্যবেক্ষণ করে লাজে রাঙা তার বউকে।চিন্তিত ভঙ্গিমায় মেয়েটা আরো শোভিত।ওড়না বিহীন মেয়েটা যে তাকে পিষ্ট করছে,মাথামোটা কি সেই খবর রাখছে?
পুনরায় ঘনিষ্ঠ হতে গিয়েও উমাইর নিজেকে দমিয়ে নেয়।দুপুরে মেয়েটার উপর একটু বেশি বল প্রয়োগ করে সে।ফলস্বরূপ বক্ষদেশে নিশ্চয় পীড়ায় জর্জরিত রূপসী বধূ?

–“আন্টি… মা, নিশ্চয় মনে মনে হেসেছেন।”
তাহুরার নিচু সুর।
–“ছেলে তার বউকে আদর করেছে,এটা জানলে মা না হেসে কাঁদবে?সবাই তোমার মতো মাথামোটা নাকি?”
মনের সকল ভাবনা পুষিয়ে রেখে জবাব দেয় উমাইর।
তাহুরার দৃষ্টি ছোট ভঙ্গিমায়।লোকটাকে কিছু বলা মানে,নিজের কথায় ফেঁসে যাওয়া।সে উমাইরকে সরিয়ে বিছানা হতে নামে।অনুভব করে শরীরের ভারী ভাব।উমাইর নিশ্চয় অনেক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো তার অবয়বের উপরেই।তাহুরা সম্মুখে পা ফেলার জোগাড় হলে নিজ উদরে প্রাণের স্বামীর শক্ত হাত অনুভব করে। অপর হাত বিচরণ করে বেশ নরম ভঙ্গিমায়।যেনো ব্যথা দূর করার নতুন কায়দা।তবে, ব্যথা দূরের চেয়ে অন্যরকম পীড়া হচ্ছে।উমাইর আলতো ছুঁয়ে দিলেও ক্ষীণ এক চোট অনুভব হয়।মেয়েলী কাঠামো সত্যি বেশ মোলায়েম।তবে,উমাইর ছাড়েনি।অধরের কার্য সম্পাদন করে।ছুঁয়ে দেয় মেয়েটার উপরিভাগের সকল সত্তা।পরক্ষণে শুনতে পায় উমাইরের যত্নাদির আদেশ,
–“একটা মলম দিবো।বাসায় গিয়ে লাগাবে।তবে,তৈরি করো নিজেকে উমাইরের আদরের আরো গভীরতায় মত্ত হতে,জান।”
…………….
সেদিন রাতে নম্রতা এসে সকল মালিন্য দূর করেছিলো।তাহুরা দয়ার সাগর।সে এইভাবেও কখনো কষ্ট দেয়নি কাউকে।অতঃপর নম্রতার সহিত তার সকল বোঝাপড়া ঠিক হয়।এমনকি নম্রতা এখন মাঝে মাঝে ফোন করে তাহুরাকে,খোঁজ খবর নেয়।সত্যি জানার পর নম্রতা আজও নিজের কাজের জন্যে অনুশোচনায় ভুগে।কিন্তু, তাহুরার অমায়িক ব্যবহারে নম্রতা সামলে নেয় নিজেকে।

তাহুরার অনার্স প্রথম বর্ষের ক্লাসগুলো সবসময় না করলেও,মাঝে মাঝে কলেজ যেতে হয়।নাহলে পরীক্ষার সময় বিপদ আবশ্যক।যেদিন কলেজ যাওয়া দরকার,সেদিন উমাইরকে জানায় সে।বিনিময়ে উমাইর তাকে টাকা পাঠায় কিছু।বিয়ের পর থেকে তাহুরার কলেজে আসা যাওয়ার মাধ্যম সিএনজি।অথবা,মাঝে মাঝে উমাইর নামিয়ে দেয় তাকে।

কলেজের অ্যাপ্রোন গায়ে ছড়িয়ে হিজাব করে তাহুরা।একটা চুলও দেখা যাচ্ছে না। উমাইরের নির্দেশ। চুল দেখা গেলেই নাকি টেনে ছিঁড়বে।লোকটা বদ,পাজি।একাকীত্বে পেলে ঝাঁঝরা করে ছাড়ে।কাছাকাছির মুহূর্তের কথা ভাবলে শরীরে শিহরণ জাগে। উমাইরের সেই গভীরতার দৃষ্টির কথা মনে আসলে হাত ভার হয় তাহুরার।লোকটা তখন অন্যরুপী উমাইর।কতটা ব্যাকুল থাকে সে এই মানবীর জন্যে!

কাঁধের একপাশে সাইড ব্যাগ ঝুলায় তাহুরা।বাবা নাস্তা করছে।সিএনজি সচরাচর বাবা ঠিক করে দেয়।তাহুরাকে তৈরি দেখে দ্রুত নিজ নাস্তা সাড়ে মুন্সী।মেয়ের হাত ধরে গেইটের বাহিরে দাঁড়ায়।ধরণীতে আজ রৌদ্রের তেজ।সর্বাঙ্গ ঝলসে যাওয়ার উপক্রম।বহু সময় বাদে একখান সিএনজি পায় মুন্সী।চওড়া দামে ঠিক করে।আজ পরিবহন ধর্মঘট,সময়কাল বেলা বারোটা।
তাহুরার তাড়া থাকায় দ্রুত উঠে পড়ে সিএনজিতে।বাবা কিছু নির্দেশনা দেয় রোজকারের ন্যায়।

কলেজ গেইটে নামলে স্বাগতা এবং চৈতালির দেখা মিলে।তাহুরাকে অবলোকন করে দুই সই এগিয়ে আসে।
–“তোর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।”
চৈতালি বলে উঠে।
–“কেনো রে?”
তাহুরা হাঁটা অবস্থায় প্রশ্ন করে।
–“একসাথে ক্লাসে যাওয়ার জন্যে,বেকুব।”
স্বাগতা হাসে।
–“রোদে দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষা!বাহ,ভালো তো।”
জবাব দেয় তাহুরা।
কিছুদূর গিয়ে থামে স্বাগতা। থামায় তার বাকি দুই সইকে।হাত টেনে ধরে।
চৈতালি কিঞ্চিৎ খোঁটা দেয়,
–“জানতাম তাহুর জন্যে এমনি অপেক্ষার পেছনে কারণ আছে।জলদি বল।কাহিনী কি?”
–“হ্যাঁ,কি হয়েছে?”
তাহুরা ঘাবড়ে যায়।

–“আমি, নিবরাস বিয়ে করেছি চার দিন আগে।তোদেরকে আজ বললাম।”
স্বাগতা বিনা দ্বিধায় বলে।সে ব্যাপারটা নিয়ে ব্যাপক গর্বিত।বুঝা যাচ্ছে,তার ভাব ভঙ্গিমায়।তাহুরার হাত অনায়াসে গালে পৌঁছায়।চৈতালি স্বাগতার পিঠে হাত বুলিয়ে বাহবা জানায়।আগে হতে তারা জানতো,
দুজনের প্রেম সম্পর্কে। তবে,বিয়ের খবর এইভাবে শুনবে কে বা জানতো?
–“হঠাৎ?”
তাহুরা বেশ চিন্তিত।

–“ইয়ে মানে,বিয়ের জন্যে যা দরকার তা হয়ে গিয়েছে তাই আরকি…উম,চুপ কর।জানিয়েছি তোদেরকে শোকর কর।”
স্বাগতা দ্রুত হাঁটে।তার পিছনে চৈতালি দৌড়ায়।

ভাবুক তাহুরার গতি ধীর।লজ্জা তার লাগছে কেনো?এইদিকে বিবাহিত হয়েও তাদের মাঝে কেনো এখনো গভীর সেই সম্পর্ক হয়নি এহেন চিন্তায় তাহুরা জর্জরিত।অতি চিন্তার মেয়েটা ভাবছে,উমাইর তাকে বিয়ে করে অখুশি কিনা!

অজানা অনুভূতিতে তাহুরার অন্তর জ্বলে ছারখার হয়।পরক্ষণে দুদিকে মাথা নেড়ে চড় দেয় নিজ গালে,
–“উনার হালকা স্পর্শে কেঁদে অস্থির হই আমি।আর বাকিটা! উফ আল্লাহ্।কিন্তু,উনি কি সত্যি খুশি আমার সাথে?”
মস্তিষ্কে সর্বক্ষণ নেতিবাচক কথা ঘুরপাক করে সরল মানুষের।প্রত্যেকটা পদে তারা ভাবে,আসলে কি তারা অন্য মানুষের সুখকে ধরে রাখতে পারবে!
—————-
দুই ক্লাস শেষ হলে তাহুরা তার সইদের সহিত বারান্দায় আসে।স্বাগতা,চৈতালি আর তার ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছে। নিবরাসের মা জানে তাদের ব্যাপারে।তাই স্বাগতা নিশ্চিন্তে আছে।তাহুরা কথা শুনছে কেবল।উত্তর দিচ্ছে না।দৃষ্টি তার মাঠের মধ্যিখানে।সঙ্গে মনে হাজারো ভাবনা।এরমাঝে আশ পাশ হতে শুনতে পায়,
–“আসসালামুয়ালাইকুম, স্যার।”
কোন স্যার তা আর দেখলো না মেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে।জবাবে,
–“ওয়ালাইকুম আসসালাম” শুনলে তাহুরার টনক নড়ে।মাথা বাঁকিয়ে তাকালে বুঝে,তার প্রিয়তম শক্ত ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে। সম্মুখ অবয়ব দেখার ভাগ্য হয়নি।জলপাই রঙের শার্টের আবরণে প্রশস্থ কাঁধ দৃশ্যমান কেবল।

দীর্ঘ শ্বাস বেরোয় তাহুরার।অজানা কারণে আজ নিজেকে উমাইরের বাহুডোরে আবদ্ধ হতে মন আনচান করছে কেবল।

ধর্মঘটের দরুণ কলেজ আজ জলদি ছুটি হয়।উমাইর তাহুরাকে মেসেজ পাঠায়,
–“আমি বাসায় দিয়ে আসবো।আমার সাথে যাবা।”
মেসেজ খানা রমণীর মন ভালো করতে যথেষ্ট।মোবাইল দেখে মুচকি হাসে।মেসেজ দেখে উত্তর না দেওয়ার ওপার হতে উমাইরের ফোন আসে তাহুরার নিকট।
তাহুরা রিসিভ করে একটু আড়ালে গিয়ে,
–“জ্বী?”
–“মেসেজ দেখে উত্তর না দেওয়ার সাহস কিভাবে হয়?”
ঝাঁজ উমাইরের কণ্ঠে।
–“ফ্রেন্ড ছিলো তো…আমি দিতাম মেসেজ এখন…”
–“পার্কিংয়ে আসো।রাস্তায় ঝামেলা বাড়ার আগে যেতে হবে।”
ফোন কাটে উমাইর।

এতো তাড়া!কেনো তাড়া?উমাইর কি বলতে পারে না,”আজ ধর্মঘট শেষ হওয়া অব্দি তোমার সাথে গাড়িতে আটকে থাকবো,বউ!”
হাহ,মনের কষ্ট মনেই চেপে রাখে তাহুরা।আজকাল উমাইরের নাগাল না পাওয়ায়,মেয়েটা এমন মরিয়া হয়েছে কেবল একটু কাছাকাছি থাকতে মানবের। সইদের বিদায় জানিয়ে তাহুরা ঝটপট হাঁটে। উমাইরের গাড়ি প্রধান ফটকের সম্মুখে।

বাকিসব চিন্তা বাদ দিয়ে ভেতরে বসে তাহুরা।গরমে চামড়া ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম।তাহুরা গাড়ির এসি কিছুটা নিজের দিকে ঘুরায়।ফুরফুরে বাতাস মুখশ্রী স্পর্শ করলে শব্দ করে সে,
–“আরাম।”
উমাইর তির্যক দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করে মেয়েটাকে।অতঃপর তার কাঁধে হাত রাখে,
–“টায়ার্ড বউ?”

তাহুরা উমাইরের পানে ফিরে।লোকটা কি জানে,”বউ” শব্দটা শুনলে তাহুরার নিজেকে সর্বসুখী মনে হয়!
–“নাহ।”
সহসা জবাব দেয় তাহুরা।
উমাইর হাসে।আজ তার পরিকল্পনা লম্বা।তাহুরা জানলে নিশ্চয় খুশি হবে!বউটার সাথে সময় কাটায় না বহুদিন।ধর্মঘটের বাহানায় বউকে কাছে পাওয়া যাবে,ভাবলে অন্তরে প্রশান্তি আসে তার।কিছু খাবার কিনে তাহুরাকে দেয়।নিজে খেয়ে,তাকেও খাইয়ে দেওয়ার আর্জি জানায়।তাহুরা নীরব দর্শকের মতো কথা শুনে কেবল।

ট্র্যাফিকে বেশ সময় আটকে থাকার পর,গাড়ি অন্য রাস্তায় গেলে,তাহুরা উৎসুক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে,
–“অন্য রাস্তা দিয়ে যাবেন?”
–“অন্য রাস্তায় যাবো।বাসায় ফোন দিয়ে বলেছি রাস্তায় গাড়ি চলছে না।জ্যাম।”
আসলেই প্রধান রাস্তায় প্রচুর ট্র্যাফিক।উমাইর গাড়ি চালাচ্ছে মূলত উল্টো দিকে।অলি গলির মাঝে।যেখানে ধর্মঘট হলেও কিছু যায় আসে না।

–“আমি বাসায় কি বলবো?”
তাহুরা প্রশ্ন করে।
–“জামাইর সাথে আছো,একটু পর জামাই তোমাকে জোর করে অনেকবেশি আদর করবে এটা বলবে।”
হাসি বাড়ে উমাইরের।তাহুরা ঝুঁকে খানিকটা।মনের সকল চাওয়া আবার বন্ধী হচ্ছে।লোকটা বড্ড বেসামাল।
তাহুরা বাসায় ফোন করে।মাকে জানায়, উমাইরের সাথে আছে সে।রাস্তায় প্রচুর জ্যাম,গাড়ি চলে না।তার কথা মুন্সী,তার মা বিশ্বাস করেছে। টিভি চ্যানেলে ধর্মঘটের ব্রেকিং নিউজ হচ্ছে,অবিশ্বাসের কথাই নেই।

গাড়ি “সিটি গেইট” ভেদ করে গ্রামীণ রাস্তায় ছুটছে।উমাইর কিভাবে যেনো সুড়ঙ্গ হাতড়ে এই রাস্তায় এসেছে।বড্ড দক্ষ মানব।
সকাল হতে হিজাব পড়ার দরুণ চুলের গোড়ায় তার ব্যথা অনুভব হয়।গ্রামীণ পরিবেশ লক্ষ্য করা অবস্থায় হিজাব খুলে সে।ক্লিপ খুলে চুল পিঠে এলিয়ে দেয়।হাতের আঙুলে নজর এলে,এখনো জাফরানের কামড়ের দাগটা লক্ষণীয়।
মলিন হাসে মেয়েটা।গায়ের অ্যাপ্রোন খুলে পিছনের সিটে রাখে।

অনুভব করে উমাইর তার হাতের মুঠো দখল করেছে।তাহুরা সিটে মাথা এলিয়ে দেয়।অন্য হাত উচুঁ করে উমাইরের গালের পাশে স্পর্শ করে,
–“নাস্তা করেছিলেন সকালে?”
উমাইর অধর স্পর্শ করে তাহুরার হাতের তালুতে,
–“করেছিলাম।”
–“মিস করি তোমাকে বউ,অনেকবেশী মিস করি।”
জবাব দেয় উমাইর।তাহুরার নিকট এলে উমাইরের সবটা এলোমেলো হয়।ভেতরটা হরতাল সৃষ্টি করে।
তাহুরা আরচোখে তাকায়।দৃষ্টি মিললে উমাইর হেসে টিটকারী দেয়,
–“চোরের মতো না তাকিয়ে,কাছে আসো।”
তাহুরা অনড়।মন আজ বাচ্চামি করছে।অন্তত বলছে,উমাইর আজ একটু বেশি অধিকার দেখাক!
যথারীতি উমাইর তার বাহু টানে।এক ঝটকায় নিজ উরুর উপর টেনে কাছে আনে,
–“মাথামোটা,কথার সাথে কাজ করবে।”
তাহুরা সোজা হলে,উমাইর তার কাঁধ চেপে ধরে।মিশিয়ে নেয় বুকের মধ্যিখানে,
–“মনে পড়ে আমার কথা,জান?”
–“অনেক।”
তাহুরা ধিম শব্দতে জবাব দেয়।

মাথা নিচু করে উমাইর।বুকের সাথে লেপ্টে থাকা প্রেয়সীর সহিত নজর মিলে।কপালের মধ্যভাগে ভালোবাসার ছোঁয়ায় মত্ত করে,
–“বাসায় থাকতে আসো।সেদিন জড়িয়ে ধরে ঘুমানোটা আমার শেষ ভালো ঘুম ছিলো।আর ঘুমাতে পারছি না।ভাবী ফোন করবে তোমার বাসায়।”

–“নাহ।এখন যাবো না।বাবা,মা যদি কিছু জানে,খুব কষ্ট পাবে।একসাথে থাকা…”
–“চুপ,একদম চুপ।কি পরিমান ধৈর্য্য নিয়ে তোমাকে কাছে থাকতে বলছি তুমি জানো, মাথামোটা?”
কিঞ্চিৎ সুর উচুঁ করে উমাইর। এতে ভয়ে কুঁকড়ে যায় তাহুরা।সরল মেয়েটা কি ভুল বললো?
–“আপনি..রেগে যাচ্ছেন?”

–“না।আমি সুখী।সুখের নৌকায় দূরের যাত্রায় যাচ্ছি।স্টুপিড।”
উমাইর কোমর হতে হাত সরায় তার।

এতে তাহুরার মন ভঙ্গুর হয়।সোজা হয়ে বসে উমাইরের শার্টে হালকা টান দেয়,
–“রাগ করেছেন?
–“কিস মি।”
উমাইর সোজা উত্তর দেয়।

চলন্ত গাড়ি,সাথে দিনের বেলা।যদিও মানুষের সংখ্যা একেবারে নেই,তাও উমাইরের মতো দক্ষ সে না।হালকা ঢেঁকুর গিলে তাহুরা,
–“রাস্তায় কিভাবে?”
–“যেভাবে আমি দিই।”
তাহুরার হাত ঘেমে আসে। জড়তায় মুষড়ে যায়।অথচ সে কিনা ভাবলো যতসব গভীর চিন্তা?
গাড়ি ততক্ষণে সবুজে আবৃত পাহাড়ের চূড়ায়।গোপন জায়গা।ভার্সিটি চলাকালীন সময়ে এই জায়গায় গোপন আড্ডায় মত্ত হতো বন্ধুমহলের সাথে।আশেপাশে সবুজের চূড়া ব্যতীত কিছু নেই।

তাহুরা ভাবতে ভাবতে উমাইর গাড়ি থামায়।প্রসঙ্গ এড়াতে তাহুরা চুলের গোছা গুঁজে বলে,
–“জানেন নিবরাস বিয়ে করেছে স্বাগতাকে।”
–“আমি সাক্ষী ছিলাম সেখানে।”
উমাইর সোজা জবাব দেয়।

তাহুরা অবাকের সর্ব শীর্ষে।কিছু বলার পূর্বে নিজের অধরের মালিকানা হারায় সে। উমাইরের হাত পৌঁছায় বউয়ের কামিজের আড়ালে।উন্মুক্ত অবয়বে।তার অবাধ্য স্পর্শে তাহুরা ধাক্কা দেয় উমাইরের কাঁধে। অপর হাতে তাহুরার দুইহাত একত্রে মুঠোয় নেয় উমাইর।মুক্ত হয় দুইজন। হাঁপিয়ে শ্বাস নিতে ভুললো তাহুরা।

উমাইরের বিদ্ধস্ত চুল কপালে হামলে আছে।অধর ভিজে।ভ্রুদ্বয় কুঁচকে। হাত এখনো আগের জায়গায়।সেথায় জোরালো স্পর্শে চোখ বুঁজে ব্যথার অভিপ্রকাশ করে তাহুরা।বিনিময়ে বউয়ের মোলায়েম আদুরে ভঙ্গিমায় উমাইর আরো নিকটে আসে।জোরালো নিঃশ্বাসের প্রকাশ ঘটায় তার মুখশ্রীতে।আদুরে রাগান্বিত সুরে আওড়ালো,
–“যখন আমি তোমাকে স্পর্শ করি,বা কাছে টানি কখনো আমাকে ধাক্কা দিবে না।সব সহ্য হয় আমার,কিন্তু তুমি আমার কাছে আসার সময় বাঁধা দিলে আমি এতটা বেসামাল হবো, কেঁদেও রক্ষা পাবে না।”

তাহুরার আঁখি ছলছল।মুহূর্তে রক্তিম হয় নাকের ডগা।উমাইর বউয়ের ভীতি বুঝতে পারে।তার বউটা বড্ড সরল।কিন্তু,উমাইর মেয়েটার বেলায় বেপরোয়া।মানব অন্তরে বিশ্বাস রাখে;ঠিক সামলে নিবে সরল তাহুরা,বেপরোয়া উমাইরকে।
উমাইর তার রক্তিম নাকে দাঁত স্পর্শ করে।তাহুরা মিহি সুরে আওড়ায়,
–“কখনো এমন করবো…”

উমাইর আঙ্গুলের সাহায্যে তাহুরার ঠোঁট চেপে ধরে।গমগমে সুরে বলে উঠে,
–“সব কথা আমার রুমে শুনবো।ভাবী ফোন করবে।ভনিতা ছাড়া যেনো আসো।নাহলে,ডিসেম্বর পর্যন্ত উমাইর তোমাকে যা টর্চার করবে,ছোট্ট মাথামোটা তোমার সহ্য হবে না।”

চলবে……..

#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব: ৩২
__________________
–“আপু,তোমার দেবর কি বাসায় আছে?উনি আমার ফোন ধরছে না।কথা বলছেন না উনি আমার সাথে।”
গলার স্বর চিকন।কণ্ঠে বেদনা।আঁখিতে জলের মারাত্মক সর্দি।ফলস্বরূপ গলার আওয়াজ একেবারে মিহি,ভারী।নিঃশ্বাস নিতে হয় গালের মাধ্যমে।তাহুরা ওড়নার কিনারায় নাক মুছে। নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়ার জোগাড় নেই।নাক বন্ধ।চুপি ভঙ্গিতে আবার দরজার পানে দৃষ্টি দেয় তাহুরা।মা আসছে না।রান্নার কাজে ব্যস্ত এখন।সেই সুযোগে বোনের সাথে কিছু অনুভূতি আদান প্রদান করা দরকার।
উমাইর জিদ দেখালেও,টুকটাক খোঁজ নিয়েছে গতকাল।আর এখন বন্ধ,একেবারে বন্ধ।লোকটার আদেশ না মানায় এতো অভিমান?এইযে তাহুরা মারাত্মক কাশি,সর্দিতে আক্রান্ত,আজ ডাক্তারের কাছে গেলো লোকটার কি সেই হদিস আছে?জিদ দেখানো দরকার সবসময়?মনটা ভারী হয়,সাথে অশ্রুর বেগ বাড়ে আঁখি মালায়।

–“উমাইর ভাইয়ার কথা মেনে নে।কয়েকদিনের জন্যে আয়।”
সুনেরা জানায়।সকালে তার ডাক্তারের নিকট যাওয়ার ফন্দি উমাইর কেটেছে, তা গোপন রাখলো দায়িত্ববান ভাবী। উমাইরের নির্দেশনায় তাহুরা বুঝে নিক,ছেলেটা ভীষণ রেগে।মনের রাণীকে কাছে রাখতে কতো না ছলনার আশ্রয় নিতে হচ্ছে উমাইরের!
–“কি বলছো?বাবা জানলে খারাপ ভাববে না বলো?বাবা কি জানে আমার বিয়ে হয়েছে?তোমার দেবর কিছু বুঝতে চায় না।হিংস্র জলদস্যু সত্যি।”
তাহুরা উত্তেজিত।

–“উহু,আয় তুই।কিছু হবে না।বোনের বাড়িতে বোন আসবে,বাবা বুঝবে সব।বেশি পাকনামি করছিস তুই!”
আপেল কামড় দিয়ে জবাব দেয় সুনেরা। বোকা মেয়েটা অযথা চিন্তা করে মাথা ব্যথা বাড়ায় নিজের।সম্মুখে বসা মেঘলা বেগমকে ইশারায় বুঝিয়ে বলছে তাহুরার কথা।মেঘলা মুচকি হাসে।ছেলের জন্যে মেয়েটার জর্জরিত অবস্থার কথা ভেবে আবার মনটা মলিন হয়।সরল মেয়েটাকে তার ছেলে বড্ড জ্বালায়।

–“আপু উনাকে…”
–“এই তাহু শুন।”
মায়ের কথায় অর্ধেক কথা থামে তাহুরার।পরপর ফোন কাটে সে।দ্রুত উঠে।যেনো চুরির পর বিরাট ধরা খাওয়ার সম্ভবনা। মা এসে সরাসরি দাঁড়ায়। হাতে টিস্যু ধরিয়ে জানায়,
–“ঐ বাড়ি যাবি আজ।কয়েকদিন থেকে আসবি।তোর বাবাকে বলেছি।তোর বাবা নিজেই বললো,বাসায় মন মরা না থেকে বোনের কাছে থেকে আয় কিছুদিন।”
তাহুরা নাকে টিস্যু চাপে ।খুশিতে নাকি উত্তেজনায় নাকি উমাইরের সম্মুখে থাকবে এই কয়দিন তার জন্যে অন্যরকম অনুভূতি,কিসের মাত্রা অনুভব করলো জানা নেই তার।মনটা কেবল জানিয়েছে, উমাইরের বাহুডোরে নিজেকে এলিয়ে দিবে আজ সে।লোকটার সুঘ্রাণ পেতে ভেতরটা মরিয়া।আবারও কি লাজে রাঙিয়ে দিবে উমাইর তার সকল সত্তা!

–“বাবা,কি সত্যি রাজি?”
তাহুরা মায়ের হাত ধরে।শিউলি বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায়।মেয়েটা তার ভীষণ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে।শিউলি স্পষ্ট বললো তার বাবা রাজি,তাও মেয়ের একই প্রশ্ন।বিরক্ত হয় মহিলা,
–“সুন্দর থ্রিপিস নে সব।সন্ধ্যায় গাড়ি পাঠাবে বললো উমাইর।”
–“উমাইর!উনি ফোন করেছিলেন তোমাকে?”
তাহুরা অবাক হয়।
–“তুই যা শুরু করলি,আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে।ভাত খা।এরপর রেডি হবি।বিকাল হচ্ছে এখনো তার ভাতের খবর নেই।এরপর ঔষুধ খাবি।”
–“সামান্য কাশি,সর্দির জন্যে জোর করে ডাক্তার দেখানোর কি দরকার ছিল? ঔষুধ আমার ভালো লাগে না,মা।”
তাহুরা বিছানায় বসিয়ে পা ঠেকায় বুকের সাথে।
–“আজ পর্যন্ত তোর ভালো লাগলো কিসে?মেজাজ খারাপ করার আগে জলদি যা।”
শিউলি মেয়েকে মিছে রাগ দেখালেও অন্তরে তার শান্তি।মেয়েটাকে এক লক্ষ্মী ছেলের হাতে যে দিয়েছে।সারাজীবনের জন্যে।

শিউলি যেতেই তাহুরা আবারও মোবাইল হাতে নেয়। উমাইরকে ফোন দেয়।কিছুক্ষণ রিং বাজলে অপর দিকে হতে ভেসে আসে,
–“আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে।”
বাকিটা শোনার পূর্বে তাহুরা ফোন রেখে গটগট অক্ষরে মেসেজ পাঠায়,
–“বাসায় আসছি।অন্তত এখন ফোনটা ধরুন?”
মোবাইলের পানে দৃষ্টি তার চাতক পাখির ন্যায়। এখন বুঝি উমাইর ফোন করলো!কিন্তু আশা রইলো অপূর্ণ।

লোকটা মেসেজ দেখলো ঠিক,উত্তর দিলো না কিছু।
তাহুরা খুব কষ্ট পেলো অন্তরে খুব।কাশির সাথে চোখের পানি মানিয়ে নেয়।মোবাইল ছুঁড়ে বিছানায়।কেনো সে অভিমান করতে পারে না পাজি লোকটার সাথে!কেনো সামান্য কিছুতে লোকটার জন্যে অন্তর নড়ে উঠে!মানবকে বেশি ভালোবাসে তাই নিশ্চয়।
কক্ষ হতে বেরুনো অবস্থায় তাহুরা আপন মনে শুধায়,
–“জলদস্যু থেকে আমি কিভাবে মায়া দয়া আশা করি!আমি সত্যি মাথামোটা।”
কপালে আলতো চড় দেয় তাহুরা।মেয়েটা ভারী সরল।

ব্যাগ গোছানো শেষে তাহুরার বাবার কক্ষে যায়।বাবার পায়ে হাত ছোঁয়ালে মুন্সী জাগে।দোকান হতে ফিরে ভদ্রলোক বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।মেয়ের স্পর্শে সজাগ হোন।বিনয়ের সুরে আওড়ায়,
–“আম্মা,চলে যাচ্ছো?”
–“নাহ।গাড়ি আসেনি আব্বা।”
মুন্সী উঠে বসে।বুকের মাঝে হাত গুঁজে।মেয়েকে প্রশ্ন করে বিনয়ের সাথে,
–“উমাইর,ছেলেটাকে তোর ভালো লাগছে তো?আমি কিন্তু বিয়েতে শুধু ছেলের মত শুনে হ্যাঁ বলিনি।আমার কাছে খবর এসেছিলো তোরও পছন্দ উমাইরকে।”
মুন্সী সেদিনের হাসপাতালের কিছু কথা চেপে গেলো।কেবল প্রাণ জুড়িয়ে মেয়েকে দেখছে।উমাইর গোপনে,আড়ালে, সরাসরি মেয়েটার বড্ড যত্ন নেয়।শিউলি গল্প পাতে তাকে।সুনেরার সুখী সংসারের কথাও জানে মুন্সী।

–“আমি….খুশি..খুশি বাবা।”
তাহুরা জানায়।বদ মেজাজ ছাড়া,উমাইর বাকি সবকিছুতে সেরা।কেবল,তাহুরাকে বিনা কারণে অতিরিক্ত কাঁদায় লোকটা।মেঘলা থেকে জানে তাহুরা,উমাইর যতো বদ মেজাজ সব তাহুরার জন্যেই বরাদ্দ।অন্য ব্যাপারে উমাইর বিরাট হাঙামা করে।অথচ,তাহুরা এমনটা দেখলো না কখনো।কেবল জানে,লোকটার সম্মুখে গেলে তাহুরা,লোকটা মিইয়ে যাবে।বুকের মধ্যিখানে আটকে নিবে।তার সন্নিকটে আসার জন্যেই তো উমাইরের এতো রাগ, গোস্সা।

–“শান্তি পেলাম,আম্মা।জলদি ফিরে আসবে।আসার সময় বোনকে আনবে।দুইবোন আমার ঘরকে আবারও আলোকিত করবে,আম্মা।ঠিক আছে?”
মুন্সী সস্থির নিঃশ্বাস ফেলে।তাহুরা মাথা নাড়ায়।তখনই আসে শিউলি।আঁচলে হাত মুছে। তাড়া দেয়,
–“গাড়ি এসেছে।আয় জলদি।”
বাবাকে সালাম করে তাহুরা।বাবার হাতে হাত বুলায়,
–“উঠো না তুমি। ঐ বাড়িরই গাড়ি।বিশ্রাম নাও।পৌঁছে মাকে ফোন করবো আমি।”
মুন্সী মানেনি তাও।মেয়েকে গাড়ি অব্দি উঠিয়ে দেয়।
তাহুরা বাবা মাকে বিদায় জানিয়ে মোবাইলের নোটিফিকেশন চেক করে ফের।পাষাণ লোকটার কোনো হদিস নেই।ক্রোধ আসে না কেনো মেয়েটার অন্তরে?এখনো আঁখি ভরে আসছে।উফফ,মেয়েটা এমন সরলবতী হওয়া খুব দরকার ছিলো?
প্রশ্নটা উমাইর যদি শুনতো,তাহলে অবশ্যই বলতো,
–“হ্যাঁ।মেয়েটা সরলবতী।কেবল উমাইরের আদুরে সরলবতী।”
……………
ঐ বাড়িতে পৌঁছালে দুয়ারে দাঁড়ানো মেঘলাকে দেখতে পায় তাহুরা।ঠিক সেই সময় মোবাইলে মেসেজ আসে।তাহুরার ইচ্ছে করলো না দেখতে।সে বুঝে নেয়,অন্য কোনো বেদরকারি মেসেজ নিশ্চয়।তার পাষাণ জলদস্যু তো মেসেজ দিবে না!
মেঘলা আগ বাড়িয়ে এগিয়ে আসে।জড়িয়ে নেয় তাহুরাকে। খুঁক খুঁক কাশছে মেয়েটা।মেঘলা তার চিবুকে হাত রাখে।নরম ভঙ্গিতে আওড়ায়,
–“অসুস্থ লাগছে?”
–“নাহ,আন্টি….মা।একটু কাশি।”
তাহুরা উত্তর দেয়।
মেঘলা হাসে।উমাইর এমন লক্ষ্মী মেয়েকে নিজের জন্যে নির্বাচন করে সবচেয়ে ভালো কাজ করেছে।মেয়েটাকে দেখলেই প্রাণ জুড়ায় মেঘলার।
–“জলদি ভেতরে আসো।একটা সুখবর আছে কিন্তু।”

–“সুখবর?কি সুখবর?”
তাহুরা উৎসুক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে।
–“বড় বউমা বলবে।বিরাট সুখবর।”
মেঘলা কাঁধ জড়িয়ে ভেতরে নেয় তাহুরাকে।নিচের ফ্লোরে সকলে উপস্থিত।কেবল নেই তার জলদস্যু,জুবায়ের আর বোন।একে একে সকলের সহিত কুশল বিনিময় শেষে দো-তলায় যায় তাহুরা।মেঘলা নিয়ে এসেছে তাকে।

বোনকে বিছানায় ক্লান্ত অবস্থায় দেখে বিচলিত হয় খানিকটা।জুবায়ের মাথায় হাত দিয়ে মালিশ করছে তার।বোনকে অবলোকন করলে সুনেরা হাত এগিয়ে দেয়।তাহুরা ধীরে সে জায়গা দখল করে,
–“আপু,কি হয়েছে?ঠিক আছো?”
–“আছি তাহু।একটা গুড নিউজ হচ্ছে,তুই খালামনি হচ্ছিস।”
সুনেরা আত্মহারা খুশিতে।তাহুরা বোনের পানে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়।বিশ্বাস করতে দুমিনিট লাগলো।তার আপন বোনের বাচ্চা আসতে চলেছে।বড্ড আদুরে হবে না সেই বাচ্চাটা!
ইস,কি আনন্দ!তাহুরা স্বাভাবিক গলায় খুশির বহিঃপ্রকাশ করে,
–“আলহামদুলিল্লাহ্ আপু।”
দুবোন মেতে উঠে খুশি ভাগাভাগিতে।

বেশ খানিক পর মোবাইল বেজে উঠে তাহুরার।মাত্র নাস্তা শেষ করে উমাইর তথা নিজ কক্ষে যাচ্ছিলো তাহুরা। উমাইরের নাম্বার দেখে এক সেকেন্ড সময় নেয়নি সে ফোন রিসিভ করতে।কিছু বলার পূর্বে ভেসে এলো উমাইরের কঠোর শব্দ,
–“মেসেজ দিয়েছি দেখোনি কেনো?শরীর ভালো লাগছে এখন?”
–“আপনি..আপনি কবে মেসেজ দিলেন?”
তাহুরা খানিক দূরে গিয়ে কথা বলে।মানুষের সামনে তো আর নিজের বকা শোনার কাহিনী দেখাবে না সে!
–“মেসেজ চেক না করে আবার বড় কথা?মোবাইল ইউজ করো কেনো তুমি,মাথামোটা?”
–“সারাদিন শরীর খারাপ আমার,তখন মেসেজ দেননি।খবর নেননি।”
তাহুরার অভিমান শব্দ আকারে প্রকাশিত হয় ধীর গতিতে।

–“মা থেকে জিজ্ঞাসা করো ডাক্তার দেখানোর জন্যে জোর করা, কার কথায় করেছে উনি!আমি তোমাকে এইসব বলছি কেনো?এই মাথামোটা,নাস্তা করেছো?মেডিসিন এনেছো সব?”
উমাইর খেঁকিয়ে উঠে।
–“তার মানে আপনি মাকে ডাক্তার দেখানোর…”
–“একশোটা প্রশ্ন করলে তার জবাবে শুনতে হয় সেই প্রথম কথারই।শেষ বার বলছি,শরীর কেমন এখন?মেডিসিন সব এনেছো?না আনলে আমি নিয়ে আসবো।”
তাহুরাকে থামিয়ে বলে উঠে উমাইর।

–“জ্বী এনেছি।আর শরীর এখন ভালো।”
কথার মাঝে বেশ কয়েকবার কাশে তাহুরা।খুব বাজে ভঙ্গিতে গলা খারাপ হয়েছে তার।
–“ওকে।রেস্ট করো।আমি মাত্র কলেজ থেকে বেরিয়েছি। বিকালে ডিপার্টমেন্টের মিটিং ছিল।ফুটবল খেলতে যাচ্ছি।বাসায় ফিরতে দেরী হবে।”
উমাইর ফোন কাটে।মেয়েটার উত্তর শুনেনি আর।লোকটা এমন কেনো?যত্ন নিয়েও প্রকাশ করে না।ধমকির সাথে যত্ন।কি অদ্ভুত যত্ন এটা!
তাহুরা আলগোছে হাসে।
…………
উমাইর ফিরে রাত তখন বারোটার কাঁটায়।তাহুরা মেঘলার সহিত বসে ছিলো।মূলত মেঘলা সুনেরার যত্নদি শেষে ফের উমাইরের কক্ষে আসে।তাহুরা ভীত সুরে এক দুবার বলেছিলো মেঘলাকে কক্ষে ফিরতে।কিন্তু,মেঘলা যায়নি।তাহুরার সাথে গল্প জুড়েছিল ঢের।ছেলের প্রবেশে মা টুকটাক আলাপের অন্তিম ঘটিয়ে বেরিয়ে যায় কক্ষ হতে।

উমাইরের পড়নে হাঁটু সমান স্পোর্টস প্যান্ট,এবং প্লেইন জার্সি।সেথায় ক্লাবের নাম লিখা।
দুজনের দৃষ্টি মিলে সরাসরি।তাহুরা মাথার ঘোমটা টানে আরো প্রগাঢ়।হাতে বিদ্যমান ব্যাগের সাথে শপিং ব্যাগ এগিয়ে দেয় সে তাহুরার পানে,
–“অফিসের কাপড় বের করো।ব্যালকনিতে রাখো।”
তাহুরা কথা শুনে উমাইরের।ফিরে এসে পায়নি উমাইরকে।বাথরুমে নিশ্চয়।দরকার দিকে নজর যায় মেয়েটার।দুইখানা কঠোর লক তাদের ঘরে বন্ধী।
উমাইর রাতে খাবে না?ভাবনায় মশগুল সে বিছানার কিনারায় বসে।একটু নড়লে যেনো মাটিতে বসবে।
বাথরুমের দরজার খট শব্দ হলে বুক ভার হয় তাহুরার।উমাইর তার কাপড় ধুয়েছে।সেটা নিয়ে ব্যালকনিতে যায়।

উমাইর রুমে এলো তাওয়াল মাথায় চালিয়ে।উদোম শরীরে কেবল ট্রাউজার পড়নে।তাহুরা মুখ খুলতে চাইলো কিন্তু পারলো না উমাইরের কথার জন্যে,
–“ঘোমটা আরেকটু টেনে মুখ ঢেকে ফেলো।”
তাহুরা চমকিত, হচকিত।বুকটা ধড়াস শব্দ করে।তাহুরা অধর কাটে দাঁত দ্বারা,
–“জ্বী?”

উমাইর দ্রুত হাঁটে।ভ্রু কুঁচকে চায় মেয়েটার পানে।এক ঝটকায় পুরো ঘোমটা সহ ওড়না টেনে খুলে,
–“রুমে আমার সাথে একাকী থাকলে ঘোমটা কেনো, ওড়নাও যেনো না থাকে।পরের বার আমি খুললে কিন্তু ব্যাপারটা ভালো দেখবে না তুমি।”
তাহুরা পিছনে যায় কিঞ্চিৎ।দু ভ্রু সমান করে মলিন ভঙ্গিতে তাকায় উমাইরের পানে।কি নিষ্পাপ ভঙ্গি!বুকে দাগ পড়ে উমাইরের।উমাইর হাত ধরে তাহুরার।সোজা দাঁড় করায় মেয়েটাকে। ক্লিপে আটকানো চুল খুলে।মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে কেশরাণীরা।

–“এই যে,রাতে খাবেন না?”
তাহুরা প্রশ্ন করে।দৃষ্টি হারিয়ে যাচ্ছে সম্মুখে দাঁড়ানো লোকটার অবয়বে।মারাত্মক আকর্ষণীয়।হালকা ভিজে আছে এখনো।পানির কণাকে হিংসে হয় তাহুরার।লোকটা কেবল তার।এই অবয়বে কেবল তাহুরা আটকে থাকবে।পানির কণার কাজ কি?তাহুরা হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয়,মুছে দেয় বিন্দুকণাকে।সেই স্পর্শে মাতোয়ারা হয় দুই হালাল কপোতযুগল।

উমাইর হাত ধরে তাহুরার।অধর স্পর্শ করে সেথায়,
–“খেয়েছি,জান।”
এক ঢিলে দুই পাখির হত্যা করে উমাইর।তাহুরা লাজুক ভঙ্গিতে আড়ষ্ট।সর্দিতে বড্ড মাথা ব্যথা হলেও লোকটার নিকট সকল ব্যথা যেনো কই উবে যায়।তাহুরার কাশি বাড়ে।

উমাইর চিন্তিত হয় ঢের।বিছানায় বসায় তাকে।গলার ভাঁজে হাতের স্পর্শের জানান দেয়,
–“মেডিসিন খেয়েছো?”
–“হুম। মা খাইয়েছে।”
তাহুরা জবাব দেয়।
–“গুড গার্ল।”
উমাইর অধর ছোঁয়ায় তাহুরার ললাটে।

–“ঘুমাবো এখন।সকালে ক্লাসে যেতে হবে।ডেকে দিও।আজ এলার্ম দিলাম না।বউ আছে, এলার্মের দরকার কি?”
উমাইর নির্দেশ দেয়।তাহুরা মাথা নাড়ায়।পেছন ফিরে ওড়নায় হাত দিতে গেলে,আবারও হাত সরায়।উমাইর এসে ওড়না নিয়ে যায় ঠিক।নেওয়ার সময় চোখ টিপে চুমুর ভঙ্গিমা দিতে ভুললো না।

লোকটা তার সম্মুখে এলে অন্যরূপে আসে।আর তাহুরা বাসায় থাকলে,তখন লোকটা যেনো সকল ক্রোধ তাহুরার উপর প্রকাশ করে।
হাসে তাহুরা।অধরে হাত রাখে। যেমনই হোক, মানবটা।এই মানবেই তো তাহুরা নিঃশেষ হয় সর্বক্ষণ।

সেইবার একসাথে ঘুমালেও অনুভূতি ছিলো অন্যরকম।আর আজ একেবারে ভিন্ন। উমাইরের বুকে আটকে তাহুরা।দুইজনের দেহের মাঝে নেই কোনো স্পেস। উমাইরের এক হাত তাহুরার কামিজের গভীরে।সুন্দর রোমান্টিক এক মুহুর্ত।অথচ,তাহুরা স্থির নেই।তার কাশি যেনো বিরাট বাঁধা।তাহুরা সরতে চায়।কিন্তু, উমাইরের আবরণ হতে মুক্তির হদিস নেই।লোকটার ঘুমে সমস্যা হচ্ছে নিশ্চয়!

তাহুরা উমাইরের উদোম বুকে হাত রাখে।ধীরে বলে,
–“আমি একটু দূরে ঘুমাই? আমার কাশিতে আপনার অসুবিধে হচ্ছে।”
তাহুরার কথায় উমাইর চোখ খুলে নির্বিঘ্নে।অধর জোড়ার মিলন ঘটায়।জ্বলছে অধরের চামড়ায়।ঘুমানোর পূর্বে উমাইর তার ভালোবাসার প্রদান ঘটায় সল্প পরিসরে।এখন আবার এহেন স্পর্শ!উমাইরের হাতের নৃত্য অস্বাভাবিক।তাহুরা নিজেকে সামলানোর জো নেই।তার নখ বিঁধে যাচ্ছে উমাইরের পিঠে।জ্বলছে কি?হ্যাঁ।তবে এখন সেই অনুভূতির হিসেব কষা নিষেধ তার।তাহুরার চুলের আবরণ তার হাতের মুঠোয় বিদ্যমান।উমাইর আরো ঘনিষ্ঠ হয়।তাহুরা তাকে থামায়।কেশে উঠে ফের।

উমাইর গাল চেপে ধরে তাহুরার।ক্ষিপ্ত সুরে বলে,
–“আরামের ঘুমের জন্যে আনিয়েছি তোমাকে।দূরে শুয়ে শোক পালন করতে না।”
মিটমিট আলোর মোলায়েম কক্ষে উমাইরের রাগে ভস্মিত চেহারা স্পষ্ট।তাহুরা ভীতু দৃষ্টিতে চায়।লোকটার এলোমেলো চুলের গভীরে নিজ হাতের জানান দেয় মেয়েটা। নাক টেনে বলে,
–“অনেক কাশি আমার।আপনার ঘুমে সমস্যা হচ্ছে,তাই…সরি..উমাইর…”
উমাইর তাহুরার পিঠের নিচে হাতের প্রবেশ ঘটায়।মিশিয়ে নেয় মেয়েটাকে নিজ বক্ষ দেশে।চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
–“কাশি হলেও সমস্যা নেই,জান। জাস্ট তুমি কাছে থাকো আমার।”
–“সরি বলতে হবে না রে বউ।শুধু আমার সাথে লেপ্টে থাকো।চুমু খাও আমাকে।”
উমাইর আলগোছে হাসে।অনুভব করে বুকের উপরিভাগে মেয়েটার নরম অধরের গরম ছোঁয়া।পুরুষালি সকল অনুভূতিরা কক্ষ জুড়ে বিচরণ করে।আঁখি তুলে তাকায় তাহুরা।খুন হয় উমাইর।
পরপর কেশে উঠে আদুরে প্রেয়সী।সকল অনুভূতি দমিয়ে রেখে তাহুরার কানে আলতো কামড় দেয় উমাইর,
–“আজ তোমার কাশির জন্যে বেপরোয়া হয়েও হলাম না,জান।খুব বেশি কি সমস্যা হবে একটু বেপরোয়া হলে?”

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে