#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব-২৩
____________________
–“বেয়াই সাহেব,আজ ভাইয়ের মতো এক আবদার করতে যাচ্ছি।আমার ছোট ছেলের জন্যে আপনার আদরের ছোট মেয়েটাকে চাই।”
অমায়িক উক্তি জয়ের। উমাইরের পূর্বে হাসপাতালে আসলে তার মনের সকল অনুভূতি মিশিয়ে জয় কথাখানা বলে।জুবায়ের বাবাকে জানিয়েছিলো সবটা,এছাড়াও মেঘলা উমাইর এবং তাহুরার ব্যাপারে পূর্ব হতে জ্ঞাপন করে। যার দরুণ জয় পরিস্থিতিতে আগ বাড়িয়ে নেমেছে।বাকিটা ছেলে এসে সামলাবে।
মুন্সীর চেহারা মলিন।ভাবভঙ্গি বুঝা দায়।নিশ্চুপ মুন্সীর পানে চেয়ে জুবায়ের এবং জয়।মুন্সী কি রাজি নয়?রাজি না হলে ঘোর বিপত্তি।উমাইর শান্ত থাকবে না।
মুন্সী নিশ্চুপ থাকায় জুবায়ের মুখ খুলে,
–“আব্বা,আমার ভাই তাহুরাকে অবশ্যই ভালো রাখবে।উমাইর অত্যন্ত যত্নবান এবং বুঝদার ছেলে।”
শিউলি স্বামীর কাঁধে হাত রাখে।মুন্সীর নড়চড় নেই।মনে মনে লোকটা বিরাট হিসেব কষছে হয়তো! প্রাণপ্রিয় ছোট মেয়েটার জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত বলে কথা।
সুনেরার পায়ের নিচ মাটি নেই।উমাইর কবে থেকে পছন্দ করে বোনকে? তাহুরার প্রতি উমাইরের কখনো অপ্রীতিকর বা প্রীতিকর কিছু দেখলো না সে।বোনের নাজুকতা ভেবে কি উমাইর সবসময় তাহুরাকে গোপনে আগলে রেখেছিলো?মাথাটা হঠাৎ ভার হয় সুনেরার।বাবার পানে দৃষ্টি মেলে সুনেরা।
ভাবুক মুন্সী অতঃপর মিনিট পাঁচেক পর জবাব দেয়,
–“এক পরিবারে দুই মেয়েকে কিভাবে দিই আমি?”
–“আপনার দুই মেয়ে আমার নিজের ঘরের মেয়ে হয়ে থাকবে।চিন্তার কিছু নেই।”
জয় হাসে।যদিও ভেতরে চিন্তার তুফান।মুন্সী রাজি নয় প্রস্তাবে।
–“সুনেরা পছন্দ করেছে বিধেয়,আমি আপনাদের মতো বড় পরিবারে তাকে বিয়ে দিয়েছি।কিন্তু,তাহুরার জন্যে আমার মধ্যবিত্ত পরিবার…”
–“আঙ্কেল,আপনার ছোট মেয়েকে আমার পছন্দ।ঠিক পছন্দ না, আই লাভ হার।”
কেবিনের দুয়ারে উমাইর দাঁড়িয়ে।হালকা ভেজা পোশাক,চুল কিছুটা কপালে লেপ্টে তার।এমন অবস্থায় মুন্সী উমাইরকে দেখেনি ইহকালে।সরাসরি প্রেম নিবেদন করলো উমাইর মেয়ের বাবাকে।কি সাংঘাতিক ঘটনা!আত্মীয়ের পাশাপাশি তাহুরার কলেজের শিক্ষক উমাইর।
ভেতরে আসলে উমাইর,জুবায়ের সুনেরা সহিত বেরিয়ে যায়।ইশারায় বুঝায় অনেককিছু।উমাইর নিভৃতে সায় জানায়।রোগীর কেবিনে ভিড় নিষিদ্ধ।
–“আপনি তাহুরার শিক্ষক হোন।সবাই খারাপ চোখে দেখবে আপনাদের।শিক্ষক,ছাত্রীর নামে বাজে কথা রটাবে।আমার সরল মেয়েটার সহ্য হবে না তা।”
মুন্সী জানায়।
শিউলি চেয়ার এগিয়ে দেয় উমাইরকে,
–“বসো বাবা।”
–“আপনি বসুন আন্টি।”
উমাইর বসলো না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে।কপালে লেপ্টে থাকা চুল আঙ্গুলের সহিত ঠেলে।চোয়ালে হাত বুলায়,
–“আমার কিছু যায় আসে না কে কি ভাবলো না ভাবলো।আপনার ছোট মেয়েকে আমি বহু বছর আগ হতে ভালোবাসি,যখন না আমি আপনার মেয়ের স্যার ছিলাম না সে আমার স্টুডেন্ট।”
ভ্রু কুঁচকে আসে মুন্সীর।কি বলছে উমাইর?বুকে হাত রাখে তাহুরার বাবা। ভোঁতা মুখে প্রশ্ন করে,
–“কি যা তা বলছেন?”
–“যা তা না আঙ্কেল।তাহুরা আমার ভালোবাসা।সি ইজ মাই এভরিথিং।আমি ছাড়া তাহুরার জন্যে অন্য কোনো অপশন রাখিনি আমি।”
মুন্সী আবারও চমকিত।সরাসরি হুমকি আবার প্রস্তাব!উমাইর তাহুরার প্রতি এহেন দূর্বল,অথচ বুঝতে দেয়নি সে কাউকে।
উমাইর হাত ভাঁজ করে বুকে।মুন্সীর সহিত নজর মেলায়।
উমাইরের নজরে মুন্সী ভরসার ছাপ পড়ে।ছোট মেয়েটা উমাইরের নিকট সালামত থাকবে সর্বক্ষণ,বুঝে সে।তাও,মনটা আকুপাকু করে মুন্সীর।দুই মেয়ে এক জায়গায় কিভাবে!মুন্সীর অনেকক্ষণ ভেবে ফের বলে,
–“দুই মেয়ে এক জায়গায় দিলে সমস্যা…”
–“আমার বাবা এবং চাচা ছোট থেকে একসাথে,সমস্যা হয়নি কোনো।আমার ভাই আর আমি একসাথে ছোট থেকে,আমাদেরও কোনো সমস্যা হয়নি।ছেলে হয়ে আমরা থাকছি,তাহলে আপনার দুই মেয়ে কেনো পারবে না?আপনার বোকা মেয়েটাকে আমার কাছে দিন আঙ্কেল।”
উমাইরের ভাবভঙ্গি নরম নয়,আবার কঠোর নয়।যেনো কোনো অনুমতি সে চাচ্ছে না,বরংচ নিজ মতামত জানাচ্ছে।
উমাইরের পানে তাকায় তার বাবা।ছেলে এমন বেপরোয়া হবে তাহুরাকে নিয়ে মেঘলা বলেনি কেনো?এমনি পছন্দ করা আর ভালোবাসি বলে মুখে খই ফুটানো কি একই বিষয়?না।একদম না।গলা খাকারি দেয় জয়।মিষ্টি হেসে শুধায়,
–“আমার ছেলে তাহুরাকে চিরসুখী রাখবে বেয়াই। দেখছেনই,কেমন কাপড় পড়ে চলে এসেছে কেবল আপনার ছোট মেয়ের জন্যে বিয়ের প্রস্তাব দিবে বলে!ফর্মালিটি দেখাতে কাপড় পরিবর্তন অব্দি করেনি।এর মানে কি দাঁড়ায়!আপনার মেয়ে আমার ছেলের জন্যে স্বর্ণের খনির মতো।”
অন্যসময় বাবার করা ব্যাখ্যায় উমাইর উপহাস করে বাবাকে কথা শোনাতো।আজ কিছু বললো না।কেবল বাবার প্রচেষ্টা অনুভব করলো।ছেলের পছন্দের মেয়েকে পুত্রবধূ করার জন্যে কি সাবলীল চিন্তাধারা!
–“আমি ঠিক….তাহুরা রাজি হবে তো?”
মুন্সী প্রশ্ন করে। ভদ্র লোক রাজি হচ্ছে ধীরেধীরে।
–“তাহুরা আমাকে পছন্দ করে আঙ্কেল।আমি জানি।”
উমাইর বিনা দ্বিধায় বললো।পছন্দ না,মেয়েটা উমাইরকে ভালোবাসে।উমাইর কচি খোকা না।তার প্রতি তাহুরার ব্যাকুলতা উমাইর বুঝে।মেয়েটা কেবল সরল বলে প্রকাশ করতে পারে না কিছু।কিন্তু,গোপনে উমাইরকে চোখে হারায় তাহুরা।মেয়েটার কীর্তিকলাপে সবকিছু স্পষ্ট।
–“আপনি যদি চান,আমার সব খোঁজ নিন।আমার আপত্তি নেই।কিন্তু,দিনশেষে আপনার মেয়েকে আমার কাছেই দিতে বাধ্য আপনি।”
কড়া ভাষায় উমাইর প্রকাশ করে তার মনোভাব।মুন্সী কিঞ্চিৎ দমে।বুকটা কেমন জর্জরিত।
উমাইর বামে ফিরে।কপালে আঙুল ঘষে। ফোঁস শব্দে নিঃশ্বাস নেয়।অতঃপর মুন্সীর নিকট যায়,তার হাত ধরে,
–“আপনার মেয়েকে বছরের পর বছর দেখে রাখলাম আঙ্কেল শুধু আমার করার জন্যে।আপনি যেমন ওর সব খেয়াল রাখেন,হয়তো তার চেয়েও বেশি আমি ওকে আগলে রেখেছি বাহিরের খারাপ দৃষ্টি হতে।আঙ্কেল,
আপনার ছোট্ট মেয়েটাতে আমার সব অনুভূতি আটকে।”
–“আমাকে ফিরিয়ে দিলে,আমি যা কিছু করবো সেসব আপনার সহ্য হবে না।অসুস্থ আপনি তাই ঝামেলা চাই না কোনো।আমি আমাকে দায় রেখে বলছি;আপনার ছোট মেয়েকে আমার জীবনের প্রদীপ করে রাখবো।”
পরপর আশ্বাস দেয় উমাইর মুন্সীকে।
জয়ের অধরে জয়ীভাব।ছোট ছেলেটার এমন মনোরম আবদার ফেলবে না কখনো মুন্সী।হলো সেটা।মুন্সী বুঝলো স্যারের ভদ্র বেশের আড়ালে আরেক জেদী বেশের অধিকারী উমাইর।এছাড়া ছেলেটা যেভাবে তার মেয়েকে রক্ষা করেছে কেবল নিজের করবে বলে,সেই ছেলের অধিকার মুন্সী হরণ করতে পারবে না।
মুন্সী মলিন হাসে।উমাইরের কাঁধে হাত রাখে,
–“বিশ্বাস করলাম আপনাকে,উমাইর।আমার মেয়েকে দেখে রাখবেন।আল্লাহ্ এর উপর ভরসায় মেয়েটাকে আপনাকে দেওয়ার জন্যে রাজি হলাম।আশা করি,মেয়েটা আমার সুখে থাকবে।”
উমাইর পলক ঝাপটায়।সেই ইশারায় আশ্বাস,ভরসা বিদ্যমান।মনে মনে উমাইর আওড়ায়,
–“বোকা পাখি,তুমি শীঘ্রই আমার হচ্ছো।”
–“তাহলে কি বিয়েটা পাকা ভাববো?”
জয় উঠে আসে বসা হতে।মুন্সী জয়ের হাত ধরে এইবার,
–“জ্বী।আপনাদের বিশ্বাস করে রাজি হলাম।”
–“বিশ্বাসটা আজীবন বহাল থাকবে ইন শাহ্ আল্লাহ্।”
জয় হেসে বলে।
–“তবে একটা কথা হলো,তাহুরার বিয়েটা সামান্য দেরীতে দিতে চাই।আপাতত কিছু না জানানো হোক ওকে।যদিও আগে চেয়েছি তাহুরার বিয়েটা সে পড়া শেষ করলে তখন দিবো কিন্তু এখন আমার শরীরের বিশ্বাস নেই। বেঁচে থেকে বিয়েটা দিতে চাই।পরপর দুই মেয়ে বিদেয় হলে আমার ঘরটা….”
–“আঙ্কেল,এই বছরের শেষ মাস মানে,ডিসেম্বরে আমার বউকে আমি ঘরে তুলবো।এর বেশী আপনার আবদার রাখতে পারলাম না।আপনার শেষ কথাটা রইলো,তাহুরাকে এখন বিয়ের ব্যাপার জানানো হবে না।”
উমাইর মুন্সীকে থামিয়ে জবাব দেয়।মেয়েটাকে তার করতে আর অপেক্ষা সহ্য হবে না উমাইরের।নিঃশেষ হবে ছেলেটা।আজও মেয়েটার অন্যরূপ দেখে এইভাবেই মত্ত উমাইর।
–“কিন্তু,উমাইর….”
–“যেটা হবে দেখা যাবে মুন্সী সাহেব।মেয়েটা আপনি আমাদের দিচ্ছেন এটা ফাইনাল।উমাইর যাওয়ার সময় আংটি কিনবি বৌমার জন্যে।তোর ভাবী বা মাকে বলবি পড়িয়ে দিতে ছোট মায়ের হাতে।”
জয় পরিস্থিতি সামলায়।
উমাইর মাথা নাড়ায়।জয় মেঘলাকে ফোন দিয়ে জানায় সবটা।মেঘলা খুশিতে বাহারি প্রীতিভোজের আয়োজন করে।উমাইর সালাম দেয় মুন্সী এবং শিউলীকে।অতঃপর বাবাকে জানায়,
–“আমি যাচ্ছি।”
কেবিন হতে বেরিয়ে লনে দাঁড়ায় উমাইর কিছুক্ষণ।এক হাত কোমরে রাখে।আজকের ঘটনাগুলো বিশ্বাস হচ্ছে না অনেকটা।অবশেষে বিয়েটাতে মুন্সীকে রাজি করালো উমাইর।মেয়েটা তার হবে,তার সরল প্রেয়সী।তার আদরের তাহুরা।বুকের ভেতর উত্তাল।সেথায় হাত রাখে উমাইর।নরম সুরে আওড়ায়,
–“তোমাকে পাওয়া,স্পর্শ করা,নিজের করে নেওয়া এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।আমার অপেক্ষা,ব্যাকুলতা সব পুষিয়ে নিবো আমি,জান।তুমি যতোটা নাজুক,উমাইর ঠিক ততটা অস্থির।”
লিফটে উঠে উমাইর।”G ” প্রেস করে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামলে ওয়েটিং জোনে ভাই,ভাবীকে দেখতে পায়।দৃষ্টি মিললে জুবায়ের সাথে সুনেরা এগিয়ে আসে। সুনেরা বোনের জন্যে চিন্তিত।কবে কি হলো,কিছুই বুঝলো না।জুবায়ের তেমন তত্ত্ব দিতে পারেনি। উমাইরকে জিজ্ঞাসা করাটা শোভনীয় নয়।
জুবায়ের ভাইয়ের কাঁধ জড়িয়ে নেয়।চিন্তিত সুরে জিজ্ঞাসা করে,
–“অল গুড?”(সব ঠিকাছে?)
–“ইয়াহ। আঙ্কেল রাজি হয়েছে বিয়েতে।ভাবী,আপনি আপাতত তাহুরাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না।আন্টিকে জিজ্ঞাসা করবেন,উনি সব বলবেন।বিয়ের ব্যাপারটা তাহুরাকে পরে জানানো হবে।”
উমাইর সোজা জানায়।
–“ঠিক আছে, ভাইয়া।”
সুনেরা হাসে।তার চেয়ে খুশি কেউ আছে এখন?দুই বোন একঘরে থাকবে।কি শান্তি!সরল বোনটাকে সে পারবে সারাক্ষণ আগলে রাখতে।এছাড়া, উমাইর ছেলেটা নিতান্ত ভদ্র এবং অযথা কথা বাড়ানোর লোক না। উমাইর এবং তাহুরাকে একত্রে দেখলে মন ভরবে সুনেরার,বড্ড মানাবে দুজনকে।
উমাইর মানি ব্যাগ আনেনি আজ।তার শর্টসের পকেট ওয়াটারপ্রুফ। সেটা হতে মোবাইল বের করে।কিছু ক্যাশ টাকা পাঠায় জুবায়েরকে,
–“কিছু ক্যাশ পাঠিয়েছি ভাই।”
সুনেরার উদ্দেশ্যে বলে,
–“ভাবী,তাহুরার জন্যে সিম্পল থেকে একটা রিং চয়েস করবেন।”
–“আমার কাছে ক্যাশ ছিলো,উমাইর।”
জুবায়ের বলে।
–“আমি যা পাঠিয়েছি সেটা দিয়ে কিনে নিও রিং।আমি বাসায় যাচ্ছি।”
উমাইর মোবাইল পকেটে পুরে।
–“তুই যাবি না?”
জুবায়ের প্রশ্ন করলে উমাইর হাটা অবস্থায় জবাব দেয়,
–“এই ড্রেসআপে আর কই কই যাবো!”
উমাইর “এক্সিট” লিখা দরজা দ্বারা বেরিয়ে আসে।বৃষ্টির দরুণ আবহাওয়া শীতল,স্নিগ্ধ।মোটর বাইক স্টার্ট দিয়ে ছুটে চলে বাড়ির উদ্দেশ্যে।মনের রাণী এখন তার হবু বউ।মেয়েটাকে এখন না দেখলে অন্তর জ্বলে ছারখার হবে।
—————————
তাহুরা মেঝেতে বসে।সেথায় বিশাল কার্পেট বিছানো।জাফরান এসেছে তার মায়ের সাথে।মেঘলা ফোন করেছে তাদের।ছেলের খুশীতে সামিল করবে বলে।কঠোর ভাবে বরণ করেছে সে জাফরানের মাকে,অত্র কথা যেনো গোপনে থাকে।
আফিয়া, দিলরুবাও বাড়ি ফিরেছে।তাদেরও একই ঘোষণা দেওয়া হয়।রাগের বশে আফিয়া নিজেকে ঘরে আটকে নেয়।নিবরাসকেও সতর্ক করে মেঘলা।
এতো বড় খবর হতে বেখবর তাহুরা।সে জাফরানের সাথে ব্যস্ত।মূলত জাফরান তাকে এটাসেটা বানিয়ে দেখাচ্ছে।আর তাহুরা সেসব বানানো শিখছে।
উমাইর ঘরে ফিরে সিঁড়ি বেয়ে সোজা উপরে উঠে। সিঁড়ির কিনারায় একটু ভেতরের দিকে বসে আছে জাফরান এবং তাহুরা।মেয়েটার হাসির শব্দে পা থামে উমাইরের।বাঁক ফিরলে তাদের দুজনকে দেখতে পায়।তাহুরার গায়ে ওড়না মোড়ানো।মাথা হতে কাপড় পড়েছে,এমন দেখাচ্ছে।লম্বা বেণী সম্মুখে বিদ্যমান।কিছু অবাধ্য চুল মেয়েটার মুখে হামলে আছে।
পবিত্র রূপের মাঝে হুট করে ভাসমান হয় তার আঁখিতে মেয়েটার অন্যরূপ।যে রূপে ধ্বংস হতে রাজি উমাইর।তারপরও নিজেকে সামলায় মানব।ভারীক্ষি সুরে আওড়ায়,
–“ফ্লোরে কেনো তোমরা?”
কম্পিত তাহুরার তনু।হঠাৎ শব্দে মেয়েটা ভয় পেয়েছে। উমাইরকে অবলোকন করে দৌড়ায় জাফরান।উমাইর তাকে কাছে টেনে আদর করে,
–“শাওয়ার নিয়ে কোলে নিবো।আমার গায়ে জার্মস এখন।”
–“ওকে,ভাইয়া।”
জাফরান আবারও ফিরে যায়।
তাহুরা আরচোখে দেখে লোকটাকে।পা জোড়া কি আকর্ষণীয়! তাহুরার নজর এলোমেলো হচ্ছে।উমাইর কেনো এমন অবস্থায় বাহিরে যায়?অন্য মেয়েরাও নিশ্চয় তার মতো উমাইরের এমন রূপে মাতোয়ারা হয়!এইযে এখন তাহুরার মন পিঞ্জিরা উত্তাল হচ্ছে,উমাইর কি জানে?
–“এই মাথামোটা,সর্দি এসেছে?”
গম্ভীর কণ্ঠ উমাইরের।তাহুরা মাথা তুলে লোকটাকে দেখে।কি স্নেহময় মুখশ্রী।সেথায় একটু ছুঁয়ে দেখলে কেমন অনুভূতি হবে?পরক্ষণে তাহুরা মাথা নাড়ে।
এলোমেলো বাক্যে বলে,
–“কার!আমার?কই… নাহ।”
–“একবারে না বলা যায় না?মাথামোটা!”
উমাইর তাচ্ছিল্য করে কেমন।
তাহুরা নজর ঝুঁকায়।মিনমিন সুরে আওড়ায়,
–“বলা যায়।”
–“জানো জাফরান,আজ যদি তোমার তাহুর জ্বর আসতো তাকে বাড়ির বাহিরে থাকতে হতো।”
জাফরান শুনেও বুঝলো না,নাকি বুঝলো কে জানে!তবে,তাহুরা তাকিয়ে সুন্দর চলমান মানবের পানে।সুঠামদেহী লোকটাতে তাহুরার মন গলে একাকার।লোকটা তাকে হুমকি দিলে,তাহুরা বুঝলো না উমাইর কি তার যত্ন করছে নাকি শায়েস্তা?
রাতের খাবার পর্ব শেষে বসার ঘরে ভিড় করে সকলে।তাহুরা সুনেরার সাথে তাল মিলিয়ে সকলকে ডেজার্ট আইটেম এগিয়ে দিচ্ছে।বোনের কাজকে সহজ করছে কেবল তাহুরা। উমাইরকে বাটি এগিয়ে দিলে সে নেয়নি।বরংচ জিদ দেখিয়ে ধিম সুরে বলে উঠে,
–“ঝুঁকে ঝুঁকে সবাইকে সার্ভ করা বন্ধ করো।ভাবী দিচ্ছে দেখো স্মার্টলি।নিজের কোমর অন্যকে দেখাতে হবে না,গাঁধী।”
তাহুরা সটান দাঁড়িয়ে পড়ে।সে বেশি ঝুঁকেছে!হয়তোবা।উমাইর সবটা কেনো লক্ষ্য করে?
–“বেশি বাজে লাগছিলো?”
–“না লাগার আগেই বললাম।বসো চুপচাপ।”
উমাইর আবারও নীরব হুমকি ছাড়ে।তাহুরা পেছন ফিরে।তার বোন সকলকে দাঁড়ানো অবস্থায় সুন্দর করে বাটি তুলে দিচ্ছে।বাড়িতে তাহুরা ঝুঁকে ঝুঁকে সকলকে সার্ভ করতো,তখনো বুঝি এমন বাজে দেখাতো! ইসস রে।সার্ভ করা শেষ দেখে তাহুরা বসে অন্য সোফায়।
উমাইরের দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকালে অবলোকন করে উমাইর তার পানে চেয়ে।কালো শার্টে মোড়ানো সুদর্শন মানব।অন্তর পুড়ে যায় তাহুরার।
পরক্ষণে,সেথায় আংটি নিয়ে হাজির হয় মেঘলা।হুট করে তাহুরার আঙ্গুলে পড়িয়ে দেয়।মাথায় চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে,
–“আমার সোনা মা।”
বাকি সবাই মুচকি হাসলেও আন্দাজ করা তাহুরার আয়ত্বের বাহিরে।তার মাঝে উমাইর উঠে চলে যাচ্ছে। তার সহ্য হচ্ছে না,মেয়েটার ভয়ংকর বউ বউ রূপ।মাথা নষ্ট ভাব উমাইরের।
তাহুরা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে মেঘলাকে,
–“এটা কেনো আন্টি?”
–“তুমি আসা অব্দি কিছু দেওয়া হয়নি,তাই এটা দিলাম।এটা কখনো খুলবে না কিন্তু।”
মেঘলা হেসে বলে।
–“আচ্ছা,আন্টি।”
তাহুরা প্রশান্তির হাসি হাসে।মেঘলা ঠিক তার মেয়ের মতো স্নেহ করে তাহুরাকে।কিন্তু, উমাইরের এইভাবে চলে যাওয়াতে মেয়েটার মনে দাগ কাটে।অতি ভাবুক মেয়েটা আপনমনে শুধায়,
–“ঝুঁকে সার্ভ করার জন্য,উনি কি রাগ করেছে আমার সাথে?”
উত্তর মিলেনি তাহুরার।
তিমিরে আঁধার রজনী।মিহি বৃষ্টি।তাহুরা আঁকিবুকি করে জানালায়।ঘুম নেই চোখে।মেঘলা অবশ্য ঘুমিয়ে। হাতের মোবাইলে মন দেয়। উমাইরকে অনলাইনে দেখাচ্ছে।মেসেজ দিবে কি?যেই ভাবা সেই কাজ। গোটা অক্ষরে তাহুরা উমাইরকে মেসেজ পাঠায়,
–“এই যে আপনি কি রাগ আমার সাথে?”
উমাইর ছাদে।মিহি বর্ষণে রেলিংয়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে।মাথার উপর ছাউনী,তাই বৃষ্টি হতে রক্ষা পায় সে।রুমে যাওয়ার মন নেই।ভয়াবহ ইচ্ছারা মনে জড়িয়ে।সেলফোনের আলো জ্বললে তাহুরার মেসেজ ভাসমান হয়।বিনিময়ে সে লিখে,
–“না ঘুমিয়ে কাজ কি?”
–“আপনি আমার সাথে সত্যি রেগে?পরেরবার খেয়াল রাখবো সব।”
তাহুরা মেসেজ দেয়।
–“যতো রাগাচ্ছো সবটার হিসেব করতে থাকো।পরে একসাথে আমার রাগের মাসুল দিবে তুমি।এখন ঘুমাও।”
তাহুরা আরো মেসেজ পাঠায়।উমাইর নোটিফিকেশন বার থেকে পড়ে নেয়।তবে জবাব দেয়নি।এই মেয়ের জন্যে উমাইর নিজের তন্দ্রাকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে।মেঘলা যখন আংটি পড়াচ্ছিলো তাহুরাকে কি অদ্ভুত আকর্ষণ করছিলো মেয়েটা তাকে। উমাইরের ইচ্ছা হলো,
মেয়েটার পাশে বসে কোমর জড়িয়ে নিতে,সুন্দর মুহূর্তকে ফ্রেম বন্ধী করতে। রেলিংয়ে নিজের দানবীয় থাবা দেয় উমাইর। ঘাড়ের ট্রিম করা চুলে হাত বুলায়,
–“আহহ জান,জলদি আমার হও তুমি।আই’ম ডাইং ফর ইউ।”
…………………
জগিং শেষে মেঘলাকে উমাইর জানায় দ্রুত নাস্তা দিতে।আজ বড্ড তাড়া তার। উমাইরের কথায় মেঘলা সায় দেয়।দ্রুত কাজে ছুটে। হাঁক লাগায় গৃহকর্মীদের।
মা চলে গেলেও উমাইর যায়নি।বন্ধ দরজার এপাশে অবস্থানরত।নির্ঘুম রাত যার জন্যে কাটিয়েছে তাকে দেখার আকাঙ্খা মনকে দিগ্বিদিক হারা করে।হাতল চেপে ভেতরে আসে উমাইর।
তার প্রিয়তমা গভীর নিদ্রায়।শান্তির ঘুম ঘুমিয়ে।হিংসে জাগে উমাইরের।হাঁটু গেড়ে বসে বিছানার ধারে।নিষ্পলক চেয়ে রয় সে তাহুরার অবয়বে।ধীরে শুধায়,
–“আর কয়েকমাস,এরপর আমাকে অশান্তিতে রাখার শাস্তি পাবে তুমি।নির্ঘুম রাত কাটাতে প্রস্তুত থাকো, বোকা মেয়ে।”
পরক্ষণে বালিশের ধারে তাহুরার হাত লক্ষ্য করে উমাইর।হালকা ঝুঁকে খুবই সাবধানে অতি মোলায়েম ভঙ্গিতে নিজ অধর ছোঁয়ায় তাহুরার সরু আঙ্গুলে বিদ্যমান আংটিতে।ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
–“ক্যান ইউ ফিল মি,বেইবি!”
চলবে…….