রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব-২১+২২

0
1130

#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব-২১
_______________
–“আসলে…আসলে বাবা অসুস্থ।তাই আমার মন খারাপ।আর কিছু না।”
ধীর সুস্থে জবাব দেয় তাহুরা।উমাইর তার সম্মুখে চেয়ারে বসে।কনভেনশন হলের বারান্দার লবিতে তারা।কয়েক আত্মীয় স্বজন আছেন।তবে তারা দূরে নিজেদের মতো ব্যস্ত।ভরা অনুষ্ঠানে কে বা কার খোঁজ করবে?
তাহুরা হাতে হাত ঘষে।চাচাদের ব্যাপারটা চেপে যায়।অথচ তার মন খারাপের প্রধান কারণ চাচারা।বাবাকে করা অপমান কিভাবে ভুলবে আদরের মেয়ে!দুপুরের কান্ড কারখানা ভাবলে আঁখি ভিজতে চায় মেয়েটার।কিন্তু,সম্মুখে বসা লোকটার জন্যে সব দায়।লোকটা সহজে ছাড়ার পাত্র না।অশ্রুজল দেখলে তাহুরার রক্ষে নেই।তাহুরা আর ঝামেলা চায় না।

উমাইর নিশ্চুপ।তাহুরার বাক্য সত্য।কিন্তু ঈষৎ।পরিপূর্ণ নয়।এইযে মেয়েটা নজর লুকাচ্ছে, হাতে হাত ঘষছে,নিভু দৃষ্টিতে উমাইরকে দেখছে,অত্র লক্ষণ যথেষ্ট।উমাইর তার লম্বা পা সটান করে।তাহুরা একটু পেছায়।

বুড়ো আঙুল দ্বারা কপালের পাশে চুলকায় উমাইর,
–“আঙ্কেল আগে থেকে অসুস্থ।এর জন্যে এমন সন্ন্যাসী সেজে আসার কারণ?আমি যদি ভুল না হই,তুমি আমাকে পুরো সত্যি বলোনি।”
তাহুরার হাত থামে।শঙ্কায় চেহারা মলিন।কোনো ভাবে চাচাদের কথা বলা যাবে না উমাইরকে,অন্যদিকে মিথ্যা বলাও সম্ভব না।তাহুরার নিশ্চুপতায় উমাইর গর্জে উঠে ক্ষীণ,
–“আমরা প্রেম করতে আসিনি এখন।সারাটা সময় আমার হাতে নেই।স্পিক আপ,তাহুরা।”

সমান্তরাল দৃষ্টিতে উমাইরের অবয়বে পানে চায় তাহুরা।বুকটা ধুকধুক করছে।উমাইর কেনো এমন জেরা করছে?কি করবে সে কারণ জেনে?নতুন আত্মীয়দের কি নিজেদের পারিবারিক সমস্যা বলা সম্ভব?উনারা নিশ্চয় ভালো ভাবে নিবেন না সমস্যাটা।তাহুরা ইতোস্তবোধ করে কয়েক পল।উমাইরের কড়া নজরে মেয়ে খুব কষ্টে আওড়ায়,
–“দেখুন..এই যে দেখুন…”
–“দেখছি।”
উমাইর সোজা হয়ে বসে।ঠিকই দেখছে সে তার প্রেয়সীকে। নিজ নজরে আবদ্ধ করছে তার প্রেয়সীর অতি সৌন্দর্যে মোড়ানো সত্তাকে।সাধারণ থাকুক বা মেকাপ করুক মেয়েটা,সর্বোপরি তাকে অপ্সরী লাগে।

উমাইরের হিংসা হয়,অন্যরা কেনো তার প্রেয়সীর রূপ দেখবে?তাই তো মেয়েটাকে এটা সেটা সে বলতেই থাকে। পরে অবশ্য অন্তর জ্বলে তার।মেয়েটাকে কটু কথার বদলে কবে ভালোবাসার কথায় দিশেহারা করবে সে তা ভেবে উমাইর ঘাড় কাত করে।
এবার উঠে দাঁড়ায়,
–“দেখছি তোমাকে।বলো এইবার।”

–“আমি এমন দেখার কথা বলিনি।”
তাহুরা এক কদম পিছে যায় ফের।
–“কেমন দেখার কথা বললে?দুষ্টু ইশারা করছো আমাকে?”
ভ্রু কুঁচকে মুখশ্রীতে গম্ভীর ভাব টানে উমাইর সর্বকালের ন্যায়।তাহুরার শরীরে ঝাঁকি দেয়।উমাইর কি বললো মাত্র!তাহুরা বামে ফিরে।আঁখিতে আঁখি রাখার সাহস নেই তার।

–“আমি ব্যাপারগুলো আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারছি না।অন্য কোনো মতলব নেই আমার।”
কি নিঃসংকোচে উত্তর! ভোলাভালা বোকাটা। উমাইরের মন গলে।মেয়েটাকে আর জেরা করবে কি?থাক,কোনো বিশাল ঘটনা হলে অবশ্য তার পরিবার জানতো।

–“আচ্ছা।বুঝলাম।”
উমাইর সম্মুখে অগ্রসর হলে খেয়াল করে তাহুরা এখনো ঠাই দাঁড়িয়ে।নড়চড় নেই।উমাইর বাঁক ফিরে পেছনে।তাহুরা অন্যমনস্ক।উমাইর ভাবে তাহুরা লজ্জায় অনড়।সে শুধায়,
–“আসবে তুমি?নাকি এইখানে রাত পার করবে?”

–“জ্বী?”
বাবার জন্যে চিন্তায় মগ্ন তাহুরার ধ্যান ছুটে।
–“আসো।”
উমাইর ডান হাত এগিয়ে ইশারা করে তাহুরাকে।ধীরে মাথা নাড়িয়ে তাহুরা এগিয়ে যায় উমাইরের পানে।

উমাইর হাত নামায়।বেহায়া হাত আরেকটু হলে মেয়েটার কাঁধে হামলা করতো, তাকে কাছে টানতো নিঃসন্দেহে।তাহুরা আশেপাশে থাকলে উমাইরের দৃষ্টি,ভাবনা সব কেমন বেহায়া হতে চায়।মনের রাণীকে নিজের পাওয়ার চেতনায় হাহাকার করে উমাইরের অন্তত পিঞ্জিরা।কবে আসবে দিনটা!সেদিন একচুল ছাড় দিবে না উমাইর।মেয়েটার কোনো মানাও শুনবে না। এতো ছটফট,নিজেকে সংযত রাখার দিন যেদিন শেষ হবে সেদিন থেকে তাহুরার জীবনে উমাইর নামক ভালোবাসাময় স্পর্শের তুফানের আগমন হবে।মেয়েটাকে নিজ বক্ষের সাথে লেপ্টে রাখবে,তাহুরা চাইলেও উঠতে দিবে না, কোনো মানা শুনবে না।

উমাইরের পাশাপাশি হাঁটতে থাকা তাহুরা জানে না,উমাইর তাকে ভালোবাসার চাদরে অতিষ্ট করার পরিকল্পনায়।
———-
বিয়ের পর্ব শেষ হয় বিদায়ের পর্বের সমাপ্তিতে।বাহিরে সকলে নতুন কনেকে সামলানোর চেষ্টায়।তবে, শক্তভাষী সুনেরা আজ ভঙ্গুর।কতক্ষণ মাকে জড়িয়ে কাঁদে তো কতক্ষণ বোনকে।তাহুরার আঁখির বাঁধ মানে না সাধারণ দিনে।আর আজ কথা নেই।লাগামহীন অশ্রুজলে তার গাল ছেয়ে।হিজাবের দুপাশ,চিবুকের নিচে অনেকটা ভেজা।
উমাইর অবাক হয়।তার ছিঁচকাদুনের কান্নাটা আজ অন্যরকম।নিজের জন্যে বা নিজে ইচ্ছে করে তাহুরাকে কান্না করালে উমাইরের সুখ অনুভব হয়।আজ ব্যতিক্রম।উমাইর বুঝে নিজে কারণ হওয়া ব্যতিত,তাহুরা অন্য কিছুতে কাঁদলে উমারের মেজাজ ঠিক থাকবে না।এখনো মনে ইচ্ছা জাগল,মেয়েটার পা উমাইরের কোমরে পেঁচিয়ে তাকে কোলে নিয়ে নিজ বক্ষে আবদ্ধ করতে।
উমাইর পাশে দাঁড়ানো জুবায়েরকে বলে,
–“শেষ করো এইসব?ভাবী সামলাও?তোমার শালী মনে হয় আজ অজ্ঞান হবে।ওকেও উঠতে বলো গাড়িতে।ভাবীর সাথে গেলে দুজনের ভালো লাগবে।”

জুবায়ের পাশ ফিরে।তার ধৈর্যশীল ছোটভাইকে অবলোকন করে।ভাইয়ের বিয়ে বলে উমাইর এতক্ষণ টিকে রইলো।নয়তো,কবে বিয়ে এটেন্ড করে বাড়ি ফিরতো সে।জুবায়ের হালকা বাঁকা হয়ে প্রশ্ন করে উমাইরকে,
–“কার জন্যে চিন্তা হচ্ছে?আমার বউ নাকি শালীর জন্যে?”
–“সময়ের জন্যে।বাট,তোমার বউয়ের জন্যে চিন্তা করে আমার লাভ কি?তোমার মাথামোটা শালীকে আমার গাড়িতে পাঠাও।”
উমাইর সহজ জবাব দেয়।ভাইয়ের সাথে নজর মিললে,জুবায়েরের অধরে ঝুলন্ত অন্যরকম হাসি পর্যবেক্ষণ করলে উমাইর ফের আওড়ায়,
–“হোয়াট?”
অনেকটা আঁধার ছেয়ে ফেলে উমাইর তার সুদর্শন মুখশ্রীতে।অতঃপর পেছনে ফিরলে অজানা হাসিতে মত্ত হয় উমাইর।বড় তার ছোট ভাইয়ের তৃপ্তিময় হাসিটা উপভোগ করতে পারলো না।

তাহুরাকে বুঝিয়ে,শুনিয়ে শিউলি পাঠাচ্ছে সুনেরার সহিত। বর বউ আলাদা গাড়িতে যাবে।ইতিমধ্যে বেশিরভাগ নিকট আত্মীয় তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি করে প্রগাড়পার।জনে জনে বেরিয়ে যাচ্ছে। সুনেরা বোন যাবে শুনে খানিক দমে।তাহুরাকে অন্য গাড়িতে বসার নির্দেশনা দিয়ে সে জুবায়েরের সাথে পেছনে বসে।সাথে যায় মেঘলা এবং জয়।শিউলিও বেরিয়ে যায় ইমনদের সাথে।এর পূর্বে নিবরাস,জাফরান এবং তাহুরা উমাইরের গাড়িতে উঠে।

তাহুরা জাফরানকে নিয়ে পেছনে বসে।নিবরাস উমাইরের পাশের সিটে বসলে গাড়ির মিডেল আয়নায় তাহুরাকে দেখে নেয় উমাইর।মেয়েটা জাফরানের হাত ধরে বসে।কেমন চুপচাপ। নিবরাস হুট করে বলে উঠে,
–“তুই বোনের বিয়েতে এমন কাঁদলে নিজের বিয়েতে সেন্সলেস হবি মনে হয়।”
তাহুরার ভাবভঙ্গির পরিবর্তন নেই।সে একই।স্থির হয়ে জবাব দেয়,
–“জানিনা রে।”

উমাইর পুনরায় মিডেল আয়নায় দৃষ্টি জ্ঞাপন করলে তাহুরার ক্লান্ত অবয়ব লক্ষ্য করে।এর মাঝে নিবরাস আবারও বলে,
–“জানবি কিভাবে তুই তখন অজ্ঞান।”
–“স্টপ নিবরাস।”
স্বাভাবিক গলায় বলে উমাইর।জর্জরিত মেয়েটাকে নিয়ে অন্য কেউ মজা করবে,হজম হলো না উমাইরের।
–“ওকে ভাই।”
নিবরাস মুখ চেপে হাসে।

পুরো রাস্তায় নিশ্চুপে গাড়ি চলে।রাতের পরিবেশ মনোরম।রাত তাহুরার সর্বপ্রিয়। তিমিরে যখন বাহারি রঙের আলো জ্বলে পরিবেশটা কেমন স্নিগ্ধ হয়।ভারী আঁখি পল্লবে তাহুরা চারপাশ দেখতে ব্যস্ত।মাঝে মাঝে উঁকি দেয় ড্রাইভিং সিটে বসা তার প্রিয়তমের পানে।পেছন হতে সুঠাম দেহি কাঁধ, ঘাড় আর ট্রিম করা চুলের সাথে মাথার তালুতে ঘন চুল দৃশ্যমান।দু একবার চোখাচোখিও হয় তাদের।

তাহুরা নজর সরায়।প্রকৃতি দেখার জো নেই।রাস্তার ধারে সারিসারি দোকান।কিছু দোকান বন্ধ হলেও রঙিন আলোয় জ্বলন্ত।হেলান দেয় তাহুরা গাড়ির সিটে। বোকা মেয়েটার আঁখিতে ভাসমান উমাইরের নানান রূপ।উমাইর কখন কি বলে কিছুই আয়ত্বে আসে না তাহুরার।এই যে আজ,দুইবার তাকে অপদস্ত করলো।প্রথমে কনভেনশনে হলে তাহুরাকে কমপ্লিমেন্ট দিলো তার প্রাকৃতিক চেহারা অন্যদের দেখাচ্ছে কিনা আবার বারান্দার লবিতে বললো তাহুরা সন্ন্যাসী সেজেছে।

কান্নার দরুণ মাথাটা দপদপ করে তাহুরার।উদরে থাকা জাফরানের হাতে হাত বুলায় সে।ভারী আঁখি বন্ধ করে।মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়,উমাইর তাকে যেইভাবে ইচ্ছে বকুক, দিনশেষে এই মানবকে সারাজীবনের জন্যে চায় তাহুরার অন্তর,মন,মস্তিষ্ক।
…………..
উমাইরদের গাড়ি পৌঁছায় সবার শেষে।সকলে বাড়ির ভেতর।পার্কিং এরিয়া তাদের বাড়ির আঙিনায় কোণায় আলাদা একটা বিশাল কক্ষ।সেথায় ভাইয়ের ফুলে সাজানো গাড়ির পাশে নিজের গাড়ি পার্ক করে উমাইর।আলগোছে ড্রাইভিং সিট থেকে নামলে নিবরাসও নামে।পেছনের দুজনের হুঁশ নেই।ঘুমে মত্ত তারা।উমাইর গাড়ির দরজা খুলে।তাহুরার নাম ধরে ডাকে,
–“তাহুরা উঠো।”

মেয়েটার খবর নেই।সে জাফরানকে জড়িয়ে ঘুমে মগ্ন।উমাইর জাফরানকে টেনে তুলে।তাহুরা কিঞ্চিৎ নড়লেও তন্দ্রা ছুটলো না।জাফরানকে উমাইর নিবরসের নিকট দিলে সে নিজেই বললো,
–“তুমি তাহুরাকে জাগাও।আমি গেলাম।”

উমাইর মাথা নাড়ে।ঘুমন্ত প্রেয়সীকে আরেকবার দৃষ্টিতে বদ্ধ করে।অতঃপর তাহুরার গালে হাতের উল্টো পিঠে ছুঁয়ে দেয়,
–“এই মেয়ে,উঠো না বাবা।”
কি নরম,আদুরে সুর।তাহুরার জায়গায় অন্য কেউ হলে উমাইর নিশ্চয় তোয়াক্কা না করে এইভাবে রেখে ভেতরে যেতো।

কয়েকবার ডাকার ফলে তাহুরার ঘুম ছুটে।উমাইরকে দেখে নিজেকে ধাতস্থ করে,
–“পৌঁছেছি!”
–“পাঁচ মিনিট আগে।”
উমাইর বুকে হাত গুঁজে।তাহুরা জিহ্বা কাটে দাঁত দ্বারা।দ্রুত নামতে নিলে শাড়ির কুঁচিতে পা আটকে পড়তে নিলে নিজেকে সামলে নেয়।

উমাইর বিরক্ত হয়।ঘুমের ঘোরে মেয়েটা কেনো এমন চঞ্চল হচ্ছে?
–“ম্যারাথনে দৌড়াবে নাকি?”
তাহুরা দুদিকে মাথা দোলায়। অর্থাৎ,সে যাবে না।

–“মাথামোটা।”
উমাইরের সরু জবাব।শব্দটা শুনতে শুনতে তাহুরার মুখস্ত।উমাইর সবসময় কেনো ওকে এমন বকে?যত্ন নিলেও বুঝি বকতে হয়?

ভেতরে কিছু নিয়ম কানুন শেষ করে সকলে ফিরে নিজ কক্ষে। সুনেরা অনেক চেয়েও তাহুরার সাথে ঘুমোতে পারেনি।তাহুরা মেঘলার সাথে থাকবে বলে জানায়।বোনের বিশেষ রাত কিভাবে তাহুরা নষ্ট করবে?

মেঘলার সাথে রাতের অনেকটা সময় তাহুরা গল্প করে।মুন্সী আবার রাতের তিনটায় তাহুরাকে ফোন দেয়।ভিডিও কলে মেঘলা আর তাহুরার সাথে কথা বলে।বাবার সাথে কথা শেষে মেয়েটা প্রাণবন্ত হয়।আরামের তন্দ্রা ভর করে আঁখি জোড়ায়।

সকাল আটটা।উমাইর চঞ্চল।ভেতরে তার অস্থিরতা। জগিংয়ে যেতে কিছুটা সময় দেরী করেছে আজ।ঘুম ভাঙেনি ভোরে।কলেজ হতে তার ছুটি আজ।
তবে বিশেষ ফোন আসায় জগিংয়ে না গিয়ে নিজের গন্তব্য পরিবর্তন করে উমাইর।মায়ের দরজায় দুই টোকা দিতেই মেঘলা দরজা খুলে।মেঘলা মাত্র বের হচ্ছিলো কামরা হতে।জগিংয়ের পোশাকে উমাইর। জগিংয়ে না গিয়ে এইখানে এলে মেঘলা প্রশ্ন করে,
–“আব্বা, জগিংয়ে যাবে না?”
–“ইমন ফোন করেছিলো।তাহুরার বাবাকে হাসপাতালে নিয়েছে খানিক আগে।ভাই,ভাবীর ফোন বন্ধ।তুমি তাদের জাগাও।”
উমাইর এক নিঃশ্বাসে বলে।মেঘলা হাত রাখে মুখে।চিন্তিত সুরে বলে,
–“হায় আল্লাহ্।কি হলো হঠাৎ? কাল রাতেও কথা বললো লোকটা মেয়ের সাথে।তুমি তাহুরাকে জাগাও সাবধানে।আমি যাচ্ছি।”
এমন মানুষ অসুস্থ হলো,তার দুই মেয়ের কথা ভেবে অস্থির মেঘলা।মেয়ে দুইজনের দিকে ফিরে হলেও আল্লাহ্ যেনো মুন্সীকে সুস্থতা দান করে যেতে যেতে দোয়া করলো ভদ্র মহিলা।

উমাইর দরজা খুলে রাখলো সটান।ধীর পায়ে তাহুরার পানে এগোয়।এলোমেলো চুল মুখে ছড়িয়ে তার।পাতলা কম্বল ঠিকঠাক।অগোছালো তাহুরাকে মাত্র ঢেকে সুশীল করে বেরুচ্ছিলো মেঘলা বেগম,তখন উমাইরের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়।

উমাইর চুল সরায় তাহুরার মুখ হতে।অতঃপর ভারী গম্ভীর কণ্ঠে ডেকে উঠে মেয়েটাকে,
–“তাহু,আমাদের বেরুতে হবে এখন।”
তাহুরা লাপাত্তাহীন। উমাইর আরো গভীর সুরে ডাকলে হুট করে আঁখি মেলে তাহুরা।পাশে দাঁড়ানো উমাইরকে অবলোকন করে কিছু বুঝার পূর্বে উমাইর বলে,
–“আমাদের বেরুতে হবে।ফ্রেশ হও।”

–“কই যাবো?আন্টি কোথায়?”
ঘুম ঘুম সুর তাহুরার। শরীরে শিহরণ জাগে উমাইরের।নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে,
–“আছে সবাই।ফ্রেশ হও।আমি রুমের বাহিরে আছি।”
উমাইর কক্ষ হতে বেরুতে নিলে তাহুরা বালিশের পাশ হতে ওড়না নিয়ে দ্রুত নামে বিছানা হতে।প্রশ্ন করে,
–“এই যে বলুন না কি হয়েছে?আপনাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে।”

উমাইর থামে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছন ফিরে।মেয়েটার সদ্য ঘুমে হতে জাগ্রত মুখশ্রী কেমন আকর্ষণীয়।তবে সেথায় আঁধার নেমে।ঠিক তাহুরার সম্মুখে এসে দাঁড়ায় উমাইর। গালে হাত রাখে আদুরে ভঙ্গিতে,
–“তোমার বাবা হাসপাতালে।কিছু হবে না,তাহু।আমি আর ভাই বেস্ট ডাক্তারের ব্যবস্থা করবো।”
ভেঙে পড়ে তাহুরা।নিজ কানে ভুল শুনলো নাকি বুঝলো না। কাল রাতে বাবা অনেকটা সুস্থ ছিলো।পা যেনো মুড়ে যাচ্ছে।উমাইর তাহুরার কোমরে হাত প্যাঁচায়।সামলে নেয় মেয়েটাকে।আঁখি জোড়া জলে টলমলে।বুকের সেই পোড়া দহন অনুভব করে উমাইর।

–“ক…কি বল…ছেন?”
বাবার ছায়ায় থাকা মুন্সীর ছোট্ট মেয়েটার দুনিয়া ঝাপসা। উমাইরের মসৃণ টিশার্ট শক্ত হাতে খাঁমচে ধরে তাহুরা।

উমাইর তাহুরার মাথার পিছে হাত রাখে।স্নেহের সুরে বলে,
–“একদম কাঁদবে না।কিছু হয়নি আংকেলের।অসুস্থ তাই হাসপাতালে।তোমাকে বললাম বেস্ট ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করবো।”

–“আমার বাবাকে ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিবেন প্লিজ।বাবা ছাড়া আমি শেষ হয়ে যাবো।”
ভেঙে পড়ে মেয়েটা।উমাইর তাহুরার মাথায় ধীর গতিতে চুলের গভীরে স্পর্শ করে,
–“তুমি কাঁদলে আমি কিছুই করবো না।স্টপ ক্রাইং তাহু।”
উমাইরের শক্ত হুমকিতে নিজেকে কিছুটা সামলায় তাহুরা।তাও আঁখি জলে ভিজে যায়।

তাহুরার হাত ধরে উমাইর।বাথরুমের সম্মুখে এনে থামায়,
–“ফ্রেশ হও।”
তাহুরা তার পানে তাকালে উমাইর হালকা হাসে।আশ্বাস দেয় কড়া সুরে,
–“তোমার জন্যে আমি সব করবো তাহুরা।তুমি শুধু অন্য কিছুতে কেঁদো না।”

চলবে…….

#রেখেছি_তারে_মন_পিঞ্জিরায়
লেখনীতে: সালসাবিল সারা
পর্ব-২২
_________________________
–“কেঁদো না,সোনা।দেখো সব ঠিক হবে।ডাক্তার আসবে,চেকাপ করবে।আর একটু ধৈর্য্য ধরো।এই অবস্থায় কান্না করা উচিত না।”
আদুরে আবদার।প্রেয়সীকে শান্ত করানোর নিতান্ত চেষ্টা।মেয়েটাও বুঝি ভরসা পেলো এহেন বক্তব্যে।ছেলেটার কথায় মেয়েটার বুকের বোঝা হালকা হয়।প্রেমিক পুরুষের প্রশস্থ কাঁধে মাথা এলিয়ে দেয় নিভৃতে।আগলে নেয় ছেলেটা তার মনের রাণীকে।কি সুন্দর দৃশ্য!মন কাড়ার মতো।

তাহুরা তাদের পানে চেয়ে ড্যাবড্যাব ভঙ্গিতে।গত কয়েকদিন যাবত উমাইর তাকে এমন শান্তনা দিয়ে এসেছে।কেবল “সোনা” আর কয়েকটা লাইন আলাদা।বাদ বাকি সব একই।ছেলেটার সুর একটু মোলায়েম।কিন্তু,উমাইরের!তার সুর গম্ভীর সাথে অস্থির শ্রুতিমধুর।তার কাছাকাছি এসে একটু যত্ন মাখা সুর শুনলেই তাহুরার পা বেঁকে আসে।লোকটা এমন আকর্ষণীয় কেনো?লোকটার ধমক থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা বাক্য তাহুরার হৃদয়ে হট্টগোল সৃষ্টি করে।

মাথায় আঙ্গুলের স্পর্শ পেলে তাহুরা অত্র যুগল হতে নজর ফেরায়।পাশে বসা উমাইর।দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিললে উমাইর থমথমে কণ্ঠে আওড়ায়,
–“যেভাবে তাকাচ্ছো তাদের দিকে,না জানি কোন সময় তোমার নজরে তারা ঝলসে যায়!”
হালকা হাসি উমাইরের অধরে।মনোরম হৃদয় বিদারক,কেমন হাহাকার অনুভব করে তাহুরা। কারো হাসি বুঝি অন্তরে জ্বালা সৃষ্টি করে?করে তো।উমাইরের হাসিতে তাহুরা ঘামতে বাধ্য হয়।

–“মেয়েটা অনেক ভাগ্যবতী।”
তাহুরা উমাইরের উল্টো কথার জবাব দেয়।
–“কেনো?”
প্রশ্ন করে উমাইর।
–“মানে মেয়েটাকে তার হাজবেন্ড যত্ন নিয়ে ভরসা দিচ্ছে।তাই।”
তাহুরা ওড়নার কিনারায় আঙুল প্যাঁচায়।উমাইর তার কার্যে মনোনিবেশ করে।তাহুরার শুভ্র হাত। সেথায় চুমুতে ভরিয়ে দেওয়ার আকাঙ্খা জাগে।পুরুষালি চিন্তায় তনুতে ভর করে উম্মাদনা।নজর সরিয়ে উমাইর বুকে হাত গুঁজে।তাহুরার নিকট কিঞ্চিৎ ঝুঁকে বলে,
–“তাহলে তুমিও লাকি।এমন শান্তনা তোমাকে আমিও দিয়েছি।”

তাহুরা জিহ্বা দ্বারা অধর ভেজায়।দ্বিধা দণ্ডিত ভাবনাগুলো অবশেষে জারি করে মেয়েটা,
–“হ্যাঁ।কিন্তু, ঐ ছেলেটার মতো বলেননি।অনেকটা…না কিছু না।”
থামে তাহুরা।কি বলছে সে উল্টোপাল্টা?মাথাটা নষ্ট হলো কি? উমাইর এর মুখে “সোনা” ডাক,তার জন্যে?এমন কিছু হলে তাহুরা সহ্য করতে পারবে না,অজ্ঞান হবে নিশ্চিত।এছাড়া উমাইর তাকে গায়ে পড়া মেয়ে ভাববে। পরে তাহুরার অবস্থা হবে আফিয়ার মতো।আফিয়ার কাহিনী সবটা জানে এখন তাহুরা।সুনেরা জানিয়েছিলো বোনকে।

–“হুয়াট?ছেলেটার মতো কি বলিনি?”
উমাইর প্রশ্ন করে।

ঘাবড়ে যায় তাহুরা।কি উত্তর দিবে এখন?উমাইর তাকে জব্দ করবে।বিনিময়ে আমতা আমতা করলে উমাইর আরেকটু ঘনিষ্ট হয় তাহুরার নিকট।অতঃপর বলে,
–“সোনা ওয়ার্ডটা আমার পছন্দ না।”
তাহুরা লাজে মরমর।লোকটা কেনো সব বুঝে যায়? তাহুরাও বা এমন ব্যাকুল হলো কবে?লোকটা তাকে সাধারণত তাহু ডাকলেই তাহুরার হুঁশ উড়ে যায়।
–“এমন কিছু না।”
কথাখানা বলতে বলতে মেয়েটার আঁখি ভারী হয়।উমাইর তাকে নির্লজ্জ ভাবছে!
–“কেমন কিছু?”
উমাইর হাসে।সেই হাসিতে শব্দ স্পষ্ট।তাহুরাকে জব্দ করতে ব্যাপক আনন্দ।তবে,তাকে জব্দ করার অনুমতি উমাইর কেবল নিজেকে দিয়েছে।

উমাইর খেয়াল করে তাহুরা ওড়না দ্বারা চোখ মুছে।পড়নে ফরমাল প্যান্টের পকেট হতে টিস্যু বের করে উমাইর।এগিয়ে দেয় তাহুরার পানে,
–“আমার কাছে তুমি সকল আবদার করবে।”

তাহুরা মাথায় উঠায় না।লাজে মুড়ে মেয়েটা।উমাইর তাহুরার হাত টানে।টিস্যু ধরিয়ে দেয়,
–“অন্যের সামনে কেঁদে নিজের রক্তিম রূপ দেখাবে না।”
টিস্যু নিয়ে মুহূর্তে আঁখি আড়াল করে তাহুরা।উমাইর সম্মুখে তাকায়।বক্ষস্থল উত্তাল।ধুকধুক শব্দটা বাহিরেও শোনা যাচ্ছে?তাহুরা জানেও না উমাইর তার জন্যে কি কি নাম ঠিক করে রেখেছে।সহ্য হবে মেয়েটার?সহ্য যে করতে হবে মেয়েটাকে।উমাইর অস্থির,উন্মাদনায় পুষ্ট,চাহিদায় নিমত্ত।কেবল মেয়েটাকে হালাল করার অপেক্ষায়।এরপর উমাইরের ধৈর্য্য ভেঙে মাটিতে লুটপাট।

তাহুরা শান্ত হয় মিনিট তিনেক পর।দৃষ্টি তুললে অবলোকন করে উমাইর কপালে আঙুল চেপে বসে।খরশান চোয়াল।কানের উপরিভাগ কিঞ্চিৎ লাল।মাথা ব্যথা করছে কি?উমাইর কলেজ থেকে সোজা হাসপাতালে এসেছে।তাহুরা এসেছিলো সেই সকালে।এখন সুনেরা এবং জুবায়ের এলে তাহুরা উমাইরের সাথে নিচ তলায় ওয়েটিং রুমে বসে।রোগীর কেবিনে একাধিক মানুষের ভিড় করা নিষিদ্ধ।

তাহুরা সকল মনোভাব আড়াল করে।সংশয়ের সহিত উমাইরকে জিজ্ঞাসা করে,
–“দুপুরে খেয়েছিলেন?”
–“কলিগের বার্থডে ছিলো।”
উমাইর জবাব দেয়।
–“ওহ।কোন স্যারের?”
–“তাহমিনার।”
উমাইরের জবাবে তাহুরার অন্তর ভারী হয়।উমাইর আর তাহমিনা ম্যাম একা বার্থডে পালন করেছে?এর মানে কি দাঁড়ালো?
–“আচ্ছা।আপনি আর তাহমিনা ম্যাম একা…”
–“সময় আছে আমার একা ঢং করার?পুরো টিম ছিলো।”
উমাইর চটে যায় খানিকটা। তাহুরা উমাইরকে ভাবে কি?

–“আপনি রাগ করেছেন?”
উমাইর নিশ্চুপ।রাগ করার কি?তাহুরা সারাক্ষণ উমাইরকে প্রশ্ন করতে পারবে।মেয়েটা তার জীবনের প্রদীপ।অহেতুক চিন্তায় ভাসে তাহুরা।উমাইর জবাব দেওয়ার পূর্বে তাদের সম্মুখে এক লোক থামে।উমাইর মাথা তুলে তাকায়।তাহুরার বাবা উনার আন্ডারে চিকিৎসা নিচ্ছে।ডাক্তার তুহিন।

–“কেমন আছেন তাহুরা?মিস্টার উমাইর, অল গুড?”
তাহুরা উত্তর না দিলেও।উমাইর হাত মেলায় তুহিনের সহিত।তুহিন তাহুরার পানে চেয়ে।তাহুরার দৃষ্টি নত।উমাইর কাঁধ জড়িয়ে ধরে তাহুরার।অনেকটা বুঝিয়ে দেয় এই মেয়েটা কেবল তার।তাহুরা কিঞ্চিৎ নড়ে উঠলেও অবাক হয় না।উমাইর রুঢ় হেসে জবাব দেয়,
–“আমরা ঠিক আছি।”
পরক্ষণে তাহুরার হাত ধরে উমাইর।হালকা টেনে জবাব দেয়,
–“আসো। আই’ম হাংরি।”(আমি ক্ষুধার্ত)
ডক্টর তুহিন অনেকটা অবাক। উমাইরকে চিনে সে জুবায়েরের তাগিদে। অপ্সরী মেয়েটাকে তুহিনের পছন্দ।কিন্তু,উমাইর এর কাণ্ডে অনেকাংশে আশাহত হয়।মেয়েটার সামনে এতবার পড়েছে তুহিন,কখনো তাহুরা চোখ তুলে তাকায়নি।অথচ এখন হেঁটে যাচ্ছে উমাইরের হাত চেপে। তাদের মাঝে নিশ্চয় কোনো গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান!
—————-
ক্যান্টিনে ভিড়।হাসপাতালের ক্যান্টিনে ভিড় হওয়া স্বাভাবিক।পরিবেশ শীতল।ক্যান্টিন বিশাল।উমাইর যেমনটা হাত ধরেছে তাহুরার,ওভাবেই হেঁটে বেড়াচ্ছে।খাবার অর্ডার শেষে পে করে সিট খুঁজে নেয়।তাহুরার খাবার তার পানে ঠেলে নিজে খেতে শুরু করে।এমনভাবে খাবার চিবুচ্ছে সে যেনো ক্রোধ সকল খাবারের প্রতি।তাহুরা ভীত।সুদর্শন মানব আবার রেগেছে।কিছু বলবে সে?নাকি আবার বকবে!

–“কয়জনের চোখ তুলবো বলো?”
হিমশিম তাহুরা।কেশে উঠে খানিক,
–“জ্বী?”
–“আজ থেকে হাসপাতালে আসবে,আংকেলকে দেখবে এরপর বাসায় যাবে।এইখানে থাকার নাটক করবে না।এইসব আর ভালো লাগছে না আমার।”
উমাইর টেবিলে চড় দেয়।তাহুরা অর্ধ জীবিত।
–“ঐ ডাক্তার সুবিধার না।আংকেলকে বিদায় জানাও।দেন,বাসায় চলো।”
উমাইর আদেশ করে।

–“আমি থাকতে…”
–“এই চুপ!মেজাজ খারাপ হয়েছে দেখছো না?দেখছো?”
তাহুরা কেঁদে উঠে হু হু শব্দে।উমাইর গলে না।ফের নির্দেশ দেয়,
–“কেঁদে কেঁদে খাওয়া শেষ করো।”
আর এক পল নজর সরায়নি উমাইর তাহুরা হতে।মেয়েটা সত্যি কন্দনরত অবস্থায় খাবার খাচ্ছে।তার আদর মেয়েটা,তার প্রেয়সী।ডাক্তার তুহিনের মতো লোকের অভাব নেই দুনিয়ায়,যেই মেয়েকে দেখবে সেই মেয়েকে পছন্দ করবে।উমাইর ক্রোধে মত্ত। দাঁতে দাঁত চেপে আওড়ায়,
–“ক্যারেক্টারলেস বেয়াদব লোক।”
——————-
মুন্সী হাসপাতালে রয়েছে বহুদিন।মাঝে তাহুরার রেজাল্ট প্রকাশিত হয়।গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে মেয়ে।আগামী সপ্তাহে পূর্বের কলেজে অনার্সে ভর্তি হবে তাহুরা।ভালো ফলাফল করেও খুশি হয়নি সে। বাবা ভালো নেই এখনো।ডাক্তার জানিয়েছে ইন্ডিয়া নিতে হবে।
তাহুরা, সুনেরা চার দিন নিজের বাসায় থেকে আবারও ফিরেছে উমাইরদের বাড়ি।শিউলি প্রথম থেকে মুন্সীর সাথে হাসপাতালে আছে।খরচের বহু অংশ বহন করেছে উমাইর এবং জুবায়ের।মুন্সীর অবস্থার উন্নতি না হলে তাকে ইন্ডিয়া পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় সকলে।সবকিছুর ব্যবস্থাও করে।দুইদিন পর রওনা হবে ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে।সাথে যাবে জয়,শিউলি।লোকটা নিজ চিকিৎসার জন্যে ইন্ডিয়ায় গেলো বহুবার।এইবারও খরচ বহন করবে উমাইর,জুবায়ের। তাদের এহেন মহাত্মার জন্যে কৃতজ্ঞ দুই বোন। সুনেরা রোজ রাতে কেঁদে স্বামীর বুক ভাসায়।বিনিময়ে জুবায়ের প্রেয়সীর প্রতি ভালোবাসা দ্বিগুণ করে।

উমাইরকে তাহুরা কয়েকবার শুকরিয়া জানিয়েছিলো।তবে,উমাইর সেই শুকরিয়া গ্রহণ না করে জবাবে বলেছিলো,
–“শুকরিয়া দিয়ে আমার কাজ নেই।আমি যা খুঁজবো তোমার থেকে,সেটাতে সায় দিলে বুঝবো মন থেকে শুকরিয়া বলেছিলে।”
বোকা মেয়েটা কৃতজ্ঞের হাসি হাসে কেবল।অথচ সে জানেনা,উমাইর ঠিক কি বুঝিয়েছে!

বিকেল হতে ঝড়। তাহুরার মন আকুপাকু করে একটু ভিজতে।বাসায় কেবল তাহুরা, নিবরাস এবং মেঘলা বেগম।নিবরাস তাহুরার সাথে অতটা আড্ডা দেয় না।আর একা হলে একদম না।উমাইর সাফ মানা করেছে নিবরাসকে।

মেঘলা এই সময়ে সন্ধ্যার নাস্তা বানায়। ছাদে গিয়ে ভেজার সাহস নেই তাহুরার।সে সিদ্ধান্ত নেয় যা বৃষ্টি হচ্ছে,ব্যালকনি দিয়ে গা ভেজানো সহজলভ্য।যেই ভাবা সেই কাজ।গায়ের ওড়না বিছানায় রাখে সে।পড়নে সুতির কামিজ,সেলোয়ার।মেঘলার রুমের ব্যালকনি নিরাপদ। আশপাশ হতে দেখা যায় না।ঝপঝপ বৃষ্টির শব্দ।ব্যালকনিতে পা রাখতে তনু ভিজতে আরম্ভ করে। তাহুরা দরজা ভিড়িয়ে দেয়। পাছে যদি কক্ষে পানি আসে!

মিনিট বিশেক নিজের সত্তাকে শীতল করে,ভিজিয়ে আকৃষ্ট করে তাহুরা।বৃষ্টির বেগ বাড়লে মেয়েটা হাসে নিজে নিজে।দু হাতের তালুতে পানি জমিয়ে আবারও উপরে ছুঁড়ে।বৃষ্টি বিলাসে মত্ত হয় উমাইরের সরল প্রেয়সী।

উমাইর কলেজ হতে দুপুরে বাসায় ফিরে তন্দ্রায় নিমত্ত।ঘুম ভাঙ্গলো তার নিবরাসের ফোনে।বৃষ্টি উপলক্ষে ফুটবল ম্যাচ রেখেছে ক্লাবে।সেই সুবাদে উমাইর উঠে দ্রুত।ফুটবল তার অন্যতম প্রিয় আসক্তি।হাঁটুর উপর প্যান্ট,সাথে স্পোর্টস টিশার্ট গায়ে জড়িয়ে কক্ষ হতে বেরোয়।মাকে বলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সেই কক্ষের পানে এগোয় উমাইর।এলোমেলো চুল না আঁচড়িয়ে হাতের সাহায্যে সামলিয়ে নেয়।ফুলে থাকা বাহু স্পষ্ট।স্বাস্থ্যবান পা দৃশ্যমান।দরজায় কড়া নেড়ে অপেক্ষা করে মিনিট তিনেক।দরজা না খুললে আবারও কড়া নেড়ে ডেকে উঠে,
–“আম্মি!”
শব্দ না পেয়ে দরজার হাতল ঘুরিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে উমাইর।কেউ নেই।ফিরতে নিলে ব্যালকনির দরজায় আওয়াজ হয়।পিছে বাঁক ফিরলে সে তাহুরাকে দেখে।হাত হতে মোবাইল ছুটে পড়ে মেঝেতে।মেয়েটার অবয়ব স্পষ্ট।ভেতরের গোপন বস্ত্রের ছাপ ভেসে উঠে।

তাহুরার দুনিয়া ঘুরে‌।দ্রুত সরতে নিলে পায়ের পানিতে পিছলে যায়।

উমাইর তাকে ধরার খেয় হারিয়েছে।সে মত্ত মেয়েটাতে।তবে,নিজেকে শক্ত রাখে উমাইর।নিষিদ্ধ অনুভূতি মনে চেপে বিছানা হতে ওড়না নিয়ে ছুঁড়ে তাহুরার সত্তায়।বাহু টেনে দাঁড় করায় তাকে। কটকট সুরে আওড়ায়,
–“নায়িকা সাজা শেষ?দরজা লক করা যায় না? যদি জ্বর আসে,বাসা থেকে বের করবো তোমাকে।”

পরপর উমাইর হাঁটু গেড়ে বসে।ভেজা পা টেনে নেয়,
–“ব্যথা লাগে?”
লজ্জায় তাহুরার জান যায়।অথচ উমাইর কেমন শীতল।যেনো কিছু হয়নি।তাহুরা নিজেকে ওড়নায় মুড়িয়ে নেয়।মুখে হাত রেখে জবাব দেয়,
–“নেই।”
–“থাকলে আরো বাড়িয়ে দিতাম।মাথামোটা কোথাকার।”
উমাইর মেকি রাগ দেখায়।ভেতরটা উত্তাল।কি মিষ্টি সুবাস আসছে মেয়েটা হতে।সহ্য শক্তি হারাচ্ছে সে।মন বলছে এখনই ডুবে যেতে মেয়েটার বক্ষ ভাঁজে।
নিজেকে ধাতস্থ করে উমাইর।জোরে শ্বাস নেয়।অবস্থা বেগতিক দেখে দূরে হটে সে।মোবাইল তুলে মেঝে হতে।পরক্ষণে মিছে ধমক দেয় সে তাহুরাকে,
–“গাঁধীর মতো না দাঁড়িয়ে থেকে চেঞ্জ করো।জ্বর আসলে আজ বাসার বাহিরে থাকবে তুমি,তাহুরা।”
নিজেকে কঠোর মানব সাজায় উমাইর।তাহুরা ভাবে,উমাইর তেমন একটা খেয়াল করেনি কিছু।নাহলে এমন বকতো না।সে সাত পাঁচ না ভেবে স্বাভাবিক করে নিজেকে।

অন্যদিকে রুম থেকে বের হলে যেনো উমাইরের মাথায় পীড়া হয়।অনুভব করে তার ভেতরকার অন্যতম আকর্ষণকে।যা দেখার কথা অনেক পরে,সেটা কেনো আগে দেখলো?কিভাবে সামলাবে সে নিজেকে? তাহুরার স্পষ্ট সকল অবয়ব।মেয়েটার ভেজা রূপ।তিরতির করতে থাকা অধর।মনে হয় না,বছর বছর অপেক্ষা করতে পারবে উমাইর।বাইকের সম্মুখে আসে সে।গাড়ি নিবে না।গায়ের জ্বলন কমছে না এখনো।বৃষ্টিতে ভেজা যাক।পুনরায় নিজের মাথার দুপাশে হাত বুলায় উমাইর।
আসমানের পানে মুখ তুলে।দৃঢ় নিঃশ্বাসে আর্জি জানায়,
–“অতিদ্রুত তুমি আমার হও,জান।নিজেকে শক্ত রাখা মুশকিল এখন।যতবার তোমাকে দেখবো ততবার এই দৃশ্য ভাসবে।”
পরপর উমাইর মোটর বাইকে বসে।হেলমেট পড়ে। ডানে বামে ঘাড় নাড়িয়ে মোটর বাইক স্টার্ট দেয়।আপনমনে সে আওড়ায়,
–“শিট ম্যান!ইউ আর কিলিং মি,তাহু।কিন্তু,যেদিন তুমি আমার হবে,সেদিন আমাতে নিঃশেষ হবে তুমি জান।”

ম্যাচ শেষ এক রাউন্ড।এর মাঝে বিরতি।উমাইর কোকের বোতলে চুমুক দেয়। হাতে ফোন।প্রেয়সীর খোঁজ নিচ্ছে।তাহুরা মেঘলার সাথে টিভি দেখছে।নিশ্চিত মনে উমাইর ফেসবুকিং করলে জুবায়েরের ফোন আসে।ভাইয়ের ফোন রিসিভ করতেই শুনতে পায়,
–“শশুর আব্বা চায়,উনি ইন্ডিয়া যাওয়ার পূর্বে উনার ছোট মেয়ের জন্যে ছেলে ঠিক করতে।আমার বন্ধু আছে নাকি জিজ্ঞাসা করলো।বন্ধু তো আছে আমার অনেক।কিন্তু,আমার ভাইটাকে আমি ভুলি কিভাবে?”
–“দুইদিন আগে এমন কাহিনী করছেন উনি?ওকে,এইবার আসল নাটক আমি দেখাই।আসছি।”
উমাইর ক্ষিপ্ত।

–“তুই কই এখন?”
–“স্পোর্টস ক্লাবে।”
উমাইর হাঁটা অবস্থায় জবাব দেয়।
–“তুই শর্টস আর টিশার্ট পড়ে বিয়ের কথা বলতে আসবি?”
জুবায়ের অবাকের সুরে বলে।
–“কাপড় ছাড়া তো আসছি না।চেঞ্জ করার সময় নেই।মুন্সীকে আমি বিশ্বাস করি না।”
উমাইর বাইকের নিকট পৌঁছায়।

–“মাকে বলছি আমি।”
আবারো বলে জুবায়ের।
–“তাহুরা একা বাসায়।বাবাকে আসতে বলো।”
–“আচ্ছা।”
জুবায়ের ফোন কাটলে উমাইর আবারও হেমলমেট হাতে নেয়।বৃষ্টি থেমে এখন পরিবেশকে সতেজ করেছে। উমাইরের পড়নে কাপড় ভেজা হলেও তার তোয়াক্কা নেই মানবের। মোদ্দা কথা হলো মুন্সীকে বশ করা।

উমাইর মোবাইল পুরে পকেটে।অধর বাঁকা করে হাসে,
–“ইন্ডিয়া যাওয়ার আগে আপনার এই কাহিনী করাটা আমার পছন্দ হয়েছে,শশুর আব্বা।আপনার ছোট মেয়েকে আমার কাছে দিতে বাধ্য আপনি।”
–“একটু হেরফের হবে তো আমি উল্টিয়ে দিবো সবকিছু।আমার বোকাটা শুধু আমার।”

চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে