#রূপবানের_শ্যামবতী
#৩৪তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী
ভোরের আলো ফোটার অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। সদ্য উদিত সূর্যের কিরণ জানালা গলে ঘরের মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। রান্নাঘর থেকে রোজকার মতো টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। প্রস্তুতি চলছে সকালের খাবারের আয়োজন করার। দিনটা সকলের জন্য আজ অন্যরকম। বাড়ির দুই বউ একসাথে রান্নাঘরের দখলদারি সামলাচ্ছে। আয়াজ – আদ্রিকার বিয়ের তিনদিন চলছে আজ। দুটো বউই যে একেবারে সোনার টুকরো হয়েছে তা কাজকর্ম দেখলেই বোঝা যায়। তাদের আচার-ব্যবহার, চলাফেরা, বোধ-বুদ্ধি সবকিছুই খান বাড়ির রীতিনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বলা চলে, দুজনেই খান বাড়ির আদর্শ বউ। ছেলেদের পছন্দ ভুল হয়নি মোটেই। অবশ্য তানিশাও কিছু কম ছিলোনা। কিন্তু অকালে চলে গেলো মেয়েটা। সেই সাথে বাড়ি ছাড়া হলো বাড়ির বড় ছেলে। কত কত আনন্দ উৎসব পেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ বাড়ির ছেলেটা এসবের মধ্যে থাকেনা। কেন আসে না ছেলেটা? এতো বছরেও রাগ কমছে না তার? মায়ের কথাও কি মনে পড়েনা?
এসবই ভেবে ভেবে দিন কাটে ফারজানার। সকলেই ভেতরে ভেতরে একটা চাপা কষ্ট নিয়ে গুমরে মরে তবে প্রকাশ করে না কেউই। দিন পেরিয়ে রাত হচ্ছে, রাত পেরিয়ে দিন। কিন্তু সুখী, পরিপূর্ণ খান পরিবারের দেখা মিলছে না আর। সবকিছু সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে ওই ভাবনার মধ্যেই।
.
.
.
আহরারের ঘরে বসে আয়াজ কিছু গোপন শলাপরামর্শে ব্যস্ত। আহরার তাকে কিছু গোপন ও জরুরি কাজের নির্দেশ দিয়েছে। বিয়ের ব্যস্ততার জন্য এ কদিন সেসব না হলেও এবার উঠেপড়ে লাগার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।
–ভাইয়া, আমার মনে হয় এভাবে ঘুরে ঘুরে, ঘাঁটাঘাঁটি করে ইনফরমেশন জোগাড় করার চেয়ে বেটার হয় একেবারে দাদীজানের কাছ থেকেই জেনে নেওয়া।
আয়াজের কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে জবাব দেয় আহরার,
–তোর কি মনে হয়? তুই প্রশ্ন করবি অরুনিকার ওপর এটাক কে করেছিলো, কাকে দিয়ে দাদীজান এই কাজ করিয়েছে, আর দাদীজান সুরসুর করে তোকে সব সত্যি বলে দিবে?
–যেই পরিস্থিতিতে তুমি তাকে ফেলে দিয়েছো ভাইয়া, আমার মনে হয়না দাদীজান আর কোনো রাখঢাক রাখবেন।
–বেশ! যদি তোর মনে হয় তাকে প্রশ্ন করলেই উত্তর পাওয়া যাবে তবে ঠিকাছে, আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কাজটা তোকেই করতে হবে। আমি তার মুখোমুখিই হতে চাইনা।
–ওকে ভাইয়া। তুমি চিন্তা করোনা। সবটা আমি দেখে নিব। কিন্তু সত্যিটা বের করেই ছাড়বো। কার এতো বড় বুকের পাটা খান বাড়ির বউ এর ওপর হামলা করে?
আয়াজের কথাটুকু শুনে ভাবনার জগতে হারিয়ে যায় আহরার। সত্যিই সে বুঝে উঠতে পারছে জানে মে রে ফেলার মতো শত্রু তাদের কে?
আয়াজের কথা শেষে সে ঘর থেকে বেরোতে উদ্যত হয়। দরজা খুলতেই তার মনে হলো কেউ বোধহয় সরে গেলো। পরক্ষণেই নিজের মনের ভুল ভেবে ভাবনাটা উড়িয়ে দিয়ে চলে গেলো নিজ গন্তব্যে। এদিকে আয়াজ চলে যেতেই আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো নাদিম। বুকের ওপর দুহাত ভাজ করে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে হাসছে। অস্বাভাবিক সেই হাসি। যেন দুটো বোকা বোকা মানুষের বোকা বোকা পরিকল্পনা শুনে ফেলেছে। হাসি থামিয়ে মৃদু শব্দে শিষ বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। একটা জরুরি কাজ সারা দরকার।
দুপুরের কড়া রোদ সরে গিয়ে হঠাৎ অন্ধকার হয়ে এলো আকাশ। পলকের মধ্যে আকাশজুড়ে কালো মেঘেদের হানা দেখা দেয়। ছাদে মেলে দেয়া কাপড়চোপড় আনার জন্য তাড়া দেওয়া হয় গুলবাহারকে। কোনোপ্রকার উচ্চবাচ্য ছাড়াই গুলবাহার ক্লান্ত শ্রান্ত দেহটাকে টেনে নিয়ে চললেন ছাদে। হাঁপাতে হাঁপাতে মেলে দেওয়া কাপড় গুলো টানতে গেলেই ওপাশে রেলিং এর ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা নাদিমকে চোখে পড়লো তার। মুহুর্তেই শান্ত মুখ ক্রোধান্বিত রূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়। একপ্রকার তেড়ে যেতে যেতে চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে ওঠেন,
–তুমি? তুমি এখানে কেন এসেছো? কি চায় তোমার?
একগাল হেসে নাদিম নম্রসুরে জবাব দেয়,
–আহা দাদীজান, রাগ করছেন কেন? আমি তো আপনাকে দেখতে এসেছিলাম। খুব মনে পড়ছিলো কিনা।
গুলবাহারের রাগ বেড়ে দ্বিগুণ হলো। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলেন,
–দেখতে এসেছো তাইনা? আজ তোমার জন্যই আমার এই অবস্থা। আমি তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে দিব না নাদিম। একবার যদি আমার ওই বাড়ির কারো সাথে কথা বলার সুযোগ হয় আমি ওদের বলে দিব। সব সত্যি বলে দিব। তাতে নিজের দোষটা স্বীকার করে নিতে হলেও আমি পিছপা হব না। তবে তুমি যে অরুনিকাকে খু ন করতে চেয়েছো, তুমি যে একটা কালসাপ সেটা আমি সবাইকে জানাবোই জানাবো।
কাছে কোথাও তীব্র শব্দে বাজ পড়লো। কেঁপে উঠলেন গুলবাহার। নাদিম শান্ত ভাবে আকাশটা পরখ করতে থাকে। চোখ না নামিয়েই বলে ওঠে,
–আমার হাতে বেশি সময় নেই দাদীজান। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে।
–কিসের সময়? আর কে তোমাকে এখানে ঢুকতে দিয়েছে? কেন দিয়েছে? আমি এখুনি কথা বলছি দাঁড়াও।
বলতে বলতে গুলবাহার ঘুরে দাঁড়ালেন যাওয়ার জন্য। সিঁড়ির কাছে আসতেই নাদিম তাকে আটকে দিলো। গুলবাহার রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই হাতে সূঁচালো কিছু ফোটার অনুভূতি হতেই মৃদু আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। তাকিয়ে দেখেন নাদিম একটা ইনজেকশন পুশ করেছে তার হাতে। নাদিমের দিকে ফিরে তাকাতেই নাদিম বেশ সুন্দর করে হাসলো। ঠোঁটে হাসি ধরে রেখেই ফিসফিসিয়ে বললো,
–চিন্তা করবেন না দাদীজান। আপনার এই কষ্টটা কমিয়ে দিচ্ছি কেবল।
বলতে বলতে পলক ফেলার আগেই নাদিম গুলবাহারকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। টাল সামলাতে পারলেন না বৃদ্ধা গুলবাহার। চিৎকার করতে করতে গড়িয়ে পড়লেন সিঁড়ি দিয়ে। শেষ মাথায় আসতেই তার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এলো। চোখ বোজার আগে মুখের কাছে নাদিমের ক্রুর হাসিমাখা মুখটা নজরে এলো তার।
___
বৃদ্ধাশ্রমে আসার পথে আয়াজের কাছে আসা একটা ফোন থামিয়ে দেয় তাকে। আহরার ফোন করেছে। যতদ্রুত সম্ভব তাকে যেতে বলেছে। সবশুনে আয়াজ পাগলের মতো গাড়ি চালিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছালো। জ্ঞানহীন গুলবাহারকে নিয়ে এক মুহুর্ত দেরি না করে ছুটলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
প্রাণপণ চেষ্টা চলছে ডক্টরদের। এই বয়সে এমন এক্সিডেন্ট অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্রাণনাশের আশংকা বেশি। কিন্তু যেন এমনটা না হয় তার জন্য সকল ডক্টররা জানপ্রাণ লড়িয়ে দিচ্ছেন।
খান বাড়ির সকলেই হসপিটালে উপস্থিত। সকলের চোখে মুখে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা প্রকাশ পেলেও আহরার নির্লিপ্ত। বড্ড কঠোর হয়ে আছে সে। নিজের প্রিয় দাদীজান বাঁচা-মরার লড়াই লড়ছে কিন্তু তার মধ্যে দুঃশ্চিন্তার ছিঁটেফোঁটাও নেই।
দীর্ঘক্ষণ চিকিৎসা চালিয়ে অবশেষে ডক্টর মলিন চেহারা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। সকলের উত্তেজিত অবস্থা। তবে প্রশ্ন করার আগেই ডক্টর বলে ওঠেন,
–অনেক চেষ্টা করেছি তবে প্রাণে বাঁচাতে পারলেও প্যারালাইসড হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারলাম না।
আফজাল সাহেব উদ্বিগ্ন স্বরে বলে ওঠেন,
–মানে কি ডক্টর? আমি কিছু বুঝতে পারছিনা।
ডক্টর ব্যাখ্যা করে বলতে থাকেন,
–উনার বেঁচে থাকা না থাকা এখন সমান হয়ে গিয়েছে। উনি পুরোপুরি প্যারালাইসড। পুরো শরীর অবস তার। চেষ্টা করলে হয়তো খানিকটা হাত আর মাথা নাড়াতে পারবেন, চোখের ইশারা পারবেন, ব্যস! এটুকুই। এখন একজন আমার সাথে আসুন। ওষুধপত্র সহ যাবতীয় সবকিছু বোঝানোর কিছু ব্যাপার আছে।
এই বলে ডক্টর চলে গেলেন। ডক্টরের পিছুপিছু আফজাল সাহেব গেলেন। বাকিরা তখন শোকে আচ্ছন্ন অবস্থায়। আদ্রিকা গুলবাহারের ব্যাপারে কিছুই জানেনা। সে বিয়েতেও গুলবাহারকে দেখেনি, এই বাড়িতে আসার পরও গুলবাহারকে নজরে পড়েনি তার। জিজ্ঞেস করতে চেয়েও নানা কারণে আর জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি। তবে আজ কৌতুহল দমাতে না পেরে অরুনিকার কাছে এসে নিচু স্বরে জানতে চায়,
–এ্যাই বুবু, উনি এতোদিন কোথায় ছিলেন?
অরুনিকা বুঝতে না পারায় পাল্টা প্রশ্ন করে,
–উনি?
–আরে দাদীশ্বাশুড়ি।
অরুনিকা বুঝতে পেরে মাথা নাড়ায়। আদ্রিকা পুনরায় জানতে চাইলে অরু তপ্ত শ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে। সবটা বলার পর থামে।
এতোক্ষণ গুলবাহারের জন্য কষ্ট হলেও সবকিছু শুনে আদ্রিকার বেশ রাগ হলো। রাগের চোটে সে মুখ ফসকে বলে ফেললো,
–তাহলে তো বেশ হয়েছে বুড়ির সাথে।
অরুনিকা ধমকে বলে ওঠে,
–ছিহহ! আদ্রি। এখনো তুই ক্ষেপাটেই থেকে গেলি। বলেছিনা গুরুজনদের নিয়ে এভাবে বলবিনা।
–তাই বলে উনি যা করেছেন সেগুলো কি মেনে নেওয়ার মতো? তুমি বলো বুবু।
–উনি যতই অন্যায়কারী হন, কিন্তু বিপদগ্রস্ত একজন মানুষকে এভাবে বলাটা একদমই ঠিক নয় আদ্রি।
–তবে তুমি যাই বলো বুবু, আমি বলবো এসবকিছু উনার পাপের ফল।
অরুনিকা আর কিছু বলেনা। আবারো এক চাপা শ্বাস বেরিয়ে এলো কেবল।
দুইদিন পরই গুলবাহারকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়। অবশেষে তাকে খান ভিলায় ফিরিয়ে আনা হলো। কিন্তু কেওই ভাবেনি তার ফিরে আসাটা এমনভাবে হবে। গুলবাহার নিজেও ভাবতে পারেননি।
নিজের বাড়িতে, নিজের ঘরে জড়পদার্থের ন্যায় পড়ে থাকতে হচ্ছে দিনরাত। চাইলেও পারবেন না নিজে থেকে একটু নড়াচড়া করতে। হাঁটাচলা তো দূর। যে মুখ দিয়ে বাড়ির বউ, বাড়ির রহমতকে তিনি তিরস্কার করতেন সেই মুখ দিয়ে এখন একটা অক্ষরও বের হয়না আর। যেই কন্ঠের জোরে নিজের অহংকার প্রকাশ করে যাকে যা খুশি তাই বলতেন সেই কন্ঠ আজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে চিরতরে। হারিয়ে গেছে তার সকল দাপট, হারিয়েছে তার আধিপত্য। একটা অপ্রয়োজনীয় বস্তুর ন্যায় বাড়ির এক কোণে পড়ে থাকা ছাড়া তার করণীয় আর কিছুই নেই। এমনকি কেউ তার মুখে খাবার তুলে দিলে তবেই খেতে পারবেন, তার বাথরুম সারার ইচ্ছে হলেও তাকিয়ে থাকতে হবে অন্যের দিকে। একদিকে শুয়ে থাকতে থাকতে কষ্ট হলে নড়েচড়ে অপরপাশে শুইতে পারবেন না যদি না কেউ শুইয়ে দেয়। কি লাভ এভাবে বেঁচে থেকে? এর চেয়ে তো মৃ ত্যুই শ্রেয়। কিন্তু আফসোস! চাইলেও তার মৃ ত্যুটাও হবেনা। তাকে এভাবেই তিলে তিলে ম রতে হবে। যতদিন তার হায়াত আছে।
তবে তার ভাগ্য এখনো সুপ্রসন্ন। তার ছেলে বউরা এবং নাতি বউরা তার দেখভাল করছে, সেবা করছে। তাকে ফেলে দেয়নি। সৃষ্টিকর্তা এটুকু দয়া যে তাকে দেখিয়েছেন তাতেই তিনি কৃতজ্ঞ।
——–
ইদানীং আহরারকে অনেক বেশি চিন্তিত দেখা যায়। সবসময় কিছু একটা নিয়ে ভাবনায় ডুবে থাকে সে। অরুনিকা খেয়াল করে সবটা। তবে হুট করেই কোনো প্রশ্ন করেনা। আজ যখন চোখের সামনে পড়ে থাকা ওয়ালেট খুঁজে না পেয়ে অরুকে ডেকে ডেকে পাগল করে দিলো, এবার আর অরু চুপ থাকতে পারলোনা। জিজ্ঞেস করেই বসলো,
–কি হয়েছে বলুন তো আপনার? এমন অন্যমনষ্ক হয়ে থাকছেন কেন আজকাল?
আহরার বোকা হেসে জবাব দেয়,
–ধুর! কি যে বলোনা। কি আর হবে?
–দেখুন, একদম আমার কথাটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবেন না। আমি বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছি কিছু তো একটা হয়েছে। আমাকে বলুন কি হয়েছে?
আহরার বুঝলো অরুর কাছ থেকে আর লুকিয়ে লাভ নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো,
–দাদীজানের এই দূর্ঘটনা ঘটার দিন আয়াজ তার কাছে যাচ্ছিলো। সত্যিটা জানার জন্য। কে সেদিন বাড়িতে ঢুকে তোমাকে মা রার চেষ্টা করেছিলো। আর জানার আগেই তো এই অবস্থা হয়ে গেলো। এতো চেষ্টা করছি লোকটাকে খুঁজে বের করার কিন্তু ধুরন্ধর লোক নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে বারবার। জানো দাদীজানের ফোনে কললিস্ট ও চেক করেছি কিন্তু সেটাও ডিলিটেড। দাদীজান ডিলিট করে দিয়েছেন হয়তো।
আহরারের কথা শুনে অরুনিকা হাসলো। পাশে বসে তার হাতে হাত রাখলো। শান্তনা দিয়ে বললো,
–এই ব্যাপারটা নিয়েই এতো দুঃশ্চিন্তা। শুনুন মশাই, এতো সামান্য ব্যাপারে চিন্তা করলে চলেনা। যে এই কাজ করেছে সে কতোদিনই বা পালিয়ে বেড়াবে। সত্য চাপা থাকেনা। আজ না হয় কাল ধরা তো সে পড়বেই। হয়তো সময়টা একটু বেশি লাগবে। একদম টেনশন করবেন না আর। নইলে কিন্তু আমি রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যাবো।
আহরার অবাক হয়ে বললো,
–ওমা! আমার দুঃশ্চিন্তা করার সাথে তোমার রাগ করে বাবার বাড়ি চলে যাওয়ার কি সম্পর্ক?
অরুনিকা কেমন অভিমানী স্বরে বললো,
–বা রে! আমার বরটাতো আমার দিকে তাকায়ই না, একটুও খেয়াল রাখেনা আমার। সারাক্ষণ খালি অন্য ভাবনা। তাহলে আমি আর এখানে থেকে কি করবো?
অরুনিকার কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠে আহরার। হাসতে হাসতে অরুনিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বাচ্চা ভোলানোর মতো বলে ওঠে,
–আচ্ছা বাবা ঠিকাছে। আর অন্য ভাবনা ভাববো না। শুধু তোমাকেই দেখবো, তোমারই খেয়াল রাখবো।
এই বলে আবারো হাসতে লাগলো আহরার। তার সাথে তাল মিলিয়ে অরুনিকাও ফিক করে হেসে দিলো।
আহরার উঠে দাঁড়ালো। অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিদায় নিয়ে বের হতে গেলে অরুনিকা পেছন থেকে ডেকে ওঠে,
–শুনুন।
আহরার দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ফেরে ভ্রুঁ উঁচিয়ে জানতে চায়, “কি?”
অরুনিকা কিছু বলেনা। এগিয়ে এসে দাঁড়ায় একদম মুখোমুখি। তারপর হুট করেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আহরারকে। যেন একটু আলগা হলেই হারিয়ে যাবে। আহরার খানিকটা অবাক হলেও সেও হালকা হেসে জড়িয়ে নেয় অরুকে। আজ অরুর কি হয়েছে সে নিজেও জানেনা। শুধু ইচ্ছে করছে আহরারকে এভাবে বেঁধে রাখতে। ছেড়ে দিলেই যেন পালাবে। বেশ কিছুটা সময় পেরোলেও যখন অরু আহরারকে ছাড়ছে না আহরার তখন কোমলস্বরে বলে ওঠে,
–দেরি হয়ে যাচ্ছে, শ্যামবতী। এবার তো ছাড়ো।
অরুনিকা ছেড়ে দেয়। কিসব পাগলের মতো ভাবনা ভাবছে সে। আহরার “আসি” বলে চলে যেতে উদ্যত হতেই অরুনিকা আবারো বলে ওঠে,
–আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরবেন প্লিজ।
আহরার মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো, সে ফিরবে। তাড়াতাড়িই ফিরবে। আহরার চলে গেলে হুট করে অরুর কেমন মন খারাপ হতে থাকে। জানেনা ঠিক কি কারণে। তবুও প্রচন্ড মন খারাপ হচ্ছে তার। নিজেকে দ্রুত সামলে মনটা অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করে সে। তারপর মনে পড়ে দাদীজানকে সকালের খাবার খাওয়ানো হয়নি। তাই সে জলদি জলদি করে খাবার রেডি করে নিয়ে চলে গেলো গুলবাহারের ঘরে।
অরুনিকাকে দেখলেই গুলবাহারের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্রকাশ তো করতে পারেন না কিন্তু মুখ দেখেই বুঝে যায় অরু। আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা। অরু হাসলো। গুলবাহারকে ধরে কিছুটা হেলান দিয়ে রাখলো যাতে খাওয়াতে সুবিধা হয়। তারপর বেশ সময় নিয়েই খাওয়ানো শেষ করে সে। খাওয়া শেষে ওষুধ খাইয়ে দেয়। তারপর তাকে আবারো ভালোভাবে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যেতে চায়, কি মনে করে যেন আবারো দাঁড়িয়ে পড়লো। গুলবাহারের কাছে এসে বসে পড়লো সে। কিছু একটা গভীর ভাবে চিন্তা করতে লাগলো। গুলবাহার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কেবল। কিছু সময় পর অরুনিকা প্রশ্ন করলো,
–আচ্ছা দাদীজান, যেদিন আমার ওপর হামলা হয়েছিলো তারপরদিন সকালে আপনি সেই লোকটার সাথে ফোনে কথা বলেছিলেন যাকে দিয়ে আপনি কাজটা করাতে চেয়েছিলেন। যদিও আপনি মা র তে চাননি..
কথাটুকু শোনা মাত্রই গুলবাহার লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নেন। সাথে সাথে তার চোখ উপচে দু ফোঁটা পানিও গড়িয়ে পড়লো। অরুনিকা বুঝতে পারলো। পরম যত্নে সে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললো,
–কষ্ট পাবেন না দাদীজান। আমি আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য বলিনি। যা হবার তা তো হয়ে গিয়েছে। এখন এসব ভেবে তা নিয়ে অনুতাপ করে লাভ নেই। আমি আসলে অন্য ব্যাপার জানতে চাচ্ছিলাম দাদীজান। আপনি আমাকে একটু ইশারা দিলেই হবে। আপনার ফোনের কললিস্ট থেকে আপনি কি ওই লোকের নাম্বারটা ডিলিট করে দিয়েছিলেন?
অরুনিকার মনে হুট করেই সন্দেহ আসে। সে যতদূর জানে সেদিন ফোনে কথা বলা শেষ হওয়া মাত্রই আহরার গুলবাহারকে নিয়ে চলে গেছিলো বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার জন্য। ফোনটা ছিলো বাড়িতেই। তিনি তো দ্বিতীয়বার আর ফোন হাতে নেওয়ার সুযোগই পাননি তবে নাম্বার ডিলিট করবেন কিভাবে? তাই শিওর হওয়ার জন্য গুলবাহারকে জিজ্ঞেস করা। অরুনিকা আবারো বলে,
–দাদীজান, আপনি শুধু একটু ইশারা করুন। একটা কাজ করুন যদি উত্তর হ্যা হয় তবে একবার পলক ঝাপটান আর উত্তর না হলে দুইবার।
অরুনিকা তাকিয়ে আছে গুলবাহারের চোখের দিকে। কয়েক সেকেন্ড পরই গুলবাহার উত্তর দেন। পলক ঝাপটান। দুইবার। তার মানে নাম্বার তিনি ডিলিট করেননি। তাহলে? কে করলো? ঝট করে অরুনিকার মাথায় আসে, এই কাজ বাড়ির কেউ করেনি তো? তাছাড়া বাইরের কেও এই কাজ করার তো কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বাড়ির কে এই কাজ করবে? কেন করবে? অরুনিকা আবারো গুলবাহারকে প্রশ্ন করে,
–দাদীজান লোকটা কি এই বাড়িরই কেও?
গুলবাহার কেমন অস্থির হয়ে পড়েন। তার ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে থাকে। অরুনিকাকে নিজের দিকে ইশারা করছেন বারবার। প্রথমদিকে অরুনিকা বুঝতে না পারলেও পরে অরু কি মনে করে যেন জিজ্ঞেস করে বসলো,
–ওই লোকটাই কি আপনার এই অবস্থা করেছে দাদীজান? যেন আপনি মুখ খুলতে না পারেন। হ্যা হলে একবার..
ধীরে ধীরে অরুনিকা সবচেয়ে বড় সত্যিটার দিকেই এগিয়ে যেতে থাকে। তার কথাটুকু শেষ হওয়ার আগেই গুলবাহার পলক ঝাপটান একবার। অরু পুনরায় প্রশ্ন করে,
–এই বাড়িরই কেউ?
গুলবাহার আবারো পলক ঝাপটান। একবার। যার অর্থ, “হ্যা”। অরুনিকার হৃদপিণ্ডটা বড্ড জোরে জোরে লাফাচ্ছে। ভয় এবং অস্থিরতায় শরীর কাঁপছে তার। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। কি যে কঠিন সত্য সে জানতে যাচ্ছে তা ধারণাও করতে পারছেনা। অরু এক ছুটে নিজের ঘরে গিয়ে ফোনটা নিয়ে এলো। তারপর গুলবাহারের মাথার কাছে বসে বললো,
–দাদীজান, আমি একটা একটা করে বাড়ির সব সদস্যের ছবি দেখাবো, তাদের মধ্যে যে ওই লোক তার ছবি দেখা মাত্রই আপনি বারবার পলক ঝাপটাবেন। একবার দুবার নয়, ঠিকাছে?
অরুনিকা এক এক করে সকলের ছবি দেখাতে লাগলো কিন্তু গুলবাহারের চোখের পাতা স্থির। একে একে সবার ছবি দেখানো হলো। এমনকি সার্ভেন্টদের ছবিও দেখিয়েছে। কিন্তু গুলবাহার পলক ঝাপটালেন না। তবে কি এদের মধ্যে কেওই না? অরুনিকা ভাবতে লাগলো, কার কার ছবি ছাড়া পড়েছে। তখনই তার মাথায় নাদিমের খেয়াল আসতেই সে সাথে সাথে গ্যালারি ঘেঁটে বহুকষ্টে নাদিমের একটা ছবি বের করলো। ফ্যামিলি ফটোর মধ্যেই। অরুনিকা ছবিটা দেখিয়ে নাদিমের দিকে আঙুল তাক করে বললো,
–দাদীজান, নাদিম ভাই..
সাথে সাথে ছটফট করতে শুরু করলেন গুলবাহার। এক মুহুর্ত দেরি না করে তিনি পলক ঝাপটাতে থাকলেন একনাগাড়ে। ধ্বক করে ওঠে অরুনিকার বুক। বিস্ফোরিত নয়নে সে চেয়ে আছে গুলবাহারের দিকে। বিশ্বাস করতে পারছেনা সে, নাদিম? এই লোকটা? কিভাবে সম্ভব? অরুনিকার মনে হলো আহরারকে জানানো উচিত। এই মুহূর্তে। ফোন হাতে নিয়ে আহরারকে কল দেওয়ার আগেই তার ফোনে একটা কল আসে। আয়াজ কল করেছে। অরুনিকা ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আয়াজের অস্থির কন্ঠস্বর,
–ভাবি, জলদি থানায় আসুন। ভাইয়াকে পুলিশ এরেস্ট করেছে।
চলবে….
#রূপবানের_শ্যামবতী
#৩৫তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী
অফিসে যাওয়ার পথেই আহরারের কাছে ফোন আসে। হক সাহেবের ফোন। আহরার রিসিভ করতেই উনি বেশ তাড়া দিয়ে বললেন, যেন এক্ষুনি উনার বাড়িতে যায় আহরার। ভিষণ জরুরি।
আহরার তাই অফিসের রাস্তায় না গিয়ে হক সাহেবের বাড়ির রাস্তা ধরে। উনার বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাতেই দেখতে পেলো পুলিশ এসেছে। আহরার অবাক হয়ে ভেতরে ঢুকতেই একজন পুলিশ এগিয়ে এসে বললেন,
–আপনিই আহরার খান? ওনার অব IWAK?
আহরার মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,
–জি আমি। কোনো সমস্যা?
আহরার হক সাহেবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–কি হয়েছে হক সাহেব হঠাৎ এমন জরুরি তলব?
উত্তরে পুলিশটি বলে ওঠেন,
–আপনি আমার সাথে কথা বলুন মি.খান।
আহরার পুলিশটির দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে,
–জি বলুন।
–আপনার কোম্পানিই তো এই বাড়ির ইন্টেরিয়র এর কাজ করেছে তাইনা?
–হ্যা।
–তা মি.খান, আপনি তো বেশ ধূর্ত।
–মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি?
–আপনি ড্রাগস সাপ্লাই করেন। এই বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় যেখানে সচরাচর মানুষের নজর পড়বেনা সেখানে লুকিয়ে রেখেছেন। আপনার পরিকল্পনা ছিলো ডিলারের সিগনাল পেলে এখান থেকে সেই জিনিসপত্র গুলো সহ ড্রাগস সাপ্লাই করে দিবেন। যেহেতু আপনার ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং কোম্পানি তার ওপর বেশ নামকরা, তাই খুব একটা সন্দেহ বা চেকিং এর সিচুয়েশনে পড়তে হবে না আপনাকে। এরই সুযোগ নিয়ে বিন্দাস এই ড্রাগস পাচার এর কাজ করে যাচ্ছেন।
আহরার বাকহারার ন্যায় চেয়ে আছে। এই পুলিশ অফিসারের কোনো কথাই তার বোধগম্য হচ্ছে না। তার কাজের মধ্যে ড্রাগস সাপ্লাই এর ব্যাপার আসলো কিভাবে?
–দেখুন অফিসার, এসব ড্রাগস এর ব্যাপারে আমি বিন্দু পরিমাণও অবগত নই।
–আমরা এই বাড়িটা সার্চ করে সমস্ত ড্রাগস খুঁজে পেয়েছি এবং হক সাহেব নিজেই সাক্ষী দিয়েছেন এই কাজ আপনার।
আহরার বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে থাকে হক সাহেবের দিকে। তাতে হক সাহেবের কোনো হেলদোল নেই। তিনি নির্লিপ্ত। এমন একটা মিথ্যা দায় লোকটা কেন তার ওপর চাপালো? কোন শত্রুতার জেরে?
আহরার কৈফিয়ত নিতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। অফিসারটি বলে উঠলো,
–আপনি বেশ সম্মানীয় ব্যক্তি তাই আমরা আপনাকে এরেস্ট করছিনা। আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে। চলুন।
আহরার কিছু না বলে পুলিশের সাথে চলে গেলো। কারণ সে বুঝতে পারছে এর মধ্যে এক বিশাল চক্রান্ত আছে।
পুলিশ আয়াজকে খবর জানালে আয়াজ দ্রুত থানায় চলে আসে। আসার পথে অরুনিকাকে ফোন করে জানিয়ে দেয়। থানায় আসতেই পুলিশের সাথে কথা হয় তার। আহরারকে এখনো লকাপে ঢোকানো হয়নি। সম্ভবত তার জামিনের ব্যবস্থা করা যাবে। ইতিমধ্যে দাইয়ান, রাদিফ, ঈশানও চলে এসেছে। দাইয়ান উকিলের সাথে কথা বলে আহরারের জামিনের ব্যবস্থা করছে। আয়াজের হাতে ছিলো আহরারের ফোন। টুং করে ফোনে ম্যাসেজ আসার শব্দ শুনে সে না চাইতেও ম্যাসেজটা দেখে ফেলে। সাথে সাথে চক্ষু কপালে ওঠে তার। আহরারের দিকে তাক করে রাখে ফোনটা। ইশারায় ম্যাসেজটি পড়তে বলে। আহরার পড়তে থাকে,
“মাই ডিয়ার ব্রাদার, কেমন ফিল করছিস? এটা ছোট্ট একটা ট্রেইলার ছিলো ভাই। সিনেমা এখনো বাকি। প্রতিশোধের খেলা তো কেবল শুরু। তুই আমার কাছ থেকে যা কেড়ে নিয়েছিলি আমিও তোর কাছ থেকে তাই কেড়ে নিব। তোর অরুনিকা.. তোকে জেলে না পাঠালে তো ওর কিচ্ছু করতে পারতাম না। একটু অপেক্ষা কর। খুব শীঘ্রই মুক্তি পেয়ে যাবি।”
ম্যাসেজটি পড়ে আহরারের বুঝতে বাকি থাকেনা এই কাজ কার। আয়মান। এতোটা ক্ষোভ পুষে রেখেছে সে মনে, তাও মিথ্যে একটা বিষয়ের জেরে।
আহরার আয়াজকে বলে, আর এক মুহুর্ত দেরি না করতে। অরুনিকার কাছে যেতে। যে করেই হোক অরুনিকাকে বাঁচাতে হবে। হয়তো অরুনিকা এতোক্ষণে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। রাস্তায় যে বিপদ ওঁৎ পেতে রয়েছে তার জন্য।
আয়াজও ভাইয়ের কথা শুনে দেরি করেনা আর। ঈশানকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এদিকে দাইয়ান, রাদিফ দ্রুত জামিনের ব্যবস্থা চালাচ্ছে।
আয়াজ অরুনিকাকে ফোনে পাচ্ছে না। ফোন বন্ধ। বাড়িতে ফোন করে জানতে পারে অরুনিকা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই।
আায়াজ, ঈশান খান ভিলা থেকে থানায় যাওয়ার রাস্তা পুরোটাই দু-তিন বার চক্কর চালিয়েছে। কিন্তু অরুনিকার নিশানাও পায়নি খুঁজে। যেই নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছিলো সেখানেও বার কয়েক ডায়াল করেছে কিন্তু এটাও বন্ধ। আয়াজ ভেঙে পড়ে ভিষণ। সে তার ভাইয়াকে কি জবাব দিবে? ভাইয়ার দেওয়া দায়িত্ব সে পালন করতে পারলোনা। ঈশান শান্তনা দিয়ে বলে,
–চিন্তা করিসনা আয়াজ, অরুনিকা ভাবির কিচ্ছু হবেনা। আমরা ঠিক খুঁজে পাব। মনের জোর রাখ।
দাইয়ান যখন কিছুতেই আহরারের জামিনের ব্যবস্থা করে উঠতে পারছেনা তখনই সে আফজাল সাহেবের শরণাপন্ন হলো। তবে আফতাব সাহেবকে কিছু জানালো না। সে অফিসিয়াল কাজে বাইরে থাকায় তাকে ঐ মুহুর্তে এমন দুঃসংবাদ দেওয়াটা অনুচিত বলে মনে করলো তারা। আফজাল সাহেব থানায় আসতেই একপ্রকার হুলুস্থুল লেগে গেলো। কারণ তিনি বিশিষ্ট গন্যমান্য ব্যক্তি। একপ্রকার নিজের পাওয়ার খাটিয়েই আহরারের জামিনের ব্যবস্থা করলেন তিনি দ্রুত।
আহরারের জামিন পেতে খুব একটা সময় ব্যায় হয়নি। জামিন পেয়ে বেরোতেই সে সর্বপ্রথম অরুনিকার খোঁজ করলো। কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আয়াজের কাছ থেকে জানতে চাইলে তার নীচুস্বরের জবাব, “অরুভাবিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ভাইয়া।” কথাটুকু শুনতেই মুহুর্তের জন্য দুনিয়া থমকে যায় আহরারের। অরুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? মস্তিষ্কে ভালোভাবে বারি খেতেই রীতিমতো উন্মাদ হয়ে গেলো সে। ছুটে বেরিয়ে পড়লো একাই। পাগলের মতো অরুকে খুঁজে বেড়াতে লাগলো। কিন্তু কোনো চিহ্নও খুঁজে পাচ্ছে না। এভাবে ক্লুলেস হয়ে কোথায় কোথায় খুঁজবে সে? মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তার। দিশেহারা হয়ে যখন এদিক সেদিক ছুটছে সে তখনই তার ফোনে আরো একটা ম্যাসেজ আসে। এবারের ম্যাসেজে ঠিকানা দেওয়া, যেখানে অরুকে আটকে রাখা হয়েছে। আহরার যেন জানে পানি পেলো। দেরি করলো না আর। গাড়ি নিয়ে ছুটলো। তবে দাইয়ানের ফোনে ঠিকানাটা ম্যাসেজ করে পাঠিয়ে তাকে আসতে বলে দিলো। আহরারের ম্যাসেজ পেতেই দাইয়ান, ঈশান, রাদিফ আর আয়াজ চারজনই একসাথে বেরিয়ে পড়লো।
এদিকে আহরারের মাথায় খু ন চেপে আছে। সে ভাবছে অরুর গায়ে যদি আজ একটা আঁচও লাগে সে সত্যি খু ন করে ফেলবে আয়মানকে। কিছুতেই ছাড়বেনা। ভাই, বন্ধু বলে আর কিছুই মানবেনা।
গাড়ি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতেই সে তার গাড়ির গোপন জায়গা থেকে একটা রি ভ লবার বের করলো। এই রি ভ লবারটা সে সবসময় নিজের কাছে রাখে। সেফটির জন্য। যেটা তার বাড়ির লোকেরা কেউই জানেনা। সেই রি ভ লবারটা এতোদিন কোনো কাজে না লাগলেও আজ লাগবে মনে হচ্ছে। আহরার আর কিছু না ভেবে রি ভ লবার নিয়ে এগিয়ে গেলো।
আহরারের এরেস্ট হওয়ার খবর শুনে অরু যখন অস্থির হয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। বাড়ির গাড়িটা অবধি নেয়নি। অন্য কোনো গাড়ি বা কোনো রিকশা নেওয়ার কথাও যেন মাথায় আসেনি তার। সে কেবল ছুটতে থাকে। একটু আগেই দাদীজানের কাছ থেকে যেই ধাক্কাটা খেয়েছে সেটার রেশ কাটানোর আগেই আরো বড় ধাক্কা। অরুনিকার চিন্তাশক্তিও লোপ পেয়ে যায়। কি করছে, কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না সে। ছুটতে ছুটতে কিছুদূর যেতেই আচমকা তার সামনে হুট করে কালো রংএর এক গাড়ি এসে থামে। অরুনিকা ভয় পেয়ে যায়। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার ভয়কে আরো বাড়িয়ে দিয়েই গাড়ি থেকে দুজন মুখোশধারী লোক বেরিয়ে আসে। অরুর মনে হলো, তার পালানো উচিত। কিন্তু সে নড়তে পারছেনা। তার পা দুটো যেন দেবে গেছে মাটিতে। শরীরে জোর লাগিয়ে শক্তি সঞ্চার করে পিছিয়ে যেতে চায় কিন্তু পারেনা। লোকদুটো ততক্ষণে এগিয়ে আসে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অরুর মুখে রুমাল চেপে ধরে। খুব একটা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেনা সে। জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে।
যখন জ্ঞান ফিরলো চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলো না সে। বুঝতে পারছে না কোথায় আছে। একটু নড়াচড়া করতেই বুঝলো তার হাত বাঁধা আর চোখও বেঁধে রাখা হয়েছে বলেই সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না।
অরুনিকা বাঁধন খোলার জন্য ছটফট করতে থাকে। তখনই মনে হলো কেউ তার হাত খুলে দিচ্ছে।
হাত দুটো ছাড়া পেতেই সে ঝট করে চোখের বাঁধনও খুলে ফেলে। বেশ অনেকক্ষণ বাঁধা থাকায় চোখ ঝাপসা হয়ে আছে তার। সবকিছু অস্পষ্ট দেখছে সে। বার কয়েক চোখ ডলে ধীরে ধীরে সবকিছু ভালোভাবে দেখতে পেলো।
নিজের গোপন আস্তানায় অরুনিকাকে বেঁধে রেখেছে আয়মান। হক সাহেবকে পাঠিয়েছে তার বাঁধন খুলে দেওয়ার জন্য। নিজের ছোট্টো ঘরটিতে রাখা চেয়ারে আয়েশি ভঙ্গিতে পা তুলে বসে আছে সে। চোখ সামনে রাখা স্ক্রিন গুলোতে যেখানে সিসিটিভি ফুটেজ দেখা যাচ্ছে। চতুর্দিকে সিসিটিভি লাগিয়ে রেখেছে সে। অরুনিকাকে যে ঘরে বেঁধে রেখেছে সেখানেও ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোন সেট করা। তারা কি করছে সেসব দেখার সাথে সাথে তাদের মধ্যে কি কথা হচ্ছে তাও শোনা যাবে। তাই তো ভিষণ মনোযোগী হয়ে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে স্ক্রিনের দিকে।
চারপাশের অস্পষ্ট সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পেতেই নিজের সামনে থাকা ব্যক্তিটির দিকে নজর পড়ে অরুনিকার। বিস্মিত নয়নে চেয়ে থাকে সে হক সাহেবের দিকে। যাকে সে তার বাবা বলে মনে করেছিলো, এই মানুষটা তাকে কিডন্যাপ করে এনেছে। কিন্তু কেন? প্রশ্ন করার আগেই হক সাহেবের কথা থামিয়ে দিলো অরুনিকাকে। চিন্তিত নয়নে চেয়ে কেমন উদ্বিগ্ন স্বরে বলে ওঠেন হক সাহেব,
–অরুমা, তুই? তুই এখানে কেন?
অরুনিকা হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। এই তো তার বাবার মতো চাহনি, বাবার মতো কথা বলার ভঙ্গি, বাবার মতোই ডাক, “অরুমা”। তার মানে অরু ভুল নয়। অরু ঠিকই চিনেছিলো নিজের বাবাকে। হক সাহেবই অরুনিকার বাবা জামিল হক। অরুর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে অশ্রুদের ভিড়ে। অস্পষ্ট স্বরে বলে ওঠে সে,
–ব..বাবা।
অরুনিকার কন্ঠে বাবা ডাক শুনে যেন ঘোর কাটে হক সাহেবের। নিজের অজান্তেই তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে বসেছেন। এখন কথা ঘোরানোরও কোনো জায়গা রইলোনা। কিন্তু তিনি কথা ঘোরাতেও চাননা। আরো কিছুটা এগিয়ে এসে মেয়ের কাছে বসে তিনি দু’হাতে মেয়ের মুখ আগলে ধরেন। পরমযত্নে মেয়ের চোখে মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,
–মা, মারে। আমার অরুমা। আমার সোনামা।
হক সাহেবের গলা ভেঙে আসছে। বাবার স্নেহের স্পর্শে অরুনিকা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে যায়। বাবাকে জাপটে ধরে হাওমাও করে কাঁদতে থাকে। হক সাহেবও মেয়েকে আগলে নিয়ে সমানতালে অশ্রুবিসর্জন দিচ্ছেন।
ওদিকে সবকিছু দেখে ও শুনে আয়মান বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। টেবিলে থাবা মেরে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,
–আরেহহহ! এই অরুনিকাকেই হক সাহেবের মেয়ে হতে হলো। পুরো খেলাটাই ঘুরে গেলো এখন।
আসিফ চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করে,
–তাহলে এখন কি করবেন বস?
আয়মান স্ক্রিনে হক সাহেব ও অরুনিকার কর্মকান্ডের দিকে নজর রাখে। কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে জবাব দেয়,
–চেয়েছিলাম অরুনিকাকে অনেক অনেক দূরে পাঠিয়ে দিব। বন্দিনী হয়ে থাকবে সে সারাজীবন। আর আহরার! খুঁজে খুঁজে মরিয়া হয়ে যাবে কিন্তু খুঁজে পাবেনা তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে। সারাটাজীবন ধরে নিজের স্ত্রীকে হারানোর যন্ত্রণা বয়ে বেড়াবে। তিল তিল করে মরবে ভালোবাসা হারিয়ে। আর এই কাজের দায়িত্ব সম্পূর্ণ হক সাহেবের ওপর ছিলো। যদি সত্যিই অরুনিকা হক সাহেবেরই মেয়ে হয়ে থাকেন তবে তিনি কখনোই এমনটা করবেন না। বিকল্প ভাবতে হবে আমায়। বিকল্প, বিকল্প..
কান্না থামিয়ে নিজেকে সামলে নেয় অরু। বাবাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে। চোখ মুছে অভিমানী স্বরে প্রশ্ন করে,
–সেদিন তুমি কেন আমাকে না চেনার ভান করেছিলে বাবা? তুমি জানো কতোটা কষ্ট পেয়েছি আমি। আর, আর এতো বছর তুমি বাড়ি কেন ফেরোনি বাবা? তোমার অপেক্ষায় অপেক্ষায় আমাদের কি অবস্থা হয়েছিলো তুমি জানো? সবকিছু বলতে হবে আজ তোমায়। বলো বাবা।
মেয়ের কথা শুনে মলিন হাসলেন হক সাহেব। আলতো করে মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জবাব দেন,
–কি করে ফিরবো রে মা। আমি যে নিরুপায় ছিলাম।
অরুনিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হক সাহেব আবারো বলতে থাকেন,
–ব্যবসার কাজে এসেছিলাম এই পাশের শহরে। তবে যার কাছে এসেছিলাম সে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। আমার সম্পূর্ণ টাকাপয়সা সবকিছু হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু পালানোর আগে আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে যায় এক ড্রাগস পাচারকারী চক্রের সাথে। মিথ্যে অভিযোগে অভিযুক্ত হই আমি। এদিকে পুলিশ আমাকে তাই হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। কিন্তু আমি ধরা দেইনা। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই। বাড়িতে ফেরার উপায় নেই কারণ পুলিশ আমার বাড়ির ঠিকানা জেনে গিয়েছিলো, এমনকি ওখানে গিয়েও আমার খোঁজ চালিয়েছে। আমার জন্য উপযুক্ত ছিলো ওই শহর ছেড়ে অন্য জায়গায় পালিয়ে যাওয়া। যেখানে আমাকে কেউ চিনবেনা। কিন্তু পালানোর কোনো পথ পাচ্ছিলাম না। ভিষণ অসহায় হয়ে লুকিয়ে থাকতাম যেখানে সেখানে। আহ! কি করুণ দিন ছিলো সেসব। তারপর একদিন ফেরেশতার মতো আগমন ঘটলো আয়মানের। সে আমাকে এই শহরে নিয়ে এলো। নিজের কাছে আশ্রয় দিলো। আমরা দুজনেই একসাথে গড়ে তুলি নিজস্ব বিজনেস। জীবনে সবকিছু ফিরে গেলাম সুন্দরভাবে। শুধু পরিবারটাকেই ফিরে পেলাম না আর।
কথা শেষ করে চোখ মোছেন হক সাহেব। বাবার কথা শুনতে শুনতে অরুনিকারও দুচোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝড়তে থাকে। সেদিকে লক্ষ্য করতেই হক সাহেব ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে ওঠেন,
–আহা অরুমা। কাঁদছিস কেন? কাঁদেনা মা আমার।
এই বলে পরম মমতায় অরুর চোখের পানি মুছিয়ে দিচ্ছেন তিনি।
স্ক্রিনে এমন দৃশ্য দেখতে দেখতে অজান্তেই ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে আয়মানের। একটা চাপা শ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবতে থাকে, “বাবা-মেয়ের ভালোবাসা বোধহয় পৃথিবীর সুন্দর বিষয়গুলোর মধ্যে একটি।”
হক সাহেব এবার কৌতুহলী স্বরে অরুনিকাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন,
–কিন্তু অরুমা, তুই এখানে এলি কিভাবে? এখানে তো আহরার খানের স্ত্রীর থাকার কথা ছিলো। ওরা কি ভুল করে তোকে তুলে নিয়ে এলো?
অরুনিকা অবাক হয়ে বলে,
–বাবা, তুমি জানোনা? আমিই আহরার খানের স্ত্রী।
হক সাহেব যেন মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না এমনকিছু শুনতে। হতবাক হয়ে বলেন,
–কিইই? তুই? তোর বিয়ে হলো কখন?
–সে অনেক লম্বা কাহিনী। কিন্তু আমার বিয়ে হয়েছে, আহরার খানের সাথেই। উনি আমার স্বামী। আর আমাকে মানে উনার স্ত্রীকে তুলে আনার কি প্রয়োজন পড়েছে তোমাদের বাবা? এসব কি তুমি আয়মান ভাইয়ার কথাতে করছো?
এবার হক সাহেব খানিকটা শক্ত কন্ঠেই জবাব দেন,
–হ্যা। আয়মানের কথাতেই করেছি। এই ছেলের জন্যই আজ আয়মানের জীবনের এতো করুণ পরিণতি। সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব সে। এমন একটা ছেলের সাথে তোর বিয়ে কি করে হলো অরুমা?
–বাবা, তুমি ভুল বুঝছো। আয়মান ভাইয়ার জীবনের এই পরিণতি উনার জন্য হয়নি। এরমধ্যে অনেক বড় একটা চক্রান্ত আছে বাবা। তুমি উনাকে ভুল বুঝিও না। উনার মতো মানুষ হয়না। তুমি ভাবতেও পারবেনা তোমার মেয়ে কতটা সৌভাগ্যবতী হয়েছে ওই মানুষটাকে স্বামী হিসেবে পেয়ে।
অরুনিকার চোখের ভাষা হক সাহেবকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করছে সত্যিই আহরার ছেলেটা খারাপ নয়। হক সাহেব হালকা হেসে পুনরায় অরুর মাথায় হাত রেখে বলেন,
–তুই যদি সুখী হোস মা, আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। আমার দুটি মাত্র রাজকন্যা..
সঙ্গে সঙ্গে উৎফুল্ল স্বরে অরুনিকা আবারো বলে,
–বাবা, আদ্রিরও বিয়ে হয়েছে জানো। আমার দেবরের সাথে। যোগ্য জীবনসঙ্গী আদ্রিকাও পেয়েছে বাবা। আমার বনুটাও খুব সুখী হয়েছে।
হক সাহেবের চোখে এবার আনন্দাশ্রু দেখা দেয়। তিনি আজ ভিষণ খুশি। মেয়েকে দেখতে পেয়েছেন, মন ভরে আদর করেছেন। দুই মেয়েই তাদের জীবনটা গুছিয়ে নিয়েছে বেশ ভালোভাবে। হক সাহেবের যেন আর কোনো চিন্তা থাকলোনা। এবার মৃ ত্যু এলেও তার আর কোনো আফসোস থাকবেনা। মেয়েকে আরো একবার বুকে জড়িয়ে নেয়ার ইচ্ছে পোষণ করে হাত বাড়িয়ে দেন হক সাহেব। অরুনিকাও ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় বাবার বুকে। তবে তার আগেই বিকট শব্দে দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করলো আহরার। অরুনিকাকে দেখতেই শান্তির ঢেউ খেলে গেলো তার বুকে। পরক্ষণেই হক সাহেবকে সামনে দেখতেই আহরারের দমে যাওয়া রাগটা নতুন উদ্যমে ফিরে এলো। এই হক সাহেব তাকে ফাঁসিয়ে জেলে ঢুকিয়েছেন, তিনিই অরুকে কিডন্যাপ করেছেন। আয়মানের সাথে হাত মিলিয়ে হক সাহেব তার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তার পিঠে ছুরি মারলেন। প্রচন্ড রাগ আর আক্রোশে আহরারে মুখমণ্ডল শক্ত কঠোর আকার ধারণ করলো। তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে সে। তাই কোনো কিছু বিবেচনা না করেই সরাসরি হক সাহেবের দিকে রি ভ লবারটা তাক করে। আহরারকে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুঁটে উঠলেও রি ভ লবার তাক করতে দেখে মুহুর্তেই সেই হাসি মিলে গেলো অরুনিকার। হক সাহেব উঠে দাঁড়িয়েছেন। ঝট করে উঠে দাঁড়ায় অরুনিকাও। অঘটন ঘটার আগেই বাঁধা প্রদান করার উদ্দেশ্যে অরু খানিকটা চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
–দাঁড়ান, এই কাজ করবেন না প্লিজ। উনাকে কিছু করবেন না। উনি আমার বা..
কথাটুকু সম্পূর্ণ করতে পারলোনা অরুনিকা। তার আগেই ঘর কাঁপিয়ে গু লির আওয়াজ ভেসে আসলো। দেয়ালে দেয়ালে বারি খাওয়া সেই শব্দ কানে তালা লাগিয়ে দেয়ার মতো। অরুনিকা চিৎকার করে দুহাতে কান চেপে চোখ বুজে মাটিতে বসে পড়ে। কম্পনরত বুকটা যেন ফেঁটে যেতে চাইছে। অরুনিকা শ্বাস নিতে পারছেনা। কষ্ট হচ্ছে তার। গু লির আওয়াজ থেমে গেলেও চোখ খুলে তাকানোর সাহস হচ্ছে না কিছুতেই। না চাইতেও একটাসময় তাকাতে হয় তাকে। কারণ হুট করেই চারপাশ নীরব, নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। এতোটা নিস্তব্ধতা সহ্য করতে পারছেনা সে। মনে মনে চাইছে খারাপ কিছু যেন তাকে না দেখতে হয়। কিন্তু হায় আফসোস! ভাগ্য সহায় হলোনা। দৃষ্টি মেলতেই জীবনের সবচেয়ে কঠিন, বেদনাদায়ক দৃশ্য ভেসে উঠলো অরুনিকার চোখের সামনে। দুহাত দূরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তার বাবা জামিল হকের র ক্তা ক্ত লা শ।
চলবে…