#রূপবানের_শ্যামবতী
#২৮তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী
প্রচন্ড আক্রোশে অল্পবয়সী এক ছেলেকে সমানে এলোপাতাড়ি মেরে যাচ্ছে আয়মান। টকটকে লাল চোখ থেকে যেন আগুন ঝড়ছে তার। হিংস্রতা গ্রাস করে রেখেছে তাকে। ছেলেটার যখন ম রা ম রা অবস্থা বাধ্য হয়ে আসিফ জোরপূর্বক টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে আনলো আয়মানকে। বারবার চিৎকার করে বলতে থাকে,
–ছেড়ে দিন বস, ছেড়ে দিন। মরে যাবে ছেলেটা।
আয়মানও দ্বিগুণ স্বরে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
–ওকে মেরেই ফেলবো আমি। ওর এত্তো বড় সাহস…
–বস, একটু শান্ত হন। আপনি ভুল বুঝছেন..
আয়মান ছিটকে খানিকটা দূরে সরে যায়। জোরে জোরে শ্বাস নেয়। নিজেকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। ধপ করে পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ে। মাথা ঠান্ডা হচ্ছে না তার কিছুতেই। চোখ বুজে কপালে জোরে জোরে আঙুল ঘষতে থাকে সে। বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে অবশেষে নিজেকে ধাতস্থ করতে সক্ষম হলো। শীতল দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে আয়মান,
–আমি যখন যেই কাজ যতটুকু করতে বলি তার বাইরে অতিরিক্ত পন্ডিতি দেখানো কাজ আমার রক্ত গরম করে দেয়। মস্তিষ্ক টনটন করতে থাকে আমার। জানিস সেটা?
র ক্তা ক্ত আহত ছেলেটি বহুকষ্টে উচ্চারণ করে কয়েকটি শব্দ,
–বিশ্বাস করুন স্যার, আমি কিছুই করিনি। আমি কিচ্ছু জানিনা।
ঝট করে উঠে এসে আয়মান ছেলেটির মুখোমুখি হাঁটু গেড়ে বসে। একহাতে শক্ত করে ছেলেটির গাল চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
–আচ্ছা? কিচ্ছু করিসনি তুই? তবে কি তোর আত্মা গিয়ে করে এসেছে?
হুট করে আসিফ বলে ওঠে,
–বস, ও সত্যি বলছে। ও তো কিছুই করেনি।
ঘাড় ঘুরিয়ে আসিফের দিকে তাকায় আয়মান। শক্ত কন্ঠে বলে,
–মানে? কি বলতে চাস তুই?
আসিফ ঝটপট জবাব দেয়,
–বাইক নিয়ে আড়ালে দাঁড়িয়েছিলো ওরা। অপেক্ষা করছিলো আমার ইশারার। আহরারদের দেখা মাত্রই আমি যখনই ইশারা দিতে যাবো তার আগেই হুট করে কোথা থেকে অন্য এক বাইক এসে ওদের পাশ ঘেষে চলে গেলো। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম ওরা এটাক করে গিয়েছে। তখন আমিই নিজের মুখ লুকিয়ে সাধারণ পথচারী সেজে গেলাম ওদের কাছে আর ওদের হসপিটালে পৌঁছে দিয়ে আসলাম।
আয়মান উঠে দাঁড়ায়। ঘরজুড়ে পায়চারি করতে থাকে চিন্তিত ভঙ্গিতে। আনমনা হয়ে বলতে থাকে,
“আমি বলেছিলাম আহরারের সামনে অরুনিকাকে এটাক করার ভান করতে। যেন ব্যাপারটা এমন এটাক করতে গিয়েও করতে পারেনি। বেঁচে গিয়েছে। শুধুমাত্র আহরারের মনে ভয় সৃষ্টি করার জন্য। কিন্তু মাঝখান থেকে কে এলো? আমার লোকেদের টপকে গিয়ে এমন একটা কাজ করলো। তার মানে সে আমার পরিকল্পনা সম্পর্কে আগে থেকেই জানে। কে সে? আর তাকে আমার খবরাখবর দিচ্ছেই বা কে?”
আসিফের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় আয়মান। তা বুঝতে পেরে আসিফ দৃঢ় স্বরে বলে,
–বস, আমি অন্তত কখনো আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবো না।
আয়মান মনে মনে হিসাব কষতে থাকে। তার পরিকল্পনা সম্পর্কে কেবল ৫ জন জানে। আসিফ, হক সাহেব, এই দুটো ছেলে যাদের কাজ করতে পাঠিয়েছিলো আর একজন তামিম। এরা সকলেই তার বিশ্বস্ত। এদের কেউ তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে তা ভাবতেই পারছে না সে। ঠান্ডা মাথায় নিজের ভাবনার প্রসার ঘটায় আয়মান। বিচক্ষণতার সাথেই তাকে সবটা বের করতে হবে।
~~~
আহরারের ঘরে শোরগোল চলছে। অবশ্য কেবল একজনেরই কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। বাকি সকলেই নিশ্চুপ। আহরার বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে। তার পাশেই বসে বসে গুলবাহার রীতিমতো বিলাপ জুড়েছেন,
–আমার আদরের নাতিটা, আমার আহরার দাদুভাই। কার এতো বড় দুঃসাহস আমার নাতির ওপর হামলা করে। তার জানে কি কোনো ভয় ডর নাই। আর এমন এক বউ হয়েছে তার যে কোনো খেয়ালই রাখতে পারেনা। কি করছিলো কি ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? চেহারা দেখাচ্ছিলো। যে-ই না চেহারা..
–আহহা আম্মাজান, আপনি শুধু শুধু অরুমাকে দোষ দিচ্ছেন। মেয়েটা এর মধ্যে কি-ই বা করতে পারতো তাও অস্ত্রধারী মানুষদের সাথে।
আফতাব সাহেবের কথা শুনে গুলবাহার আরো তেঁতে উঠে বলেন,
–একদম এই মেয়ের হয়ে কথা বলবি না তুই আফতাব। এই মেয়ে আমার দাদুভাই এর বউ হওয়ার কোনো যোগ্যতাই রাখেনা। একটা অপয়া মেয়ে। ওর সাথে ছিলো বলেই আমার আহরার দাদুভাই এর ওপর এতো বড় একটা বিপদ এলো।
ঘরের এককোণে গুটিশুটি হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে অরুনিকা। অপমানে, লজ্জায় তার ইচ্ছে হচ্ছে মাটির নিচে ঢুকে যেতে। গুলবাহারের কথাতে সকলেই চরম বিরক্ত। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছেন না। তবে আহরার চুপ রইলো না। খানিকটা উঁচু স্বরে জবাব দিলো সে,
–দাদীজান, আক্রমণ টা আমার ওপর নয় অরুর ওপর হয়েছিলো। আমি ওকে সরিয়ে দিয়েছিলাম তাই সেটা আমার গায়ে লেগেছে। আজ যদি আমি অরুকে ঠিক সময়ে সরিয়ে না দিতাম তবে ছুরিটা ওর গায়ে লাগতো, ও আহত হতো। তখন আপনি কি বলতেন? তাহলে তো তখন আমার দোষ হতো। তাইনা?
–ছিহহ! দাদুভাই। এভাবে বলছো কেন? তোমার দোষ হতে যাবে কেন?
–তাহলে অরুর দোষ হয় কিভাবে? বরং এখনো দোষটা আমারই হবে। কারণ স্ত্রীরা স্বামীর দায়িত্বে থাকে স্বামীরা নয়। সেদিক থেকে ভাবতে গেলে আমিই দায়ী। আমার ধারণা আক্রমণ টা অরুর ওপরই হচ্ছিলো। সম্ভবত কোনো ছিনতাইকারী। আমি শুধু ওকে সেফ করার একটা ছোট্ট চেষ্টা করেছি কেবল।
এরই মধ্যে ফারজানা কিছুটা তাড়া দেখিয়েই বলে ওঠেন,
–আপনার ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে আম্মাজান। চলুন, খেয়ে নিবেন।
গুলবাহার আরো কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু ফারজানার কথা শুনে থেমে যেতে বাধ্য হলেন। মূলত ফারজানার উদ্দেশ্য তো এটাই ছিলো। গুলবাহার উঠে দাঁড়ালেন। আহরারের মাথায় কয়েকবার হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। পিছুপিছু ফারজানাও গেলেন। বাকিরাও বেরিয়ে গেলো এক এক করে। এদিকে আফতাব সাহেব হালকা হেসে ছেলের উদ্দেশ্যে বলেন,
–তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যা বাবা।
বিনিময়ে আহরারও হালকা হাসি ছুঁড়ে দিলো। আফতাব সাহেব বেরিয়ে যেতেই তাসফিয়া এসে ছেলের কাছে বসেন। ছেলের এক হাত তুলে নিয়ে হাতের পিঠে চুমু খেলেন। ঘনকালো চুলের ভেতর আঙুল চালিয়ে বুকচেরা শ্বাস ফেলেন। তার চোখজোড়া চিকচিক করছে। আহরার তার এক হাত মায়ের গালে রাখতেই নিজেকে সামলে নেন তাসফিয়া। ঝুঁকে এসে ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বিশ্রাম নিতে বলে বেরিয়ে যান। যাওয়ার আগে অরুনিকার দিকে তাকিয়ে কোমলসুরে বলেন,
“খেয়াল রেখো।”
অরুনিকা মাথা নুইয়ে রেখেই ঘাড় নাড়ায়। তাসফিয়া চলে যেতেই ঘর ফাঁকা হলো।
অরু একবার আহরারের দিকে তাকালো। আহরার একহাত কপালে রেখে চোখ বুজে আধশোয়া হয়ে রয়েছে। পাশের বেডসাইড টেবিলে রাখা ফাঁকা দুধের গ্লাসটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো অরু। গ্লাসটা রেখে, রান্নাঘরের আধোয়া জিনিসপত্র ধুয়ে টুকটাক সবকাজ সেরে ঘরে এলো সে। এসেই দেখতে পেলো আহরার ঠিকঠাক হয়ে শুয়ে পড়েছে। অরু দরজা লাগিয়ে লাইট নিভিয়ে নীলরঙা ড্রিম লাইটটি জ্বালিয়ে দিলো। আহরারের পাশে এসে শুতে গিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা খোলা পিঠটা নজরে আসতেই ভেতরটা ভারি হয়ে গেলো তার। কিছুটা এগিয়ে এসে আলতো করে ব্যান্ডেজের ওপর হাত বুলিয়ে দিলো সে। ঠোঁট নামিয়ে চুমু খেলো। তৎক্ষনাৎ টপটপ করে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো আহরারের পিঠের ওপর। মাথা তুলতে গেলেই ঝট করে ঘুরে তাকায় আহরার। অরুনিকার হাত ধরে হেঁচকা টানতেই আহরারের বুকের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে অরু। এরজন্য ক্ষতটাই চিনচিন করে উঠলেও দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে নিলো আহরার। অরুনিকার উৎসুক চাহনি নজরে পড়লে মৃদুস্বরে বলে ওঠে,
–কি হয়েছে আমার শ্যামবতীটার? চোখে পানি..
বলতে বলতে অরুর চোখের ওপর আঙুল বোলালো সে। অরুর আটকে রাখা কান্নারা ছুটে বেরোতে চায়ছে এবার। সে আহরারের বুকে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে রইলো। অরুনিকার ঘন কালো চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আহরার। কিছু সময় অতিবাহিত হলে অরুনিকার কান্নামিশ্রিত স্বরে জবাব আসে,
–আজ যদি কিছু হয়ে যেতো আপনার? কি করতাম আমি? কি হতো আমার?
গলা বুজে আসছে অরু। কান্নার দমক আটকে রাখতে কষ্ট হচ্ছে তার। আহরার হাসলো। হাস্যরত কন্ঠেই বলে ওঠে,
–পাগলি, কিছু হয়নি তো আমার। একটু খালি কেটেছে। ছু রিটা তো চামড়ার ওপর দিয়েই গিয়েছে তাইনা?
–আর যদি ছু রিটা গভীরে যেতো? আমি ভিষণ ভয় পেয়েছি আজ জানেন। চোখের সামনে পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছিলো আমার। দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলাম বারবার। আপনার জন্য সৃষ্টি হওয়া ভয়, আপনাকে হারানোর ভয় এতো ভয়ানক হতে পারে আগে বুঝিনি। কখনো অনুভব করিনি।
–এতো ভালোবাসো আমায় অরু?
থুতনিতে ভর রেখে মাথা খানিকটা উঁচু করে আহরারের চোখের দিকে তাকায় অরুনিকা। আবেশিয় স্বরে বলে,
–কতোটা ভালোবাসি জানিনা। শুধু আপনি ছাড়া এখন আর কিছুই ভাবতে পারিনা খান সাহেব।
বলতে বলতে নিজের একহাত এগিয়ে আহরারের গাল ছুঁয়ে পুনরায় বলে ওঠে,
–আমাকে ছেড়ে যাবেন না প্লিজ। কক্ষনো, কোত্থাও যাবেন না। আপনি আমার সাথে যেভাবে জড়িয়েছেন ঠিক শরীরের একটা অঙ্গের মতো। মানব শরীরের কোনো একটি অঙ্গ না থাকলে সে যেমন অচল, অসহায় হয়ে পড়বে আপনি ছাড়া আমার পরিণতি ঠিক তেমনটাই হবে খান সাহেব।
অরুর কথা শেষ হতেই তার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নেয় আহরার। অসংখ্য চুমুতে ভরিয়ে দেয় পুরো হাত জুড়ে। শক্ত করে জড়িয়ে নেয় অরুকে। একহাতে আগলে রেখে অপর হাত কেশের ভাজে গলিয়ে জবাব দেয় আহরার,
–ছেড়ে যাওয়া? এই বাক্যটাই তো আমি ভাবতে পারিনা তোমার আমার ক্ষেত্রে। আমি তো নিজেই ভয়ে থাকি যদি তুমি আমায় ছেড়ে যাও। যদি কখনো ভুল বোঝো।
ধীরস্বরে অরু থেমে থেমে উচ্চারণ করে,
–এমন দিন যেন কখনো না আসে।
অরুর চুলে মুখ ডোবায় আহরার। মোহনীয় ঘ্রাণ পাগল করছে তাকে। অরুর মুখখানা তুলে সযত্নে কপালে ওষ্ঠের পরশ ঠেকায়। সেই পরশ কপাল হতে চক্ষু, গাল, নাক, থুতনি সহ সব জায়গায় ঘুরে এসে অধরে মিলিত হয়। নিমিষেই নিজের ক্ষত ভুলে শ্যামবতীর মাঝে ডুবে যেতে থাকে রূপবান। বিনাবাক্য ব্যয়ে নিজেকে এই সুখানুভবের সাগরে বিলিয়ে দেয় অরুনিকা।
~~~
সকাল ১১ টা।
হসপিটাল থেকে রিকশায় করে ফিরছে নাদিম আর ফারনাজ। আজ গাড়ি নিয়ে বেরোয়নি তারা। রিকশায় চলাচলটা এখন ঠিক নয় জেনেও নাদিম ইচ্ছে করেই গাড়ি না নিয়ে রিকশা নিয়েছে।
আজ হসপিটালে যাওয়ার বিশেষ কারণ – তাদের জীবনে দ্বিতীয় সুখবর এসেছে। এ নিয়ে ফারনাজ মনে মনে উৎফুল্ল থাকলেও বাইরে তা প্রকাশ করতে পারছে না। কারণটা নাদিম। কাল রাতে তাকে খবরটা জানানো মাত্রই সে গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। ঠিকমতো কথা অবধি বলেনি। আর আজ সকাল সকাল তাকে নিয়ে হসপিটালে ছুটেছে। সব পরীক্ষা নিরীক্ষার পর যখন জানা গেলো ঘটনা সত্যি ফারনাজ খুশিতে আত্মহারা হলেও নাদিমের গম্ভীরতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
তাদের প্রথম সন্তান নিধি জন্ম নেওয়ার পর নাদিম তাকে বেশ কঠোরভাবে জানিয়ে দিয়েছিলো দ্বিতীয় সন্তানের কথা যেন সে না ভাবে। নাদিম একটা সন্তান নিয়েই থাকতে চায়। দ্বিতীয় সন্তান নিয়ে সে ভাবতে চায়না। ফারনাজ ভেবেছিলো নাদিম মুখে এমনটা বলছে তবে সত্যি সত্যি যখন সুখবর পাবে তার মন বদলে যাবে। সে খুশি হয়ে যাবে। হাজার হোক বাবা তো। নিধির প্রতি তার ভালোবাসাটা দেখেই মূলত এমন কথা ভেবেছিলো সে। নাদিম নিধি বলতে অজ্ঞান। নিধির জন্য নিজের জীবনটাও দিয়ে দিতে পারে সে। যদিও নাদিমের বৈশিষ্ট্য জানা সত্বেও ফারনাজ এটাই বিশ্বাস করে যে বাবা হিসেবে সে আদর্শ। অথচ খবরটা শোনার পর থেকে নাদিমের ব্যবহার তো অন্যকিছু নির্দেশ করছে। তার মানে নাদিম খুশি হয়নি। সে যা চেয়েছিলো তা সত্যি। ফারনাজের ভেতরে ভীতির সৃষ্টি হতে থাকে। বারবার সে নাদিমকে লক্ষ্য করছে আর প্রত্যেকবার নাদিমের মুখভঙ্গিমা তার ভয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আচমকা রিকশা থেমে যাওয়ায় ভাবান্তর ঘটে ফারনাজ। বাড়ির সামনে না থেমে কিছুটা দূরে থেমেছে রিকশা। নাদিম নেমে পড়েছে। তাই ফারনাজ আর কিছু বললো না। সে ও নেমে পড়লো। রিকশা ভাড়া দেওয়ার সময় ঘটে গেলো বিপত্তি। লোকটা নাদিমদোর আর্থিক অবস্থা আন্দাজ করতে পারায় লোভে পড়ে সে অতিরিক্ত ভাড়া দাবী করে বসে। নাদিম বেশ ঠান্ডা ভাবেই ভাড়া যত ততই লোকটার হাতো দিয়ে চলে যাওয়ার ইশারা করে। কিন্তু লোকটা মানতে নারাজ। সে চেঁচিয়ে বাড়তি টাকাটা দেওয়ার কথা বলতে থাকে। নাদিম তখনও শান্ত। এদিকে নাদিমকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে চেনা ফারনাজ ভয়ে কাঁপত শুরু করেছে। আসন্ন তান্ডবলীলার আঁচ করতে পেরেছে সে। তবে কি হবে সেটাই ভেবে উঠতে পারছে না সে। লোকটা সমানে খ্যাঁচখ্যাঁচ করে যাচ্ছে। নাদিম তখন বলে ওঠে,
–আপনাদের লোকাল ভাড়া যত আমি ততই দিয়েছি। আপনার প্রাপ্য আপনি পেয়েছেন। এবার যেতে পারেন।
–কি কন মিয়া? আফনে গাড়ি ছড়া মানুষ, রিকশা ভাড়া জানবেন ক্যামনে? সবকিছুর দাম বাইড়া গেছে। ভাড়াও বাইরা গেছে। বেশি প্যাচাল না পাইরা আরো ১০০ টাকা বাইর করেন। এমনেও আপনের পিছে নষ্ট করার মতো টাইম নাই।
নাদিম শীতল দৃষ্টিতে লোকটাকে দেখলো। তারপর পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে তা থেকে ১০০ টাকা নিয়ে লোকটাকে দিতেই লোকটা খুশি মনে নিজের রিকশা টেনে চলে যেতে লাগলো। তবে বেশি দূর যেতে পারলো না। ঝড়ের বেগে সামনে এসে দাঁড়ালো নাদিম। লোকটা কোনোরকমে রিকশা থামালো। তবে নিজে পড়ে গেলো। গা হাত ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায় লোকটা। অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে নাদিমের দিকে তেড়ে গেলে আচমকা চোখের পলকে লোকটাকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিলো নাদিম। হিংস্র গতিতে এগিয়ে পেছনে থাকা হাতটা উঁচু করে ধরলো সে। হাতে একটা বড় ইটের টুকরো। মাটিতে বসে সেকেন্ডের ব্যবধানে সেই ইটটা দিয়ে লোকটার মাথায় জোরে জোরে আঘাত করতে লাগলো। পরপর কয়েকটা বারি পড়তেই লোকটার মাথা দিয়ে গলগল করে র ক্ত ছুটে ভেসে যেতে থাকে। ছটফট করতে করতে কিছু সময় পরই নিস্তেজ হয়ে যায় লোকটার শরীর। নাদিম উঠে দাঁড়ায়। হাতের ইটটা দূরে ছুড়ে ফেলে সামনে তাকাতেই খানিকটা দূরে দাঁড়ানো ফারনাজকে চোখে পড়ে তার। পুরোটা দৃশ্য সচক্ষে দেখা ফারনাজ বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে থরথর করে কাঁপছে। ভয়ের চোটে তার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। নাদিম দ্রুতগতিতে তার দিকে এগোলে ফারনাজ জানপ্রাণ লাগিয়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা। নাদিম একেবারে কাছাকাছি আসতেই চারিদিকে আঁধার নামে তার। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে।
জ্ঞান ফিরতেই ফারনাজ নিজেকে তার ঘরে দেখতে পায়। ধীরে ধীরে সবটা মনে পড়তেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে সে। বিছানার মুখোমুখি রাখা কিং সাইজ চেয়ারটাতে পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকা নাদিমকে দেখতে পেলো সে। কফি খেতে খেতে ম্যাগাজিন বই পড়ছে নাদিম। ফারনাজকে উঠে বসতে দেখেই সুন্দর করে হাসলো সে। মিষ্টি সুরে বলে ওঠে,
–আরে উঠে পড়েছো। জ্ঞান ভালোভাবে ফিরেছে তো? কফি খাবে?
নাদিমের স্বাভাবিকতা ফারনাজের আত্মায় কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। একটু আগে সে যেই কাজটা করে এসেছে তার বিন্দুমাত্র কোনো ছাপ তার চোখে মুখে দেখা যায় না। ফারনাজ মনে মনে ঠিক করে নেয় সে এখানে আর থাকবেনা। বাবার বাড়িতে চলে যাবে। নাদিমের সাইকো আচরণ বহু দেখেছে সে। তবে খু ন! নাহ। এই মানুষটা এতো সহজে খু ন করতে পারে? খু ন করেও যে এতোটা স্বাভাবিক থাকতে পারে তা ভাবতেই পারেনি ফারনাজ। চোখের সামনে এমন ঘটনা দেখার পর এই মানুষটার সাথে আর কিছুতেই থাকা যায় না। কিন্তু নাদিমের উপস্থিতিতে সে পালাতে পারবেনা। নাদিম অফিসের জন্য বেরোলে সেই সুযোগেই সে বেরিয়ে পড়বে। ফারনাজের ভাবনার মাঝেই নাদিম বলে উঠলো,
–জ্ঞান যখন ফিরেছে এখন নিশ্চয়ই ঠিক আছো। আমি তবে অফিস গেলাম। ওকে?
ফারনাজ অতি উত্তেজনায় জোরে জোরে মাথা নাড়াতে থাকে। তা দেখে নাদিম মৃদু হেসে বেরিয়ে পড়লো। নাদিমের চলে যাওয়া নিশ্চিত হতেই ফারনাজ আর এক মুহুর্ত দেরি না করে নিজের ব্যাগপত্র গোছাতে ছুটলো। আজ বাড়িতে কেউ নেই। এমন ফাঁকা বাড়িতে এরকম একটা খু নির সাথে সে কিছুতেই থাকতে পারবেনা। যাওয়ার পথে নিধিকে স্কুল থেকে নিয়ে নিবে। কিন্তু সে অবাক হচ্ছে একটা জিনিস ভেবে, সে নিজ চোখে নাদিমকে খু ন করতে দেখা সত্ত্বেও নাদিম তাকে কিছু না বলে একা ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো কেন?
–জান.. তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাচ্ছো জান?
পিলে চমকে ওঠে ফারনাজের। জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলে ছিটকে পেছনে সরে যায় সে। নাদিমের করুণ কন্ঠস্বর, চেহারাটাও করুণ করে রেখেছে অথচ ফারনাজের ভয়ে জান বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা। নাদিম ফিরে এসেছে। কেন?
দরজা ছেড়ে ধীরপায়ে ঘরে ঢুকলো নাদিম। ফারনাজের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
–তুমি আমাকে এভাবে ছেড়ে চলে যেতে পারবে জান?
নাদিম যত এগোচ্ছে ফারনাজের শ্বাস আটকে আসছে। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না তার। কেবল মনে হচ্ছে দম আটকে বুঝি ম রেই যাবে এখন। নাদিম একদম মুখের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। হাত তুলে ফারনাজের মুখের ওপরে পড়ে থাকা চুল কানে গুঁজে দিয়ে বলে,
–কি হলো জান উত্তর দিচ্ছো না কেন?
–আ..আ..আমি আপাতত বাবার বাসায় থাকি?
–কেন?
–না..মানে.. প্রেগন্যান্সিতে তো বেশিরভাগ মেয়েরাই বাবার বাড়ি থাকে। নিধির সময়েও তো আমি ওখানেই ছিলাম তাই না? এবারেও…
নাদিম ঝুঁকে এসে ফারনাজের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
–যে থাকবেই না তাকে পৃথিবীতে আনার কিসের এতো তোড়জোড় জাআআননন?
হৃদপিণ্ড ধরাস করে লাফিয়ে উঠলো ফারনাজের। ভয়ে পেট মুচড়িয়ে উঠছে বারবার। কি বলছে এসব নাদিম? নাদিমের মুখের দিকে তাকাতে গেলেই আচমকা নাদিম এক অবিশ্বাস্য কাজ করে ফেলে। ফারনাজের ঘাড় চেপে ধরে তাকে টেনে এনে জোরে ছুঁড়ে মারে খাটের কোণার দিকে। নিশানা ভালো তার। খাটের কর্ণারের ওপর গিয়ে পড়ে ফারনাজ। ঠিক তলপেট বরাবর লেগেছে আঘাতটা। ব্যথায়, যন্ত্রণায় গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ওঠে সে। চোখ মুখ ভয়াবহ লাল হয়ে গিয়েছে তার। পেট চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়ে। অনবরত অশ্রু গড়াতে থাকে। দাঁতে দাঁত চেপে উবু হয়ে ব্যথা সহ্য করার প্রয়াস চালাতে গিয়ে দেখতে পায় সারা ফ্লোর র ক্তে ভেসে যাচ্ছে। এবার ভয়ের চেয়ে কষ্টের তীব্রতা গ্রাস করে তাকে। সন্তান হারনোর ভয়। চিৎকার করে উঠলো আবারো। এই চিৎকার সন্তানহারা মায়ের করুণ আর্তনাদ। এবার নাদিম এগিয়ে এসে কোলে তুলে নেয় তাকে। ঘৃণায় ফারনাজ নেমে যাওয়ার চেষ্টা করে তবে শক্তিতে কুলোয় না। শরীরটা কেমন অসাড় হয়ে আসছে তার। মনে হচ্ছে আবারো জ্ঞান হারাবে সে। চোখ দুটো ঝাপসা হওয়ার আগে শুনতে পায় নাদিমের বিদ্রুপের স্বরে বলা বাক্য,
“এবার নিশ্চয়ই বিদায় নিয়েছে ওইটা..”
চলবে….
#রূপবানের_শ্যামবতী
#২৯তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী
ফারনাজকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। বাড়ির বাকি লোকদের খবর দেওয়ার কথা বলেছে ডক্টর। নাদিম তাই নিজের বাড়ির লোকদের সাথে সাথে ফারনাজের বাড়ির লোকদেরও খবর জানিয়ে দিয়েছে। একজন আদর্শ স্বামীর দায়িত্ব পালন করছে সে। যখন যা যা প্রয়োজন ছুটে ছুটে সব জোগাড় করে আনছে। অস্থিরতার সাথে পায়চারি করছে অপারেশন থিয়েটারের সামনে। যখনই কেউ বের হচ্ছে তাকেই চেপে ধরে জানতে চাচ্ছে নিজের স্ত্রীর অবস্থা সম্পর্কে। এক অদ্ভুত পাগলামি দেখা যাচ্ছে নাদিমের মাঝে। যেন স্ত্রীর চিন্তায় চিন্তায় তার শ্বাস ফেলারও জো নেই। সত্যিই কি তাই? নাকি সবটাই লোক দেখানো?
কিছু সময়ের মধ্যেই তার মা, বাবা, বোন আর ছোটো ভাই এসে হাজির। নাদিম সকলের সামনে নিজেকে শোকে পাগলপ্রায় হিসবে উপস্থাপন করে। অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে আপনমনে কিসব বিরবির করতে লাগলো। ধীরে ধীরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেলো। সকলে ভাবলো বেচারা খুব মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে গেছে। এখানে আর থাকতে পারছেনা তাই বাইরে গেলো। কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পেলো না তার দুরভিসন্ধি কত ভয়াবহ।
ফারনাজের খবরটা শোনার পর থেকেই ফারজানা হাওমাও করে কেঁদেই যাচ্ছেন। খান বাড়ির পরিস্থিতি থমথমে হয়ে গিয়েছে। গতকাল আহরারের ওমন দূর্ঘটনা আজ ফারনাজের এমন খবর। সকলকে স্তব্ধ করে রেখেছে। ফারনাজ, খান বাড়ির বড় মেয়ে। বড় আদরের মেয়ে। কত আদর, যত্ন, স্নেহ, মমতায় আগলে মেয়েটাকে মানুষ করা হয়েছে। মেয়েটা বড্ড ভালো মনের মেয়ে তাদের। কখনো কারো সাথে কোনোপ্রকার উচ্চবাচ্য তো দূর, কারো সাথে চোখ তুলেও কথা বলেনা। নম্রতা তার অন্যতম গুণাবলি। এই মেয়েটার সাথে এতোবড় দূর্ঘটনা কেউ সহজে মানতে পারছেন না। আফজাল সাহেবের মতো শক্ত মানুষও মেয়ের এমন অবস্থা শুনে ভেঙে পড়েছেন।
সকলেই হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে গুলবাহার যেতে পারবেন না। তাই অরুনিকা থেকে গেলো তার সাথে। আহরারকেও যেতে মানা করেছে সকলে। যেহেতু তার শরীরটাও ঠিক নেই। কিন্তু আহরার সে কথা শুনতে নারাজ। বোনের এমন খবর তাকে কিছুতেই বাড়িতে বসে স্থির থাকতে দিবেনা। বাধ্য হয়ে আর কেউ বারণ করতে পারলোনা। সকলেই বেরিয়ে গেলো। আহরার সবার শেষে বেরোলো। বেরোনোর আগে অরুনিকাকে বলে গেলো,
–সাবধানে থেকো অরু। নিজের আর দাদীজানের খেয়াল রেখো। আমি না ফিরলেও বাকিরা ফিরে আসবে। তাই মন খারাপ করো না বা ভয় পেও না। আজ আমেনাও নেই। তোমাকে এভাবে একা রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছে না।
আহরারের কথা শুনে অরুনিকা হাসলো।
–এতো চিন্তা করবেন না। আপনি যান। আর আপুর খবরাখবর আমাকে ফোন করে জানাতে থাকবেন কিন্তু।
আহরার হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার সময় দরজার কাছে গিয়ে কি মনে করে যেন দাঁড়িয়ে পড়লো। ঘাড় ঘুরিয়ে অরুনিকার দিকে চাইলো। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আজ তার। কিছু একটা মিল পাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। কিন্তু কি সেই ঘটনা? কি মিল পাচ্ছে? বুঝতে পারছেনা। হুট করে মনটা কেন যেন সায় দিচ্ছে না তার অরুনিকাকে রেখে যেতে। ওদিকে গাড়ির হর্ণ কানে বাজতেই আহরার নিজের চিন্তা ছাড়লো। হাত নেড়ে অরুকে বিদায় দিয়ে দ্রুত গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো। যতক্ষণ পর্যন্ত গাড়িটা দেখা গেলো অরুনিকা চেয়ে থাকলো। গাড়ি দৃষ্টির আড়াল হতেই দরজা আটকে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো সে। গুলবাহারের দুপুরের খাবারটা রেডি করার উদ্দেশ্যে।
গুলবাহারের জার্নি করে যাওয়াটা শরীরে সয় না আজকাল। সামান্য জার্নির ধকলও তিনি নিতে পারেন না। তাই নাতনিকে দেখতে যাওয়ার এতো ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যেতে পারেননি। বিছানায় আাধাশোয়া হয়ে দোয়া দরূদ পড়ছেন তিনি। আর মনে মনে কেবল আল্লাহকে বলছেন, যেন তার নাতনিটার কিছু না হয়। মেয়েটা সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে যেন বাড়ি ফিরতে পারে।
আচমকা ফোনের ক্যাটক্যাটে রিংটোনটা বেজে ওঠায় তার দোয়ায় ব্যাঘাত ঘটে। স্ক্রিনে তাকিয়ে কলকারীর নামটা পড়া মাত্রই হুড়মুড় করে ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করেন,
–হ্যা..হ্যালো.. হ্যালো.. আমার ফারনাজ দাদুমনি ঠিক আছে তো?
কিছু সময় নীরব থেকে অপর পাশ হতে আসা উত্তর শুনলেন তিনি। মুহুর্তেই তার মুখবিবরে দুঃশ্চিন্তার ছাপ সরে গিয়ে বিস্ময়ের রেখা দেখা দিলো। অবাকসুরে বললেন,
–কি বলছো? আজই? ফারনাজের এমন অবস্থা.. তুমি এসব চিন্তা করছো?
–ফারনাজের কিচ্ছু হবেনা। ও ঠিক হয়ে যাবে। তবে অরুনিকাকে সরানোর জন্য আজকের মতো সুযোগ আর হবে কিনা তাই ভাবুন দাদীজান। ভালো করে ভাবুন। ভেবে আমাকে জানান। আপনি যা বলবেন তাই হবে।
লাইনটা কেটে গেলো। গুলবাহার কান থেকে ফোনটা নামিয়ে রাখেন। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ভাবতে থাকেন, কি করবেন।
ঠকঠক করে দরজায় আওয়াজ হতেই চমকে ওঠেন তিনি। দরজার ওপাশ হতে অরুনিকা মিহিসুরে বলে ওঠে,
–দাদীজান।
বিরক্তিতে ভ্রুঁ কুঁচকে আসে গুলবাহারের। মুখ দিয়ে “চ” জাতীয় শব্দ করেন। খরখরে আওয়াজে জবাব দেন,
–ভেতরে এসো।
দরজাটা হালকা ঠেলে মাথাটা সামান্য গলিয়ে দাঁড়ায় অরুনিকা। পুরোপুরি ভেতরে প্রবেশ করেনা সে। মৃদু হেসে বলে,
–আপনার খাবারটা কি এখানেই নিয়ে আসবো দাদীজান? নাকি ডাইনিং এ দিবো?
চোখেমুখে বিরক্তি ভাব বজায় রেখেই উত্তর করেন গুলবাহার,
–অদ্ভুত মেয়ে তো তুমি। বাড়িতে কেউ নেই, শুধু শুধু ডাইনিং এ গিয়ে কেন খাবো? এখানে নিয়ে এসো।
শেষ কথাটুকু খানিকটা ধমকের সুরেই বলেন তিনি। অরুনিকার খারাপ লাগেনা। সে নিজেকে অভ্যস্ত করে নিয়েছে গুলবাহারের এমন ব্যাবহারে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত খাবারটা নিয়ে আসতে গেলো। এদিকে গুলবাহার নিজের ভাবনার ফলাফল নিশ্চিত করেছেন। ফোনটা হাতে নিয়ে একটু আগে আসা কলনাম্বারে পুনরায় কল লাগান। রিসিভ হতেই বলে ওঠেন,
–ঠিকআছে। কাজটা তাহলে আজই করো। সত্যিই এমন সুযোগ আর আসবে না।
ফোনের ওপারে, এপারে দুজনের ঠোঁটেই ফুটে ওঠে ক্রুর হাসি।
গুলবাহারের ঘরে খাবারটা রেখে অরুনিকা রান্নাঘরের বাকি কাজগুলো সারতে চলে গেলো। হঠাৎই লাগাতার কলিং বেলের আওয়াজে উদ্বিগ্ন অরু ছুটে গেলো দরজার কাছে। কেউ ফিরে এলো নাকি? সব ঠিক আছে তো? ভাবতে ভাবতে দরজা খুলতেই অবাক হলো সে। বাইরেটা ফাঁকা। কেউ নেই। তবে বেল বাজালো কে? অরু বেরিয়ে এসে চারিদিকে ভালোভাবে নজর বুলালো। নাহ! কেউ নেই। মেইন গেটের দিকে উঁকি দিয়ে দেখলো গেট লাগানো। তবে কে করলো এমন কাজ? আশ্চর্য! নাকি অরু ভুল শুনলো? আর কিছু না ভেবে ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো সে। রান্নাঘরে এসে পুনরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তেই ওপর থেকে ঝনঝন করে কিছু ভাঙার আওয়াজ ভেসে এলো। অরুনিকা ভাবলো দাদীজানের কোনো সমস্যা হলো না তো? তাড়াহুড়ো করে ছুট লাগালো গুলবাহারের ঘরের দিকে। দরজা খুলে উঁকি দিতেই দেখতে পেলো গুলবাহার গভীর ঘুমে মগ্ন। অরু ধীরপায়ে ভেতরে প্রবেশ করে খাবারের প্লেট, গ্লাসগুলো হাতে তুলে নিলো। রুম থেকে বেরিয়ে দরজাটা ভালোভাবে চাপিয়ে চলে গেলো। অরু চলে যেতেই ঝট করে চোখ মেলে তাকান গুলবাহার। ক্রুর হাসি হেসে কাত হয়ে শুয়ে আরামে চোখ বুজেন পুনরায়।
অরুনিকার ছটফট লাগছে। মনে হচ্ছে বাড়ির পরিবেশটা ঠিক নেই। অদ্ভুত কিছু টের পাচ্ছে সে। কিন্তু কি? সেটাই বুঝতে পারছেনা। কাজকর্ম শেষ করে নিজের ঘরের দিকে এগোতে এগোতে এসবই ভাবছিলো। আচমকা ধুপ করে হওয়া এক শব্দে চমকে ওঠে সে। মনে হলো কেউ যেন লাফিয়ে পড়লো তার খুব কাছেই। দ্রুত চারপাশ খুঁজে দেখলো। কিন্তু সন্দেহজনক কোনোকিছুই চোখে পড়লো না তার। একবার মনে হলো পুরো বাড়িটা খুঁজে দেখা উচিত। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। একে একে প্রতিটা ঘর, বারান্দা, ডাইনিং, ড্রয়িং সবজায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলো তবে এমন আজব আজব শব্দ হওয়ার কোনো উৎস খুঁজে পেলোনা সে।
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অরু। তার মাথায় খেলে গেলো এক অদ্ভুত ভাবনা যা তাকে স্থির করে দিয়েছে। শান্ত চোখজোড়া চারিদিকে ঘোরাতে ঘোরাতে ভাবতে লাগলো সে, তানিশার মৃত্যুর দিনও তো পরিস্থিতিটা ঠিক এমনই ছিলো। ফারনাজের ডেলিভারি ছিলো সেদিন। সকলে ওখানেই গিয়েছিলো। সেদিনও তো বাড়িতে শুধু তানিশা আর গুলবাহারই ছিলেন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তবে কি অরুনিকার পরিণতিও তানিশার মতোই হবে?
ধরাম করে বিকট এক শব্দে লাফিয়ে ওঠে অরু। কন্ঠস্বর গলে বের হয় চাপা চিৎকার। শব্দটা এসেছে ছাদ থেকে। মনে হলো প্রচন্ড জোরে দরজাটা লাগিয়ে দিলো কেউ। অরুনিকা ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিঁড়ির দিকে। মনে হচ্ছে এখনি কেউ নেমে আসবে ছাদ থেকে। নড়াচড়া ভুলে রোবটের মতো কাঠকাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অরুনিকা। ঘনঘন ঢোক গিলছে সে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে। যদি কেউ নেমে আসে, কি করবে সে? এই ভয়ে দম আটকে চেয়ে আছে সিঁড়ির দিকে। ৫ মিনিট, ১০ মিনিট, ১৫ মিনিট পেরিয়ে গেলেও কেউ নামলো না। অরুনিকা ঝট করে পাশের জানালা গলে বাইরে নজর ফেলে। হ্যা! বাতাসের তীব্রতা বোঝা যাচ্ছে বেশ। তার মানে জোরে হাওয়া এসে দরজা ভিড়িয়ে দিয়েছে তাই এমন শব্দ। হালকা স্বস্তির শ্বাস ফেলে মনকে শান্তনা দিলো অরু। পরক্ষণেই মনে হলো সমস্ত দরজা – জানালা ভালোভাবে আটকে রেখেছে সে কিন্তু ছাদের দরজা খোলা। দরজাটা আটকে দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে বসে থাকবে। যতক্ষণ না বাড়ির লোকেরা ফিরবে সে বেরোবে না কিছুতেই। কিন্তু দাদীজান? দাদীজান তো ঘরে একা। তাহলে বরং দাদীজানের ঘরেই বসে থাকবে সে। যতক্ষণ তিনি ঘুমোবেন অরু ঘরের এক কোণে বসে থাকবে, তার ঘুম ভাঙলেই না হয় বেরিয়ে যাবে। ভাবনা সমাপ্ত করে সিঁড়ি ভেঙে ছাদের দরজার দিকে এগিয়ে গেলো অরু। যতই দরজার দিকে এগোচ্ছে একটা ভয় ক্রমশ তাকে আঁকড়ে ধরছে চারদিক থেকে। ছাদে কেউ নেই তো? এই ভরদুপুরে কেমন গা ছমছমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে চারপাশে। নিরব, শান্ত, নেই কোনো কোলাহল, কোনো শব্দ। দিনের আলোতেও যেন ভুতুড়ে পরিবেশে পরিণত হয়েছে। হাতের উল্টো পিঠে কপাল ও ঠোঁটের চারপাশে জমা ঘামটুকু মুছে নেয় অরু। শুকনো ঢোক গিলে এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলো ছাদের দরজার দিকে। কাছাকাছি আসতেই তাড়াহুড়ো করে দরজাটা লাগিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে টেনে ধরলো দরজা। যখনই ভিড়াতে যাবে ওমনি তার নজর সামনের দিকে পড়তেই চিৎকার করে ছিটকে সরে গেলো সে। ঠিক সামনেই, মুখোমুখি রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে কেউ একজন। অদ্ভুত পোশাক তার। উল্টো ফিরে থাকায় মুখ দেখা যাচ্ছে না। অরুনিকা সাহস করে খানিকটা উঁচু স্বরে বলে ওঠে,
–কে আপনি? এখানে কি করছেন?
লোকটা ঘুরে দাঁড়ালো। ছ্যাঁত করে উঠলো অরুনিকার বুক। ভয়ংকর মুখোশ পরিহিত লোকটা ঠিক পোশাকের সাথে মিলিয়েই। দেখে মনে হচ্ছে মানুষরূপী এক দানব দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। লোকটার হাতে কি যেন চকচক করছে। ভালো করে খেয়াল করতেই অরু বুঝতে পারে ওটা একটা ছুরি। এক হাত লম্বা, ধারালো ছুরি হাতে লোকটা অরুনিকার দিকে এগোতে থাকে। অরুনিকা যেন জমে পাথর হয়ে গেছে। চোখ দুটো কোটর ছেড়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মুখ হা করে শ্বাস নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে সে। গলা শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। ঢোক গিলে গলা ভেজানোর চেষ্টা টুকুও সম্ভব হচ্ছে না। এই মুহূর্তে তার ছুটে পালানো উচিত। কিন্তু সে পারছেনা এক পা ও নড়তে। ভয়ের চোটে শরীর অবশ হয়ে আসছে তার। লোকটা খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। অরুনিকার অবচেতন মন তাকে বারবার তাগিদ দিচ্ছে, “পালা অরু, পালা।”
____
ফারনাজের অপারেশন ভালোভাবেই শেষ হয়েছে। সদ্য সৃষ্টি হওয়া আড়াই মাসের ভ্রুণটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অপারেশনের মাধ্যমে সেসব ক্লিন করা হয়েছে। কেবিনে শিফট করতেই সকলে গিয়ে দেখে আসছে তাকে। জ্ঞান নেই ফারনাজের। ফিরতে কিছুটা সময় লাগবে। সকলেই ব্যথিত মন নিয়ে দেখে যাচ্ছে ফারনাজকে। যে পরিমাণ র ক্তক্ষরণ হয়েছিলো তাতে ডক্টরদের ধারণা ছিলো বোধহয় তার লাইফ রিস্কে পড়ে যাবে। তবে সৃষ্টিকর্তার অসীম দয়ায় সকল বিপদ কাটিয়ে উঠেছে মেয়েটি।
মেয়ের মাথার কাছে বসে ফারজানা নিরবে চোখের জল ফেলছেন। তাসফিয়া কাঁধে হাত রেখে শান্তনা দিচ্ছেন তবুও তাকে শান্ত করা যাচ্ছে না। আহিয়া দূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আর মনে মনে তার ফারহাপুর কথা স্মরণ করছে। সে যে নেই এখানে।
আহরারের বিয়ের কিছুদিন পর একপ্রকার জেদাজেদি করেই আবারো অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে গেছে ফারহা। এদিকে আয়মান ভাইটাও নেই।
চার সন্তানের মধ্যে দুটো সন্তান কাছে আছে ফারজানার। তাদের মধ্যে একজনের এই হাল। সন্তানদের নিয়ে এতো যন্ত্রণা আর নিতে পারছেন না তিনি। আয়াজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে নিজের মাকে দেখছে আর এসবই ভাবছে। সকলেই থম মেরে আছে। কারো মনে শান্তি নেই।
আয়াজ! সে তো যন্ত্রণার বিশাল এক পাহাড় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একে তো পরিবারে আসা এই ঝড়, অপরদিকে বিরহ ব্যথা। কিসের বিরহ? তা কি কেউ জানে? দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়াজ। বুকে ব্যথা হচ্ছে তার। ভিষণ ব্যথা।
আফজাল সাহেব বাইরে বসে আছেন স্থির হয়ে। তার চোখেও অশ্রুরা ভিড় জমাচ্ছে বারবার। পাশে বসেই আফতাব বড় ভাইকে শান্তনা দিচ্ছেন, “সব ঠিক হয়ে যাবে, ভাইজান। ফারনাজ মা সুস্থ হয়ে যাবে।”
আহরার ফারনাজকে এক নজর দেখে বাইরে এসে দাঁড়ায়। তার মনটা ছটফট করছে খুব। অরুর জন্য। আসার সময় বারবার তার মন অরুকে ফেলে আসতে চাইছিলো না। কিছু একটার আঁচ করছিলো সে বারবার। এখন সেই ছটফটানি দ্বিগুণ বেড়ে গেছে তার। হসপিটালের করিডোর এমাথা থেকে ওমাথা চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়চারি করছে কেবল। একবার অরুকে ফোন করার কথা মাথায় আসতেই চট করে ফোন বের করে ডায়াল করে অরুর নাম্বারে। রিং হতে থাকে..
নিস্তব্ধ পরিবেশে বিকট শব্দে ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই ঘোর কাটে অরুর। ফোন বাজছে। নিশ্চয়ই আহরার ফোন করেছে। আহরারের কথা ভাবতেই নিমিষেই নিজের হারানো শক্তি ফিরে পায় অরু। ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে নেমে যায় সে। ফোনের কাছে গিয়ে রিসিভ করতেই আহরারকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে থাকে অরু,
–খান সাহেব, আমাকে বাঁচান। একটা লোক.. একটা ভয়ংকর লোক.. ছুরি নিয়ে..
আর কিছু বলতে পারলো না অরু। লোকটাকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে দেখে ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায়।
ওদিকে আহরার “হ্যালো, হ্যালো” করতে থাকে। অরুর আর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আর এক মুহুর্ত দেরি করলো না সে। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যেই তার মাথা খুলে গেলো। মনে পড়ে গেলো আজ থেকে ৫ বছর আগের কথা। তানিশার মৃ ত্যুর দিন সবকিছু ঠিক এমনই ছিলো। সে-ই একই ঘটনা। কিন্তু তানিশার মতো অরুনিকার কোনো ক্ষতি সে হতে দিবেনা। কিছুতেই না। হাই স্পিডে গাড়ি ঝড়ের বেগে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আহরার।
অরুনিকা কি করবে না করবে দিশেহারা হয়ে চারিদিকে তাকাতেই সামনেই তার শ্বাশুড়ির ঘর চোখে পড়ে। ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ে ঘরটায়। দরজা আটকে হাঁপাতে থাকে।জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখা শ্বাস। গলা ফেটে যাচ্ছে তৃষ্ণায়। পানি, একটু পানি খাওয়া প্রয়োজন। ঘরে রাখা জগটা হাতে নিতেই দেখে খালি। পানি নেই। অরুর কান্না পাচ্ছে ভিষণ। কি করবে সে? কিভাবে বাঁচাবে নিজেকে? এই লোকটাই বা কে? কেন তাকে মারতে চায়ছে? আচ্ছা, তানিশার মৃত্যুর পিছনে এই লোকটার হাত নেই তো?
হুট করে গুলবাহারের কথা মনে পড়তেই ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেলো তার। দাদীজান! দাদীজান একা ঘরে। যদি লোকটা তার কোনো ক্ষতি করে দেয়। অরু আর নিজের কথা ভাবতে পারলোনা। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। গুলবাহারের ঘরের দিকে যাওয়ার আগেই দেখতে পেলো লোকটা বসে আছে সিঙ্গেল সোফাটায়। পায়ের ওপর পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে অরুনিকার দিকেই তাকিয়ে আছে। লোকটাকে টপকে তাকে গুলবাহারের ঘরের দিকে যেতে হবে। লোকটার হাতে অস্ত্র। এভাবে ফাঁকা হাতে অরু কিভাবে লোকটার সাথে পেরে উঠবে? অরু অত্যন্ত সাহসিকতার সাথেই লোকটাকে টপকে এগিয়ে যেতেই লোকটা উঠে দাঁড়ালো। সাথে সাথে অরু আরো একটি দুঃসাহসিক কাজ করে ফেললো। তার হাতে থাকা জগটি দিয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে লোকটার মাথায় বারি দিয়ে বসলো। লোকটা মাথায় হাত দিয়ে আর্তনাদ করে পিছিয়ে গেলো। সেই সুযোগে অরু ছুট লাগায়। তবে লোকটার দম আছে অনেক। ওমন অবস্থায়ও সে অরুর পিছু নিলো এবং ধরেও ফেললো। অরু লোকটার পা বরাবর লাথি দিতেই লোকটা মাটিতে পড়ে যায়। অরু পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পারেনা। লোকটা অরুর এক পা টেনে ধরে তাকেও মাটিতে ফেলে দেয়। মুখ থুবড়ে পড়ে অরু। বুকে প্রচন্ড ব্যথা পায় সে। লোকটা উঠে এসে অরুকে সোজা করে গাল চেপে ধরে তার। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে থাকে অরু। কেমন ফ্যাসফ্যাসে গলায় লোকটা রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে,
–কোথায় পালাচ্ছিস? তোর পালানোর কোনো পথ নেই আজ। আজই তোর শেষ দিন। মরার জন্য প্রস্তুত হ।
অরু লোকটাকে কিল,ঘুষি, থাপ্পড় যা পারছে যেভাবে পারছে মারছে। তবে তাতে লোকটার কিছুই হচ্ছে না। লোকটা একহাতেই অরুর দুইহাত মুঠোবন্দি করে শক্ত করে চেপে ধরে থাকে। নিজের পা দ্বারা অরুর পা দুটো চেপে রেখেছে। অরুর নড়াচড়া আটকে দিয়ে অপর হাতে তুলে ধরে সেই চকচকে ধারালো ছুরি। অরু বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে দেখে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসছে তার। চিৎকার করার কথাও ভুলে গেছে সে। কেবল মনে হতে থাকে, সত্যিই বোধহয় আজই তার শেষ দিন।
লোকটা ছুরিটা ওপরে তুলতেই চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় অরু। শরীরে ধারালো ছুরির আঘাতে হওয়া বিষাক্ত যন্ত্রণার অপেক্ষা করতে লাগলো…
চলবে…