#রূপবানের_শ্যামবতী
#২৬তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী
বাইরে থেকে আসা শব্দ কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই সতর্ক হয়ে যায় আয়মান।
–হক সাহেব, আপনি গিয়ে দেখে আসুন কিসের শব্দ হলো। আমি আপাতত আড়ালে রইলাম। পরিস্থিতি বুঝেই বেরোবো।
হক সাহেব বলে সম্বোধন করা ব্যক্তি যাকে অরুনিকা নিজের বাবা ভেবেছিলো তিনি আয়মানের কথায় সম্মতি জানিয়ে দ্রুত পায়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। আশেপাশে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাউকে পেলেন না। তাই তিনি ভেতরে গেলেন আয়মানকে ডাকতে। এদিকে পাশেই থাকা গাছপালার ঝোপের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল অরুনিকা। মুখে হাত চেপে শ্বাস আটকে রেখেছিলো এতোক্ষণ। লোকটা চলে যেতেই আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো সে। যেভাবেই হোক তাকে এখন এখান থেকে পালাতে হবে। কিন্তু সামনে দিয়ে পালানো যাবেনা। পেছনে দিক দিয়েই পালাতে হবে। বাড়িটার পেছন দিকে আসতেই হতাশ হতে হলো অরুকে। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা চারপাশ। কিভাবে বেরোবে সে? হুট করে দেওয়ালের সাথে লেগে থাকা বিশাল এক গাছের দিকে নজর আসে তার। খুশি হয়ে যায় সে। এই গাছ বেয়ে উঠলেই দেয়ালটা টপকাতে পারবে। গ্রামের মেয়ে হওয়ার দরুন গাছে ওঠা তার কাছে কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। নিজেকে ভালোভাবে প্রস্তুত করে আর এক মুহুর্ত দেরি করলো না অরু। তরতর করে গাছ বেয়ে উঠতে লাগলো। কিন্তু ওপরে উঠতেই বাঁধলো বিপত্তি। যখনই দেয়ালের ওপর পা রাখতে যাবে তখনই সে আটকে গেলো। পিছু ফিরে দেখে একটা ডালের সাথে তার ওড়নাটা বাজেভাবে ফেঁসে গেছে। যত চেষ্টা করছে খুলতে তত বেশি যেন আটকে যাচ্ছে। পায়ের শব্দ শুনতেই পিলে চমকে ওঠে অরুনিকার। নিশ্চয়ই এবার দুজনেই বেরিয়েছে। যেকোনো মুহুর্তে এদিকটায় চলে আসতে পারে। অরুনিকা প্রাণপণ চেষ্টা করছে ওড়ানাটা ছুটিয়ে আনার। সফল হচ্ছে না কিছুতেই। পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। তার মানে ওরা চলে এসেছে। আর কোনো কিছু না ভেবেই ওড়নাটা হেঁচকা টান দিতেই চলে এলো সেটা। তবে কিছু অংশ ছিঁড়ে আটকে রইলো সেই ডালটার মাথায়। অরুনিকা এক লাফে দেয়ালটার ওপর উঠে গেলো। সেখানে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে পড়লো সে। পায়ে ব্যথা পেলেও সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে ছুটতে থাকলো কেবল।
আয়মান আর হক সাহেব ওদিকটায় এসে খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু কারো কোনো অস্তিত্ব না পেয়ে হক সাহেব বলে ওঠেন,
–আমরা বোধহয় ভুল ভাবছি কোনো বিড়াল টিড়াল ছিলো বোধহয়।
আয়মান কোনো জবাব দেয়না। এখনো সে জহুরি নজর চালিয়ে তল্লাশি করছে। তবে কিছুই ধরতে পারলোনা সে। হক সাহেবের কথাই ঠিক ভেবে ফিরে আসতে যাবে তখনই তার চোখ যায় দেয়ালের সাথে লেগে থাকা গাছটির দিকে। সেদিকে এগিয়ে এসে এক হাত গাছে রেখে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলো। ঝট করে ওপরের দিকে তাকাতেই ঠোঁটের কোণে দেখা দেয় বক্র হাসি। সরে এসে দাঁড়ায় সে। হক সাহেব প্রশ্ন করলেন,
–কি হয়েছে?
কন্ঠে বিদ্রুপ মিশিয়ে জবাব দিলো আয়মান,
–কাঁচা খেলোয়াড়। হাহ!
হক সাহেব বুঝতে না পেরে পুনরায় প্রশ্ন করেন,
–মানে?
–মানেটা হলো যা বোঝার আমি বুঝে গিয়েছি। সময় হয়ে গিয়েছে পরবর্তী চাল চালার।
বলতে বলতে পকেট হাতড়ে নিজের ফোনটা বের করে আয়মান। আসিফের নাম্বারে ডায়াল করে। রিসিভ হতেই আসিফকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শক্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
–পরবর্তী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সময় এসে গেছে। প্রস্তুত হ।
নিজের কথাটুকু শেষ করেই ফোন কেটে দেয় সে। নজর তার তখনও সেই গাছের ডালে আটকে থাকা অরুনিকার ওড়নার অংশবিশেষের দিকে।
ছুটতে ছুটতে নিজের কোচিং সেন্টারের গেটের কাছে এসে দাঁড়ায় অরুনিকা। হাঁটুতে দুহাত রেখে ঝুঁকে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে সে। কিছুটা ধাতস্থ হতেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আশেপাশে চোখ বুলায়। নাহ। আহরার এখনো আসেনি। সাথে সাথে গেট দিয়ে স্টুডেন্টদের বের হতে দেখে বুঝতে পারে কোচিং শেষ। তখনই আহরারের গাড়িটা আসতে দেখে তাড়াহুড়ো করে স্টুডেন্টদের সাথে মিশে গেলো অরু। যেন মনে হয় সেও কোচিং শেষ করে বেরোচ্ছে। গেটের কাছে গাড়ি থামিয়ে নেমে আসে আহরার। অরুনিকাকে বেরোতে দেখে প্রশস্ত হেসে এগিয়ে আসে সে। অরুনিকাও পাল্টা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বুঝতে পারে তার হাসি আসছে না। একটা ভয় কাজ করছে তার। আহরার যদি বুঝতে পেরে যায় সে আজ কোচিং ফাঁকি দিয়েছে। তবে কি তাকে ভুল বুঝবে। মনে মনে ভাবলো, আজ আহরারকে বলে দেবে সব। এমনকি আজকের ঘটনাটাও। স্বীকার করে নেবে সে। অন্যের কাছ থেকে জানার আগে অরু নিজেই জানিয়ে দিতে চায়। ভাবনার জগতে এতোটাই হারিয়ে গিয়েছে অরু যে আহরারের ডাকও তার কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। আহরার দু বাহু ধরে ঝাঁকাতেই চমকে ওঠে বলে,
–হ..হ্যা.. কি হয়েছে?
–কোথায় হারিয়ে গেলো। এতো করে ডাকছি সাড়া দিচ্ছো না।
–ওহহ। না মানে খেয়াল করিনি।
–বেশ। চলো তাহলে যাওয়া যাক।
–হুম। চলুন।
আহরার অরুনিকাকে নিয়ে চললো। বাড়ির পথে না গিয়ে অন্য পথে যাওয়ায় অরুনিকা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
–এটা তো বাড়ির রাস্তা নয়। তবে কোথায় যাচ্ছেন এদিকে?
অরুনিকার প্রশ্ন শুনে দ্বিগুণ অবাক হয় আহরার।
–মানে সিরিয়াসলি অরু। এরিই মধ্যে ভুলে গেলে তুমি। আজ কি কথা ছিলো।
অরু মনে করার চেষ্টা করে। আর মনে পড়তেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটে সে। মাথা থেকে একেবারেই বেরিয়ে গিয়েছিলো। আজ যে আহরার তাকে তার পছন্দের জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাবে বলেছিলো।
–আমি খুবই দুঃখিত। কিভাবে যেন ভুলে গেলো।
–আরে ইটস ওকে অরু। কোনো ব্যাপার না।
গাড়ি এসে থামে দীঘির পাড়ে। আহরার নেমে এসে অরুনিকার দরজা খুলে তাকে নামায়। অরুর এক হাত শক্ত করে ধরে তাকে নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চলে দিঘীর দিকে। নিরিবিলি জায়গা দেখে সেখানে বসে পড়ে দুজনে। এই দিঘীরপাড় অরুনিকার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। যেদিন আহরার তাকে প্রথম এখানে নিয়ে আসে সেদিন ঘন্টার পর ঘন্টা নির্বাক হয়ে স্থির দৃষ্টিতে দীঘির জলের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। সেদিন অরু বলেছিল এই জায়গায় এসে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। সেই সাথে হারিয়ে ফেলে নিজের সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, চিন্তা ও মানসিক চাপ। নিজেকে নতুন ভাবে খুঁজে পায় সে। নিজেকে ও নিজের জীবনকে নিয়ে সব ভালো কিছু ভাবতে ইচ্ছে করে তার। তাই আজও আহরার তার মন ভালো করার জন্যই তাকে এখানে নিয়ে এলো।
ভেসে আসছে শীতল দখিনা হাওয়া। সেই হাওয়ায় মজে দীঘির শান্ত জলে মনোনিবেশ করে রেখেছে অরুনিকা। কেমন অন্যমনষ্ক ভাব তার। সেই ভালো লাগার অনুভূতির রেশ তার চোখে মুখে দেখা যাচ্ছে না। আহরার শান্ত চোখে দেখছে অরুনিকাকে। বেশ কিছু লটা সময় নীরবতা পালন করে হুট করে আহরার বলে ওঠে,
–তোমার ওড়নাটা ছিঁড়লো কিভাবে অরু?
চমকে উঠে অরু। আহরারের দিকে দৃষ্টি ফেরায় সে। অত্যন্ত স্বাভাবিক মুখভঙ্গিমা আহরারের। তার কথায় অরুর মনে হয় এবার সবটা বলে দেওয়া উচিত। পরক্ষণেই তার মাথায় অন্য এক প্রশ্ন আসায় কৌতুহল দমাতে না পেরে বলেই বসলো,
–আচ্ছা, আপনার বড় ভাইয়ের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ কী ছিল?
ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায় আহরার। অরুর প্রশ্নের জবাবে সেও পাল্টা প্রশ্ন করে,
–হঠাৎ এই প্রশ্ন?
অরুনিকা চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,
–আপনার ভাইয়ের ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনা। কখনো কাউকে প্রশ্ন করার সাহস দেখাতে পারিনি। তাই আজ আপনার কাছ থেকে জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
নীল আকাশে পেজা তুলোর মত সাদা মেঘের দল ভেসে বেড়াচ্ছে। তার ছায়া দীঘির জলে পড়েছে। তাই জলের রংও স্বচ্ছ নীল দেখাচ্ছে। পড়ন্ত বিকেলে হেলে পড়া সূর্যটার তাপ তখনো কমেনি।অরুনিকা খুট খুট করে ঘাস ছিঁড়ছে। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে তপ্ত শ্বাস ফেলে আহরার বলা শুরু করল,
–আয়মান আর আমার বয়সের পার্থক্য গুনে গুনে ৮ মাসের। যার দরুন সে আমার বড় ভাই হওয়া সত্ত্বেও আমরা দুজন বন্ধুর মতো ছিলাম। এমনকি আমি তাকে ভাই বলে না ডেকে নাম ধরেই ডাকি। আমাদের দুজনের জীবনে এমন কোন সিক্রেট নেই যা আমরা জানিনা। ছোটবেলা থেকেই দুষ্টুমি, খুনসুটি করে করে বড় হওয়া আমরা দুজন দুজনের জানের দোস্ত ছিলাম। একে অপরের সাথে সবকিছু শেয়ার করা থেকে শুরু করে একে অপরের দুঃখ কষ্ট ভাগাভাগি করে নেওয়া সবটাই ছিল আমাদের মধ্যে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কি জানো অরু? আমরা জামা কাপড়ও পড়তাম একইরকম। জামা- কাপড়, জুতা, ঘড়ি, এমনকি সানগ্লাসটাও আমাদের ম্যাচিং ম্যাচিং থাকতো। কেউ যদি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করত তবে আয়মান তার বারোটা বাজিয়ে দিত। আর আয়মানের সাথে কেউ দুর্ব্যবহার করলে আমিও তাকে ছেড়ে দিতাম না। একটা ঘটনা বলি, আমরা তখন সদ্য ভার্সিটিতে উঠেছি। আমাদের ভার্সিটি একই ছিল। আমরা একই ক্লাসে পড়তাম। নাদিম মানে ফারনাজের বর আমাদের সাথেই পড়তো। সে বেশ ভালো মানের ছাত্র ছিল। আমিও প্রথম সারিরই ছাত্র ছিলাম। নাদিমকে টপকে স্কুল কলেজে কেউ কখনো ফার্স্ট হতে পারেনি। কিন্তু ভার্সিটিতে এসে আমি হলাম ফার্স্ট আর ও হয়ে গেল সেকেন্ড। তাই তার কিছু পুরোনো বন্ধু তাকে সব সময় ক্ষেপাতো এই বিষয়টা নিয়ে। যার কারণে ওর পুরো রাগ এসে পড়ে আমার উপর। একদিন আমি অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে যাচ্ছিলাম প্রফেসরের সাথে দেখা করতে। বাইকে করে যাচ্ছিলাম। হুট করে কোথা থেকে নাদিমও বাইক নিয়ে এসে আমার বাইকে ধাক্কা দিতেই আমি ছিটকে পড়ে গেলাম। বেশ ব্যথা পেয়েছিলাম। উঠতে পারছিলাম না। তখন নাদিম এসে আমার দীর্ঘদিন ধরে কষ্ট করে তৈরি করা অ্যাসাইনমেন্টে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। দ্রুত ছুটে এসে আমি আগুন নিভানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু বেশিরভাগ পুড়ে গেছে। হাত দিয়ে আগুন নেভাতে যাওয়ার কারণে আমার হাতেও ফোসকা পড়ে গিয়েছিল। আর এসব কিছু যখনই আয়মান জানতে পেরেছে সাথে সাথে ২-৪ জন ছেলে নিয়ে গিয়ে কৌশলে নাদিমকে বাড়ি থেকে বাইরে এনে বেধরম পিটিয়েছে। এক মাস সে বিছানা থেকে উঠতে পারেনি। এর জন্য ভার্সিটি থেকে আয়মানকে সাসপেন্ড করে দিচ্ছিল। কিন্তু বড় আব্বুর অনুরোধে তাকে প্রথম ও শেষবারের জন্য ছেড়ে দেওয়া হলো। এরপর নাদিম আর ভার্সিটিতে আসেনি। কারণ ও এই ভার্সিটি বদলে অন্য ভার্সিটিতে চলে যায়। বহুদিন পর তার এক বন্ধুর কাছ থেকে তার এই ক্ষোভের কারণ জানতে পেরেছিলাম। জানার পর তার প্রতি আর কোন রাগ ছিল না। আমি মাফ করে দিয়েছিলাম। যাই হোক এই ঘটনা শুনেই। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো আয়মান আর আমার সম্পর্ক কেমন ছিলো। কিন্তু এই সুন্দর সম্পর্কটাই একদিন নিমিষেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
আহরারের চোখের কোণে অশ্রুরা ভিড় করতে শুরু করেছে। অরুনিকা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে এতোক্ষণ সবটা শুনছিলো। আহরার থেমে যাওয়ায় তার মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আহরারের চোখের কোণে জমা অশ্রু নজরে আসতেই অরু দুহাতে আহরারের মুখটা ধরে নিজের দিকে ফেরায়। উৎকন্ঠা হয়ে প্রশ্ন করে,
–কি হয়েছে খান সাহেব? আপনি কাঁদছেন? কেন কাঁদছেন?
বলতে বলতে আহরারের মাথা টেনে এনে নিজের বুকে চেপে ধরে অরু। সযত্নে হাত বুলিয়ে শান্তনা দিতে থাকে নিজের স্বামীকে।
~~~
কলেজ থেকে ফিরে কোনোরকমে হাতমুখ ধুয়ে ছুটে ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা আটকে দেয় আদ্রিকা। পুরোটা বিষয় সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেন সেলিনা। ব্যাপারটা এবার সন্দেহের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। নাহ। তার এখন জানতেই হবে আদ্রিকা করছেটা কি?
ফোনটা হাতে নিতেই জানে পানি আসে আদ্রিকার। আজ কলেজে ফোন নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছে সে। পুরোটা সময় কতোটা অস্থিরতায় কাটিয়েছে যেন জানটা হাতে নিয়ে রেখেছে। এখন বাড়ি এসে ফোনটা জায়গামতো দেখেই স্বস্তি মিললো তার। ঝটপট ফোন চালু করতেই সেই অপরিচিতের ম্যাসেজ দেখে আরো এক দফা শান্তির ঢেউ খেলে গেলো মনে। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ম্যাসেজিং এ ডুবে গেলো সে।
“রূপসীর মায়াভরা, অপরূপ সৌন্দর্য্যমন্ডিত, স্নিগ্ধ মুখখানি দেখার বড্ড পিপাসা পাচ্ছে যে।”
ম্যাসেজটা পড়ে ঠোঁটে লাজুক হাসি দেখা গেলো আদ্রিকার। দ্রুত আঙুল চালিয়ে টাইপ করে উত্তর পাঠালো সে,
“আচ্ছা, আপনি কি কখনো আমাকে দেখেছেন।”
ওপাশে বেশ কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে অতঃপর ফিরতি উত্তর,
“হুমমম! দেখেছি তো। যেদিন প্রথম দেখেছি তোমায় সেদিন সোজা বুকে এসে লেগেছিলো। এমন অসম্ভব রূপবতী আমি আমার জীবদ্দশায় কখনো দেখার সৌভাগ্য অর্জন করিনি।”
লজ্জায় লাজুকলতার ন্যায় নুইয়ে পড়ছে আদ্রিকা।
“ইশশ! লোকটা কিভাবে কথা বলে। কত্তো লজ্জা দেয়। কি আশ্চর্য! এই লজ্জার মধ্যেও এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে। এগো ভালো লাগছে কেন সবকিছু।”
ম্যাসেজের আওয়াজে পুনরায় ফোনের দিকে নজর দেয় আদ্রিকা,
“রূপসী বোধহয় লাজরাঙা হয়ে মুখ লুকোচ্ছে। ওমন লজ্জামাখা মুখটা দেখার জন্য বড্ড মন আনচান করছে। কবে দেখবো সেই মুখ?”
আদ্রিকা আর ফোনটা হাতে রাখার সাহস পেলো না। বিছানার এক কোণে ফোন ছুঁড়ে মেরে উঠে গিয়ে জানালার সামনে দাঁড়ায়। মুখে লাজ, ঠোঁটে হাসি। জানালা বরাবর থাকা ফুল গাছটার গা ছুঁইয়ে দেয় সে। আর ফিসফিস করে বলতে থাকে,
“কিরে, তাকিয়ে দেখছিস কি আমার দিকে। এ্যাই, বল না তোরা আমার আনন্দ হচ্ছে কেন? কেন এতো ভালো লাগছে সবকিছু। চারিদিকে যা-ই দেখছি সবকিছু কত্তো সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে দুঃখ বলতে কিচ্ছু নেই। সবখানে শুধু সুখ আর সুখ।”
নিজমনেই কথাগুলো বলেই খিলখিল করে হেসে ওঠে সে। তবে সেই হাসির স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ থাকেনা। দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ার আওয়াজে ধুম করে হাসি থেমে যায় তার। একটু একটু ভয় লাগতে শুরু করে। একটু আগে তার বলা কথা আর হাসি কেউ শুনে নেয়নি তো। তবে ভয়টা জেঁকে বসার আগেই দূর হয়ে গেলো। যখন ওপাশ থেকে সেলিনার আওয়াজ ভেসে আসে,
–হ্যা রে আদ্রি, কলেজ থেকে ফিরেই দরজা আটকে কি করছিস? রুমকি এসেছে। ডাকছে তোকে। বেরো।
রুমকির কথা শুনে খুশি হয়ে গেলো আদ্রিকা। তার প্রিয় বান্ধবী। যাকে সে সবকিছু খুলে বলে। একটু আগেই সেই অপরিচিতের সাথে হওয়া কথাগুলো তো ওকে জানাতে হবে। এই ভেবে ছুটে এসে দরজা খোলে সে। জোরেশোরে দৌড় লাগায় প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর উদ্দেশ্যে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আদ্রিকার ছুটে যাওয়া দেখলেন সেলিনা। তারপর ধীর পায়ে তার ঘরে এসে ঢুকলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে বিছানার ওপর পড়ে থাকা ফোনটা দেখতেই এগিয়ে গিয়ে সেটা হাতে তুলে নিলেন। ফোনটা চালু করতেই ওপরে জ্বলজ্বল করছে কিছু ম্যাসেজ। ম্যাট্রিক অবধি পড়াশোনা করা সেলিনা ম্যাসেজটুকু ভালোভাবেই পড়তে পারলেন। ফোন চালানোও শিখেছেন কিছুটা। তাই ইনবক্সে ঢুকে একে একে সবকটা ম্যাসেজ পড়তে লাগলেন তিনি।
~~~
আকাশজুড়ে রক্তিম আভা। সন্ধ্যা নেমে আসছে প্রায়। নরম ঘাসের ওপরে বসে এখনো দীঘির জল দেখতে ব্যস্ত আহরার অরুনিকা। তিক্ত স্মৃতিচারণের কারণে কিছুটা দূর্বল হয়ে পড়েছিলো আহরার। যার ফলাফল চোখে পানি আসা। অরুনিকার ভালোবাসা মাখা শান্তনায় নিজেকে সামলে নিয়েছে সে। দুজনেই চুপচাপ। থেকে থেকে কেবল বুকচিঁড়ে আসা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে আহরার। নিরবতা ভেঙে অরুনিকাই বলে উঠলো,
–আপনাদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ কি ছিলো?
দূরে দৃষ্টি মেলে তাকায় আহরার। চোখ বুজে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে সন্তর্পণে ছেড়ে দেয় তা। পুনরায় দৃষ্টি মেলে ব্যথিত মন নিয়ে শীতলকন্ঠে জবাব দেয়,
–কারণটা ছিলো আয়মানের স্ত্রী – তানিশা…
চলবে….
#রূপবানের_শ্যামবতী
#২৭তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী
পড়াশোনা শেষ করে ব্যবসায় মন দেয় আয়মান। তবে বাবা চাচাদের ব্যবসা নয়। নিজস্ব ব্যবসা শুরু করে সে। কর্মঠ, পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ আয়মান অল্প দিনে সফলতা লাভ করে তার ব্যবসায়। বছর ঘুরতে না ঘুরতে লাখপতি হয়ে যায় সে। আহরার তখন মাস্টার্সের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। এদিকে আয়মানের বিয়ে নিয়ে তোড়জোর শুরু হয় বাড়িতে। যেহেতু তার নিজস্ব কোন পছন্দ ছিলো না তাই সবটা পরিবারের ওপরই ছেড়ে দেয় সে। বাড়ি থেকে মেয়ে দেখা শুরু হয়। কিন্তু মনের মতো মেয়ে পাওয়া হয়ে যায় মুশকিল। একটার পর একটা মেয়ে দেখা হয়, কারো না কারো কোনো না কোনো দিক অপছন্দ হয়ে যায়। তবে আয়মান থাকে নির্বিকার। সে পছন্দ হয়েছে কি হয়নি সেসব কিছুই বলবে না। শুধু একটাই কথা বলবে, “বাড়ির লোকেরা যা ভালো বোঝে”।
সেদিন ছিল এক আষাঢ়ে বিকেল। ফারজানা ছেলেকে ফোন দিয়ে জানান তারা এক জায়গায় মেয়ে দেখতে যাচ্ছেন। আয়মান যেন সময়মতো উপস্থিত হয়। যথাসময়ে আয়মান ওই এলাকায় হাজির হয়ে যায়। তবে সে বাড়ির ঠিকানাটা ভুলে যায়। মাকে ফোন দিতে থাকে কিন্তু রিসিভ হয়না। বিরক্ত হয় আয়মান। সে এখন কোথায় রাস্তায় রাস্তায় খুঁজে বেড়াবে? এদিকে আকাশে ঘন কালো মেঘ করে এসেছে। যেকোনো মুহূর্তে মুষলধারে বৃষ্টি নামবে। ভাবতে না ভাবতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামতে শুরু করে। কোন কিছু না ভেবে আয়মান এক বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আশ্রয় নেয়। অনেকখানি ভিজে গিয়েছে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে চুল ঝাড়তে থাকে সে। তখনই খট করে দরজা খোলার আওয়াজ হয়। সেদিকে গুরুত্ব দেয় না আয়মান। আচমকা মিহি সুরেলা কণ্ঠস্বর এসে কানে বাজতেই মস্তিষ্ক ঝনঝন করে ওঠে তার। ঝট করে ঘাড় ঘুরিয়ে চায় সে। আবছা আলো আবছা আঁধারে এক সুন্দরী রমনীর মুখশ্রী ভেসে ওঠে চোখের সামনে। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং। তবে মুখের মাধুর্যতা যে কাউকে কাবু করে ফেলতে সক্ষম। দ্বিতীয়বারের মতো সেই সুরেলা কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই ঘোর কাটে আয়মানের। মেয়েটি বেশ নম্র সুরে প্রশ্ন করে,
–কাউকে খুঁজছেন?
আয়মান খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলতে থাকে,
–না মানে আসলে…
তারপর বৃষ্টির দিকে নজর আসতেই দ্রুত বলতে থাকে,
–এই বৃষ্টির জন্যই আটকা পড়ে গেলাম। বাধ্য হয়ে এখানে আশ্রয় নিতে হল। বৃষ্টিটা একটু কমলেই চলে যাব।
মেয়েটি ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে,
–আরে এত হাইপার হওয়ার কিছু নেই। আমি বুঝতে পেরেছি বিষয়টা। আপনি এখানে না দাঁড়িয়ে বরং ভেতরে এসে বসুন।
–না, আমি ঠিক আছি। সমস্যা নেই।
আয়মান সামনে ফিরে দাঁড়ায়। তার হৃদস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। কেন এমনটা হচ্ছে বুঝতে পারছে না সে। শুধু মনে হচ্ছে জলদি বৃষ্টিটা কমুক। সে ছুটে পালাতে চায়। ততক্ষণে মেয়েটি পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বৃষ্টিটা পর্যবেক্ষণ করে বলতে থাকে,
–ভাবলাম এটুকু বৃষ্টিতে কিচ্ছু হবে না। বের হতে পারব। এখন তো মনে হচ্ছে ছাতা নিয়ে বেরোলেও ভিজে সার হয়ে যাব।
আয়মানও জবাব দেয়,
–হুম। এই বৃষ্টির মধ্যে বের হতে পারবেন না। একটু অপেক্ষা করে যান।
এরপর নীরবতায় কেটে যায় অনেকটা সময়। বৃষ্টি কমে এসেছে। তবে এখনো টিপটিপ করে পড়ছে। হুট করে তীরের বেগে আয়মান ছুটে চলে যেতে লাগলো। ফোঁটা ফোঁটা পানি গায়ে পড়ে ভিজে যাচ্ছে সেদিকে কোন ধ্যান নেই তার। যেন পালাতে পারলেই বাঁচে সে। এদিকে আয়মানের এমন তাড়াহুড়ো দেখে মেয়েটি আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে রয়। আপন মনে আওড়াতে থাকে, “কি আজব মানুষ রে, বাবা!”
পেছনে ঘরের ভেতর থেকে তার মা খানিকটা চেঁচিয়ে বলতে থাকে, “মেয়েটার কাণ্ডজ্ঞান দেখো, সুযোগ পেলো আর বাইরে ছুটলো।”
মেয়েটা বিশেষ পাত্তা না দিয়ে ছাতা মাথায় এগিয়ে গেল নিজ গন্তব্যের দিকে।
বাড়িতে ফিরতেই ফারজানা ছেলেকে বলেন, “আজ বৃষ্টির জন্য মেয়ে দেখতে যেতে পারেননি তারা। এদিকে ফোন সাইলেন্ট করে রাখায় আয়মানের কল বুঝতে পারেননি। পরবর্তীতে কল দিলেও আয়মানের ফোন তখন বন্ধ দেখায়।”
এই হচ্ছে ঘটনা। আয়মান কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে শুয়ে পড়ে সে। কাপড়টা অবধি পাল্টায় না। তার বড্ড অস্থির অস্থির লাগছে। কেবল ওই মেয়েটার মুখটা মনে পড়ছে বারবার। একি হলো তার? এমন অদ্ভুত অনুভূতির সাথে তো কখনো পরিচিতি ছিল না তার। তবে আজ কি হলো? কেন হলো? ঝট করে উঠে বসে ছুটে বারান্দায় চলে যায় সে। কোথাও স্থির হতে পারছে না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ধূসর আকাশের পানে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে সে। আচমকা মেয়েটার কন্ঠস্বর কানে বেজে উঠতেই চমকে আশপাশ দেখতে থাকে। না তো, কোথাও নেই তো। নিজের এলোমেলো চুলে হাত চালিয়ে আরো এলোমেলো করে দিল সে। ঠোঁটের কোণে জুড়ে আছে সূক্ষ্ম হাসির রেখা।
পরদিন ফারজানা আয়মান কে আর অফিসে যেতে দেন না। আজ ওই মেয়েকে দেখতে যাওয়া হবে যাকে গতকাল বৃষ্টির জন্য দেখতে যাওয়া হলো না। আয়মানের কেমন যেন অনীহা কাজ করতে থাকে। এতদিন তো এমনটা হয়নি। মনের উপর একপ্রকার জুলুম করেই মেয়ে দেখতে গেল সে।
অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে মেয়ের বাড়ি। সকলেই গল্প গুজবে ব্যস্ত। এদিকে আয়মান মনে মনে শুধু “পালাই, পালাই” করছে। তখনই সেখানে মেয়েকে নিয়ে আসা হলো। ঠিক আয়মানের মুখোমুখি থাকা সোফাটায় বসানো হলো মেয়েকে। সকলেই দেখছে আর প্রশংসায় গদগদ হচ্ছে। কিন্তু আয়মান একটিবারও চোখ তুলে দেখলো না। ফারনাজ কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
–ভাইয়া, মেয়ে কিন্তু দারুণ। তোমার পাশে মানাবে বেশ। দেখলে চোখ ফেরাতে পারবে না। একটিবার দেখোতো।
ফারনাজের কথায় বিরক্ত হলেও আনমনে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয় সে। তৎক্ষনাৎ যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল তার শরীরে। পুনরায় চোখ ফিরিয়ে তাকাতেই দেখতে পেলো সেই রমণী যে গতদিন থেকে তাকে অস্থির করে রেখেছে। এই মেয়েটিই তবে পাত্রী। আয়মানের অস্থিরতা বেড়ে গেছে বহুগুণ। হুট করে তার কি হলো কে জানে। ইচ্ছে হলো চিৎকার করে সবাইকে বলতে, “আমি এই মেয়েটাকেই বিয়ে করতে চাই। আজই, এক্ষুনি। ”
নিজের ভাবনা দেখে নিজেই হতভম্ব হয়ে গেল আয়মান। এদিকে একপাশ থেকে আহিয়া গুতোগুতি শুরু করে দিয়েছে,
–বড় ভাইয়া, বড় ভাইয়া আমার এই ভাবিটাকে খুবই পছন্দ হয়েছে। আমি একেই ভাবি হিসেবে চাই।”
আহিয়ার কথা শুনে আয়মান মনে মনে খুশি হলো। মেয়েটিকে বাড়ির সকলেই পছন্দ করলো। ছেলে মেয়ে দুজনকে আলাদাভাবে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিতে চায়লো সকলে তবে আয়মান বারণ করলো। সে এখন কিছু বলতে চায় না। সেদিনকার মত মেয়ে দেখা শেষে সকলে বিদায় নিল। বাড়িতে ফিরে সবাই আলোচনায় বসলো। মেয়ে যেহেতু সকলের পছন্দ হয়েছে তাই কথাবার্তা আগানোই উচিত বলে মনে করছেন সবাই। আয়মান চুপচাপ সকলের আলোচনা শুনছে। তার মনটা কেমন ছটফট করছে। মেয়েটার নাম জানতে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে তার। তখনই ফারজানা তাসফিয়ার উদ্দেশ্য বলেন,
–হ্যাঁ রে, তাসফি তানিশাকে তোর পছন্দ হয়েছে তো?
তাসফিয়া উৎফুল্লস্বরে জবাব দেন,
–তা আর বলতে ভাবি। এত্তো মিষ্টি একটা মেয়ে।
এদিকে আয়মানের মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে ছড়িয়ে পড়ছে একটি নাম – “তানিশা তানিশা”।
অবশেষে পরিবারের সকলের সম্মতিতে তানিশার সাথেই আয়মানের বিয়েটা ফাইনাল হয়ে গেলো। এরই মধ্যে তানিশার সাথে আলাদা ভাবে কথা বলার জন্য আয়মানকে একপ্রকার চাপাচাপি করা হলো। ভীষণ লজ্জা ও জড়তা নিয়ে আয়মান বাধ্য হয়ে তানিশার সাথে দেখা করতে গেল। তানিশা তখন সদ্য ভার্সিটিতে উঠেছে। প্রথম বর্ষের ছাত্রী। আয়মান তার ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুসময় পরই তানিশাকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। তানিশাকে দেখামাত্রই আয়মান এদিক ওদিক এলোমেলোভাবে চাইতে লাগলো। তা দেখে তানিশা মৃদু হাসে। একেবারে আয়মানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লম্বা করে সালাম দিলো। ভড়কে যায় আয়মান। তোতলানো স্বরে সালামের উত্তর দেয়। তানিশার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। বহুকষ্টে হাসি চেপে রাখে সে। আয়মান তানিশা পাশাপাশি হাঁটছে। আয়মান কোনো কথা বলছে না দেখে তানিশাই বলে ওঠে,
–আপনি এত সংকোচবোধ করছেন কেন?
আয়মান গলায় বৃথা জোড় টেনে জবাব দেয়,
–কই নাতো, একদমই আমি কোন সংকোচ বোধ করছি না।
তানিশা সন্দিহান স্বরে বলে ওঠে,
–সত্যি? তাহলে এমন জড়োসড়ো হয়ে হাঁটছেন কেন?
আয়মান এবার সোজা সটসট হয়ে দাঁড়ায়। গটগট পায়ে হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গি করে বলতে থাকে,
–একদমই না। এই দেখুন, আমি কতটা সোজা হয়ে হাঁটছি।
আয়মানের কথা বলার স্টাইল ও হাঁটার ভঙ্গিমা দেখে এবার আর তানিশা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আশপাশ কাঁপিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সে। হাঁটা থামিয়ে আয়মান পিছু ফিরে তাকায়। এমন প্রাণ খোলা ভাবে হাস্যরত সুন্দরী রমণী আয়মানকে এবার পুরোপুরি ঘায়েল করে দিলো। সে যেন নিজের মন, প্রান, অস্তিত্ব সবকিছুই এই রমণীর নামে করে দিতে প্রস্তুত।
বেশ ধুমধাম ভাবেই আয়মান তানিশার বিয়েটা হয়। সবাই ভীষণ খুশি ছিলো। তানিশা আসার পর খান বাড়ি যেন আলোকিত হয়ে গেল। গুলবাহার থেকে শুরু করে আমেনা পর্যন্ত সকলের খেয়াল রাখতো মেয়েটা। সবদিকে সমান নজর থাকতো তার। সংসারটাকে দুহাতে আগলে রাখতো সে। আর আয়মান-তানিশার সম্পর্ক? এ যেন ভালোবাসার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্ত্রী হিসেবে নিজের সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতো তানিশা। কোথাও কোন ফাঁক ফোকর রাখতো না। আয়মানের গৎবাঁধা সাদাকালো রোবোটিক জীবনটায় তানিশা এক জাদুকরী হয়ে এসেছে। ভালোবাসায় মুড়িয়ে রঙ্গিন করে তুলেছে তার জীবন। দূর করে দিয়েছে সকল যান্ত্রিকতা। তৈরি করেছে এক সুখনীড়। তবে সুখনীড়ের সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয় না। এক দমকা ঝড়ো হাওয়া এসে সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে গেলো।
আয়মানের অফিসে তখন এক নতুন পিএ (পার্সোনাল সেক্রেটারি) নিযুক্ত করা হয়ে ছিলো। যে ছিলো একটি অল্প বয়সী মেয়ে। মেয়েটির আয়মানের প্রতি দুর্বলতার সৃষ্টি আয়মানের জীবনে ঝড়ের সূচনা। আয়মান বিবাহিত জানা সত্ত্বেও মেয়েটি নানাভাবে আয়মানকে প্রলোভন দেখিয়ে নিজের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে। যেটা আয়মান পুরোপুরি বুঝতে পারে না। তবে তানিশা বুঝতে পারে। আয়মান কে বারবার এই মেয়েটিকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিতে বললেও আয়মান তা শুনতো না। কারণ মেয়েটি অসম্ভব মেধাবী এবং কাজে পটু ছিলো। যার জন্য আয়মানের ব্যবসার ব্যাপক উন্নতি সাধন হয়েছে। তাই সে ওই মেয়েটিকে হাতছাড়া করতে চাইতো না। এই নিয়ে প্রায়শই দুজনের মধ্যে ঝগড়া লাগে। সেই ঝগড়া একদিন এতটাই বিশাল আকারে পরিণত হয় যে আয়মান তানিশার গায়ে হাত তোলে। তানিশা সেদিন কোনো প্রতিবাদ করেনি। চুপচাপ স্থির দৃষ্টিতে আয়মান কে দেখেছিলো কেবল। হয়তো চেনা মানুষের এমন অচেনা রূপ তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলো। এর পরদিনই তানিশা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আয়মানও রাগ করে তাকে ফিরিয়ে আনতে যায় না। কিন্তু কিছুদিন পরে তানিশার শূন্যতা তাকে গ্রাস করতে শুরু করলো। সিদ্ধান্ত নিলো সবকিছু মিটমাট করে নেওয়ার। বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে তানিশাকে ফিরিয়ে এনেছিলো সে। ফিরে আসার পর তানিশাকে বেশিরভাগ সময় আহরার এর সাথে গল্প গুজবে ব্যস্ত দেখা যেতো। মূলত তারা দুজনে মিলে শলাপরামর্শ করতো কিভাবে ওই মেয়েটিকে আয়মানের অফিস থেকে তাড়াবে। আর এটারই সুযোগ নিয়ে আয়মানের সেই পিএ তাকে কান মন্ত্রণা দিতে থাকে। তাকে বোঝাতে থাকে আহরার ও তানিশার মধ্যে অবৈধ মেলামেশা চলছে। প্রথম প্রথম আয়মান এসব গুরুত্ব না দিলেও ধীরে ধীরে তার মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। এই নিয়ে একদিন তুমুল বাকবিতন্ডার মধ্যে আয়মান আবারও তানিশার গায়ে হাত তোলে। সেদিনও তানিশা চুপ ছিল।
দুইদিন পর বাড়ির সকলে গিয়েছিল ফারনাজের শ্বশুর বাড়ি অর্থাৎ নাদিমদের বাড়ি। ফারনাজের তখন প্রেগন্যান্সির ৭ মাস। সেই অনুষ্ঠানের জন্যই ওই বাড়িতে যাওয়া সকলের। এদিকে খান বাড়িতে কেবল গুলবাহার আর তানিশা। গুলবাহার অসুস্থ থাকায় তানিশা সকলকে পাঠিয়ে নিজে থেকে গিয়েছে। আয়মান, আহরার দুজনেই তখন অফিসে। হঠাৎ দুজনের ফোনেই তানিশার ম্যাসেজ আসে, দ্রুত বাসায় ফেরার জন্য। আহরার আগে এসে পৌঁছায়। সারা বাড়ি খুঁজে কোথাও তানিশাকে না পেয়ে ছাদে চলে যায়। সেখানেও নেই। রেলিং এর ধারে দাঁড়িয়ে নিচে বাগানের দিকে চোখ বোলাতে থাকে আহরার। তখনই যে দৃশ্য তার চোখে পড়লো, মুহূর্তের জন্য সে স্তব্ধ পাথর হয়ে গেলো যেন। ঝড়ের গতিতে ছাদ থেকে নেমে আসে সে। সিঁড়ির গোড়ায় আয়মানের সাথে ধাক্কা লাগলে আয়মান উদ্বিগ্ন স্বরে বলে ওঠে,
–কি হয়েছে? এভাবে পাগলের মত দৌড়াচ্ছিস কেন?
আহরারের কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছে। তবুও কষ্ট করে বললো,
–বাগানে.. বাগানে ভাবি.. জলদি চল…..
বলতে বলতে আহরার ছুঁটতে থাকে। আয়মানও পেছন পেছন ছুঁটতে থাকে। বাগানে আসতেই আহরারকে মাটিতে বসে থাকতে দেখে কৌতুহলী দৃষ্টিতে সামনে তাকায় আয়মান। সঙ্গে সঙ্গে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলো তার। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এলো যেন। চারপাশ কাঁপছে তার। চোখের সামনে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তানিশার র ক্তা ক্ত লা শ। আহরার পালস চেক করে মৃ ত দেখেই থম মেরে বসে আছে। আয়মান ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো। তানিশার মাথার কাছে ধপ করে বসে পড়লো। তানিশাকে সোজা করে তার র ক্তা ক্ত মাথাটা কোলে তুলে নিলো। সযত্নে হাত বোলাতে থাকে থে ত লে যাওয়া মাথায়। র ক্তে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে তার হাত, শরীর। তবুও নির্বিকার সে। কেবল স্থির দৃষ্টিতে প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে দেখছে। শেষবারের মতো, ভালোভাবে। আহরার এগিয়ে এসে আয়মানকে সরাতে চাইলে “হুসস”করে উঠে সে। ফিসফিস করে বলে,
–ছেড়ে দে আমাকে,ছাড়। আমার তানি ঘুমাচ্ছে। আমি ওকে ঘুম পাড়াচ্ছি। ডিস্টার্ব করবি না। সরে যা।
–আয়মান সরে আয়। পাগলামি করিস না ভাই। ভাবি নেই। তানিশা ভাবি আর বেঁচে নেই।
গলা ধরে আসে আহরারের। আয়মান চিৎকার করে বলে ওঠে,
–চুউউপ! একদম চুউউপ! যা এখান থেকে। চলে যা। নইলে খু ন করে ফেলবো তোকে।
আহরার এক প্রকার জোরজবরদস্তি করে আয়মানকে ছুটিয়ে আনার চেষ্টা করে। ততক্ষণে দাড়োয়ানের ফোন পেয়ে বাড়ির সকলে চলে এসেছে সেখানে। সকলে স্তব্ধ। কেউ যেন মেনে নিতে পারছে না এমন একটি ঘটনা। ময়নাতদন্তের ভয়ে ব্যাপারটা পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছাতে দিলো না কেউ। তানিশার দাফন কাজ শেষ হলো। তার বাড়ির লোকেরা পুলিশ কেস করতে চাইলেও এগোতে পারল না খুব একটা। আয়মান বেশ কয়েকদিন শোকে আধা পাগল এর মতো ছিলো। এরমধ্যে একদিন আয়মান আহরারের সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করে। তার ধারণা তানিশার সাথে আহরারের অবৈধ সম্পর্ক ছিলো। হয়তো আহরারই তানিশাকে জোর করেছে। আর সেই জের ধরে আহরার তানিশাকে ছাদ থেকে ধা ক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। আহরার ই খু ন করেছে তানিশাকে। আহরার আয়মানকে যত বোঝানোর চেষ্টা করে এসব মিথ্যে, এসব তার ভুল ধারণা। আয়মান ততই ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। একসময় তা মারামারিতে পরিণত হয়। আয়মান আহরারকে ইচ্ছেমতো চড়, থাপ্পর ঘুষি মারতে থাকে। তখনই আফজাল সাহেব আয়মানকে টেনে এনে পরপর কয়েকটা থাপ্পর দেন এবং হুংকার ছেড়ে বলেন,
–বেড়িয়ে যা এ বাড়ি থেকে। এই মুহূর্তে বেরিয়ে যা। তোর মত জা নো য়ার কু লা ঙ্গার ছেলে এই খান বাড়িতে থাকার অধিকার রাখে না।
রাগে দিশেহারা অবস্থা তখন আয়মানের। তাই বাবার মুখে কথাগুলো শুনে সত্যি সত্যি আয়মান বেরিয়ে গেলো খান ভিলা ছেড়ে। আর কখনোই এই বাড়ির ত্রিসীমানায় পা রাখেনি সে। এরপর কেটে গেছে পাঁচ বছর। আজও আয়মান নিখোঁজের মতোই আছে। ধরা দেয় না কারো সামনে।
বুকে যন্ত্রণা চেপে বহুকষ্টে কথাগুলো বলে শেষ করলো আহরার। অরুনিকা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহরারের দিকে। কি অনায়াসেই একটা মানুষের মৃ ত্যু ঘটে গেলো আর কতো সহজেই ভেঙে গেলো বন্ধুর মতো ভাই-ভাই এর সম্পর্ক। হুট করে অরুর আজকের ঘটনা মনে পড়লো। সে তো আয়মানকে দেখেছে। খানিকটা ছটফটিয়ে অরুনিকা বলে ওঠে,
–খান সাহেব, আমার আপনাকে কিছু বলার আছে..
–যা বলার বাড়িতে গিয়ে বলো অরু। এখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। জায়গাটা সেফ নয়। আমাদের যেতে হবে এখন।
এই বলে আহরার নিজে উঠে অরুনিকাকেও উঠে দাঁড় করালো। শক্ত করে এক হাত চেপে দ্রুত এগিয়ে গেলো গাড়ির দিকে। গাড়ির কাছে আসতেই অরু আহরারের হাত টেনে বলে,
–শুনুন না, কথাটা ভিষণ গুরুত্বপূর্ণ। একবার শুনুন..
অরুর কথা শুনে আহরার তার দিকে তাকাতেই হুট করে ভ্রুঁ কুঁচকে আসলো তার। সাথে সাথে চোখেমুখে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে আহরারের। আচমকা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আহরার এক ঝটকায় অরুকে টেনে এনে গাড়ির সাথে দাঁড় করায়। অরুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুহাতে অরুকে আগলে রেখেছে সে। তখনই একটা বাইক আহরারের পেছন ঘেষে চলে গেলো। আহরার “উফফ” করে আর্তনাদ করে ওঠে। ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে গেছে তার। অরুনিকা বুঝে উঠতে পারছেনা কিছুই। তার এক হাত আহরারের পিঠের শার্ট খামছে ছিলো। হঠাৎ হাতে ভেজা ভেজা অনুভূত হতেই সে দ্রুত সরে এসে আহরারের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। আহরারের পিঠের দিকে তাকাতেই মাথা ঘুড়ে আসে তার। তাজা র ক্তে ভেসে যাচ্ছে আহরারের পিঠ..
চলবে…