#রূপবানের_শ্যামবতী
#২৫তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী
অনেকটা পথ ছুটেও গাড়ির নাগাল পেলোনা অরুনিকা। ব্যথিত মন নিয়ে চেয়ে রইলো ব্যস্ত সড়কের পানে। সাঁই সাঁই করে পাশ ঘেষে ছুটে যাচ্ছে কত গাড়ি। সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। শূণ্যে দৃষ্টি মেলে শুধু ভাবছে যদি গাড়িটা ফিরে আসতো। যদি গাড়ি থেকে বেরিয়ে “অরুমা, অরুমা” বলে ছুটে আসতো তার বাবা। ভেতর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। ধীরপায়ে ফিরে আসে IWAK ভবনে। অফিস রুমে ঢুকতেই দৃষ্টি থমকায় তার। উৎকন্ঠিত আহরারের ফোন কানে রেখে ছুটোছুটি করা দেখতেই ভাবনায় পড়ে যায় সে, “কি হয়েছে?”
কিন্তু সে কিছু বলার আগেই আহরারের নজরে চলে আসে। কান থেকে ফোন নামিয়ে তীরের বেগে এগিয়ে আসে আহরার। স্থান, কাল ভুলে জাপটে ধরে নিজের প্রেয়সীকে। শক্ত করে আগলে রাখে বুকে। হৃৎপিণ্ডের দ্রুতগতিতে ওঠানামার শব্দ এসে বারি খায় অরুর কানে। কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করে,
–কি হয়েছে খান সাহেব? আপনি এতো অস্থির হয়ে আছেন কেন?
অরুনিকার কথা শুনে তাকে ছেড়ে দেয় আহরার। সোজা দাঁড় করিয়ে দুবাহু ঝাঁকিয়ে তেজালো স্বরে পাল্টা প্রশ্ন করে,
–কোথায় গিয়েছিলে তুমি? বলো। তোমাকে খুঁজে না পেয়ে কতোটা ভয় পেয়েছি আমি জানো। পাগল পাগল লাগছিলো। আমি তো এক্ষুনি সিসিটিভি ফুটেজ দেখার জন্য তাড়া দিচ্ছিলাম। আমাকে না বলে কোথায় চলে গিয়েছিলে বলো?
আহরারের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অরু অন্য প্রশ্ন করে বসলো,
–আপনার অফিস থেকে কিছুক্ষণ আগে যেই লোকটা বেরোলো উনি কে?
–উনিই সেই ক্লায়েন্ট যিনি তার ঘরের ইন্টেরিয়র ডিজাইনে গ্রামীণ পরিবেশ চান।
অরুনিকা উপায় খুঁজে পেয়ে গেলো। বাবার সাথে দেখা করার উপায়। আহরার পুনরায় তাড়া দিয়ে বলে ওঠে,
–কি হলো, কোথায় গেছিলে বলছো না কেন?
–একটু বাইরে হাঁটতে গিয়েছিলাম। বেশিদূর যাইনি তো। এখানে ভালো লাগছিলো না তাই..
–তাই বলে কাওকে না বলে চলে যাবে। এই ভুল আর একদম করবে না। হয় আমাকে বলবে আর আমাকে না পেলে অন্য কাওকে বলে যাবে। ঠিকাছে?
অরু মাথা হেলিয়ে সাই জানায়। আহরারকে সে এই মুহূর্তে কিছু জানাতে চায়না। যেদিন তার বাবার সাথে সামনাসামনি সাক্ষাৎ ঘটবে সেদিনই জানাবে।
বাড়ির পথে ফিরছে দুজন। পথিমধ্যে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। সারাদিনের ভ্যাপসা গরম কাটিয়ে এ যেন এক টুকরো প্রশান্তি। ছটফটিয়ে ওঠে অরু। উত্তেজিত স্বরে খানিকটা চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
–গাড়ি থামান, গাড়ি থামান।
অরুনিকার কথা শুনে হুট করেই ব্রেক কষে আহরার। উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করে,
–কি হয়েছে অরু? কোনো সমস্যা?
আহরারের তাকিয়ে মন ভোলানো এক হাসি দিয়ে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
–গাড়ি থেকে নেমে আসুন।
বলতে বলতে নিজেই নেমে পড়ে ঝটপট। আহরার কিছু বুঝতে পারছে না। এই বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটা এভাবে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো কেন? সে গাড়িটা এক সাইডে রেখে নেমে পড়লো অরুনিকাকে অনুসরণ করে। তাকে নামতে দেখে অরু ছুটে এসে তার এক হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো রাস্তার মাঝে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা এসে মুহুর্তেই ভিজিয়ে দিচ্ছে সারা শরীর। নিরিবিলি পরিবেশ। আশেপাশে নেই কোনো মানুষজন। যানবাহনের আনাগোনাও দেখা যাচ্ছে না। পিচঢালা পথটিতে দুপাশে কেবল লম্বাকৃতির ল্যাম্পপোস্ট দাঁড়িয়ে। নিয়ন বাতির ঘোলাটে আলোতে বৃষ্টিমুখর এই পরিবেশ অভাবনীয় অনুভূতি সৃষ্টি করছে। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় ঝলকে উঠছে চারপাশ। চাপাস্বরে চলছে মেঘের গর্জন। আকাশের দিকে মুখ বাড়িয়ে রেখেছে অরুনিকা। গালে মাখছে বৃষ্টির ফোঁটা। দুহাতে জাপটে ধরে আছে আহরারের হাতদুটো। আহরার শুধু অবাক নয়নে দেখছে তার শ্যামবতীকে। এককালে বৃষ্টি অপছন্দকারী এক মেয়েকে। আজ কিভাবে সে এই বর্ষনের আমেজ উপভোগ করছে মনভরে। এমন দৃশ্য দেখাও যেন পরম সৌভাগ্যের। ধীরস্বরে আহরার বারণ করার উদ্দেশ্যে বলে,
–ঠান্ডা লেগে যাবে অরু। হয়েছে তো চলো।
মুখ নামায় অরু। সরাসরি আহরারের দিকে তাকায়। ঠোঁটে লেগে আছে সূক্ষ্ম হাসি। ভেজা ভেজা গালে যেন মায়ার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে। থমকায় আহরার। এই শ্যামবতী রমণীকে সে নতুন নতুন রূপে আবিষ্কার করে। স্থির হয়ে যায় সে। স্থির হয় তার চারপাশ। সেই দৃষ্টি বোধগম্য হয়েছে বলেই কিনা অরুনিকা প্রশ্ন করে,
–এই অসুন্দর মেয়েটাকে এতো মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিভাবে দেখেন আপনি?
–কেন নিজেকে অসুন্দর মনে হচ্ছে তোমার?
–সকলেই তো বলে।
–ভুল বলে। কারণ তারা জানেনা এই অসুন্দর মেয়েটার একটা সুন্দর রূপ আছে। সেই রূপ দেখার চোখ সবার হয়না। যার হয় সে মুগ্ধ হয়। যেমন আমি।
অরুর ঠোঁটজোড়ায় খেলে যায় আবারো সেই মনকাড়া হাসি। অদম্য এক ইচ্ছে পোষণ হয়ে যায় আহরারের। বেসামাল মন বারণ না মানায় আচমকা এক অবিশ্বাস্য কাজ করে ফেলে সে। হুট করে ঝুঁকে এসে অধরে অধর মিলিয়ে দেয় স্বীয় প্রেয়সীর। কয়েক সেকেন্ড। পলকে এসে পলকেই সরে গেছে। ব্যাপারটা বুঝে ওঠার সময়টুকু মিললো না অরুর। হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো কেবল। লজ্জা পেতেও যেন ভুলে গেছে সে। মস্তিষ্ক সজাগ হতে খুব বেশি সময় লাগলো না তার। তখনই লজ্জার মহাসাগরে ডুবে যেতে লাগলো। এদিকে আহরার দুকদম পিছিয়ে দুহাত মেলে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে,
–এই বৃষ্টি, এই সন্ধ্যা,
সাক্ষী থেকো সকলে।
লিখে নিও এক ভালোবাসার কবিতা
আবার কখনোও দেখা হলে।
একটু থেমে অরুনিকার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলায় সে। বৃষ্টির প্রকোপ বাড়ছে। চোখ মেলে রাখাও দায়। আহরার আঙুল তুলে ইশারা করলো অরুনিকার দিকে। আবারো চিৎকার করে বলে উঠলো,
“যে ভালোবাসা আমি করেছি উৎসর্গ
কেবল এবং কেবলই আমার শ্যামবতীর কাছে।”
আরো এক মধুর স্মৃতির সংযোজন হলো রূপবান-শ্যামবতীর গল্পে।
~~~~
কলিং বেলের শব্দে অস্থির হয়ে উঠেছে খান ভিলা। আমেনা ছুটতে ছুটতে এসে দরজা খুলেই দুটো গালি দিতে গিয়েও সংযত করে নিলো নিজেকে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে এই বাড়ির অতি আদরের জামাই নাদিম। দ্রুত দরজা থেকে সরে দাঁড়ায় আমেনা। এই লোকটাকে তার একদমই ভালো লাগেনা। অদ্ভুত দৃষ্টি তার। বুঝে ওঠা যায় না। নাদিমও কেমন ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভেতরে চলে গেলো। নাদিম চলে যেতেই আমিনা ভাবছে, “এই ব্যাডা আবার হুট কইরা এইহানে আইছে ক্যান?”
সবথেকে বেশি তাজ্জব হলো যখন নাদিমকে গুলবাহারের ঘরো ঢুকতে দেখলো।
“ওমাগো মা, ওই বুড়ির লগে এই ব্যাডার কিয়ের পিরিতি?”
–কে এসেছে আমেনাবু?
অরুনিকার প্রশ্নে আমেনা মুখ বাঁকিয়ে জবাব দেয়,
–জামাইবাবু আইছে।
–হঠাৎ?
–কইতে পারিনা নতুন ভাবি।
তারপর কাছাকাছি এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলে,
–বড় ম্যাডামের ঘরে ঢুকছে। কি শলাপরামর্শ করবো আল্লাহই জানে।
এই বলে আমেনা রান্নাঘরে চলে গেলো। অরুনিকা কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে গুলবাহারের ঘরের দরজার দিকে। লোকটাকে তার ভিষণ সন্দেহজনক লাগে।
—
ক্লায়েন্টের ডিমান্ড অনুযায়ী সকল জিনিসপত্র বানিয়ে দিয়েছে অরুনিকা। তবে তার চিন্তাধারায় ঘুরপাক খাচ্ছে অন্য বিষয়। আহরারকে তা বলতে চাচ্ছে। তবে কিছু একটা জড়তা কাজ করায় সহজে বলে উঠতে পারছেনা। অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো আহরার। অরুনিকা তার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে দিচ্ছিলো। বারবার আহরারের দিকে দেখছে আর ইতিউতি করছে। ব্যাপারটা নজরে আসে আহরারের। গম্ভীরস্বরে ডেকে ওঠে,
–অরু..
ভড়কে যায় অরু। কোনোকিছু ভুল হয়ে গেলো কিনা বারবার দেখতে থাকে। আহরার এগিয়ে এসে একইস্বরে আবারো বলে ওঠে,
–আমার সামনে দাঁড়াও।
অরুনিকা বাধ্যের ন্যায় সামনে এসে দাঁড়ায়। আহরার অরুর থুতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে মুখটা ওপরে তোলে। আহরারের চোখে চোখ রাখতেই সে কন্ঠস্বর বদলে কোমলতার সুরে বলে ওঠে,
–কি ব্যাপার, আমার সুনয়নার এতো ইতস্ততা কিসের? আমার সামনে এখনও তার এতো জড়তা?
–না মানে আসলে..
আমতা আমতা করতে থাকে অরু।
–হুম, বলো? যা বলতে চাও নির্দ্বিধায় বলো অরু। আমার সামনে কথা বলতে ভাবনা চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। কোনো রাখঢাক রাখারও দরকার নেই। মনখুলে বলো কি বলার আছে।
–আসলে আমি আপনার সাথে ওই ক্লায়েন্টের বাড়িতে যেতে চাই। আমাকে নিয়ে যাবেন?
ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায় আহরার। অরুনিকা কৈফিয়তের সুরে বলতে থাকে,
–না মানে এতো এতো জিনিস বানালাম ওসব দিয়ে কিভাবে বাড়িটা সাজান তাই দেখতে খুব ইচ্ছে..
–আরে বাবা রিল্যাক্স রিল্যাক্স। কারণ ব্যাখ্যা করার কোনো প্রয়োজন নেই তো। তুমি যেতে চেয়েছো আমি অবশ্যই নিয়ে যাব। এমন কোনো বড় ব্যাপার নয়।
–সত্যিইইই?
–হুম সত্যি। যাও তৈরি হয়ে নাও।
–এখনি?
–হ্যা আমি তো অফিস যাব না। এখান থেকে সোজা ক্লায়েন্টের বাড়িতেই যাব।
–ঠিকাছে। আমাকে তবে ৫ মিনিট সময় দিন।
তৈরি হয়ে অরুনিকা বেরিয়ে পড়লো আহরারের সাথে। তার ভেতরে অত্যাধিক অস্থিরতা কাজ করছে। সেই সাথে মনের ভেতর জমে আছে প্রশ্নদের ভিড়। অপেক্ষা করছে জলদি জলদি নিজের বাবার মুখোমুখি হওয়ার।
ক্লায়েন্টের বাড়িতে আসতেই অরু আগে আগেই ছুটে ভেতরে চলে গেলো। পুরোটা রাস্তা অরুর অস্থিরতা খেয়াল করেছে আহরার। আবার এখনো এইভাবে ছুটে যাওয়া। ভিষণ রহস্যময় লাগছে। তবে সে ইচ্ছে করেই অরুকে কোনো প্রশ্ন করছেনা। তার বিশ্বাস অরু নিজ থেকেই তাকে সবকিছু বলবে।
বাড়িতে ঢুকেই বিস্ময়ে হা হয়ে আছে অরু। সবকিছু বেশ সুন্দর ও পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে। দেখে বোঝার উপায় নেই এটি একটি আধুনিক ডুপ্লেক্স বাড়ি। ভেতরটা পুরোই গ্রামীণ পরিবেশেই সাজানো। চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছে অরু। আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে সব। পছন্দগুলো একেবারে তার বাবার পছন্দের সাথে মিলে যায়। হাসলো অরু। মিলবে না-ই বা কেন? এই বাড়ির তো অরুর বাবারই। আচ্ছা! সত্যিই এটা অরুর বাবারই বাড়ি তো?
–হ্যালো মিস অর মিসেস। থ্যাংক ইউ সে মাচ। একদম আমার মনের মতো করেই সাজিয়েছেন সবকিছু। আ’ম রিয়েলি গ্রেটফুল।
পরিচিতি কন্ঠস্বর। হ্যা, এই তো সেই প্রিয় কন্ঠস্বর। পিছু ফিরে তাকাতেই চেনা পরিচিত সেই মুখটাও নজরে আসে অরুনিকার। হাসিহাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন এক স্যুটবুট পড়া ভদ্রলোক। মুখভর্তি দাঁড়িসহ চেহারায় বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। তবুও নিজের বাবাকে চিনতে ভুল করে না অরু। মুখফোটার আগেই চোখে জল জমে তার। কন্ঠস্বর কেঁপে ওঠে। ঠোঁটের কোণে হাসি। হারানো জিনিস ফিরে পাওয়ার খুশি। কম্পনরত কন্ঠস্বরে ভাঙা ভাঙা ভাবে উচ্চারণ করে সে,
–ব..ব..বাবা..
লোকটির হাসিহাসি মুখ পরিবর্তিত হয়ে কৌতুহলীতে রূপান্তর হয়। পরক্ষণেই সৌজনমূলক হাসি দিয়ে বলে ওঠে,
–সরি! বুঝলাম না। কে বাবা?
বিস্মিত, হতভম্ব হয়ে যায় অরু। কি বলছে কি বাবা? বাবা কি তবে তাকে চিনতে পারছে না।
–বাবা, তুমি আমায় চিনতে পারছোনা। আমি, আমি তোমার অরুমা।
–আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনি কারো সাথে আমায় গুলিয়ে ফেলেছেন। আমি আপনার বাবা নই। আমি তো আপনাকে চিনিই না
বড়সড় ধাক্কা খেলো অরু। তার নিজের বাবা তাকে চিনতে পারছেনা। এমন দিনও দেখতে হলো তাকে। নাকি চিনেও না চেনার ভান করছে। কিন্তু কেন?
–বাবা, তুমি আমায় ভুলে গেছো? তোমার অরুমাকে?
–আ’ম রিয়েলি ভেরি সরি। আপনি হার্ট হলে। বাট আই হেভ নাথিং টু ডু। আমি সত্যি বলছি। আমি আপনাকে চিনিই না। যাই হোক আপমাদের কাজের পেমেন্ট যতটা করার কথা ছিলো আমি তার চেয়েও বেশি করতে চাই। আ’ম ভেরি স্যাটিসফাইড।
লোকটা চলে গেলো। অরুনিকা ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। সত্যি কি এই লোকটা তার বাবা নয়? অরু বিশ্বাস করতে পারছেনা। তার বুকে ব্যথা হচ্ছে ভিষণ। বাবা! তার বাবা। পেয়েও তবে হারিয়ে ফেললো সে তার বাবাকে।
–অরু..
আহরারের ডাক শুনে দ্রুত নিজেকে সামলে নেয় অরু। চোখ মুখে স্বাভাবিক হয়ে যায়।
–এতো হন্তদন্ত হয়ে চলে এলে ভেতরে। সব ঠিক আছে তো।
–হ..হ্যা। সব ঠিক আছে। আসলে ভেতরটা দেখার লোভ সামলাতে পারছিলাম না।
–ঠিকাছে চলো তাহলে এবার।
–হুম।
অরুনিকা আহরারের সাথে সাথে এগিয়ে যেতে লাগলো। বারকয়েক পিছু ফিরে চাইলেও বাবাকে দেখতে পেলো না। একবুক যন্ত্রণা নিয়ে চলে গেলো সে। ওদিকে আড়াল থেকে একজোড়া করুণ দৃষ্টি যে তাকেই দেখছিলো তা সে জানতেই পারলোনা।
বেশ কয়েকদিন অরুনিকা কেমন যেন শান্ত হয়ে থাকে। কম কথা বলে। খুব একটা হাসেনা। মনমরা ভাব। আহরার অনেক চেষ্টা করেছে অরুর মন ঠিক করার কিন্তু পারেনি।
আজ অরুকে কোচিং এ রেখে আসার সময় আহরার বলে,
–অরু, আজ কোচিং শেষে ঘুরতে যাব তোমার পছন্দের জায়গায়। ওকে।
অরু হালকা হেসে মাথা নাড়ায়। আহরার বিদায় জানিয়ে চলে যেতেই অরুনিকা স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সেদিকে। আহরারের গাড়ি পুরোপুরি চোখের আড়াল হতেই কোচিং সেন্টারের গেটে না ঢুকে বাইরে বেরিয়ে পড়লো অরু। তার উদ্দেশ্য সেই লোকটার বাড়ি। যাকে সে নিজের বাবা ভেবেছে। আড়াল থেকে লোকটার ওপর একটু নজর রাখতে চায় সে। তার বাড়ির সামনে আসতেই বেশ কিছুটা সময় আড়াল থেকে উঁকিঝুকি মেরে দেখার চেষ্টা করতে থাকে অরু।
কিন্তু কিছু দেখতেও পায়না। বুঝতেও পারেনা। তাই বাধ্য হয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে নজর বোলাতে বোলাতে এগিয়ে যেতে থাকে সে। গেটের কাছে এসে সন্তর্পণে ভেতরে প্রবেশ করলো। ভাগ্যিস কোনো দারোয়ান নেই। মূল দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই বুঝতে পারে দরজা ভেতর থেকে আটকানো। তার মানে লোকটা বাড়িতে আছে। এখন অরু কি করবে? বুঝে উঠতে পারেনা। বারবার ঢোক গিলছে। ধরা পড়ার আশংকায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তখনই নজরে আসে মূল দরজার পাশে থাকা জানালাটায়। ধীরপায়ে জানালার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। আড়ালে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি মারতেই লোকটাকে দেখতে পায় অরু। সোফায় বসে কারো সাথে গুরুগম্ভীর কোনো আলোচনা সারছে। কিন্তু কার সাথে? মুখটা দেখতে পাচ্ছে না অরু। আরো একটু এগিয়ে গিয়ে ভালোভাবে উঁকি দিতে থাকে। লোকটা এদিকে পিঠ রেখে বসায় অপরপাশের ব্যক্তিটি আড়াল হয়ে আছে। কিন্তু অরু হাল ছাড়ে না। কিছু মুহূর্ত পরই সে সফলও হয়। লোকটা হালকা সরে যাওয়ায় এক পলকের জন্য অপরপাশের ব্যক্তিটির মুখ নজরে আসে অরুর। তৎক্ষনাৎ মাথা ঝনঝন করে ওঠে তার। ওই ব্যাক্তিটি তার চেনা। কোথায় যেন দেখেছে? মস্তিষ্কে হালকা চাপ দিতেই পরিষ্কার হয়ে যায় সব। আহরারের ঘরে থাকা সেই ফটোফ্রেমের ছেলেটা। কি যেন নাম… আয়মান। হ্যা, ইনিই তো আয়মান। অবাকের চূড়ান্ত সীমায় যেতেই অরু দুহাতে মুখ চেপে ধরে। আস্তে আস্তে পেছাতে থাকে। তবে খেয়াল না করায় পেছাতে গিয়ে বারান্দা থেকে পিছলে পড়ে যায় সে। ধুপ করে শব্দ হয়। ভেতরে থাকা ব্যক্তিরা স্পষ্ট সেই শব্দ শুনতে পায়। মস্তিষ্ক সতর্ক করতে থাকে অরুকে, ধরা পড়তে চলেছে সে।
চলবে….