#রূপবানের_শ্যামবতী
#২৩তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী
খান ভিলা আজ আবারো সেজেছে জাঁকজমক সজ্জায়। আজকের আয়োজন বেশ জমকালো। বহু মানুষের ভিড়। সকলেই নিমন্ত্রণ পেয়ে ছুটে এসেছে। উদ্দেশ্য- খান বাড়ির অপূর্ব সুন্দর এই রূপবান পুত্র আহরার খানের বউকে দেখা। না জানি সে কতো রূপবতী।
নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছে অরুনিকার পরিবারও। আহরার নিজে গিয়েছে তাদের আনতে। বাড়িতে এসেই সকলকে গেস্টরুমে আরাম করতে বলে সে চলে যায় অরুনিকাকে খবর দিতে। অরুনিকা তখন সদ্য গোসল সারতে গিয়েছে। আহরার তাকে না পেয়ে অন্যদিকে চলে যায়। এদিকে আদ্রিকা তার বুবুকে দেখার জন্য ছটফটিয়ে মরছে। তাই সে আর ধৈর্য্য রাখতে না পেয়ে একা একাই বেরিয়ে পড়ে বুবুকে খুঁজতে। সংকোচে ভরা কদম ফেলে ইতিউতি করে চাইতে চাইতে এগিয়ে যাচ্ছে সে। কিন্তু এতোবড় বাড়িতে কোনদিকে তার বুবুর ঘর সেটাই খুঁজে পাচ্ছে না সে। পথিমধ্যে আহিয়ার সাথে দেখা হতেই আদ্রিকা খুশি হয়ে গেলো। আহিয়া অবাক সুরে প্রশ্ন করে,
–আরে, আদ্রিকা তুমি? কখন এলে?
–এইতো একটু আগে। সবাই এসেছে।
–বাহ! তা কাওকে খুঁজছো নাকি?
–হ্যা, বুবুকে…
–ওহহ ভাবির ঘর তো ওপরে। সোজা গিয়ে বামে গেলেই ওদের রুম।
–আচ্ছা ধন্যবাদ।
–ঠিকাছে, যাও তবে। আমার আবার ওদিকে একটু যেতে হবে অনেক কাজ।
এই বলে ব্যস্ত পায়ে প্রস্থান করে আহিয়া। আদ্রিকা আহিয়ার কথা অনুযায়ী ওপরে যায়। তবে সে দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যায়, ডানে যাবে নাকি বামে। দুদিকেই তো ঘর। তবে ভুলে যায় আহিয়া তাকে সোজা যেতে বলেছিলো। বামে যাওয়ার কথা স্মরণ করে সে বামের ঘরেই ঢুকে গেলো। ঘরে ঢুকেই হা হয়ে চারিদিক দেখতে লাগলো। যেন কোনো নীল জগত। চারিদিকে নীলে নীলে সজ্জিত সবকিছু। মনে হচ্ছে ঘরের মালিকের নীল রং ভিষণ প্রিয়। আদ্রিকা মনে মনে ভাবছে তার আহরার ভাইয়ের নীল রং এতো পছন্দ? জানা ছিলো না। হুট করেই তার মাথায় খেলে সে আয়াজকে অনেক নীল রঙা জিনিস ব্যবহার করতে দেখেছে। অন্যমনষ্ক হয়ে ভাবনার জগতে হারিয়ে যাওয়া আদ্রিকার চমক হয় দরজা খোলার আওয়াজে। ওয়াশরুমের দরজা খুলে খালি গায়ে বেরিয়ে এলো আয়াজ। শুধুমাত্র তোয়ালে পরে থাকা আয়াজের খেয়াল হয়না সামনে কোনো রমণীর অস্তিত্ব। এদিকে আয়াজকে দেখে আদ্রিকা বিস্মিত হয়ে অবাক নয়নে চেয়ে থাকে। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই আদ্রিকাকে নজরে আসে আয়াজের। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পেছনে ফিরে আদ্রিকার উপস্থিতি নিশ্চিত করে তাড়াতাড়ি নিজের শার্টটা নিয়ে গায়ে জড়াতে জড়াতে একপ্রকার চেঁচিয়ে বলতে থাকে,
–একি তুমি? তুমি এখানে কি করছো?
আয়াজের তীক্ষ্ণ স্বরে ঘোর কাটে আদ্রিকার। তারপরই তার নজর পড়ে আয়াজের খোলা শরীরের দিকে।
–আল্লাআআআহহহ!
একটা চিৎকার দিয়ে আদ্রিকা দুহাতে চোখ ঢেকে ফেলে। দ্রুতগতিতে উল্টো ফিরে একছুটে বেরিয়ে যায়। বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেস্টরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। বুকে হাত রেখে হাঁপাতে থাকে সে। আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে নজর বুলিয়ে আস্তে করে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
অরুনিকা যখন জানতে পারে তার বাড়ির সকলেই এসেছে সে এক মুহুর্ত দেরি না করে ছুটে চলে আসে সেই ঘরে। মাকে দেখামাত্র ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাকে জড়িয়ে ধরে হাওমাও করে কাঁদতে থাকে। কতদিন পর মাকে কাছে পেলো। কতদিন পর দেখতে পেলো। আদ্রিকাও ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে তার বুবুকে। সেও কাঁদতে থাকে। এ এক মধুর মিলন! কান্নাকাটি থামিয়ে আরজু বেগম মেয়েকে নিজের পাশে বসান। কোমল স্বরে প্রশ্ন করেন,
–অরুমা, তুই এখানে ভালো আছিস তো?
কান্নামাখা স্বরেই অরুনিকা জবাব দেয়,
–আলহামদুলিল্লাহ! যতটা আশা করিনি তার চেয়েও অনেকবেশি ভালো আছি মা।
–আলহামদুলিল্লাহ! মাশাআল্লাহ! তুই ভালো থাকলেই আমার শান্তি।
পাশ থেকে সেলিনা বলে ওঠেন,
–হ্যা রে অরু, জামাই ভালো তো?
“জামাই” শব্দটা শুনে অরু খানিকটা লজ্জা পেলো। তবে সেটা প্রকাশ করলো না। নম্রসুরে জবাব দিলো,
–উনি ভালো না হলে আমি হয়তো এখানে টিকে থাকতেই পারতাম না।
সেলিনা খুশি হলেন। পরম মমতায় অরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
অরুনিকার ডাক পড়লো। একদল শ্বাশুড়ির মধ্যিখানে তাকে বসিয়ে দোওয়া হলো। ফুফু শ্বাশুড়ি, খালা শ্বাশুড়ি, চাচী শ্বাশুড়ি, মামী শ্বাশুড়ি সহ পুরো একটা শ্বাশুড়ি গোষ্ঠী। সকলেই অরুনিকাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। কারো কারো কাছে অরুর মায়াবী মুখখানা বেশ মনে ধরেছে। আবার কেউ কেউ গায়ের রং দেখে নাক সিঁটকানো শুরু করেছে। তবে মুখে কিছু বলার সাহস কেউই করে উঠতে পারছেনা। কিন্তু মামীশ্বাশুড়িদের মধ্যে একজন কোনোভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। শেষপর্যন্ত বলেই বসলো,
–আহরারের এ কেমন পছন্দ? আর কি মেয়ে পেলোনা?
বলতে বলতেই হেসে উঠলেন তিনি। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হেসে উঠলো আরো কয়েকজন। অরুনিকার হাসিখুশি মুখখানায় মুহুর্তেই আঁধার নেমে আসে। বুঝতে পারে এখন এমন অনেক কথাই হয়তো তাকে শুনতে হবে। চোখ বুজে নিজেকে শান্ত রেখে সেসব কথা শোনার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। ঠিক তখনই পরিচিত এক কন্ঠস্বর কানে এসে বারি খেতেই ঝট করে চোখ খুলে তাকায় সে। আহরার বোধহয় আশেপাশেই ছিলো। নিজের মামীর কথাটুকু শোনামাত্রই তার ঝটপট জবাব,
–কেন মামী? কেমন মেয়ে পেলে বিয়ে করা উচিত ছিলো বলুন তো?
–আরে আহরার বাবা, তুমি কত্তো সুন্দর একটা ছেলে, এমন শ্যামা মেয়েকে তোমার মতো ফর্সা ছেলের সাথে মানায়?
–ঠিক কোন নীতিতে এমনটা লিখা আছে? ফর্সার সঙ্গে শ্যামা মানায় না?
–এ তো চোখের দেখাতেই বোঝা যায়। যা কিছু দেখতে ভালো লাগবে তাই তো মানানসই।
–তাহলে তো আপনার দৃষ্টিতে সমস্যা মামী। কারণ আমার চোখে তো এই শ্যামা মেয়েটিকেই আমার পাশে মানানসই মনে হয়। তবে?
এবার পাশ থেকে আহরারের একজন চাচী ফোড়ন কেটে বলে ওঠে,
–আহরার তো আবেগে ডুবে আছে। তাই বুঝতে পারছেনা। কিছুদিন যাক বুঝে যাবে সবকিছুই।
আহরার কোনো জবাব দেওয়ার আগেই তার মামী পুনরায় বলে ওঠেন,
–তোমার মতো ছেলে এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করবে সত্যি ভাবিনি। বড় রূপের বড়াই তোমার আর তোমার পরিবারের..
–আপনাদের আর্থিক অবস্থান নিয়ে আপনারা তো বেশ গর্ব করতেন। কিন্তু আপনার মেয়ে কিভাবে একটা অটো ড্রাইভারের সাথে পালিয়ে গেলো? বেশ ভাবনার বিষয় কিন্তু।
আহরারের দেওয়া মোক্ষম জবাব তার মামী সহ সকলের মুখ বন্ধ করে দেয়। মামী যেন ভিষণ লজ্জার মধ্যে পড়ে গেলেন। মুখ লুকানোর অজুহাত খুঁজতে গিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলে দ্রুত প্রস্থান করেন সেখান থেকে।
আড়চোখে একবার আহরারকে দেখে নিলো অরু। কেমন এক প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো অরুনিকার মনটা। এই মানুষটা কিভাবে তার প্রয়োজনে হাজির হয়ে যায়? কি অসম্ভব মনের টান! এমন মানুষটা সত্যিই তার। একান্তই তার।
মূলত আহরার জানতো এতো এতো আত্মীয় স্বজনরা সকলেই অরুনিকাকে সহজে গ্রহণ করতে পারবেনা। কেউ না কেউ তাকে খোঁচা মেরে কথা বলবেই। অপমানজনক কথা বলতেও ছাড়বেনা। তাই এদের মধ্যে সে অরুনিকাকে কিছুতেই একা ছাড়তে পারবেনা। এই ভেবে সারাটাক্ষন আহরার অরুনিকার আশেপাশেই ছিলো। যখনই কারো সাথে অরুনিকার কথা চলতো সে একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনতো সবটা। না জানি তারা তার অরুকে কোন আঘাত দিয়ে ফেলে। এখনও এই শ্বাশুড়িদের দলের মধ্যে অরুনিকাকে নিয়ে আসা হলো যখন আহরার তখনও একটু দূরে দাঁড়িয়ে সবটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলো। সকলের মুখভঙ্গি, দৃষ্টি, আচার-আচরণ, কথাবার্তা সবটাই লক্ষ্য রাখছিলো সে। তাই তো যখনই তার মামী এমন একটা কথা বলে উঠলো সাথে সাথে সে এগিয়ে এসে জবাব দেয়। আহরার থাকতে অরুনিকাকে কেউ কটু কথা শোনাবে সেটা সে কিছুতেই হতে দিবেনা।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে একটু বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলো আদ্রিকা। বেশ বিলাসবহুল বাড়ি। বোঝাই যাচ্ছে বেশ খানদানি বংশের বউ হয়েই এসেছে তার বুবু। এই বাড়িটার মতোই তার বুবুর জীবনের সুখটা রাজকীয় হোক। মনে মনে এটাই প্রার্থনা করতে করতে এগোতে থাকে সে। আচমকা আয়াজের মুখোমুখও হতেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে আদ্রিকা। একটা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলো সে। তবে তার চেয়ে আয়াজের অস্বস্তির পরিমাণটা তুলনামূলক বেশি। সেটা লক্ষ করতেই আদ্রিকার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে যায়। সে আয়াজের কিছুটা কাছে এগিয়ে আসে। ভড়কে যায় আয়াজ। দু কদম পেছাতে গিয়েও পেছাতে পারেনা। আদ্রিকা বিদ্রুপের স্বরে বলে,
–কি ইংরেজি সাহেব এবার ইংরেজিতে দু চার লাইন ঝাড়ুন।
অবাক হয়ে আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আয়াজ,
–কেন হঠাৎ রাগ ঝাড়তে যাবো কেন?
–এই যে আপনার ব্যক্তিগত সম্পদ দেখে ফেলেছি যে।
চক্ষুদ্বয় বিশাল আকৃতি ধারণ করে আয়াজের। এই মেয়ে বলে কি? কন্ঠে বিস্ময়ের রেশ রেখে কোনোরকমে প্রশ্ন করে,
–মা..মানে কি? ব্যাক..ব্যাক্তিগত সম্পদ?
আদ্রিকা একেবারে মুখের সামনে এগিয়ে এসে ফিসফিসানো আওয়াজে বলে,
–যা কেবল আপনার বউ এরই দেখার অধিকার ছিলো।
আয়াজ হুড়মুড় করে আদ্রিকাকে পাশ কাটিয়ে ছুটে পালাতে চায়। আর বলতে থাকে,
–ধ্যার, পাগল মেয়ে একটা। কি সব বকে যাচ্ছে। মাথা ঠিক নেই বোধহয় তোমার। পানি খাও যাও।
বলতে বলতে পালাতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো একবার। নিজেকে বাঁচিয়ে জলদিই পগারপার হয়ে গেলো। তা দেখে আদ্রিকা হেসে কুটিকুটি। ছেলেটাকে বিপাকে ফেলতে পেরে বেশ মজা লাগছে তার। হাসি থামিয়ে এগিয়ে গেলো ছাদের দিকে। ছাদে এসে ছাদ বাগানটা দেখতেই মনটা আরো ভালো হয়ে গেলো তার। গাছগাছালি গুলো দেখতে দেখতে হাতে থাকা ফোনে টুং করে ম্যাসেজের আওয়াজ হয়। ম্যাসেজটা দেখতেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে তার। বিলম্ব না করেই ফিরতি ম্যাসেজ পাঠানোতে মনোযোগী হয় সে। এই ফোনটা তারা দুই বোনই ব্যবহার করতো। এখন তে অরু নেই তাই আদ্রিকা একাই ব্যবহার করছে। কিছুদিন হলো সে নতুন ফেসবুক আইডি খুলেছে। এই বয়সী মেয়েদের প্রথম প্রথম ফেসবুক ব্যবহারে যেমনটা হয়, বিভিন্ন মানুষের সাথে ম্যাসেজিং করতে আগ্রহটা একটু বেশিই কাজ করে। আদ্রিকারও ব্যতিক্রম নয়। একটা ছেলের সাথে বেশ কিছুদিন হলো কথা চলছে তার। যদিও আইডি দেখে চেনার উপায় নেই। তবে ছেলেটা এতো সুন্দর করে কথা বলে, আদ্রিকার মন ভালো হয়ে যায়। আদ্রিকা মন খুলে ছেলেটাকে সবকিছু বলতে থাকে। ছেলেটা তাকে গান শোনায়, কবিতা শোনায়। তার মন খারাপ থাকলে নিমিষেই ভালো করে দেয়। ধীরে ধীরে ছেলেটার প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ কাজ করতে থাকে আদ্রিকার। এই আকর্ষণ কতদূর অবধি গড়াবে জানা নেই তার।
অনুষ্ঠান শেষে সকলেই বিদায় নিয়ে চলে যায়। বিদায় নেয় অরুর পরিবারও। অরুর অনেক মন খারাপ হয়। কান্না পায়। তবুও সবাইকে বিদায় দেয়। কারণ এটাই তো মেয়েদের জীবন। নিজ পরিবার ছেড়ে অচেনা এক পরিবারকে আপন করে নিতে হয় এবং সেই পরিবারেই হয় তার পরবর্তী ঠিকানা। তখন নিজ পরিবারই হয়ে যায় পর। মাঝে মাঝে অতিথির মতো দেখা মিলবে। সময় ফুরোলে এভাবে বুকে কষ্ট নিয়ে বিদায় দিতে হবে।
যদিও মন খারাপ ভাবটা খুব বেশিক্ষণ থাকেনি। কারণ তাকে ধরে বেধে নিয়ে গিয়ে আহিয়াসহ আরো কয়েকজন জা ননদ মিলে তাকে সাজাতে লাগলো। অরুনিকা বুঝতে পারছে হঠাৎ আবার কেন সাজানো হচ্ছে তাকে। কিন্তু কাওকে প্রশ্ন করে কোনো লাভ হয়নি। কেউ কিচ্ছু বলেনি। বরং মুখ টিপেটিপে হেসেছে কেবল। সাজানো শেষে সকলেই তাকে তার ঘরের দিকে নিয়ে গেলো। ঘরে ঢুকতেই আরেকদফা অবাক হলো সে। সারাঘর ফুলে ফুলে সজ্জিত। অবাক নয়নে পুরোটা ঘরে চোখ বুলিয়ে ভাবছে অরু, “এটা কি তাদেরই ঘর?” আনমনেই সে বলে ফেলে,
–এ তো মনে হচ্ছে বাসর ঘর।
পাশ থেকে দুষ্টুমির সুরে বলে ওঠে এক জা,
–হ্যা তো, তোমাদেরই তো বাসর ঘর।
জায়ের বলা উত্তর শুনে এবং নিজের মুখ ফসকে বলা কথাটা মনে করে লজ্জায় অরুর মাথাকাটা যাওয়ার অবস্থা হয়। ইচ্ছে হচ্ছে এক ছুটে পালিয়ে যেতে। তা দেখে আহিয়া হেসে বলে ওঠে,
–থাক, থাক, আর এতো লজ্জা পেতে হবেনা। সব লজ্জা বরং আমার ভাইয়ার জন্য তুলে রাখো। একটু পরই এসে পড়বে।
আহিয়ার কথা শুনে সকলেই হাসতে থাকে। এদিকে অরুর মরি মরি অবস্থা। ইশ! কি ভয়ংকর লজ্জা! আরো এক ননদ বলে উঠলো,
–তোমাদের তো বাসর এর আয়োজন হয়নি হুট করে বিয়ে হওয়ায়। আজ অনুষ্ঠান হলো তাই বাসরের আয়োজনও হয়ে গেলো। এবার বাকিটা তোমাদের ওপর। এই চলো, এবার আমরা ঘর ফাঁকা করি। আহরার ভাই এলো বলে।
অরুনিকাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে সকলে চলে গেলো। অরুনিকা বসে বসে ভাবতে থাকে, “কি হতে গিয়ে কি হলো? এভাবে হুট করে যে সে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে যাবে ভাবতেই পারেনি। এবার কিভাবে সামলাবে সে সবটা।”
খট করে দরজা খোলার শব্দ। ধীরপায়ে আহরারের প্রবেশ। দরজা লক করে বিছানার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। ইতস্তত করতে করতে এককোণে বসে পড়ে সে। অরুনিকা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে চুপচাপ। গলা খাঁকারি দিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো আহরার। তারপর কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলতে লাগলো,
–আসলে, আমি নিজেও জানতাম না এসবকিছুর ব্যাপারে। হঠাৎ কিসব.. তুমি কিছু মনে করোনা।
অরুনিকা কোনো জবাব দেয়না। তবে আহরারকে এতো ইতস্ততবোধ করতে দেখে তার হাসি পাচ্ছে। মানুষটা এমন অদ্ভুত কেন? আচমকা অরুনিকার কি হলো কে জানে।
জানালা গলে পূর্ণিমার চাঁদের আলো ঠিকরে এসে পড়ছে মেঝেতে। ঘরজুড়ে নরম আলো ছড়িয়ে রেখেছে। চারিদিকে মোমের আলো। আহরারের সুন্দর মুখখানা প্রথমবারের মতো অরুনিকার দৃষ্টি ভেদ করে অন্তরে গিয়ে বিঁধে। এক মোহনীয় আবেশে সে পরম ভালোলাগা, ভালোবাসা নিয়ে দেখতে লাগলো আহরারকে।
কিছুটা সময় নিশ্চুপ থেকে হুট করে বলে উঠলো,
–আপনাকে কখনো সেভাবে দেখিনি বলা ভালো কখনো সাহস পায়নি দেখার। আজ খুব ইচ্ছে করছে, মন ভরে আপনাকে দেখতে।
বিস্মিত, হতভম্ব হয়ে আহরার চেয়ে আছে অরুনিকার দিকে। চক্ষুদ্বয় তার বিশাল আকৃতি ধারণ করেছে। কন্ঠস্বরও যেন রোধ হয়ে আছে। বেশ কসরত করেই গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো তার,
–এ.. এ আমি কি.. শুনছি? কার কাছে শুনছি?
পরক্ষণেই কিছুটা পিছিয়ে সরে গেলো সে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অরুকে আগাগোড়া পরখ করতে লাগলো। অতঃপর সন্দেহের সুরে খানিকটা জোর গলায়ই বলে ওঠে,
–এ্যাই.. এ্যাই তুমি সত্যি অরুনিকা তো? নাকি অরুনিকার ভুত?
অরুনিকা ভিষণ মজা পেলো। তাই তো মজা আরেকটু বাড়িয়ে দিতে সে আহরারের কাছাকাছি এগিয়ে এলো। কিছুটা ঝুঁকে খরখরে গলার স্বর বানিয়ে ভুতের মতো বলার চেষ্টা করে,
–মেয়েরা ভুত হয়না, হয় পেত্নী। কিন্তু আমি পেত্নী না আমি প্রেতাত্মা।
–হুসস!
এই বলেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় আহরার। তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,
–তুমি যে মানুষ তা আমি জানি।তবে তোমার এ অদ্ভুত পরিবর্তন হজম করতে বড্ড অসুবিধা হচ্ছে।
অরুনিকাও দাঁড়িয়ে পড়ে। কেমন অভিমানের সুরে বলতে থাকে,
–কেন? আপনাকে দেখার অধিকার কি আমার নেই?
আহরার ব্যতিব্যস্ত হয়ে জবাব দেয়,
–অবশ্যই অরু, অবশ্যই আছে। আমাকে দেখার অধিকার কেবল তোমারই আছে অরু।
–তাহলে এতো কথা না বলে একটু স্থির হয়ে দাঁড়ান তো। আমি একটু মন ভরে দেখি আপনাকে।
অরুনিকার কথা শুনে আহরার স্থির হয়েই দাঁড়ালো। ঘোরলাগা দৃষ্টিতে নিষ্পলক তাকিয়ে দেখছে অরুনিকা আহরারকে। তার দৃষ্টির গভীরতা উপলব্ধি করার সাধ্য আহরারের হলো না। বরং সে নিজেই অরুনিকার দিকে চেয়ে থাকতে পারলো না আর। দৃষ্টি সরিয়ে এদিক ওদিক এলোমেলোভাবে চাইতে থাকে। আহরারের এমন অস্থির চাহনি দেখে অরুনিকা প্রশ্ন করে,
–কি হলো?
–ইয়ে না মানে..
অরুনিকা ভ্রুঁ নাচায়। আহরার সেদিকে তাকিয়ে মাথা চুলকে লাজুক স্বরে বলতে থাকে,
–আসলে তুমি ওভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার তো সরম লাগছে।
অরুনিকা গোল গোল চোখ করে তাকায়। অতঃপর খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সে। তার হাসির শব্দে মুখরিত হলো চারপাশ। আহরার মুগ্ধ দৃষ্টিতে অরুর হাসি দেখছে। কি মারাত্মক সুন্দর হতে পারে একটা মানুষের হাসি! উফফ! আহরার তো খুন হয়ে গেলো অরুনিকার হাসিতে।
মুখে হাত চেপে অরু হাসি থামায়। কন্ঠে হাসির রেশ রেখে বলে ওঠে,
–এতোওও সরম! কই, আমার পিছু পিছু ঘোরার সময়, আমার মন পাওয়ার কত চেষ্টা, তখন তো সরম লাগেনি।
–কারণ তখন তো তুমিই সরমে মরে যেতে তাই।
–আচ্ছা তাহলে এখন থেকে আপনি সরমে মরবেন আর আমি করে যাবো বেসরম কাজ। ঠিকাছে?
আহরার আনমনেই মাথা নেড়ে বলে,
–ঠিকাছে।
পরক্ষণেই লাফিয়ে ওঠে। অরু কি বললো এটা? অরুর দিকে তাকাতেই অরুর দৃষ্টিতে দৃষ্টি আটকে যায় তার। আজ শ্যামবতীর হয়েছে টা কি? দারুন দারুন চমকে মেতে রেখেছে আহরারকে।
চমকের ওপর চমক দিতেই কিনা অরুনিকা আহরারের আরো কাছে এগিয়ে আসে। মায়াভরা চাহনি মেলে নিজের একহাত আহরারের গালে ছুঁইয়ে রাখে। আলতো পরশে হাত বুলিয়ে বলে,
–আপনি যতবার আমার পিছু নিয়েছেন, পাগলামি করেছেন আমার মন পেতে। আমি ততবার আপনাকে ফিরিয়ে দেওয়ার অযুহাত খুঁজেছি। ভয়ে, অবিশ্বাসে। আমার মতো মেয়েকে এতো সুদর্শন পুরুষ কেন পছন্দ করবে? কিন্তু জানা ছিলো না এই মানুষটার ভালোবাসা ছিলো নিখাদ, অতীব শক্তিশালী যা আমাকে বাধ্য করবে তার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াতে। আজ অরুনিকা এই মানুষটার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। তবে ভালোবাসা গ্রহণ করতে নয়। নিবেদন করতে। আজ আমি স্বীকার করছি, আপনাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। এই অরুনিকা আজ নিজেকে আপনার কাছে সমর্পণ করছে। তার মন, প্রাণ, আবেগ এমনকি…
–এমনকি? কি? বলো..
সম্মোহনীর ন্যায় স্থির হয়ে অরুর বলা কথাগুলো কর্ণগোচর করছিলো আহরার। থেমে যাওয়ায় সাথে সাথে অস্থির স্বরে বলে ওঠে সে। অরুনিকা জবাব দেয়,
–এমনকি.. ভালেবাসাও।
আহরারের অধরে ফুটে ওঠে প্রাপ্তির হাসি। আহরার আজ পরিপূর্ণ। তার আর কোনো অপ্রাপ্তি নেই। নেই কোনো আর চাওয়া। গাল ছুঁইয়ে থাকা অরুর হাতখানা টেনে নিয়ে হাতের পিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় গভীরভাবে। অতঃপর ধীরকন্ঠে বলে ওঠে,
–বিয়ের আগে অনেক পাগলামি করলেও বিয়ের পর তোমার দিকে এগোনোর সাহস পেতামনা। কারণ তোমার মন জিতার আগেই তো হুট করে বিয়ে হয়ে গেলো। জানতাম না আদৌ তোমার মনে আমার জন্য জায়গা সৃষ্টি হয়েছে কিনা। তাই তোমাকে তেমার মতো ছেড়ে দিয়েছিলাম। তোমাকে ছুঁতে গেলেও সংকোচ লাগতো যদি তুমি খারাপ ভাবো। যদি ভাবো স্বামী হয়েছি বলে অধিকার খাটাচ্ছি, সুযোগ নিচ্ছি। ভাবলাম, আমারই তো বউ। সে তো আমারই থাকবে। আজ না হয় কাল সে নিজ থেকেই ধরা দিবে আমার ভালোবাসার জগতে। অবশেষে আজ সে দিন এসেই গেলো।
মুগ্ধ নয়নে আহরারের দিকে চেয়ে আছে অরুনিকা। আহরার পরম যত্নে অরুনিকার কপালে অধর ছুঁইয়ে দিলো। প্রথম কোনো পুরুষের এমন গভীর ছোঁয়া পেলো। কেঁপে ওঠে অরুনিকা। তবে ভালোলাগার আবেশ ছিলো বেশি। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী রমনীদের তালিকায় ভাবতে পেরে শান্তির ঢেউ খেলে মনজুড়ে। চোখ বুজে অনুভব করতে লাগলো সেই সুখ।
নিভে গেলো ঘরের সকল মোমবাতি। সেই সাথে বেড়ে গেলো চাঁদের আলোর তীব্রতা। চাঁদ যেনো আজ রূপবান-শ্যামবতীর সুখমিলনের সাক্ষী হতে জানালার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। তার সমস্ত আলো উজার করে দিচ্ছে পুরো ঘরজুড়ে।
চলবে…