#রূপবানের_শ্যামবতী
#১৬তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী
গ্রামের চেয়ারম্যান আকবর চৌধুরী থম মেরে বসে আছেন চেয়ারে। পাশেই বসে আছেন আরো দুজন। দাইয়ানের দাদা মকবুল মিঞা, আরো একজন প্রবীণ ব্যক্তি নিয়ামত আলী। তাছাড়া শাহাদাতের বাবা শাহীন নিয়াজীও উপস্থিত আছেন। মূলত গ্রামের যেকোনো সালিসি কাজে তারা সকলেই উপস্থিত থাকেন। মাঝে মাঝে এসব বিচারকার্যে জসীমউদ্দিনও থাকেন। অথচ আজ তার বাড়িতেই সালিস। অপমানে মুখ থমথমে হয়ে আছে তার। বাবার সাথে জাহেদও আছেন। আজ তিনি দোকানে যাননি। গতকাল রাতেই চেয়ারম্যানের কর্মচারী এসে খবর দিয়ে গেলো চেয়ারম্যান সাহেব বসবেন। তাই আজ বাড়িতে সকলেই উপস্থিত।
বাড়ির উঠোনে চেয়ার পেতে রাখা আছে। কিছু দখল আর কিছু ফাঁকা। অারজু বেগম আর সেলিনা ভেতরের বারান্দায় বসে আছেন। তাদের সঙ্গে গ্রামের আরো কিছু মহিলাও রয়েছেন। বারান্দা থেকে উঠোনটা দেখা যায়। তাই কি চলছে বা কি কথা হচ্ছে সবটাই তারা জানবে। এদিকে অরুনিকা বারান্দার সাথে লাগোয়া ঘরটির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে খানিকটা আড়াল হয়ে। সঙ্গে আদ্রিকাও। এই মুহূর্তে লজ্জায়, অপমানে যতোটা না তার কষ্ট হচ্ছে তার চেয়েও বেশি ভয় কাজ করছে। যেটার ভয় পেয়েছে এতোদিন তা-ই হয়ে গেলো না তো। তার চরিত্রে কলঙ্কের দাগ না লেগে যায়। তবে যে এ সমাজে তার বেঁচে থাকাই দায় হয়ে যাবে। ভুল না করেও কি তাকে শাস্তি পেতে হবে?
কথা ছিলো খুব একটা মানুষজনের উপস্থিতি থাকবেনা। কিন্তু গ্রামের কৌতুহলী মানুষজনদের দমানো সম্ভব হলো না। ইতিমধ্যে অনেকেই উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে।খুব শীঘ্রই ভিড় বেড়ে যাবে।
এরমধ্যে শাহাদাতও উপস্থিত। তার সঙ্গীদের নিয়ে। আয়েশি ভঙ্গিতে জায়গামতো বসে এবার বিচারকার্য উপভোগ করবে তারা। তাদের মধ্যে একজন শাহাদাতকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–যাক ওদেরকে এইভাবে ফাঁসিয়ে ঠিকই করেছো ভাই। এটাই ছিলো সবথেকে মোক্ষম চাল।
শাহাদাত হেসে ওঠে। তারপর কিছুটা বিরক্তির সুরে জবাব দেয়,
–তোদের কি মনে হয় এই কাজ আমি করেছি?
–তুমি ছাড়া আর কে করবে শাহাদাত ভাই?
–ধুররর! আমি জানিইনা ওই শহুরে আহরারের বাচ্চা এখনো গ্রামে আছে। আমি ভেবেছিলাম মার খেয়ে ভেগেছে বোধহয়।
–তাহলে কে ছড়ালো এই কথা?
শাহাদাত চিন্তিত ভঙ্গিতে জবাব দেয়,
–জানিনা কে করেছে। তবে যে করেছে সে আমার অনেক উপকার করেছে। হাহ! এসব ভাবনা ছেড়ে এখন মজা নে।
গলা খাঁকারি দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন নিয়ামত আলী,
–তাহলে কথাবার্তা শুরু করা যাক।
মকবুল মিঞা সম্মতি জানিয়ে বলেন,
–চেয়ারম্যান সাহেব আপনি বলেন।
আকবর চৌধুরী গ্রামের চেয়ারম্যান হিসেবে যথেষ্ট সৎ ও নিষ্ঠাবান একজন মানুষ। ন্যায়পরায়াণ, সুবিচারক হিসেবে এই গ্রামসহ আশেপাশে বহু বহু গ্রামে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে আছে। তিনি অরুনিকাকে ভালোভাবেই চেনেন এবং যথেষ্ট ভালো মেয়ে বলেই জানেন। সেই মেয়েকে নিয়ে তার কাছে অভিযোগ এসেছে। গ্রামের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি তার কাছে এসেছিলেন এবং জানিয়েছেন, ইদানীং অরুনিকাকে মকবুল মিঞাদের পুরাতন আড়ত ঘরে যাওয়া আসা করতে দেখা গিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায় বেশকিছুদিন ধরে সেখানে এক শহুরে ছেলের বাস। সেই ছেলে আর কেউ নয় মকবুল মিঞার নাতির বন্ধু। এমন এক জোয়ান ছেলের ঘরে কুমারী মেয়ের এরূপ যাতায়াত দৃষ্টিকটু তো বটেই। এর একটা বিহিত করা প্রয়োজন।
তাদের কথা শুনে আকবর চৌধুরী বেশ ভাবনা চিন্তা করে অরুনিকাদের বাড়িতে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মোটেও এখানে বিচার করতে আসেননি অথচ গ্রামের মানুষদের মুখে মুখে রটেছে এখানে আজ বিচার চলবে।
ধীরভাবে শ্বাস ফেলে আকবর চৌধুরী গলা পরিষ্কার করে নেন। জসীমউদ্দিনের উদ্দেশ্যে গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠেন,
–আজ এখানে এভাবে বসার কারণ তো আপনি ভালোভাবেই জানেন চাচা। গ্রামে যেটা ছড়িয়েছে খুব একটা ভালোভাবে তা ছড়ায়নি। এখন যদি আপনি অনুমতি দেন তো আমি আপনার নাতনির সাথে কথা বলতে চাই।
–যা বলার আমার সাথে বলুন। অরুনিকাকে এর মধ্যে টানার কোনো প্রয়োজন নেই। ও সম্পূর্ণ নির্দোষ।
শক্ত, কঠিন পুরুষালী আওয়াজ শুনে উৎস অনুসরণ করে তাকায় সবাই। আচমকা থেমে গেলো সকল কোলাহল। নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। অপলক ভাবে সকলেই চেয়ে আছে সেই মানুষটির দিকে যাকে ইতোপূর্বে কেউ কখনো দেখেনি বা দেখার সুযোগ পায়নি। এমন সুশ্রী মুখাবয়বের অধিকারী, যার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি যেন সবকিছুই সৃষ্টিকর্তার অতি যত্নে গড়া। নিঁখুত গড়নে পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য বোধহয় তাকেই ঢেলে দেওয়া হয়েছে। ঘোর কাটলো সকলের দাইয়ানের গলার আওয়াজে। “আহরার” বলে ডাক ছেড়ে সে এগিয়ে এলো। উদ্বিগ্ন স্বরে বলতে লাগলো,
–আহরার। তুই এসে গেছিস। তোর জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম। দোস্ত, কি থেকে কি হয়ে গেলো কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা। কিভাবে সবটা ম্যানেজ করবি এখন?
দাইয়ানের কাঁধে হাত রেখে আহরার ভরসা দেয়,
–আমার ওপর ছেড়ে দে সবটা। চাপ নিস না। আই উইল ম্যানেজ।
কথাটুকু শেষ করে সামনে তাকালো সে। আশেপাশে সবার দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো। বাদ গেলোনা দূরে ঘরের দরজার কোণে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা ভীতসন্ত্রস্ত অরুনিকাও। দৃষ্টি ফিরিয়ে এবার দৃঢ়তার সাথে সামনে এগিয়ে গেলো আহরার। আকবর সাহেবের কাছাকাছি এসে সরাসরি তাকে উদ্দেশ্য করে নম্র তবে দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠে,
–আপনি সম্মানীয় ব্যক্তিত্ত্ব সেই সাথে জ্ঞানী ও বিচক্ষণও বটে। আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ জনসম্মুখে একটা মেয়েকে দাঁড় করিয়ে তার নামে রটা মিথ্যে নোংরা রটনা নিয়ে তাকে প্রশ্ন করবেননা। এতোদিন ধরে একটু একটু করে তার অর্জিত সম্মান এভাবে এক লহমায় মিশে যেতে দিবেন না। আপনার যা জিজ্ঞাসাবাদ তা আমায় করুন। আমি নিশ্চিত করছি সবকিছুর সঠিক উত্তরটাই পাবেন।
আকবর সাহেব প্রখর দৃষ্টিতে দেখছেন আহরারকে। ছেলেটার কথার ধার অনেক তীব্র। যতোটা সুন্দর গুছিয়ে মার্জিতভাবে কথাগুলো সে বললো তাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা আকবর সাহেবের নেই। মনে মনে ভাবনাগুলো ভেবে নিলেন। তারপর বেশ অমায়িক সুরেই জবাব দিলেন,
–ঠিকাছে। তুমি আগে বসো।
ফাঁকা এক চেয়ার টেনে এনে ঠিক আকবর সাহেবের মুখোমুখি রেখে তাতে বসে পড়লো সে। সকলেই কিছুটা অবাক হলো। একেবারে চেয়ারম্যান সাহেবের সামবে বসে পড়া পড়ার সাহস দেখানোর জন্য। আহরার হালকা হেসে বলে,
–কথাবার্তা সামনাসামনি হওয়া উচিত। আগে পিছে নয়। ঠিক বলছি?
আকবর সাহেবও সমানতালে হেসে জবাব দেন,
–হুম! নিশ্চয়ই।
সকলের মধ্যে আহরারকে নিয়ে এমনিতেই চাপা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে তার রূপ নিয়ে। অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, “এমন চাঁদের মতোন ছেলেটার সঙ্গে ওমব শ্যামলা মেয়ে অরুনিকার সংযোগ হলো কেমনে? কিভাবে সম্ভব?”
আকবর সাহেবের গমগমে আওয়াজে থেমে যায় সব।
–সবাই চুপ করুন।
আহরারের দিকে তাকিয়ে বলেন,
–বলো এবার, কি বলার আছে তোমার। এই যে গ্রামের মানুষের অভিযোগ তোমার সাথে অরুনিকার অবাধ মেলামেশা যেটা এই গ্রামের পরিবেশ খারাপ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই ব্যপারে তুমি কি বলবে?
আহরার আরে একবার অরুনিকার দিকে তাকায়। স্পষ্ট বুঝতে পারলো অরুনিকা কাঁদছে। কিন্তু কেন? অসম্মানের ভয়ে? আহরার থাকতেও ভয়। মৃদু হাসলো আহরার। পরক্ষণেই নিজের মুখাবয়ব পরিবর্তন করে নেয়। নিজের দৃঢ়তা বজায় রেখেই আকবর সাহেবের উদ্দেশ্যে জবাব দিতে প্রস্তুত হয়। আর তার প্রশ্নের জবাব হিসেবে শুরুতেই সে একটি বিস্ফোরক বাক্য উচ্চারণ করে যা মুহুর্তেই সেখানে শোরগোল বাড়িয়ে দিয়েছে।
আহরার সরাসরি বলে বসলো,
–আমি অরুনিকাকে পছন্দ করি এবং বিয়ে করতে চাই।
গ্রামের মানুষজনদের যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে এমন একটা ছেলে অরুনিকার মতো মেয়েকে পছন্দ করতে পারে এমনকি তার জন্য বিয়েরও প্রস্তাব দিতে পারে।
জসীমউদ্দিন, জাহেদ, সেলিনা বাকশূন্য হয়ে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আহরারের দিকে। আরজু বেগম ভীষণভাবে চমকে গিয়েছেন। তিনি একবার পিছু ফিরে অরুনিকার দিকে তাকান। অরুনিকা মাথা নিচু করে কেঁদেই যাচ্ছে। আরজু বেগম পুনরায় সামনে ফিরে আহরারকে আরো একবার ভালো করে দেখলেন। এই ছেলেকে তিনি আগেও দেখেছেন। তবে মুখটুকু দেখা হয়নি। দাইয়ানের চাচীদের কাছে ছেলেটার অনেক প্রশংসাও শুনেছেন তিনি। তবে যখন জানলেন এই ছেলের জন্যই গ্রামে তার মেয়ের বদনাম রটেছে তখন তার ভিষণরাগ হয়েছে। কিন্তু ছেলেটার এমন অকপটে নিজের পছন্দের কথা স্বীকার করা এবং সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার সাহস দেখে তিনি চরম বিস্মিত হয়েছেন।
আকবর সাহেব কিছু বলার পূর্বেই আহরার বলে ওঠে,
–যেদিন প্রথম এই গ্রামে প্রবেশ করলাম সেদিন অদ্ভুতভাবে প্রথমেই অরুনিকাকে চোখে পড়েছিলো। নিজের অজান্তেই একটা ভালো লাগা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো। তারপর ওকে কাছ থেকে যত দেখতে লাগলাম তত সেই ভালোলাগা গাঢ় হতে লাগলো। একটা সময় অনুভব করলাম আমি হয়তো মেয়েটাকে মন থেকেই পছন্দ করে ফেলেছি। তাকে নিজের জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পাওয়ার একটা তীব্র আকুলতার সৃষ্টি হলো। আমি নিজের মনের কথা তাকে জানালাম। তবে মেয়েটা ভিষণ শক্ত মনের অধিকারী। সে আমাকে ফিরিয়ে দিলো। যতবার সে আমাকে ফিরিয়ে দেয় আমি তত তার পিছু নিতে থাকি। কিন্তু কিছুতেই তার মন পাইনা। তবে আমিও পণ করেছি তার সম্মতি অর্জন ব্যতীত আমি পিছু হটছিনা। আপনাদের কাছে মনে হয়েছে এখানে ভুল কিছু হচ্ছে। অথচ সবকিছুই ছিলো ভদ্র ও সভ্যভাবে। যা কিছু করেছি সব তো আমিই করেছি। এখানে তবে অরুনিকার দোষটা কোথায়? আমাদের সমাজব্যবস্থা সবকিছুতে নারীদের দোষী বানাতে অভস্ত্য। তারা বিচার বিবেচনা, যুক্তিতর্ক ভুলে কেবল নারীকে দোষী সাবস্ত করার চেষ্টায় মত্ত থাকবে। একবারও কেউ গোড়াটা যাচাই করে দেখার চেষ্টা করবেন না যে আসলেই মেয়েটা দোষী কিনা। যেই মেয়েটাকে আপনারা সবাই এতো বছর ধরে দেখেছেন, যাকে ভালো মেয়ে হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যার প্রশংসা করেন অথচ মিথ্যে, বানোয়াট তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মুহূর্তেই তাকে কিভাবে খারাপ মানুষ বানিয়ে দিলেন।
দম নেয় আহরার। কিছুটা সময় নিশ্চুপ থাকে। নিরব থাকে বাকিরাও। কেউ কোনো কথা বলেনা। সবাই যেন গভীরভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে আহরারের বলা কথাগুলো। সবথেকে বেশি অবাক করেছে সবাইকে যে এই ছেলেটা অরুনিকার মন পাওয়ার জন্য তার পিছু পিছু ঘুরেছে। একেরপর এক অবিশ্বাস্য সব ধামাকা পাচ্ছে আজ সকলে। আড়চোখে একবার অরুনিকার দিকে চেয়ে পুনরায় ধীরকন্ঠে বলে ওঠে আহরার,
–অরুনিকা শুদ্ধ, পবিত্র। শিশিরভেজা পুষ্পের ন্যায় শুভ্র, স্বচ্ছ সে। যাকে দেখলেই গভীর এক শ্রদ্ধাবোধ কাজ করবে। সম্মানে নুয়ে আসবে মস্তক। এমন মানুষকে অতি মূল্যবান রত্নের মতো যত্নে রেখে দিতে হয়। তাকে নিয়ে এভাবে বিচার বসানো যায়না।
কথা সম্পন্ন করে আহরার আকবর সাহেবের দিকে দৃষ্টি ফেরায়। আকবরসাহেব মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় সবটা শুনছিলেন। এই ছেলেটার প্রতি অদ্ভুত এক শ্রদ্ধা কাজ করছে তার। কোনো পুরুষ কোনো নারীকে এতোটা সম্মান করতে পারে তা এই ছেলেকে না দেখলে বোধহয় তার জানা হতো না। ভেতরে চেপে রাখা তপ্ত শ্বাসটুকু সন্তর্পণে ছেড়ে দেন। তারপর আহরারের উদ্দেশ্যে বলেন,
–এতোটা সম্মান যখন দিতে পেরেছো তখন পুরোপুরি ভাবেই দাও। বিয়ে করে নাও অরুনিকাকে। আজ, এক্ষুনি। পুরো গ্রামকে সাক্ষী রেখে। প্রমাণ করে দাও এই মেয়েটা তোমার কাছে কতোটা সম্মানীয়। তার মান মর্যাদা তোমার কাছে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। বলো, পারবে? এই সৎসাহস কি তোমার হবে?
আকবর সাহেবের কথায় বাকিরাও সম্মতি প্রকাশ করেন। আহরার জবাব দেয় না। মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ায় সে। ধীরপায়ে এগিয়ে যায় আরজু বেগমের কাছে। তার সামনে এসে হাঁটুগেড়ে বসে সে। আরজু বেগম ভড়কে যান। নড়েচড়ে ওঠেন তিনি। আহরার ওভাবেই বসে থাকে। দুহাত জোড় করে চোখ নামিয়ে রাখে। নত মস্তকে শান্ত স্বরে বলে ওঠে,
–একজন মা তার মেয়ের বিয়ে নিয়ে শুধু একটিই চিন্তা করে যান,তার মেয়েটা সুখী হবে কিনা। একজন বিশ্বাসী, ভরসার মানুষ খোঁজেন যার হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্তে দিন অতিবাহিত করতে পারবেন।
চোখ তুলে তাকায় আহরার। দেখতে পায় আরজু বেগম মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকে দেখছেন ও তার কথা শুনছেন। আহরার পুনরায় বলে ওঠে,
–আমি আপনার সেই বিশ্বাসী ও ভরসার মানুষ হয়ে উঠতে চাই যার হাতে নিজের মেয়েকে আপনি বিনা দ্বিধায় তুলে দিতে পারবেন। আজ এই পুরো গ্রামের সামনে কথা দিচ্ছি, যতোটা আপনি আগলে রেখেছেন এতোদিন ততোটা না পারলেও ততখানি চেষ্টা করে যাব আজীবন। অরুনিকা আমার বহু কষ্টে অর্জিত অতি মূল্যবান সম্পদ যাকে আমি নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখতে চাই। আমাকে কি এই সুযোগটা দিবেন? অরুনিকাকে আমার হাতে তুলে দিবেন প্লিজ। আপনার অনুমতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আরজু বেগমের মনটা শীতলতায় ভরে গেলো যেন। এমন একটা ছেলে তিনি বরবারই নিজের মেয়ের জন্য চেয়েছেন। কিন্তু তারপরও কেন যেন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন তিনি। কিছু বলতে যাবেন তার আগেই কারো গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে থেমে গেলেন তিনি।
কেউ একজন শক্ত কন্ঠে “আহরার” বলে ডেকে উঠেছেন।
ডাক শুনে আহরার পিছু ফিরে। নিজের বাবাকে দেখে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। কিছু বলতে উদ্যত হতেই আকবর সাহেব বলে ওঠেন,
–আরে আপনি? আফতাব সাহেব? আপনি? আমার গ্রামে। কি সৌভাগ্য আমার।
আফতাব সাহেবও ভদ্রতাসূচক হেসে হাত মিলানোর উদ্দেশ্য হাত বাড়িয়ে বলতে থাকেন,
–আমারো ভালো লাগছে আকবর সাহেব আপনাকে দেখতে পেয়ে।
ব্যবসায়িক খাতিরে শহরে যাতায়াত থাকে আকবর সাহেবের। বেশ কয়েকবার আফতাব খানের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে তার। সেইসূত্রেই তারা ভালোই পরিচিত। তবে আকবর সাহেব বুঝতে পারছেন না আফতাব খান হঠাৎ এখানে কেন?
তবে তিনি সকলের উদ্দেশ্যে পরিচয় করিয়ে দেন আফতাব খানকে।
–প্রিয় গ্রামবাসী। উনি আমার পরিচিত বন্ধু বিশেষ। বিশিষ্ট শিল্পপতি। শহরজুড়ে তার অনেক খ্যাতি।
–আরে আকবর সাহেব, এটা বেশি বেশি বলছেন। এমন কিছুই নই আমি। আপনাদের মতোই সাধারণ।
গ্রামের মানুষজন বুঝতে পারলো এই লোকটি বেশ উচ্চ পর্যায়ের মানুষ। তারা সকলেই বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছে আফতাব খানকে।
ওদিকে আহরার ঈশারায় দাইয়ানের কাছে জানতে চাইলো তার বাবা এখানে কিভাবে? দাইয়ানও ঈশারায় জানায় সে-ই খবর দিয়ে আনিয়েছে।
আহরার এগিয়ে গেলো আফতাব সাহেবের দিকে,
–বাবা!
সকলে যেন আরেকদফা অবাক হলো। আহরার এই বিশিষ্ট ব্যক্তিটির পুত্র ব্যপারটা সবাইকে বিস্ময়ের চূড়ায় পৌঁছিয়ে দিলো। আকবর সাহেব হতবাক কন্ঠে বলে ওঠেন,
–ও আপনার ছেলে?
–জি আমার ছেলে। আমার যোগ্য সুপুত্র।
বলতে বলতে আহরারের পিঠ চাপড়ে দেন তিনি। এখানকার পরিস্থিতি সবটাই তিনি জানেন। দাইয়ানের খবর পেয়ে তিনি যখন এখানে আসছিলেন দাইয়ানকে বলেছিলেন ভিডিও কলে যুক্ত থেকে সবকিছু যেন তাকে দেখায়। তিনি দেখেছেন সবটা। ছেলের বলা সবকটা কথাও শুনেছেন। গর্বে তার বুকটা ভরে গেছে। কারণ তিনিও একটাসময় এভাবেই সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে আহরারের মা তাসফিয়াকে বিয়ে করে নিয়ে গিয়েছিলেন।
–বাবা, তোমাকে আমি সবটা বুঝিয়ে বলছি..
–আমাকে কিছু বোঝাতে হবেনা রে পাগলা। আমি সবটা জানি। আর এসেছি যখন তখন একেবারে ছেলের বউ নিয়েই ফিরি। কি বলিস?
বলতে বলতেই চোখ টিপে দেন আফতাব সাহেব।
–বাবা… সত্যি?
আফতাব সাহেব জসীমউদ্দিন এবং আরজু বেগম দুজনের উদ্দেশ্যে সামনে এসে দুহাত জোড় করে বলেন,
–আমার ছেলেকে আমি যতটা চিনি তাতে একটা জিনিস আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, ও কিন্তু ওর ওয়াদার বরখেলাপ করেনা। নিজের ওয়াদা রক্ষার জন্য জানপ্রাণ লাগিয়ে দিবে সে এটুকু গ্যারান্টি আমি দিতে পারি। তাই আমি অনুরোধ করবো আপনাদের মেয়েটাকে আমার ছেলেটার জন্য দিয়ে দিন।
জসীমউদ্দিন নমনীয় হেসে জবাব দেন,
–আপনার মতো মানুষ অনুরোধ করছেন আমার নাতনির জন্য আর আপনার ছেলের কথাতে আমি যে জোর দেখেছি তাতে আমার অন্তত অমত করার আর জায়গা নেই। এবার বড়বউ বলুক তার কি মত?
আফতাব সাহেব আরজু বেগমের দিকে তাকান।আরজু বেগম ভিষণ বিব্রত হয়ে পড়েন। তিনি একবার শ্বশুরের দিকে তাকান। জসীমউদ্দিন ঈশারায় রাজি হতে বলেন। তা দেখে আরজু বেগমও এবার নম্র স্বরে জবাব দেন,
–বেশ! আমারও তবে আপত্তি নেই।
এ পর্যায়ে জাহেদ মুখ খোলেন,
–বাবা, ছেলে চাইছেন ভালো কথা কিন্তু পরিবারের বাকি সদস্যরা কি মেনে নিবেন?
আফতাব সাহেবের ভেতরে একটা ভয় খেলে গেলো জাহেদের কথা শুনে। তার মা গুলবাহার বেগম। যে আজও পর্যন্ত তাসফিয়াকে মেনে নেয়নি সে কি অরুনিকাকে মেনে নিবে। কিন্তু ছেলের মুখের তাকিয়ে এই ভয়টাকে তিনি উড়িয়ে দিলেন। হাসিমুখে বললেন,
–ছেলে রাজি, ছেলেরা বাবা রাজি আর ছেলের মায়েরও কোনো আপত্তি হবেনা। ব্যস! আর কার মতের প্রয়োজন?
আরজু বেগম অরুনিকার কাছে আসেন। মেয়েটার কান্না থেমে গিয়েছে। কারণ যখন থেকে আহরারের সাথে তার বিয়ের কথা চলছে সে প্রথমে থমকে গেলেও পরবর্তী একপ্রকার ঘোরের মধ্যে চলে যায়। অস্থির হয়ে পড়ে সে। কেন এই অস্থিরতা তা সে বুঝতে পারেনা। আরজু বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কোমলস্বরে প্রশ্ন করেন,
–অরুমা! এই বিয়েতে তোর কোনো আপত্তি নেই তো?
পাশ থেকে আদ্রিকা ফিসফিসিয়ে বলে যাচ্ছে,
–না বুবু না দোহায় তোমার। মানা কোরো না।
কি জানি কি ভেবে অরুনিকার আর আপত্তি করার সাহস হলো না। সে ধীরভাবে দু পাশে মাথা নাড়িয়ে আপত্তি নেই বোঝায়। আরজু বেগম খুশি মনে চলে যান। শ্বশুর, দেবরকে উদ্দেশ্য করে সবকিছুর ব্যবস্থা করতে বলেন। এদিকে আকবর সাহেবও আফতাব সাহেবের অনুমতি নিয়ে তার কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ভালো একজন কাজীর ব্যবস্থা করতে। যত দ্রুত সম্ভব যেন বিয়ের আয়োজন হয়।
দাইয়ান, রাদিফ, ঈশান এসে আহরারকে হালকা ধাক্কা দিতে থাকে আর বলতে থাকে,
–কি গো রূপবান! অবশেষে তোমার শ্যামবতীকে তুমি পেয়েই যাচ্ছো।
বলতে বলতে সকলে চাপা হাসিতে ফেটে পড়ে। এদিকে আহরার লাজুক হেসে কপালে আঙুল ঘষতে থাকে। আড়চোখে একবার সেই ঘরের দরজার দিকে চাইতেই দেখতে পায় আড়াল থেকে চোরাচোখে চেয়ে থাকা অরুনিকাকে।
চলবে…