রূপবানের শ্যামবতী পর্ব-১১

0
662

#রূপবানের_শ্যামবতী
#১১তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী

ভোরের আলো ফুটতেই পাখিদের কলকাকলীতে মুখরিত হলো চারপাশ। সদ্য উদিত হওয়া সূর্যের কিরণ এসে চোখে লাগে অরুনিকার। পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায় সে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। বাহির হতে ঘরে প্রবেশ করা শুভ্র আলো দেখে অরুনিকার ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে আলতো হাসি। বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায় সে। ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশে মন জুড়িয়ে যায়। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শুনে আনমনা হয়ে চেয়ে থাকে অরুনিকা। চোখ বুজে এই মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে থাকে। আচমকা চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে কাল রাতের ভয়াবহ ঘটনা। ধরমড়িয়ে চোখ খুলে ফেলে সে। যেন চোখ বোজা থাকলেই সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। জানালার কাছ থেকে সরে গিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। হাত পা কাঁপছে তার। ভয়ে শরীর কেমন ঝিমিয়ে আসছে। শুকনো ঢোক গিলে যাচ্ছে বারবার। মনে হচ্ছে যেন এখনি সেই ঘটনা ঘটলো তার সাথে। চোখ বুজে আরো একবার পুরো ঘটনা মনে করতে চাইলে হুট করে আহরারের মুখ ভেসে ওঠে তার সামনে। ধীরে ধীরে চোখ খুলে জানালার বাইরে দৃষ্টিপাত করে সে। “যদি মানুষটা ঠিক সময়মতো না আসতো? কি হতো আজ অরুনিকার?” প্রথমবারের মতো আহরারের কথা ভেবে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেলো অরুর মধ্যে। নিজেকে ধাতস্থ করে নিতেই দরজা খুলে কারো ভেতরে প্রবেশের শব্দ শুনতে পায় সে। সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পায় আদ্রিকা কেমন চোরের মতো নিঃশব্দে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করছে। ঘরে ঢুকে সামনে চাইতেই অরুকে বসে থাকতে দেখে একগাল হেসে বলে,

–ওমা! বুবু, তুমি উঠে পড়েছো? আমি ভাবলাম তুমি এখনো ঘুমাচ্ছো। তোমার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে যেন তাই আস্তে আস্তে আসছিলাম।

অরুনিকা কিছু না বলেই পুনরায় জানালার বাইরের দিকে চেয়ে থাকে। আদ্রিকা এসে পাশে বসে পড়ে। নম্র স্বরে বলে ওঠে,

–বুবু, মন খারাপ করে বসে আছো কেন?

চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখে হাসির ঝিলিক ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে অরু। বোনের দিকে তাকিয়ে বলে,

–আমি মন খারাপ করে নেই বনু।

–সত্যি?

–হুম একদম সত্যি।

–তাহলে চলো বাইরে চলো।

–এখুনি উঠলাম। বাইরে পরে যাই?

–না বুবু, তুমি ঘুমিয়ে থাকলে কিছু বলতাম না। যেহেতু তুমি উঠে পড়েছো তাই এখন তো যেতেই হবে?

–কি ব্যাপার বল তো? এমনভাবে যেতে বলছিস যেন জরুরী কাজ আছে।

–জরুরী কি না সে তো গেলেই বুঝতে পারবে। চলো তো চলো।

আদ্রিকা অরুনিকাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিলো। বাইরে বের হয়ে বাগানের দিকে নিয়ে গেলো। তারপর হুট করেই অরুনিকাকে দাঁড় করিয়ে রেখেই সে ছুটে চলে গেলো। এদিকে অরুনিকার কোনো কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। আদ্রিকা চলে যেতেই আলগোছে সামনে তাকাতেই পিলে চমকে ওঠে তার। ভুতের মতো সাঁই করে সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে আহরার। এমন অসময়ে নিজের বাড়িতে আহরারকে দেখে যতোটা না অবাক হয়েছে তার চেয়েও বেশি ভীতি কাজ করছে। যদি কেউ দেখে ফেলে? আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে নজর বুলিয়ে আহরারকে চাপা স্বরে প্রশ্ন করে সে,

–আপনি এখানে কেন এসেছেন?

আহরারও অরুনিকার স্বরকে নকল করেই একই ভঙ্গিতে বলে উঠে,

–আমার শ্যামবতীকে দেখতে।

আহরারের উচ্চারিত বাক্যমালার জন্যই হোক কিংবা তার বলার ভঙ্গিতেই হোক কথাটুকু শুনে শিরশির করে ওঠে অরুনিকার সারা শরীর। অাহরার পুনরায় বলে ওঠে,

–তুমি ঠিক আছো তো অরু?

আহরারের কন্ঠস্বরে কেমন দুঃশ্চিন্তা প্রকাশ পাচ্ছে। অরু সরাসরি আহরারের চোখের দিকে তাকায়। সেই চোখে একরাশ মায়া আর মুগ্ধতার ছড়াছড়ি। যা হয়তো অরুর জন্য প্রকাশ পাচ্ছে। চোখে চোখ রেখেই অরুনিকা ওপর নিচ মাথা দুলিয়ে জবাব দেয়,

–হুম। ঠিক আছি।

স্বস্তির শ্বাস ফেলে আহরার। কিছু সময় নীরব থেকে বলে,

–অরু!

–হুম!

–আমি চলে যাচ্ছি।

ঝট করে ফিরে তাকায় অরু। আহরারের চলে যাওয়ার কথা শুনে কিছু একটা কি হলো তার? কি হলো? হয়তো একটু খারাপ লাগার সৃষ্টি হলো। স্বাভাবিক। একটা মানুষকে বেশ কয়েকদিন চোখের সামনে দেখেছে তাই তার চলে যাওয়ার কথা শুনে এটুকু মায়া তো কাজ করতেই পারে। অরু একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে আহরারের দিকে। জবাব না পেয়ে আহরার আবারও বলে উঠে,

–কিছু বলবে না তুমি?

–কি বলবো?

–আমার চলে যাওয়াতে তোমার খারাপ লাগছে না?

–নাহ।

অরুর সোজাসাপ্টা জবাবে আহরারের অন্তরে যেনো সুঁচ এসে বিঁধলো। করুণ স্বরে বলে উঠে,

–সত্যিই? আমার চলে যাওয়া না যাওয়ায় কিছুই যায় আসে না তোমার?

–এতোদিন আপনার জ্বালাতনে খারাপ লাগলেও কালরাতে আপনি আমাকে অনেক বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। আর তাই আপনার প্রতি রাগ বা বিরক্তি যা-ই ছিলো সবটাই চলে গিয়েছে। এখন আপনার প্রতি একটা সম্মান আর শ্রদ্ধাবোধ কাজ করছে। সেটা সর্বদা থাকবে। ব্যাস! এটুকুই।

অরুনিকার কথা শেষ হতেই আহরার মৃদু শব্দে হাসলো। সেই হাসিতে স্পষ্ট বেদনার ছাপ। এই বেদনা আশা নিরাশায় পরিণত হওয়ার বেদনা। যা অরুনিকা বুঝতে পারা সত্ত্বেও অবুঝ হয়েই রইলো। সুগভীর চাহনি মেলে শেষবার তার শ্যামবতীকে চাইলো আহরার। অতঃপর কোমলস্বরে বললো,

–কাল রাতে তোমাকে আমার মনের কথা জানিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি। উত্তরের জন্য আমি জোরাজোরি করবো না। তবে আশাও ছাড়বো না। এই যে আমি চলে যাচ্ছি। এই যাওয়ায় কিন্তু শেষ যাওয়া নয়, সুনয়না। আমি আবার ফিরবো। আমার উত্তরের জন্য ফিরবো। যতদিন না আমি আমার কাঙ্ক্ষিত উত্তর পাচ্ছি…

কথাটুকু থামিয়ে কিছুটা এগিয়ে এলো আহরার। অরুনিকার দিকে ঝুঁকে কানের কাছে এসে মৃদু স্বরে বাকি কথাটুকু সম্পূর্ণ করলো,

“আমি তোমার পিছু ছাড়ছি না।”

কথা শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আহরার নিজের এক হাত এগিয়ে নিয়ে যায় অরুনিকার দিকে। তার হাতে একটা কালো গোলাপ। সেই গোলাপটি অরুর কানের ওপর গুঁজে দেয় পরম যত্নে। পুরোটা সময় অরু নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। কোনো কিছুতেই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। আহরার পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই আবার দাঁড়িয়ে পড়ে। পিছু না তাকিয়েই বলে,

–সাবধানে থেকো অরু। নিজের যত্ন নিও। তুমি কিন্তু আমার অতি মূল্যবান সম্পদ যা তোমার কাছেই আমানত রেখে গেলাম। এই আমানতের যেন খেয়ানত না হয়।

আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে আহরার চলে যায়। পলকের মধ্যেই যেন গায়েব হয়ে গেলো সে। অরুনিকা তখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো মনের কোনো না কোনো কোণে চিনচিনে ব্যাথাও অনুভূত হচ্ছে। তবে এই অনুভূতির কোনো প্রশ্রয় নেই অরুনিকার কাছে। বিশাল আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়ে স্বগোতক্তি করে অরু,

“আমি নিজের সীমাবদ্ধতা জানি। আর আমার সেটা মনে রাখা উচিত…সর্বদা।”

~~~
“খান ভিলা” তে আজ উৎসবমুখর পরিবেশ। চারিদিকে সাজসাজ রব। দীর্ঘ ৮ বছর পর বাড়ির মেয়ে বাড়িতে ফিরছে আজ। তাই তাকে ঘিরে কত-শত আয়োজন চলছে।
খান বাড়ির কর্তী গুলবাহার বেগম। তার দুই ছেলে আফজাল এবং আফতাব। সেই দুই ছেলের বউ ফারজানা এবং তাসফিয়া। বড় ছেলের চার সন্তান এবং ছোটো ছেলের দুই সন্তান নিয়ে এই ভরা সংসার তার। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়লেও এখনো বাড়িতে তার কতৃত্ব বিরাজমান। আজ তার বড় ছেলের ঘরের ছোটো নাতনী সূদুর অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরবে। তাই তিনি বিশেষ তদারকিতে ব্যস্ত। যেন সবকিছু তার নাতনীর পছন্দমতো হয়। আটটা বছর মেয়েটা নিজের বাড়িঘর ছেড়ে দূরে পড়ে ছিলো। ওই আট বছরের তার সব অপ্রাপ্তি গুলো প্রাপ্তিতে পরিণত করতে চান গুলবাহার। রান্নাঘরের বিশাল দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। ভেতরে কি রমরমা আয়োজন! তাকে দেখতেই তাসফিয়া ছুটে এসে বলেন,

–একি আম্মা! আপনি এখানে? কিছু প্রয়োজন? কষ্ট করে আসলেন কেন? ডেকে পাঠাতেন।

–না ছোটো বউ। আমার কিছু প্রয়োজন নেই। আমি দেখতে আসলাম রান্নাবান্না কতদূর।

ফারজানা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে জবাব দেন,

–প্রায় শেষ হয়ে এলো আম্মা। আপনি গিয়ে বরং বিশ্রাম নিন। এখানে কষ্ট করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।

–হুম! ফারহাকে আনতে কে গিয়েছে?

তাসফিয়া জবাব দেয়,

–আয়াজ গিয়েছে আম্মা।

–কেন? আমি বলেছিলাম, ফারহাকে আনতে আহরার যাবে।

তাসফিয়ার দিকে তাকিয়ে কড়াস্বরে বলে উঠেন গুলবাহার,

–ছোটো বউ তুমি কি ছেলেকে বাক্সবন্দি করে রাখার উদ্দেশ্যেই যেতে দাওনি? আমার নাতি হচ্ছে পুরুষ মানুষ। সে চলবে দাপটের সাথে। আর তুমি এক মা, ছেলেকে শুধু লুকিয়ে রাখতে চাও।

তাসফিয়া মাথা নিচু করে শ্বাশুড়ির কথা শুনছেন। কোনো জবাব দিতে পারছেন না। তাই ফারজানাই জবাব দেন,

–না আম্মা তাসফিয়া কিচ্ছু করেনি। বন্ধুর বোনের বিয়েতে থাকায় বেশ কয়েকদিন কাজে ঘাটতি পড়ে গেছে। তাই আহরারই আয়াজকে যেতে বলেছে। কাজের চাপে আহরার যেতে পারলো না।

–হুম বুঝলাম।

গুরুগম্ভীর স্বরে জবাব দিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করেন গুলবাহার। খান বাড়ির কর্তী হিসেবে যথেষ্ট ঠাটবাট বজায় রাখা মানুষ তিনি। শিক্ষিত, মার্জিত স্বভাবের গুলবাহার তার বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা দিয়ে এই পরিবারটিকে এক করে রেখেছেন। বরাবর তাকে সকলেই ভয় করে এসেছে এবং এখনও ভয় করেই চলে।
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে বসে গুলবাহার গভীর চিন্তায় মগ্ন। আজ তার বাড়িটা ভরে যাবে তবে পরিপূর্ণ হবে কি? নাহ! বড় নাতিকে ছাড়া কিভাবে তার পরিবার পরিপূর্ণ হবে? কিন্তু.. মৃ ত্যুর আগে পুরো পরিবারকে একসাথে দেখার সৌভাগ্য তার হবে কিনা তা তিনি জানেন না। চশমাটা খুলে আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন গুলবাহার। আর তা নজরে এলো আহিয়ার। দাদীর চোখে পানি আসার কারণ বুঝতে পারে আহিয়া। পাশে বসে গুলবাহারের কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করে আহিয়া,

–দাদীজান, আয়মান ভাইয়ার কথা ভেবেই কাঁদছো তো। কেঁদো না দাদীজান। দেখবে ভাইয়া একদিন ঠিক ফিরে আসবে।

নাতনীর পিঠে হাত বুলিয়ে গুলবাহার জবাব দেন,

–তাই যেন হয় দাদুমনি। তোমার কথাই যেন সত্য হয়। আমার আয়মান দাদুভাই যেন খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসে।

বাহিরে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ কানে আসতেই নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ান গুলবাহার। সেই সাথে আহিয়াও খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলে,

–ফারহাপু এসে গেছে। হুররেএএএ!

এই বলে এক ছুটে বাইরে চলে যায় আহিয়া। ওদিকে রান্নাঘর থেকে ফারজানা, তাহমিনাও বেরিয়ে আসেন। গাড়ি থেকে সর্বপ্রথম বেরিয়ে আসে আয়াজ। আয়াজ বেরিয়েই জিনিসপত্র বের করার কাজে লেগে পড়ে। কিছুটা সময় নিয়েই ধীরে ধীরে বের হলো ফারহা। তাকে দেখতেই আহিয়া “ফারহাপুউউউ” বলতে চিৎকার করে ওঠে। দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফারহাও হাসতে হাসতে বোনকে জড়িয়ে ধরে। আহিয়ার জড়াজড়ি শেষ হলে ফারহা এগিয়ে যায় গুলবাহারের দিকে। দাদীকে সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরে সে। গুলবাহার বড় আদুরে ভঙ্গিতে নাতনির গা মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।

তারপর তাসফিয়াকে সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। তার কাছে কিছুসময় আদর খেয়ে এবার গেলো মায়ের কাছে। ফারজানা মেয়েকে দেখেই হু হু করে কাঁদতে শুরু করেন। ফারহা জানতো এটাই হবে। মা কে দু হাতে আগলে নিয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকে সে,

–মাই ডিয়ার কিউটি সুইটি মা, কাঁদে না সোনা কাঁদে না।

ফারহার দুষ্টমি দেখে সকলেই হেসে ফেলে। ফারজানাও কান্নার মাঝে হেসে দেন। মেয়ের পিঠে আলতো করে মেরে বলেন,

–এখনো শুধরালিনা।

মায়ের কথা শুনে হি হি করে হাসতে থাকে ফারহা।

বাড়িতে তাকে নিয়ে তো হুলস্থুল পড়ে গিয়েছে। সবার এতো আদর, আহ্লাদে ফারহা রীতিমতো হাঁপিয়ে গিয়েছে। সবার সাথে হাসি, মজা শেষে এবার সে রুমে যাওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকে। ছাড়া পেয়ে নিজের রুমের দিকে যেতে গিয়ে একবার আশেপাশে দেখে নেয়। নাহ! কেউ নেই! এবার পা টিপেটিপে এগিয়ে গেলো “নিষিদ্ধ” ঘরের দিকে। দরজাতে হালকা ঠেলা দিতেই খুলে যায়। ভেতরে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে। ঘরটা দেখেই যেন এক অদ্ভুত শান্তি পেলো সে। ভেতরে পা বাড়াতে গিয়েও আর বাড়ালো না। মনে মনে বললো, “নাহ! যা তুমি অপছন্দ করো তা আমি কখনো করিনি আর করবোও না। যেদিন তুমি নিজে আমাকে এই ঘরে ঢোকার অধিকার আর অনুমতি দুটোই দেবে সেদিনই না হয় প্রবেশ করবো এই নিষিদ্ধ ঘরে। এখন, এই যে ঘরটা দেখে নিলাম, এইটুকুতেই আমার পরম তৃপ্তি।” এই বলে দরজা যেভাবে ভেজানো ছিলো সেভাবেই লাগিয়ে রেখে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় ফারহা।

~~~

আজ অরুনিকা কলেজে যাবে। বেশ কয়েকদিন কলেজ মিস যাওয়ায় পড়াশোনায় পিছিয়ে গিয়েছে সে। নিজের পড়াশোনায় কখনো গাফিলতি করে না অরু। তৈরি হয়ে আদ্রিকাকে সঙ্গে নিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। সেদিন রাতে আরজু বেগম অরুনিকাকে দেখে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন। তবে দাইয়ান আর আদ্রিকার তাৎক্ষণিক কিছু যুক্তিযুক্ত কথাতে ব্যাপারটা চাপা পড়ে যায়। তবে আরজু বেগম মনে মনে ভাবেন, অরু ঠিক নেই। আর তাই তিনি আজ মেয়েকে কলেজে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না। তবে অরুর জোরাজোরিতে রাজি হতে বাধ্য হন।

কলেজে যাওয়ার পথে আদ্রিকা অনেক বকবক করছে। অরু শুধু শুনছে আর হু হা করে জবাব দিচ্ছে। কেন যেন মনটা না চাইতেও আহরারের কথা ভাবনাতে চলে আসছে। মনকে ধমকে ধামকেও ভাবনার লাগাম টানতে পারছে না সে। হঠাৎ কি মনে হলো। অরুনিকা হুট করে দাঁড়িয়ে পিছু ফিরে তাকায়। আদ্রিকা প্রশ্ন করে,

–কি হয়েছে বুবু?

অরু ভালোভাবে এদিক ওদিক নজর বুলিয়ে সামনে ফিরে দাঁড়ায়। আদ্রিকার হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে আবার। আদ্রিকা পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

–বলো না বুবু, কি হয়েছে?

–না তেমন কিছু না। মনে হলো কেউ পিছু নিচ্ছে..

–এটা তোমার মনের ভুল বুবু। হয়তো কালকের ঘটনা নিয়ে ভয় পেয়ে আছো এখনো…

–হুম! হতে পারে… আচ্ছা বাদ দে। চল চল তাড়াতাড়ি পা চালা।

অরু আদ্রি দ্রুতগতিতে কলেজের দিকে ছুটতে থাকে। এদিকে আড়ালে লুকিয়ে থাকা লোকটি বেরিয়ে আসে। ফোনটা বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করতে থাকে।

পুরোনো এক গুদামঘর। হালকা হলদে আলোতে দেখা যায় পুরো ঘরজুড়ে কেবল একটা চেয়ার আর একটা টেবিল ছাড়া কিছু নেই। সেই চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর দু পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে গা এলিয়ে রেখেছে এক আগন্তুক। গুনগুন করে গান গাইছে সে। যেন আজ তার মনে ব্যাপক ফূর্তি। হুট করে ফোন বেজে ওঠায় খানিকটা বিরক্ত হয় সে। ফোনের স্ক্রিনে না তাকিয়েই রিসিভ করে কানে লাগায়। আত্মা কাঁপানো ক্রুর কন্ঠস্বর। “হ্যালো” বলতেই ওপাশের লোকটা কিছুটা কেঁপে উঠলো। ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে বলতে থাকে,

–বস, মেয়েটা কলেজ এসেছে। সঙ্গে ছোটো বোনটাও আছে।

ওপাশ থেকে বক্রহাসির শব্দ ভেসে আসে। তার পরপরই বিদ্রুপের স্বরে জবাব আসে,

–তাই নাকি? স্টুডেন্ট! বাহ বাহ! যাই হোক, আপাতত কিছু করার দরকার নেই। কেবল নজর রাখো।

–ওকে বস।

লাইনটা কেটে যেতেই আগন্তুক টেবিলে আঙুল দিয়ে খটখট আওয়াজ তুলতে থাকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে ফোনের স্ক্রিনে ভেসে থাকা অরুনিকার ছবিটি। অতঃপর আপনমনেই বলতে থাকে,

“আহরার খানের প্রাণভোমরা বলে কথা। এই মেয়েটিই হবে আমার তুরুপের তাস। তবে ভোমরাটা একটু শক্তিশালী হয়ে উঠুক। তারপর… ঠিক সময়মতো এই প্রাণভোমরা ধরেই টান মারতে হবে। আহরার খান! খুব শীঘ্রই তুমি যন্ত্রণার এক কঠিন অধ্যায় দেখবে। তৈরি থেকো।”

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে