রূপবানের শ্যামবতী পর্ব-০৫

0
705

#রূপবানের_শ্যামবতী
#৫ম_পর্ব
#এম_এ_নিশী

আকাশে আজ সূর্যের দেখা নেই। তুলোর মতো ধূসর বর্ণের মেঘরাশির চলাচল দেখা যাচ্ছে কেবল। এই বর্ষা বাদলের দিনে রোদের দেখা পাওয়া বড় মুশকিল। রোদ এলেও কখন যে মেঘের ভেলায় মিলিয়ে যাবে, কে জানে?

সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অস্থির চিত্তে অপেক্ষা করছে আদ্রিকা। মাথায় ঠিকঠাক ভাবে ওড়না জড়াতে জড়াতে বাড়ির ভেতর হতে বের হলো অরুনিকা। সেদিকে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে বলে উঠে আদ্রিকা,

–এতোক্ষণ লাগলো আসতে তোমার বুবু?

–রাগ করে না বোন, একটু গোছগাছ করছিলাম। নে চল। বেরিয়ে পড়ি।

–হ্যা চলো।

অরুনিকা আর আদ্রিকা চললো দাইয়ানদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। দাইয়ানের চাচী রেহানা এসে বারবার বলে গেছেন অরু আদ্রি যেন আগেই চলে যায়। বিশেষ করে অরু। মেয়েটা এসব কাজেকর্মে যথেষ্ট পটু। তার হাতের কাজ বেশ যত্নশীল আর নিঁখুত। যেকোনো কাজে হাত লাগালে সেই কাজটি এতো সুন্দর আর গুছিয়ে শেষ করবে যে সকলকেই তাক লাগিয়ে দিবে তা। তাই রেহানা চান বিয়ের বাড়ির কাজে অরু হাত লাগাক, যেন সবকিছু আরো সুন্দর হয়ে ওঠে।

দাইয়ানদের বাড়িতে ইতিমধ্যেই বিয়ে বাড়ির আয়োজন শুরু হয়েছে। ঘর সাজানো থেকে শুরু করে স্টেজ সাজানোর ও গেট সাজানোর সকল জিনিস পত্র আনা হয়ে গিয়েছে।

একগাদা রঙিন কাগজ, জড়ি, সুতা আর অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ির ভেতরের উঠোনটাতে বসেছে অরুনিকা। তারপর মনের মাধুরি মিশিয়ে যত্নের সাথে নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে তৈরী করছে বিভিন্ন নকশা। তাকে সাহায্য করছে আদ্রিকা, রূপা, ঝুমুর, নূপুর।

এদিকে বাইরে স্টেজ বানানোর কাজ চলছিলো। বাঁশ কেঁটে তা দিয়ে স্টেজ তৈরি করার কাজ সারছিলো চার বন্ধু। কাজ মোটামুটি এগিয়ে গেলে দাইয়ান এসে বলে,

–এখন কাজটা এতোটুকু থাক। বাকিটা পরে সাজানো যাবে। চল যাই বাড়ির ভেতরের কাজগুলো এবার আগাই।

কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ঈশান জবাব দেয়,

–হ্যা দোস্ত চল। মেঘ মেঘ আবহাওয়া থাকা সত্ত্বেও ঘেমে নেয়ে অবস্থা খারাপ। একটু শরবত খাওয়া দরকার।

রাদিফ বলে উঠে,

–আর এদিকে তো আমার ক্ষিদে পেয়ে গেছে।

রাদিফের মাথায় টোকা মেরে আহরার জবাব দেয়,

–সকাল বেলা সবথেকে বেশি তো তুই-ই খেলি। আর এখনি ক্ষিদে পেয়ে গেলো? কতো খাওয়া লাগে তোর? এতো খেলে মোটা হয়ে যাবি, পরে কিন্তু মেয়ে পাবি না।

বলতে বলতে হেসে ওঠে আহরার। তার সাথে তাল মিলিয়ে দাইয়ান, ঈশানও হাসতে থাকে।
ওদের হাসি দেখে মেকি রাগ দেখায় রাদিফ,

–একদম অপমান করার চেষ্টা করবি না আমায়। আমি একদম ফিট। দাইয়ানকে দেখ। দিন দিন আলুপটাশ হয়ে যাচ্ছে। ওকে কিছু বল।

ফোঁস করে ওঠে দাইয়ান,

–বাই এনি চান্স তুই আমারে ইনডিরেক্টলি মোটা বললি?

সবকটা দাঁত ক্যালিয়ে রাদিফ জবাব দেয়,

–ইনডিরেক্টলি বলবো ক্যান? ডিরেক্টলিই কইতাছি, তুই একখান মোটা।

–শা লা… নিজেরে হৃত্তিক রোশন মনে করস?

এই বলে দাইয়ান এগিয়ে এসে দুম দুম করে কিল বসাতে থাকে রাদিফের পিঠে।
ঈশান ফোঁড়ন কেঁটে বলে উঠে,

–রাদিফ সাবধান বন্ধু। দাইয়ানের একটা কিলে তোর একটা হাড্ডি চুরমার…

কথাটা প্রশংসা ছিলো নাকি অপমান তা বোঝার চেষ্টা করতে থাকে দাইয়ান। তবে বোঝাবুঝি বাদ দিয়ে সে রাদিফকে ছেড়ে একহাতে ঈশানের গলা চেপে ধরে হে হে করে হাসতে থাকে,

–কি বন্ধু, প্রশংসা করছিলে?

দাইয়ানের চাপ খেয়ে ঈশান খরগোশের মতো লাফাতে থাকে। দাইয়ান ওভাবেই ঈশানকে ধরে বাড়ির ভেতর যেতে থাকে। পিছু পিছু রাদিফ আর আহরারও হাসতে হাসতে ওদের অনুসরণ করতে থাকে।

ভেতরে প্রবেশ করতেই বাকি তিনজন যার যার মতো দুষ্টুমিতে ব্যস্ত। এদিকে আহরারের পা থেমে গিয়েছে কখন। চোখদুটো স্থির। বিস্মিত নয়নে অবলোকন করে যাচ্ছে এক অপূর্ব দৃশ্য।
শ্যামবতী কন্যা কি গভীর মনোযোগে রঙিন কাগজের নকশা বুনছে। তার হাতের শিল্পকর্ম চোখে লাগার মতোই। গালে, মুখে হয়তো জড়ির ছোঁয়া লেগেছে। মুখখানা চিকচিক করছে। মাঝে মাঝে ঠোঁটের কোণে আলতো হাসির রেখা খেলে যাচ্ছে। চোখ তুলে চাইছে, একেকজনকে এটা ওটা বুঝিয়ে দিচ্ছে, পুনরায় নিজের কাজে মনোযোগী হচ্ছে।
সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে মৃদু হেসে আহরার ধীরস্বরে বলতে থাকে,

–আমাদের তবে আবার একটি অপূর্ব সাক্ষাৎ হলো,সুনয়না।

আলগোছে চোখ তুলে তাকায় অরুনিকা। নামিয়ে নিতে গিয়েও পারেনা, ঝট করে ফিরে তাকায়। মুখ দেখা না গেলেও সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে চিনতে অসুবিধা হয় না তার।
এই মানুষটা? উনি এখানে… তার মানে এই বিয়ের উদ্দেশ্যেই উনার এখানে আসা।
ব্যপারটা পুরোপুরি বোধগম্য হতেই অরুনিকার ভেতরে ছটফটানি ধরে যায়। তাকে এখানে থাকতে হবে। এই মানুষটার আশেপাশে। কিভাবে থাকবে সে?
অরুনিকা ভাবনার মাঝেই আরো একবার চোখ তুলে তাকালো আহরারের দিকে। তা দেখে আহরার ভ্রু নাচায়। অরুনিকা নামিয়ে নেয় চোখ। আর তাকানোর সাহস পায় না।
ওদিকে দাইয়ানের ডাক পড়ে যায়, হালকা খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। ডাক পেয়ে আহরার চলে যায়। অরুনিকা তা বুঝতে পারে। ধীরে ধীরে আড়চোখে দেখতে থাকে সে আহরারের যাওয়ার পথে। যেতে যেতে হুট করেই আহরা ঘাড় বাঁকিয়ে পিছু ফিরে তাকায়, সরাসরি অরুনিকার দিকেই। ভড়কে যায় অরুনিকা। চোখ নামিয়ে নিয়ে ঝটপট কাজে ডুবে যায়। মুচকি হেসে আহরার ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়।

~~~
বিকেল বেলা~
দাইয়ান তার চাচার সাথে বাজারে গিয়েছে আরো কিছু বাজার সারতে। রাদিফ আর ঈশান একটু ঘুরতে বেরিয়েছে। আপাতত কাজের চাপ তেমন নেই। আগামীকাল গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। বাকি কাজগুলো আগামীকাল সারলেই চলবে।
আহরার বাড়িতেই আছে। সে কোত্থাও যায়নি। যেতে চায়নি। তার কারণ- অরুনিকা। অরুনিকার আশেপাশে থাকতে তার বড্ড ভালো লাগছে। লোকচক্ষুর আড়ালে সে যে অরুনিকার পিছু পিছু ঘুরছে, নানা ছুঁতো, বাহানায় অরুনিকার আশেপাশে থাকার চেষ্টা করছে তা অরুনিকা বেশ বুঝতে পারছে। তার অস্বস্তিও বেড়ে চলছে। এসব সে মোটেও স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না। তার মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করতে থাকে। যা সে কাওকে বলতেও পারছে না বোঝাতেও পারছে না।

বাড়ির পাশের পুকুরটিতে শান বাঁধানো ঘাট। বেশ সুন্দর দেখতে। সেখানে বসে বসে শান্ত পানির দিকে চেয়ে এক ধ্যানে কিছু একটা ভাবছে আহরার। কি ভাবছে? ভাবছে তার সুনয়না, শ্যামবতীকে নিয়ে। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে আহরার,
“কি হয়েছে তোর? মেয়েটাকে এক পলক দেখার জন্য এতো মুখিয়ে থাকিস কেন সবসময়? তার মুখদর্শন হলে কেন ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে আসে তোর? ওই মায়াবী চোখের পানে চেয়ে অন্তর শীতলীকরণ করিস? কেন? কে হয় মেয়েটা তোর? কি চাস ওর কাছে?”
তপ্ত শ্বাস ছেড়ে চোখ বুজে নেয় আহরার। কিছু সময় নিজেকে স্থির করে, মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে চলতে থাকা এলোমেলো অনুভূতিগুলোকে গুছিয়ে নেয়। অতঃপর চোখ খুলে পুনরায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পুকুরের শান্ত স্থির পানির দিকে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসি ফুটিয়ে বলতে থাকে,
” জানিনা আমি কি চাই, শুধু জানি ওই শ্যামবতীর মায়ায় পড়েছি আমি। সেই মায়া কখন কিভাবে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিয়েছে তা আমার অজানা। তবে তাকে দেখলে বুকের ভেতরে চিনচিন করে ওঠা সূক্ষ্ম ব্যাথাটা আমাকে তার কাছে টানে, আরো কাছে, আরো..আরো কাছে….”

বহুক্ষণ তার শ্যামবতীকে দেখে না। তাই ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে যায় সে বাড়ির ভেতরে। এদিক ওদিক খুঁজে বেড়াতে থাকে তার সুনয়নাকে। কিন্তু এ কি! কোথায় গেলো সে? নজরে আসছে না কেন? কেমন যেন খালি খালি লাগছে তার। ইতিউতি চাইতে চাইতে সামনে এগোচ্ছিলো সে। আচমকা কোথা থেকে যেন হুট করে উড়ে এসে সামনে পড়ার মতোই দাঁড়িয়ে পড়লো আদ্রিকা। জহুরি চোখে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে থাকে সে আহরারকে। তারপর ফিক করে হেসে দেয়। হেসে হেসেই বলে,

–আপনি সে-ই ভাইয়া না যে আমাদের বাড়ি গিয়েছিলেন। যাকে বাড়ি ঘুরে দেখিয়েছিলাম।

আহরার ওপর নিচ মাথা দুলিয়ে সায় জানায়। আদ্রিকা আবারও বলে উঠে,

–হুমমম! কিন্তু আপনি এভাবে মুখ ঢেকে চলেন কেন? বাড়ির ভেতরেও?

গম্ভীর স্বরে জবাব দেয় আহরার,

–আমি নিজের মুখ প্রদর্শন করিনা।

আদ্রিকা হেসে ফেলে আবার। প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

–কিন্তু আমি যে আপনার মুখটা দেখে ফেলেছিলাম। তা কি আপনি জানেন?

ধ্বক করে ওঠে আহরারের বুক। কি বলে এই মেয়ে? তার অভিসন্ধি তো ঠাওর করা যায় না।

চঞ্চলা আদ্রিকা ফের ছটফটিয়ে বলতে থাকে,

–কখন দেখেছি জানেন? যখন আপনি আমার বুবুর সাথে কথা বলছিলেন। আর এটাও বেশ ভালোভাবেই বুঝেছি আমার বুবুকে আপনি পছন্দ করেছেন। তাই না? তাই না? বলুন। বলুন।

এবার বেশ বিব্রতবোধ করে আহরার। এতোটুকু একটা মেয়ে কেমন জেরা করছে তাকে। আবার একটু লজ্জাও লাগছিলো তার। এভাবে পিচ্চি একটা মেয়ের কাছে ধরা পড়ে গেলো ভেবে। মাথা চুলকে আশপাশ দেখছিলো আহরার। কেউ আবার শুনে ফেললো না তো। এবার আদ্রিকা বেশ গদগদ কন্ঠে বলতে থাকে,

–আমি সবই বুঝেছি। বুবুকে বলেছিলাম এক সুন্দর রাজপুত্র আসবে তার জন্য। বুবু বিশ্বাসই করলো না। এখন তো আমার কথা সত্যি হয়ে গেলো। উফফ! কি যে খুশি লাগছে আমার।

আহরার হুসস! করে উঠলো। নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল ঠেকিয়ে ঈশারায় চুপ করতে বলে। আশেপাশে আরো একবার ভালো করে দেখে নেয়। নাহ! কেউ নেয়। এবার ধীরস্বরে জবাব দেয়,

–আস্তে কথা বলো। কেউ শুনে ফেললে কি ভাববে?

আহরারের কথা বুঝতে পেরে আদ্রিকা বুঝদারের মতো মাথা নাড়ায়। তারপর গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলে,

–কিন্তু একটা কথা জানেন?

–কি কথা?

–আমার বুবু কিন্তু বেশ কঠোর মনের অধিকারী। তাকে টলাতে আপনার অনেক কাঠখড় পোড়ানো লাগবে ভাইয়া।

বক্রহেসে আহরার জবাব দেয়,

–তাই নাকি? তাহলে হাত ধুয়ে মাঠে নামি? দেখি ম্যাডাম কতোটা কঠোর হয়ে থাকতে পারেন। কি বলো?

–আপনি চেষ্টা চালিয়ে যান ভাইয়া। আমি আছি আপনার সাথে।

–সত্যি?

–হ্যা সত্যি তো। এমন একটা রাজপুত্র আমার বুবুর বর হলে আমার চেয়ে খুশি আর কে হবে?

আদ্রিকার কথা শুনে খুকখুক করে কাঁশতে থাকে আহরার। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,

–আচ্ছা, তোমার নামটা যেন কি?

–আমার নাম আদ্রিকা, আর বুবুর নাম হলো অরুনিকা।

অবশেষে সে তার শ্যামবতীর নাম জানলো। মনে মনে কয়েকবার আওড়ে নেয় সে, “অরুনিকা, অরুনিকা, অরুনিকা!”

~~~
রূপা আর ঝুমুর আজ এক অদ্ভুত পরিকল্পনা সাজিয়েছে আহরারের মুখ দেখার জন্য। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর এখানে বিদ্যুৎ চলে যায়। আজ রূপা ভেবে রেখেছে, যখনই বিদ্যুৎ চলে যাবি হারিকেন দেওয়ার বাহানায় ওই ঘরে ঢুকবে আর সাথে সাথে আহরারের মুখ দেখে নিবে। ঘরে নিশ্চয়ই মুখ ঢেকে রাখবেনা।
সন্ধ্যা প্রায় নেমেই গিয়েছে। ঝুমুর হারিকেন রেডি করে রেখেছে। অপেক্ষা এবার শুধু বিদ্যুৎ যাওয়ার।

বারান্দা পেরিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অরুনিকা। রান্নাঘর থেকে বড় মা ডেকে পাঠিয়েছে। দাইয়ানের মেজো চাচীকে বড়মা বলেই ডাকে অরুনিকা। কিছুদূর যেতেই আচমকা বিদ্যুৎ চলে গেলো। নেমে এলো চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে হুট করে কোথায় যেন টান খেয়ে হাতের ব্রেসলেটটি ছুটে যায় অরুনিকার। তা বুঝতে পেরে বিরক্ত হয় সে। এখন এই অন্ধকারে কোথায় খুঁজবে ব্রেসলেট। মেঝেতে বসে পড়ে সে, অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে থাকে ব্রেসলেটটি। কিন্তু কিছুতেই পাচ্ছে না।

ফোনটা কোথায় রেখেছে জানে না আহরার। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় অন্ধকারে ফোন খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো তার পাশেই দেশলাই আর মোমবাতি রাখা ছিলো। দাইয়ান রেখেছিলো। যেহেতু এখানে বিদ্যুৎএর সমস্যা একটু বেশি। আন্দাজ করে দেশলাই খুঁজে বের করলো সে। কাঠি জ্বালাতেই সেই আলোতে মোমবাতি পেলো। তারপর মোমবাতিটি জ্বালিয়ে নিলো।
এদিকে মেঝে হাতড়েও ব্রেসলেট খুঁজে না পাওয়ায় উঠে দাঁড়ায় অরুনিকা। ঠিক সেই মুহুর্তে আহরার মোমবাতি নিয়ে সামনে ফিরে দাঁড়ায়। মুখোমুখি হয়ে যায় রূপবান আর শ্যামবতী।
আহরারের হাতের মোমবাতিটি ঠিক মাঝখানে ধরে রাখা। সেই মোমবাতির নরম আলোয় শ্যামবতীর মায়াবী মুখখানা আরো মায়াবী দেখাচ্ছে। আহরার মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। আর তার মুখ দিয়ে আনমনেই বেরিয়ে আসে একটি শব্দ,
“অপূর্ব!”
মোমের মৃদু আলোকচ্ছটা এসে পড়েছে দুজনের মুখেই। এভাবে আহরারের মুখোমুখি হবে ভাবেনি অরুনিকা। স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে সে। এদিকে আহরারের ঘোরলাগা দৃষ্টি অরুনিকার অন্তর ছেদ করে তীরের বেগে প্রবেশ করে যায় ভেতরে। আহরার মৃদুস্বরে বলে উঠে,

–আজ আমার রাজকপাল মনে হচ্ছে। সুনয়না স্বয়ং আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমতা আমতা করতে থাকে অরুনিকা। ইতিউতি করতে করতে বলে,

–আ..আস..আসলে আমার ব্রেসলেটটা পড়ে গেছে এখানে কোথায়..

বলতে বলতে আবারও খুঁজতে থাকে অরুনিকা। আহরারের পায়ের একটু কাছেই পড়ে ছিলো ব্রেসলেটটি। সেটা দেখতে পেয়ে হাতে তুলে নেয় আহরার। চোখের সামনে তুলে প্রশ্ন করে,

–এটা খুঁজছিলেন নাকি?

ব্রেসলেটটি দেখতে পেয়ে খুশি হয় অরুনিকা। উৎফুল্ল হয়ে জবাব দেয়,

–হ্যা এইতো এটাই।

বলতে বলতে সেটা নিতে গেলেই আহরার তা মুঠোয় পুরে নেয়। নিতে দেয় না। অরুনিকা মন খারাপ করে বলে,

–দিয়ে দিন না।

আহরার একটু সামনে এগিয়ে আসে। অরুনিকা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। মনে মনে বলতে থাকে, “কি বিপদেই না পড়লাম।”
অরুনিকার চোখের দিকে চেয়ে আহরার বলে উঠে,

–আর যদি না দেই?

–ও..ওটা.. আমার বাবার দেওয়া। দয়া করে দিয়ে দিন।

–হাতটা দিন।

বুঝতে না পেরে অবাক দৃষ্টিতে চায় অরুনিকা। মোমবাতিটি পাশের টেবিলের ওপর রেখে আহরার পুনরায় বলে,

–হাতটা দিন।

অরুনিকা ধীরে ধীরে এক হাত বাড়িয়ে দেয়। আহরার সেই হাতে বেশ যত্ন করেই ব্রেসলেটটি পড়িয়ে দেয়। পড়ানো হয়ে গেলে সেদিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে বলে,

–বাহ! বেশ সুন্দর।

–আ.. আমি.. এখন যাই।

এই বলে অরুনিকা আহরারের পাশ কাটিয়ে ছুটে পালাতে চায় কিন্তু যেতে পারে না। তার ওড়নাতে টান লাগায় দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। ওড়নার এক অংশ টেনে ধরে রেখেই আহরার বলে উঠে,

–সবসময় এমন “পালাই পালাই” করেন কেন অরুনিকা?

আহরারের মুখে নিজের নাম শুনে অবাক হয় অরুনিকা। কিন্তু কিছু বলে না।
আহরার ওড়না ছেড়ে দেয়। অরুনিকার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,

–আমাকে দেখলেই কেন পালাতে চান আপনি?

–আম..আমার ক..কাজ আছে।

–তাই। ঠিকাছে যান তাহলে।

এই বলে পথ থেকে সরে দাঁড়ায় আহরার। আর এই সুযোগে অরুনিকা ছুট লাগায়। তবে দরজার কাছে যেতেই আবার থমকে যায় আহরারের কথা শুনে।

–সুযোগ করে পুরো একটা দিন আপনাকে আমার সামনে বসিয়ে রাখবো। সেদিন কিন্তু আপনি পালাতে পারবেন না অরুনিকা।

আহরারের কথার কোনো জবাব নেয় অরুনিকার কাছে। সে শুধু মাথা ঘুরিয়ে একবার চাইলো আহরারের দিকে। কি বুঝাতে চাইলো মানুষটা? বুঝতে চায় না সে। ঝড়ের বেগে পালিয়ে গেলো সেখান থেকে। তা দেখে আহরার হাসিতে লুটিয়ে পড়ে। মোমবাতিটি হাতে নিয়ে সে ও বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে।

ওদিকে হারিকেন জ্বালাতে গিয়ে হারিকেনটাই উল্টে ফেলে দিয়ে ভেঙে ফেলেছে রূপা। নতুন হারিকেন এনে তা জ্বালিয়ে যখন আহরারের ঘরে এলো। ঘর তখন ফাঁকা। রূপা এমাথা ওমাথা, এমনকি খাটের নিচেও খুঁজে দেখে। কিন্তু নাহ! পায় না। এবার নিজের কপালে নিজেই বারি মেরে বলে,

–ওই মুখ আর দেখা হবে না আমার।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে