রুপালি মেঘের খামে পর্ব-৩৭ এবং শেষ পর্ব

0
884

#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz

শেষ পর্ব.
পৌষের মাঝামাঝি সময়। ঘুরতে আসার জন্য আবহাওয়া একদম সঠিক। প্রকৃতি এই সময় সূর্যের মৃদু উত্তাপে আদুরে রূপ ধারণ করে। মিষ্টি রোদে আবহাওয়া থাকে প্রায়শই কুয়াশা ভেজা, স্নিগ্ধ। এমনই একটি সময় সামির-অরা ঘুরতে চলে এসেছে সাজেক ভ্যালি। বিয়ের পর তাদের প্রথমবার একসাথে ঘুরতে আসা।

অরার পরিকল্পনা ছিল সে এবার সম্পূর্ণ সাজেক ঘুরে দেখবে। কোনো রিসোর্টে দুইদিনের বেশি থাকবে না। দশদিনেই পুরো শহর চষে ফেলবে৷ কিন্তু আজ চারদিন ধরে তারা রিসোর্টের একটি রুমের মধ্যেই বন্দী আছে। অরা এসেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এখন তার তিনমাস চলে। এই সময় নাকি মিস ক্যারেজ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই খুব সাবধানে থাকতে হচ্ছে। রুম সার্ভিস এসে খাবার দিয়ে যায়৷ তারা শুধু দরজা পর্যন্ত গিয়ে খাবারটা রিসিভ করে। বিকেলের দিকে আশেপাশে ঘুরতে বের হয়। ব্যস, এভাবেই দিন কাটছে।

আজ অবশ্য বিকেলে তারা বের হয়নি। রূপা ফোন করেছিল অরাকে। সায়ানের সাথে কথা হলেই নাকি তার কান্না কান্না পায়। সেই দুঃখ অরার কাছে প্রকাশ করে। সামির তখন রিসোর্টের বাইরে গেছে। চারদিন পর বোধহয় দ্বিতীয়বারের মতো অরাকে রেখে সে বেরিয়েছে। এছাড়া সবসময় তারা একসাথেই বের হয়।

রূপা রাগী কণ্ঠে বলল,” তোর কোনো খোঁজ নেই কেন সেলফিশ? বর পেয়ে আমাকে পর করে দিলি? আমার কথা কি তোর একবারও মনে পড়ে না? চট্টগ্রাম কবে আসবি, দোস্ত? তোদের সবার কথা আমার খুব মনে পড়ছে।”

রূপার কণ্ঠে আকুতি, অভিমান। অরা সহাস্যে বলল,” আম্মু তো তোকে তার কাছে থেকেই যেতে বলেছিল। কেন থাকলি না?”

” মামি বলেছে বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ি থাকতে নেই। আচ্ছা তোর ঘুরাঘুরি কেমন চলছে? নিশ্চয়ই খুব মজা হচ্ছে, তাই না?”

” কিসের মজা? রিসোর্ট থেকেই বের হতে ইচ্ছে করে না। কত প্ল্যান ছিল! ঘুরাঘুরি করবো, শপিং করবো, পাহাড় দেখবো। প্রতিদিন প্ল্যান করি। কিন্তু শেষমেষ কিছুই হয় না। চারদিন ধরে শুধু দেখছি বেডরুমের এসি, বাথরুম, টিভি,ফার্ণিচার আর জানালার বাইরের প্রকৃতি।”

” তোরা তাহলে ঘুরতে এসেছিস কিজন্য বা*ল? সারাদিন ঘরে বসে থেকে তোরা শা’লা করিসটা কি?”

অরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,” একটু হাঁটলেই পা ঝিনঝিন করে। তাছাড়া আমার শরীরও ভালো নেই।গতকাল কি হয়েছে জানিস? ”

” কি?”

অরা লাজুক কণ্ঠে বলল,” কাল আমি নীল শাড়ি পরে খুব সুন্দর করে সেজেছিলাম ঘুরতে যাবো বলে। ঠিক বের হওয়ার আগে উনার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কেমন লাগছে? ব্যস, আর ঘুরতে যাওয়াই হলো না।”

রূপা হাসিতে ভেঙে পড়ল।মজা করে বলল,”ওয়াও! অবশ্য ঠিকই আছে। প্রথমবার হানিমুনে গেলে সবারই এই অবস্থা হয়। তবে বেশ ভালো কিন্তু ব্যাপারটা। ভাইয়া খুব রোমান্টিক তাই না? দেখে কিন্তু একদম মনে হয় না।”

“আচ্ছা এখন রাখি। উনি মনে হয় চলে আসছে। তোর সাথে পরে কথা বলব।”

” আচ্ছা। বায়।”

অরা কাঁথায় মুখ ঢেকে শুয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর সামির ঘরে ঢুকল। অরাকে শুয়ে থাকতে দেখে বলল,” কি হয়েছে অরাবতী? শরীর খারাপ নাকি? আবার জ্বর এসেছে তোমার? দেখি!”

” জ্বর আসেনি। ঠিকাছি আমি।”

” তাহলে এভাবে শুয়ে আছো যে? চলো এখন আমাদের বের হতে হবে।”

“কোথায় যাবো?”

সামির চোখ টিপে বলল,” সারপ্রাইজ!”

ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে নিতে শুরু করল সামির। তাদের রিসোর্ট পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন তারা যাচ্ছে সাজেকের বিখ্যাত মেঘ মাচাং রিসোর্টে। সেখানে বারান্দায় দাঁড়িয়েই সরাসরি মেঘ ধরা যায়।

সামির ভেবেছিল পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে অরাকে সারপ্রাইজ দিবে। তাই আগে থেকেই রিসোর্ট বুক করেছিল। কিন্তু নানান ঝামেলায় বুকিং ক্যান্সেল করতে হয়েছে। এবার তো খালিও পাওয়া যায়নি। কিন্তু সামির মেনেজ করেছে। সে অরাকে মেঘের রাজ্যে নিয়ে যাবেই। সিলেট যাওয়ার আগে এটাই তাদের প্রথম ও শেষ ট্রিপ!

ভোরের স্নিগ্ধতা আকাশে ছড়াতে শুরু করেছে মাত্র। সূর্য আধবোজা দৃষ্টি মেলে তাকাবে একটু পরেই। অরা চোখ মেলে দেখল, চারিপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা। কাঠের খুঁটি দিয়ে তৈরি বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে শুয়ে আছে তারা। শিশিরে গা ভিজে গেছে। সামনে চমৎকার সবুজ পাহাড়গুলো দৃশ্যমান। চতুর্দিকে কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের শীহরণ। অরার শরীর ঠান্ডায় কাটা দিচ্ছে। খোলা আকাশের নিচে কার্পেটের মতো ঘাসগুলোয় শিশির জমে ওঠায় চকচক করছিল। হঠাৎ ঠান্ডা হাতের স্পর্শে অরার শরীর কেঁপে উঠল। এই কম্পন থামছেই না। সামির ধীর গলায় বলল,” কেমন লাগছে অরাবতী?”

অরা অবাক হল। চোখ বড় করে বলল,” অসম্ভব ভালো। মনে হচ্ছে আমি স্বপ্নে আছি।”

” ওদিকে তাকাও। সুন্দর না?”

অরা দেখল তারা ঝলমলে আকাশ। উচ্ছ্বাসিত গলায় বলল,”সুন্দর মানে? খুব খুব খুব সুন্দর। যেন স্বর্গরাজ্য।”

সামির মৃদু হাসল। সেই হাসির শব্দটা চমৎকার লাগল অরার কানে। ঘোর লেগে যাওয়ার মতো,নেশাময় অনুভূতিতে আবিষ্ট হয়ে গেল সে।

” এখন কি মাঝরাত?”

সামির উত্তর দিল,” না তো! এখন ভোর পাঁচটা বাজে। আর একটু পরেই সকাল হবে। আলো ফুটলেই ভেসে উঠবে মেঘ। তখন মনে হবে মেঘের রাজ্যে শুয়ে আছি আমরা!”

অরা চোখ বন্ধ করে সামিরের বুকে মাথা ঠেঁকালো। তার চোখ ভরে আসছে অশ্রুতে।সামির বলল,” আগেই বুক করতে চেয়েছিলাম এই রিসোর্ট। সাজেকের বেস্ট প্লেস এটা। কিন্তু খালি ছিল না। তোমাকে বললে তুমি মনখারাপ করতে। তাই বলিনি। এখন সরাসরি সারপ্রাইজ দিলাম।”

” সকাল কখন হবে?”

“অপেক্ষা করো। খুব জলদি সকাল হবে। আর আধঘন্টা! ”

বেশ কিছুক্ষণ সামিরের বুকে মাথা ঠেঁকিয়ে শুয়ে থাকল অরা। সামির তখন অরার কোমল চুলে হাত বুলাচ্ছিল। অরা কান পেতে শুনছিল সামিরের বুকের ঢিপঢিপ শব্দ। আগের রাতে বৃষ্টি হওয়ার কারণে ভেজা মাটির সোদা গন্ধে মুখরিত হয়ে আছে চারদিক। সাথে সামিরের পারফউমের চিরচেনা সুভাষ। যেন অন্যরকম নেশা। সামির মগ্ন ছিল অরার ভেজা চুলের মিষ্টি গন্ধে। আস্তে আস্তে আকাশ জুড়ে ভোরের আলো উঁকি দিতে লাগল। সামির ডাকল,” মেঘবতী!”

“হু!”

“একটা গল্প শুনবে?”

” কি গল্প?”

” আমাদের গল্প।”

” আজ আপনি যা বলবেন… আমি সবকিছু শুনব। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনব।”

এই কথা বলেই সামিরের গালে আদর নিয়ে চুমু দিল সে। সামির আনমনা হয়ে উঠল। অরাকে ঘুরিয়ে আরাম করে তার বুকে মাথা রাখল। অরা আপত্তি করল না। খুব যত্নে আগলে নিল। গভীর আবেগে হাত দিয়ে বিলি কা-টতে লাগল সামিরের চুলগুলোয়। ছেলে মানুষের চুল এতো মসৃণ হয়? অরা নিজের আঙুলে খুব আরাম পাচ্ছিল।

সামির আধবোজা দৃষ্টিতে ঘোরমাখা কণ্ঠে কেমন কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতে যেতে বলল,” আট বছর আগের কথা। ছোট চাচ্চুর চাকরির ট্রান্সফার হয় চট্টগ্রামে। আমি চান্স পেয়েছিলাম চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে। তাই সেখানে চলে গেছিলাম, চাচ্চুকে সঙ্গ দিতে। নতুন জায়গায় এসে আমি একটু বেশিই স্বাধীনতা পেয়ে গেছিলাম৷ সারাদিন ঘুরে-বেড়াই। রাত করে বাড়ি ফিরি। মা-বাবার শাসন নেই। বখেই যাচ্ছি।

আমাকে বাঁধার জন্য চাচ্চু টিউশনের ব্যবস্থা করলেন। যাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। পড়ালেখার চাপ সামলে, টিউশন করে, বাড়িতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকবো৷ বখে যাওয়ার সুযোগ নেই। আইডিয়াটা ভালোই ছিল। টিউশনির অফারও পেলাম। ক্লাস এইটের ছোট্ট মেয়েকে পড়াতে হবে। সামিয়ার বয়সও তখন এমন। ওই বয়সে সামিয়া অনেক বাদর ছিল। আমি তো ভেবেছিলাম, সেও সামিয়ার মতো দুষ্ট হবে। কিন্তু যেদিন প্রথম পড়াতে গেলাম, একটা শান্ত, স্নিগ্ধ আর নিশ্চুপ মেয়েকে খুঁজে পেলাম৷ এতো অদ্ভুত মেয়ে আমি ইহজনমে দেখিনি। নাম ধরে ডাকলেও কেঁপে ওঠে। আমার হাসি পায়। কিন্তু হাসা নিষিদ্ধ। স্টুডেন্টের মায়ের কড়া অর্ডার, গম্ভীর টিচার লাগবে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও গম্ভীর আচরণ করতে হয়। তার সাথে মেশা যায় না, বন্ধুত্ব করা যায় না, শুধু ধমক দিতে হয়। আমার প্রতিটি কথার তালে সে শুধু জড়সড় হয়। তার সেই জড়সড় ভঙ্গিতে কেমন অদ্ভুতভাবেই না জড়িয়ে যাই আমি!”

অরার কান গরম হচ্ছে। চোখমুখ লালচে। ক্রমশ কুঁকড়ে যেতে মন চাইছে। সামির হঠাৎ পুরনো দিনের গল্প শুরু করল কেন? উফ, আগে জানলে অরা শুনতো না। কিন্তু এখন উঠতেও পারবে না। তাকে অগত্যা শুনতেই হলো।

অরার বিয়েতে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনাই ছিল না সামিরের। সে চট্টগ্রামে তার ছোট চাচ্চুর বাসায় উঠেছিল। ছোট্ট চাচ্চুর সাথে অরার পরিবারের একটা পরিচয় ছিল। একেই হয়তো বলে ডেস্টিনি! নাহলে অরার বিয়ের সময়ই কেন সামির চট্টগ্রাম যাবে?

একসময় সামির অরার গৃহশিক্ষক ছিল। আজ অরার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সামির তাকে এতোবছর পর দেখবে, দোয়া করবে, অরার মা-বাবাও নিশ্চয়ই সামিরের আগমনে খুশি হবেন। এই যুক্তিগুলো শুনেই যেতে রাজি হলো সে। কিন্তু তখনও সে জানে না, সেদিন চাচ্চুর অনুরোধে নয় বরং নিজের মনের অবাধ্য ব্যাকুলতাই তাকে বিয়ে বাড়ি পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিল।

বিয়ে বাড়ির কোলাহল মুখর পরিবেশটা মানুষে গিজগিজ করছিল। বাড়ির ছাদে প্যান্ডেল টানিয়ে বিয়ের আয়োজন। গ্যারাজে হচ্ছে রান্নাবান্না। সামির গ্যারাজেই বসেছিল। উপরে যেতে ইচ্ছে হলো না। অপরিচিত মানুষের বিয়েতে এসে যেন খুব বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে তাকে। কাউকে চিনছে না। কার সাথে বসবে? কোথায় দাঁড়াবে… সেটিও যেন ঠিক করতে পারছিল না।

বধূবেশে পার্লার থেকে সেজে আসা তরুণীটি নামছিল গাড়ি থেকে। বউয়ের আগমনে সাজ সাজ রব পড়ে গেল চারদিকে। গ্যারেজে নিঃসঙ্গ অবস্থায় একটি ভাঙা চেয়ারে বসে থাকার সময় সামিরের ধ্যানভঙ্গ হলো চারিপাশের মুখরতায়। কৌতুহলী চোখ নিয়ে রাস্তায় তাকাতেই চমকে গেল সে। বউ নামছে!

লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি গায়ে, ছোট্ট, পাতলা মুখটিতে ভরাট মেকাপের প্রলেপ। সুন্দর ঠোঁটজোড়ায় গাঢ় লাল রঙা লিপস্টিক। এতো সাজগোজ তার চেহারার স্নিগ্ধতা একফোঁটা কমাতে পারেনি। মনে হচ্ছে যেন সদ্য ঝরা বৃষ্টিতে ভিজে ওঠা কোনো লাল গোলাপ। সামির নির্বাক তাকিয়ে রইল বধূবেশীর দিকে।

অরা যখন অনেকটা সামনে চলে এলো, তখন সামির দ্রুত গতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে নিজেও সামনে এলো। তার নিজের প্রতি কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই তখন। নিঃশ্বাস নিচ্ছে দ্রুত। হাত-পায় অসাড়তা প্রায়। বিবশ হয়ে দেখছে, তার আঠাশ বছরের জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর ব্রাইড।

হ্যাঁ, সেদিন সামিরের হৃদয় কোঠরের ঘুমিয়ে থাকা অনুভূতিরা এক চুটকিতেই জেগে উঠে লাল গোলাপের মতো মুখটির প্রেমে লুটিয়ে পড়েছিল। এটা কি লাভ এট ফার্স্ট সাইট! উহুম, সামির অরাকে আরও সাতবছর আগে দেখেছিল। তখনও তার মনে একই অনুভূতি হয়েছিল। তখন সেই অনুভূতি ছিল ঘুমন্ত, আজ জাগ্রত। পার্থক্য কি এখানেই?

এই সময় সামির নিজের মধ্যে নেই। সে এই জগতেও নেই। ভালোবাসার সম্মোহন তাকে নিয়ে গেছে দূর অজানার কোনো স্বপ্নময় বেলাভূমিতে। যেই ভূমিতে সামিরের নিশ্চল অনুভূতিরা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই আছড়ে বেড়াচ্ছিল। সামির সামলাতে পারছিল না সেই উত্তালতার টাল। তাই গা ভাসিয়ে দিল। ভেসে গেল ভালোবাসার স্রোতে!

চোখের সামনে আয়নার মতো ভেসে উঠছিল ঝকঝকে স্মৃতিগুলো। যে ছোট্ট অরাকে তার ভীষণ আপন, ভীষণ নিজস্ব মনে হতো। যার প্রতিটি কথায় সামির হাসি চেপে গম্ভীর মুখে তাকাতো। মেয়েটির প্রতিটি আচরণ ছিল রহস্যময়, অদ্ভুত মায়াজাল।

তার মনে হচ্ছিল, এখানেই তাকে থাকতে হবে৷ সামির নিজেও জানে না, তার কেন থাকতে হবে! যেমন করে জানে না, তার জীবনের আনন্দঘন ঝকঝকে সময়গুলো হঠাৎ কেন বিষণ্ণ মলিনতায় ঢাকা পড়ে। সে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তার জীবন থেমে যায়।বুকের কাছে শূন্য লাগে।

আজ এই আশ্চর্য সুন্দর বধূবেশীকে দেখেও একই অনুভূতি হচ্ছে। বরং আগের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি গাঢ় এই অনুভূতি। সামির তার হারিয়ে যাওয়া কৈশোরে ফিরে যাচ্ছে কখনও। যে কথা কেউ জানে না, সে কথা কেবল সামির নিজে জানে। ওই মেয়েটি তার অনেক বিশেষ! তার সাতটি বছর ধরে বয়ে বেড়ানো অচেনা বদ্ধ অনুভূতির একশেষ। যে অনুভূতি সামির উপলব্ধি করেছে মাত্র সাতমিনিট আগে।

তারপর হঠাৎ করেই যখন সামিরের মস্তিষ্ক সজাগ হলো, কড়া নাড়ল বাস্তবতা, কেউ যেন সপাটে আঘাত করল গালে। বিবেক বলে উঠল তাচ্ছিল্য করে,” ছি, তোর ছাত্রী হয় সে। তাছাড়া যাকে দেখে তোর প্রেম জেগে উঠছে সে কিছুক্ষণ পর অন্যকাউকে কবুল বলে তার স্ত্রী হয়ে যাবে। তুই পরস্ত্রীর দিকে নজর দিচ্ছিস সামির? ধিক্কার তোকে!”

কিন্তু মন বলে উঠল,” বিয়ে তো এখনও হয়নি।তার সাথে আমার কেন এখনি দেখা হলো? বিয়ের পরেও তো দেখা হতে পারতো। কেন আমি অকারণে চট্টগ্রাম ছুটে এলাম? কাকতালীয় ভাবে কেন এই বিয়ে বাড়িতেই আজ আমায় আসতে হবে? এই সবকিছু একসাথে ঘটছে এর মানে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। আমার মতো সেও আমার অপেক্ষায় ছিল কি?”

বিবেক যেন মনকে শাসিয়ে দিল,” কেউ তোর অপেক্ষায় ছিল না গর্দভ। মেয়েটার মুখের হাসি দেখেছিস? এই বিয়েতে সে যথেষ্ট খুশি। তার এই খুশিকে নষ্ট করার অধিকার তোর নেই। আর কাকতালীয় যে ব্যাপারটার কথা ভাবছিস, তা হচ্ছে ছ্যাঁকার লক্ষণ। এই ছ্যাঁকাময় বিকেলবেলায় তুই কঠিন ছ্যাঁকা খেতেই বিয়ে বাড়িতে এসেছিস। তুই ছ্যাঁকা খেয়ে চলে যাবি নিজের রাস্তায়। মেয়েটি চলে যাবে তোর বিপরীত রাস্তায়। তোদের পথ আলাদা হবে। আর তুই হবি নিজের পথের দিশেহারা পথিক। তোকে সে চিনবেও না,কোনোদিন জানবেও না তোর মনের কথা। ”

সামির অনুজ্জ্বল বিকেলের আকাশের দিকে চাইল। অচিরেই মনের মধ্যে উদাসী ভাব এসে ভর করল। মনখারাপে চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরল। মন বলল,” এমন উদাসী বিকেল কারো জীবনে কখনও না আসুক!”

বিয়ের স্টেজে বউ সেজে পুতুলের মতো বসে ছিল অরা। তার লাজুক মুখ আর অপ্রস্তুত দৃষ্টি কারো হৃদয় আন্দোলিত করছে তখন। সে জানেও না কেউ যে খুব দূর থেকে, ভীষণ সাবধানে কারণে -অকারণে তার উপর নজর রাখছে। মাঝে মাঝে অরার হুট করে হেসে ওঠা প্রাণবন্ততা, চঞ্চলতা, হাসি-খুশি ভাব সেই মানুষটির হৃদয়ের গাঢ় বিষব্যথা আরও বিষাক্ত আর গাঢ় করে দিচ্ছে!

আরিফ সাহেব পেছন থেকে ডাকলেন,” কেমন আছো, বাবা?”

সামির প্রথমেই চিনতে পারল না। ভালো করে চেয়ে থেকে বুঝল, অরার বাবা তিনি। সাথে সাথেই সালাম দিল। আরিফুল ইসলাম আর কিছু বলার আগেই সাবিরা প্রায় ঝাঁপিয়ে এসে বললেন,” তোমাকে আমি কত খুঁজছি জানো?”

সামির হকচকিয়ে গেল। হাসার অভিনয় করে বলল,” না। জানি না আন্টি। কেন খুঁজছেন?”

” সাত বছর আগের রহস্য জানতে। এতো সিরিয়াস টিচার ছিলে তুমি। এতো পানচ্যুয়াল ছিলে। অথচ অরার জেএসসি পরীক্ষার ঠিক এক সপ্তাহ আগে থেকে তোমার আসা বন্ধ হয়ে গেল। ফোন বন্ধ, যোগাযোগ বন্ধ, আর কোনোদিন আমাদের কথা মনে পড়ল না তোমার? মানুষ বুঝি এভাবে হারিয়ে যায়? তোমাকে আমি নিজের ছেলের মতো স্নেহ করতাম। আমার দুই মেয়ে। কোনো ছেলে ছিল না। তোমাকে ছেলে ভেবেছিলাম। এইভাবে মায়ের মনে দুঃখ দিলে?”

সাবিরা চোখে আঙুল দিয়ে কেঁদে ফেললেন। কাঁদছেন আরিফও। সামির থতমত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আরিফ অতীতের স্মৃতি কথা মনে করতে লাগলেন। একদিন তুমুল বৃষ্টির সকাল। সামিরের ভার্সিটিতে পরীক্ষা আর আরিফ সাহেবের অফিস মিটিং। প্রায় দেরি হয়ে যাচ্ছে। দু’জনে একই রিকশা দাঁড় করাল। অতঃপর দু’জনই দু’জনের দিকে চেয়ে হাসল। আরিফ বললেন, “তুমি আগে যাও। তোমার পরীক্ষায় লেইট হচ্ছে।”

সামির তখন খুব সুন্দর করে বলল, “আপনি যান আঙ্কেল। আমি হেঁটে যেতেও অভ্যস্ত। এই রিকশা চলে গেলে বৃষ্টির মধ্যে আরেকটা পেতে দেরি হবে। আপনার বস আবার ফোন করবে।”

কিছুক্ষণ আগে ফোনে বসের সাথেই কথা বলছিলেন আরিফ৷ তা হয়তো সামির শুনেছে মনোযোগ দিয়ে।

কিন্তু আরিফ যাবেন না। বাচ্চা ছেলে কষ্ট করবে আর তিনি রিকশায় উঠে যাবেন৷ তাই কি হয়? শুরু হলো তর্ক। কারোই যাওয়া হচ্ছিল না। তারপর দু’জনই এক রিকশা শেয়ার করার সিদ্ধান্ত নিল। মাঝপথে সামির নেমে গেল। সেই তাকে বৃষ্টিতে ভিজতেই হলো। তবু, কিছুটা পথ তো এগিয়েছে। কষ্ট কম হয়েছে। কি সাধারণ একটা স্মৃতি! অথচ আরিফ সাহেব এখনও মনে রেখেছেন। এই মানুষগুলোর সাথে সামির মাত্র একবছর কিংবা তার কম সময় কা-টিয়েছিল। তাও সপ্তাহে ছয়দিন মাত্র ঘণ্টা দেড়েকের জন্য!

এইটুকুতেই বুঝি কেউ এতো আপন হয়ে যায়? সম্পর্ক গড়তে সময় লাগে না আসলে।তবে সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করতে যুগের পর যুগ শেষ হয়ে যায়। মানুষ হয়তো হারিয়ে গেলে কিংবা যোগাযোগ করা ছেড়ে দিলেই ভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা হলো। কিন্তু হৃদয় থেকে কি সে এতো সহজে হারিয়ে যায়? হারানো সহজ নয়। সামিরের তো মনে হচ্ছে, কখনো সম্ভবও নয় । নাহলে সাতবছর পরেও সাবিরা কেন সামিরকে দেখে আবেগে কেঁদে ফেলবেন? আরিফ সাহেব কেন খুব সামান্য স্মৃতি মনে করে হাসবেন? খুব আপন কেউ ছাড়া আমরা যার তার জন্য এমন অনুভূতি ব্যক্ত করি না।

তারপরের ঘটনাগুলো তো একদম সিনেমাটিক। হঠাৎ জানা গেল অরার বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। চারদিকে হৈচৈ, অস্থিরতা। মুহূর্তেই সুন্দর পরিবেশে নেমে এলো ভয়ানক বিশৃঙ্খলা। আরিফ সাহেব হুংকার ছেড়ে বলছিলেন, দশ মিনিটের মধ্যে অনেক ভালো পাত্র যোগাড় হবে। আবসারের ছেলের চেয়েও হাজার গুণ যোগ্য পাত্রের সাথে মেয়েকে বিয়ে দেবো আমি।

সবকিছু জানার পর সামির তার নিয়তির উপর চরমভাবে কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ল। তার মনে হচ্ছিল, এতো চমৎকার ঘটনা পৃথিবীতে আর কখনও ঘটেনি। সে তার জীবনের জ্যাকপট পেয়ে গেছে!

ইউনিভার্সিটি লাইফে সচরাচর সবাই প্রেম করে। কিন্তু সামির কখনও প্রেম করেনি। বন্ধুরা ভাবতো, তার বুঝি প্রেমে পড়ার ক্ষমতা নেই। এই নিয়ে কত হাসি-তামাশা চলতো৷ তবে সামির জানতো, সে কারো অপেক্ষায় আছে। কেন সেই অপেক্ষা? কার জন্য অপেক্ষা? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর তার কাছে ছিল না। সে শুধু জানতো এই অপেক্ষা মধুময়।

ভালোবাসা হতে সময় লাগে এক মুহূর্ত। কিন্তু ভালোবাসা বুঝতে হয়তো জীবন-যৌবনও শেষ হয়ে যায়। সামিরের ক্ষেত্রে শেষ হয়েছে মাত্র সাতটি বছর। অবশেষে সে নিজের চিনচিনে ব্যথাময় অপেক্ষার কারণ খুঁজে পেয়েছে। যে ছিল তার অবেলার বিষণ্ণতার উৎস। এই রকম করেও বুঝি কারো ভালোবাসা তৈরী হয়?

অরাকে দেখার পর থেকে সামিরের মনে হচ্ছিল সে নিশ্চয়ই মা-রা যাবে। তার হৃৎপিন্ড অকেজো হয়ে যাবে, অসহ্য ব্যথার দাবদাহে সে নিঃস্ব ক্রমশ। সাত বছরের একত্রিত অত্যাচার হৃদয়ে দামামা বাজাচ্ছিল। এই কঠিন সমস্যার অসম্ভব সমাধান সে বের কর‍তে পারল না। সামিরের মনে হচ্ছিল একমাত্র সৃষ্টিকর্তার কোনো চমৎকার ছাড়া এর কোনো সমাধান নেই। সামির পবিত্র মনে প্রার্থনা করছিল, তার ভালোবাসা বিশুদ্ধ হলে সে যেন যন্ত্রণা মুক্ত হয়।

আর নিয়তির বিচার কি চমৎকার ছিল! বিষাক্ত বাতাসে ঘেরা বিকেলে সামিরের উদাসী মন যেন সঞ্জীবনী শক্তি পেল। কোনো এক উদাসী বিকেলের মায়াঘেরা ছায়াতেই সামির তার রুপালি মেঘের খামে বন্দী সুপ্ত ভালোবাসাকে পেয়েছিল। এইতো, তাদের গল্পটা!

ভোর হতে শুরু করেছে। ডানপাশে তাকাতেই চোখ ধাঁধিয়ে উঠল অরার। আপনা-আপনিই মুখ থেকে একটা চিৎকার ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইল। মনে হচ্ছে সত্যিই স্বর্গে চলে এসেছে তারা। চারদিকে মেঘের স্তুপ। সবুজ পাহাড়গুলো গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘের চাদরে ঢেকে আছে। অরা হাত বাড়াতেই লুটিয়ে পড়তে লাগল মেঘগুলো। সে উঠে দাঁড়ালো। উল্লাসের একটা চিৎকার দিয়ে মেঘ মুঠো বন্দী করার মতো ব্যর্থ কাজে মত্ত হল।

সামির ঘুমিয়ে পড়েছিল। অরার চিৎকারে তার ঘুম শেষ। চোখ মেলে তাকিয়েই দেখতে পেল তীব্র উচ্ছ্বাস মাখা একটা স্নিগ্ধ মুখশ্রী। মনটা মেঘের মতোই নরম হয়ে উঠল তার। অরার চোখ দুটো আনন্দে ঝলমল করছে। এই মায়াবী মুখ দেখার জন্য সামির তার জীবনের সবটুকু সময় উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত!

সমাপ্ত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে