#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz
৩৬.
করিডোরে হাত ভাঁজ করে একা একাই হাঁটছিল অরা।
সে বুঝতে পারছে না, তার দোষটা কোথায় ছিল? কেন তাকে ডিসকোলিফাই করা হলো, সে জানে না! এই দিন দেখার জন্যই বুঝি এতো পড়াশুনা করেছিল? খুব রাগ হচ্ছে সামিরের উপর। তাকে ভস্ম করে ফেলতে মন চাইছে। সে নিজেকে কি মনে করে?
হঠাৎ একটা মেয়েদের গ্যাং এসে সামনে দাঁড়াল । ছোট চুলের জিন্স পরা একটি মেয়ে আঙুলের সাহায্যে ইশারা করে বলল,” হেই ইউ, অরেঞ্জ শাড়ি…কাম হেয়ার!”
অরা ভ্রু কুঁচকে শুধাল,” আমাকে ডাকছেন?”
” এখানে অরেঞ্জ শাড়ি বলতে আর কেউ কি আছে?”
অরা এগিয়ে গেল। মেয়েটি তার পেছনের সঙ্গীদের ইশারা করল। তারা দুইদিক থেকে টেনে ধরল অরাকে। হতভম্ব হয়ে অরা বলল,” আরে, কি করছেন?”
” আদব-কায়দা শেখাতে নিয়ে যাচ্ছি খুকি! সিনিয়রের সাথে বেয়াদবির মজা বুঝবে। লেটস গো।”
” আরে… কিন্তু আমি কি বেয়াদবি করলাম আপু?”
পেছনের একজন মেয়ে বলল,” এখনও বড় আপুকে সালাম দাওনি। এটাই তো সবচেয়ে বড় বেয়াদবি!”
” স্যরি… আমি বুঝতে পারিনি। আসসালামু আলাইকুম আপু।”
তারা একটা ফাঁকা জায়গায় এসে থামল। অদ্রি অরার হাত টেনে তাকে অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,” নাও তোমার সালামের জবাব। ওয়া আলাইকুম আসসালাম।”
তারপর বাইরে থেকে দরজা আটকে দেওয়া হলো। অরা চিৎকার শুরু করেছে। কিন্তু তার চিৎকার কেউ শুনছে না। বেশ কিছুক্ষণ পর দরজা খোলা হলো। অরা দেখল কয়েকটা লম্বাকৃতির ছায়া। হঠাৎ একটা মেয়ে অরার চুল টেনে তাকে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দিল। কারো পায়ের সামনে এসে লুটিয়ে পড়ল অরা।
মুখ তুলে চাইতেই সে দেখল তন্বির হাসিমাখা চেহারা। মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল তার। তন্বি অরার চিবুক স্পর্শ করে বলল,” হাই জুনিয়র! ওয়েলকাম টু হেল।”
অরা উঠে দাঁড়াল। এতোক্ষণ তার ভয় লাগছিল৷ কিন্তু এখন আর লাগছে না। ইস্পাতের মতো কঠিন মুখে সে বলল,” তুমি এসব করেছো তাহলে? ঠিকাছে, আমাকে টর্চার করে যদি তোমার মনের কষ্ট কমে তাহলে করো। ”
তন্বির হাসি হাসি মুখ থমথমে রূপ ধারণ করল। অরা আরও বলল,” বাট আমাকে ওয়েলকাম করার প্রয়োজন নেই। কারণ আমি তোমাদের জাহান্নামে প্রবেশের জন্য সিলেক্ট হইনি। ডন্ট ওরি। ”
অদ্রি ভ্রু উঁচু করে বলল,” ফাইজান স্যারের বউ হয়েও ভাইভাতে সিলেক্ট হওনি? হোয়াট আ জোক! তন্বি, এই মেয়ে মিথ্যা বলছে আমি শিউর।”
তন্বি বিদ্রুপমাখা দৃষ্টিতে বলল,” যেদিন তোমার এক্সাম চলছিল, সেদিনই তো স্যারের এক্সিডেন্ট হয়। তাকে ওই অবস্থায় রেখেও তুমি এক্সান দিয়েছো। হোয়াট আ ডেডিকেশন লেভেল! এতোকিছুর পরেও সিলেক্ট হলে না? আহারে কি আফসোস! আমার তো শুনে খুব দুঃখ লাগছে তোমার জন্য।”
প্রত্যেকে হেসে উঠল উচ্চশব্দে। বিদ্রুপ করে বলতে লাগল, সো স্যাড! অপমানে অরার মুখ লাল হয়ে এলো৷ সামিরকে ভস্ম করে ফেলার ইচ্ছেটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তার জন্যই তো এসব হয়েছে। সে অরাকে কিসের শাস্তি দিচ্ছে কে জানে?
তবে তন্বির সামনে সেও মাথা নোয়াবে না। কাটা ঘাঁয়ে নূনের ছিটা সেও ছড়াতে জানে। মৃদু হেসে বলল,” আমাকে নিয়ে আফসোস কোর না তন্বি আপু। কারণ তোমার দুঃখের কাছে আমার এই সামান্য দুঃখটা তো কিছুই না। দিনশেষে আমার পছন্দের মানুষ আমার পাশেই আছে। তার বুকে মাথা রেখে আমি পৃথিবীর সব কষ্ট ভুলে যেতে পারি। কিন্তু তুমি? তুমি কি করবে? নিজের কষ্ট ভোলার জন্য?”
অরা চমৎকার করে হাসল। তার ওই হাসি দেখে তন্বির মনের জ্বলন্ত আগুনে ঘি পড়ল যেন। অন্যদের মুখও চুপসে গেল। তন্বি রাগে কটমট করে বলল,” এই অসভ্য মেয়েকে আমার চোখের সামনে থেকে দূর কর, প্লিজ। নয়তো আমি কি করব নিজেও জানি না।”
কালো টি-শার্ট পরিহিত একটা মেয়ে বলল,” কোথায় নিয়ে যাবো?”
তন্বির অসহ্য কণ্ঠ,” যেখানে খুশি!”
কয়েকজন মিলে অরাকে ধরতে এলো। অরা তাদের থামিয়ে বলল,” আমি নিজেই যেতে পারি।”
সে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই খোলা জানালার সামনে এসে পা পিছলে গেল৷ তারা যেই ভবনে ছিল সেটা দুইতলায়। এখান থেকে পড়লে সরাসরি গ্রাউন্ড ফ্লোরে। কোনমতে এক হাত দিয়ে দেয়াল চেপে ধরতেই তন্বি এসে তার অন্য হাতটা ধরে ফেলল। চোখ বড় করে তাকাল অরা। পেছনে ফাঁকা জায়গা। বালু দিয়ে ভর্তি করে রাখা হয়েছে।
অদ্রি বলল,” কি ভাবছিস? ফেলে দে।”
অরার মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেল। সে এখান থেকে পড়লে যদি বাবুর কোনো ক্ষতি হয়? দ্রুত নিজের পেটের উপর হাতটা চেপে ধরল। একরাশ মিনতি নিয়ে বলল,” প্লিজ… আমাকে ফেলে দিও না।”
তন্বি তাচ্ছিল্য হাসল। অদ্রি অবাক হয়ে বলল,” এতো জলদি দম ফুরিয়ে গেল? তন্বি, কি করা যায় এবার বলতো?”
অরা আকুতি মিশ্রিত গলায় বলল,” আমি অসুস্থ। এখান থেকে পড়ে গেলে আমার বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে… প্লিজ!”
অরা জোর করে উঠতে চাইছিল কিন্তু তন্বি তাকে উঠতে দিল না। ধাক্কা মেরে আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতির তৈরী করল। অরার হাত-পা ত্রাসে কাঁপছে। কি হবে এবার? তন্বি বলল,” দেখলে তো, তোমার বাঁচা-মরা এখন আমার হাতে। আমি চাইলেই তোমাকে বাঁচাতে পারি। আবার চাইলেই ফেলে দিতে পারি।”
অরা বাধ্য হয়ে বলল,” তুমি যা বলবে আমি তাই করব।”
তন্বি হাস্যমুখে বলল,” সত্যি? তাহলে একটা ডিল করি, চলো। তুমি এখন আমার সামনে নীল ডাউন হয়ে মাফ চাইবে। শুধু এখন না। প্রতিদিন ভার্সিটিতে ঢোকার পর এটাই হবে তোমার ফার্স্ট রুটিন।”
অরা বিস্মিত হয়ে তাকাল। পেছনে বালুর উঁচু স্তর। হঠাৎই সামিরকে দেখতে পেল। অরা ভাবল চিৎকার করে ডাকবে। কিন্তু ডাকতে পারল না। সামির চলে যাচ্ছে। অরা বলল,” ঠিকাছে… আমি রাজি।”
” ওকে।”
এই কথা বলেও তন্বি তার হাত ছেড়ে দিল। অরা চিৎকার দিয়ে উঠল। সামির অনেকক্ষণ ধরে অরাকে খুঁজছিল। অবশেষে তাকে ক্যাম্পাসের বড় মাঠে বালুর মধ্যে শুয়ে গড়াগড়ি করতে দেখা গেল। সামির দ্রুত ছুটে গেল সেখানে। অরাকে দুইহাতে উঠিয়ে বিচলিত গলায় বলল,” অরা, কি হয়েছে?”
অরা নিজের গায়ের বালু ঝেরে পরিষ্কার করছে। পায়ের জুতোজোড়া খুলে গেছিল৷ একটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে মনোযোগ দিয়ে জুতো খুঁজছে। সামিরের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেয়েও তার কাছে এই মুহূর্তে জুতোই বেশি জরুরী যেন।
সামির নিজেই অরার জুতো কুঁড়িয়ে এনে দিল। তারপর অবাক স্বরে জানতে চাইল,” এখানে পড়লে কিভাবে? ঠিকাছো? পেটে আঘাত লাগেনি তো? দেখি!”
অরা গরম কণ্ঠে বলল,” শাট আপ। ডন্ট ডেয়ার টু টাচ মি।”
দুপুরের কড়া রোদের চেয়েও অরার কণ্ঠের উত্তাপ বেশি। সামির চুপসে গেল। অরা জুতোটা সামিরের হাত থেকে নিয়ে তার মুখের সামনেই ঝারতে শুরু করল। সামির কেশে উঠে নরম গলায় বলল,” অন্তত তোমার ব্যাগটা আমার হাতে দাও।”
অরা অগ্নিদৃষ্টিতে বলল,” খবরদার আমার সাথে কথা বলবেন না আপনি৷ হু আর ইউ? আমি আপনাকে চিনি না।”
এইটুকু বলেই সে জুতো পায়ে দিয়ে তড়িৎগতিতে সামনে হাঁটতে লাগল। পায়ে কিছুটা ব্যথা লেগেছে। তাই হালকা খুঁড়িয়ে হাঁটছে। ভাগিস্য ঠিক বালুর স্তরের উপর পড়েছিল। শরীর গিজগিজ করছে বালুতে কিন্তু খুব একটা ব্যথা লাগেনি। সামির কাছে এসে বলল,”রোদের মধ্যে কষ্ট করে হাঁটছো কেন? ছায়াতে আসো।”
অরা কঠিন দৃষ্টিতে চাইল। সামির আর কিছু না বলে তার পেছনে এলো শুধু। বাইরে এসে হালকা গলায় বলল,” আইসক্রিম খাবে?”
অরা জবাব দিল না। সামির ফুচকাও অফার করল। কিন্তু অরা নিরুত্তর। বাধ্য হয়ে সে ট্যাক্সি নিল বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে। অরা চুপচাপ ট্যাক্সিতে উঠে বসল। যদিও তার চিৎকার করতে মন চাইছে। কিন্তু রাস্তায় সিন ক্রিয়েট করার মানে হয় না। তাই স্থির হয়ে বসে রইল। সামির কোমল কণ্ঠে বলল,” আই এম স্যরি।”
অরা কিড়মিড় করে বলল,” আপনার আসল উদ্দেশ্য কোনটা ছিল? আমাকে ডিসমিস করা নাকি আমাকে লজ্জায় ফেলা?”
সামির শান্ত গলায় বলল,” দু’টোই।”
অরা ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল। সামির বলল,” কথা শোনো আগে, আমি ভাবিনি তুমি সবার সামনে এমন একটা এনসার দিবে।”
” তাহলে কি আমার চুপ থাকা উচিৎ ছিল?”
” সেটাই ভালো হতো।”
” তাহলে কি আপনি আমাকে সিলেক্ট করতেন? বলুন?”
” আমি তোমাকে কোনো অবস্থাতেই সিলেক্ট করতাম না।”
অরা আহত কণ্ঠে বলল,” কেন? আমি বিভীষণ দেখিনি কিন্তু আপনাকে দেখেছি। ইনফ্যাক্ট আপনি তো বিভীষণের চেয়েও ভয়ংকর! আমার এতোদিনের আশা, আকাঙ্খা সব নষ্ট করে দিলেন। কেন এটা করলেন আপনি?”
সামির কথা না বলে অরার দিকে একটা খাম বাড়িয়ে দিল। অরা বিরক্তি নিয়ে বলল,” কি এটা?”
” খোলো।”
অরা খাম খুলে দেখল চাকরির এপয়েন্টমেন্ট লেটার। সিলেটের একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সামিরের চাকরি হয়ে গেছে। সে আশ্চর্য হয়ে বলল,” এর মানে কি? আপনি ইন্টারভিউ কখন দিলেন?”
” তুমি চট্টগ্রাম ছিলে তখন। তাই জানো না। এতোদিন পর লেটার এসেছে। আমার আশা ছিল না। কিন্তু হয়ে গেল।”
“ভার্সিটি ছেড়ে দিবেন?”
সামির হাসিমুখে বলল,” হুম। সিলেট যাচ্ছি আমরা। আমাদের রাজকন্যার জন্ম হবে সেখানে।”
তার কণ্ঠ স্বপ্নময়, চোখ দু’টো চকচক করছে। অরা তার দিকে চেয়ে বলল,” আগে বলেননি কেন? তাহলে আমি কষ্ট করে পরীক্ষাই দিতাম না।”
” এই লেটার আজকেই এসেছে অরা৷ আমি নিজেও তো জানতাম না। কিন্তু সমস্যা নেই। তুমি ভালো প্রিপারেশন নিয়েছো। এবার সিলেটের কোনো ভালো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারবে। আমরা সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় বাসা নিবো। তুমি নিজের মতো করে সাজাবে সবকিছু। ”
অরা চঞ্চল কণ্ঠে বলল,” আম্মুরাও যাবে আমাদের সাথে?”
সামির মনখারাপ নিয়ে বলল,” না, শুধু আমরা দু’জন যাচ্ছি।”
অরার মনটা নিভে গেল এবার। সবাইকে ছাড়া সে থাকবে কিভাবে? এই কয়েকদিনেই পুরো পরিবার এতো আপন হয়ে গেছে যে তাদের ছাড়ার কথা চিন্তাও করা যায় না! কি অদ্ভুত! ছোট থেকে শ্বশুরবাড়ির ব্যাপারে কত অভিযোগ শুনতো। কিন্তু তার কাছে শ্বশুরবাড়িটা পুরো স্বপ্নের মতো। যেন এক টুকরো সুখের নীড়!
তবে একটা বিষয় ভেবে শান্তিও লাগছে তার। তন্বি নামক ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে। তার অত্যাচারও সহ্য করতে হবে না এবার। যা হয় তা বুঝি ভালোর জন্যই হয়।
তবুও অরা একটু অসন্তুষ্ট গলায় বলল,” স্যারদের সামনে আপনি আমাকে শাড়ি নিয়ে ওভাবে না ঝারলেও পারতেন। এটা কিন্তু ঠিক হলো না।”
সামির বলল,” তোমাকে বাইরে বের হলে শাড়ি পরে ফুলটুসী সাজতে নিষেধ করি আমি। সবাই তাকিয়ে থাকে৷ আমার দেখতে একদম ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে প্রত্যেকের চোখ খুলে রেখে দেই।”
” তাহলে আপনি কেন ইন করা শার্ট পরে, হাতা গুটিয়ে, চুলে শ্যাম্পু করে ফুলবাবু সেজে বের হোন? এখন থেকে মুখে কালি মেখে বের হবেন। চুলে একগাদা তেল মেখে রাখবেন। অন্যরা আপনাকে দেখলে সেটা আমারও ভালো লাগে না।”
সামির হু-হা করে হেসে অরাকে জড়িয়ে ধরল। ফিসফিস করে বলল,” তুমি ডিসকোলিফাই হয়ে গেছো অরাবতি। এবার তাহলে কথা রাখো। হ্যান্ডেল মি।”
অরা আলতো করে সামিরের গালে চুমু দিল। সামির ভ্রু কুঁচকে বলল,” এটা চিটিং। এভাবে কিস করলে তো হবে না!”
অরা মিনমিন করে বলল,” বাকিটা বাসায় গিয়ে।”
সায়ান আজ চলে যাচ্ছে। সকাল দশটায় তার ফ্লাইট। তাকে বিমানে তুলে দিতে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এসেছে সবাই। নীলিমা ভীষণ কান্নাকাটি করছেন। এখন ছোট ছেলে যাচ্ছে। দুইদিন পর বড়ছেলেও চলে যাবে। তার সংসারটা শূন্য হয়ে থাকবে। তিনি কিভাবে সামলাবেন নিজেকে?
সায়ানের খুব কষ্ট হচ্ছে। সামিয়া পর্যন্ত তার যাওয়ার দুঃখে কাঁদছে। অথচ রূপার যেন কোনো হেল-দোলই নেই। সকালে সে রূপার কাছে বিদায় নিতে গিয়েছিল। রূপা হাসিমুখে তাকে বিদায় দিয়েছে। সায়ান মলিন মুখে জানতে চাইল,” তোমার কি একটুও খারাপ লাগছে না রূপা?”
রূপা চোখ বড় করে বলল,” এখানে খারাপ লাগার কি আছে? তুমি কি ম-রে যাচ্ছো, আজব!”
ইশ, রূপা এতো পাষাণ কেন হলো? সে একটু নরম হলে কি হতো? সায়ানকে জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদলে কি এমন ক্ষতি হতো? সে এয়ারপোর্টেও আসেনি। কি অদ্ভুত মেয়ে! ফোনটাও ধরছে না। শেষবারের মতো আরেকটু কথা হয়ে যেতো!
অথচ সায়ান জানে না, রূপা বাসায় বসে হিঁচকি তুলে কাঁদছে এখন৷ ফোন ধরার মতো অবস্থায় সে নেই। সায়ানকে হাসি মুখে বিদায় জানাতে পারবে না বলেই সে এয়ারপোর্টেও আসেনি। নিজের এমন দূর্বল রূপ সে সায়ানকে দেখাতে চায় না!
সায়ান অরার কাছে গিয়ে বলল,” ভাবি, রূপাকে দেখে রেখো৷ তোমার কাছে ওকে আমানত রেখে গেলাম।”
অরা হেসে বলল,” চিন্তা কোর না সায়ান ভাই। আমি সবসময় রূপার খেয়াল রাখব।”
” আমার একটুও যেতে মন চাইছে না। দেহ কানাডায় গেলেও মন এখানে পড়ে থাকবে। রূপার কাছে।এবার বুঝেছি…কেন ভাইয়া যেতে পারেনি।”
অরা চমকে বলল,” মানে?”
” ভাইয়া পিএইচডি’র জন্য আমেরিকায় স্কলারশিপ পেয়েছিল না?যায়নি তো।”
অরার দৃষ্টি স্তিমিত হয়ে এলো। হতভম্ব গলায় শুধাল,” কেন যায়নি?”
” তুমি জানতে না?”
অরা দুইপাশে মাথা নাড়ল। সায়ান জীভ কাটল এবার। সে কি তাহলে ভুল জায়গায় ভুল খবর দিয়ে ফেলেছে? যেই কথা সামির নিজে বলেনি সেই কথা আগ বাড়িয়ে তার বলার দরকার ছিল না। ভুল হয়ে গেল। কিন্তু যেটা মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে সেটা তো আর ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। সায়ান টিস্যুতে নাক মুছে বলল,” আচ্ছা ভাবি, বাদ দাও।”
” বাদ কেন দিবো? উনি স্কলারশিপ রিজেক্ট করেছিলেন নাকি? সায়ান ভাই, কি হয়েছিল আমাকে বলোতো।”
” আমি এর বেশি কিছু জানি না ভাবি। সেজন্যই বললাম বাদ দাও। তোমাদের খুব মিস করব।”
অরা কোনো উত্তর দিল না। সে সায়ানের এই মাত্র বলা কথাটি নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। সামির পিএইচডি’র জন্য স্কলারশিপ রিজেক্ট করে দিয়েছে? কিন্তু কেন?
সন্ধ্যায় একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। সামির বলেছিল তার কিছু বন্ধু আসবে। অরা যেন একদম সাজ-গোজ না করে। শাড়ি তো নিষিদ্ধ। সাধারণ একটা কামিজ পরে মাথায় ওরনা দিয়ে তৈরী হলো সে। মেহমানদের জন্য রান্না-বান্না করল। নীলিমাই অর্ধেক কাজ করে দিচ্ছিলেন। অরার তেমন কষ্টই হলো না। সে বলল,” আপনাকে ছেড়ে আমি সিলেটে একা কিভাবে সব সামলাবো আম্মু? আপনি তো আমাকে কাজ করতে না দিয়ে একদম বিগড়ে ফেলেছেন।”
নীলিমা বললেন,” প্রথম কিছুদিন তোমার মাকে এনে নিজের কাছে রেখো। অন্তত ডেলিভারি পর্যন্ত। এরপর আমিই চলে আসব নাতি পালতে।”
অরা হেসে উঠল। সামির মনে-প্রাণে চাইছে মেয়ে হোক। সুমন সাহেবেরও প্রত্যাশা তাই। কিন্তু নীলিমা নাতি চান। সেটা তার কথাতেই বোঝা যায়। ভুল করেও মুখ দিয়ে নাতনি উচ্চারণ করেন না তিনি।
মেহমানদের দেখে অরা পুরোপুরি বিব্রত হয়ে পড়ল। সেদিন ভাইভা রুমে যে কয়জন স্যার উপস্থিত ছিলেন তারা প্রত্যেকেই এসেছেন। সেদিন তো অরা তাদের স্যার বলে ডাকছিল। কিন্তু আজ সবাইকে ভাইয়া বলে ডাকতে হচ্ছে। তারাও কি স্বাচ্ছন্দ্যে অরাকে ভাবি বলে ডাকছে! অস্বস্তিকর ব্যাপার! সামিরের চলে যাওয়ার খবরে সবাই খুব ব্যথিত। অরার সাথে তাদের বেশি একটা দেখা হয়নি। তবুও যতটুকু দেখা হয়েছে… তারা ভাবি ডেকে অস্থির করে তুলেছে। অরা লজ্জায় ঘরে এসে বসে রইল। এতোকিছুর মধ্যে সে স্কলারশিপের ব্যাপারটা সামিরকে জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেল।
চলবে