রুপালি মেঘের খামে পর্ব-৩৫

0
652

#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz

৩৫.
কেবিন রুম ফুল দিয়ে ভর্তি হয়ে গেছে। সামিরের স্টুডেন্টরা একের পর এক তাকে শুভেচ্ছা জানাতে ছুটে আসছে। সবার মুখ হাসি হাসি। শোকসভা কেটে গিয়ে আনন্দ সভা বসেছে।

অরার এখনও কিছু বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যিই কি সামির তার সামনে বসে আছে? নীলিমা বললেন,” দেখলে তো সামির ভালো আছে, এবার তুমি নিজের কেবিনে গিয়ে রেস্ট করো।”

অরা অনুরোধ করে বলল,” আমি এখানে থাকব আম্মু প্লিজ।”

সামির বলল,” যাও অরা। একটু পর আমিই তোমার কাছে আসব।”

নীলিমা মুখ ভোঁতা করে বললেন,” আহারে, ভাঙা পা নিয়ে উনি নাকি বউয়ের কেবিনে যাবেন। শখ দেখো ছেলের!”

সকলের মৃদু হাসির গুঞ্জন শুরু হলো৷ অকারণেই প্রতিটি কথায় হাসছে সবাই। অরা কাউকে খেয়াল করছে না। তার মা, বাবা, শাশুড়ী, দেবরও যে এখানেই উপস্থিত তারও তোয়াক্কা না করে হঠাৎই সামিরকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল। শুধু তাই নয়, আবেগে বেসামাল হয়ে সামিরের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে লাগল।

একজন নার্স খাবার নিয়ে ঢুকল। বলা হলো ভীর কমাতে। নীলিমা খাবারের প্লেট রেখে বললেন,”অরা, পারলে একটু খাবারও খাইয়ে দিও আমার ছেলেটাকে! শুধু আদরেই কি ওর পেট ভরবে?”

অরা এই কথা শুনে প্রচন্ড লজ্জা পেয়ে যায়।প্রত্যেকেই খুশিমনে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। অরা আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই তখনি সামিরের নাকে, মুখে, গলায় একনাগাড়ে চুমু দিতে লাগল। সামির নার্সের সামনে এতো বেশি অপ্রস্তুত হলো যে অরাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইল।

কিন্তু তৃষ্ণার্ত অরা কিছুতেই থামতে চাইছে না। সামিরের জ্ঞান ফেরার জন্য অপেক্ষমাণ ভয়াবহ যন্ত্রণাময় সময়গুলোর হিসাব যেনো এখনি মিটিয়ে নিতে হবে তাকে।

নার্স বলল,” আপু, এখন উনার ঔষধ খাওয়ার সময়। আর একটা ইঞ্জেকশন পুশ করতে হবে।”

” ঠিকাছে করুন। কিন্তু আমি এখানেই থাকব।”

নার্স সামিরের পায়ে ইঞ্জেকশন পুশ করল। অরা ভয়ে শিউরে উঠল। অথচ সামিরের কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। মানুষ না রোবট? অরা বলল,” এবার আপনি যান৷ উনাকে ঔষধ আমিই খাওয়াতে পারব৷”

নার্স একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে সামিরের দিকে তাকাল। সামির তাকে ইশারায় যেতে বলায় সে চলে গেল। অরা হাসিমুখে সামিরকে জড়িয়ে ধরল এবার। এতো খুশি লাগছে তার! যেন দ্বিতীয় জীবন পেয়েছে।

অরার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকাল সামির। তার মুখটা ধরে বলল,” কি অবস্থা হয়েছে তোমার! চুল আঁচড়াও না কয়দিন? চোখের নিচে এমন কালো দাগ পড়লো কিভাবে? ভাসা ভাসা সুন্দর চোখগুলো একদম কোটরে ঢুকে গেছে।”

অরা সামিরের বুকে মাথা ঠেঁকিয়ে বলল,” আপনার জন্যই তো হয়েছে সব। আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে বেডে শুয়ে থাকতে কে বলেছিল? দিন-দুনিয়ার কোনো খবর রেখেছেন? এদিকে আমি মরতে মরতে বেঁচে আছি।”

” আচ্ছা এদিকে তাকাও৷ তোমাকে দেখি ভালো করে।”

অরা অভিমানী স্বরে বলল,” খুব কষ্ট দিয়েছেন আমাকে।”

সামির অরার চিবুক ধরে কোমল গলায় বলল,” আমার আদরের বউটা, সামনে ঘুরে বসো।”

” কেনো?”

” বসতে বলেছি।”

অরা সামিরকে পিঠ দেখিয়ে ঘুরে বসলো। সামির একটানে অরার চুলের খোঁপা খুলে ফেললো। বেডের সাইড টেবিলে একটা পরিষ্কার প্লাস্টিকের চিরুনি ছিল। সেটা হাতে নিল।

অরা বলল,” আরে কি করছেন?”

” চুল আঁচড়ে দিচ্ছি।”

” আমি নিজেই আঁচড়াতে পারি।”

” একদম চুপ। কত আঁচড়াতে পারো সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। এতো সুন্দর চুলের কি অবস্থা করেছো! জট লেগে পাখির বাসা হয়ে আছে। গত দুইদিন ধরে তুমি কি কি করেছো সায়ান সব বলেছে আমাকে । প্রথম দিন নাকি ল্যাব থেকে বিষাক্ত শিশি নিয়েছিলে? রূপা না ধরলে কি হতো? কেন এতোবড় পাগলামি অরা? তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কি করতাম?”

সামির অরাকে নিজের দিকে ঘুরিয়েই দেখল সে কাঁদছে। কিন্তু কষ্টের কান্না নয়, খুশির। সামিরের বকা শুনে তার অসম্ভব ভালো লাগছে। এতো শান্তি আসছে মনে! ‌

সামির একটু নরম হয়ে অরার দুইহাত মুঠোয় নিল। চুমু দিয়ে বলল,” আর কখনও এরকম কোর না। মেঘবতীকে ছাড়া সামির একদম বাঁচবে না।”

অরা একটু আর্তনাদ করে বলল,” খুব ভয় লাগছিল। আপনার যদি কিছু হতো…”

সামির অরার ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে মুখ দিয়ে শব্দ করল,” শশশ..”

অরা চুপ হয়ে গেল। সামির তার কপালে কপাল ঠেকাল। একে-অপরের দিকে তারা নির্ণিমেষ চেয়ে রইল। নিঃশ্বাসের শব্দ অনুভব করছিল। তারপর সামির অরার শুষ্ক, নরম, অবিশ্রান্ত ঠোঁটে চুম্বন করল। অরা চোখ বুজল। মুহুর্তেই গভীর ভালোবাসায় সিক্ত প্রলম্বিত সুখে তলিয়ে গেল তার হৃদয়।

হসপিটালের ট্যারেসে কফি মগ হাতে নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে রূপা আর সায়ান। রূপা উজ্জ্বল মুখে বলল,” আজকে আমার খুব শান্তি লাগছে। নাইটমেয়ার শেষ হয়েছে অবশেষে। অরার অবস্থা আর দেখতে পারছিলাম না।”

সায়ান হালকা করে হাসল। রূপার দিকে চেয়ে থেকে বলল,”রূপা, তুমি খুব ভালো একজন বেস্টফ্রেন্ড আর খুব ভালো মেয়েও।”

রূপা ঠোঁটে হাসি আনার চেষ্টা করল এবং বলল,” তাই?”

” হুম। তোমার কাছে আমি ঠিক কতটা কৃতজ্ঞ বলে বোঝাতে পারব না। ভাবির অসুস্থতায় তুমি অনেক খেয়াল রেখেছো। আমার মা-বাবাকেও সামলে রেখেছো। মাঝখানে বাবাও অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁকেও হসপিটালে ভর্তি করতে হয়েছে। তিনিও এখন মোটামুটি সুস্থ। তুমি না থাকলে আমি আর সামিয়া এতো দ্রুত এসব সামলাতেই পারতাম না।”

রূপা মাথা নিচু করে হাসল। তারপর কিছুটা আনমনা হয়ে বলল,” আমি জন্মের পর থেকেই স্বপ্ন দেখতাম ঠিক তোমাদের মতো একটা পরিবারের। কখন সবাইকে এতো আপন ভাবতে শুরু করেছি তা নিজেই জানি না।”

রূপা ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে দেখে সায়ান মজা করার উদ্দেশ্যে বলল,” আমার মনে হয়, পলিটিক্যাল সাইন্স বাদ দিয়ে নার্সিং-এর কলেজে ভর্তি হলেই তুমি বেশি ভালো করতে।”

রূপা কটমট চোখে চাইল,” তুমি কি আমাকে নিয়ে মজা করছো?”

সায়ান শব্দ করে হেসে উঠল। রূপা রাগ করে যেতে নিলেই সে হাত টেনে ধরল। গালে আলতো করে চুমু দিয়ে বলল,” আই লভ ইউ, আমার রূপালি চাঁদ!”

রূপা লাজুক হাসল। সায়ানের গলার পেছনে হাত বেঁধে বলল,” আমার গাঁধারাম, আই লভ ইউ টু।”

সায়ান একটু মনখারাপ নিয়ে বলল,” ভাইয়া বলেছে এমবিএ’র আগে বিয়ে সম্ভব না। হয়তো আমি এই মাসেই কানাডা চলে যাচ্ছি। দীর্ঘসময়ের দূরত্ব। আমাকে ভুলে যাবে না তো।”

রূপা ছলছল চোখে বলল,” নিজেকে ভুলে যেতে পারি কিন্তু তোমাকে ভোলা সম্ভব না।”

সায়ান ব্যাকুলতা নিয়ে রূপার ঠোঁটে চুমু দিল। তখনি হুট করে সামিয়া উপস্থিত হলো সেখানে। এমন দৃশ্য দেখে শব্দ করে কেশে উঠে বলল,” আ’ম স্যরি, আ’ম স্যরি!”

রূপা অস্বস্তি নিয়ে দ্রুত সরে দাঁড়াল। সায়ান রেগে বলল,” তোর এখানে কি কাজ? ”

সামিয়া দুই হাতে চোখ ঢেকে বলল,” স্যরি, ফোর রং টাইমিং। কিন্তু মা তোমাকে খুঁজছে ছোটভাইয়া।”

” ঠিকাছে যা। আমি আসছি।”
___________________________
” কি অবস্থা বাবা?”

আরিফ সাহেবকে দেখে সামির শোয়া থেকে উঠে বসতে চাইল,” বাবা, আসুন।”

” অসুবিধা নেই। তুমি শুয়ে থাকো। শরীরের অবস্থা কেমন?”

” এখন তো ভালোই আছি৷ শুধু ডান পায়ের ব্যথাটাই কমছে না।”

” এখনও ব্যথা কমেনি? বলো কি? লিগামেন্ট- ফিগামেন্ট ছিঁড়ে গেল না তো আবার?”

অরা বলল,” আল্লাহর রহমতে সেরকম কিছু হয়নি বাবা। ডাক্তার বলেছে দুইদিন বেডরেস্টে থাকলেই সব ব্যথা সেরে যাবে। হাঁটতে-চলতেও আর অসুবিধা থাকবে না।”

” যাক ভালোয় ভালোয় সুস্থ হয়ে গেছো এতেই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আমার মেয়েটা তো পাগলই হয়ে যেতো তোমার কিছু হলে।”

সামির কোমল হেসে অরার দিকে চাইল। বলল,” ওর কিছু হলে আমিও কি বাঁচতাম?”

অরা লজ্জায় মাথা মুড়ল। অপ্রস্তুত গলায় বলল,” তোমরা কথা বলো। আমি বাইরে যাচ্ছি।”

সকালেও অরার শরীর খুব দূর্বল ছিল। উঠে হাঁটার শক্তিটাও ছিল না। অথচ এখন গটগট করে হাঁটছে। যেন সম্পূর্ণ সুস্থ সে। মনের সুস্থতাই শরীরকে আশিভাগ সুস্থ করে দেয়।আরিফ সাহেব আরাম করে বেডের পাশের টুলটিতে বসতে বসতে বললেন,” সুখবরটা মনে হয় এখনও পাওনি তুমি।”

সামির ভ্রু কুঁচকে শুধাল,” কি সুখবর?”

” অরা নিজের মুখেই তোমাকে বলবে।”

অরা ইমারজেন্সি ইউনিটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। নীলিমা বের হয়ে ওয়েটিংরুমে এলেই সে কাঁপা কণ্ঠে ডাকল,”আম্মু।”

নীলিমা পেছন ফিরে অরার মুখ দেখেই হেসে উঠলেন।আদুরে স্বরে বললেন,” আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছো? কিছু বলবে মা?”

অরা মাথা নিচু করল। সে কিভাবে এই কথা বলবে বুঝতে পারছে না। নীলিমা এখানে এসেছিলেন রাতে সামিরের সেবার জন্য নিয়োজিত নার্সের সাথে কথা বলতে। কিন্তু অরা চাইছে না কোনো নার্স সামিরের সাথে থাকুক। তাও মহিলা নার্স! প্রয়োজনে সে নিজেই থাকবে। সামিরকে ঔষধ খাওয়াবে, কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে দেখবে, সময়মতো ডাক্তারকে ওর অবস্থা জানাবে৷ মানে একজন নার্সের যতসব করণীয় তার সবকিছুই অরা নিজেই করবে।

সামিয়ার ভার্সিটিতে এক্সাম শুরু হয়েছে৷ তাই সে ফিরোজাকে নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। ফুলবানু সেখানে একা। অরার মা-বাবাও চলে যাবেন। সন্ধ্যা হয়ে গেলে কেবিনে বাইরের মানুষ প্রবেশের অনুমতি নেই। শুধু রোগীর সাথে সর্বোচ্চ একজন পরিবারের মানুষ থাকতে পারবে।

নীলিমা আজরাতে সুমন সাহেবের কেবিনেই থাকবেন। তিনিও খুব অসুস্থ। নীলিমা বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। একসাথে বাপ-ছেলে অসুস্থ হয়ে গেল। দুইজনের খেয়াল রাখা তাঁর একার পক্ষে মুশকিল। তাই অরা নিজে থেকেই দায়িত্বটা নিতে চাইছে। নার্সের ভরসায় সে সামিরকে রাখতে পারবে না।

অরা অনেকক্ষণ ধরে চুপ আছে দেখে নীলিমা কাছে এসে হাত দিয়ে তার মুখ তুলে বললেন,” আরে, কথা বলে না কেনো মেয়েটা? বলো কি হয়েছে?”

” আম্মু আমি বলছিলাম যে আমি কি আজরাতে আপনার সাথে হসপিটালে থেকে যাবো? আসলে বাসায় গিয়ে আমার মন টিকবে না। তাছাড়া আমি আপনাকে হেল্পও করতে চাই। আপনি একা আর কয়দিক সামলাবেন বলুন?”

নীলিমা অরার চোখের ভাষা পড়েই চট করে বুঝে ফেললেন আসল কাহিনী,” আমাকে হেল্প করতে চাও? কিন্তু তুমি নিজেই তো অসুস্থ।”

” সমস্যা নেই। আমি পারব।”

নীলিমা একটু ঠাট্টা করার জন্য বললেন,” তাহলে আজরাতে তোমার বাবার একটু খেয়াল রেখো। তাকে দেখার মতো কেউ নেই। নার্সের ভরসায় তো আর ছাড়া যায় না। বয়স্ক মানুষ! তাই দায়িত্বটা তোমাকেই দিচ্ছি। বেশি কিছু না, এই কখন কি লাগে..ঔষধ,খাবার,পানি সব এগিয়ে দিবে। বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হলে ধরে-ধরে নিয়ে যাবে। আর বেশি সমস্যা হলে নার্সদের ডেকে নিও। ওরা তোমাকে হেল্প করবে। পারবে না?”

অরার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দপ করে নিভে গেল। আহত চোখে বলল,” জ্বী, পারবো।”

নীলিমা খুব জোরে হাসতে লাগলেন। অরা একটু অপ্রতিভ হয়ে উঠল। নীলিমা বললেন,” তুমি কি আসলেই আমাকে হেল্প করতে চাও নাকি সামিরের কেবিনে থাকতে চাও? কোনটা?”

অরা লজ্জা পেয়ে হেসে দিল। নীলিমা অরার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” আমি নিজেই এটা তোমাকে বলবো ভেবেছিলাম।তোমার কাছেই সবচেয়ে ভালো থাকবে সামির। এটা আমি বিশ্বাস করি। সারাজীবন এভাবেই ওর খেয়াল রেখো!”

অরা মাথা নেড়ে বলল,” রাখব।”

সামিরের হাসপাতালে আর কিছুদিন থাকার কথা ছিল। কিন্তু পরদিনই সে এতো সুস্থ হলো যে ডাক্তার ওকে চেকাপ করে বিকালের মধ্যে রিলিজ করে দিলেন। হুইল চেয়ারে করে তাকে বাড়ি আনা হলো। রূপা সবার সামনেই জিজ্ঞেস করে ফেলল,”কি এমন সেবা করেছিস তুই যে ভাইয়া একদিনেই সুস্থ হয়ে গেল? সিকরেটটা কি?”

সামিয়া আর সায়ান হেসে উঠল। অরা লজ্জায় হতভম্ব। এর মধ্যে ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট পাবলিশ হয়ে গেছে। পরীক্ষার তিনদিনের মাথায় ওয়েবসাইটে রেজাল্ট চলে আসে। সামির সকালেই চেক করেছে। অরা এখনও রেজাল্টের বিষয়ে কিছু জানে না। সে সারাক্ষণ সামিরের সুস্থতা নিয়েই ব্যস্ত। সামির সকালে কি খাবে, দুপুরে কি খাবে এসব নিয়ে তার যত চিন্তা।

ঠিক বারোটার দিকে সামিরকে একটা ঔষধ খাওয়াতে হয়। অরা গরম গরম চিকেন স্যুপ আর ঔষধ নিয়ে এসেছে। তখন সামির বলল,” রেজাল্ট দেখেছো তোমার?”

অরা অবাক হয়ে বলল,” কিসের রেজাল্ট?”

সামির গরম চোখে তাকাল। তখনি অরার মনে পড়ল, আজ তার রেজাল্ট দেওয়ার কথা। রাতে ফেসবুকে দেখেছিল৷ সকাল হতেই ভুলে বসে আছে। সে জীভ কেটে বলল,” আসলেই তো, ভুলে গেছিলাম। এখনি চেক করছি।”

” দরকার নেই। আমি চেক করেছি।”

অরার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। কৌতুহল নিয়ে বলল,” কি রেজাল্ট?”

” তুমি ভাইভায় সিলেক্ট হয়েছো।”

অরা কতক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল,”আপনি খুশি হয়েছেন?”

” না।”

” কেন?”

” কারণ সিরিয়াল খুব পেছনে। ভর্তি হলেও ভালো সাবজেক্ট পাবে না। আর ভাইভা খুব কঠিন হবে।”

” আপনি কিভাবে বুঝলেন ভাইভা কঠিন হবে? আমি তো রিটেনে টিকে গেছি। তাহলে ভাইভায় টেকা কি এমন কঠিন কাজ?”

” পড়ো ভালো করে। কঠিন না সহজ সেটা পরে বুঝবে।”

পরীক্ষা শেষেও শান্তি নেই৷ ভাইভার জন্য নাকি আবার পড়তে হবে। কি মুশকিল! কিন্তু অরা ভাইভা’টা খুব সিরিয়াসলি নিল না। একটু দায়সারাভাবে পড়াশুনা করল। রেজাল্ট পাবলিশের পনেরোদিন পরেই ভাইভার জন্য ডাকা হয়।

পনেরোদিন পর। অরা মিটিংরুমে ঢুকেই আৎকে উঠল। প্রফেসরদের সাথে সামিরও বসে আছে। অরা জানতো না যে তাদের ভাইভা পরীক্ষায় সামির থাকবে। আগে কেন বলেনি সে? তাহলে এতো অবাক হতে হতো না। খুব ইতস্তত হয়ে টেবিলে বসতে নিয়ে সে হাতের ফাইল ফেলে দিল। তারপর দ্রুত সেটা তুলে বলল,” আ’ম স্যরি।”

একজন টিচার বললেন,” ইটস ওকে। এতো নর্ভাস হওয়ার কিছু নেই। টেক আ ডীপ ব্রিথ। মাথা ঠান্ডা রাখো।”

অরা মুচকি হেসে বলল,” থ্যাঙ্কিউ স্যার।”

সামির এতোক্ষণ চুপ ছিল৷ এবার বেশ গম্ভীর গলায় বলল,” শাড়ি কেন পরেছো? ভাইভা দিতে এসেছো নাকি নবীনবরণে?”

অরা হকচকিয়ে গেল। আজকের দিনটা তার জন্য খুব স্পেশাল তাই শাড়ি পরেছিল। কিন্তু সামির রেগে যাবে সে বোঝেনি। অন্যরাও কিছুটা অবাক হয়েছে। সামির এই ধরণের পোশাক-আশাক সংক্রান্ত প্রশ্ন কারো বেলায় করেনি। তাহলে এই মেয়েটির বেলায় কেন? অরা থতমত দৃষ্টিতে বলল,” স্যরি স্যার। ”

ভদ্র দেখতে স্যারটি পরিস্থিতি সহজ করার নিমিত্তে বললেন,” এনিওয়ে, শাড়ি অনেকেই পরেছে। নাথিং সিরিয়াস।”

অরা হাসার চেষ্টা করল। পরিস্থিতি সহজ হচ্ছে না। সে ভেবেছিল সামিরের জন্য একটু সাহস পাবে। অথচ সে নিজেই অরার আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন সব কৌশলী প্রশ্ন করছে যে অরা উত্তর দিতে গিয়ে হিমশীম খাচ্ছে। শেষ পর্যায় প্রত্যেক টিচারই চিরকুটে লিখে একটা প্রশ্ন করল। দশ সেকেন্ডের মধ্যে এর উত্তর দিতে হবে। মূলত আইকিউ যাচাইয়ের প্রশ্ন এটা।

অরা প্রত্যেকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল। কিন্তু সামিরের চিরকুট হাতে নিয়ে হতভম্ব বনে গেল। সবার সামনে এই প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দিবে? অথচ ভাইভায় টেকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্নটা ছিল,” মনে করো তুমি ভাইভায় ডিসকোলিফাই হয়েছো৷ এবার বাসায় ফিরে হাজব্যান্ডকে কিভাবে হ্যান্ডেল করবে?”

সময় যাচ্ছে। দশ সেকেন্ডের মধ্যেই বলতে হবে। অরা তাড়াহুড়ো করে বলে ফেলল,” আই উইল কিস হিম।”

সবাই চোখ বড় করে তাকাল। লজ্জায় অরার বাতাসে মিশে যেতে মন চাইছে। সামির বলল,” ইউ আর ডিসকোলিফাইড।”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে