#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz
৩৪.
আইসিউ’তে শুয়ে থাকা এক মৃত্যু পথযাত্রীর জন্য অরার বুকের পিঞ্জরে এতো উথাল-পাথাল ঢেউ, এতো যন্ত্রণা, এক নিমেষে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ভয়, চরম সর্বনাশের হাতছানি কর্ণকুহরে অবিরাম বেজে চলেছে। সন্তাপের আগুন পুড়তে পুড়তে সে কবেই ছাই বনে গেছে! নিজেকে একফোঁটা সামলে রাখার শক্তিটুকুও নেই। সামিরের কণ্ঠে আর কোনোদিন ‘আমার প্রজাপতি’ ডাক শোনা হবে না ভেবেই অরার চোখ থেকে অবিরাম অশ্রুপাত হচ্ছে। বুকে কি অসহ্য ব্যথা! ডাক্তার ম্যাডাম নরম কণ্ঠে বললেন,” ঠিকাছো মা তুমি? কেমন লাগছে এখন?”
অরা চোখ পিটপিট করে ভদ্রমহিলার চেহারাটা একবার দেখে পুনরায় চোখ বুজে নিল। সবকিছু খুব ঝাপসা লাগছে৷ হাত-পা থেকে শুরু করে মাথাটা পর্যন্ত অসহ্য যন্ত্রণায় ফেটে যেতে চাইছে।
” শুয়ে থাকো কিছুক্ষণ। খুব দূর্বল তোমার শরীর। হাজব্যান্ডের চিন্তায় তুমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছো।”
অরা অচেতনের মতো চোখ বন্ধ করে অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করল,” উনি কি বেঁচে আছেন?”
” নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোর না।”
অরা একটু পর আবিষ্কার করল সে সাদা একটা বিছানায় শুয়ে আছে। তার সামনে সায়ান হাত ভাঁজ করে একরাশ বিষণ্ণতার ছাপ চোখে-মুখে এঁটে দাঁড়ানো। নীলিমা শাড়ির আঁচল মুখে চেপে গুমরে কাঁদছেন। সুমন সাহেব ফ্যাকাশে মুখে নির্বিকার হয়ে চেয়ারে বসে আছেন। রূপা ঠিক অরার পাশে বসা।
অরার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল হঠাৎ। কি হচ্ছে এসব? সবাই এমনভাবে এইখানে বসে আছে যেনো শোকসভা চলছে। অরার অসহ্য লাগছে। মন চাইছে সবকিছু চুরমার করে ফেলতে। সবাইকে একবার হাসতে অনুরোধ করতে। এই কান্নাকাটির প্রতিযোগিতা তার সহ্য হচ্ছে না।
সে দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ রইল। কিন্তু তার চোখ দিয়ে তপ্ত জল অবাধ ধারায় গড়িয়ে চলেছে। সে সামিরের কথা জিজ্ঞেস করার সাহস একটুও পাচ্ছে না। যদি খারাপ কিছু শুনতে হয়? সেই শক্তি অরার দূর্বল মনের নেই। প্রতি মুহুর্তে তার মনটা ঝড়ের রাতের মোমবাতির মতো ধিকধিক করছে। যেকোনো মুহুর্তে নিভে যেতে পারে শিখা। অরা জোরে কয়েকবার শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারছে না।
ডাক্তার দৌড়ে কাছে এলেন। নার্সও এলো৷ সবাই কেমন উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। তারা অরাকে অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দিল। অরা সবার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেল।
ঘুমের মধ্যে সে অনুভব করল সামির এসে বসেছে পাশে। সন্তর্পণে তার কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,” কেমন আছে আমার অরাবতী?”
অরা মুচকি হাসলো। অসীম সুখে মন-প্রাণ শীতল হয়ে উঠল।
” আমার কি হয়েছে? কেনো আমাকে বিছানায় শুইয়ে রাখা হচ্ছে? আমি কেনো বার-বার ঘুমিয়ে যাচ্ছি? কেনো সবকিছু এতো অদ্ভুত লাগছে? আমি কি, আমি কি মারা যাচ্ছি?”
“এইসব বলো না। আমি থাকতে তোমার কিছু হতে দিবো না।”
সামির অরার কপালে একটা গভীর চুমু দিল। অরা চোখ বন্ধ করে সামিরের হাতটা চেপে ধরে বলল,” প্লিজ ,আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আমার সাথে কথা বলতে থাকুন।”
” কথা বলতেই তো এসেছি। আমি তোমার কাছেই আছি। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।”
” কেন?”
সামির টলমল দৃষ্টিতে বলল,” আমার বিদায়ের সময় এসে গেছে যে।”
অরা মুখ ভেঙে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলো। তার সেই কান্নায় রাশি রাশি যন্ত্রণার শিহরণ প্রকাশ পাচ্ছে। এক নিঃশ্বাসে নিজের অব্যক্ত অনুভূতিগুলো যেনো কান্নার মাধ্যমেই প্রকাশ করতে চাইছে!
সামির বলল,” কেঁদো না অরা। তোমার কান্না মুখ দেখে তো আমি যেতে পারব না। কিন্তু যেতে হবেই। তুমি কি চাও ওই পারে গিয়েও আমি কষ্ট পাই?”
” আমিও আপনার সাথে যেতে চাই।”
” সম্ভব না।”
” কেন?”
” এখনও সময় আসেনি। সময় হলে আমি নিজেই তোমাকে নিয়ে যাবো।”
” আমি আপনাকে ছেড়ে কিভাবে থাকব?আমি ম-রে যাবো।”
ঘুমের মধ্যে অরাকে কাঁদতে দেখে রূপা ভয়ার্ত কণ্ঠে ডাকল,” অরা, এই অরা! কি হয়েছে তোর?”
এইবার চোখ খুলে অরা পাশে রূপা ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পেল না। রূপা বলল,” খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস?”
অরা অনেকটা যন্ত্রের মতো উচ্চারণ করল,” সবাই কোথায়?”
” বাইরে আছে। ডাকবো?”
অরার চোখ ভিজে এলো। বুকভরা ব্যথা নিয়ে প্রশ্ন করল,” উনি মারা গেছে৷ তাই না?”
” কি বলছিস এসব?”
” তোরা আমার কাছে সত্যিটা লুকাচ্ছিস কেন?”
” বিশ্বাস কর, এমন কিছু হয়নি। ভাইয়া একদম ঠিকাছে। ইন ফ্যাক্ট ডাক্তার বলেছে উনার অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো! ”
রূপা এইটুকু বলে হাসল। অরা নিষ্ঠুর কণ্ঠে বলল,” মিথ্যা কথা। উনি মা-রা গেছে৷ আমি জানি। রূপা শোন, আমিও ম-রে যাবো। তুই কি আমার বাচ্চাটাকে দেখে রাখতে পারবি? আমার সমস্ত চিন্তা শুধু ওকে নিয়ে। এছাড়া অন্যকোনো চিন্তা নেই। বাচ্চাটা বাবা-মা ছাড়া কিভাবে থাকবে? ওকে কখনও আমাদের অভাব বুঝতে দিস না। নিজের সন্তানের মতো আগলে রাখিস৷ আমাদের দশবছরের ফ্রেন্ডশিপের দোহাই৷ আমার বাচ্চাটাকে তুই দেখিস।”
রূপা কাঁদতে কাঁদতে বলল,” অরা, এসব কি বলছিস তুই? তোর কিচ্ছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
” না। আর কিচ্ছু ঠিক হবে না। যেই পৃথিবীতে উনি থাকবে না, সেই অন্ধকার পৃথিবীতে আমিও থাকতে চাই না।”
” তুই এতো নেগেটিভ চিন্তা কেন করছিস? ভাইয়া ভালো আছেন। বিশ্বাস কর আমার কথা!”
“তাহলে আমাকে উনার কাছে নিয়ে চল! আমি উনাকে দেখব।”
রূপার মুখের স্ফীতি হ্রাস পেল। অচিরেই চুপসে গেল সে। তার ঘাবড়ানো মুখশ্রী দেখে যা বোঝার বুঝে নিল অরা। হাতের সেলাইন টিউব টেনে খুলে ফেলল হঠাৎ। রূপা আর্তনাদ করে বলল,” পাগলামি করিস না! দোহাই লাগে।”
কোনো নিষেধ শোনার মানসিক অবস্থা তার এই মুহূর্তে নেই। সে দূর্বল শরীর নিয়েই হাঁটতে লাগল৷ মাথা ঘুরে আসছে, তবুও তোয়াক্কা করল না। বাইরে সায়ান দাঁড়িয়ে ছিল। অরাকে বাইরে আসতে দেখেই তেড়ে এলো। দুই হাতে জাপটে ধরল,” ভাবি, কোথায় যাচ্ছো?”
” আমি উনাকে দেখব। আমি উনাকে দেখব, ছাড়ো।”
সায়ান রূপার উপর রেগে তাকাল,” কিছু বলেছো তুমি?”
রূপা দুই পাশে মাথা নাড়ল। কান্নার জন্যে কথা আসছে না মুখ দিয়ে। সায়ান সামলানোর চেষ্টা করল,” ভাবি, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার কথা বিশ্বাস করো।”
অরা আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করল,” আমি উনাকে দেখতে চাই!”
সাবিরা ছুটে এলেন। মাকে দেখে অরা পাগলের মতো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। এর মধ্যে দুইদিন কেটে গেছে। কতকিছুই ঘটে গেছে। অরা কিছুই জানে না। সে কেবল অচেতনের মতো পড়ে থেকেছে বিছানায়। সাবিরা বিলাপের স্বরে বলতে লাগলেন,” আমার মেয়েটা… কি হয়ে গেল এসব! এই অল্পবয়সে এতো কষ্ট তুই কিভাবে সহ্য করবি? আমার সাথে চল। আমার বাড়িতে থাকবি। আমি তোকে চোখের সামনে রাখব।”
আরিফ সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন,” ওর সামনে কান্নাকাটি করছো কেন এভাবে? মেয়েকে সামলাবে নাকি নিজেকে?”
সাবিরা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন দ্রুত। এই অবস্থায় তাকেই শক্ত হতে হবে সবার আগে! অরা প্রশ্ন করল,” মা, তোমরা কখন এসেছো? আমি কিছু জানি না কেন? কি হচ্ছে? প্লিজ, আমাকে একবার উনার কাছে নিয়ে যাবে? ওরা কেউ আমাকে যেতে দিচ্ছে না!”
অরা বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। আরিফ ঠান্ডা গলায় বললেন,” সায়ান, আমার মেয়েকে সামিরের কেবিনে নিয়ে যাও।”
সায়ান দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে আপত্তি জানাল,” কিন্তু আঙ্কেল…”
” আমি যেতে বলেছি না?”
” ঠিকাছে।”
সায়ান অরার হাত ধরে বলল,” চলো ভাবি।”
খুশিতে হাসতে লাগল অরা। সামিরকে দেখতে পাবে সে। এর চেয়ে আনন্দের ব্যাপার আর কি হতে পারে? কেবিনের সামনে ভীড় জমে আছে। প্রত্যেকের মুখ মলিন। কারো কারো চোখে পানি। এদের কাউকেই অরা চিনতে পারল না।
সায়ান ফিসফিস করে বলল,” ভাইয়ার ভার্সিটি থেকে স্টুডেন্টরা এসেছে। এখন তুমি ভেতরে চলো। আমরা অন্যসময় দেখা করতে আসবে।”
অরা কঠোর গলায় বলল,” আমি এখনি দেখা করব।”
সায়ান হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ল। তাদের আসতে দেখে ছেলে-মেয়েরা পাশ কেটে জায়গা করে দিল। অরা চঞ্চলতা নিয়ে ছুটে গেল। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারল না। বাইরে থেকে কাঁচের দেয়াল ছুঁয়ে দেখল সামির শুয়ে আছে। তার সারা শরীরে ব্যান্ডেজ। মুখটুকু ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আর মুখেও অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। কি নিষ্প্রাণ! ভয়ানক করুণ এই দৃশ্য অরা সহ্য করতে পারল না। দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে যেতে নিচ্ছিল। সায়ান তাকে দুইহাতে ধরল। অরা মাথাটা একপাশে হেলিয়ে কাঁদতে লাগল অসহায়ের মতো।
সায়ান একজন নার্সকে উদ্দেশ্য করে বলল,” ভাবি হয় আমার। উনাকে একটু ভেতরে যেতে দিবেন প্লিজ!”
নার্স কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,” ঠিকাছে। কিন্তু শুধু দুই মিনিটের জন্য৷ আর শব্দ করে কাঁদবেন না।”
অরা নিজেকে শান্ত করতে চাইল। কান্নার দমকে কেঁপে উঠছে তার দেহ। সায়ান তাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। অরা আলতো হাতে সামিরের মুখটা স্পর্শ করল। বার কয়েক মর্মযন্ত্রণা নিয়ে ডাকল,” সামির, এই সামির, উঠুন। একটু কথা বলুন প্লিজ। রাগ করুন, বকা দিন৷ যা ইচ্ছা তাই করুন। তবুও আপনি আমাকে ছেড়ে যেতে পারবেন না৷ আমি সবকিছুর বিনিময়ে শুধু আপনাকে ফিরে পেতে চাই।”
সামির নিস্পন্দ অবস্থায় শুয়ে আছে। এতো নীরবতা অরার সহ্য হচ্ছে না। কখন সে চোখ খুলে তাকাবে? কখন আদুরে গলায় ডাকবে? প্রজাপতি, প্রজাপতি করে প্রাণ জুড়িয়ে দিবে! অরা সামিরের কপালে, নাকে, গালে অজস্র চুমু দিল। তীব্র আকাঙ্ক্ষায় তার বুক পুড়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় চিৎকার করতে মন চাইছে। তার চোখের পানিতে সামিরের মুখ ভিজে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর সায়ান ডাকল,” ভাবি, ওঠো এখন প্লিজ।”
অরা অনুরোধ নিয়ে বলল,” আরেকটু থাকি?”
সায়ান কি বলবে খুঁজে পেল না৷ তার বড্ড মায়া লাগছে। বড্ড কষ্ট হচ্ছে। কি করবে? জোর করে তো উঠিয়ে নেওয়া যায় না৷ ডাক্তার বলেছে সামিরের জ্ঞান ফেরার নিশ্চয়তা নেই। অরা সামিরের হাতটা নিয়ে চুম্বন করতেই আঙুল নড়ে উঠল। বিস্মিত হয়ে তাকাল অরা। বুকের মধ্যে উথাল-পাথাল শুরু হলো। সামির অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করল,” অরা!”
সায়ান চমকে উঠল। অরা সাথে সাথে সামিরের মুখের দিকে ঝুঁকে বলল,” এইতো, আমি আপনার কাছেই আছি। শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা? দেখতে পাচ্ছেন আমাকে?”
অরার কণ্ঠ কাঁপছে তীব্র উত্তেজনায়। সায়ান সামিরের অন্যপাশে এসে দাঁড়াল। অবিশ্বাসী গলায় ডাকল,” ভাইয়া!”
অরা সামিরের কথা শোনার জন্য কান পেতে দিল। তখন সামির বেশ দূর্বল গলায় বলল,” এক্সাম কেমন হয়েছে তোমার?”
অরা প্রচন্ড অবাক হলো। এই অবস্থাতেও সে এক্সামের খবর জানতে চাচ্ছে? এই লোক মানুষ না অন্যকিছু? প্রচন্ড খুশি আর বিস্ময়ে অরা ফুঁপিয়ে উঠল।
চলবে