#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz
৩৩.
এনসার শিট জমা দেওয়ার প্রায় বিশমিনিট পর শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। আজ ক্যাম্পাসে পরীক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভীড়। তাই গেইট পর্যন্ত ধাক্কাধাক্কি করে যেতে অনেক সময় লেগে গেল। কেউ লাইন ধরতে রাজি নয়। গার্ডরা বাঁশি বাজিয়ে ছেলে-মেয়েদের সতর্ক করছে। বাইরে গার্ডিয়ানদের লম্বা লাইন। অরা ঘাড় উঁচু করে সুমন সাহেবকে খোঁজার চেষ্টা করল। তিনি কোথাও নেই। বেশ অনেকটা সময় দাঁড়ানোর পরেও অরা তার শ্বশুরকে খুঁজে পেল না।
একজন দারোয়ান প্রশ্ন করলেন,” তোমার সাথে কেউ আসেনি?”
অরা ঠোঁট উল্টে বলল,” আমার বাবা বলেছিলেন এখানেই দাঁড়াবেন। এখন তো খুঁজে পাচ্ছি না।”
” ফোন করো।”
” ফোন তো আমার কাছে নেই। হলে ফোনসহ প্রবেশ নিষেধ। তাই বাবার কাছেই ফোন জমা দিয়ে গিয়েছিলাম।”
” চাইলে আমার মোবাইল থেকে ফোন করতে পারো।”
তিনি নিজের মোবাইল এগিয়ে দিলেন। অরা হাসল একটু। সুমন সাহেবের নাম্বার তার মুখস্ত নেই। তবে সামিরের নাম্বার মুখস্ত আছে। এতোক্ষণে সামিরের এখানে চলে আসার কথা। কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছে না কেন? ফোনও রিসিভ হচ্ছে না। অরা দারোয়ানের মোবাইলটা ফিরিয়ে দিয়ে বাইরে এলো।
পার্কিং লটের পাশ দিয়ে চলে গেছে একটা লম্বা রাস্তা। সেখানেই একপাশে বসে আছে রূপা। তার চোখ-মুখ লালচে। চেহারা খুব গম্ভীর। অরা দ্রুতপায়ে সেখানে ছুটে গেল। রূপার কাঁধে হাত রেখে বলল,” দোস্ত, তুই এসেছিস?”
রূপা শূন্যদৃষ্টিতে তাকাল। কেমন মরা কণ্ঠে বলল,” অরা!”
অরা খুশিতে রূপাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” জানিস, আমার পরীক্ষা বেশ ভালো হয়েছে। চান্স পাবো কি-না বলতে পারছি না। হিসাব করে দেখলাম আমি যে ইউনিটে পরীক্ষা দিয়েছি সেখানে আবেদন করেছে প্রায় সত্তর হাজার। অথচ সিট মাত্র ছয়শো। অর্থাৎ এক সিটের জন্য লড়াই করছে দশহাজার জন! আমি কি এতোগুলো মানুষকে পেছনে ফেলে একটা সিট দখল করতে পারব?কি জানি? আমি নিজের সবটুকু চেষ্টা করেছি। বাকিটা আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছি। আচ্ছা, উনি কোথায়?”
রূপার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি বের হলো। অরার হাত ভিজে গেল সেই চোখের পানিতে। সে বিস্ময়ে হালকা উত্তেজিত গলায় বলল,” কি হয়েছে রূপা? তুই কাঁদছিস কেন এভাবে?”
রূপা একহাতে নিজের মুখ ঢাকতে চেষ্টা করে। অরাকে সে কিভাবে জানাবে এই করুণ সত্যি? অরা তার মুখটা ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,” কিছু হয়েছে নাকি বাসায়? মা কি আবার তোকে কিছু বলেছে? নাকি দাদী? প্লিজ, কি হয়েছে আমাকে বল!”
রূপা ভাঙা গলায় আর্তনাদ করল,” অরা, তুই শক্ত হ প্লিজ। আমি জানি না তোকে কিভাবে বলব… কিন্তু সামির ভাই…”
রূপা তার কথা শেষ করতে পারল না। অরা মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিচ্ছিল। প্রচন্ড রোদের দাবদাহে তার দুনিয়া ঘুরে আসছে। সে অবসন্ন, কান্ত একইসাথে বিচলিত। রূপা তাকে শক্ত হাতে ধরে রাস্তার একপাশে বসায়। বোতল খুলে পানি খেতে দেয়।
অরা পানি মুখে নিল না। বড় শ্বাস ছেড়ে নিজেকে শক্ত করে শুধাল,” সামিরের কি হয়েছে রূপা?”
সত্যি কথা বলার সাহস রূপা পেল না। জিহ্বার সাহায্যে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,” কিছু না।”
” আমাকে সত্যি কথা বল। উনি কোথায়?”
রূপার আবার কান্না পেল। অরার বুকটা হালকা ধ্বক করে উঠল। মনের অস্থিরতা বেড়ে গেল বহুগুণ। ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চাইল,” বল না প্লিজ, কি হয়েছে?”
রূপা কোনমতে উচ্চারণ করল,” এক্সিডেন্ট করেছে।”
” কিহ!”
অরা দিশেহারার মতো তার শরীর ছেড়ে দিল। শ্বাসটা যেন গলার কাছে এসে আটকে গেল হঠাৎ। রূপা তাকে শান্ত করতে ক্রমাগত পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। অরা কাঁপা কণ্ঠে জানতে চাইল,” কি অবস্থা? উনি কেমন আছে?”
” তোকে নিতেই এসেছি আমি৷ সিরিয়াস কন্ডিশন। আইসিউতে।”
অরা হু হু করে কেঁদে উঠল। রূপা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” প্লিজ ভেঙে পড়িস না। শান্ত হ একটু। সব ঠিক হয়ে যাবে৷ শুধু আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।”
কয়েকজন মহিলা এসে পাশে দাঁড়াল। তারা ভাবল অরা অসুস্থ রোগী। সাহায্যের প্রয়োজন কি-না! রূপা বলল তাদের সাহায্য লাগবে না। মেয়েটার স্বামী এক্সিডেন্ট করেছে। তাই সে কাঁদছে। এই কথা শুনে একজন একটা সিএনজি ডেকে দিল। রূপা অরাকে নিয়ে কোনমতে সিএনজি’তে উঠে যায়।
সম্পূর্ণ রাস্তায় আর একটাও কথা বলে না অরা। রূপার বুকে মাথা ঠেঁকিয়ে চুপটি করে বসে থাকে। তার চোখের তপ্ত অশ্রুতে রূপার টি-শার্ট ভিজে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে সায়ান ফোন করে। রূপা জানায়, সে অরাকে নিয়ে আসছে।
হাসপাতালে পৌঁছে দেখা গেল সায়ান তাদের জন্য বাইরেই অপেক্ষা করছে। সিএনজি ভাড়া দিয়ে অরাকে ধরে নামাতে রূপাকে সাহায্য করে। অরা কোনো কথা বলছে না তখনও। কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। যেন সে একটা ঘোরে আছে। সায়ান অপরাধী স্বরে বলল,” স্যরি ভাবি। তখন তোমাকে সত্যি কথা বলতে পারিনি৷ ভাইয়া নিষেধ করেছিল। তোমার পরীক্ষা যেন ভালো হয় তাই গোপন রাখতে বলেছিল।”
অরা কোনো জবাব দিল না। সায়ান আর রূপা তাকে নিয়ে লিফটে উঠল। থার্ড ফ্লোরের করিডোরে দেখা হয়ে যায় ফিরোজা আর নীলিমার সাথে। মুখে শাড়ির আঁচল চেপে নীলিমা এমনভাবে কাঁদছেন যেন এটা কোনো শোকসভা। শাশুড়ীর কান্না দেখে অরা আরও হকচকিয়ে যায়। ফিরোজা বলল,” বউমারে এখান থেকা নিয়া যাও। ওয় এসব দেখলে সইয্য করতে পারব না।”
সায়ান বলল,” ঠিক৷ রূপা, তুমি ভাবিকে নিয়ে অন্যকোথাও বসো।”
অরা এতোক্ষণে দৃঢ় কণ্ঠে কেবল একটা কথাই উচ্চারণ করল,” আমি এখানে থাকতে চাই।”
” না ভাবি। প্লিজ রূপার সাথে যাও। ডাক্তার বলেছে ভাইয়ার একটু পরেই জ্ঞান ফিরবে। তখন আমরা সবাই যাবো দেখা করতে।”
সায়ান নিতান্ত মিথ্যা বলে অরাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল। রূপা তাকে ধরে করিডোরের অন্যপাশে নিয়ে স্টিলের আসনে বসালো। অরা কাঁদছে না এখন আর। কেমন চুপ করে আছে। চোখে-মুখে সে খুব অন্ধকার দেখছে। পৃথিবীটা যেন মাথার উপর ভেঙে পড়তে চাইছে। গতরাতের স্মৃতি মনে আসছে বার-বার। সামিরের হাসি মাখা মুখটা স্পষ্ট!
তাদের মধ্যে কথা হয়েছিল পরীক্ষা শুরুর আগে অরা সামিরের সাথে দেখা করেই হলে প্রবেশ করবে। পরীক্ষা শেষে বের হলে সামির পেছনের গেইটে তার জন্য অপেক্ষা করবে। যদি অরার পরীক্ষা ভালো হয়, তাহলে সে ট্রিট দিবে সামিরকে। আর যদি খারাপ হয়, তাহলে সামির ট্রিট দিবে তাকে। অরা ভেবেছিল ইচ্ছে করেই বলবে তার পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। কিন্তু বলাই হলো না। সব কেমন অসমাপ্ত থেকে গেল। সামির তো তার কথা রাখল না। কেন এমন হলো?
রূপা দুইহাত মাথায় ঠেঁকিয়ে বসে আছে। অরার গলাটা প্রচন্ড শুকিয়ে এসেছে। সে মৃদু কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” পানি।”
রূপা আশেপাশে বোতলটা খুঁজে পেল না। মনে হয় রাস্তায় ফেলে এসেছিল। তাই সে পানি আনার জন্য উঠল। তখন অরা দেখল সামনে ল্যাবরেটরি। কেউ নেই সেখানে। অনেকগুলো কাঁচের শিশি দেখা যাচ্ছে। অরা কি মনে করে উঠল। তার দাঁড়ানোর শক্তি নেই। তবুও সে দূর্বল পায়ে হেঁটে কাঁচের শিশিগুলোর কাছে গেল। একটা বিষাক্ত বোতলের ছোট্ট শিশি হাতে নিয়ে ওরনার আড়ালে লুকিয়ে ফেলল। ঠিক সেই সময় শুনল দু’জন নার্স আলাপ করছে, রিসেন্ট আনা আইসিউ এর পেশেন্ট নাকি মারা গেছে!
অরা তাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পায়। তার দুনিয়া কেমন কেঁপে ওঠে। রূপা পানি নিয়ে এসেছে। কিন্তু অরা তার জায়গায় নেই। রূপা ঘাবড়ে যায়। সে কি অরাকে একা ফেলে গিয়ে ভুল করেছে? দ্রুত এদিক-সেদিক খুঁজতে লাগল৷ হঠাৎ দেখল ল্যাবরেটরির সামনে দাঁড়িয়ে অরা একটা কাঁচের শিশি খুলে মুখে দিচ্ছে। রূপা “আল্লাহ” বলে চিৎকার দিয়ে উঠল। তারপর দৌড়ে সেখানে গেল। অরার হাত থেকে শিশিটা কেঁড়ে নিয়ে বলল,” কি করছিলি তুই এসব! পাগল হয়ে গেছিস?”
অরা প্রাণহীন চোখে চাইল। কিন্তু সে রূপার কথা শুনতে পেল না। তার অবয়বটাও ঝাপসা দেখতে পেল। সম্পূর্ণ পৃথিবী অন্ধকার আর নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে। মাথায় চিনচিনে ব্যথা। বুকের বামপাশ অবশ। চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে গেছে।
রূপার পেছনে সায়ানও এসে দাঁড়াল। অবাক হয়ে ডাকল,” ভাবি, কি হয়েছে?”
অরা তাদের কোনো কথা শুনতে পেল না। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে সংজ্ঞাহীনের মতো ঢলে পড়ল।
আধঘণ্টার মধ্যে ইমারজন্সি ইউনিটে এসে জড়ো হয় সবাই। অরা হঠাৎ করেই অজ্ঞান হয়ে গেছে। ভেতরে তাকে চেকাপ করছেন একজন মহিলা ডাক্তার। কিছুক্ষণ পর নার্স এসে জানাল,” সুখবর, পেশেন্ট প্রেগন্যান্ট!”
সুখবর শুনেও কারো মুখে হাসি ফুটল না। বরং সবার আরও বেশি মনখারাপ হয়ে গেল। নীলিমা কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
চলবে