#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz
৩২.
অরা মহাবিরক্ত। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে বেশ শান্ত স্বরে বলল,” কিছু মনে কোর না আপু। কিন্তু আমি যদি সত্যিই উনার কাজিন হতাম…তাও তোমার মতো মেয়েকে আমার ভাবি বানাতাম না।”
তন্বি ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,” কেন? আমি কি দেখতে সুন্দর না?”
” সৌন্দর্য্যই সবকিছু না৷ তোমার মতো হাজারটা সুন্দরী মেয়ে আছে পৃথিবীতে। এর মানে কি উনি সবাইকে বিয়ে করবে?”
তন্বি ক্ষেপে বলল,” বয়সে আমার চেয়ে ছোটই হবে তুমি। রেসপেক্ট রেখে কথা বলো, ওকে? ফাইজান স্যারের সাথে রিলেটেড সবকিছুই আমার কাছে ইম্পোর্ট্যান্ট। শুধুমাত্র এই কারণে আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। নাহলে কখনও আসতাম না।”
ঠিক এমন সময় সামির এসে অরার কোমরে হাত রেখে বলল,” চলো, স্ন্যাক্স কাউন্টারে যাই!”
তন্বির দৃষ্টি সেদিকে আটকে গেল। মুখের রঙ পাল্টে গেল নিমেষে। কেমন বিভ্রান্তি আর দ্বিধা নিয়ে তাকিয়ে রইল সে। অরা সামিরের হাতের উপর হাত রেখে বলল,” হুম জান। চলো।”
সামিরের প্রায় বিষম ওঠার উপক্রম হলো। অরা তাকে ‘জান’ বলছে। তাও আবার ‘তুমি’ করে! ব্যাপারটা ঠিক হজম হলো না। তন্বির মুখে চড়ুইপাখির মতো ছোট্ট হাঁ সৃষ্টি হয়েছে এতোক্ষণে।
অরা তন্বির দিকে চেয়ে বলল,” আজকে আমাদের বিয়ের তিনমাস হলো। সেটাই সেলিব্রেট করতে এসেছি।”
তন্বির চোখ দু’টো অচিরেই লাল হয়ে গেল। চেহারা অত্যন্ত ফ্যাকাশে। মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। সামির নরম গলায় বলল,” আমার মনে হয় তোমাদের আগেই পরিচয় হয়েছে। ”
অরা বলল,”না, এইতো এখন পরিচয় হলো। এতোক্ষণ তো তন্বি আপু আমাকে তোমার কাজিনই ভাবছিল। হাহাহা!”
সামিরও অরার সাথে হাসল। কিন্তু তন্বির মুখ পাথরের মতো শক্ত।
” আচ্ছা, তোমাদের কথা শেষ হয়েছে?” সামিরের প্রশ্নের জবাব অরা বলল,” আমি একটু পর আসছি।”
” ওকে।”
সামির চলে যেতেই অরা তন্বির কাছে এলো। একটু ফিসফিসিয়েই বলল,” আশা করি বুঝতে পেরেছো কেন আমার পাশের সিট তোমাকে দেওয়া সম্ভব না? কারণ এটা সারাজীবনের জন্য এঙ্গেজড হয়ে গেছে।”
তন্বির মুখ মেঘলাটে আকাশের মতো নির্জীব দেখায়। অরা হাসি মুখে সামিরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মনে অদ্ভুত একটা শান্তি অনুভব করে সে এখন।
আড়াই ঘণ্টার সিনেমায় পনেরো মিনিটের ইন্টারভেল। অরা বাথরুমে যাওয়ার কথা বলে হল থেকে বের হয়। তন্বি তখনও কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে। অরা তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ব্যাগ থেকে চিরকুটটা বের করে বলল,” এটা কি তোমার?”
হঠাৎ অরার আগমনে তন্বি চমকে যায়। চোখের জল মুছে নিয়ে বলল,” ইচ্ছে করেই আমাকে তুমি এখানে ডেকেছো, তাই না?”
” হ্যাঁ। কারণ আমি আমার বরকে নিয়ে একটু বেশিই পজেসিভ। তার দিকে অন্যকোনো মেয়ে তাকালেও আমি সহ্য করতে পারি না। আর তুমি তো ডিরেক্ট উনাকে লাইন মারছো!”
তন্বি থমথমে মুখে বলল,” আমার সামনে থেকে চলে যাও।”
” তোমার হাতে এটা কি?”
তন্বি সাথে সাথে তার হাতের জিনিসটা লুকিয়ে ফেলতে চাইল। কিন্তু অরা সেটা হতে দিল না। সে জোর করে তন্বির কাছ থেকে জিনিসটা কেঁড়ে নিয়ে বলল,” এই ছবির মানুষটা আমার। তাই তার ছবিও আমার কাছেই থাকবে। তুমি ইচ্ছে করলেই তার ছবি বের করে দেখতে পারো না।”
অরা চিরকুটটা তন্বির হাতে দিয়ে বলল,” আর কখনও আমার বরকে এইসব দেওয়ার সাহস করবে না। মনে থাকবে?”
তন্বি জবাব দিল না। অরা জবাবের অপেক্ষাও করল না। সামিরের ছবিটা নিজের ব্যাগে ভরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। রাগ আর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল তন্বি। প্রথম দেখায় অরাকে খুব সহজ-সরল মেয়ে ভেবেছিল সে। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে মেয়েটা মিচকা শয়তান! ইচ্ছে করে তাকে ডেকে এনেছে হ্যারেস করতে। তার এখানে আসাই উচিৎ হয়নি।
দুপুরের রান্না নিজের হাতেই শেষ করেছে রূপা। ফিরোজা তাকে টুক-টাক সাহায্য করেছে। রান্না শেষ হওয়ার পর ফিরোজা বলল,” এক বাটি মাংস খালাম্মার জন্য উঠায় রাখেন। উনি লবণ টেস্ট করব।”
রূপা কুণ্ঠিত গলায় বলল,” লবণ টেস্ট করার জন্য এক বাটি মাংস লাগবে?”
” উনি মাংস খাইতে খুব পছন্দ করে। আপনে নিজের হাতে নিয়া যান, তাইলে খুশি হইব।”
রূপা বেশ খানিকটা মাংসের ঝোল আর সাথে দু’টো রুটি নিয়ে ফুলবানুর ঘরে ঢুকল। তখন ফুলবানু সদ্য বাথরুম থেকে বের হয়েছেন। হাতে লোশন মাখতে মাখতে বললেন,” বাথরুমে পানি নাই৷ পেটও পরিষ্কার হয় নাই। তোমার চা খায়া আমার পেট ভারী হয়া গেছে। আঙুল দিয়া এতো গুতাইলাম, তাও গু বাইর হইল না।”
রূপা বিব্রত মুখে বলল,” আপনার জন্য মাংস এনেছি দাদী। ভালো করে হাতটা ধুঁয়ে নিন?”
” হাত কেমনে ধুইতাম? কলে তো পানিই নাই। তয় একটু লোশন লাগাইছি। আর গুয়ের গন্ধ করতাছে না।”
ফুলবানু তার লোশন মাখা হাত নিজের নাকে ধরে শুকলেন। রূপার প্রায় বমি আসার উপক্রম হলো। মাংসের বাটি কোনমতে টেবিলে রেখে বলল,” আপনি খান দাদী। আমি যাই।”
সে ঘর থেকে বের হতে নিলেই ফুলবানু ডেকে বললেন,” আরে থামো, এতো হাড্ডিওয়ালা মাংস দিছো কেন? একটাও তো নরম হয় নাই।”
তিনি সব মাংস হাত দিয়ে টিপে দেখছেন। ঘৃণায় চোখ-মুখ কুঁচকে এলো রূপার। ফুলবানু বললেন,” এই বাটি নিয়া যাও। ফিরোজারে বলো আমারে মাংস দিতে। আমি কেমন মাংস খাই তা ওয় জানে।”
রূপা দ্রুত মাংসের বাটি নিয়ে বের হয়ে এলো। সে এখন এই তরকারি নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিবে। বাথরুম থেকে এসে হাত না ধুঁয়ে লোশন লাগানো, সেই হাত দিয়ে আবার মাংস টিপে দেখা… ও মাই গড! এতো নোংরা মানুষও হয়?
মাঝপথে নীলিমা এসে বললেন,” আম্মা মাংস খায়নি?”
রূপা মৃদু হেসে বলল,” না। উনি নাকি নরম মাংস ছাড়া খাবেন না।”
” তাহলে এটা দাও। সায়ান আর ওর বাবা খেতে বসেছে তো। ওদেরকে দিয়ে দেই।”
রূপা কিছু বলার আগেই নীলিমা বাটি নিয়ে চলে গেলেন। রূপাও গেল পেছন পেছন। সুমন সাহেব আর সায়ান তখন মাত্র খেতে বসেছে। তাদের সামনে মাংসের বাটি রাখতেই দু’জন একসাথে মাংস নিতে শুরু করল। রূপা কয়েকবার সায়ানকে ইশারায় বোঝাতে চাইল যাতে সে মাংস না খায়। কিন্তু সায়ান তার ইশারা বুঝলই না। সুমন সাহেব আঙুল চেটে খেতে খেতে বললেন,” মাংসের তরকারিটা দারুণ হয়েছে তো, অনেকদিন পর এতো তৃপ্তি করে খাচ্ছি।”
সামির আর অরা বাড়ি ফিরেছে বিকালে। তারা সিনেপ্লেক্স থেকে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল। সেখান থেকে লাঞ্চ করে শপিং-এ। অনেক ঘুরাঘুরির পর অবশেষে বাসায়। নীলিমা এতোক্ষণ তাদের আগমনের অপেক্ষাতেই ছিলেন। বাড়ি ফিরতেই সামিরকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন তিনি।
” আম্মু, কিছু বলবে?”
নীলিমা দরজা আটকে প্রশ্ন করলেন,” আমার চোখের দিকে তাঁকা, মিথ্যা বলবি না একদম। সায়ান আর রূপার প্রেমের ব্যাপারটা তুই আগে থেকেই জানতি, তাই না?”
সামির সাথে সাথে কিছু বলতে পারল না। কয়েক মুহূর্ত চুপ রইল। তারপর সে ভাবল, মিথ্যা বলার চেয়ে ভালো সত্যিটাই বলে দেওয়া। এতে ঝামেলা কম হবে। সে শুধু বিয়ের ব্যাপারটা গোপন রাখল। এছাড়া বাকি সব সত্যি নীলিমাকে জানিয়ে দিল।
” তুই আমাকে আগে বললি না কেন এসব?”
” ব্যাপারটা নিয়ে তোমার ছেলে আমার সাথে কথা বলতে পেরেছে মানে বুঝতে পারছো? সে অবশ্যই খুব সিরিয়াস।”
নীলিমা অভিযোগ করে বললেন,” বুঝলাম সে সিরিয়াস। তো আমাকে বললে কি আমি ভিলেইন হতাম? আমাকে বলতে পারল না অথচ তোকে বলে দিল? আমি কি এতোই খারাপ মা? ”
সামির নীলিমার মুখটা আঁজলায় নিয়ে বলল,” আমি জানি আমার আম্মু বেস্ট। এজন্যই তো সবকিছু বলে দিলাম। এবার তুমি ব্যাপারটা নিজের মতো সোলভ করো।”
” ভালো করেছিস। খবরদার, সায়ান যেন কোনোভাবে বুঝতে না পারে যে তুই আমাকে এসব বলেছিস। আমিও দেখতে চাই ও কত মিথ্যা বলতে পারে।”
কম্পিউটারে মনোযোগের সাথে কিছু একটা করছে সামির। অরা হঠাৎ এসে কম্পিউটার শাট ডাউন করে দিল। মহাবিরক্ত হয়ে তাকাল সামির। অরা ফট করে তার কোলে বসে পড়ল। সামিরের চশমা খুলে টেবিলে রাখল। হাত দিয়ে চুল ঘেঁটে দিতে দিতে বলল,” ঘুম পায়নি আপনার? ”
সামির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” আমি একটা জরুরী কাজ করছিলাম অরা। তুমি পিসি অফ কেন করলে? এখন আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে সব।”
অরা সামিরের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,”এই মুহূর্তে আপনি কোনো কাজ করতে পারবেন না। শুধু আমাকে কোলে নিয়ে বসে থাকবেন।”
সামির এই কথা শুনে শক্ত করে অরার কোমরটা জড়িয়ে ধরল। আচমকা আক্রমণে শিউরে উঠল অরা। সামির দাঁত খিঁচে বলল,” কি হয়েছে আজকে তোমার? সকালে তন্বির সামনে জান বলে ডাকছিলে। এখন আবার এইসব। হঠাৎ এতো পাগলামি কেন করছো? ”
অরা সামিরের মুখের কাছে ঝুঁকে বলল,” পাগল হয়ে গেছি তাই। আপনার দিকে কেউ তাকালেও আমি তার চোখ তুলে ফেলব। আপনি শুধু আমার। অনলি মাইন।”
সামির জড়ানো কণ্ঠে বলল,” তাহলে মেইন রিজনটা তন্বি?”
” উহুম। আমার বরকে আমি যখন ইচ্ছা আদর করব। এখানে তন্বি-চুন্নি আসল কোথ-থেকে?”
এই কথা বলেই সামিরের কপালে, নাকে, গালে পাগলের মতো চুমু দিতে লাগল অরা। সামির আর বসে থাকতে পারল না। লাইট নিভিয়ে অরাকে কোলে নিয়ে বিছানায় এলো। অরা ব্যাকুল কণ্ঠে বলতে লাগল,”ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভীষণ, ভীষণ ভালোবাসি আমি আপনাকে।” সামির খুব যত্নে অরার কথা বলার উপায় বন্ধ করে দিল।
তখন মাঝরাত। দুঃস্বপ্ন দেখে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় সামিরের। বুকে অপ্রতিরোধ্য ধুকপুক শুরু হয়। কপাল ঘেমে যায়। উঠে বসতেই সে দেখল অরা তার পাশে নেই। ভয়ে আরও অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। অস্থির হয়ে ঘরে বাতি জ্বালল সে।
লিভিংরুমের লাইট জ্বলছে। সরু আলোকরশ্মি মেঝেতে এসে পড়েছে। সামির হন্তদন্ত হয়ে লিভিংরুমে পৌঁছাতেই দেখল অরা সোফায় বসে বই নিয়ে পড়ছে। তার গায়ে একটা বেগুনী রঙের শাড়ি। চুল হালকা ভেজা। ভীষণ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। সামির কাছে এসেই অরাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। অরা তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না। চুপচাপ শুনল সামিরের বুকের অবাধ্য লাবডুব। সদ্য ঘুম থেকে উঠে আসার কারণে তার শরীর গরম। আর অরার শরীর ঠান্ডা। দু’জনেরই বেশ আরাম লাগছিল।
অরা হালকা গলায় বলল,” কি হয়েছে? আমি নেই দেখে ঘুম ভেঙে গেছে?”
” তুমি এখানে কি করছো?”
” ঘুম আসছিল না। তাই ভাবলাম সময়টা নষ্ট না করে পড়াশুনা করি।”
” এডমিশন টেস্ট নিয়ে তোমাকে খুব সিরিয়াস মনে হচ্ছে।”
” ইয়েস। আ’ম ভেরি সিরিয়াস। আপনার ইউনিভার্সিটিতে আমাকে ঢুকতেই হবে।”
” কিন্তু না ঘুমিয়ে এভাবে পড়লে তো অসুস্থ হয়ে যাবে অরা।”
” এতো অল্পতে আমি অসুস্থ হবো না। ডন্ট ওরি।”
অরার চোখ চকচক করছে। সামির মনে মনে দোয়া করল, যেই স্বপ্নের জন্য অরা এতো কষ্ট করছে তার সেই স্বপ্ন পূরণ হোক। সে আলতো করে অরার কপালে চুমু দিয়ে বলল,” ভেতরে চলো। এখানে বসে পড়ার কি দরকার?”
” ঘরে লাইট জ্বালিয়ে পড়লে আপনার ঘুমে সমস্যা হতো। তাই এখানে চলে এসেছি।”
সামির হেসে বলল,” ঘুম ভেঙে তোমাকে না দেখে আমি কত ভয় পেয়েছিলাম জানো?”
” কি ভেবেছেন? চুরি হয়ে গেছি?”
সামির ঝুঁকে বলল,” কার এতো সাহস যে তোমাকে আমার থেকে চুরি করবে?”
অরা হেসে উঠল। কিন্তু সামির নিশ্চিন্ত হতে পারল না। সে একই ধরণের দুঃস্বপ্ন বার-বার কেন দেখছে? এটা কি কোনো কুলক্ষণ?
রূপার ঘুম ভাঙল দরজার ধুপধাপ শব্দে। ফজরের আযান হচ্ছে তখন। এই সময় কে আসবে? রূপা দরজা খুলতেই দেখল সায়ান। আশেপাশে চেয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল,” তুমি এখানে কি করছো?”
সায়ান ভেতরে ঢুকে বলল,” আজকে সকালে একটু বের হতে পারবে? মা’র জন্য ছাদেও দেখা করা যাচ্ছে না। ঘরে দেখা করা বিপজ্জনক। তাই আজ বাইরে মিট করব আমরা। আমি আগে বের হয়ে যাবো, তুমি একটু পরে বের হবে।”
” এই কথা টেক্সট করেও বলা যেতো সায়ান। তুমি এই সময় কেন এসেছো? জানো না, আন্টি নামাযের জন্য ওঠেন। যদি দেখে ফেলে?”
” আরে দেখবে না। মা এতো সকাল সকাল ঘর থেকে বের….”
সায়ান তার কথা শেষ করতে পারল না। নীলিমা ইতোমধ্যে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। হাত ভাঁজ করে তাকিয়ে আছেন। তাঁর আগমনে সায়ান-রূপার মুখ অস্বস্তিতে ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
” কি হচ্ছে এখানে?”
সায়ান হুট করে অন্যকোনো অযূহাত খুঁজে না পেল না। উপরে তাকাতেই ফ্যান বন্ধ দেখে বলল,” রূপার ঘরের ফ্যানটা কাজ করছিল না। ও গরমে ঘুমাতেই পারছে না। তাই আমি একটু দেখতে এসেছিলাম।”
নীলিমা গমগমে স্বরে বললেন,” তুই ইলেকট্রিক মিস্ত্রী হলি কবে থেকে? ফ্যান ঠিক করে ফেলবি? আগে পায়ের নিচের মাটি শক্ত কর৷ তারপর সিলিং-এ উঠে ফ্যান ঠিক করার কথা ভাবিস। না হয় যেকোনো সময় উষ্টা খেয়ে নিচে পড়বি।”
সায়ান থতমত খেয়ে বলল,” আচ্ছা।”
” বের হ।”
মায়ের ধমক শুনে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দ্রুত বের হয়ে যায় সায়ান। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে রূপা। সকাল সকাল কি একটা অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হলো। লজ্জায় দেয়ালে মিশে যেতে মন চাইছে।
নীলিমা কাছে এসে রূপার চিবুকে হাত রেখে বললেন,” আমার ছেলে এখনও নিজেকেই সামলাতে পারে না। একদম বাচ্চা রয়ে গেছে। তুমি কি এই পাগলটাকে সামলাতে পারবে?”
রূপা হতভম্ব চিত্তে তাকাল। বিস্ময় মাখা গলায় বলতে চাইল,” মানে? আন্টি আমি…”
নীলিমা রূপাকে কথা শেষ করার সুযোগ দিলেন না। হাসি মুখে বললেন,” শুয়ে পড়ো।”
এটুকু বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। সামির আর অরার ঘরে বাতি জ্বলতে দেখে তিনি সেদিকে এগোলেন। এতো ভোরে তো তাদের ওঠার কথা না। দরজায় টোকা দিতেই অরা এসে খুলল।
” গুড মর্ণিং আম্মু। আপনার কিছু লাগবে?”
” না মা, এমনি দেখতে এলাম তোমাদের। কি করছো?”
” আমি পড়ছিলাম আপনার ছেলের কাছে। ভেতরে এসে বসুন না।”
“সামিরও উঠেছে? ওর সাথে আমার একটু দরকার ছিল।” নীলিমা ভেতরে ঢুকলেন।
সামির বলল,” কিছু হয়েছে নাকি?”
নীলিমা মৃদু হেসে বললেন,” আমি রূপার ঘর থেকে এলাম। সায়ানও সেখানে ছিল।”
তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে সম্পূর্ণ ঘটনা বলতে লাগলেন। সায়ানের ভয় পাওয়া, রূপার লজ্জা পাওয়া, ব্যাপারগুলো তিনি বেশ উপভোগ করছেন। অরা বলল,” আম্মু, এটা কিন্তু ঠিক না। শুধু শুধু ওদের টিজ করছেন কেন? ওরা তো ভয়ে আছে।”
” আরে এটাই তো মজা। সায়ান যতক্ষণ আমাকে নিজে থেকে এসে না বলবে আমি ততক্ষণ ওদের জ্বালাতেই থাকব। তুমি আবার রূপাকে কিছু বলতে যেও না। আমি আরও কিছুদিন দেখব ওদের। ওরা নাকি আজ বাইরে দেখাও করবে। আমি ঠিক করেছি রূপাকে বের হতে দিবো না ঘর থেকে।”
অরা সামিরের দিকে চাইল৷ সামির তাকে চোখ মেরে ফিসফিসিয়ে বলল,” আম্মু একটু গেইম খেলতে চাইছে। খেলুক না। এটলিস্ট সিচুয়েশন কন্ট্রোলে আছে।”
অরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নীলিমাকে দেখে মনে হচ্ছে আসলেই তিনি খুব মজা পাচ্ছেন।
দেখতে দেখতে ঘনিয়ে এলো এডমিশন টেস্টের সময়। আগামীকাল পরীক্ষা। অরা আজ রোজা রেখেছে। এতোদিন এক ওয়াক্ত নামাযও উপেক্ষা করেনি। খুব মনোযোগের সাথে পড়াশুনা করেছে। দিনে মাত্র চারঘণ্টা ঘুমিয়েছে। এছাড়া বাকি সময় পড়াশুনা করেই কাটিয়েছে। সামির তার এই হাড়ভাঙা পরিশ্রম দেখে ঠিক করেছে পরীক্ষার পর তাকে একটা বিরাট সারপ্রাইজ দিবে।
সকাল সাড়ে সাতটা তখন। অরা পরীক্ষার কেন্দ্রে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরী হচ্ছে। নীলিমা কুরআনের কিছু আয়াত পড়ে অরার গায়ে ফুঁ দিয়ে বললেন,” তোমার মাকে ফোন দিয়ে দোআ চাও। এই সময় মায়ের দোআ সবচেয়ে কার্যকর।”
অরা হেসে বলল,” আপনিও তো আমার মা।”
নীলিমা আদর করে অরার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” তোমার শ্বশুর যাবে তোমার সাথে। সায়ান আর সামির কানাডার হাই কমিশনে গেছে আজ। ওই সায়ানের জন্য ভিসার জন্য আর কি! ”
অরার একটু মনখারাপ তাই। আজকে তার এক্সাম। আর আজকেই সামিরকে বাইরে যেতে হলো? নীলিমা তার গোমরা মুখ দেখে বললেন,” চিন্তার কিছু নেই। সামিরের সাথে কথা হয়েছে আমার। তুমি কেন্দ্রে ঢোকার আগেই ও ভার্সিটিতে চলে যাবে। পরীক্ষার আগে দেখা হবে তোমাদের।”
অরা লাজুক হেসে বলল,” তাহলে ঠিকাছে।”
মা আর বাবাকে ফোন দিয়ে দোআ চেয়ে নিল সে। ফুলবানুর ঘরেও গেল সালাম করতে। তিনি বললেন,” পায়ে ধইরো না। জ্বীনে রাগ করব।”
নীলিমা অবাক হয়ে বললেন,” এখানে জ্বীন কোথ থেকে এলো আম্মা? ”
“ওর উপরে জ্বীনের আছর আছে।”
“আপনি যে কি বলেন আবোল-তাবোল! ”
অরা মুখ টিপে হাসতে লাগল। পরীক্ষা শুরু হবে দশটায়। সাড়ে নয়টার মধ্যে হলে প্রবেশ করতে হবে। এখন বাজছে নয়টা। অরা চিন্তিত স্বরে বলল,” বাবা, উনাকে একটু ফোন দিন না! কোথায় আছে? এখনও আসছে না যে?”
সুমন সাহেব বললেন,” দেখছি আমি। তুমি টেনশন কোর না।”
অরা পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না। তার কেমন যেন লাগছে সকাল থেকেই। বার-বার মাথা চক্কর দিচ্ছে। কিছু খেতে মন চাইছে না। জোর করে সকালের নাস্তা খেয়েছে।
সামির আর সায়ান কনস্যুলেট থেকে বের হয়ে পাঠাও ভাড়া করল। সায়ান বলল,” ভাইয়া, হাইরোড দিয়ে যাচ্ছি। বাইকে ওঠা কি ঠিক হবে?”
সামির ব্যস্ত গলায় বলল,” যেই জ্যাম রাস্তায়… বাইক ছাড়া টাইমলি পৌঁছানো সম্ভব না।”
সে অরাকে প্রমিস করেছিল পরীক্ষার আগে অবশ্যই দেখা করবে। তাছাড়া সে থাকলে অরা কনফিডেন্স পাবে। রাইডারের কাছে মাত্র একটাই হেলমেট ছিল। সামির সেটা সায়ানকে দিয়ে দিল। মাঝখানে সায়ান, পেছনে সামির বসেছে। আর সামনে রাইডার। ত্রিশমিনিটের মধ্যে তাদের পৌঁছাতে হবে। বাইকে বসে তারা ফোন ধরতে পারছিল না।
পেছন থেকে জোরালো একটা ধাক্কা অনুভব হয় হঠাৎ। বাইক থেকে ছিটকে পড়ে যায় সামির। তখন বাইক উল্টে যায়। মাথায় হেলমেট থাকার কারণে সায়ান আর রাইডারের তেমন ক্ষতি হলো না। অথচ সামিরের অবস্থা গুরুতর। পেছনে থাকার কারণে সে মাইক্রোর নিচে চলে গেছে। সায়ান দিশেহারার মতো ‘ ভাইয়া’ বলে বিকট একটা চিৎকার দিয়ে থম মেরে গেল। রাস্তায় মানুষ জমতে শুরু করেছে। পিচঢালা রাস্তাটা তাজা রক্তে রঙিন। সামিরের মোবাইল ফোন তখনও বাজছে।
ঠিক সাড়ে নয়টা। মাইকে পরীক্ষার্থীদের স্ব স্ব হলে প্রবেশের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।অরা ব্যাকুল হয়ে সামিরকে ফোন করছে। সুমন সাহেব বললেন,” মা, তুমি ভেতরে যাও। ওরা জ্যামে আটকে গেছে মনে হয়।”
অরা অস্থির চিত্তে শুধাল,” ফোন কেন ধরছে না বাবা? উনি ফোনটা কেন ধরছে না? অন্তত একবার কথা হয়ে যেতো।”
” হয়তো ফোন সাইলেন্ট আছে। চিন্তা কোর না। পরীক্ষার আগে এতো স্ট্রেস নিলে পরীক্ষা ভালো হবে না। ”
অরার পরীক্ষা দিতে একটুও মন চাইছে না। ইচ্ছে করছে সব ছুঁড়ে বাড়ি চলে যায় সে।
দশমিনিটের মধ্যে এম্বুলেন্স চলে আসে। সামিরকে যখন স্ট্রেচারে তোলা হচ্ছে তখনও তার জ্ঞান ছিল। সে অস্ফুটস্বরে সায়ানকে বলল,” সায়ান… অরা যেন কিছু না জানে। ও এই পরীক্ষার জন্য অনেক হার্ডওয়ার্ক করেছে। ও যেন নিশ্চিন্তে পরীক্ষা দেয়..”
সায়ান ভাইয়ের হাত ধরে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। এ যেন কোনো ভয়ানক দুঃস্বপ্ন! এম্বুলেন্স চলে যেতেই পকেটে ফোনের কম্পন টের পায় সে। খুব কষ্টে কান্না থামিয়ে ফোন রিসিভ করে।
অরা অধীর কণ্ঠে বলল,” হ্যালো সায়ান ভাই, তোমরা কোথায়? উনি কি তোমার সাথে আছে? একটু দাও না প্লিজ। আমি শুধু একবার কথা বলব।”
অরার কণ্ঠ শুনে সায়ানের আরও বেশি কান্না পেয়ে যায়। সে কোনমতে বলল,” ভাবি, ভাইয়া তোমাকে ভালো করে পরীক্ষা দিতে বলেছে। পরীক্ষার পর দেখা হবে।”
এইটুকু বলেই লাইন কেটে দিল। আশ্চর্য! সুমন সাহেব তাড়াহুড়ো করে বললেন,” অরা অনেক দেরি হয়ে গেছে মা। এখন না ঢুকলে আর ঢুকতে পারবে না।”
অরা একরাশ আক্ষেপ নিয়ে হলে ঢুকল। বুকভরা শূন্যতায় খা খা করছে ভেতরে। পরীক্ষার পরেই হয়তো সামিরের সাথে তার দেখা হবে। কিন্তু এইযে এখন কথা না বলতে পারার যে তৃষ্ণাটা রয়ে গেল…. এই তৃষ্ণা যেন আজন্মেও মিটবে না আর!
চলবে