রুপালি মেঘের খামে পর্ব-২৯

0
621

#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz

২৯.(১ম ভাগ)
গলির মোড়ে একটা চায়ের দোকানে বসে আছে সায়ান। তার মাথায় নানান চিন্তা ঘূর্পাক খাচ্ছে। সে জানে বেশি ভেবে কাজ নেই। ঘটনাটা সে নিজেই ঘটিয়েছে৷ তাই এখন ভয় পেয়ে পিছু হঁটলে চলবে না।

এখন সকাল নয়টা বাজছে। এতোক্ষণে নিশ্চয়ই মা ঘুম থেকে উঠে গেছেন৷ এটাই মোক্ষম সময়। পরিবারে নিজের মাকে সায়ান সবচেয়ে ভালোবাসে। সে সারারাত চিন্তা করে মাকে ফোন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।আর কেউ না বুঝলেও মা তার কথা বুঝবে এই ভরসাতেই ফোন করল।

” হ্যালো।”

” মা, কেমন আছো?”

” ভালো আছি। তোদের কি খবর? সামির বলল তুই নাকি বউমাকে একা রেখে বন্ধুদের সাথে ট্যুরে চলে গেছিস? এটা কি ঠিক হয়েছে বল? অন্তত বড়ভাই আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতি।”

সায়ান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” আমি তোমাকে একটা জরুরী বিষয় বলার জন্য ফোন করেছি মা। কথাটা অনেক ইম্পোর্ট্যান্ট। প্লিজ তুমি কিন্তু মনোযোগ দিয়ে শুনবে।”

নীলিমার মোটেও মনোযোগ নেই। তিনি ফিরোজাকে চা বানানোর নির্দেশ দিচ্ছেন,” আম্মার চায়ে আদা দিও না ফিরু। আমার চায়ে দিও শুধু। ”

সায়ান বলল,” মা, তুমি কি আমার কথা শুনছো?”

” হ্যাঁ বল না, শুনছি তো।”

সায়ান অনুচ্চ স্বরে বলল,” ধরো আমি একটা বড় অপরাধ করেছি। তুমি কি মা হিসেবে আমাকে ক্ষমা করবে?”

” ফিরু, মায়ের চায়ে চিনি দেওয়ার দরকার নেই।”

সায়ান বিরক্ত গলায় বলল,”আমি রাখি।”

” কেন? তুই না কি বলবি?”

” আমি তো বলতে চাইছি। কিন্তু তুমি শুনছো কই?”

” আচ্ছা৷ এখন বল। ফিরু চলে গেছে।”

” ধরো তোমার কোনো সন্তান অপরাধ করেছে… তাহলে তুমি কি করবে?”

নীলিমা সহজ গলায় বললেন,” অপরাধ যদি ক্ষমার অযোগ্য হয় তাহলে শাস্তি দিবো। আগে জানতে হবে অপরাধটা কি?”

” ধরো আমি তোমাকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললাম।”

নীলিমা প্রশ্ন করলেন,” হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন? তুই কি সেরকম কিছু ভাবছিস?”

” আসলে মা আমি…”

সায়ান বাকি কথা বলার আগেই নীলিমা কড়া হুমকি দিলেন,” খবরদার, এই সমস্ত চিন্তা মাথাতেও আনবি না। কত শখ ছিল ছেলের জন্য নিজে গিয়ে মেয়ে বাছাই করব। বিয়েতে বিরাট আয়োজন করব। সামিরের বেলায় তো এসব কিছুই হয়নি।

যদিও সে আমার অনুমতি ছাড়া বিয়ে করেনি। ফোনে অনুমতি নিয়েছিল। তাই ওকে মাফ করেছি। কিন্তু তোকে মাফ করার প্রশ্নই আসে না। তুই আমার একমাত্র অবিবাহিত ছেলে। তোকে নিয়ে আমি অনেক কিছু ভেবে রেখেছি। তাছাড়া তোর বিয়ের বয়স হতে এখনও অনেক দেরি।”

সায়ানের গলা শুকিয়ে এলো। মা এই কথা শুনলে নির্ঘাত স্ট্রোক করবে। সায়ান প্রসঙ্গ কাটিয়ে দ্রুত ফোন রেখে দিল। সত্যিটা বলার সাহস পেল না।

রূপা পায়চারি করছে অনবরত। শারমিন গরম গরম রুটি আর ভাজি এনে বলল,” কিছু খেয়ে নাও রূপা৷ রাতেও খাওনি।”

রূপার হাতে মোবাইল। সে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছে৷ ত্যক্ত কণ্ঠে বলল,” খাবো না আমি।”

” কি হয়েছে?”

” সকাল থেকে এতোবার ফোন দিয়েছি… একবারও ধরছে না অরা। আল্লাহই জানে আমার জন্য আবার ওর বরের সাথে ঝগড়া হয়ে গেল নাকি।”

” টেনশন কোর না। মনে হয় এখনও ঘুম থেকে উঠেনি।”

” অরা এতো বেলা অবধি কখনও ঘুমায় না। ও তো খুব দ্রুত উঠে যায়। উফ… আমার খুব টেনশন হচ্ছে শারমিন। আমি শিউর কিছু একটা হয়েছে। নয়তো ফোন কেন ধরবে না?”

সে আরেকবার ফোন করল। এবার ঠিকই ওই পাশ থেকে রিসিভ হলো ফোনটা। রূপা অধীরচিত্তে শুধাল,” হ্যালো, অরা?”

ওই পাশ থেকে শব্দ এলো,” রূপা, আমি সামির।”

হঠাৎ সামিরের কণ্ঠ শুনে রূপা ধাঁধায় পড়ে গেল। অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” ভাইয়া, আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন?”

” হুম। ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”

” জ্বী ভাইয়া.. ভালো। অরা কোথায়?”

” ঘুমাচ্ছে ও।”

“আসলে আমার ওর সাথে একটু দরকার ছিল।”

” বুঝতে পেরেছি। অনেকবার ফোন দিয়েছো দেখলাম।”

” ও উঠলে একটু জানাবেন যে আমি ফোন করেছিলাম।”

” ঠিকাছে। নিশ্চয়ই জানাবো। আর কিছু বলতে হবে?”

” না। শুধু এইটুকু বললেই হবে। বাকিটা ও বুঝবে।”

পাশ থেকে কেউ বলল,” রূপা নাকি?”

” জ্বী।”

” তাহলে আমাকে দাও।”

সাবিরা সামিরের থেকে ফোনটা নিয়েই প্রশ্ন করলেন,” রূপা? তুমি নাকি সু*ইসাইড করতে গিয়েছিলে? এসব কি শুনছি তোমার নামে? এই যুগের মেয়ে হয়ে এমন বোকার মতো কাজ কেউ করে?”

রূপা মৃদু কণ্ঠে বলল,” আসলে আন্টি, ওটা একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। আমি সেরকম কিছু করিনি।”

” না করলেই ভালো। আমি যেন আর কখনও এরকম না শুনি। ”

” অরা কেমন আছে আন্টি? এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে যে? মানে শরীর ভালো তো?”

” নারে মা, মেয়েটার শরীর ভালো নেই। কাল একা হাতে অনেক কাজ করেছে। আমরা কেউ তো বাসায় ছিলাম না। আজ সকালে এসেছি। আর এসে থেকেই দেখছি মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। তোমার ওর সাথে কি দরকার ছিল? আমাকে বলতে পারো।”

রূপা খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছে। তার মনে হয় অরাকে দিয়ে কথাটা না বলিয়ে সাবিরা আন্টিকে দিয়ে বলালে বেশি ভালো হবে। তিনি শাশুড়ী মানুষ। সামির গুরুজন হিসেবে তাঁর কথা ফেলতে পারবে না। বিষয়টা মাথায় আসতেই রূপা গড়গড় করে সাবিরাকে গতকালকের সব ঘটনা জানিয়ে দেয়। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়। সব শুনে সাবিরা প্রচন্ড ক্ষেপে যান।

” তুমি ভাবলে কি করে এই বিষয়ে আমি তোমাকে সাহায্য করব? ন্যূনতম কমন সেন্স থাকলে এইরকম একটা কান্ড তুমি করতে না। এখন আবার আমার মেয়েকেও এসবে জড়াতে চাইছো? কি চাও তুমি ওর সংসারটা ভাঙুক?”

রূপা থতমত খেয়ে বলতে চাইল,” আন্টি আমি…”

সাবিরা তুমুল শব্দে ধমক দিয়ে উঠলেন,” চুপ করো। কিভাবে এতো সাহস পেলে তুমি? লজ্জা করল না আমাকে এসব বলতে? এতোবড় অন্যায় করে আবার সাহায্যও চাইছো?”

সাবিরার হুংকার শুনে রূপা চুপসে যায়। কয়েক মুহূর্তের জন্য বিকল হয়ে আসে স্বরযন্ত্র। সাবিরা থেমে থাকেন না। যা নয় তাই বলে রূপাকে অপমান শুরু করেন। তার বংশ পরিচয় নিয়ে কথা বলতেও ছাড়েন না।

সায়ানকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করার জন্য তাকে নির্লজ্জ উপাধিও দেন। রূপা জানে না, কেন সে চুপচাপ সবকিছু শুনল? কেন একটা কথাও উচ্চারণ করতে পারল না মুখ দিয়ে? ছোটবেলার স্মৃতিগুলো তার মনে পড়ে।

মা যখন মা-রা যান, তখন সাবিরা নিজেই বলেছিলেন,” আজ থেকে আমি তোমার মা। আমার কাছে অরা যেমন..তুমিও তেমন। অরার মতো তুমি আমার আরেকটা মেয়ে।” সেই কথাগুলো যে কতটা ভুল তা আজ তিনি প্রমাণ করে দিলেন। রূপার চোখ দিয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ল বড় বড় ফোঁটার অশ্রু।

ফোন রাখার পর সে আসলেই দ্বিধায় পড়ে যায়। বাস্তব বোধ জাগ্রত হয়। কে সে? সায়ানের মতো ছেলেকে বিয়ে করার যোগ্যতা কি আসলেই তার আছে? সে অনাথ একটা মেয়ে। মাথার উপর মামার ছায়া না থাকলে কবেই রাস্তার মেয়ে হয়ে যেতো। এই নিগূঢ় সত্যিটা বুঝতে রূপা খুব বেশিই দেরি করে ফেলল বোধহয়।

সায়ান বাড়ি ফিরে রূপাকে খুঁজে পায় না। শারমিন জানায়, সে নাকি চলে গেছে। যাওয়ার আগে সায়ানের জন্য একটা চিরকুট ফেলে গেছে।

সায়ান চিরকুট খুলে দেখে এর মধ্যে লেখা,” আমি জলে ভাসা পদ্ম সায়ান। তুমি বাগানবিলাস। আমাদের মিলনটা খুব বেমানান। এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি৷ তুমিও নিজের বাড়ি ফিরে যাও। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও আর সবকিছু ভুলে যেও।”

আশ্চর্য! এটা কেমন কথা? নিজে সারারাত ধরে সায়ানকে কত প্রবোধ দিল, কত বোঝাল। অথচ এখন কি-না নিজেই হার মেনে চলে গেল? কেন? রূপা তো এতো দূর্বল না! শারমিন বলল,” এখান থেকে যাওয়ার আগে রূপা খুব কাঁদছিল সায়ান ভাই। আমার মনে হয় সাবিরা আন্টি ওকে বকেছে।”

অরার ঘুম ভাঙল দুপুর বারোটার পর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে চরম বিব্রত। এতো সময় নিয়ে আগে কখনও ঘুমায়নি। তার ঘুমও খুব পাতলা। সামান্য শব্দেই উঠে পড়ে। অথচ আজ এতো বেলা হওয়ার পরেও কেন উঠল না? ঘরের বাইরে হাসা-হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আরিফ সাহেব কথা বলছেন আর সাবিরা হাসছেন। মা আর বাবা চলে এসেছে নাকি?

দ্রুত বিছানা থেকে নামতে গিয়ে অরা খেয়াল করে তার ঘাড়ে প্রচন্ড ব্যথা। বেকায়দায় শোয়ার জন্য হয়তো। পুরো শরীর চিনচিন করছে। সে ধীরপায়ে বিছানা ছেড়ে নামে। বাথরুমে ঢুকে বেসিনের আয়নায় নিজেকে দেখেই লজ্জায় থতমত খেল। গলা থেকে বুক পর্যন্ত ছোপ ছোপ লাল দাগে ভর্তি। নিখুঁত ত্বকে খুব স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে।

এই অবস্থায় বাবা-মায়ের সামনে যাবে কি করে? অরা কলারসহ ফুলহাতা ব্লাউজ ওয়ালা একটা শাড়ি নেয়। সময় নিয়ে গোসল সেরে লিভিংরুমে আসতেই তার চোখ জুড়িয়ে যায়। আরিফ সাহেব, সাবিরা, সামির… সবাই একসাথে সোফায় বসে গল্প করছে। প্রত্যেকের মুখে হাসি। দৃশ্যটা এতো ভালো লাগল দেখতে!

অরা কাছে যেতেই আরিফ সাহেব বললেন,” এইতো আমার মেয়ে এসে গেছে। গুড মর্ণিং মামনি। অবশ্য এখন তো আর সকাল নেই। দুপুর হয়ে গেছে।”

অরা হাসি মুখে জানতে চাইল,” তোমরা কখন এসেছো বাবা?”

সাবিরা বললেন,” সেই সকাল নয়টায়। এসেই দেখি তুই ঘুম। এদিকে আয়। আমাদের সাথে বোস।”

অরা সামিরের পাশে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,” আমাকে ডাকলেন না কেন আপনি?”

” তুমি ঘুমাচ্ছিলে।”

” সেজন্যই তো ডাকা উচিৎ ছিল।”

” তুমিই তো বলেছিলে ঘুম না হলে মাথাব্যথা করবে। বাই দ্যা ওয়ে, রূপা ফোন করেছিল।”

” কখন?”

” যখন তুমি ঘুমাচ্ছিলে। সকাল নয়টার দিকে মনে হয়।”

অরা দ্রুত ঘরে ছুটে নিজের ফোন হাতে নেয়। সে একদম ভুলেই গেছিল তাদের ব্যাপারে৷ সামিরকে এখনও কিছুই জানানো হয়নি৷ ত্বরিতে রূপাকে ফোন করে সে। কিন্তু আশ্চর্য, রূপার ফোন বন্ধ। অরা সায়ানকে ফোন করে।

” হ্যালো সায়ান ভাই।”

” ভাবি… বলো।”

” কি হয়েছে রূপার? ওর ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে কেন?”

” রূপা চলে গেছে।” সায়ানের কণ্ঠ ভারী শোনায়। অরা বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,” চলে গেছে মানে? কোথায় গেছে?”

” ওর বাড়িতে। ও আমার সাথে ব্রেকাপ করেছে!”

” আশ্চর্য তো৷ ব্রেকাপ কেন করবে? পাগল নাকি ও? তোমাদের না বিয়ে হয়ে গেছে!”

” ও এই বিয়ে মানে না।”

” উফ, এই রূপার কান্ড-কারখানা আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। ওর হঠাৎ কি হলো?”

” সেটা তো তোমার মা ভালো বলতে পারবে ভাবি। উনাকেই জিজ্ঞেস করো। উনি রূপাকে কি এমন বলেছেন যে রূপা এমন একটা স্টেপ নিল?”

সায়ানের কথা শুনে অরার মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করে। শারমিনের থেকে সায়ান যা কিছু শুনেছিল তাই অরাকে বলে। এসব জানার পর অরার হৃদযন্ত্র স্পন্দিত হলো তুমুলভাবে। রূপা এই বোকামিটা করবে এটা সে ভেবেছিল। মা এসব শুনলে কখনো মানবে না সেজন্যই অরা আগে তাকে জানায়নি। অথচ রূপা নিজেই জানিয়ে দিল।

সাবিরা রান্নাঘরে ছিলেন। অরা সেখানে গিয়ে শক্তমুখে ডাকল,” মা।”

সাবিরা অরার দিকে চেয়ে হাসি মুখে বললেন,” বাহ, তোকে তো খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু এমন জুব্বা পরেছিস কেন? শীত লাগছে নাকি? জ্বর আসেনি তো আবার?”

সাবিরা মেয়ের কপালে হাত রাখলেন। দেখলেন সত্যিই গা গরম। তিনি অস্থির হয়ে বললেন,” আসলেই তো জ্বর। কি সর্বনাশ! নাপা খেয়েছিস?”

” আমি ঠিকাছি। কিন্তু তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে। সেটা কি তুমি শুনবে?”

সাবিরা গম্ভীর হয়ে বললেন,” আমি জানি তুই কোন বিষয়ে কথা বলতে চাস। কিন্তু এই বিষয়ে কথা বলে কোনো লাভ নেই।”

” তুমি রূপাকে কি বলেছো মা? কি দরকার ছিল তোমার ওকে ওসব বলার?”

সাবিরা কঠিন মুখে বললেন,” তোরা একটা ভয়ংকর অন্যায় করেছিস। রূপা তোকে আর সায়ান দু’জনকেই ফাঁসিয়েছে।”

অরার মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করল। রাগী স্বরে বলল,” রূপা কাউকে ফাঁসায়নি। সায়ান ভাই নিজে ওকে কাজী অফিসে নিয়ে গেছে বিয়ের জন্য। এখানে ওর কি দোষ ছিল? ”

“সায়ান তো একটা বাচ্চা ছেলে। ও ভালো-মন্দের কি বুঝে? বড়ভাবি হিসেবে তোর উচিৎ ছিল সায়ানকে শাসন করা। সেটা না করে উল্টা তুই ওকে সাপোর্ট করেছিস। এটা তো আরও বড় অন্যায়। সামির যদি এসব শোনে তাহলে কি হবে?”

” সামির এমনিতেই সব জানবে মা। আমি নিজে ওকে বলব।”

” খবরদার অরা, নিজের সংসারে আগুন লাগাস না। সর্বনাশ হয়ে যাবে।”

” তুমি প্লিজ এইসব থেকে দূরে থাকো। আমি তোমার পরামর্শ চাইনি।”

সাবিরা আহত দৃষ্টিতে বললেন,” এভাবে কেন কথা বলছিস মা? আমি তো তোর ভালো চাই বলেই..”

অরা চেঁচিয়ে উঠল,” আমার ভালো চাইতে তোমাকে কে বলেছে? প্লিজ, চেও না আমার ভালো। দোহাই লাগে।”

মেয়ের মেজাজ দেখে সাবিরা হকচকিয়ে যান। অরা তড়বড় করে রান্নাঘর থেকে বের হতে নিয়ে দেখল সামনে থমথমে মুখে সামির দাঁড়িয়ে আছে।

চলবে

#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz

২৯.(২য় ভাগ)
অরা ঘরে ঢুকতেই সামির ভেতরে এসে দরজা আটকে দিল। তারপর হাত ধরে টেনে তাকে জানালার কাছে নিয়ে এলো।তীক্ষ্ণ একটা অস্বচ্ছন্দ্য বোধ ভেতর থেকে জাপটে ধরল অরাকে। পরিস্থিতি এভাবে বিগড়ে যাবে সে ভাবেনি।

সামিরকে ঠান্ডা মাথায় সব বোঝানোর কথা ছিল। অথচ সে এমনভাবে ব্যাপারটা জানল যে অরা এখন চাইলেও কিছু ব্যাখ্যা করতে পারবে না। সামির তাকে নিশ্চিত ভুল বুঝবে।

সামিরের মুখের গম্ভীর অভিব্যক্তি দেখে সে ঘাবড়ে গেল আরও। শুকনো কণ্ঠে বলল,” আমি আপনাকে কালরাতেই সব জানাতে চেয়েছিলাম।”

” কি জানাতে চেয়েছিলে?”

” রূপার ব্যাপারে। বিশ্বাস করুন, এখানে ওর কোনো দোষ ছিল না। ওর মামা বিদেশ চলে যাচ্ছেন। এর আগে তিনি রূপাকে বিয়ে..”

সম্পূর্ণ বাক্য শেষ করার আগেই সামির প্রশ্ন করে বসল,” দোষ না থাকলে তুমি ভয় পাচ্ছো কেন?”

অরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নিচু করল। বলল,” রূপার জন্য ভয় পাচ্ছি। আপনিও কি মার মতো বিশ্বাস করে নিচ্ছেন যে রূপারই সব দোষ?”

সামির আস্তে-ধীরে অরার চিবুক ধরে মুখটা উপরে তুলল। আদেশ দেওয়ার মতো বলল,” আমার দিকে তাকাও।”

অরা নরম দৃষ্টিতে তাকাল। অনুরোধ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,” ওদের বিয়েটা মেনে নিন প্লিজ।”

সামির বলল,” তোমার থেকে আমি এটা এক্সপেক্ট করিনি অরা।”

অরা ভয় পেয়ে যায়। সামান্য ধাতস্থ হয়ে শুধাল,” মানে? আমি কি ওদের সাপোর্ট করে ভুল করেছি? আপনি সম্পূর্ণ ঘটনা না শুনেই জাজ করছেন। আগে আমাকে সবকিছু বলতে দিন।”

” আমি সব জানি।” সামিরের নির্লিপ্ত উত্তর। অরা বিস্মিত হয়।

” কিভাবে জানলেন?”

” সায়ান ফোন করেছিল সকালে। সব বলেছে।”

অরার মুখ ছেড়ে হাত দু’টো পেছনে গুটিয়ে নেয় সামির। জানালায় একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। তার কি মনখারাপ হয়ে গেছে এসব শুনে? নাকি সে দুশ্চিন্তা করছে? অবশ্য দুশ্চিন্তা করার মতোই ব্যাপার। কিন্তু সায়ান যে নিজমুখে সামিরকে সব জানিয়েছে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে অরার।

সে কনফিডেন্স নিয়ে বলল,” তাহলে বুঝুন। সায়ান ভাই কতটা সিরিয়াস এই ব্যাপারে!”

সামির রুক্ষ দৃষ্টিতে তাকাল,” তুমি কিভাবে আমার থেকে গোপন করলে? কেন আগে জানালে না? ”

” আমি বলতে চেয়েছিলাম।”

” এখন বলে লাভটা কি? বিয়ের আগে কেন আমাকে বলার প্রয়োজন বোধ করোনি?”

সামিরের ধমকানো গলা শুনে অরা অপ্রস্তুত হলো খানিক। আমতা-আমতা করে বলল,” আপনিই তো আমার উপর রেগে ছিলেন। ফোন ধরছিলেন না। কিভাবে জানাতাম?”

সামির অবহেলা যুক্ত কণ্ঠে বলল,” উইক এক্সকিউজ। ওদের বিয়ে যেদিন হয়েছিল সেদিন সকালেও আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু তুমি কিছু বলোনি।”

” কারণ তখন অলরেডি ওদের বিয়ে হয়ে গেছে। ফোনে এই রকম সিরিয়াস টপিক নিয়ে কথা বলতে চাইনি। সামনা-সামনি কথা বলতে চেয়েছিলাম। সেজন্যই আপনার আসার অপেক্ষা করছিলাম।”

” ও৷ তাহলে এজন্য আমার অপেক্ষা করছিলে?”

সামির প্রশ্নটা করে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। অরা বিব্রত হয়ে বলল,” মানে?”

” তুমি শুধু আমাকে কনভিন্স করতে চেয়েছিলে। আমার অপিনিয়নের কোনো গুরুত্ব তোমার কাছে ছিল না। ঠিক বললাম?”

অরা চুপসে যায়। নিজের ভুল মেনে নিয়ে বলল,” আচ্ছা, আমি স্যরি। কিন্তু তখন তো আমার নিজেরই কিছু করার ছিল না৷ আমি ওদের সাপোর্ট করেছি এটাই কি আমার ভুল?সায়ান ভাই আর রূপা এটাই চেয়েছিল। জীবনটা তো ওদের।”

” তুমি কি চেয়েছিলে অরা? আমি জানতে চাই তুমি কি চেয়েছিলে? কালরাতে যা কিছু করেছো সব কি শুধু আমাকে কনভিন্স করার জন্য?”

সামির দুই পা এগিয়ে আসতেই অরা দুই পা পিছিয়ে গেল। নিভু কণ্ঠে বলল,” একদম না। আপনি এরকম কেন ভাবছেন? আমি শুধু ওদের ভালোবাসাকে সাপোর্ট করেছি। কিন্তু তার মানে তো এই না যে আপনার ভালোবাসার কোনো মূল্য আমার কাছে নেই।”

” ডু ইউ লভ মি অর নট?”

অরা হকচকিয়ে যায়। সামির একদৃষ্টিতে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে, চোখে অবিশ্বাস। অরা হাসার চেষ্টা করে বলল,” এটা কি রকম প্রশ্ন?”

” এনসার মি।”

” অফকোর্স আই লভ ইউ।”

” আই ডন্ট বিলিভ ইউ এনিমোর।”

অরা অবাক হয়ে বলল,” কেন?”

সামির চুপ করে জানালার দিকে চেয়ে রইল কিছুসময়। কোনো জবাব দিল না। অরা উত্তরের অপেক্ষায় ছটফট করছে। সামির একটু পর বলল,” আজরাতে আমরা ঢাকায় ফিরে যাচ্ছি।”

” কি? কেন? সায়ান ভাই আর রূপার কি হবে?”

” সেটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। অনেক চিন্তা করেছো। বাকিটা আমাকে ভাবতে দাও।”

যাওয়ার আগে সামির আরেকটা কথা বলল,” বাই দ্যা ওয়ে, তুমি মায়ের কাছে মাফ চাইবে।”

” মায়ের কাছে মানে? আপনার মা?”

“না, তোমার মা।”

“কিন্তু কেন? ওইসময় রান্নাঘরে করা তর্কের জন্য? কিন্তু সেটা আমি কেন করেছি? মা রূপার সাথে কি করেছে তা কি আপনি জানেন?”

” আমি জানি না। জানার দরকারও নেই আমার। কিন্তু তুমি কি করেছো সেটা আমি দেখেছি। উনি তোমার মা হয়৷ তুমি উনাকে কষ্ট দিয়েছো। তাই অবশ্যই তোমার মাফ চাওয়া উচিৎ। ”

” ঠিকাছে আমি মাফ চাইব। এটা কোনো সমস্যা না। কিন্তু রূপা? ওর কি হবে? ও যে মা’র কথায় কষ্ট পেয়ে চলে গেল?”

” আমি ওকে আমাদের সাথে ঢাকায় নিয়ে যাবো।”

অরা উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,” সত্যি? কিন্তু কিভাবে?”

সামির কোনো জবাব না দিয়ে ঘর থেকে চলে গেল।

সায়ান সবচেয়ে দুঃসাহসিক কাজটা করে ফেলেছে আজ। তার নিজের এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। তবে সে আসলেই করেছে! সামিরকে ফোন করে নিজমুখে সব সত্য জানিয়েছে।

বড় কোনো অঘটনের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল সে। সামির সব শুনে ক্রুদ্ধতার বশে কি করবে তা ভেবেই শিহরিত হচ্ছিল। কিন্তু অবিশ্বাসের ব্যাপার, সামির একটা কথাও বলেনি। শুধু মনোযোগ দিয়ে সব শুনেছে। তারপর খুব স্বাভাবিক স্বরে প্রশ্ন করেছে,” তোর এমবিএ’র জন্য কানাডা যাওয়ার কথা ছিল না? কবে যাচ্ছিস?”

সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ শুনে সায়ান অভিভব বোধ করে।আর কিছু বলার জন্য সাহসে কুলায় না। চূড়ান্ত সাহস সে দেখিয়ে ফেলেছে। কোনোমতে ঢোক গিলে উত্তর দেয়,” জানি না। ”

সামির ঠাণ্ডা স্বরে বলে দিল,”থিসিস শেষ করে তুই প্রিপারেশন শুরু কর। এই ইয়ারেই কানাডা যাচ্ছিস।”

তারপর সামির ফোন রেখে দিতে নিলেই সায়ান উত্তেজনা মিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠল,” ভাইয়া আমার পক্ষে সম্ভব না রূপাকে ছেড়ে থাকা। আমি ওকে চাই। আই এম সিরিয়াস…”

সামির এই পর্যায়ে কোনো উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেয়। সায়ানের বুকের বামপাশে তখন এতো জোরে শব্দ হচ্ছিল যেন কোনো পাহাড় ধ্বসে পড়েছে।

বিষণ্ণমুখে বাড়ি ফিরল রূপা। কারো সাথে কথা বলল না। চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আয়নায় নিজের বিমর্ষ মুখটার দিকে চাইতেই চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইল হঠাৎ। কিন্তু সে কাঁদল না৷ এতো দূর্বল সে কখনও ছিল না। আর হবেও না।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতেই আমিনা এসে দরজায় কড়া নাড়লেন। কাল সারারাত রূপা কোথায় ছিল সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তিনি করেননি। অরা বলেছিল রূপা রাতে তাদের ওখানে থাকবে৷ হঠাৎ সেখান থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে আসার কোনো কারণ আমিনা খুঁজে পেলেন না। বার-বার দরজায় কড়া নেড়ে রূপাকে ডাকতে লাগলেন।

রূপা তিক্ত স্বরে বলল,” যাও এখান থেকে মামী। প্লিজ, আমাকে বিরক্ত কোর না।”

” দরজা খোল৷ তোর সাথে দেখা কর‍তে কে আসছে দ্যাখ।”

রূপা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে হঠাৎ দরজা খুলতেই দেখল আমিনার পেছনে সায়ান দাঁড়িয়ে আছে। আমিনা বললেন,” বাইরে আয়।”

রূপা ধীরপায়ে ঘর থেকে বের হলো। সায়ানের সাথে বসার ঘরে ঢুকতেই দেখল অরা আর সামির বসে আছে সোফায়। তাদের সাথে বসে আছেন রূপার মামা খালেদ রশিদ। তিনি হাসিমুখে রূপার দিকে চেয়ে বললেন,” কিরে মা, তোর যে পড়াশুনা করার এতো মন তা আমাকে আগে বলবি না? তাহলে কি আমি এতো জলদি তোর বিয়ের কথা ভাবতাম?”

রূপা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। অরা ইশারায় তাকে কিছু একটা বোঝাতে চাইল। কিন্তু রূপা কিছু বুঝতে পারল না। সামির বলল,” মামা, আমি রূপার সাথে একটু কথা বলব।”

” হ্যাঁ অবশ্যই। আয় মা রূপা, এদিকে বোস।”

রূপা হতভম্বের মতো তাকিয়ে থেকে সোফায় বসল। খালেদ রশিদ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,” আমি এখন বাজারে যাবো। আজকে রাতে কিন্তু আপনারা না খেয়ে যেতে পারবেন না।”

অরা আর সামির হাসল। সায়ান মাথা নিচু করে সামিরের পাশে বসে আছে। রশিদ সাহেব চলে যেতেই সামির দরজার কাছে দাঁড়ানো আমিনা খাতুনের দিকে চেয়ে বলল,” আন্টি, এদিকে একটু চা দেওয়া যাবে?”

আমিনা লজ্জা পেলেন। এখন পর্যন্ত মেহমানদের চা- নাস্তা দেওয়া হয়নি। তিনি দ্রুত রান্নাঘরে গেলেন। সামির এবার রূপার দিকে চেয়ে বলল,” ভালোই ব্লেন্ডার করেছো তোমরা। সায়ানকে আমার নামে পরিচয় করানোর কি দরকার ছিল?”

রূপা বিরসমুখে বলল,” বাড়িতে ওর কথা সবাই জানে। আমি যদি ওর পরিচয় দিতাম তাহলে ও এখানে থাকতে পারতো না।”

” এখন কিন্তু তোমার মামা-মামী দু’জনেই ওর পরিচয় জানে। তবুও ও এখানে থাকতে পারছে। কেউ ওকে বের করে দেয়নি।”

রূপা কোনো কথা বলল না। সামির হঠাৎ বলল,” তোমার মামার কাছে আমি তোমাদের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি।”

এই কথা শুনে রূপা আৎকে উঠল। বড় বড় চোখে চাইল। কৌতুহল নিয়ে বলল,” মামা রাজি হয়েছে? ”

” প্রথমে একটু কিন্তু করলেও পরে রাজি হয়েছেন। অবশ্যই কনভিন্স করতে সময় লেগেছে। আমি বলেছি তুমি ঢাকায় পড়াশুনার জন্য যাবে। সায়ানও পড়াশুনা করছে। ওর এমবিএ শেষ হলে আমরা পরিবার নিয়ে তোমাকে দেখতে আসব। তুমি নিজেও পড়াশুনা ছেড়ে এখন বিয়ে করতে রাজি না৷ তোমার মামা তোমাকে ঢাকায় যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন।”

রূপা অপ্রস্তুত হয়ে শুধাল,” কিন্তু ঢাকায় গিয়ে আমি কি করব? আমার কলেজ এখানে।”

” তোমাকে ঢাকায় যেতে হবে রূপা। সেখানে তুমি আমাদের বাড়িতে গেস্ট হিসেবে থাকবে। কিন্তু সেটা তোমার বাড়িতে কেউ জানবে না। কমপক্ষে একমাসের জন্য তোমাকে থাকতেই হবে। এর মধ্যে আমি আম্মুকে কনভিন্স করব বিয়ের জন্য।

সায়ান এমবিএর জন্য এই বছরই কানাডা যাচ্ছে। আমি চেষ্টা করব এর আগেই বিয়ের ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে যেন তুমিও ওর সাথে যেতে পারো।”

রূপা বিভ্রান্তি নিয়ে বলল,” কিন্তু এসবের জন্য আমাকে কেন ঢাকায় যেতে হবে? আমি এখানে থাকলেই তো হয়।”

“তোমাকে ঢাকায় নিতে চাইছি তার কারণ তুমি আমাদের বাসায় থাকলে আমি বিয়ের প্রসঙ্গ তোলার একটা অযূহাত পাবো। নাহলে হঠাৎ বিয়ের ব্যাপারে কথা বললে বাসার কেউই রাজি হবে না। তাছাড়া তুমি দূরে থাকলে তোমার মামাও মাইন্ড চেঞ্জ করে তোমাকে অন্য কোথাও বিয়ে দেওয়ার সুযোগ পাবে না। তোমরা যেহেতু এই রিলেশনশীপ নিয়ে এতো বেশি সিরিয়াস তাই আমি এখানে কোনো রিস্ক নিতে চাইছি না।”

রূপা সায়ানের দিকে তাকাল। সায়ানও তার দিকেই তাকিয়ে ছিল।

সামির বলল,” ভেবে দেখো। আমার মনে হয় এটাই সবদিক দিয়ে ভালো। তুমি আমাদের বাসায় থাকলে আম্মুকেও ইমপ্রেস করতে পারবে৷ আর আম্মু যদি নিজে থেকেই তোমাকে পছন্দ করে ফেলে তাহলে ব্যাপারটা আরও সহজ হবে। এদিকে তোমার মামা অলরেডি রাজি…ওদিকে আম্মু আর বাবা রাজি হয়ে গেলেই প্রবলেম সোলভড।”

অরা ফিসফিস করে বলল,” ওয়াও, হোয়াট আ গ্রেইট প্ল্যান। সাচ আ মাস্টারমাইন্ড! রূপা রাজি হয়ে যা প্লিজ। তোকে আমাদের ফ্রেন্ডশিপের দোহাই।”

সামির তাকাতেই অরা চুপ করে গেল। আমিনা খাতুন চা নিয়ে ভেতরে ঢুকছেন। এই মুহূর্তে সবাই চুপ। রূপা গভীর চিন্তায় বুঁদ হয়ে গেছে। সায়ান অস্থিরতা অনুভব করছে। এদিকে অরার খুশিতে নাচতে মন চাইছে। রূপা তাদের সাথে ঢাকায় যাবে, এর চেয়ে মজার ব্যাপার আর কি হতে পারে?

আমিনা খাতুন চায়ের সাথে সন্দেশ আর নাড়ু সার্ভ করে চলে যেতেই সামির নিচু কণ্ঠে সতর্ক বার্তা দিল,”সায়ান, রূপা… তোমাদের দু’জনকেই বলছি। তোমরা কিন্তু গতকালকের এক্সিডেন্টাল বিয়ের ইস্যুটা একদম ভুলে যাবে। কেউ যেন এই বিষয়ে কিছু জানতে না পারে। নাহলে কিন্তু আমাদের সব প্ল্যান ডিসমিস। এক বাড়িতে থেকেও তোমরা কোনো লিমিট ক্রস করবে না আশা করি। আমি তোমাদের হেল্প তখনি করতে পারব যখন তোমরা আমাকে সাপোর্ট করবে।”

রূপা বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল,” ঠিকাছে। আমি রাজি।”

সায়ান হেসে বলল,” আমিও রাজি।”

অরা চেঁচিয়ে উঠল,” ইয়েস৷ মিয়া-বিবি রাজি তো কেয়া কারেগা কাজী? প্লিজ সবাই মিষ্টি খাও।”

অরা সন্দেশের বাটি হাতে নিয়ে রূপার মুখে আস্তো একটা সন্দেশ ঢুকিয়ে দিল। রূপা অনেকক্ষণ পর একটু করে মুচকি হাসল।

__________________
অরাদের বাসস্ট্যান্ড ছাড়তে আরিফ সাহেব ও সাবিরা দু’জনেই এসেছেন। রূপা আসতে চায়নি৷ রশিদ সাহেব বিদেশ না যাওয়া পর্যন্ত সে এখানেই থাকবে তারপর ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার কথা বলে ঢাকায় চলে আসবে। সায়ানের যথারীতি মনখারাপ। তাদের পরিকল্পনা কি আসলেই সফল হবে? নাকি স্বপ্ন সবসময় স্বপ্নই থাকবে… কে জানে?

বিদায়বেলায় সাবিরা খুব আবেগী হয়ে উঠলেন। তাঁর কান্না পাচ্ছে। আবার কবে মেয়েকে দেখবেন ঠিক নেই। তিনি বললেন,” আর কয়টা দিন তো থাকতে পারতি মা। এতো তাড়া কিসের?”

অরা সাবিরাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” আ’ম স্যরি মা। তুমি কি আমার সকালের কথায় কষ্ট পেয়েছো?”

” তা তো একটু পেয়েছিই। কিন্তু মনে রাখিনি। সন্তানরা ভুল করলে বাবা-মা শুধরে দিবে এটাই তো নিয়ম। তুই হয়তো এখন বুঝতে পারছিস না কিন্তু একদিন ঠিক বুঝবি।”

অরা হাসিমুখে বলল,” মা, আমি কিন্তু তোমাকে খুব ভালোবাসি।”

” আমিও ভালোবাসি মা। খুব মিস করব তোকে। মনে পড়লেই চলে আসবি কিন্তু।”

অরা বাবার থেকে বিদায় নিয়ে বাসে উঠল৷ যথারীতি সামিরের পাশেই তার সিট। কিন্তু সামির দরকার ছাড়া খুব একটা কথা বলছে না তার সাথে। সকালের ইস্যু নিয়ে এখনও রেগে আছে নাকি কে জানে? সে যে কখন রাগে আর কখন খুশি হয় অরা কিছুই বুঝতে পারে না। তার মন-মেজাজ আকাশের মতো। এই বৃষ্টি, এই রোদ। সে ভেবেছিল ঘটা করে সামিরকে একটু থ্যাংকস জানাবে। কিন্তু সুযোগই হচ্ছে না।

বাস ছাড়া হলো এগারোটা দশে। চারদিক থেকে আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে তখন। আঁধার নেমে এসেছে পরিবেশে। অরা ফিসফিস করে বলল,” একটা কথা বলব?”

সামির নির্বিকার স্বরে বলল,” না। ঘুমাও।”

এই কথা বলে সিটে মাথা এলিয়ে সে নিজেই ঘুমিয়ে গেল। অরা অবাক। একটা মানুষ এতো দ্রুত কিভাবে ঘুমাতে পারে?

সকালের দিকে অনেক জ্যাম থাকায় তারা বাড়ি পৌঁছালো আটটায়। প্রত্যেকেই ক্লান্ত ছিল। বাসে অরার একদম ঘুম হয় না। তাই ঘরে এসে ভেবেছিল ঘুমাবে। সামির ফ্রেশ হতে গোসলে ঢুকেছে। আজকেও কি সে ইউনিভার্সিটিতে যাবে? রাগ নিয়ে চলে গেলে অরার ভালো লাগবে না। তার রাগ ভাঙানোর জন্য একটা চেষ্টা তো করাই যায়।

সামির বাথরুম থেকে বের হতেই দেখল তার স্টাডিটেবিলের উপরে একটা চিরকুট ঝুলে আছে। একটু কাছে যেতেই দেখল সেখানে লেখা,

” জানেন, ছোট থেকে আকাশ আমি ভীষণ ভালোবাসি। এর অবশ্য একটা কারণ আছে। কারণটা হচ্ছে আমার নাম৷ বাবা বলেছিল অরা নামের অর্থ মেঘ। সেদিন থেকে নিজেকে মেঘ ভাবতে আমার বেশ লাগে।

আমি আমার জীবনে ঠিক আকাশের মতো কাউকে চেয়েছিলাম। যে আমাকে আগলে রাখবে। যেভাবে আকাশের বুকে লেপ্টে থাকে মেঘ। আর আকাশ তাকে আগলে রাখে নিজের বিশালতায়।

আপনি কি জানেন? অজান্তেই আপনি আমার আকাশ হয়ে উঠেছেন। আকাশের সাথে আপনার অনেক মিল। আপনি গম্ভীর হয়ে তাকালে মনে হয় কালো মেঘের ঘনঘটা। আপনি ধমক দিলে মনে হয় বজ্রপাতের গর্জন। কিন্তু আপনি যখন হাসেন, তখন মনে হয় নীলাভ আকাশটা তার একচ্ছত্র সাদাময় মায়াবী সৌন্দর্য্য নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

ও আমার আকাশ, অলীক সৌন্দর্য্যময় আকাশ…. সবসময় হাসবেন প্লিজ। মেঘাচ্ছন্ন রুঢ় আকাশের চেয়েও নীলচে সাদা মেঘের কোমলতা আমার বেশি পছন্দ।

ইতি,
আপনার প্রজাপতি,মেঘবতী, অরাবতী অথবা লজ্জাবতি।”

শেষ লাইনটুকু পড়ে সামির না হেসে পারল না। অরা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে সেই হাসি দেখে বলল,” যাক বাবা, কালো মেঘ কেটেছে।”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে