#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz
২৫.
আতিফের চেঁচামেচি শুনে ফিরোজা ছাদ থেকে বের হয়ে গেল। অরাও যেতে নিলে ধড়াম করে দরজাটা আটকে দিল আতিফ। অরার মুখ ছাইবর্ণ ধারণ করল। ভয়ে তিরতির করে কাঁপতে লাগল শরীর। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু গড়াচ্ছে। সে মনে-প্রাণে চাইতে লাগল, সবটা মিথ্যা হয়ে যাক। আতিফের এখানে আসার পুরো ব্যাপারটা যেন বীভৎস কোনো কল্পনা হয়।
ঠিক সেই সময় মোবাইলের ভাইব্রেশন অনুভব করল অরা। অনেকক্ষণ ধরেই বাজছিল মোবাইলটা। এতোক্ষণ সে বুঝতে পারেনি। ফোন উল্টে দেখল সামিরের নাম্বার। এই অসম্ভব ভয়ংকর পরিস্থিতিতে সামিরের ফোনটাকে মনে হলো এক পশলা প্রশান্তির বৃষ্টি। অথৈ সাগরে ডুবে যাওয়ার সময় কুল-কিনারাহীন জায়গায় ফোনটা যেন নিশ্চিত গন্তব্য।
অরা দুই পা পিছিয়ে ফোন রিসিভ করল,” হ্যালো।”
“টানা পাঁচবার কল দিয়েছি। এটা ষষ্ঠবার। মানুষ দেখছি আমার চেয়েও বিজি!”
সামিরের কণ্ঠে অভিমানের প্রলেপ। অরা কাঁপা গলায় উচ্চারণ করল,” আপনি, আপনি কোথায়?”
তার ত্রাসিত কণ্ঠ শুনে ভড়কে গেল সামির,” কি হয়েছে অরা?”
” দ্রুত বাসায় আসুন প্লিজ।”
আতিফ কাছে এসে অরার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল ফ্লোরে। ডিসপ্লে ফেটে ফোন সুইচড অফ হয়ে গেল। আতঙ্কে শিউরে উঠল অরা। আতিফ খ্যাপা ষাঁড়ের মতো চিৎকার করে উঠল। হঠাৎ তেড়ে এসে অরাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরতেই সে ব্ল্যাকআউট হয়ে গেল।
___________________
নীলিমা রান্না-বান্না শেষ করেছেন মাত্র। ওরনায় মুখ মুছতে মুছতে বের হচ্ছিলেন একটু পানি খাওয়ার উদ্দেশ্যে। তখনি ফিরোজা ছুটে এসে বলল,” আফাগো, সর্বনাশ হইছেগো।”
ফিরোজার বেগতিক অবস্থা দেখে নীলিমা হকচকিয়ে গেলেন,” কি হয়েছে ফিরু?”
ফিরোজা ছাদের ঘটনা সম্পূর্ণ বলতেই নীলিমা ছুটে সেখানে গেলেন। ফিরোজা ততক্ষণে বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে।
সামির গাড়িতে বসেই ছটফট করছিল। অরার ফোন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল কেন? সে অন্যদের নাম্বারে ফোনের পর ফোন দিতে লাগল কিন্তু কেউ তার ফোন ধরছিল না। গলির মোড়ে এসে জ্যাম লেগে যাওয়ায় সে গাড়ি থেকে নেমে হন্তদন্ত হাঁটতে শুরু করল।
আতিফকে ছাদে পাওয়া গেল না। সে হয়তো লিফট দিয়ে নেমে গেছে। কারণ লিফট তখন ব্যস্ত ছিল। সবাই সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠতেই দেখল অরা মেঝেতে পড়ে আছে।ছাদের দরজা সম্পূর্ণ খোলা তখন। সায়ান তাকে কোলে করে নিচে নিয়ে এলো। জ্ঞান ফেরার পরেও অরা কোনো কথা বলছিল না। সে একটা ট্রমার মধ্যে পড়ে গেছে। নীলিমা সবাইকে ঘর থেকে বের করে দরজা আটকে দিলেন।
তারপর অরার পাশে বসে কোমল গলায় প্রশ্ন করলেন,” ভয় পেও না। কি হয়েছিল নির্দ্বিধায় বলো। তুমি কথা না বললে তো সমস্যার সমাধান হবে না।”
অরা হঠাৎ নীলিমাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে শুরু করল। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই কাঁদল সে। নীলিমা তাকে অভয় দিলেন। তাঁর ভরসা মাখা কণ্ঠে আশ্বাস পেয়ে শুরু থেকে সম্পূর্ণ ঘটনাই বলতে লাগল অরা। আতিফের সাথে বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হওয়া, তারপর সেই বিয়ে ভেঙে যাওয়া, এতোদিন পর হুট করে তার আগমন। আর এমন অস্বাভাবিক কার্যকলাপ ; যা অরা চিন্তাও করতে পারেনি।
সে অনুতপ্ত গলায় বলল,” আম্মু আমার উচিৎ ছিল যাওয়ার আগে আপনাকে জানানো। কিন্তু আমি অন্যায় করার পর ভুল বুঝতে পেরেছি।”
নীলিমা বিগলিত স্বরে বললেন,” তুমি অন্যায় করোনি। এটাকে বোকামি বলে। ছেলেটার মনের মধ্যে কি আছে তা তুমি বুঝবে কি করে? অবশ্য এমন বোকামি হয়তো তোমার জায়গায় থাকলে আমিও করতাম। যাইহোক, আতিফের সাথে দেখা করার আগে তোমার উচিৎ ছিল কারো থেকে পরামর্শ নেওয়া। আমার তো এখনও বুক ঢিপঢিপ করছে। যদি তোমার কোনো ক্ষতি হতো মা?”
অরা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,”আমার নিজের মা এখানে থাকলে আগে আমাকে কষিয়ে একটা চড় মা-রতেন। কিন্তু আপনি ভুলের জন্য শাসন করার আগে আমার ক্ষতির কথা চিন্তা করছেন। আপনি এতো ভালো কেন আম্মু?”
নীলিমাকে জড়িয়ে ধরল সে। নীলিমা চিন্তিত ভঙ্গিতে অরার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। অরা বলল,” ফিরোজা আন্টি আমাকে ছাদে দেখেছে। সবাই কি ভাববে এখন?
নীলিমা কঠিন স্বরে বললেন,” কিছুই ভাববে না। ফিরোজার এতো সাহস নেই যে আমার ছেলের বউয়ের নামে উল্টা-পাল্টা বলবে। ওর মুখ ভোঁতা করে দেবো না আমি?”
অরা আশ্বস্ত হলো।নীলিমাকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখল। এর মাঝে সামির বাড়ি ফিরলো।সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে সে আতঙ্ক নিয়ে কেবল একটা প্রশ্নই করল,” অরা কেমন আছে?”
নীলিমা বললেন,” খুব ভয় পেয়ে গেছে। ঘরে আছে। ”
” একা?”
” না, সাথে সামিয়াও আছে।”
সামির ঘরে ঢুকল। দরজা খোলার শব্দ কানে আসতেই কিছুটা চমকে উঠল অরা। তারপর ঝটপট ছুটে এসে সামিরকে জড়িয়ে ধরল তীব্রভাবে। তার শরীর এখনও কিছুটা কাঁপছে। সামির ক্রোধ নিয়ে বলল,” তোমার সাথে কি করেছে লোকটা? বলো, একদম খু-ন করে ফেলব আমি ওকে।”
অরা কোনো কথা বলল না। সামির খেয়াল করল তার শরীর উত্তপ্ত। সে জ্বরে কাবু হয়ে পড়েছে। আতিফের ভয় তাকে এখনও ভেতর থেকে গ্রাস করে রেখেছে।
নীলিমা থার্মোমিটারে অরার দেহের তাপমাত্রা মেপে দেখলেন জ্বর একশো দুই ডিগ্রী। দ্রুত মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করতে হবে। এর আগে তাকে জ্বরের ট্যাবলেট খাওয়ানো হলো। অরা সামিরের হাত ধরে বলল,” প্লিজ, আমার কাছে বসে থাকুন। আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই।”
সামির বিনা প্রশ্নে বসল। স্পষ্ট গলায় বলল,” এখন কোনো কথা বলার দরকার নেই। রেস্ট নাও। চুপ।”
পরে অবশ্য অরা জানতে পেরেছিল আতিফের সাথে বিবাহ ভঙ্গের কারণ। আতিফ মানসিকভাবে অসুস্থ। সহজে সেটা বোঝা যায় না। কিন্তু মাঝে মাঝে তার আচরণ ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ঢাকায় তাকে চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছিল। কিভাবে সে অরার নাম্বার যোগাড় করেছে আর এখানে এসে পৌঁছেছে তা এক বিরাট বিস্ময়। এতোকিছুর পরেও অরার মনে একটা প্রশ্ন খচখচ করছে। সামির কেন তার বিয়েতে এসেছিল? সাত বছর ধরে তো তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। তাহলে বিয়ের দিন হঠাৎ কিভাবে এলো?
________________________
ঘড়িতে সকাল সাতটা। অরার ঘুম ভাঙল ঝরণার শব্দে। বাথরুমে কেউ গোসল করছে। সে চোখ পিটপিট করে একবার তাকিয়েই আবার চোখ বুজে নিল। এন্টিবায়োটিক খাওয়ার কারণে শুধু ঘুম আসছে। এখনও ঘুমের ঘোর কা-টেনি। তবে গায়ের জ্বর ছেড়ে দিয়েছে। পানির শব্দটা তাকে খুব বিরক্ত করছে। সে উঠে বসল।
বাথরুমের দরজা খুলে বের হলো সামির। তাকে পরিচ্ছন্ন সুন্দর লাগছে! অরাকে দেখেই সে নরম গলায় বলল,” গুড মর্ণিং?”
অরার বুকে একটা জোরালো ধাক্কা লাগল। সামির এই সাত সকালে গোসল করল কেন? রাতের কথা অরার কিছুই মনে নেই। সামির আয়নায় তাকিয়ে ভেজা চুল আঁচড়ে নিচ্ছে। অরা দুরু দুরু বুক নিয়ে দেখছে, সামিরকে খুব খোশমেজাজি লাগছে।
অরার অদ্ভুত লজ্জা অনুভব হলো। সে যা ভাবছে তা কি সত্যি? ইশ, তাহলে তো বিরাট মুশকিল হয়ে যাবে। তার তো কিছু মনে নেই। তাদের এতো প্রতীক্ষার পর অবশেষে সেই স্পেশাল রাত এলো অথচ অরা কি-না সকাল হতেই সব ভুলে গেল? এটা খুবই অন্যায়।
এদিকে সামির চুল মুছে তোয়ালেটা চেয়ারে ছুঁড়ে অরার সামনে এসে দাঁড়ালো৷ তার শরীর থেকে বয়েস শ্যাম্পুর ঘ্রাণ আসছে। অরা ইতস্তত করে বলল,” আমি যাই।”
” কোথায় যাবে?”
” বাইরে।”
” এখন বাইরে গিয়ে কি করবে? ফ্রেশ হও। তারপর আমরা একসাথে ব্রেকফাস্ট করতে যাবো।”
“ঠিকাছে।”
” গুড গার্ল। আর শোনো, গোসল করার দরকার নেই৷ শুধু হাত-মুখ ধুঁয়ে নাও। এমনিতেও তোমার শরীর ভালো নেই। আজকের আবহাওয়াও ঠান্ডা। এই সকালে গোসল করলে আবার না সর্দি লেগে যায়।”
অরা কেমন জড়সড় হয়ে উঠল। সামির অবাক হয়ে বলল,” তোমার কি হয়েছে? কিছু বলবে?”
অরা বিব্রত কণ্ঠে বলল,” কিছু না।”
সামিরের চোখে সন্দেহ। কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে বলল,” তুমি কি ভাবছো বলোতো?”
” কই? কিছু না!”
অরার চোখে কেমন ধরা পড়ার ভয়। সামির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” যা ভাবছো তেমন কিছু হয়নি। আমি এমনিই গোসল করেছি। গতকাল বিভিন্ন ঝামেলায় গোসল করা হয়নি। তাই কেমন যেন লাগছিল। ঘুম থেকে উঠেই বাথরুমে ঢুকেছি।”
অরা হাঁফ ছেড়ে স্বগতোক্তি করল,” ওহ। তার মানে কিছু হয়নি। ”
সামির জোরে হেসে উঠে বলল,” না, কিছুই হয়নি।’
অরার ভীষণ লজ্জা লাগল এবার। সে তোয়ালে নিয়ে দ্রুত বাথরুমে চলে গেল।ঠিক ওই সময় বাইরে থেকে শব্দ ভেসে এলো। সায়ন গান গাইতে গাইতে লিভিংরুমে হাঁটছে,” যেটা হয়নি, হয়নি, সেটা না হওয়াই থাক৷ সব হলে নষ্ট জীবন!”
সামির কটমট করে বলল,” সায়ান, শাট আপ। আলতু-ফালতু লিরিক্সে গান গেয়ে মুড নষ্ট করবি না।”
ধমক শুনে সায়ান একটু ভ্যাবাচেকা খেল। সামান্য একটা গানের লিরিক্সই তো ভুল হয়েছে। সেজন্য ভাইয়া এভাবে ধমক দিল কেন? আশ্চর্য!
রান্নাঘরে নীলিমার সাথে পরোটা ভাজছে অরা। নীলিমা ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,” সামিরকে দ্রুত আরেকটা পরোটা দিয়ে এসো। নাহলে দেখবে তাড়াহুড়ো করে একটা খেয়েই চলে গেছে। আর চাইবেও না।”
” আচ্ছা যাচ্ছি।”
অরা পরোটা নিয়ে ডাইনিংরুমে আসতেই শুনল ফুলবানু বলছেন,” পোলায় পাগল আছিল বুঝছি। কিন্তু নবাবের বেটি তারে ঘরে না বসায়া ছাদে নিয়া যাইবো ক্যান? ফিরোজারে দেইখা দুইজনই ছ্যাবলা খায়া উঠছিল। তোর বউ তো পোলারে জড়ায় ধইরা কানতাছিল।”
সামির গরম কণ্ঠে বলল,” দাদী, সেখানে কি হয়েছে আমি জানি। এসব নিয়ে চিন্তা করে তোমার প্রেশার বাড়াতে হবে না। আর একবারও যেন এই টপিকে কোনো কথা না শুনি। ”
অরা গম্ভীর মুখে ডাইনিংরুমে ঢুকল। সামির তাকে দেখেই বলল,”সামিয়া, তোর দাদীকে এখান থেকে নিয়ে যা।”
” ওকে ভাইয়া। চলো দাদী।”
ফুলবানু প্রথমে যেতে চাইলেন না। অরাকে কথা শোনানোর জন্য তিনি কাল থেকে অপেক্ষা করছেন। সামির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি উঠে গেলেন। যাওয়ার আগে ফিসফিস করে কি যেন বললেন।
অরা মুখ ভার করে বলল,” আই এম স্যরি।”
” স্যরি কিসের জন্য?”
” আমি কালকে অনেক বড় ভুল করেছি।”
” কালকের ঘটনা ওখানেই শেষ। বসো, নাস্তা খাও। ”
” আম্মু আপনার জন্য আরেকটা পরোটা পাঠিয়েছে।”
” আমি আর খাবো না। তুমি খাও।”
সামির অরার মুখে পরোটা তুলে দিল। অরা মৃদু হেসে বলল,” বাড়ি ফেরার পর আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
” কি সারপ্রাইজ?”
” এখন বলে দিলে সারপ্রাইজ কিভাবে হলো?”
সামির কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই অরাকে কিস করতে নিল। অরা সরে গেল ত্বরিতে। চারদিকে তাকিয়ে বলল,”মেন্টাল নাকি? আমরা ডাইনিং রুমে।”
তখনি দেখা গেল সায়ান আসছে। তার কানে ফোন। এদিকে মনোযোগ নেই৷ তাই সামির দ্রুত অরার নাকে, ঠোঁটে, গালে চার-পাঁচটা চুমু দিয়ে ফেলল৷ সায়ন সাথে সাথে থেমে গেল। এদিকে কৌতুহল নিয়ে তাকাল।
সামির বলল,” কিছু বলবি?”
সায়ান মাথা চুলকে বলল,” আমি একটা উইয়ার্ড সাউন্ড শুনতে পেলাম।”
অরা লজ্জায় অন্যদিকে ঘুরে গেল। সামির রেগে বলল,” তুই আমার হাতে উইয়ার্ড একটা থাপ্পড় খাবি। তারপর তিনদিন আর কোনো উইয়ার্ড সাউন্ড শুনবি না। ”
সায়ান থতমত খেল। ভাইয়া সকাল থেকে তার উপর এতো রেগে আছে কেন? এমন হলে তো মুশকিল। তার ইমারজেন্সি কিছু টাকার দরকার। রূপা ফোন ধরছে না। সকাল থেকে এই পর্যন্ত না হলেও বিশবার কল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রূপার ফোন বন্ধ। গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে একবারও তার সাথে কথা হয়নি। কি হয়েছে মেয়েটার? দুশ্চিন্তায় কিছু ভালো লাগছে না। সে ঠিক করেছে আজকেই চট্টগ্রাম যাবে।
সামির বের হওয়ার সময় সায়ান আশেপাশেই ঘুরছিল। কেমন ইতস্তত করছে সে। সামির জুতোর ফিতা লাগাতে নিলেই ছুটে এসে বলল,” আমি লাগিয়ে দিচ্ছি ভাইয়া।”
সামির সায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে তোর? টাকা লাগবে?”
সায়ান মাথা নিচু করে বলল,” হুম। ”
“কত?”
“হাজার পাঁচ এক। তুমি তিনহাজার দিলে বাকিটা বাবার থেকে নিবো।”
” বাবার থেকে নেওয়ার দরকার নেই। আমিই পুরোটা দিচ্ছি। কিন্তু এতোটাকা কেন লাগবে হঠাৎ? ”
” বন্ধুদের সাথে ট্যুরে যাব।”
মিথ্যাটা বলেই সায়ান বুক ধ্বক ধ্বক করছিল। সে ভেবেছিল সামির সন্দেহ করবে। কিন্তু তেমন কিছু হলো না। সামির শুধু জিজ্ঞেস করল,” কোথায় যাচ্ছিস?”
সায়ান অকপটে আবার মিথ্যা বলল,” সাজেক ভ্যালি।”
____________________
দুইদিন ধরে রূপার কোনো খোঁজ নেই। অরা এতোবার ফোন দিচ্ছে, কিন্তু মোবাইল সুইচড অফ। এরকম কখনও হয় না। মেয়েটার কি হয়েছে? দুশ্চিন্তায় টিকতে না পেরে অরা তার বান্ধবী শারমিনকে ফোন করল। সে রূপাদের বাসার কাছেই থাকে। শারমিন ফোন ধরতেই অরা ক্ষীপ্ত গলায় বলল,” রূপার বাচ্চাকে এতো ফোন দিচ্ছি তাও ধরছে না। তুই এক কাজ করতো। ওর বাসায় গিয়ে ওর কানটা টেনে বল আমাকে ফোন করতে।”
শারমিন আতঙ্কগ্রস্ত গলায় শুধাল,” তুই কিছু জানিস না?”
” মানে? কি জানব?”
ওই পাশ থেকে ভেসে এলো দীর্ঘশ্বাস। শারমিন ব্যথিত এবং ভারী কণ্ঠে গলায় বলল,” রূপা সুই*সাইড করেছে।”
” কি?”
অরার কথাটা বিশ্বাস হলো না। কিন্তু অবিশ্বাস করারও উপায় নেই। অরা চটজলদি তার মাকে ফোন লাগাল। কিন্তু সাবিরা এই বিষয়ে কিছুই জানেন না। কিছুদিন আগে নাকি তিনি রূপার মামীর কাছে শুনেছিলেন, তারা রূপার বিয়ে ঠিক করেছে। কিন্তু বিয়েরোধ করতে আত্ম-হ*ত্যা করবে… এমন মেয়ে রূপা নয়। সাবিরা আশঙ্কা করে বললেন,” দ্যাখ আবার মে*রে-টেরে ফেলল নাকি মেয়েটাকে। আজ-কাল নিউজে যা দেখি! ওর মামী তো একটা ক-সাই।”
এসব শুনে অরা একটুও শান্ত থাকতে পারল না। সে সায়ানের কাছে ছুটে গেল। সায়ান জানাল তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল৷ তারপর থেকে রূপার ফোন বন্ধ। তাই সায়ান চট্টগ্রাম যাচ্ছে। রূপাকে সারপ্রাইজ দিবে।
সে হাসি-খুশি কণ্ঠে বলল,” তুমি আমার সাথে একটু শপিং-এ যাবে ভাবি? রূপার পছন্দের কিছু গিফটস কিনে নিতাম। আমি তো মেয়েদের বিষয়ে এতো ভালো জানি না। তোমার বেস্টফ্রেন্ড, তুমি জানবে ভালো। ”
অরার কান্না পেয়ে গেল। বেচারা সায়ান এখনও কিছু জানে না৷ সে এই বিষয়ে সায়ানকে কিছু জানাতেও গেল না। শুধু শুধু তাকে প্যানিকড করে লাভ কি? অরা বলল,” আমরা এখনি চট্টগ্রাম যাবো সায়ান ভাই।”
” মানে কি? আমি তো রাতের টিকিট কাটতে চেয়েছিলাম। তুমিও আমার সাথে যাবে?”
” হ্যাঁ যাবো। রাতে নয়, দিনেই যাবো।”
” ভাইয়া জানে?”
অরা একটু ভেবে বলল,” কাউকে কিছু জানানোর দরকার নেই। আম্মুকে বলে যাব। তারপর তোমার ভাইয়া এলে আম্মুই বুঝিয়ে বলবে।”
সায়ান সন্দিহান কণ্ঠে বলল,” ভাবি, কি হয়েছে? সিরিয়াস কিছু?”
অরা নিজের ব্যগ্রতা চাপা দিয়ে বলল,” না। কিন্তু আমার রূপার জন্য টেনশন হচ্ছে!”
বিকাল সাড়ে চারটায় সামির বাড়ি ফিরেছে। দরজা খুলল সামিয়া। সামির অস্থির গলায় প্রশ্ন করল,” তোর ভাবি কোথায়? ফোন ধরছে না কেন?”
সামিয়া টিপ্পনী কেটে বলল,” আসতে না আসতেই ভাবির খোঁজ শুরু। ঘরে গিয়ে দেখো।”
বেডরুমে এসেও অরাকে পাওয়া গেল না। সে বাড়ির কোথাও নেই। সামির ফোন দিতে নিবে তখনি খেয়াল করল, তার স্টাডিটেবিলের কাছে একটা চিরকুট পড়ে আছে। এর মধ্যে লেখা,
” আপনাকে না জানিয়ে এভাবে চলে যেতে হলো এইজন্য রাগ করবেন না প্লিজ। আমার খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু কি করবো? এদিকে একটা সিরিয়াস ব্যাপার ঘটে গেছে। ছুটি ম্যানেজ করতে পারলে আপনিও চলে আসবেন। লাভ ইউ। বাই।”
আশ্চর্য! অরা এভাবে ফোন না করে শুধু একটা চিরকুট লিখে দিয়ে চলে গেল? এটাই কি তার সারপ্রাইজ ছিল? আজ সারাদিন সে একটা ফোনও করেনি। সামিরের ফোনও ধরেনি।
সামিরের কাছে পুরো ব্যাপারটা একটু রহস্য লেগেছিল। কিন্তু এমন যে হবে সেটা ভাবেনি। সামিয়া যে দরজা খুলল, তখনও সে কিছু বলেনি। এতোবড় একটা ঘটনা কেউ সামিরকে জানাবে না কেন? সামির রেগে বের হলো ঘর থেকে। পথেই দেখা হলো অন্তির সাথে।
” কিরে তুই?” সামির অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
অন্তি চোখ মেরে বলল,” তোকে কোম্পানি দিতে চলে এলাম৷ তোর বউ থাকবে না সাতদিন। তাই ভাবলাম আমিই থাকি তোর সাথে। তোকে সঙ্গ দেই।”
-” থা*প্পড় চিনিস?”
” কথায় কথায় খালি মা*রের হু*মকি দিস কেন? নারী নি*র্যাতনের মা*মলা ঠুঁকে দিলে বুঝবি।”
সামির মায়ের ঘরে ঢুকল। নীলিমা বিছানায় বসে ইউটিউবে আচার বানানোর রেসিপি দেখছেন।
” অরা কখন গেছে মা?”
ছেলের উন্মত্ত কণ্ঠ শুনে নীলিমা একটু চমকে উঠলেন। তারপর হেসে বললেন,” ও। অরা? সে তো দুপুরের বাসেই চট্টগ্রাম চলে গেছে। সায়ান তাকে নিয়ে গেছে।”
” মানে? আমাকে কেউ জানাল না কেন?”
” অরাই তোকে জানাতে নিষেধ করেছিল। তুই নাকি যেতে দিবি না ”
” অবশ্যই যেতে দিতাম না। কেন গেল সে? ওকে তোমরা যেতে দিলে কিভাবে?”
সামিরের চোয়াল শক্ত। চেহারায় দুশ্চিন্তার গাঢ় ছাপ। নীলিমা নরম গলায় বললেন,” একা তো আর যায়নি। সাায়নও গেছে ওর সাথে। তুই চিন্তা করিস না।”
সামির ভাবতেও পারছে না মা এমন দায়সারা কাজ কিভাবে করতে পারেন! তাকে কেউ কিছু একটাবার জানালও না? সামির অরাকে ফোন করল। কিন্তু মোবাইল বন্ধ। সে উচ্চ স্বরে বলল,”ওর ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে কেন আম্মু?”
সামিরের গলার রগ রীতিমতো কাঁপছে। নীলিমা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন,” তুই শান্ত হো বাবা। স্ট্রোক করে ফেলবি নাকি? বাসা থেকে বের হওয়ার সময় অরার ফোনে চার্জ ছিল না। আমি বলেছিলাম কাউন্টারে বসে যেন চার্জে দিয়ে নেয়। হয়তো সময় পায়নি। এজন্য বন্ধ হয়ে গেছে। এতো চিন্তার কিছু নেই।”
সামির ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল। কপালে হাত ঠেঁকিয়ে ভঙ্গুর এবং দূর্বল কণ্ঠে বলল,” তুমি এখনও বলছো চিন্তার কিছু নেই? চিন্তা না করে আমি কিভাবে থাকি?”
সামিরকে কেমন দিশেহারা দেখাচ্ছে। নীলিমা ভয় পেয়ে গেলেন। তাড়াহুড়ো করে বললেন,” ঠিকাছে তুইও তাহলে চট্টগ্রাম চলে যা। এখনি রওনা দে।”
চলবে