রুপালি মেঘের খামে পর্ব-২৪

0
609

#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz

২৪.
বহু শঙ্কা-আশঙ্কা বুকে দাবিয়ে রেখে ধীরপায়ে ছাদে পৌঁছালো অরা। দরজার সম্মুখেই দেখতে পেল আতিফকে।সবুজ রঙের ইন করা শার্ট, ফরমাল প্যান্ট আর মাথায় সাদা রুমাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। শরীর ঘর্মাক্ত। রুমাল দিয়ে সে কপালের ঘাম মুছছে অনবরত। তার চেহারায় অস্থিরতা। অরা ঢোক গিলে সামনে এগিয়ে গেল। কাছাকাছি যেতেই আতিফের চোখের চারপাশে ঘন কালো দাগ দৃষ্টিগোচর হলো।

আতিফ এলোমেলো দৃষ্টিতে অরাকে দেখেই হাসল। কিন্তু কোনো কথা বের হলো না তার মুখ দিয়ে। বড় বড় চোখে কেবল অরাকেই দেখছিল সে। দেখতে দেখতে গলা শুকিয়ে এলো। বিয়ের পর অরা আরও দ্বিগুণ….না, না দশগুণ সুন্দরী হয়ে গেছে!

ওর গায়ে কমলা রঙের একটি সুন্দর শাড়ি৷ ঢেউ খেলানো চুলগুলো যত্ন করে আঁচড়ানো। গলায় অসম্ভব সুন্দর একটা লকেট। কি সুন্দর চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপবাম মেখে পটের বিবি সেজে আছে৷ আহা, এই দুপুরবেলাতেও এমন পরিপাটি কেউ থাকে?

আতিফের কাছে আসবে বলে অরা পরিপাটি হয়েছে এমনটাও মনে হচ্ছে না। কারণ অরার চোখে লেপ্টে থাকা কাজল আর ঠোঁট দেখে মনে হচ্ছে, সে কালরাতে সেজেছিল। সেই সাজ এখনও মুখে লেগে আছে। আর এই সাজেই তাকে এখনও অমায়িক সুন্দর দেখাচ্ছে।

অরার ফরসা গাল দু’টো আগের চেয়ে একটু ফুলো হয়েছে কি? চোখ দু’টোও বোধ হয় ফোলা। সারাদিন বুঝি ঘুমায় এই মেয়ে। তবে এমন আদুরে, ফোলা মুখে তাকে অসহ্য সুন্দর লাগছে। কি ভয়ানক সেই সৌন্দর্য্য! আতিফ বার বার ঢোক গিলতে লাগল।

এর মানে কি, বিয়ে করে অরা খুব সুখে আছে? মেয়েরা সুখে থাকলেই এভাবে সেজে থাকে, নিশ্চিন্তে ঘুমাতেও পারে। তাদের চেহারায় সবসময় একটা উজ্জ্বল দীপ্তি ফুটে থাকে। অরার চেহারাতেও সেই দীপ্তি স্পষ্ট।

ভেতরটা অসহনীয় ব্যথায় জ্বলতে লাগল আতিফের। অরার সুখ দেখার প্রত্যাশা নিয়েই এসেছিল। কিন্তু অরা সুখী আছে ভেবে আর ভালো লাগছে না কেন?

” আসসালামু আলাইকুম।” অরাই প্রথমে কথা শুরু করল।

আতিফ কোনোমতে সালামের উত্তর দিল। তারপর দু’জনেই চুপ। একটু পর অরা উচ্চারণ করল,” যা বলার দ্রুত বলুন৷ আমার হাতে বেশি সময় নেই।”

রিনঝিনে কণ্ঠটা আতিফের কর্ণকুহরে বিচরণ করতে লাগল। এই কণ্ঠ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সুর। আতিফ খুব ইতস্তত করছে। অরার সামনে এসে যে সে এইভাবে কুঁকড়ে যাবে তা ভাবতেই পারেনি। রুমাল দিয়ে নাক আর কপালের ঘাম মুছে মাথা নিচু করল।

” আপনি এসেছেন তাই আমি খুব খুশি হয়েছি। থ্যাঙ্কিউ।”

” দেখুন, আসল কথা বলুন। কেন ডেকেছেন আমাকে?”

“আপনাকে একটা জরুরী কথা জানানোর খুব প্রয়োজন ছিল। ”

” কি জরুরী কথা? শুনি!”

” কথাটা হচ্ছে- আমাদের বিয়ের ব্যাপারে।আপনি নিশ্চয়ই শুনেছিলেন। আমার একটা দোষের কারণে বিয়েটা ভেঙে গেছিল। কিন্তু কি সেই দোষ? তা কি আপনি জানেন? আর জানলেও কি সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করেছেন কখনও?”

” সত্যতা যাচাইয়ের কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমার বাবা আমাকে যা বলেছেন তাই আমার কাছে যথেষ্ট।”

আতিফ আহত হাসল। টলমলে চোখে বলল,”যাদের আমরা বিশ্বাস করি, তারাই আমাদের ধোঁকা দেয়।সবচেয়ে জঘন্য উপায়ে।”

” আপনি পরিষ্কার করে কথা বলুন প্লিজ।”

” বিয়ের দিন ঠিক বরযাত্রী যাওয়ার সময় আমাকে জানানো হলো, বিয়েটা হচ্ছে না। কারণ আপনি অন্যকাউকে ভালোবাসেন।”

” কি?”

” আমার বাবা আমাকে এটাই বলেছিলেন। জানেন অরা, আমি কতটা কষ্ট পেয়েছিলাম? আমার পুরো এক জীবনে এতো কষ্ট কোনোদিন হয়নি। প্রত্যেকটি রাত ম’রণ যন্ত্রণার মতো কে-টেছে। আপনার মতো এতো পবিত্র আর নিষ্পাপ একটি মেয়ে কিভাবে এমন প্রতারণা করতে পারে? বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না মন থেকে।”

একটু থেমে আতিফ আরও বলল,” পরে অবশ্য আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আপনি নির্দোষ। সব মিথ্যা। এমনকি আপনাকেই নাকি আমার কোন দোষের কথা বলা হয়েছিল। যাতে আপনি সামির সাহেবকে বিয়ে করতে বাধ্য হোন। চক্রান্তটা কি বুঝতে পারছেন? ”

অরা উপলব্ধি করল, তার মাথার শিরা দপদপ করছে। আতিফ যা বোঝাতে চাইছে তা সে চিন্তাও করতে পারে না। কিঞ্চিৎ ক্ষীপ্ত স্বরে বলল,” আপনি কি বলতে চান? কে চক্রান্ত করেছে? আমার বাবা?”

আতিফ বিষণ্ণ গলায় বলল,” আমি সরাসরি তাকে ব্লেইম করছি না। কিন্তু আমার মনে হয়, সামির সাহেব যদি না আসতো তাহলে আমাদের বিয়েতে কোনো অসুবিধাই হতো না। সে গেস্ট হিসেবে বিয়েতে আসেনি। এসেছিল কালসাপ হিসেবে। তার মূল লক্ষ্য ছিল, আপনাকে ছিনিয়ে নেওয়া। আর সেটা যেকোনো মূল্যে। তাতে দু- একজনের জীবন যদি ধ্বংসও হয়ে যায় তাও কিছু যায়-আসবে না তার।”

অরার কানের লতি, নাকের ডগা লাল হলো। ঠোঁট কাঁপছে ক্রমশ। অস্পষ্ট স্বরে বলল,” আপনার কথা আমি বিশ্বাস করি না।”

” তাহলে এখনি আপনার বাবাকে ফোন করুন। প্রশ্ন করুন, কেন সেদিন বিয়ে ভেঙে গেছিল? আমার কি দোষ ছিল? তিনি কিন্তু বলতে পারবেন না। তিনি শকড হয়ে যাবেন।

আপনি চাইলে আপনার হাজব্যান্ডকেও প্রশ্ন করতে পারেন। তার কাছে তো বিয়ের ইনভাইটেশন যায়নি। তবুও সে কেন এসেছিল? ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এতোটা দূরত্বে কেবল একদিনের জন্য বিয়ের দাওয়াতে কি কেউ আসে? যদি খুবই ঘনিষ্ট আত্মীয় না হয়? আমি আপনাদের ব্যাপারে সব ইনফরমেশন কালেক্ট করেছি।

আপনি তো ছোটবেলায় তার স্টুডেন্ট ছিলেন। কোনো একটা কারণে সে আপনাকে পড়ানো ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে সে নিরুদ্দেশ। আপনার সাথে কিংবা আপনার পরিবারের সাথে আর কখনও তার যোগাযোগ হয়নি। তাহলে হঠাৎ এতোগুলো বছর পর গেস্ট হিসেবে আপনার বিয়ের দাওয়াতে এসে আপনাকেই বিয়ে করে নেওয়াটা কি একটু বেশি অদ্ভুত না?”

অরার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। না, সামিরকে সে অবিশ্বাস করে না। সামিরের স্বচ্ছ হাসির আড়ালে কোনো কলুষতা থাকতে পারে না। অসম্ভব! অরা দুইহাতে মুখ ঢাকল।

বুক ভরে শ্বাস নিয়ে মন স্থির করে বলল,” আপনার কোনো কথা আমি বিশ্বাস করি না। দয়া করে এখান থেকে চলে যান। আমাকে বিরক্ত করতে আসবেন না। পাস্ট ইজ পাস্ট। অতীতে যা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে আমি আর চিন্তা করতে চাই না। আমি আমার প্রেজেন্ট নিয়ে যথেষ্ট ভালো আছি।”

অরা চলে যেতে লাগল৷ আতিফের কোনো আকুতি শুনতে চায় না সে। কিন্তু আতিফ স্পষ্ট, ভরাট গলায় বলল,” কয়দিন সুখে থাকবেন এভাবে? আপনার এই সুখও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে।”

” অভিশাপ দিচ্ছেন? ”

আতিফ কাছে এসে বলল,” না। বাস্তবতা বলছি। রিভেঞ্জ অফ নেচার। কাউকে কষ্ট দিয়ে কেউ সুখী হতে পারে না। একমাত্র স্বার্থপরেরা ছাড়া। আপনি কি স্বার্থপর, অরা? ”

অরা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। আতিফও তাকিয়ে আছে। তাদের মাঝে দূরত্ব মাত্র কয়েক ইঞ্চি। এইভাবে একে-অপরকে নিষ্পলক চেয়ে থাকতে দেখে বালতি দিয়ে শব্দ করল ফিরোজা বুয়া। অরা হকচকিয়ে তাকাল৷

ফিরোজা ছাদে কাপড় নাড়তে এসেছে। এখন নিশ্চয়ই ঘরে গিয়ে অন্তত ফুলবানুকে এসব জানাবে সে! কি হবে তখন? উফ, বিপদ এলে এমন সবদিক থেকে কেন আসে?
___________________
তন্বি অনেকক্ষণ এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল। সে কোনো কথা বলছে না দেখে সামির নিজেই বলল,” সবার আগে আমি তোমাকেই এই ব্যাপারটা বলেছি। ভার্সিটির কেউ এখনও জানে না।”

তমসাচ্ছন্ন মুখে তন্বি ঢোক গিলল। কাঁপা স্বরে উচ্চারণ করল,” অভিনন্দন.. স্যার।”

” থ্যাঙ্কিউ। আমি তোমাকে কেন এই কথা বলেছি সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো। আমার মনে হয় তোমার বাবার সাথে দেখা করার আর কোনো প্রয়োজন নেই এখন।”

তন্বির চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো। সে অন্যদিকে ফিরে চোখের জল মোছার চেষ্টাও করল না। চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে যেন। কোনমতে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইল। চোখের পানি গাল ছুঁয়ে চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।

সামির বলল,” যদি মনের অজান্তেও কখনও তোমার ফিলিংস হার্ট করে থাকি… তাহলে স্যরি। আমি আমার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসি। তাকে ছাড়া অন্য কিছু চিন্তাও করা সম্ভব না আমার পক্ষে।”

তন্বি কোনো কথা বলতে পারল না। গলার কাছে যেন খঞ্জর আটকে আছে। হৃদয়ে র-ক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে।

” আই হ্যাভ টু গো।” এই বলে তন্বির উত্তরের অপেক্ষা না করেই ব্যস্ত সড়কের মাঝখানে গাড়ি থেকে নেমে গেল সামির। ভীষণ হালকা লাগছে আজ। যেন বুকের ভেতর থেকে পাহাড় সরে গেছে।
___________________
আতিফের সাথে আর এক মুহূর্তও ছাদে দাঁড়ানোর প্রয়োজন বোধ করছে না অরা। ফিরোজা কাপড় নাড়ছে। কিন্তু আঁড়চোখে দেখছে তাদের৷ তার ওই দৃষ্টি অরাকে খুব বিব্রত করে দিচ্ছে। তাই সে নিচে নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

আতিফের দিকে চেয়ে বিরবির করে বলল,” আমাদের বাড়ির কাজের আন্টি। উনি দেখে ফেলেছে মানে বুঝতে পারছেন? সর্বনাশ! প্লিজ এখন চলে যান। আর দয়া করে আমাকে ফোন করবেন না।”

” সত্যিটা আপনার জানা জরুরী ছিল৷ আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে বুঝবেন।”

” বুঝেও কি লাভ? আমার বিয়ে হয়ে গেছে। এখন কি চান? আমি তাকে ডিভোর্স দিয়ে আপনার কাছে চলে আসি? কোন যুক্তিতে?”

” আমাকে ভুল বুঝবেন না।”

” তাহলে কেন এসেছেন? আমাদের মধ্যে ঝামেলা বাঁধাতে?”

“আমি শুধু সত্যিটা জানাতে এসেছি। কারণ আপনাকে আমি ভালোবাসি৷ আর ভালোবাসার মানুষকে ঠকে যেতে দিই কি করে?”

” কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি না। শুধু বাবার অনুরোধে বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম। আপনার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি নেই। আমি এখন আমার হাজব্যান্ডকেই ভালোবাসি। তাকে ছাড়া অন্যকিছু চিন্তাও করতে পারি না। আর ঠকে যাওয়ার কথা কেন বললেন?”

“কারণ তিনি আপনাকে কৌশল খাটিয়ে বিয়ে করেছেন। যাকে বলে টোপ ফেলে মাছ ধরা। সে হলো শিকারি আর আপনি তার শিকার। এখনও এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না? আবার বলছেন তাকে ভালোবেসে ফেলেছেন! আফসোস!”

অরার ভ্রু কুঁচকে গেল বিরক্তিতে। তেরছা দৃষ্টিতে চেয়ে প্রশ্ন করল,” আপনি আমাদের বিয়ের ব্যাপারে এতোকিছু জানলেন কিভাবে?”

আতিফ মৃদু হেসে বলল,” যাকে ভালোবাসি, তার সম্পর্কে এতটুকু খোঁজ রাখবো না?”

অরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,” ভালো থাকবেন।”

সে চলে যেতে নিচ্ছিল। পেছন থেকে আচমকা হাত টেনে ধরল আতিফ। সশব্দে উচ্চারণ করল,”আমি একটাও মিথ্যা বলিনি। আর আমার ভালোবাসাতেও কোনো মিথ্যা ছিল না। আপনি আমাকে কেন ধোঁকা দিলেন অরা? কি দোষ ছিল আমার? আমি আপনাকে এতো সহজে যেতে দিবো না। যদি আপনি চলে যান… তাহলে এই ছাদ থেকে লাফ দিয়ে সুই*সাইড করব আমি।”

অরা ভয়ে শিটিয়ে গেল। হাত-পা কাঁপতে লাগল। ফিরোজার ঘাড় তখন একবার ডানে ঘুরছে তো একবার বামে। বড় বড় দৃষ্টিতে সে আতিফ আর অরার অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করে জটিল কিছুর হিসাব মিলিয়ে ফেলতে চাইছে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে