রুপালি মেঘের খামে পর্ব-২১+২২

0
707

#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz

২১.
রাত বারোটার পর থেকেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি। পরিবেশে কনকনে ঠান্ডা। আচমকাই দমকা বাতাস এসে নাড়িয়ে দিচ্ছে গাছপালা। পানিতে টইটম্বুর রাস্তাঘাট। ঝমঝম বৃষ্টির শব্দটা বেশ উপভোগ্য। ফুলবানুকে রিলিজ দেওয়া হবে কাল দুপুরে। ভোরের দিকে সবাই বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিল। নীলিমা একা শুধু থেকে যাবেন শাশুড়ীর সাথে হসপিটালে। সকালে অরা আর সামিয়া রান্না করে আনবে।

বাড়ি ফেরার জন্য উবার ডাকা হয়েছে। সামির ঠিক করেছে, অরাকে নিয়ে রিকশায় যাবে। তাই সে সবার সাথে অরাকে গাড়িতে উঠতে নিষেধ করল। অরা ভয় পেয়ে গেল। এই লোকের মাথায় কি মতলব ঘুরছে কে জানে? আলাদা করে রিকশায় নিয়ে অরাকে আবার শায়েস্তা করবে না তো?

সে দ্রুত গাড়িতে উঠে যেতে নিচ্ছিল। তখন সামির তার হাত ধরে সুমন সাহেবকে বলল,” তোমরা চলে যাও বাবা। আমরা রিকশায় আসছি।”

সুমন সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,” তোরা আবার রিকশায় কেন যাবি? যাচ্ছি তো এক জায়গাতেই। চল একসাথে চলে যাই..”

নীলিমা স্বামীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,” আরে যেতে দাও ওদের। আলাদা একটু টাইম স্পেন্ড করুক। এসবের দরকার আছে।”

সুমন সাহেব বললেন,” আচ্ছা ঠিকাছে। একটা গাড়িতে এতো মানুষ গাদাগাদি করে ওঠার মানে হয় না।”

সায়ান কিছু না বুঝে বলল,” গাদাগাদি কোথায় হচ্ছে বাবা? এইতো ভাবি সামিয়ার সাথে বসুক আর ভাইয়া আমার বসুক। তুমি তো সামনে বসে গেছোই। সুন্দর হয়ে গেল!”

অরা তাল মিলিয়ে বলল,” হ্যাঁ। সায়ান ভাই ঠিক কথাই বলেছে। আমরা গাড়িতেই যাই, প্লিজ।”

সামির অরার হাত টেনে বলল,” না, আমরা রিকশায় যাবো।”

সুমন সাহেব বললেন,” তোরা সাবধানে আসিস।”

গাড়ি চলে গেল তাদেরকে রেখেই। অরা একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। এবার কি আছে কপালে? নীলিমা বললেন,” অর্ঘ্য তাহলে রিকশা ঠিক কর। আমি অরার সাথে দাঁড়াচ্ছি।”

সামির বলল,” সমস্যা নেই আম্মু। তুমি যাও। আমরা একটু সামনে হেঁটে তারপর রিকশা নিবো।”

অরার বুক ঢিপঢিপ করছে এবার। সামির সবাইকে ভাগিয়ে দিচ্ছে কেন? তার মতলব কি? শেষ-মেষ অরাকে পায়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে না তো?

নীলিমা যেতে নিলেই অরা অনুরোধের স্বরে বলল,” আম্মু, আমি আপনার সঙ্গে হাসপাতালে থাকি, প্লিজ?”

এই কথায় নীলিমা হেসে ফেললেন। অরার গালে হাত রেখে বললেন,” তুমি কেন থাকবে? সারারাত ঘুম হয়নি। বাসায় গিয়ে রেস্ট করো মা। দুপুরের দিকে সামিয়ার সাথে এসো।”

” আম্মু প্লিজ। আমার কোনো সমস্যা হবে না।”

” কিন্তু আমার সমস্যা হবে। বললাম না সামিরের সাথে যাও? কথা শোনো অরা।”

সূর্য তখন মাত্র উদিত হচ্ছে। চারদিকে এখনও অন্ধকারের লেশ মুছে যায়নি। ভোরের আমেজটা এতো প্রাণবন্ত আর সুন্দর! তার উপর বৃষ্টির স্নিগ্ধতা যেন অন্যরকম মাধুর্য্য এনে দিয়েছে। বিশুদ্ধ বাতাসে প্রাণ খুলে শ্বাস নিতেই মন ভরে যাচ্ছে।

বৃষ্টি হচ্ছে ইলেশগুঁড়ির মতো। গায়ে লাগছে না, তবে হালকা হালকা ফোঁটা শরীরে হিম জাগিয়ে তুলছে। পাশে সামির। নির্বিকার ভঙ্গিতে পকেটে হাত গুঁজে হাঁটছে। তার গায়ে এশ রঙের টি-শার্ট, কালো ট্রাউজার। এলোমেলো চুল, ক্লান্ত মুখ। তবুও দেখতে কত ভালো লাগছে!

অরা অন্যদিকে তাকালে সামিরও আঁড়চোখে তাকে লক্ষ্য করল। গায়ে খয়েরী রঙের শাড়ি। চুলগুলো হাত খোঁপায় বাঁধা। কিছু চুল কানের কাছে, কপালে পড়ে আছে। চোখ ফোলা, বিষণ্ণ মুখ। বার-বার হাই তুলছে। এতো আদুরে লাগছে দেখতে! সামিরের ইচ্ছে হলো বলতে, আমার মিষ্টি পুতুল। আমি তোমাকে কোলে নিয়ে হাঁটি। তুমি আমার বাহুতে ঘুমাও।

অরা একটু পর অভিযোগের স্বরে বলল,” কি সমস্যা আপনার? রিকশা কেন নিচ্ছেন না? নাকি এভাবে হাঁটি হাঁটি পা পা করেই আমাকে বাসায় নিয়ে যাবেন? এটাই কি তাহলে আমার শাস্তি? ”

সামির মৃদু হাসল। একটু আয়েশী ভঙ্গিতে অরার গলার পেছনে হাত রেখে নিচু হয়ে বলল,” বৃষ্টিস্নাত রাস্তা, ঠান্ডা বাতাস, হুড ওঠানো রিকশা আর পাশে বেলীফুলের মতো স্নিগ্ধ তুমি। কি ম্যাজিকেল ব্যাপার, তাই না?”

অরা অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। হঠাৎ সামির অন্যসুরে গান গাইছে কেন? তার মিষ্টি কথায় মন ভোলালে হবে না। সে অরাকে নিয়ে আলাদা যেতে চেয়েছে মানেই কিছু একটা গর্ভর আছে। অরা বলল,” কিন্তু সবাই কি ভাবছে? বাবা-মা কি বলবে?”

” আমার বাবা-মা আমার কাছে বেস্টফ্রেন্ডের মতো।তুমি তো এতোদিন ধরে দেখেছো। এখনও চিনতে পারোনি তাদের? সব বিষয়ে তারা সাপোর্টিভ। অনেকেই বলে জয়েন ফ্যামিলিতে নাকি প্রাইভেসী থাকে না। অথচ আমাদেরও জয়েন ফ্যামিলি। কিন্তু প্রাইভেসীতে কখনও কমতি মনে হয়েছে?”

” না। সবাই একদম আলাদা। আমার বাবাও অনেক ফ্রেন্ডলি। যদিও মা একটু অন্যরকম। কিন্তু আপনার বাবা আর মা দু’জনেই সেইম। একদম পারফেক্ট। আমি কখনও ভাবিনি এমন চমৎকার একটা পরিবার পাবো।”

সামির অরার একটা হাত নিজের বুকের উপর এনে বলল,” ধরো আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর পর যখন তুমি আর আমি বুড়ো হয়ে যাবো, আমাদের কাজ-কর্ম থাকবে না, সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে বসে কাটাতে হবে, তখন আমরা কি করবো?”

” আসলেই তো, কি করবো?”

” এইযে, এখনকার সুন্দর স্মৃতিগুলো মনে করে হাসবো!”

” বাহ! ভালো বলেছেন তো!”

সামির অরার নাক স্পর্শ করর বলল,” এজন্য বেশি বেশি মিষ্টি স্মৃতি কালেক্ট করা উচিৎ।”

” হুম। এখন দার্শনিক কথা-বার্তা ছেড়ে একটু রিকশা খুঁজুন। একে বৃষ্টি তার উপর ভোর। যদি রিকশা না পাওয়া যায় তাহলে মিষ্টি স্মৃতি টক হয়ে যাবে।”

সামির শব্দ করে হেসে উঠল। রিকশা পেতে বেশি সময় লাগল না তাদের। সামির রিকশাওয়ালাকে বলল খুব আস্তে প্যাডেল ঘোরাতে হবে। তাদের পৌঁছাতে যত বেশি সময় লাগবে, রিকশাওয়ালা তত বেশি টাকা ভাড়া পাবে।

অরা হেসে ফেলল এই কথা শুনে। হুড তোলা রিকশায় উঠে সামির অরার কোমর জড়িয়ে ধরল। অরার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। কেমন যেন কাঁপছে সে। এতোদিন হয়ে গেল তাদের সম্পর্কের। তবুও সামিরের স্পর্শ তার সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। যতক্ষণ সামির তার গায়ে হাত রেখে দেয় ততক্ষণ সে স্বাভাবিক হতে পারে না। মনে হয় যেন অন্যজগতে হারিয়ে যাচ্ছে৷

অরা একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল,” একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

” বলো।”

” আমি যদি ফিরে না আসতাম তাহলে আপনি কি সত্যি আমাকে ডিভোর্স দিতেন?”

সামির অরার মুখের দিকে চাইল। একই সময় অরাও চাইল। সন্দিগ্ধ দৃষ্টি তার। সামির হেসে ফেলে বলল,” তোমার কি মনে হয়?”

” জানি না… আমি..”

অরা কথা শেষ করতে পারল না। সামির হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল,” মামা, এদিকে একটু থামান।”

অরা অবাক হয়ে বলল,” কি সমস্যা?”

সামির কিছু না বলেই রিকশা থেকে নেমে গেল। ফুটপাতে একটা ফুলের দোকান। অনেকগুলো কাঠগোলাপের মালা, গাজরা, কানের দুল আর ক্রাউন বিক্রি হচ্ছে। একটা মালা ছিল শুধু লাল কাঠগোলাপ দিয়ে বানানো। সামির সেটা কিনে আনল। সাথে গাজরা, ক্রাউন আর কানের দুলও আনল।

তারপর অরার কাছে এসে উৎসাহী কণ্ঠে বলল,”বাসায় নিয়ে তোমাকে এগুলো দিয়ে সাজাবো। তারপর আয়নায় দাঁড় করিয়ে দেখবো। কে বেশি সুন্দর?গাছের কাঠগোলাপ নাকি আমার কাঠগোলাপ।”

অরার গালে লালচে আভা সৃষ্টি হলো। সকাল বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টির তেজও বেড়েছে। অরা বাসায় এসে গোসল সেরে বারান্দায় দাঁড়ালো।বাতাসে তার শরীর কাঁপছে। তার খোলা চুলে, মাথায়, কানে, সবজায়গায় কাঠগোলাপের গয়না। মিষ্টি সুঘ্রাণে মন ভরে যাচ্ছে। সামির পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,” রোমান্টিক ওয়েদার, তাই না?”

অরা বলল,” কিন্তু সকালে গোসল করতে গেলে তো দম বের হয়ে যায়। এতো ঠান্ডা! শুনুন আমাকে একটু জড়িয়ে ধরুন তো।”

সামির বিস্মিত কণ্ঠে বলল,” কি বললে? আমি কি ভুল শুনেছি?”

অরা নিজের গরজে সামিরকে জড়িয়ে ধরে বলল,” ঠিক শুনেছেন। আমার ঠান্ডা লাগছে খুব।”

“এখন আর লজ্জা লাগে না, অরা?”

“না। একদম না।”

সামির অরাকে ছেড়ে তার চোখের দিকে তাকাল। ঠোঁট চেপে হাসি আটকে বলল,” কিন্তু তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে, তুমি এখনও লজ্জা পাচ্ছো।”

” অসম্ভব। আমি লজ্জা পাচ্ছি না।”

” ঠিকাছে, তাহলে দেখি কতক্ষণ তুমি লজ্জা না পেয়ে থাকো!”

সামির এগিয়ে আসতেই অরা পিছিয়ে গেল। লজ্জায় মুখে রক্ত জমে গেল। তবু সে বলল,” আমি লজ্জা পাচ্ছি না। একদম না।”

এই কথা বলেই সামিরের গলা জড়িয়ে ধরল দুইহাতে। নিজ উদ্যাগে ঠোঁটে চুমু দিল। সামিরকে আর পায় কে? সহসা অরাকে পাজাকোলায় তুলে নিল। তারা বিছানার কাছে আসতেই সামিরের ফোনটা বেজে উঠল শব্দ করে। বিরক্ত হয়ে সামির ফোন সাইলেন্ট করতে নিলেই অরা বলল,” জরুরী ফোন হতে পারে। হয়তো হাসপাতাল থেকে। ”

এই কথা শুনে কিছু একটা ভেবে নাম্বারটা দেখল সামির। তারপর হঠাৎই বিছানা থেকে নেমে ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। অরা অবাক হয়ে চেয়ে রইল। এমন কে ফোন করেছে যে তার সামনে বসে কথাও বলা যাবে না?

ব্যাপারটা অরার কাছে একটু সন্দেহজনক লাগায় সে বারান্দার কাছে গেল৷ কাজটা ঠিক নয়, তবুও অরা আড়ি পাতল। সামিরের কথা শুনে স্পষ্টত বোঝা গেল সে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলছে। অরার হৃৎপিন্ড ছলাৎ করে উঠল। সামির ফোনে বলছে,” আমি একটু পর বের হচ্ছি। দেখা হলে তখনি সব বলব। এই মুহূর্তে অরা পাশে আছে তাই কথা বলা সম্ভব না।”

এটুকু শুনেই অরা দ্রুত বিছানায় এসে বসে গেল। সামির বারান্দা থেকে বের হয়েই আলমারি খুলে আয়রন করা শার্ট বের করল। অরা বলল,” কোথাও যাচ্ছেন নাকি?”

” হ্যাঁ। একটা কাজ পড়ে গেছে। আর্জেন্ট। যেতেই হবে।”

” একটু রেস্ট নিয়ে যান… সারারাত এতো ধকল গেল!”

সামির হাসল। কাছে এসে অরার গাল টেনে বলল,” এখন সময় নেই। ফিরে এসে কথা হবে। হুম? বায়।”

অরা হতাশ মুখে তাকিয়ে রইল। তার মনখারাপের ব্যাপার সামিরকে বুঝতে দিল না। সে চলে যাওয়ার পর অরার কেমন অস্থিরবোধ হতে লাগল। সারারাত না ঘুমিয়ে থাকার কারণে মাথা ব্যথা করছিল।

সে ভাবল, একটা মাথা ব্যথার ঔষধ খেয়ে যদি ঘুমিয়ে থাকে তাহলে তার শান্তি লাগবে। অযথাই এসব নিয়ে মাথা খারাপ করে লাভ নেই। তার মনে সন্দেহ ঢুকে গেছে। যা ভীষণ খারাপ! এই ভেবে সে ফুলবানুর ঘরে গেল ঔষধ নিতে। কিন্তু তখন সামিয়া আর সুমন সাহেব সেই ঘরে ছিল।

সামিয়া চাপা স্বরে বলছিল,” ভাবি যাতে কিছু না জানে বাবা। তাহলে কিন্তু সমস্যা হয়ে যাবে। ভাইয়া বলেছে ভাবিকে কিছু জানানো যাবে না।”

অরা বাকিটা শোনার জন্য আড়ি পাতল। সায়ন এসে দরাজ গলায় বলল,” ভাবি তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো?”

অরার মুখ থমথমে হয়ে গেল। সামিয়া প্রায় আৎকে উঠল। তার ভয় পাওয়া দেখে অরার সন্দেহ আরও বেড়ে গেল। কি এমন ব্যাপার যেটা সামিয়া তাকে জানাতে এতো ভয় পাচ্ছে?

চলবে।

#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz

২২.
অরা খুব অন্যমনস্ক হয়ে রান্না করছিল। একটু পর তাদের হাসপাতালে যেতে হবে। হঠাৎ তার অন্যমনস্কতার ব্যাপারটা লক্ষ্য করতেই সামিয়া প্রশ্ন ছুঁড়ল,” ভাবি, কি হয়েছে? তোমার কি মনখারাপ?”

অরা সবজি কাটছিল৷ হঠাৎ সেই কাজ বাদ দিয়ে সামিয়ার কাছে এসে তার হাত চেপে ধরে বলল,”আমি তন্বির সাথে কথা বলতে চাই সামিয়া। তুমি কি ওর নাম্বারটা আমাকে দিতে পারবে?”

সামিয়া একটু থতমত খেয়ে বলল,” তন্বি কে?”

” তোমার ভাইয়ার ইউনিভার্সিটিতে পড়ে যে মেয়েটা। ওইতো সেদিন বাসায় এলো!”

“ও। কিন্তু তুমি ওর নাম্বার দিয়ে কি করবে?”

” দরকার আছে। তুমি পারবে দিতে?”

” আমার কাছে নেই। তবে সায়ান ভাইয়ার কাছে থাকতে পারে।”

অরা এবার একটু অবাক হয়ে জানতে চাইল,” সায়ান ভাইয়ার কাছে তন্বির নাম্বার?”

সামিয়া দুষ্ট হেসে বলল,” হুম। সায়ান ভাইয়ার তো তন্বির উপর সিক্রেট ক্রাশ ছিল। তন্বি বড়ভাইয়ার খোঁজে এখানে প্রায়ই আসে। তখন থেকেই সায়ান ভাইয়া তাকে পছন্দ করে। আচ্ছা, তুমি চাইলে আমি ভাইয়ার থেকে নাম্বার এনে দিবো। ”

অরা ব্যাপারটা শুনে খুবই চমকিত হলো। রূপা জানলে কি হবে? সেও নিশ্চয়ই তন্বিকে চিবিয়ে খেতে চাইবে। যেমন অরারও মন চাইছে তন্বিকে সবজির মতো চপিং বোর্ডে ফেলে কুচি কুচি করে কা-টতে! সকালে সামির নিশ্চয়ই তন্বির সাথে কথা বলেই বের হয়েছিল। কোথায় গেছে সে তন্বিকে নিয়ে? তারা কি করছে একসাথে?

বারোটার দিকে অরা আর সামিয়া খাবার নিয়ে হসপিটালে গেল। দুপুরেই ফুলবানুকে রিলিজ দেওয়া হলো। কিন্তু সামির সেই যে সকালে বের হয়েছিল, এখনও বাড়ি ফেরেনি। একটা ফোন পর্যন্ত করেনি অরাকে। নীলিমা বললেন তাঁর নাকি সামিরের সঙ্গে কথা হয়েছে। সামির জরুরী কাজে ব্যস্ত আছে। কি আশ্চর্য, তার কি এমন জরুরী কাজ যে অরাকে একটা ফোন পর্যন্ত করবে না?

মিস পিহু ফুলবানুর কেবিনের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। অরাকে দেখেই উৎসাহী ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বলল,” আমি আপনাকেই খুঁজছিলাম। আপনার সাথে আমার জরুরী কথা আছে।”

” কি কথা?”

মিস পিহু ফিসফিস করে বলল,” এখানে বলা সম্ভব না। আপনার ফোন নাম্বারটা দিন। আমি সময় বুঝে আপনাকে ফোন করব।”

অরার মনে আবার সন্দেহ জেগে উঠল। মিস পিহু কি এমন বলতে চান? সামিরের ব্যাপার কিছু না তো? সামির কি তার সঙ্গে ফ্লার্ট করছে? ধূর, এসব সে কি ভাবছে?এভাবে সামিরকে সন্দেহ করে সে নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক না। সে মিস পিহুকে নিজের ফোন নাম্বার দিয়ে চলে এলো। কিছু জিজ্ঞাসাও করল না।

হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় অরা মাঝপথে নেমে যেতে চাইল। নীলিমা প্রশ্ন করতেই সে বলল,” আমার একটা জরুরী জিনিস কিনতে হবে আম্মু। তাই একটু শপিং-এ যাবো।”

” সামিয়াকেও নিয়ে যাও।”

” সমস্যা নেই। আমি একাই যেতে পারব।”

” সাবধানে যেও।”

অরা সামিরের ভার্সিটিতে চলে গেল। সেখানে সামিরকে পাওয়া গেল না। সে নাকি আজ ভার্সিটিতেই আসেনি! আশ্চর্য, তাহলে কোথায় সে?

বাড়ি ফিরে অরা সায়ানের ঘরে ঢুকল। সায়ান ফোনে কারো সাথে কথা বলছিল। নিশ্চয়ই রূপা! অরাকে দেখেই সে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফোন রেখে শুধাল,”ভাবি, কিছু বলবে?”

“আমার একটা কাজ করে দেবে, সায়ান ভাইয়া?”

” নিশ্চয়ই। বলো কি কাজ?”

অরা হাত ভাঁজ করে বলল,” তোমার ভাই আজকে ভার্সিটি যায়নি। তুমি একটু খোঁজ লাগাও তো কোথায় গিয়েছে?”

সায়ান অবাক বিস্ময়ে নিয়ে শুধাল,” ভাইয়া ভার্সিটি যায়নি এটা তুমি জানলে কিভাবে? তুমি কি ভাইয়ার পেছনে স্পাই লাগিয়েছো নাকি?”

” লাগাতেই পারি। তোমার ভাইয়া দিন দিন যেভাবে বিগড়ে যাচ্ছে, তাকে টাইট দেওয়ার জন্য অবশ্যই স্পাই লাগানো উচিৎ। ”

সায়ানের মুখ আতঙ্কে তমসাচ্ছন্ন। অরা কুটিল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,” তুমি সব জানো তাই না?”

” ভাবি, প্লিজ মাথা ঠান্ডা করো।”

” কিসের মাথা ঠান্ডা করবো? আজ তোমার ভাই আসুক৷ আমি আজই চট্টগ্রাম চলে যাবো। আমার কাছে তোমরা কি লুকাচ্ছো?”

” তোমার খুশির জন্যই তো লুকাচ্ছি।”

অরা কটমট করে তাকাল। তার খুশির জন্য লুকাচ্ছে মানে কি? সামিরের কারো সাথে অ্যাফেয়ার আছে জানলে সে কষ্ট পাবে এজন্যই কি লুকিয়ে রাখা? কষ্ট তো এখনও পাচ্ছে। অরা দুশ্চিন্তা আর নিতে পারছে না। সে ফুলবানুর ঘর থেকে দু’টো ঘুমের ঔষধ এনে খেয়ে শুয়ে পড়ল।

সামির না ফেরা অবধি কারো সাথে কথা বলবে না। সে এলে তার সঙ্গেই শেষ বোঝাপরাটা হবে। এর আগে অরার খুব ঘুম প্রয়োজন। কিন্তু ঘুমটাও আসছে না। মনের দগ্ধতা আর অস্থিরতার কারণে। অরা ঝিম ধরে শুয়ে রইল। সন্ধ্যা ফুরিয়ে রাত হয়ে গেল।

একসময় দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। অরা ঘুমানোর ভাণ করে জবাব দিতে চাইল না।কারো সাথে কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না। কিন্তু বাইরের মানুষটি দরজা ধাক্কাচ্ছে তো ধাক্কাচ্ছেই বাধ্য হয়ে দরজা খুলতেই দেখা গেল সামিয়া।

” ভাবি, তুমি না তন্বির নাম্বার চেয়েছিলে? এইতো এনেছি।”

অরা গোমরা মুখে বলল,” থাক, লাগবে না।”

” তাহলে তুমি যে চাইলে? আমি কত কৌশল করে ভাইয়ার ফোন চুরি করে নাম্বারটা যোগাড় করেছি…”

” ঠিকাছে রেখে যাও।”

” তোমার কি শরীর খারাপ ভাবি? অসময় শুয়ে আছো যে?”

” আমি ঠিকাছি। একটু মাথাব্যথা করছে।”

সামিয়া সামিরের স্টাডি টেবিলের ওপর নাম্বার লেখা কাগজটা রেখে চলে গেল। অরা আবার দরজা বন্ধ করল। কাগজটির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে সে ভাবতে লাগল, তার কি তন্বিকে ফোন কি করা উচিৎ?

একটু পর আবার দরজায় শব্দ হলো। এবার দেখা গেল সায়ান এসেছে। অরা বলল,” কি ব্যাপার সায়ান ভাই?”

” ভাবি, তুমি আমাকে একটা ব্যাপারে খোঁজ লাগাতে বলেছিলে৷”

” হুম।খোঁজ নিয়েছো? তোমার ভাইয়া কোথায়?”

সায়ান রহস্যের ভঙ্গিতে হাসল। অরার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,” তোমার নামে একটা পার্সেল এসেছে।”

এই কথা বলেই সে নিচে থেকে বড় একটা বাক্স ওঠাল। অরা বিস্মিত স্বরে বলল,”আমার পার্সেল! কে পাঠালো?”

” আমি জানি না। তোমার জিনিস, তুমিই খুলে দেখো।”

সায়ান পার্সেল রেখে চলে গেল। খুব সম্ভবত এটা সামির পাঠিয়েছে। এর আগেও তো সে পার্সেলে করে চিঠিতে ডিভোর্সের সংবাদ পাঠিয়েছিল। এবারও কি তেমন কিছু হতে যাচ্ছে?

ক্রমশ গলা শুকিয়ে এলো অরার। খুব দ্বিধা আর শঙ্কা পার্সেলটি খুলল। ভেতরে পাওয়া গেল ভিন্ন ডিজাইনের একুশটি পায়েল, একুশটি কালারফুল পেনড্রেট, একুশজোড়া কানের দুল, আর একটা ডায়মন্ড রিং। প্রত্যেকটা জিনিসই মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকার মতো সুন্দর!

আরেকটা প্যাকেট খুলতেই পাওয়া গেল মেজেন্টা রঙের ভীষণ সুন্দর একটা শাড়ি। শাড়ির ভাঁজে একটা চিরকুট,” এই সুন্দর শাড়িটি তার জন্য, যার কাছে পৃথিবীর সব রঙ তুচ্ছ, সব সৌন্দর্য্য মলিন। তার মেঘলাবরণ গা স্পর্শ করার অধিকার কি সে এই নগন্য শাড়িটিকে দেবে?”

অরা বিস্ময়াভিভূত। কসমেটিক্সের সাথে আরও দু’টো চিরকুট আছে। সেগুলো খুলতে নিয়ে উত্তেজনায় তার আঙুল কাঁপছিল,” অরা, আমার প্রজাপতি। আমার চক্ষু জুড়ানো শীতল বৃষ্টি তুমি। তোমার হৃদয় ছুঁতে চেয়েও বার-বার ব্যর্থ হওয়া এই অসহায় প্রেমিককে ক্ষমা করো। তুমি এই সামান্য উপহার গ্রহণ করলেই আমার প্রেমজীবন ধন্য হবে।”

তারপর আরও একটা চিরকুট। সেটা লাল রিবন দিয়ে বাঁধাই করা। অরা বাঁধন খুলল,” আজকের এই দিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে স্পেশাল। এই দিনেই পৃথিবীতে এসেছিল আমার স্নিগ্ধ ভালোবাসা। যার স্নিগ্ধতায় প্রতিটি দিন আমি নতুন করে উজ্জীবিত হই। যার প্রাণবন্ত হাসিতে আমার অনুভূতিরা সঞ্জীবনী শক্তি পায়। যার চঞ্চলতাই আমার ব্যাকুলতার কারণ। আমার প্রজাপতি, শুভ জন্মদিন! দেখো তো, ঘড়ির কাটায় ঠিক বারোটাই বাজছে কি-না? তোমাকে সঠিক সময়ে শুভেচ্ছা জানাতে পেরেছি তো?”

অরা ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল সত্যিই বারোটা বাজছে। এতো দ্রুত সময় কিভাবে পেরিয়ে গেল? অদ্ভুত সুখের পরশ অরার হৃদয়ের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে। সত্যিই আজ তার জন্মদিন! অথচ সে ভুলেই গেছিল।

অবশ্য এটা নতুন কিছু না। প্রত্যেকবছরই সে ভুলে যায়। মা তার পছন্দের খাবার রান্না করে মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু এবার যে এতোটা চমৎকার ভাবে কেউ মনে করাবে তা অরা কল্পনাও করেনি।

অরা চিরকুট গুলো বার-বার পড়তে লাগল। একসময় জিনিসগুলো বুকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এক অসীম প্রশান্তিতে হৃদয় উদ্বেলিত হচ্ছে। চোখের কার্ণিশে আনন্দের জল চিকচিক করছে। বুকের বামপাশ চিনচিন করছে সুখব্যথায়!

আচ্ছা, সামির সকালে যে মেয়েটির সাথে কথা বলছিল সে কি তাহলে অনলাইন সেলার ছিল? ইশ, কত বোকা সে! সামিরের নামে কত কি ভাবছিল! সায়ন, সামিয়াও তাহলে সারপ্রাইজের ব্যাপারেই আলাপ করছিল। অথচ অরা কারো কথা বোঝার চেষ্টা না করে শুধু সন্দেহই করে যাচ্ছিল। পুনরায় দরজায় শব্দ হলো।

এবার দরজা খুলতেই সে দেখল নীলিমা, সুমন, সাহেব, সায়ান, সামিয়া সবাই একত্রে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকে উচ্চ কণ্ঠে সমস্বরে বলতে লাগল,” হ্যাপি বার্থডে অরা, হ্যাপি বার্থডে টু য়ু।”

অরা মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল স্তম্ভের মতো। নীলিমা তার দুইহাত চেপে ধরে বললেন,” জন্মদিনের অনেক, অনেক শুভেচ্ছা মা। হ্যাপি বার্থডে।”

ঘড়িতে তখন ঠিক বারোটা বেজে একমিনিট। একে একে সবাই অরাকে শুভেচ্ছা জানাল। সবাই আলাদা আলাদা উপহার দিল। অরার প্রথমবারের মতো উপলব্ধি হলো, সে এই বাড়ির সবার কাছে কতটা আদরের! আনন্দে চোখে জল চলে এলো। নিজেকে ভীষণ স্পেশাল মনে হচ্ছিল। সবাই তাকে হাত ধরে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এলো।

বাড়িটিকে কোনো রেস্টুরেন্টের চেয়ে কম মনে হচ্ছে না। কি অদ্ভুত সুন্দরভাবে ঘরটা সাজানো হয়েছে! পোস্টারে বিশাল সাইজের অক্ষর দিয়ে অরার নাম ইংরেজিতে লেখা। বেলুন, ফুল, পোস্টার, বাহারি রঙের বাতি আরও বিভিন্ন ডেকোরেটিভ জিনিসের ছড়াছড়ি। তার অগোচরে এতোকিছু কখন হলো?

চারপাশ থেকে সবাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা ধ্বনি উচ্চারণ করছে। সায়ান খুব জোরে একটা বেলুন ফাটিয়ে পার্টি স্প্রে ছড়িয়ে দিল। তারপর শিষ বাজালো।

অরা চোখ মুছে সবার উদ্দেশ্যে বলল,” থ্যাঙ্কিউ। এই দিনটি আমি কখনও ভুলতে পারবো না। আমার জীবনের বেস্ট বার্থডে এটা।”

সুমন সাহেব বললেন,” তাই যদি হয়, তাহলে সবকিছুর জন্য সামিরকে থ্যাঙ্কিউ বলো। ছেলেটা কত কষ্ট করেছে তোমার জন্য! আজ সারাদিন ভার্সিটি না গিয়ে এইসব কান্ড করেছে।”

অরার হঠাৎ মনে পড়ল, আসলেই তো সবার মাঝে সামির কই? তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না কেন? অরা জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা পাচ্ছিল। নীলিমা নিজেই বললেন,” সামির তোমাদের ঘরে আছে। আগে এখানে আমাদের সাথে কেক কা-টো। তারপর রুমে গিয়ে ওর সাথে আবার কেক কা-টবে।”

অরা কোনমতে কেক কে-টে সবার মুখে অল্প অল্প করে তুলে দিল। ফুলবানু শুকনো মুখে বললেন,” বাঁইচা থাকো। আমার নাতির মাথাটা তো খাইছো। এবার শত সন্তানের জননী হও।”

এমন দোআ শুনে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না অরা। সুমন সাহেবও দোআ দিলেন,” শত বছর বেঁচে থাকো মা। আমার মাথায় চুলের সমপরিমাণ হায়াত তোমার হোক।”

অরা তাকিয়ে দেখল, তাঁর শ্বশুর সাহেবের মাথায় একদম চুল নেই। তালুর পেছনে হালকা কিছু লেগে আছে। নীলিমা এই নিয়ে একটা খোঁচাও মা-রলেন,” তোমার মাথায় শত চুল হবে নাকি?”

“কি বলো? কমপক্ষে হাজারখানেক চুল তো হবেই। বিশ্বাস না হলে গুণে দেখো।”

” আমার অতো সাধ নেই।”

সুমন সাহেব হেসে উঠলেন। তাদের কথা-বার্তা শুনে অন্যরাও মুখ টিপে হাসছে। কেক কা-টার পর্ব শেষ হতেই নীলিমা বললেন,” তোমার কি কি পছন্দ লিস্ট করে দিও। কাল সব আমি নিজের হাতে রান্না করবো।”

অরা কৃতজ্ঞতায় শাশুড়ী মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” অনেক ধন্যবাদ আম্মু।”

বেডরুমে যেতে অরার খুব নর্ভাস লাগছিল। একদম প্রথম রাতের মতো অনুভূতি। যেন সে বাসর ঘরে যাচ্ছে। রুমে ঢুকেই আরও এক দফা অবাক হতে হলো। পুরো ঘর বেলীফুলের গন্ধে ভরে আছে। মেঝেতে পা রাখতেই কিছু একটা ঠেঁকল পায়ের সাথে। অরা নিচু হয়ে দেখল একটা গাজরা পড়ে আছে দরজার সামনে। সেটি তুলতেই আরও একটা চিরকুট পাওয়া গেল,” যার প্রাণবন্ত মিষ্টি সুভাস বেলীফুলের সুভাসকেও হার মানায়, সেই স্নিগ্ধ সুভাসিনীর জন্য।”

অরা গাজরাটা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। ঘর অন্ধকার। টিমটিমে আলো জ্বলছে। বিছানায় ছড়িয়ে আছে গোলাপের পাপড়ি। একটা গোল টেবিলে ছোট্ট চকলেট কেক রাখা। সেই কেকের চারিপাশে মোমবাতি জ্বালাচ্ছে সামির। আপনমনে গুণছে,” সতেরো, আঠারো, উনিশ, বিশ, একুশ। শুভ একুশতম জন্মবার্ষিকী অরা। ”

অরা মিষ্টি করে হাসল। সামির গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” হ্যাপি বার্থডে আমার প্রজাপতি।”

তারপর পেছন থেকে বের করে আনল একতোড়া গোলাপ। অরা হাসতে হাসতে সেই গোলাপের তোড়া নিয়ে বিছানায় বসল। হাঁফ ধরা কণ্ঠে বলল,” আমি ক্লান্ত এবার। আর কত সারপ্রাইজ দেবেন? ইশ, জন্মদিন মানুষের জীবনে প্রতিদিন কেন আসে না?”

সামির হাঁটু গেঁড়ে বসে অরার পা নিজের কাছে টেনে নিল। বাম পাটা উরুর উপর রেখে একটা সুন্দর ঝকঝকে কালো রঙের পায়েল পরিয়ে দিতে দিতে বলল,” তুমি চাইলে প্রতিটি দিন এমন স্পেশাল হবে।”

অরা একটু ঝুঁকে এলো। গভীর চোখে তাকিয়ে বলল,” না। আমি চাই না। স্পেশাল দিন জীবনে অল্প কয়েকবারই আসুক। প্রতিদিন হলে তো সেটা নরমাল হয়ে যাবে, তাই না?”

সামির অরার কপালের চুল সরিয়ে দিল।আলতো স্পর্শে তার গালে হাত রেখে বলল,” তোমাকেও তো আমি রোজ দেখি। কখনও নরমাল মনে হয়নি তো। সবসময়ই এতো স্পেশাল কেন লাগে?”

অরা অপ্রস্তুত হলো। সামির কাছে এলেই সুন্দর একটা নেশা মেশানো ঘ্রাণ তার চারিপাশে আলোড়ন জাগিয়ে তোলে। সে লজ্জায় মাথা মুড়ল।

কেক কা-টার সময় সামির আঙুলের ডগায় ক্রিম নিয়ে অরার নাকে মেখে দিল। অরা রেগে সামিরের গালে ক্রিম মেখে দিল। সামির তখন নিজের গাল দিয়ে অরার গালে ঘঁষে ক্রিম মুছে নিল। লজ্জা পেয়ে গেল অরা। একটু পর সে চিরকুটগুলো বের করে প্রশ্ন ছুঁড়ল,” সত্যি করে বলুন তো, এগুলো কি আপনার লেখা?”

” তোমার কি মনে হয়?”

অরা গম্ভীর হয়ে বলল,” আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে কথাগুলো আপনার সাজানো।”

” কেন?”

” এতো রোমান্টিক কথা আপনি লিখতেই পারেন না!”

” তাহলে কে লিখতে পারে?আতিফ?”

অরা চমকে উঠল। ভ্রু কুঁচকে শুধাল,” এখানে আতিফ কোথ থেকে এলো?”

“এমনি বললাম।”

সামির হাসল। কিন্তু অরা হাসল না। কেন সে হঠাৎ আতিফের নাম বলল? তার সাথে অরার বিয়ে ভেঙে গেছে। সেই প্রসঙ্গ ওখানেই শেষ। তাহলে আজকের মতো একটা দিনে সামির তার কথা কেন মনে করাল? অরা রেগে বলল,” আপনি বের হোন।”

” কি?”

” এখনি ঘর থেকে বের হয়ে যাবেন।”

” স্যরি….আমি বুঝিনি যে ওর কথা বললে তুমি এতো রেগে যাবে।”

অরা কোনো জবাব না দিয়েই সামিরকে হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে দিল। শুধু তাই নয়, ধড়াম করে দরজাটাও আটকে দিল।

কিছুক্ষণ হকচকিয়ে তাকিয়ে রইল সামির। অরা কেন এতো রেগে গেল? তার মনে কি এখনও আতিফের জন্য কিছু আছে? নাহলে এতো রিয়েক্ট করবে কেন? সে কি ভেতরে দরজা বন্ধ করে কাঁদছে?

সামির অনেক সাত-পাঁচ ভেবে দরজায় কড়া নাড়ল। কিন্তু অরার কোনো জবাব নেই। একটু পর দরজা এমনিই খুলে গেল। সামির দ্বিধাভরা মন নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজতেই ড্রেসিংটেবিলের কাছে চোখ আটকে গেল তার।

অরা নতুন শাড়িটা পরেছে। গলায় সামিরের গিফট করা মেজেন্টা পেনডেন্ট। খোঁপায় বেলীফুলের গাজরা। অরাকে সাক্ষাৎ রূপকথার রাজকন্যা বলে ভ্রম হলো। সামির মোহগ্রস্তের মতো হাঁ করে তাকিয়ে থাকার পর ভাবল, এভাবে দেখা উচিৎ নয়।

কিন্তু তার বদ্ধ প্রতিজ্ঞার দফা-রফা করে সামনে এসে দাঁড়ালো অরা। আচমকা জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা ঠেঁকিয়ে বলল,”ভাগ্যিস সেদিন আতিফের সাথে আমার বিয়েটা হয়নি। নাহলে আপনাকে আমি কোথায় পেতাম?”

অরার কণ্ঠ কেমন নিভে এলো। আজ সারাদিন তার মনে হচ্ছিল সামিরকে সে হারিয়ে ফেলবে। সেই কষ্টের কথা ভেবেই কান্না পাচ্ছে এখন। সামির বলল,” কাঁদছো কেন তুমি?”

” ভবিষ্যতের কথা ভেবে কান্না পাচ্ছে। আপনি কি সবসময় আমাকে এভাবে ভালোবাসবেন?”

সামির দুই পাশে মাথা নেড়ে বলল,” না। আমি তোমাকে এর চেয়েও বেশি ভালোবাসবো। আমার ভালোবাসা সময়ের সাথে কখনও কমবে না, শুধু বাড়বে। কারণ আমার প্রজাপতিটি বড্ড ভালোবাসাময়। তাকে অল্প করে ভালোবাসাই যায় না। তার মায়াজাল প্রতিদিন নতুনভাবে আকর্ষণ ছড়ায়। আমি সেই বন্দিজালের নিশ্চুপ আসামী। শুধু ভালোবাসা দেওয়া ছাড়া আমার উপায় নেই। তাকে ভালো না বাসলে আমার মৃ’ত্যু নিশ্চিত!”

অরার চোখ টলমল করছে। নরম ও তৃপ্তিময় কণ্ঠে বলল,” আমার কিছু বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আজকের দিনটা স্বপ্ন।”

” তোমাকে পাওয়ার পর থেকে প্রতিটি দিন আমার কাছে স্বপ্নই মনে হয় অরা। শুধু অবহেলার মুহূর্তগুলো ছাড়া।”

অরা মাথা নিচু করে তীব্র অপরাধবোধ থেকে বলল,” আই এম স্যরি। আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি আমি।”

সামির তার ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে বলল,” শশশ, ওইসব কথা আমরা একদম ভুলে যাবো।”

” কিন্তু আমি জানি আপনি এতো সহজে পারবেন না ভুলতে। আমি কি করব আপনাকে ভোলানোর জন্য?”

সামির অরার কোমর জড়িয়ে ধরে একটু উপরে তুলে গাঢ় কণ্ঠে বলল,” আমাকে আদর করো, তাহলেই হবে।”

অরা হাসল। সামিরের দুই গাল চেপে ধরে এবার ঠিক কপালে চু’মু দিল। খুব আদর নিয়ে। সামিরের চোখ টলমল হয়ে এলো অসীম তৃপ্তিতে। সে অরাকে ওভাবেই ধরে বিছানায় নিয়ে এলো। তবে আজকে নিয়ন্ত্রণ হারালো না। অরা খুব সংবেদনশীল। তাকে পেতে প্রয়োজন অসীম ধৈর্য্য। এই কয়েকদিনে অন্তত এই ব্যাপারটা সামির ভালো করে বুঝেছে। তাই আজ খুব ধৈর্য্য নিয়ে সে আলতোভাবে অরার ঠোঁটে চু’মু দিল।

অরার ঘুম জড়ানো চোখ আর ক্লান্ত শরীর বিছানা পেয়েই যেন অচেতন হয়ে লুটিয়ে পড়ল ঘুমরাজ্যের তলদেশে। সন্ধ্যায় সে ঘুমের ঔষধ খেয়েছিল। স্নায়বিক উত্তেজনার কারণে এতোক্ষণ তা কাজে আসেনি। তবে এখন স্নায়ু কিছুটা শিথিল হতেই মাত্র পাঁচমিনিটে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

সামিরের অনুভূতিরা আকাশে উড়তে থাকা অবস্থায় হঠাৎ যেন ছিটকে পড়ল নিচে। সে আশ্চর্য হয়ে বলল,” অরা, এটা কি কোনো ঘুমানোর সময়? প্লিজ ওঠো। ওঠো বলছি!”

অরা উঠল না। বরং আরাম করে সামিরের হাত জড়িয়ে ধরে গাঢ় ঘুমে নিবৃত্ত হলো। সামির তাকে টেনে ওঠাল। স্পষ্ট করে ডাকল,”এই মেয়ে ওঠো। তোমাকে উঠতেই হবে।”

ঘুমে কাতর অরা ঢলে পড়ল সামিরের বুকে। আধো আধো কণ্ঠে অনুরোধ করল,” প্লিজ… আমাকে একটু ঘুমাতে দিন!”

আহা, কি মায়া সেই কণ্ঠে! কি আকুল আবেদন! সামির দীর্ঘশ্বাসের সাথে ছেড়ে দিল অরাকে। অতঃপর নিজেও শুয়ে পড়ল পাশে। এভাবেই তার সারাটা রাত কাটল, অরার ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে থেকে, প্রগাড় অপেক্ষা নিয়ে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে