রুপালি মেঘের খামে পর্ব-২০

0
625

#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz

২০.
সামিরের মুখ রাগে ফুলে আছে। সুমন সাহেব মনে মনে দুঃখবোধ করলেন।কেমন বাবা তিনি? ছেলের বিপদে হাসছেন! এভাবে হাসা উচিৎ হয়নি।

তিনি সামিরের কাঁধে হাত রাখলেন। সামির বাবার হাত কাঁধ থেকে সরিয়ে অতিষ্ট কণ্ঠে বলল,” সরো তো বাবা। তোমাদের ফাজলামি আমার ভালো লাগছে না।”

সুমন সাহেব বিগলিত কণ্ঠে বললেন,” আরে, তুই মেজাজ দেখাচ্ছিস কেন? আমি বুঝতে পারছি, সমস্যাটা গুরুতর। কিন্তু একটা সমাধান তো বের করতে হবে। এভাবে কয়দিন চলবে? তুই রেগে গেলে তো হবে না। আমি এসেছি ঠান্ডা মাথায় তোর সাথে কথা বলতে। চল, তোকে বরং এখানেই একটা ডাক্তারকে দিয়ে চেকাপ করাই। অবশ্য রাতে তো ডাক্তার বসে না। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”

” ধ্যাৎ!”

সামির দারুণ বিরক্তি নিয়ে বাবার সামনে থেকে উঠে চলে এলো। চূড়ান্ত রাগ লাগছে তার। অরা কি বলেছে সবাইকে? জানার জন্য সে অরাকে খুঁজতে শুরু করল।

ফুলবানুর কেবিনের সামনে যেতেই দেখা হলো সামিয়ার সাথে। সামিয়া হেসে বলল,”ভাইয়া, দেখো। ওই দাদুটা কত রোমান্টিক। দাদীটা শুয়ে আছে আর দাদু তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সো সুইটা না?”

সামির কাঠখোট্টা স্বরে প্রশ করল,” তোর ভাবি কই?”

” একটু আগে দেখলাম মায়ের সাথে কথা বলছে। করিডোরের মধ্যে কোথাও আছে মনে হয়।”

সামির যেতে নিলেই শুনল সামিয়া ফিসফিস করে বলছে,” তুমিও অনেক রোমান্টিক ভাইয়া। সারাক্ষণ শুধু ভাবী ভাবী করো।”

কথাটা শুনেই আগুন চোখে তাকাল সে। সামিয়ার ঠোঁটে চাপা হাসি। সামির বলল” এমনিই মাথা গরম হয়ে আছে। মেজাজ খারাপ করবি তো এক চড় লাগাবো।”

সামিয়া চুপসে গেল। হঠাৎ ভাইয়া এমন রেগে আছে কেন? কি হয়েছে?

দক্ষিণ পাশের আসনগুলোর একটাতে মনখারাপ করে বসে আছে অরা। তার পাশেই নীলিমা। সামির সেখানে উপস্থিত হয়ে সরাসরি বলল,” অরা, একটু এদিকে এসো।”

অরা বলল,” কি হয়েছে?”

” আগে আসো, তারপর বলছি।”

অরা ভয় নিয়ে নীলিমার দিকে চাইল। নীলিমা বললেন,” যাও।”

অরা কাছে আসতেই সামির তার হাত ধরে টেনে নির্জনে নিয়ে এলো। অরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,” আরে, কি হয়েছে? এমন করছেন কেন?”

” তুমি কি বলেছো সবাইকে?”

” আমি কিছুই বলিনি। টেস্টের রেজাল্ট ভুল এসেছিল।কিন্তু আপনি আমাকে অবিশ্বাস করেছেন।”

সামির কটমট স্বরে বলল,” অবিশ্বাস কেন করব? রেজাল্ট যে ভুল এটা আমি আগেই গেস করেছিলাম। আরেকবার টেস্ট করানোর কথাও ভেবেছিলাম। বাট তুমি কি করেছো? সবাইকে আমাদের ব্যাপারে কি বলেছো?”

” আমি তো কিছু বলিনি। শুধু আম্মুকে বলেছিলাম। ”

সামির অরার থুতনি ধরে মুখ উপরে তুলে প্রশ্ন করল,” কি বলেছো আম্মুকে? সেটাই জানতে চাইছি আমি।”

” যা সত্যি তাই বলেছি।”

” সোজা কথায় উত্তর দাও। কোনটা সত্যি?”

“আমাদের মধ্যে এমন কিছুই হয়নি যে কারণে আমি প্রেগন্যান্ট হতে পারি… ”

” বাহ! খুব ভালো। এটাই বলেছো?”

“উফ, আমি বলতে চাইনি। কিন্তু… ”

অরাকে থামিয়ে সামির ধমক দিয়ে উঠল,” আমাকে বোঝাও। এগুলো কি ফ্যামিলির সাথে আলোচনা করার জিনিস? তোমার কমন সেন্স নেই?”

” আপনি তো আমার সিচুয়েশনটা বুঝতে পারছেন না। আমি কেন বলেছি শুনবেন তো আগে। আমি জানি রেজাল্ট ভুল ছিল। কিন্তু আমার কথা তো কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই নার্সকে বলেছিলাম আরেকবার টেস্ট করাতে। রেজাল্ট ভুলও হতে পারে। তখন উনি প্রশ্ন করলেন যে আমি কিভাবে শিউর হলাম রেজাল্ট ভুল? আমার ভয় লাগছিল। তার উপর আপনিও আমার সাথে কথা বলছিলেন না। তাই তাকে ভরসা করে সত্যিটাই বলেছি। কিন্তু সে আম্মুকে সব বলে দিয়েছে।”

সামির হাতে তালি বাজিয়ে বলল,” বাহ, আমার ইজ্জতের ফালুদা বানানোর জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল।”

অরা অপরাধী স্বরে বলল,” স্যরি। কিন্তু আপনি এতো রাগ হচ্ছেন কেন? ওরা যা ভাবছে সেটা তো সত্যি না।”

” রাগ হবো না কেন? সত্যি হোক আর না হোক, মা-বাবার সামনে এখন আমি কিভাবে দাঁড়াবো? সায়ান পর্যন্ত জেনে গেছে। ওহ, মাই গড! তুমি এটা কি করলে অরা? ”

” স্যরি। আপনি যদি আমাকে তখন একটু বিশ্বাস করতেন তাহলে এসব কিছুই হতো না।”

” আমি ঠিকই বিশ্বাস করেছি তোমাকে। উল্টা তুমিই আমাকে বিশ্বাস করোনি।”

” মানে? আমি কখন আপনাকে অবিশ্বাস করলাম? আপনিই তো সবার সামনে থেকে রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন। তখন আমার কি অবস্থা হয়েছিল জানেন?”

” তাই বলে তুমি এইরকম ডাম্ব একটা কাজ করবে? আম্মুকে এইসব বলবে? ”

” বার-বার আমাকে দোষারোপ করছেন কেন? আমি আম্মুকে কিছু বলিনি। উল্টা-পাল্টা বলেছে ওই নার্স।
তাছাড়া প্রথম দোষ তো আপনারই। আপনার উচিৎ ছিল রাগ না দেখিয়ে আমার সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা বলা। ”

সামির তীব্র মেজাজ নিয়ে আওড়াল,” মেয়ে মানুষ বলে কাদের? যাই হয়ে যাক, নিজের দোষ জীবনে স্বীকার করবে না।”

” হোয়াট ডু ইউ মিন?”

“এই পুরো ঝামেলার মুল উৎস তুমি অরা।তোমার ন্যাকামির জন্যই এতোকিছু হয়ে গেছে।”

এবার অরাও খুব তেতে উঠল। একটা ভুলের জন্য আর কয়বার কথা শুনতে হবে তাকে রোষ নিয়ে বলল,” শুনুন, নিজের ভুল মানতে শিখুন ওকে? প্রথম দিকে কিন্তু আপনিই গেস্টরুমে থাকা শুরু করেছিলেন। এগুলো আম্মুর নজরে পড়েছে। তাই তিনি এতোকিছু ভেবে বসেছেন। আমি বলার কারণেই যে উনি ভেবেছেন এমন না। আমি শুধু ততটুকুই বলেছি যতটুকু বলা প্রয়োজন ছিল।”

” আমি গেস্টরুমে কেন শিফট হয়েছিলাম? সেটাও তো তোমার জন্যই৷”

” আচ্ছা বুঝলাম প্রথমে আমি আনকমফোর্ট ছিলাম। কিন্তু আমি যখন চট্টগ্রাম থেকে ফিরে এলাম তারপর নিজের ভুলের জন্য রিগ্রেট করলাম তখন আপনি গেস্টরুমে যাওয়ার ঢংটা না করলেও পারতেন।”

” ওহ, তাই নাকি? এখন সব আমার দোষ? তুমি নিজেকে কি ভাবো? আর আমাকে কি ভাবো? আমি কি বানের জলে ভেসে এসেছি যে যখন ইচ্ছে হলো চড় মা-রলে আবার যখন ইচ্ছে হলো চুমু দিয়ে সব ভুলিয়ে দিলে? এতো সহজ মনে হয় সবকিছু?”

অরা তাচ্ছিল্য হাসল৷ হাত ভাঁজ করে বলল,” ও আচ্ছা। বুঝেছি, তার মানে এটিটিউড দেখিয়েছেন আমাকে!”

” এটিটিউড না৷ এটাকে বলে সেল্ফ রেসপেক্ট।”

” জ্বী না। সেল্ফ রেসপেক্ট আর ইগো’র মধ্যে পার্থক্য আছে। আপনি যেটা করেছেন সেটা ইগো ছাড়া কিছুই না।”

” ইগো শুধু আমারই আছে? তোমার কি নেই? ইগো প্লাস ন্যাকামির গোডাউইন একটা!”

” এক্সকিউজ মি, এখন আমি ন্যাকামির গোডাউন? অথচ প্রথমে এমন ভাব করতেন যেন আমার ন্যাকামিই আপনার ভালো লাগে। সব ছেলে মানুষ এক। প্রথম প্রথম কত মিষ্টি কথা! আর এখন আমি ন্যাকার গোডাউন?”

“প্লিজ আর হাসিয়ো না। আমি বলে তোমার ন্যাকামি সহ্য করেছি। অন্য কোনো ছেলে হলে এতোদিনে ডিভোর্স দিতো।”

” তাই বুঝি? তাহলে আপনি ডিভোর্স দিলেন না কেন?”

” আমি দয়াবান তাই।”

” এতো দয়া দেখাতে কে বলেছিল?”

” আচ্ছা? এই ব্যাপার? ডিভোর্সের কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে কে মাফ চেয়েছিল? আজকে রাতেও তো স্যরি বলছিলে। শুধু পায়ে ধরা বাকি রেখেছো।”

অরা ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে বলল,” আপনার সাথে কথা বলতেও বিরক্ত লাগছে আমার। আমি গেলাম। খবরদার আমার আশেপাশে আসবেন না।”

” থ্যাংক গড। প্লিজ গো।”

অরা আছড়ে আছড়ে পা ফেলে চলে যেতে লাগল। ফোঁসফোঁস করে তার নিঃশ্বাসের শব্দ বের হচ্ছে। গা কাঁপছে রাগে।

সামির একটু ঠান্ডা হয়ে ডাকল,” শোনো।”

” আপনার কোনো কথা শোনার ইচ্ছে আমার নেই। ডাকবেন না।”

” জরুরী কথা।”

” চুলোয় যাক জরুরী কথা।”

অরা চলে যাচ্ছে। সামির রাগে দেয়ালে আঘাত করল। সাথে সাথে কাঁচ ফে-টে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। এইখানে যে কাঁচ আছে সেটা একদম খেয়াল করেনি সে। মুখ দিয়ে আর্তনাদ বের হলো,” আহ!’

অরা শব্দ শুনে ছুটে এলো। সামিরের র/ক্তা/ক্ত হাত দেখে বিস্ময়ে চিৎকার করল।

” কি হয়েছে আপু? কোনো প্রবলেম?” যে নার্স অরাকে এক্সামিন করেছিল সেও ছুটে এসেছে।

অরা-সামির কেউ কোনো জবাব দিল না। নার্সটি নিজের গরজে সামিরকে ধরে ইমারজেন্সী কেবিনে নিয়ে এলো। হাতে ফার্স্ট এইড ব্যান্ডেজ করে দিল। অরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিল সবকিছু। সামির অরাকে রাগানোর উদ্দেশ্যে নার্সকে বলল,” থ্যাঙ্কিউ। মিস পিহু।”

নার্স অবাক হওয়া হাসি দিয়ে বলল,” আপনি আমার নাম কিভাবে জানলেন?”

” ওইতো, নেইম প্লেট দেখে।”

নার্সটি লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। বলল,” এই প্রথম আমাকে কেউ নাম ধরে ডেকেছে। এমনিতে সবাই সিস্টার বলেই ডাকে।”

” কিন্তু আপনার নামটা এতো সুন্দর যে সিস্টার বলে ডাকতে ইচ্ছে হলো না।”

অরার মুখ ক্রমশ শক্ত হচ্ছে। সামিরের অন্যহাতও ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। বেটা অসভ্য!নার্সটিও বেহায়া কম না। কেমন করে হাসছে দেখো! আরে গাঁধী, তোর সাথে ফ্লার্ট করা হচ্ছে। এখনও বুঝলি না?

সামির বলল,” আপনাকে কিন্তু সিস্টারর মতো একদম লাগে না।”

” তাহলে কিসের মতো লাগে?”

” ডক্টর।”

মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল। অরা ভেতরে ভেতরে ঝলসে যাচ্ছে। কিন্তু এমন ভাব করল যেন তার কিছু যায়-আসছে না। পিহু অরার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল,” উনি আপনার কি হয়?”

সামির ভ্রু কুঁচকে কিছুটা অবজ্ঞাসূচক ভঙ্গিতে বলল,” কাজিন। বাদ দিন ওর কথা।”

মেয়েটি অবাক হয়ে বলল,” সত্যি? কাজিন হয়?”

” হুম। কেন? আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?”

“কিন্তু আমি প্রথমে ভেবেছিলাম উনি আপনার ওয়াইফ।”

” ছি, কি বলেন? আমার টেস্ট এতো বাজে না।”

এবার অরার আর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করল না। সে নির্ঘাত উল্টা-পাল্টা কিছু করে ফেলবে। গটগট করে হেঁটে চলে আসতে নিচ্ছিল। তখন শুনতে পেল সামির বলছে,” আপনার ফোন নাম্বারটা পাওয়া যাবে, মিস পিহু?”

একটি নির্জন জায়গায় এসে থামলো অরা। এইখানটায় কোনো মানুষ নেই। কেউ তাকে দেখছে না। ঝরঝর করে কান্না পেয়ে গেল এবার। আশ্চর্য, সামান্য একটা বিষয় নিয়ে কেন কান্না পাচ্ছে? নাকি সামির একটা মেয়ের সাথে ওইভাবে কথা বলেছে এটাই তার সহ্য হচ্ছে না?

সে জানে, সামির তাকে জ্বালানোর উদ্দেশ্যে এসব করেছে। তবুও তার খারাপ লাগছে। এতোটা সংবেদনশীল কেন সে? চোখ মুছতে মুছতে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। কিন্তু না, চোখের পানি যেন শেষই হচ্ছে না।

নিজের প্রতি করুণা হলো৷ এতোটা ভঙ্গুর তার হৃদয়? কেউ একটু অবহেলা করলেই ঠাস করে কান্না পেয়ে যায়! তার মন ভা-ঙা বুঝি এতোই সহজ?

পেছনে কেউ আলগোছে এসে দাঁড়াল। একটা লম্বাকৃতির ছায়া দেখল অরা। মানুষটির উপস্থিতি টের পেয়েই ঝট করে ঘুরে তাকালো। সাথে সাথে তাঁর মাথা ঠেঁকল সামিরের বুকে। অরা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পিছিয়ে গেল।

সামিরকে পাশ কা-টিয়ে চলে যেতে নিলেই তার কোমর চে-পে ধরা হলো। অরা চোখে অগ্নি ফুলকি নিয়ে ভারী এবং কঠিন গলায় বলল,” ছাড়ুন।”

সামির নরম কণ্ঠে বলল,” যদি না ছাড়ি?”

অরা কটমট করে চেয়ে রইল। সামির যেন তার রাগ ইঞ্জয় করছে। তার ঠোঁটে মৃদু হাসি। হঠাৎই কানের কাছে মুখ এনে বলল,” স্যরি।”

অরা নিজের উপর পুনরায় বিরক্ত হলো। তার আবার কান্না পাচ্ছে৷ সামান্য ‘স্যরি’ শুনেই মন গলে গেলে চলবে? সামির যখন রাগে তখন তো অরা হাজারবার ‘স্যরি’ বললেও কাজ হয় না৷ তাহলে অরা কেন একটা ‘স্যরি’তেই গলে যাবে?

সে আরও রাগ দেখানোর চেষ্টা করল। ছুটোছুটির চেষ্টা করল। কিন্তু সামির শক্ত করে ধরে থাকায় ছুটতে পারল না। তারপর এমনভাবে কাঁদতে লাগল যেন ছাড়া না পেয়ে বিরক্ত হয়ে কাঁদছে। কিন্তু সামির তো বুঝতে পারল তার কান্নার কারণ৷ অরার মাথাটা বুকে চে-পে ধরেই আদুরে কণ্ঠে বলল,” আ’ম স্যরি। আর কখনও এমন হবে না। আমি খুব খারাপ।”

অরা আর নড়াচড়া করল না। সামিরের বুকে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতেই থাকল। কান্নার সাথে ঝরে পড়ছিল অভিমান। কিছুক্ষণ সময় এভাবে কা-টল।

সামির অরার চুলে হাত বুলাচ্ছিল অনবরত। এক সময় অরা মুখ তুলে তাকালো। সামিরের ব্যন্ডেজ করা হাতটা নিয়ে আফসোসের সুরে বলল,” এটা কি করলেন বলুন তো? আপনি এতো পাগল কেন?”

” তুমি এতো জেদি কেন? তখন আমার কথাটা শুনলে কি হতো?”

” আচ্ছা এখন বলুন, কি এমন কথা? যার জন্য হাতের এই হাল করলেন?”

” দাদীকে রেজাল্ট ভুলের ব্যাপারটা জানানোর দরকার নেই৷ উনি আপাতত যেটা জেনে খুশি আছেন সেভাবেই খুশি থাকুক। পরে বাড়িতে নিয়ে বুঝিয়ে বলবো।”

” এই সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নেওয়া হয়েছে৷ আম্মু আমাকে বলেছেন দাদীকে যেন কিছু না জানানো হয়।”

” তাহলে ঠিকাছে।”

” আর আমিও আম্মুকে পুরো বিষয় বুঝিয়ে বলেছি। আপনার ইজ্জতের ফালুদা হবে না।”

অরা এই কথা বলে হেসে ফেলল। সামির খেয়াল করল আশেপাশে কেউ নেই। তাই সে টুপ করে চুমু দিল অরার ঠোঁটে। অরার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল নিমেষেই।

সামির হুটহাট এমন সব কাজ করে যা অরা ওইসময় কল্পনাও করতে পারে না। ভ্যাবাচেকা খেয়ে স্তব্ধ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সামিয়া আর সায়ানের কণ্ঠ ভেসে আসছে। তারা এদিকেই আসছে।

সামির অরার হাত ধরে বলল,” চলো।”

অরা মাথা নিচু করে নিজেও সামিরের হাতটা ধরল। তখনি ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। অরা বলল,” রূপা। আপনি যান, আমি আসছি।”

” ওকে।”

সামির চলে যাওয়ার পর অরা ফোন রিসিভ করতেই
ওই পাশ থেকে বিচলিত কণ্ঠে রূপা চেঁচিয়ে উঠল,” কিরে অরা, এগুলো কি শুনলাম? ”

” কি শুনেছিস?”

রূপা ফিসফিসিয়ে বলল,”তোর বরের নাকি মেশিনগান নষ্ট? এখনি কি সার্ভিসিং করাতে হবে?”

অরা ভীষণ বিরক্তি নিয়ে বলল,” প্লিজ, এখন তুইও শুরু করিস না আবার। এসব নিয়ে এমনিও অনেক কিছু ঘটে গেছে।”

“তার মানে কি ঘটনা সত্যি? হায় আল্লাহ!”

“কিছুই সত্যি না। সব গুজব। আর সায়ান ভাইয়ের কি খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই যে তোকেও এসব জানায়? আশ্চর্য ব্যাপার!”

রূপা অহংকার করে বলল,” ও আমার কাছে কিছু গোপন করতে পারে না। ওর কণ্ঠ শুনলেই বুঝে ফেলি কি সমস্যা। মিথ্যা বললেও খপ করে ধরে ফেলি। আমি হচ্ছি দারোগা।”

” ঠিকাছে দারোগা সাহেবান। আপনাকে আমি বাসায় গিয়ে ফোন করব। এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না।”

রূপা ব্যস্ত গলায় বলল,” আরে শোন, শোন, প্রথমে তোর প্রেগনেন্সির খবরটা শুনে তো আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। সায়ান যখন বলল, আমি যে কি অবাক হয়েছি! কারণ ভেতরের খবর তো আমি জানি। পরে অবশ্য শুনলাম রিপোর্ট ভুল। যাই হোক, কিন্তু দাদীর হঠাৎ পুতির মুখ দেখার শখ হলো কেন আমি বুঝলাম না। আবার তোকে নাকি খুব আদরও করছে?”

অরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সায়ান রূপাকে হাসপাতালের কোনো ঘটনা বলতে বাদ রাখেনি। হায়রে! পারেও সে। অরা বলল,” এই ব্যাপারটা আমিও বুঝিনি। অথচ আমার জন্যই কিন্তু দাদী অসুস্থ হয়েছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, এই কথা তিনি কাউকে কিছু বলেননি।”

” তোর জন্য অসুস্থ হয়েছে মানে? তুই কি করেছিস?”

অরা একটু হেসে বলল,” আর বলিস না, আমি একটা ভয়ংকর কান্ড করেছি। দাদীকে জ্বীনের ভয় দেখিয়েছি। বলেছি আমার সাথে জ্বীন আছে। সেই জ্বীন আমার বড়মাকে মেরেছিল। আরও হেন-তেন ব্লাহ ব্লাহ বানিয়ে বলেছি। এসব শুনে দাদী তো ভয়ে আধমরা। রাতে স্ট্রোক করতে নিয়েছিল।”

” হায়, হায়, বলিস কি অরা? যদি সত্যি স্ট্রোক করতো?”

” ভাগ্যিস সেরকম কিছু হয়নি। কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছিলাম আমার কান্ড নাকি আবার বলে দেয়। তাহলে সবাই আমাকেই….”

অরা তার কথা শেষ করতে পারল না৷ পেছনে ঘুরতেই সামিরকে দেখে তার বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠল।

দ্রুত ফোন কেটে সোজা হয়ে দাঁড়ালো অরা। কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” আপনি কখন এসেছেন?”

সামির হাত ভাঁজ করে জবাব দিল,” কেন জিজ্ঞেস করছো? আমি তোমার কথা কতটুকু শুনেছি সেটা বোঝার জন্য? সব শুনেছি আমি।”

অরার চেহারা সাদা কাগজের মতো রঙহীন হয়ে গেল। মাথা নিচু করল সে। কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সামিরও কিছু বলছে না। কিভাবে যেন একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অরার শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। বুকে দামামা বাজছে।

সামির ছোট্ট করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” কি করা উচিৎ এখন? বলো।”

অরা নতমুখে বলল,” কি করব? সেদিনের মতো আবার কানে ধরে উঠ-বস করব?”

” না৷ আরও ভয়ংকর শাস্তি হবে তোমার। কারণ তুমি একটা ভয়ংকর অন্যায় করেছো।”

অরার মুখ চুপসে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঢোক গিলে উচ্চারণ করল,” কি শাস্তি?”

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে