রুপালি মেঘের খামে পর্ব-১৯

0
655

#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz

১৯.
সুখবর শুনে ফুলবানুর শরীর সুস্থ হয়ে গেছে। তিনি এখন প্রতিটি কথায় হাসছেন। বেশ জোরে জোরে কথাও বলছেন। শ্বাস নিতেও কোনো অসুবিধা নেই। ডাক্তার বললেন,” খুবই ইমপ্রেসিভ। মনের শান্তি শরীরকে অর্ধেক সুস্থ করে দেয়। কথাটির যথার্থতার প্রমাণ আবার পাওয়া গেল। এভাবেই পেশেন্টকে হাসি-খুশি রাখবেন। উত্তেজিত হতে দিবেন না। উনার হার্ট কিন্তু খুব দূর্বল।”

এদিকে রেজাল্ট কিভাবে পজিটিভ এলো তা এখনও বোধগম্য হচ্ছে না অরার। সামির কিভাবে যেন তার দিকে চেয়ে আছে। অরার কান্না পাচ্ছে। সামির কি তাকে সন্দেহ করবে? ভুল বুঝবে? হে আল্লাহ, এবার কি হবে?

অরা তো নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে এখনও কুমারী। তাহলে তার গর্ভে কিভাবে সন্তান আসবে? এটা তো অলৌকিক ঘটনা! অথচ এই ব্যাপারটা কাউকে বলাও যাচ্ছে না।

ফুলবানু এই প্রথমবারের মতো অরাকে জড়িয়ে ধরলেন।কপালে চুমু দিয়ে বললেন,” আমার প্রিয় নাতবউ, তোমার জন্য আমি পুতিন দেইখা ম-রতে পারবো৷ আমার এতো আনন্দ বহুদিন পর হইতাছে।”

অরার মন চাইল চিৎকার দিয়ে কিছু একটা বলে দিতে। কিন্তু কি বলবে সে? কিছুই বলার নেই। ফুলবানু আরও বললেন,” আমি তো সকালেই ভাবছিলাম তোমারে পরীক্ষা করাতে বলবো। তারপর আবার ভাবলাম থাক, তোমরা মডান ছেলে-মেয়ে। এতো জলদি মনে হয় বাচ্চা নিবা না। আমার নিজের বউই তো বিয়ার দুইবছর পর বাচ্চা নিছে। সেই খানে নাতবউরে কিভাবে বলি দ্রুত বাচ্চা নিতে? কিন্তু দেখো, রাখে আল্লাহ মা-রে কে? আল্লাহ চাইলো বইলা ঠিকই তোমার কোল ভরার ব্যবস্থা হয়া গেল।

এখন থেকা আমার বাঁচার ইচ্ছা আরও তিনগুণ বাইড়া গেছে। অন্তত আগামী পাঁচবছর তো আমারে বাঁচতেই হইব। পুতিন বড় করতে হইব না? আমি তার সাথে খেলবো, গান গাইবো, তারে নিয়া রোজ বেলা হাঁটতেও কিন্তু যাবো৷ তুমি নিষেধ করতে পারবা না। আমি শুনবো না।”

অরা খুব অবাক হলো। ফুলবানু এতো মিষ্টি ব্যবহার কেন করছেন? তার উদ্দেশ্যটা কি? তিনি তো অরাকে সহ্যই করতে পারতেন না। এদিকে শাশুড়ীর ছেলেমানুষী দেখে নীলিমার চোখ টলমলে হয়ে এলো।

সবার চেহারায় আজ এতো উচ্ছ্বাস! অকারণেই সবাই হাসছে। সামিয়া বলল,”আমি যে এতো দ্রুত ফুপু হয়ে যাবো চিন্তাও করিনি। ভাবি, নামটা কিন্তু আমি রাখবো। প্লিজ, প্লিজ।”

সুমন সাহেব হাসতে হাসতে বললেন,” আচ্ছা, আচ্ছা, রাখিস।”

সায়ান বলল,” আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি চাচা হবো। ভাবি, আমি এখন থেকেই ভাবছি ওকে ফুটবল খেলা শেখাবো।”

সামিয়া আঁড়চোখে তাকিয়ে বলল,” ছেলে হবে বুঝলে কি করে? মেয়েও তো হতে পারে!”

” মেয়েরা কি ফুটবল খেলে না? তাছাড়া আমার ভাতিজি তোর মতো সব বিষয়ে অষ্টরম্ভা হবে না। সে অলরাউন্ডার হবে। সব পারবে। কি বলো ভাইয়া?”

সামির কোনো কথা না বলে আচমকা কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। তার এমন আচরণে সবাই হতবাক। এই পর্যন্ত সে একটা কথাও বলেনি। এতোটুকু আনন্দ প্রকাশ করেনি৷ কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। আশ্চর্য, সন্তান আগমনের খুশি সামিরকে কেন ছুঁতে পারছে না?

সামিয়া বিড়বিড় করে বলল,” ভাইয়ার আবার কি হলো?”

সায়ান কিছু বুঝতে না পেরে ঠোঁট উল্টে কাঁধ ঝাঁকাল।বলল,” কে জানে?”

সুমন সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন,” বুদ্ধি-সুদ্ধি এখনও হয়নি ছেলেটার। কোন কথায় কিভাবে রিয়েক্ট করতে হয় সেটাও জানে না।”

নীলিমা অরার বিব্রত চেহারা দেখে বললেন,” তুমি মনখারাপ কোর না অরা৷ আমরা সবাই অনেক খুশি হয়েছি।”

অরার নিজেকে সবচেয়ে অসহায় প্রাণী মনে হচ্ছে। সে কি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে এই মুহূর্তে? তাহলে এই দুঃস্বপ্নটা এখনি ভেঙে যাক। আর সহ্য করা যাচ্ছে না।

কিছুক্ষণ পর অরা বাইরে এসে সামিরকে খুঁজতে নিয়ে সেই নার্সকে দেখতে পেল। যে একটু আগেই তাকে পরীক্ষা করেছিল। দ্রুত সেই মহিলার কাছে গিয়ে অরা বলল,”সিস্টার, আমার মনে হচ্ছে রেজাল্ট কোনোভাবে ভুল এসেছে। আরেকবার পরীক্ষা করে দেখুন না প্লিজ!”

নার্স অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,” রেজাল্ট যে ভুল হয়েছে এটা আপনি কিভাবে বুঝলেন?”

অরা মাথা নিচু করল। খুব বিব্রত স্বরে বলল,” আমি জানি, এটা অসম্ভব। কারণ আমি কুমারি।”

” কিন্তু আমি তো জানি আপনি বিবাহিত। করিডোরে যে ছেলেটা বসে আছে সে কি আপনার হাজব্যান্ড না?”

অরা চূড়ান্ত অস্বস্তির মুখে পড়ে বলল,” হ্যাঁ উনিই আমার হাজব্যান্ড। কিন্তু তাও আমি কুমারি। এখন এই বিষয়ে আমি আপনাকে বেশি কিছু বলতে চাই না। শুধু বলব প্লিজ, আরেকবার পরীক্ষা করে দেখুন। কোথাও একটা নিশ্চয়ই ভুল হচ্ছে।”

নার্স কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,” বুঝলাম। ঠিকাছে চলুন।”

দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় রেজাল্ট সত্যিই নেগেটিভ এলো। অরা এবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সামিরকে ব্যাপারটা দ্রুত জানাতে হবে। নীলিমা দূর থেকে দেখলেন অরা নার্সের সঙ্গে কথা বলছে। তিনি কিছুটা এগিয়ে যেতেই সব কথা শুনে ফেললেন।

নার্স তখন বলছে,” ভুলটা আমারই ছিল। স্যরি ম্যাম।আসলে দুইজনের কীট এক জায়গায় ছিল। তাই ব্লেন্ডার হয়ে গেছে। ওই আপুটা সত্যি গর্ভবতী। তার কীট দেখেই আমি বলে ফেলেছি আপনি প্রেগন্যান্ট। ”

এই কথা শুনে নীলিনার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। তিনি এগিয়ে এসে নার্সকে ঝারতে শুরু করলেন,” এটা আবার কেমন ভুল? আপনি খেয়াল করবেন না? এখন কতবড় একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেল আমাদের ফ্যামিলিতে। আমার শাশুড়ীকে এবার কিভাবে বোঝাবো এটা?”

অরা নরম গলায় বলল,” থাক আম্মু, বাদ দিন। ভুল তো হতেই পারে।”

নার্স বলল,” সমস্যা তো আপনার হাজব্যান্ডের। তাকে ডাক্তার কেন দেখাচ্ছেন না?”

নীলিমা আশ্চর্য হয়ে বললেন,” মানে? কাকে ডাক্তার দেখাবে? সামিরকে? সামিরের আবার কি হয়েছে?”

অরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,” কিছু হয়নি আম্মু।”

নার্স স্পষ্ট গলায় বলল,” এসব এখন আর গোপন রাখার বিষয় না। আপনি লজ্জা পাচ্ছেন কেন? দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি আপনার শাশুড়ীর সাথে ফ্রী। তাহলে তাকে সত্যি কথাটা বুঝিয়ে বলুন। আপনার হাজব্যান্ড অক্ষম বলেই তো আপনাদের বেবি হচ্ছে না।”

অরা রাগান্বিত দৃষ্টিতে চাইল। খিটমিট করে বলল,” আপনি চুপ থাকবেন? কখন আপনাকে বলেছি এই কথা আমি? একটু বেশিই বুঝেন।”

” আপনি নিজেই তো বলেছেন যে আপনি কুমারি। আপনাদের মধ্যে কখনও ইন্টিমেসি হয়নি।”

শাশুড়ীর সামনে এমন কথা উঠে আসায় অরার চোখ-মুখ লাল হয়ে এলো লজ্জায়। ফ্যাকাশে দেখাল চেহারা। এদিকে নীলিমা এসব শুনে থম মেরে গেছেন। তার মাথায় যেন বজ্রপাত হয়েছে। তিনি এটা কি শুনলেন? এটা তো কোনো স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না।

নার্স বলল,” পরে কন্সিভ না করার জন্য সবাই আপনাকে ব্লেইম করতে থাকলে বুঝবেন।”

” আমাদের ফ্যামিলি ম্যাটার নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না। নিজের চরকায় তেল দিন।”

” আপনার ভালো চাইছি আমি। এটাও কি দোষ?”

” আপনাকে ভালো চাইতে বলেছি আমি? কি আশ্চর্য! ”

অরা যখন নার্সের সঙ্গে তর্কে ব্যস্ত তখন নীলিমা কিছু না বুঝে সেখান থেকে চলে এলেন।

সুমন সাহেব করিডোরের একপাশে দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছিলেন। এদিকটায় প্রচন্ড বাতাস। নীলিমা সুমন সাহেবের পাশে এসে দাঁড়ালেন। সুমন সাহেব ঘনিষ্ট আত্মীয়দের সুসংবাদ জানাচ্ছেন। নীলিমা চোখ-মুখ কঠিন করে বললেন,” ফোন রাখো।”

সুমন সাহেব স্ত্রীর রুদ্রমূর্তি দেখে তড়িঘড়ি করে ফোন রাখলেন। নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,” কিছু বলবে?”

” এই পর্যন্ত কয়জনকে জানিয়েছো?”

সুমন উৎসাহের সাথে বললেন,” বড় আপাকে জানালাম। শুনে খুব খুশি হয়েছে।”

” আর কাউকে জানানোর দরকার নেই।”

” কেন?”

” কারণ রেজাল্ট ভুল এসেছে।”

” বলো কি?”

নীলিমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,”ঠিকই বলছি। কিন্তু এখন যে তার থেকেও টেনশনের বিষয় ঘটে গেছে!”

” আবার কি?”

নীলিমা মাত্র শুনে আসা ঘটনাটাই স্বামীকে জানালেন। এবার সুমন সাহেব সত্যি বিচলিত হয়ে পড়লেন। রেজাল্ট ভুল আসা তেমন কোনো বড় বিষয় না। কিন্তু বিয়ের এতোদিন পরেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই এটা সত্যিই খুব বিস্ময়কর ব্যাপার। চিন্তাজনক তো বটেই। নীলিমা দুঃখী কণ্ঠে বললেন,” আচ্ছা, আমাদের সামিরের কোনো সমস্যা থাকে যদি?”

সুমন সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন,” কি বলছো? তা কিভাবে হয়? না,না!”

” হতেও তো পারে। তুমি জানো বিয়ের প্রথমদিকে কিন্তু অরা সামিরকে একদম দেখতে পারতো না। খুব অবহেলা করতো। বৌভাতে যেদিন বেয়াইনরা এলো সেদিন অরা বলছিল সে একাই নাকি বাপের বাড়ি চলে যাবে। সামিরকে নেবে না। তাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো হলে এই কথা কেন বলবে?

সুমন সাহেব তাকিয়ে রইলেন। নীলিমা বললেন,” তাছাড়া আমি দেখেছি, সামির প্রায়ই গেস্টরুমে গিয়ে ঘুমায়। নিজের চোখেই ওকে অনেকবার গেস্টরুম থেকে সকাল সকাল বের হতে দেখেছি। আর অরা তো প্রায় একমাস বাপের বাড়তেই থাকল। নতুন বিয়ের পর কোনো মেয়ে কি এতোদিন বাপের বাড়ি থাকে? এসব কি কোনো ভালো লক্ষণ তুমিই বলো? বিয়ের পর প্রথম প্রথম তো আমাদেরও কত ঝগড়া হতো৷ তাই বলে কি আমরা আলাদা থাকতাম?”

সুমন সাহেবের কপালের ভাঁজ গাঢ় হতে শুরু করেছে। তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন। নীলিমা আফসোসের সুরে বললেন,” নার্স বলেছে অরা কখনও মা হতে পারবে না।”

সুমন সাহেব ভীত গলায় বললেন,” তাহলে কি আমাদের ছেলে শারীরিকভাবে অক্ষম?”

” হোয়াট? কি বলছো বাবা তোমরা এসব?” হঠাৎ সায়নের কণ্ঠ শুনে নীলিমা এবং সুমন সাহেব বিষম খেলেন। সায়ন হাঁ করে তাকিয়ে আছে। সে বিস্ময়াভিভূত।

নীলিমা রেগে বললেন,”তুই লুকিয়ে লুকিয়ে কথা শুনছিস কেন?”

” আমি লুকিয়ে কথা শুনিনি মা। আমি জাস্ট যাচ্ছিলাম এখান দিয়ে আর সাডেনলি কথাটা আমার কানে এসে লাগল। আমি লিটরেলি সারপ্রাইজড। তোমরা কার বিষয়ে কথা বলছো? আমি নাকি ভাইয়া? প্লিজ বলো!”

সুমন সাহেব উত্তর দিলেন,” সামিরের ব্যাপারে কথা হচ্ছে। তোর চিন্তার কিছু নেই।”

সায়ান প্রথমে হাঁফ ছাড়ল৷ তারপর পুনরায় বিস্মিত হয়ে বলল,” তার মানে ভাইয়া..”

বাকি কথা উচ্চারণ করার আগেই সুমন সাহেব ধমক দিলেন,” আস্তে কথা বল। মানুষ শুনে ফেলবে তো।”

সায়ন দ্রুত গলার আওয়াজ নিচু করে বলল,” স্যরি, স্যরি, কিন্তু এটা কি সত্যি? তাহলে ভাবীর গুড নিউজ? সেটা কিভাবে সম্ভব?”

এবার নীলিমা বিরস মুখে জানালেন,” রেজাল্ট ভুল এসেছে।”

” ও মাই গড, ও মাই গড!”

সায়ন দুই হাত মাথায় ঠেঁকিয়ে একবার ডানে গেল, আরেকবার বামে এলো। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সর্বনাশ করেছে। নিজের বড়ভাইয়ের এমন দূর্বলতার কথা মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

সুমন দুঃখ ভারাক্রান্ত গলায় বললেন,” তুই কি সামিরের সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে পারবি? ওকে তো ব্যাপারটা বোঝাতে হবে। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না।”

সায়ানের চক্ষু চড়কগাছ। উচ্চ কণ্ঠে বলল,” ভাইয়া আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড় বাবা। আমি কিভাবে তার সাথে এই বিষয়ে কথা বলব?”

সুমন সাহেব মাথা নেড়ে বললেন,” তা অবশ্য ঠিক৷ থাক,থাক, আমিই বলবো। তুই যা। এই কথা আবার কারো সাথে আলোচনা করিস না।”

” কিন্তু তুমি বাবা হয়ে ভাইয়ার সাথে কিভাবে এই বিষয়ে কথা বলবে? ভাইয়া তো লজ্জা পাবে বাবা।”

” এখন তো কিছু করার নেই। কথা বলতেই হবে। সমস্যা বেশি গুরুতর হলে চিকিৎসাও করাতে হবে।”

নীলিমা মনে মনে প্রচন্ড আহত হলেন। তার সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে অরার জন্য। আহারে, মেয়েটার জীবন কেমন নষ্ট হয়ে গেল। অথচ মেয়েটা এতোদিন মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলেনি। আজকে আবার নার্স যখন বলে দিতে নিচ্ছিল তখনও সে থামানোর চেষ্টা করছিল। নিশ্চয়ই মেয়েটার সংসারের প্রতি মায়া জন্মে গেছে। তাই স্বামী অক্ষম জেনেও সবকিছু মেনে নিয়েছে। কি আর করবে?

অরার প্রতি স্নেহ কয়েক গুণ বেড়ে গেল নীলিমার। তিনি অরার কাছে ছুটে গেলেন। অরা করিডোরে সারিবদ্ধভাবে সাজানো আসনগুলোর একটিতে চুপচাপ বসেছিল।

নীলিমা এসে অরার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” মনখারাপ কোর না মা। আজ থেকে আমি তোমার পাশে আছি। সামিরকে আমরা অনেক বড় ডাক্তার দেখাবো। প্রয়োজনে বিদেশে নিয়ে যাবো। ওকে সুস্থ করিয়েই ছাড়বো।”

অরা প্রথমেই কথার অর্থ বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

সুমন সাহেব অনেক ইতস্তত করছেন। সামিরের সাথে এ বিষয়ে শেষ কথা বলেছিলেন যখন সামির বয়ঃসন্ধিতে পা রেখেছিল। কিশোর ছিল। ছেলে যাতে কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে ভুল কিছু না করে তাই অনেক পরামর্শ দিয়েছেন সেই সময়।

তখন উপদেশ দিতে এমন অস্বস্তি লাগেনি। তবে কখনও তিনি চিন্তাও করেননি ছেলের বিয়ের পর আবার এইসব বিষয়ে কথা বলতে হবে। একবার তিনি ভাবলেন সায়ানকেই পাঠাবেন। তারপর আবার ভাবলেন, সায়ানকে দিয়ে এসব বলানো হলে সামির বেশি লজ্জা পেতে পারে। তার চেয়ে ভালো তিনি নিজেই বলবেন।

অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি ডাকলেন,” সামির, বাবা।”

সামির কোনো জবাব দিল না। সে বাইরে তাকিয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভাবছে। সুমন সাহেব সময় নিয়ে আবার ডাকলেন,” বাবা সামির।”

সামির এবার সচকিত হলো। পকেটে হাত গুঁজে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,” ওহ বাবা, বলো।”

ছেলের কণ্ঠ শুনে আরও মনখারাপ হয়ে গেল সুমন সাহেবের। তিনি সামিরকে পাশে নিয়ে বসতে বসতে বললেন,” আমি বুঝতে পারছি বাবা। তুই একটা বিষয় নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছিস।”

সামির একটু থতমত খেল৷ বাবা কিভাবে বুঝল যে সে দুশ্চিন্তা করছে? অবাক হয়ে বলল,” তুমি জানো?”

” অরার কাছে সব শুনেছি আমি।”

” কি শুনেছো অরার কাছে?” সামির আশঙ্কা নিয়ে তাকাল। অরা খুব লাজুক। সে নিশ্চয়ই বাবা-মায়ের সাথে এসব নিয়ে আলোচনা করবে না!

সুমন বললেন,” ‌যা নিয়ে তুই দুশ্চিন্তা করছিস, তাই শুনেছি। রেজাল্ট ভুল এসেছে। অরা প্রেগন্যান্ট না। আর কখনও হতেও পারবে না।”

সামির চোখ বড় করে তাকাল,” ও তোমাদের সব বলে দিয়েছে নাকি?”

সুমন মাথা নাড়লেন। সামির বিস্ময়ে স্তব্ধ। লজ্জায় চেহারার রঙ বদলে গেল। হঠাৎ পেছন থেকে কারো হাসির আওয়াজ শোনা যায়। সামির পেছনে তাকাতেই দেখল সায়ানকে। অবাক হয়ে বলল,” ও হাসছে কেন বাবা?”

সুমন সাহেব মাথা নিচু করে বললেন,” কারণ সেও জানে।”

” তোমরা ওকেও এই কথা বলে দিয়েছো নাকি? মানে এসব কি হচ্ছে?”

সুমন শান্ত স্বরে বললেন,” আমি আসলে তোর মায়ের কাছে শুনেছি। অরা তাকেই পুরো বিষয়টা বলেছে।”

সামির আর কথা বলার ভাষা খুঁজে পেল না। রাগে প্রচন্ড বিরক্ত লাগল। অরা তাদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলো তার চৌদ্দ গুষ্টিকে জানিয়ে দিয়েছে। কি অদ্ভুত মেয়ে!

সামির বলল,” অরা কি বলেছে বাবা?”

সুমন সাহেব একটু হকচকিয়ে গেলেন। সরাসরি বলতে গেলে সামিরই তো লজ্জা পাবে। তাই তিনি বললেন,” তুই যেটা ভাবছিস সেটাই।”

” আমি কি ভাবছি সেটা কি তুমি জানো?”

” বুঝতে পারছি। আসলে এটা তো গোপন রাখার বিষয় না। এটা একটা সমস্যা। তোর চিকিৎসার প্রয়োজন।”

সামির এবার দিশেহারার মতো বলল,”আমার চিকিৎসার প্রয়োজন মানে? এখন আমার আবার কি হলো?”

” দ্যাখ সামির, আমাদের বংশে কারো এমন সমস্যা হয়নি। এই প্রথম তোরই হলো। বিষয়টা আমাকে ভাবাচ্ছে। তুই বিয়ের আগে যদি বলতি..”

” বিয়ের আগে কি আমি জানতাম এমন হবে?”

” সেটাও ঠিক। বিয়ের আগে তো ভালো করে বোঝা যায় না।”

সায়ান আর সুমন সাহেব চোখাচোখি করল। তাদের চোখের ভাষা কেমন অদ্ভুত। সামির বিভ্রান্ত হয়ে বলল,” প্লিজ কেউ আমাকে বলো, বিষয়টা কি? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

সায়ান একটু কাছে এসে বলল,”ভাইয়া, ওয়েট। আমি বোঝাচ্ছি তোমাকে। ধরো ম্যাচের কাঠিতে আগুন জ্বলছে না। তাহলে সেই কাঠিটিকে আমরা কি বলবো?”

” ওয়েস্টেড!”

” হ্যাঁ। এর বাংলা অর্থ কি? ”

“অকেজো।”

সায়ান এবার দুঃখী দুঃখী গলায় বলল,” সেই ম্যাচের কাঠির মতো তোমার লাঠিও অকেজো ভাইয়া! সেখানেও আগুন জ্বলে না।”

সামির কিছু মুহূর্ত সময় নিল। তারপর যেই মাত্র ব্যাপারটা বুঝতে পারল, ওমনি চেঁচিয়ে বলল,” হোয়াট ননসেন্স!”

সুমন সাহেব হাসি আটকে রাখতে পারছেন না। বিষয়টা দুঃখজনক হলেও সায়ানের ব্যাখ্যা শুনে তাঁর হাসি পাচ্ছে। তিনি হেসে উঠলেন শব্দ করে। সায়ানও হাসতে শুরু করল। সামিরের গায়ের রক্ত গরম হয়ে গেল হঠাৎ৷ বাবাও তার সাথে এই ধরণের সস্তা রসিকতা কর‍তে পারলেন? কি আশ্চর্য! সবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে