#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz
১৭.
সকালের ওই ঘটনার পর থেকে অরা কোনো কাজে এতোটুকু মন বসাতে পারছে না। একবার সায়ানের জন্য কফি বানাতে গিয়ে চিনির জায়গায় লবণ দিয়ে ফেলেছিল। সেই কফি মুখে নিয়ে সায়ান ফিরোজা খালার সাথে চেঁচামেচি শুরু করে দিল। অরা গিয়ে অপরাধী স্বরে বলল,” স্যরি সায়ান ভাই। ভুল আমার। কফিটা আমি বানিয়েছি৷ দাও, চেঞ্জ করে আনছি।”
দ্বিতীয়বার কফি বানাতে গিয়ে শাড়ির আঁচলে আগুন লাগিয়ে ফেলল। নীলিমা না দেখলে নির্ঘাত অঘটন ঘটতো। তিনি অরাকে ধমক দিয়ে বললেন,” আর রান্নাঘরে আসতে হবে না তোমার। যাও পড়াশুনা করা। সামনে পরীক্ষা। সেই টেনশনেই এতো ঝামেলা হচ্ছে। এখন যদি কিছু একটা হয়ে যেতো?”
এখানেই শেষ নয়। দুপুরে খাওয়ার সময় সুমন সাহেব পানি চাইলেন। অরা গ্লাসে পানি না ঢেলে এঁটো ফেলার বাটিতে ঢেলে দিল। টেবিল ক্লোথ ভিজে একাকার অবস্থা। অরা বিচলিত কণ্ঠে বলল,” স্যরি বাবা। এখনি মুছে দিচ্ছি।”
সুমন শান্ত গলায় শুধালেন,” তোমার কি হয়েছে? শরীর ভালো তো?”
অরা লজ্জিত হয়ে বলল,” আমি খেয়াল করিনি বাবা।”
তার কেমন উদাসীন লাগছে সবকিছু। নিজের ঘরে এসে বিছানার দিকে চোখ যেতেই সকালের ঘটনা আবার মনে পড়ে গেল। অরা বিছানায় বসে রূপাকে ফোন করার সিদ্ধান্ত নিল। তার সাথে কথা বললে যদি মনটা স্থির হয়!
জানালার পর্দাটা বাতাসে নড়ছে। সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সে। রূপা ফোন ধরে কিছুক্ষণ হ্যালো, হ্যালো করল। অথচ ওই পাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। অরা ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে চুপচাপ।
রূপা লাইন কেটে আবার কল দিল। ফোনটা বাজছে৷ কিন্তু অরার সেই খেয়ালও নেই। কিছুক্ষণ পর সামিয়া ভেতরে ঢুকে বলল,” ভাবি, তোমার ফোন বাজছে।”
অরা কোনো জবাব দিল না। যেন শুনতেই পায়নি। ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি। সামিয়া কাছে এসে হাত ঝাঁকিয়ে বলল,” ভাবি?”
” হ্যাঁ? ” অরা চমকে উঠল ভীষণভাবে। সামিয়া বলল,” ফোন বাজছে তো।”
অরা দেখল রূপার তিনটি মিসডকল এসে গেছে। গালি দিয়ে একটা মেসেজও পাঠিয়েছে সে,” শা*লি, নিজে ফোন করে এখন ধরছিস না কেন? ম-রে গেছিস নাকি?”
নিজের উদাসীনতায় লজ্জা পেয়ে অরা বলল,” স্যরি, আমি খেয়াল করিনি।”
” কি হয়েছে তোমার ভাবি? ঠিকাছো?”
” হুম।”
“পরীক্ষা নিয়ে খুব টেনশন করছো তাই না? আমি বুঝতে পারছি। আমারও এরকম হয়েছিল৷”
অরা মৃদু হাসল। সারাক্ষণ বই নিয়েই বসে থাকে সে। অথচ এতোটুকু পড়তে পারে না। পড়া মাথাতেই ঢোকে না। আর আজকে তো এমনিতেও কোনোকিছুতে মন বসছে না। সকালের ঘটনা বার-বার মনে পড়ছে।
সামিয়া বলল,” তুমি ভাইয়ার থেকে হেল্প নিতে পারো কিন্তু। তার সাজেশন অনুযায়ী পড়লে অবশ্যই চান্স পাবে। আমি তো আর্সের স্টুডেন্ট ছিলাম৷ তাই ভাইয়ার কাছে পড়তে পারিনি৷ তোমার ব্যাকগ্রাউন্ড তো সাইন্স। তুমি পড়ছো না কেন? নাকি ভাইয়া সময় দিচ্ছে না?”
অরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই পড়া নিয়েই তো এতো ঝামেলা। সে আর যাই করুক, সামিরের থেকে হেল্প নিয়ে পড়বে না। কিন্তু চান্স তাকে পেতেই হবে। সামিরের হেল্প ছাড়াই; এটা তার চ্যালেঞ্জ।
অরা বলল,” আমার সমস্যা হয় না৷ আমি একা একা পড়েই অভ্যস্ত।”
” কি বলো? সাইন্সের সাবজেক্ট একা একা পড়া যায়?”
অরার আবার ফোন বেজে উঠল। ” আচ্ছা তুমি কথা বলো। আমি গেলাম।” সামিয়া উঠে চলে গেল।
অরা বারান্দায় এসে ফোনটা রিসিভ করল। মনমরা কণ্ঠে বলল,” রূপা।”
” কি হয়েছে তোর? ফোন ধরছিলি না কেন?”
” আমার কিছু ভালো লাগছে না রূপা।”
” ভালো লাগছে না মানে? এই কথা বলার জন্যই কি ফোন করেছিস?”
অরার চোখে পানি এসে গেল। অশ্রুসিক্ত চোখ মুছে বলল,” উনি আজকে আমাকে কিস করেছে।”
রূপা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,” তুই কি আবার চড় মেরেছিস?”
” না, পাগল? চড় কেন মারব? সেদিন তো ভুলে মেরেছিলাম।”
” তাহলে এখন কাঁদছিস যে?”
” জানি না। আমার কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। কিছুতেই ভুলতে পারছি না ব্যাপারটা। কোনো কিছুতে মন বসছে না। অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে…”
” কি মনে হচ্ছে?”
” মনে হচ্ছে…আমি প্রেমে পড়ে গেছি।”
” কি?” রূপা উচ্চশব্দে হেসে উঠল। হাসতেই থাকল। অরা রাগান্বিত গলায় বলল,” হাসছিস কেন তুই? এটা কি কোনো হাসির মতো কথা? আমি শিউর না এখনও।”
” বিয়ের দেড়মাস পরে এসে বলছিস তুই প্রেমে পড়েছিস! তাও আবার নিজের বরের। আবার বলছিস শিউর না। আমি হাসব না তো কি করব?”
অরা বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,” কিন্তু আমি উনার প্রেমে পড়তে চাই না। উনাকে তো আমার অপছন্দ করা উচিৎ। চটগ্রাম থেকে আসার পর এই পর্যন্ত উনি একবারও আমার সাথে ভালো ব্যবহার করেনি। সবসময় নিজের ইগো নিয়ে থেকেছে। এমনকি আমরা একঘরেও থাকছি না।একদিন সে গেস্টরুমে যায়, অন্যদিন আমাকে যেতে হয়। মানসিক ভাবেও সে আমার উপর টর্চার করছে। পড়াশুনা করতে দিচ্ছে না। ব্লেকমেইল করছে। এই জঘন্য মানুষটার প্রতি আমার ঘৃণা হওয়া উচিৎ। অথচ হচ্ছে উল্টোটা। আমার মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
” এর মানে তুই প্রেমে পড়ে রিগ্রেট করছিস?”
” অবশ্যই। খুব রিগ্রেট করছি।”
” কিন্তু তুই তো প্রথম থেকে এটাই চেয়েছিলি। উনি তোর কাছে আসবে না, দূরে দূরে থাকবে। এখন তাহলে মানতে পারছিস না কেন?”
” জানি না। আমি কি চাই সেটাও বুঝতে পারছি না। একবার মনে হচ্ছে উনাকে এড়িয়ে চলব। আবার মনে হচ্ছে উনি কাছে এলেই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করব।”
রূপা দুষ্টমি করে বলল,” ভিডিও করিস প্লিজ।”
” তুই কি মজা নিচ্ছিস?”
রূপা আবার হেসে উঠল। অরা বলল,” আমি রাখছি।”
” আরে, শোন, শোন। সলিউশন না শুনেই ফোন রেখে দিবি?”
অরা হতাশ স্বরে আওড়াল,” এই প্রবলেমের কি আসলেই কোনো সলিউশন আছে? আমার তো মনে হয় নেই।”
রূপা স্পষ্ট স্বরে বলল,” অবশ্যই আছে। পুরো ব্যাপারটাই একটা ডার্ক সাইকোলজি। তুই হয়তো মানতে চাইবি না। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করলেই বুঝবি। প্রথম প্রথম উনি যখন তোকে ভালোবাসতে চাইল, তুই সেটা অগ্রাহ্য করলি। কারণ তখন তুই তাকে টেকেন ফোর গ্রান্টেড ভেবে নিয়েছিলি। আর হঠাৎ বিয়েটা হওয়ায় প্রথম থেকেই তোর কিছুটা ভয় ছিল। তার উপর তুই জানতিও না উনার আসল পরিচয়। হঠাৎ জানতে পেরে শক খেয়ে গেছিস। সেই শক সামলাতেও সময় লেগেছে।
কিন্তু যেই মাত্র উনি তোকে ডিভোর্সের কথা বলল আর ওই তন্বি নামের মেয়েটি তোদের লাইফে এলো তখন থেকেই তোর মনে একটা ইনসিকিউরিটি তৈরী হয়েছে। আর এখন তুই তোর মনের ফিলিংস একটু একটু করে রিয়েলাইজ করতে পারছিস। সিম্পল!”
অরা বিভ্রান্ত হয়ে বলল,” মানে? তুই কি মিন করতে চাইছিস আমি আগে থেকেই উনার প্রেমে পড়ে ছিলাম? এখন শুধু রিয়েলাইজ করেছি?”
” অনেকটা তাই।”
অরা মাথা ঠান্ডা করতে চাইল। এসব নিয়ে বেশি চিন্তা করলে সে সত্যি পাগল হয়ে যাবে। এমন সময় ফিরোজা ঘরে এসে বলল,” আপনারে খালাম্মা ডাকে।”
অরা বিরক্ত হলো৷ ফুলবানু বেগমের ঘরে ঢুকলেই তিনি বকবকানি শুরু করবেন। অরার মাথা ধরে যাবে। কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই। তখন দেখা যাবে তিনি নিজেই উঠে চলে আসবেন। সেটা হবে আরও বিরক্তিকর ব্যাপার।
অরা চিন্তা করল, আজকে সে এমন কিছু বলবে যাতে তিনি আর কখনোই আশেপাশে না আসেন। অরা ফোন রেখে বাইরে এলো। ফুলবানুর ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি টিপ্পনী কেটে বললেন,” কিলো নবাবের বেটি, শুনলাম তোমারে নাকি জ্বীনে ধরছে? রান্দা করতে গিয়া নিজের শাড়িতে আগুন লাগায় দিছো? কি ভাবছো? এইসব রঙ- ঢঙ কি আমরা বুঝমু না?আমরা কি সংসার করি নাই?”
অরা কিঞ্চিৎ মনখারাপের স্বরে বলল,”ছোটবেলায় আমাকে একবার জ্বীন ধরেছিল। অনেক ঝাড়-ফুঁক করে সাড়াতে হয়েছিল। সেই জ্বীনটাই আবার ফিরে এসেছে নাকি বুঝতে পারছি না দাদী।”
ফুলবানুর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। ছোট ছোট চোখ মেলে কতক্ষণ অরার দিকে চেয়ে থেকে শুধালেন,” কি কও? তোমারে হাছাই জ্বীনে ধরছিল?”
” বাদ দিন দাদী। এসব অনেক ঘটনা। শুনলে ভয় পাবেন।”
” বুঝছি, তুমি আমারে ভয় দেখানোর চেষ্টা করতাছো। কিন্তু এসব জ্বীন-ভূতের আলাপ কইরা লাভ নাই। আমার নাম ফুলবানু। জ্বীন-ভূতের ভয় আমি করি না, উল্টা সব আমারে ভয় করে।”
অরা কাছে এসে বলল,” তাহলে তো আপনাকে বলতেই হবে।”
অরা ফুলবানুর হাত ধরার উদ্দেশ্যে বিছানায় বসতে নিলেই তিনি খেঁকিয়ে উঠলেন,” ওই মাইয়া, খবরদার।জ্বীন লয়া আমার কাছে আইবা না। এইখানে আমি নামায-কালাম পড়ি। তুমি এইখানে বসলে আমার বিছানা নাপাক হয়া যাইব।”
” জ্বীন তো অপবিত্র কিছু না। খুব পবিত্র জ্বীন। যখন আমাকে ধরে, তখন বেশি বেশি নামায পড়তে মন চায়। আর নামাজী ব্যক্তিদেরও সে খুব পছন্দ করে। আমার বড়মাও আপনার মতো পরহেজগার মানুষ ছিলেন। রাতে তিনি যখন ঘুমাতেন, জ্বীনটা তার পাশে শুয়ে থাকতো।”
” জ্বীন পাশে শুয়া থাকতো বুঝলা কেমনে? গল্প বানানের আর জায়গা পাও না? আমারে গুল মারো?”
” প্রথম প্রথম তো বুঝিনি দাদী। কিন্তু একদিন যখন গলা টিপে ধরল..”
ফুলবানু ধমক দিয়ে উঠলেন,” একদম চুপ। আর একটাও ফালতু কথা বলবা না।”
মুখে ধমক দিলেও তাঁর চেহারা ছাইবর্ণ ধারণ করেছে। চোখ দু’টো বড় হয়ে গেছে। অরা বলল,” কেন দাদী? ভয় পাচ্ছেন নাকি? ভয় পেলে থাক, আর বলব না।”
ফুলবানু আমতা-আমতা করে বললেন,” জ্বীন তোমার বড়মার গলা চাইপা ধরছিল ক্যান? সে কি করছিল?”
” কিছু করেনি। শুধু আমার আশেপাশে কাউকে সহ্য করতে পারতো না জ্বীনটা। আমি বড়মার খুব ন্যাওটা ছিলাম তো, তাই সবার আগে তাকেই মেরেছে। পানিতে চুবিয়ে।”
ফুলবানুর বুক ধড়ফড় করতে লাগল। কিন্তু সেটা তিনি বুঝতে না দিয়ে বললেন,” যতসব মিছা কথা।আমার ঘর থেকা এখনি বাইর হও। তুমি আর জীবনেও এই ঘরে আসবা না।”
” এভাবে বলবেন না দাদী। জ্বীন রেগে যাবে। সে কিন্তু এখানেই আছে। আপনার বিছানার কাছে!”
” ওই হা-রামজাদারে আমি ঝাঁটা দিয়া পিডামু।”
ফুলবানু রাগে ক্ষুব্ধ হয়ে তোষকের নিচ থেকে সত্যিই ঝাঁটা বের করলেন। তাই দেখে অরা দৌড়ে বের হয়ে এলো। বলা যায় না,যদি ঝাঁটার বারিটা তাকেই লাগিয়ে দেয়!
___________________
ডিনারের পর অরা তখন বই-পত্র গুছিয়ে নিচ্ছিল গেস্টরুমে যাওয়ার জন্য। সামির ঘরে এসে গম্ভীর মুখে বলল,” বসো একটু। দরকার আছে।”
অরা আতঙ্কিত হলো। সে সকালের ঘটনা আর মনে করতে চায় না। তাই সামিরকে এড়িয়ে চলতে চাইছে। মুখোমুখি হলেই তার কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।
সামির আলমারি থেকে কয়েকটা শপিং ব্যাগ বের করে বিছানায় ফেলল। অরা কৌতুহল নিয়ে তাকাল।
” খুলে দেখো।” সামির শান্ত গলায় বলল।
বিছানায় বসে ব্যাগগুলো খুলল অরা। একে একে অনেক গুলো কামিজ বের হলো। অরা অবাক হয়ে বলল,” এসব?”
” তোমার জন্য।”
“কি দরকার ছিল? আমার তো কামিজ আছে।”
“তাহলে শাড়ি পরে থাকো কেন সবসময়?”
” শাড়ি পরা কি খারাপ?” অরা আশ্চর্য হলো।
সামির বলল,” হ্যাঁ খারাপ। শাড়ি খুব বিপজ্জনক পোশাক। আজকে নাকি আঁচলে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিলে? তারপর একটা অঘটন ঘটলে? সকালেও তো পড়ে যেতে নিচ্ছিলে। এখন থেকে আর শাড়ি পরবে না তুমি।”
অরা হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,” ঠিকাছে, আর পরব না। এখন তাহলে আমি যাই।”
সামির বলল,” না, আজ আমি যাবো। তুমি এখানেই থাকো।”
” সত্যি?”
” হুম।”
” থ্যাঙ্কিউ।”
সামির কাঁথা আর বালিশ গুটিয়ে চলে যেতে লাগল। অরা বুঝতে পারছে না। হঠাৎ এতো ভালো কিভাবে হয়ে গেল সে? অরাকে আজ সারাদিন একদম বিরক্তও করেনি।
ড্রয়িংরুমের কাছাকাছি এসেই হঠাৎ অদ্ভুত শব্দ শুনল সামির। পেছনে ফিরতেই দেখল অরা দৌড়ে আসছে অনেকটা ঝড়ের গতিতে। আচমকা তীব্রভাবে সামিরের বুকের উপর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ল সে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সামির।
অরা সামিরের টি-শার্ট খামচে ধরল। চোখ-মুখ কুঁচকে বলতে লাগল,” টিকটিকি, এত্তোবড় একটা টিকটিকি দেখেছি ওই ঘরে। প্লিজ কিছু করুন”
সামিরের হতভম্ব দৃষ্টি তখন সামনে। লজ্জিত মুখে সে ঢোক গিলল। ড্রয়িংরুমের দরজার সামনে অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে আছেন নীলিমা আর সামিয়া। দু’জনের চেহারাতেই চাপা হাসি খেলছে।
অরা আর্তনাদ করে বলল,”আমি টিকটিকি খুব ভয় পাই..”
সামির অরাকে থামানোর জন্য সতর্কমূলক কাশি দিল। অরা মাথা তুলে পেছনে ঘুরতেই লজ্জায় আৎকে উঠল। তারপর প্রায় ছুটে ঘরে চলে গেল।
নীলিমা বললেন,” ঝগড়া করেছিস নাকি?”
সামিয়া বলল,”তাই তো মনে হচ্ছে। দেখো না, ভাইয়া কেমন কাঁথা, বালিশ গুটিয়ে অন্যরুমে চলে যাচ্ছে! এই দু’জনের সারাক্ষণ লেগেই থাকে।”
সামির চোখ বড় করে ধমক দিল,” সব বিষয়ে নাক গলাবি না। যা এখান থেকে। ”
সামিয়া ভেঙচি কাটল। সামির চোখ রাঙাল। মা সামনে থাকলেই সাহস বেড়ে যায় এই মেয়ের। নীলিমা বললেন,” এটা তো তোর বাবার অভ্যাস ছিল। একটু ঝগড়া হলেই বালিশ উঠিয়ে অন্যঘরে চলে যেতো। তুই কি তার এই বাজে স্বভাবটাই পেলি?”
অরা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এসব শুনে মুখ টিপে হাসছিল। সামির ঢুকতেই পিছিয়ে গেল সে। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল সামির। তারপর কঠিন গলায় বলল,” খুব মজা লাগছে তাই না?”
অরা জোর করে হাসি থামানোর চেষ্টা করল। কিন্তু দুষ্টমি করার লোভ সামলাতে পারল না। কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠে বলেই ফেলল,” আরও যান গেস্টরুমে। ”
সামির শীতল এবং রাগী কণ্ঠে বলল,” তোমার কমফোর্ট জোনের জন্যই তো যাই। কিন্তু এখন যে ধরা পড়ে গেলাম? আজ আমাদের এক ঘরে থাকতে হবে অরা।”
অরার মুখ চুপসে গেল। তাইতো, সে এটা ভাবেইনি। একঘরে তারা কিভাবে থাকবে?
সামির হাত ভাঁজ করে বলল,”তোমার ভুলের জন্যই এটা হয়েছে। এখন আমার কিছু করার নেই। আর দুই বছরের বাচ্চার মতো এতো ভয় পাওয়ার কি আছে টিকটিকি দেখে? কোথায় টিকটিকি, দেখাও।”
অরা নিশ্চুপ। সে আসলে কোনো টিকটিকি দেখেনি। এটা শুধু সামিরকে জড়িয়ে ধরার একটা বাহানা ছিল। এমনি তো লজ্জার কারণে জীবনেও জড়িয়ে ধরতে পারতো না। তাই ভয় পাওয়ার বাহানায় ধরেছে! বুদ্ধিটা রূপা দিয়েছিল। কিন্তু এভাবে নাটক করতে গিয়ে যে শাশুড়ী আর ননদের কাছে ধরা খেতে হবে তা কে জানতো?
সামির বলল,” যাইহোক, তুমি পড়তে চাইলে টেবিলে চলে যাও। আমি শুয়ে পড়ছি। সকালে আমাকে উঠতেও হবে। গুড নাইট।”
সামির বিছানা গোছাতে লাগল। অরা দাঁড়িয়ে রইল স্তম্ভের মতো। তার এখন অনেকটা নর্ভাস লাগছে। বিয়ের পর এই প্রথম তারা একই ঘরে, একই বিছানায় শুতে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ শব্দটা স্পষ্ট টের পাচ্ছে সে। আজ তার ঘুম আসবে না। একদমই না।
কিছুক্ষণ পড়ার পর অরা বুঝল, তার মাথায় কিছু ঢুকছে না। এভাবে পড়া হয় না। শুধু শুধু আলো জ্বেলে রেখে লাভ কি? সামিরের ঘুমের ডিস্টার্ব হচ্ছে। সে লাইট নিভিয়ে বারান্দায় চলে এলো। আচ্ছা, তার কি ভালো লাগছে সামির এই ঘরে শুয়েছে বলে? সামিরের পাশে গিয়ে কি শুতে ইচ্ছে করছে? নিজেকেই প্রশ্ন করল অরা। সে আসলে কি চায়?
হঠাৎ হাত থেকে আংটিটা খুলে পড়ে গেল। আজ সকালেই নীলিমা তাকে এই আংটি পরিয়ে দিয়েছিলেন। জিনিসটা হারিয়ে গেলে খুব লজ্জার ব্যাপার হবে। অরা নিচু হয়ে আংটি খুঁজতে শুরু করল। গড়িয়ে সেটা কোথায় গিয়ে ঠেঁকল কে জানে?
সামিরেরও ঘুম আসছে না। সে ফাঁকা বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে। একবার ভাবল নিজে উঠে গিয়ে অরাকে শুতে বলবে। তখনি টেবিলের কাছে কি যেন একটা ঝলমল করে উঠল। সামির কৌতুহলবশত বিছানা থেকে নেমে টেবিলের কাছে গেল। হাঁটু গেঁড়ে বসে জিনিসটি হাতে নিতেই বুঝল এটা একটা আংটি। এদিকে অরাও হামাগুড়ি দিয়ে আসছিল। দু’জনেই মাথায় টক্কর খেল হঠাৎ।
অরা আর্তনাদ করে উঠল,” আউচ, আপনি এখানে কি করছেন?”
” তার আগে বলো তুমি এভাবে ফ্লোরে গড়াগড়ি করছো কেন?”
” আমি আমার আংটি হারিয়ে ফেলেছি। সেটা খুঁজছি।”
সামির ইচ্ছে করেই আংটি লুকিয়ে ফেলে বলল,” লাইট জ্বালিয়ে খুঁজলেই হয়।”
” আপনার ঘুমের ডিস্টার্ব হবে ভেবেই তো লাইট জ্বালাইনি।”
” আমার ঘুম নিয়ে এতো চিন্তা কেন তোমার?”
” কারণ আমি আপনার মতো না। মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা চিন্তা করি সবসময়। আপনার মতো অত্যাচার করি না কাউকে।”
” আমি অত্যাচার করি?”
” অবশ্যই করেন। আজকে সকালে কি কি করেছেন আমি ভুলিনি।”
” চ্যালেঞ্জটা তুমিই নিয়েছিলে। তাছাড়া একটু আগে কি করেছো সেটাও আমি ভুলিনি। ”
” মানে? কি করেছি আমি?” অরা বিস্মিত হলো।
সামির বলল,”ভয় পাওয়ার এক্সকিউজ দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছো। কি ভেবেছো আমি বুঝব না?”
অরার মুখ অপমানে লাল হয়ে উঠল। যদিও সেটা দেখা গেল না। আবছা অন্ধকারে তারা কেবল একে-অন্যের অবয়ব দেখতে পাচ্ছে। অরা রেগে বলল,” আর আপনি নিজে কি করেছেন? আজকে সকালেও আমাকে জোর করে কিস করেছেন।”
সামির চোয়াল শক্ত করে বলল, “আমি জোর করে কিস করেছি?”
অরা নিভল না। স্পষ্ট গলায় বলল,” হ্যাঁ। আপনার মতো সুযোগসন্ধানী মানুষ লাইফে অনেক দেখেছি। কিন্তু নিজের বরও যে এমন হবে ভাবিনি।”
সামিরের কান গরম হচ্ছে। অরার হাত টেনে তাকে কাছে আনল। শক্ত করে তার পিঠের সাথে চেপে ধরল হাতটা। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল অরা। পেছনে টেবিলের খাঁজের সাথে খোঁচা লেগে হাত কে-টে গেছে। র-ক্ত বের হচ্ছে। সামির তাকে ওভাবে রেখেই উঠে বের হয়ে গেল ঘর থেকে।
অরা নিজের আহত হাতের দিকে তাকাল। হঠাৎই দৃষ্টি অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠল তার। ফিসফিস করে বলল,” পিশাচ!”
সামির একটু পরেই আবার ফিরে এলো। তার হাতে ফার্স্ট এইড বক্স। তাই দেখে অরা জেদ ধরে বলল,” দূরে সরুন। আমার কাছে আসবেন না৷ আমাকে ধরবেন না।”
সামির জোর করে হাত ধরে বলল,” কথা না শুনলে আবার কিস করব কিন্তু।”
অরা চোখ বড় করে তাকাল। অন্ধকারেও অনুভব করতে পারল সামিরের ঠোঁটে হাসি। কি বীভৎস, কি জঘন্য, কি নিকৃষ্ট এই লোক! অরা কিছুক্ষণ একভাবে চেয়ে থেকে সবচেয়ে সাহসী কাজটি করল। নিজেই সামিরকে কিস করে ফেলল।
চলবে