রুপালি মেঘের খামে পর্ব-১৬

0
638

#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz

১৬.
দিন দিন সামিরের অত্যাচার বাড়াবাড়ির মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এখনি কিছু না করলে সত্যিই দেখা যাবে অরা চ্যালেঞ্জে হেরে গেছে। সামির যেভাবে হাত ধুঁয়ে পেছনে লেগেছে…. এভাবে চললে তো ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু অরা কখনও এতো সহজে হার মানার পাত্রী নয়।

সে তার বড়বোনকে ফোন করার সিদ্ধান্ত নিল। অরার বড়বোনের নাম ইশিতা ইসলাম তারা। ছয়বছর আগে তারার বিয়ে হয়েছিল। সে এখন হাসব্যান্ডের সাথে ডেনমার্ক থাকে। অরার মতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমতী মহিলা হলো তার তারু আপা। সে নিশ্চয়ই অরাকে ভালো কিছু পরামর্শ দিতে পারবে এই বিষয়ে। তার কাছে সব সমস্যার সমাধান থাকে।

কিন্তু অরা রূপাকে যেভাবে নিঃসংকোচে সব বলতে পারে, বড় আপাকে তো আর সেভাবে বলতে পারবে না। তার সাথে কথা বলতে হবে হিসেব করে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে তারাকে ফোন করেই ফেলল অরা।

” অরা, কেমন আছিস বোন আমার? এতোদিন পর আপার কথা মনে হলো?”

” তোমার উপর আমি রেগে আছি আপা। আমার বিয়ের পর একবারও দেশে আসোনি।”

” আহারে, রাগ করিস না সোনা বোন। বললেই কি আর আসা যায়? তোর দুলাভাই ছুটি ম্যানেজ করতে পারছে না। আর বাবাও তোর বিয়েটা কত তাড়াহুড়ো করে দিল। যাইহোক, শ্বশুরবাড়িতে দিন কেমন কা-টছে তাই বল।”

” দিন তো ভালোই কা-টছে। আমার শাশুড়ী মা অনেক ভালো জানো? কাজ না করলেও আমাকে কথা শোনায় না। যদিও এই বাড়িতে কাজের লোক আছে। তবুও আমাকে কখনও চা পর্যন্ত বানাতে বলেনি।”

” বাহ, বেশ ভালো শাশুড়ী পেয়েছিস তো। আর তোর হাসব্যান্ড? সে কেমন? তোকে সাপোর্ট করে?”

অরা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল এবার। বেশ নাটকীয় কণ্ঠে বলল,” দুঃখের কথা তোমাকে আর কিভাবে বলি আপা? হাজব্যান্ড জুটেছে একটা হাড়বজ্জাত। আমার শ্বশুর-শাশুড়ী যত ভালো, ওই বেটা তত বদমাইশ।”

” বলিস কি? কি করেছে?”

” আমি এখানকার একটা ভালো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু সে চ্যালেঞ্জ নিয়েছে আমাকে জীবনেও পড়াশুনা করতে দিবে না।সকাল-বিকাল আমাকে বিরক্ত করছে।

আমি যেন পড়তে না পারি সেজন্য পারলে বই লুকিয়ে রাখে৷ রাতে পড়তে নিলে আমাকে অন্যরুমে পাঠায়। তার রুমে পড়া যাবে না৷ সে লাইট নিভিয়ে ঘুমাবে। কারণ তাকে সকালে উঠতে হয়।

আমি গেস্টরুমে পড়ার জন্য গেলে সেখানেও গিয়ে লাইট ফিউজ করে দেয়।”

” বলিস কি? এতো খাটাশ?”

” হ্যাঁ। দিনে পড়তে নিলে দাদী শাশুড়ীকে আমার কাছে পাঠাবে। তিনি পাশে বসে এমন সব আবোল-তাবোল বকতে থাকেন যে পড়াই হয় না। আগে কিন্তু উনি আমার ঘরে আসতেন না৷ আর এখন সারাক্ষণ আমার কাছে এসেই বসে থাকেন।

আমি জানি এসব উনিই শিখিয়ে দিয়েছেন দাদীকে। আর দাদীটাও খুব অপছন্দ করে আমাকে প্রথম থেকেই। জানি না কেন! তাছাড়া উনি বাড়ি ফিরলে তো আমি বইও ছুঁতে পারি না। কথায় কথায় অর্ডার করবে। যেন সে নবাবজাদা এসেছে৷ তাকে পনেরো মিনিট পরপর কফি বানিয়ে দিতে হবে। মাথায় ম্যাসাজ করতে হবে। আর এসব না করলে উনি শাশুড়ীর কাছে আমার নামে বিচার দিবে বলে ভয় দেখায়।”

” কি নিয়ে বিচার দিবে? তুই কি করেছিস?”

অরা এবার থেমে গেল। বাসর রাতের চড় মা-রার ঘটনা তো আর আপাকে বলা যাবে না। সে আমতা-আমতা করে বলল,” কিছু কি করতে হবে? সে বানিয়ে বললেও যদি শাশুড়ী বিশ্বাস করে ফেলে? আমি আম্মুর চোখে কালার হতে চাই না।”

” তোর শাশুড়ী আম্মু না খুব ভালো? তাহলে কেন বিশ্বাস করবে তার ইবলিশ ছেলের কথা? তুই একদম ভয় পাবি না, অরা। সে তোকে থ্রেট করছে তো, তুইও থ্রেট করবি।”

” আমি কিভাবে থ্রেট করব?”

” তার কোনো উইকপয়েন্ট কি তোর জানা নেই?”

অরা হতাশ কণ্ঠে বলল, “নেই তো।”

তারা বলল,” খুঁজে বের করার চেষ্টা কর। আমি তো জানতাম বিয়ের দুই-তিনমাসে হাসব্যান্ডের আসল রূপ বোঝা যায় না। প্রথম প্রথম ছেলেরা ভং ধরে থাকে। যেন সাক্ষাৎ ফেরেশতা। কয়েকটা মাস গেলে বোঝা যায়, সবই এক জাতের। কিন্তু তোর বর দেখি প্রথম থেকেই আসল রূপ দেখানো শুরু করেছে। সামান্য ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া নিয়েই এতো দুশমনি?”

” হ্যাঁ আপা। আসলে ওই ভার্সিটির লেকচারার সে। আমাকে এডমিশনের ব্যাপারে হেল্প করতে চেয়েছিল। আমি রিজেক্ট করার পর থেকেই দুশমনি দেখানো শুরু করেছে।”

তারা অবাক হয়ে বলল,” রিজেক্ট কেন করতে গেলি? হেল্প নিলে তো তোরই ভালো হতো।”

” আমি চাই না কারো হেল্প নিয়ে কিছু করতে। নিজের চেষ্টাতে সব করব।”

” ওহ, বুঝেছি এইবার। মেয়েদের এই চিন্তাটাই পুরুষজাত সবচেয়ে অপছন্দ করে। তাদের মেইল ইগো হার্ট হয় কি-না! তোর হাজব্যান্ড আসলে তোকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট হতে দিতে চায় না৷ সবসময় তার উপর ডিপেন্ডেট থাকবি এটাই তার চাওয়া।”

” ঠিক বলেছো আপা। পরীক্ষার সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। এদিকে আমার কিচ্ছু পড়া হয়নি। মাথা কাজ করছে না। এই ইবলিশকে কিভাবে শায়েস্তা করা যায় বলোতো? ”

অরার কথার মাঝেই সামির ভেতরে ঢুকল। ভয়ে অরা সাথে সাথে ফোন কেটে দিল। সামির কপালে ভাঁজ ফেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অরা হাসার ভাণ ধরে প্রশ্ন করল,” আপনি আজকে এতো দ্রুত চলে এলেন?”

সামির অবজ্ঞার স্বরে বলল,” ছুটি নিয়েছি। তোমার কোনো প্রবলেম?”

” না। আমার আবার কি প্রবলেম হবে?”

মুখে এই কথা বললেও মনে মনে বলল,” ছুটি কেন নিয়েছেন তা মনে হয় আমি জানি না৷ দ্রুত বাড়ি এসে আমাকে টর্চার করার জন্য।”

” আচ্ছা, ফোনে ইবলিশের নামে কি যেন বলছিলে… সেই ইবলিশটা কি আমি?”

অরা বইয়ের দিকে চেয়ে থেকে উত্তর দিল,” বাহ, নিজেই নিজেকে চিনে ফেলেছেন। ভেরি গুড।”

কথাটা বলে বই থেকে চোখ তুলে সামনে তাকাতেই চমকে উঠল অরা। সামির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ভ্রু উঁচু করে বলল,” ইবলিশ কাকে বলে সেটা তুমি এখনও জানো না। তবে খুব দ্রুত জানবে।”

এই কথা বলেই অরার হাত থেকে বইটা ছিনিয়ে নিল সে। অরা আর্তনাদ করে বলল,” প্লিজ আমার বই দিন। আপনি কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছেন। আমাকে একদম পড়তে দিচ্ছেন না৷ এমন হলে কিন্তু আমি চট্টগ্রাম চলে যাবো।”

” যাও, কে নিষেধ করেছে? আমিও আম্মুকে সেদিনের ঘটনা বলবো। তাছাড়া তোমার তো আরও একটা অপরাধ আছে। যেটা এখনও কেউ জানে না।”

” মানে? আবার কোন অপরাধ?”

” তুমি দাদীকে কি বলেছো?”

অরার কণ্ঠ শুকিয়ে এলো। হালকা ঢোক গিলে বলল,” আমি আবার দাদীকে কি বলব?”

” সুযোগ পেলেই নাকি দাদীকে তুমি ভয় দেখাও? ”

অরা বিহ্বল কণ্ঠে বলল,” আপনাকে কে বলল?”

” কে বলল সেটা বড় কথা না। কিন্তু তুমি দাদীর সাথে এমন করছো কেন? বয়স্ক মানুষ উনি। এভাবে প্রেশার দিলে যদি কিছু হয়ে যায়? যদি হার্ট এটাক করে?”

অরা প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,”প্লিজ, বাবা আর আম্মুকে এসব বলবেন না। উনারা এই কথা জানলে আমাকে কি ভাববে? আসলে দাদী আমার নামে এতো আজে-বাজে কথা বলে যে আমিও রাগ করে দুয়েকটা উল্টা-পাল্টা বলে দেই। স্যরি, এখন থেকে আর বলব না।”

অরা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। সে ফুলবানুকে একা পেলে হুমকি-ধামকি দেয়, এটা সত্যি। ফুলবানুর কথা কেউ বিশ্বাস করে না বলে অরার ভয় ছিল না এতোদিন। কিন্তু সামির তো বুঝে ফেলেছে! কিভাবে বুঝল?

সামির তার স্টাডি টেবিলের চেয়ারে বসে অরার বইগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলল,” ঠিকাছে, বলব না। কিন্তু সেজন্য আমার কথা শুনতে হবে।”

” যা বলছেন তাইতো শুনছি। আর কি চান?”

” কোনো রকম অফেন্স ছাড়া শুনতে হবে। এখন যাও। এক কাপ আদা চা বানিয়ে আনো। তোমার সাথে বকবক করে মাথা ব্যথা করছে।”

অরা বাধ্যের মতো বলল,”এখনি যাচ্ছি।”

মনে মনে সামিরকে একশোটা গালি দিয়ে সে রান্নাঘরে ঢুকল। তার কিছুই ভালো লাগছে না। এভাবে চললে সে অবশ্যই চ্যালেঞ্জে হারবে। একটু পর চা নিয়ে ঘরে এসেই হতভম্ব হয়ে গেল অরা। সম্পূর্ণ ঘর পরিপাটিভাবে গুছানো। বই-খাতা কিছুই নেই। সব যেন গায়েব হয়ে গেছে। অরা চিৎকার দিয়ে বলল,” আমার বই?”

সামির গোসলে ঢুকেছে তখন৷ অরা দরজায় নক করতে লাগল। ভেতর থেকে বিরক্ত গলায় আওয়াজ এলো,” প্রবলেম কি?”

“আমার বই কোথায় রেখেছেন আপনি? এটা কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে। ভালোয় ভালোয় আমার বই ফিরিয়ে দিন। নাহলে খুব খারাপ হবে।”

” তোমার বই সুরক্ষিত আছে। সময়মতো পেয়ে যাবে। এখন বলো, চা এনেছো?”

” এনেছি। এখন কি করব? বালতিতে ঢেলে দিবো? চা দিয়ে গোসল করবেন?”

অরার রসিকতাকে খুব সহজে অগ্রাহ্য করে সামির বলল,” হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো।”

” মানে? কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব এভাবে?”

” যতক্ষণ আমি বের না হচ্ছি ততক্ষণ। ”

“চা ঠান্ডা হয়ে গেলে?”

” আবার গরম করে আনবে।”

রাগে অরার শরীর কাঁপছে এবার। কিড়মিড় করে বলল,” বদমাইশ, তোর বউ বাসরের আগেই ডায়রিয়ায় মরবে দেখিস।”

এই কথা বলেই অরা তওবা করল। সে নিজেই তো সামিরের বউ। আর তাদের এখনও বাসর হয়নি! সর্বনাশ!
_________________
সকাল সকাল সামিরের ফোন পেয়ে তন্বি প্রফুল্লিত। তার হারিয়ে যাওয়া আইডি কার্ড আর স্বর্ণের দুল খুঁজে পাওয়া গেছে অবশেষে। এগুলো ফিরিয়ে দিতেই সে ফোন করেছিল। তন্বি তাকে বাড়ি আসতে বলেছে। সামির চেয়েছিল ভার্সিটিতে দেখা হলেই ফেরত দিবে। কিন্তু তন্বি বলল,” প্লিজ স্যার, আই ইনসিস্ট। কানের দুলটা আমার আর্জেন্ট লাগবে।”

সামির বলল,” ওকে। তুমি আজকেই পেয়ে যাবে।”

তন্বি সাধারণত ভার্সিটিতে না গেলে খুব বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। বারোটায় ফ্রেন্ডদের নিয়ে হ্যাংআউটে যায়। তার বিভিন্ন পরিকল্পনা থাকে। কিন্তু আজ সব ক্যান্সেল। সে সকাল সকাল গোসলে ঢুকল।

ঠিক সাড়ে এগারোটায় একজন মেইড এসে দরজায় নক করে বলল,” ম্যাম, আপনার একজন গেস্ট এসেছেন। নিচে অপেক্ষা করছেন।”

তন্বি বাথরোব জড়িয়ে মাত্র বের হয়েছে গোসল সেড়ে। এতো দ্রুত সামির চলে আসবে সে চিন্তাও করেনি। নতুন শাড়ি, মেকাপ, সব বের করা আছে। তৈরী হতে ত্রিশমিনিটের মতো সময় লাগবে। নর্ভাসনেসে তন্বির গলা কাঁপছে। সে কোনমতে বলল,” উনাকে গেস্টরুমে নিয়ে বসাও। আর চকলেট পেস্ট্রি অর্ডার করেছিলাম যে, এসেছে?”

” এসেছে ম্যাম।”

” উনাকে সার্ভ করো। আর বলো কিছুক্ষণ ওয়েট করতে। আর পাপাকে ইনফর্ম করেছো?”

” স্যার তো অফিসে ম্যাম।”

“আচ্ছা, আমি ফোন করছি। তুমি গেস্টের খেয়াল রাখো। উনার যাতে কোনো অসুবিধা না হয়।”

” জ্বী ম্যাম।”

তন্বি সেলিম সাহেবকে ফোন করল। তিনি জরুরী মিটিংয়ে থাকা অবস্থায় ফোন কেটে দিচ্ছেন। তন্বি তবুও বার-বার ফোন করে যাচ্ছে। সেলিম সাহেব বাধ্য হয়ে ফোন ধরে বললেন,” মিটিংয়ে আছি মা। একঘণ্টা পরে কথা বলি?”

” না পাপা, তোমাকে দশমিনিটের মধ্যে বাড়ি আসতে হবে। মিটিংয়ের থেকেও আর্জেন্ট ম্যাটার। ”

” কি হয়েছে?”

“তোমাকে বলেছিলাম না, একজনের সাথে মিট করাব? উনি চলে এসেছেন। আমাদের গেস্টরুমে অপেক্ষা করছেন।”

সেলিম সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন,” তোর ফাইজান স্যারের কথা বলছিস?”

তন্বি লাজুক কণ্ঠে বলল,” হ্যাঁ।উনিই।”

” এভাবে না জানিয়ে হঠাৎ আসার কারণ কি? আমাকে আগে জানালে আমি প্রিপারেশন নিয়ে রাখতাম।”

” উফ পাপা, এখন তো জানিয়েছি। প্লিজ দ্রুত আসো। প্লিজ, প্লিজ!”

” আচ্ছা দেখছি।”

সেলিম ফোন রেখে সাথে সাথেই মিটিং পোস্টপন্ড করলেন।
_________________
সামির গোসল শেষ করে চা খেল। অরা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছে কখন বইগুলো ফেরত পাবে!

একটু পর সামির বলল,” তুমি এখন যেতে পারো।”

” বই ছাড়া আমি কিভাবে যাব? দয়া করে আমার বইগুলো ফিরিয়ে দিন। প্লিজ!”

” কানে ধরে উঠ-বস করো৷ দিচ্ছি।”

” মানে? কানে কেন ধরবো? আমি কি করেছি?”

সামির চোখ বড় করে তাকাতেই দ্রুত কানে ধরল অরা। উঠ-বস করতে লাগল অনবরত। সে বুঝতে পারছে না এগুলো কিসের শাস্তি! দাদীকে হুমকি দেওয়ার জন্য নাকি বাসর রাতে চড় মারার জন্য? সাহায্যের প্রস্তাব নাকচ করার জন্য নাকি একটু আগে ‘ইবলিশ’ বলার জন্য?

মাত্র পাঁচমিনিট ধরে উঠ-বস করেই হাঁপিয়ে উঠল অরা। ক্লান্ত গলায় বলল,” এবার হয়েছে? আর পারছি না।”

” তোমার বই সানসেটের উপরে আছে… নিয়ে বিদায় হও।”

অরা উপরে তাকিয়ে দেখল সানসেটে সুন্দর করে বইগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজানো। বিপর্যস্ত কণ্ঠে বলল,” আমি ওখান থেকে কিভাবে বই নিবো? আপনার মতো কি আমি তালগাছ?”

” সেটা তোমার প্রবলেম। আমি কি জানি?”

অরা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ডাইনিং রুমে গেল। সেখান থেকে চেয়ার আনল। তারপর আনল একটা টুল। খাটের উপর চেয়ার রেখে, চেয়ারের উপর টুল রেখে বই পাড়তে উঠল। সে ভাঙবে তাও মচকাবে না। এই অহংকারী লোকের অহংকার ধুঁলোয় মিশিয়ে ছাড়বে।

সামির আঁড়চোখে দেখছিল। যেকোনো সময় অরা পড়ে যেতে পারে ভেবে সে উঠে এলো। হঠাৎ বলল,” দেখি, নামো। আমি এনে দিচ্ছি।”

অরা কঠিন গলায় বলল,” লাগবে না। আমি নিজেই পারি।”

সামিরও কিছু বলল না। মেয়েটা অসম্ভব জেদী৷ তবে সে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রইল। যেন অরা পড়ে যেতে নিলেও তাকে ধরে ফেলতে পারে।

ভারী বইগুলো নামাতে গিয়ে অরার ঘাম ছুটে যাচ্ছে। একটা করে বই তুলে সে বিছানায় ছুঁড়ে মারছে৷ কারণ সব একসাথে নামানো সম্ভব না। হঠাৎ খেয়াল করল সামির তার উন্মুক্ত পেটের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে। লজ্জায় অরার শরীর স্তিমিত হয়ে গেল। সহসা পিছলে গেল পা। তবে সে পড়ার আগেই সামির সবল দুইহাতে আগলে ধরল তাকে।

অরা হাঁফ ধরা কণ্ঠে বলল,” থ্যাংকস। আপনি না ধরলে পড়েই যেতাম।”

সামির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অরার মুখ লজ্জায় লাল হচ্ছে ক্রমশ। ওই লাজে রাঙা মুখটির দিকে চেয়ে সামির হঠাৎই খুব বন্য হয়ে উঠল। এক নিমেষে ভেঙে গেল সব প্রতিজ্ঞা। অরা চোখ বুজে ফেলল। সামির প্রগাঢ় স্পর্শে চুমু দিতে লাগল তার ঠোঁটে। অরার শরীর শক্ত হয়ে আসছে, সামিরের আমর্শ প্রচন্ড উত্তপ্ত। এমন মুহূর্তে ফোন বেজে উঠল তীব্র শব্দে। দু’জনেই চমকে উঠল।

সামির অরাকে নিচে নামিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেল। অরা বিছানায় বসে লম্বা শ্বাস নিতে লাগল। কেমন দিশেহারা বোধ হচ্ছে তার।

ঘরের বাইরে এসে সামির মোবাইল হাতে নিল। আজকে তার তন্বিদের বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না বলে সে তার ডিপার্টমেন্টের দফতরি মাহমুদকে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন সে-ই ফোন করছে। সামির বলল,” হ্যাঁ মাহমুদ, বলো। কাজ হয়েছে?”

মাহমুদ অসহায় স্বরে বলল,”এটা আমাকে কোথায় পাঠালেন স্যার? এরা তো জামাই আদর শুরু করেছে।কিছুতেই বের হতে দিচ্ছে না। দুপুরে নাকি লাঞ্চ না করে আমি যেতে পারব না। একের পর এক খাবার দিচ্ছে। তন্বি আপার বাবা নাকি আমার সঙ্গে দেখা করবেন। তিনি তার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছেড়ে আসছেন। স্যার, আমি কি কোনো অপরাধ করেছি? আমাকে কি শাস্তি দেওয়া হবে?”

সামির একটু বিস্মিত হয়ে বলল,” কি জানি? বড়লোক মানুষের বড় বড় ব্যাপার। ওরা হয়তো অতিথি আপ্যায়ন এভাবেই করে। তোমার সমস্যা কি? হসপিটালিটি ইঞ্জয় করো।”

” কিন্তু আমার তো ভয় লাগছে স্যার।”

“ভয়ের কিছু নেই। কোনো প্রবলেম হলে আমাকে জানিও৷ আমি আছি তো।”

” ওকে স্যার।”

” ওকে।”

ফোন রেখে ঘরে ঢুকল সামির। অরা আবার উপরে উঠতে নিচ্ছিল বাকি বই নামানোর জন্য। সামির তার হাত ধরে নিচু গলায় বলল,” আমি নামিয়ে দিচ্ছি। বসো তুমি।”

অরা আড়ষ্ট হয়ে বসল। সামির উপরে উঠে বাকি বইগুলো নামিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু অরা একটু আগের ব্যাপারটা ভুলতে পারছে না। শুধু আজে-বাজে কল্পনা মাথায় আসছে। উফ!

জমকালো সাজ দিয়ে বের হয়েছে তন্বি। তাকে দেখতে বিউটি কন্টেস্টের মডেলের মতো লাগছে। গেস্টরুমে ঢুকে মাহমুদকে বসে থাকতে দেখে সে খানিক বিস্মিত হলো। কৌতুহলপূর্ণ কণ্ঠে শুধাল,” মাহমুদ ভাই, আপনি?”

” জ্বী আপা। আমি।”

” স্যার কোথায়?”

” উনি তো আসেননি। আমাকে পাঠিয়েছেন৷ এই আপনার আইডি কার্ড আর কানের দুল।”

কি হলো মাহমুদ কিছু বুঝল না। তন্বি হঠাৎ তার হাত থেকে জিনিসগুলো নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর কঠিন স্বরে বলল,” গেট আউট।”

মাহমুদ হকচকিয়ে গেল। এতোক্ষণ এতো আদর-যত্নের পর হঠাৎ এমন অপমান হজম হলো না। সে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। তন্বি চেঁচিয়ে উঠল,” দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আই স্যায় গেট আউট!”

মাহমুদ ত্বরিতে বের হয়ে গেল। তন্বি এক দৌড়ে তার বেডরুমে এসে দরজা বন্ধ করল। বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল। আশ্চর্য, এই সামান্য বিষয়ে এতো কান্না পাওয়ার কি আছে? সে কি পাগল হয়ে গেছে?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে