#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz
১৫.
অরার এতোটাই মন খারাপ হলো যে রাতে ভাতও খেতে ইচ্ছে করল না। ছাদে গিয়ে চুপচাপ বসে রইল। অন্ধকার, গা হিম করা ঠান্ডা বাতাস সেখানে। পটপট করে উড়ছে শাড়ির আঁচলটা। খোলা চুল মুখে আছড়ে পড়ছে। চমৎকার অনুভূতি হওয়ার কথা। কিন্তু অরার কিছুই চমৎকার লাগছে না। তার মনটা বিশাল আকাশের মতোই কালো মেঘের আস্তরণে ঢেকে আছে।
প্রায় আধঘণ্টা পর ছাদে উঠে এলো সামির। তাকে খুব স্নিগ্ধ লাগছিল। মাথার চুল হালকা ভেজা। নিশ্চয়ই গোসল সেড়েছে। কালো রঙের টি-শার্টে তাকে এতো সুন্দর কেন লাগছে? উফ, অরা তো হাঁ করে চেয়ে থাকতে থাকতে ম-রেই যাবে। জোর করে একটা ঢোক গিলে নিয়ে প্রশ্ন করল,” আপনি এখানে কেন?”
সামির অবজ্ঞাসূচক বাক্যে জবাব দিল,” এমনিই এসেছি। ছাদে আসতেই পারি।”
এই কথা বলতে বলতেই ঠিক অরার পাশে এসে বসল সে। ভুরভুর করে বয়েজ শ্যাম্পুর সুঘ্রাণ নাকে ধাক্কা খেল। অরা এলোমেলো হয়ে পড়ল মুহূর্তেই। নিজেকে ধাতস্থ করে কাঁপা কণ্ঠে বলল,” তাহলে আমার পাশেই কেন বসেছেন?”
“আমার এখানে বসতে ইচ্ছে হয়েছে তাই বসেছি। এখন এটা যদি তোমার পাশ হয় তাহলে আমার কি করার?”
অরা কি বলবে বুঝতে পারল না। মুখ ভার করে বসে রইল চুপচাপ। সামির বলল,” রাতের বেলা ছাদে কি করছো? তোমার না নিক্টোফোবিয়া আছে? অন্ধকারে ভয় লাগে না?”
” না।”
এমন সময় ফোন বেজে উঠল সামিরের। অরার মেজাজটাই বিগড়ে গেল। এতো রাতে তাকে ফোন কে দিচ্ছে? অরার মনে আছে, গতরাতেও ঠিক এই সময় ফোনটা এসেছিল।
সামির ঠিক কালকের মতোই ফোন রিসিভ করে অন্যপাশে চলে গেল। ব্যাপারটা মোটেও সুবিধার লাগল না। আচ্ছা, এটা কি ওই তন্বি নামক চুন্নির ফোন?ব্যাপারটা মনে আসতেই তীব্র ঈর্ষাময় একটা অনুভূতি মস্তিষ্কে আঁচড় কা-টতে লাগল। সেই আঁচড়ের গভীরতা পৌঁছে গেল হৃদয় পর্যন্ত।
সামির যখন ফোনে কথা বলা শেষ করে আবার অরার পাশে এসে বসেছে তখন অরার চোখের কোল জলে টইটম্বুর। সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে আছে যাতে সামির দেখতে না পায়। ঠিক আগের দিনের মতো করেই সামির লম্বা শ্বাস টেনে বলল,” এখানেই কি বসে থাকবে? ঘরে যাবে না?”
অরা তার অভিমানী কণ্ঠ ছুঁড়ে প্রশ্ন করল,” কার ফোন ছিল?”
সামির একটু অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, অরার কণ্ঠটা অধিকারপূর্ণ, হালকা শাসনের সুর, মৃদু অভিমানে সিক্ত। সে নিজের মনেই হাসল। অরাকে বিস্মিত করে দিয়ে বলল,” নিজেই দেখে নাও।”
অরা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। আশ্চর্য হয়ে দেখল, সামির তার ফোনটা অরার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। অরা একবার ফোনের দিকে চেয়ে আবার সামিরের দিকে চাইল।
সামিরের ঠোঁটে প্রশ্রয়ের ছাপ। চোখের ইশারায় ফোনটি নিতে বলল। অরা নিঃসংকোচে সামিরের মোবাইল হাতে নিল। তীব্র অধিকারবোধ নিয়ে একে একে চেক করল তার কললিস্ট, ম্যাসেজলিস্ট, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, সবকিছু। সামির কেবল চুপচাপ বসেছিল। সহাস্যে দেখছিল অরার কান্ড। ঠোঁটে লেগেছিল চাপা হাসি।
না, অরা সন্দেহ করার মতো কিছুই পেল না। বরং কিছুক্ষণ আগে নিজের মনে জেঁকে ওঠা অহেতুক ভয়ের জন্য নিজেই লজ্জিত হলো। সামির অরার দিকে হালকা ঝুঁকে এসে তরল গলায় জানতে চাইল,” দেখা হয়েছে?”
অরা মাথা নিচু করে ফোনটা ফিরিয়ে দিল। সামিরের চোখে চোখ রাখতে পারল না। তার প্রশ্নটায় কি কিছু মেশানো ছিল? অরার শরীর কাঁপছে কেন?অন্যদিকে চেয়ে ঘাড় নাড়ল অরা। অর্থাৎ তার দেখা হয়ে গেছে।
সামির বলল,” এবার তাহলে নিচে চলো। তুমি খাওনি বলে আম্মু ডিনার নিয়ে ওয়েট করছে।”
সামির যাওয়ার জন্য সামনে এগোতে নিলেই অরা নিস্পন্দ কণ্ঠে বলে উঠল,” যদি না যাই, তাহলে কি কালকের মতো আজকেও কোলে উঠিয়ে নিয়ে যাবেন?”
সামির তাকাল। অরা লজ্জায় জুবুথুবু। তার অবস্থা দেখে না হেসে পারল না সামির। কিন্তু অরা দেখার আগেই সেই হাসিটা টুপ করে গিলে নিয়ে নরম কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” তুমি তাহলে এটাই চাও?”
অরা কথা বলতে পারল না। লজ্জায় শরীর শিরশির করছিল। সামির সত্যি সত্যি কাছে এসে তাকে কোলে নিল। অরার গা কাটা দিয়ে উঠল। মুহূর্তেই যেন প্রবল বেগে বিদ্যুৎ বয়ে গেল শিরদাঁড়ায়। সে চোখ খুলল না।
বিড়ালছানার মতো গুটিশুটি মে-রে সামিরের বুকে মুখ লুকিয়ে রাখল। পায়ের পাতা কাঁপছে তিরতির করে। তার চারপাশ ভরে আছে অদ্ভুত সুন্দর একটা সুগন্ধে। যে সুগন্ধ শুনলেই অরার লজ্জা লাগে।
সামির এক পা করে যত সিঁড়ি ভাঙছিল ততই তার বুকের কাঁপন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বামপাশের আওয়াজটা কি তীব্র! অরা কি শুনতে পাচ্ছে সেই ঢিপঢিপ? প্রত্যেকটি স্পন্দন কেবল তারই নাম নিচ্ছে। এটা কি সে জানবে? সামির অরার গায়ের মিষ্টি গন্ধের মাদকময় স্পর্শে নিজেকে হারাতে বসেছিল। দু’জনের জন্যই মুহূর্তটা ঐশ্বরিক, স্বর্গীয়। আচমকা তাদের ঘোর ভাঙল একটি কর্কশ কণ্ঠের শব্দে,” বউ মা কি অসুস্থ?”
অরা এবং সামির দু’জনেই ঘাবড়ানো দৃষ্টিতে তাকালো। বাড়িওয়ালা আঙ্কেল সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। মুখভর্তি স্পষ্ট কৌতুকময় হাসি। বৌভাতের অনুষ্ঠানে ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয়েছিল অরার। লজ্জায় চেহারা চুপসে গেল। সামির ইতস্তত হয়ে বলল,” হ্যাঁ আঙ্কেল। ওর পায়ে একটু ব্যথা। হাঁটতেই পারছে না।”
” আহারে, সাবধানে নিয়ে যাও। খেয়াল রেখো পড়ে না যেন।”
সামির অরার দিকে কেমন অন্যরকম দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,” রাখব।”
অরার গা শিরশিরে অনুভূতিটা প্রখর হয়ে ফিরে এলো আবার। আজকেও ড্রয়িংরুমে কেউ নেই। কিন্তু ডাইনিং রুমে সবার ভীর। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হয়েছে। নীলিমা ব্যস্ত গলায় সামিয়াকে আদেশ দিচ্ছেন যাতে অরা-সামিরকে ছাদ থেকে ডেকে আনা হয়।
সামির ডাইনিং রুম সাবধানে ক্রস করেই অরাকে নিয়ে বেডরুমে চলে এলো। তাকে বিছানায় বসিয়ে উঠতে নিলেই ঘটল বিপত্তি। অরার চুল আটকে গেছে সামিরের বোতামের সাথে। কাজটা অরাই করেছে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়। সামির নিশ্চয়ই টের পায়নি। সে বোতাম থেকে চুল ছাড়াতে ব্যস্ত হলো।
অরা ইচ্ছে করেই বলল,” আউ, ব্যথা পাচ্ছি।”
” নড়ো না, এভাবেই থাকো।আমি খুলছি।”
অরা সামিরের হাত সরিয়ে বলল,” আপনি কি আমার চুল ছিঁড়তে চান?”
” ছিঁড়বে না। আমি সাবধানে খুলে আনছি তো।”
“দরকার নেই। আমি খুলছি।”
অরা নিজে খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু সে চাইছিল জটটা না খুলুক। এভাবেই তারা কাছাকাছি থাকুক অন্তত কিছু সময়। সামির অরার চুলের গন্ধে তাল হারিয়ে ফেলছে বার-বার। তার বেহায়া চোখ দু’টো সেলোটেপের মতো আটকে আছে অরার চেহারায়। অরা লাজুক হেসে জিজ্ঞেস করল,” এভাবে কি দেখছেন?”
সামির অন্যদিকে ফিরে বলল,” কই? কিছু না!”
অরার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। এই লোক ভাঙবে তবু মচকাবে না। এতো ইগো কেন? ইচ্ছে করেই সামিরের বোতাম টেনে ছিঁড়ে ফেলল অরা।
“এটা কি হলো?” সামির অবাক।
” স্যরি… ছিঁড়ে গেছে।”
সামির তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেল। অরা নিচুস্বরে বলল,” গেস্টরুমে যাচ্ছেন?”
” হুম। এতো এলোমেলো ঘরে আমি ঘুমাতে পারব না।”
অরা বিছানায় ছড়ানো বইগুলোর দিকে চেয়ে মনখারাপ করে বলল,” শুধু শুধুই এতো বই কিনলাম৷ এখন এসব কোনো কাজে আসবে না।”
তার মনখারাপ করা কণ্ঠ শুনে সামির কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবল। তারপর বলল,” তুমি কি সিরিয়াস? আসলেই আমার ভার্সিটিতে ভর্তি হতে চাও?”
” চাই তো। কিন্তু সুযোগ কই?”
” তুমি চাইলে আমি ব্যবস্থা করতে পারি। কিন্তু এক্সাম অনেক চ্যালেঞ্জিং হবে। সেকেন্ড টাইমার হিসেবে তোমার মার্কস কেটে রাখা হতে পারে। চান্স পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। তখন মনখারাপ হবে।”
অরা উৎফুল্ল গলায় বলল,” এর মানে কি সুযোগ আছে?”
” একটা সুযোগ আছে। আমি তোমাকে হেল্প করব। ডন্ট ওরি।”
অরা খুশিতে বাক-বাকুম হতে নিয়েও চুপসে গেল। সামির হেল্প করলে তো ঝামেলা হবে। যদি সে ফিজিক্স রিলেটেড কোনো সাবজেক্ট পেয়ে যায়? তাছাড়া সামির আবার তার টিচার হোক এটা সে কোনোমতেই চায় না।
” ইম্পসিবল!” অরা প্রাণপণে উচ্চারণ করল।
সামির ভ্রু কুঁচকে বলল,” কেন?”
” আপনার হেল্প আমার লাগবে না। আমি নিজেই নিজেকে হেল্প করতে পারি।”
” অরা, আমি কিন্তু তোমার ভালোর জন্য বলছি। এক্সামটা খুব চ্যালেঞ্জিং। এখন বুঝতে পারছো না। কিন্তু পরে চান্স না হলে আফসোস করবে।”
” আমি আফসোস করব না। আপনি আমাকে আন্ডারেস্টিমেট করছেন কেন? আমি নিজে নিজে কি কিছু করতে পারি না? আপনার সাহায্য কেন লাগবে আমার?”
” এটা আন্ডারেস্টিমেট করা না৷ আমি হেল্প করলে বিষয়টা তোমার জন্য ইজি হবে।”
” লাগবে না। আমার চ্যালেঞ্জিং কাজই পছন্দ। আমি আপনাকে চ্যালেঞ্জ করলাম, আপনার হেল্প ছাড়াই চান্স পেয়ে দেখাব।”
সামির কেমন ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে চাইল৷ হাত ভাঁজ করে বলল,” ও তাই নাকি? আর যদি চান্স না পাও? তখন কি হবে?”
অরা এই প্রশ্নে খানিক বিব্রত হলো, তবে দমল না। আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,” অবশ্যই পাবো। না পেলে… আপনি যা বলবেন আমি তাই করব।”
” শিউর? আমি যা বলব তাই?”সামিরের চোখ চকচক করে উঠল। অরা একটু নিভে গিয়ে বলল,” হুম। কিন্তু যদি আমি চান্স পাই, তখন? আপনি আমাকে কি দিবেন বলুন?”
সামির মাথা নেড়ে বলল,” আমিও তাই দিব যা তুমি চাইবে।”
অরা উচ্ছ্বসিত হলো এবার। বলল,” ইয়েস… তাহলে ঠিকাছে। এবার আমাকে পড়াশুনা করতে দিন।”
” কিন্তু মনে রেখো… এটা কিন্তু একটা চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ তুমি নিজের ইচ্ছায় নিয়েছো। আমি তোমাকে হেল্প করতে চেয়েছিলাম…. বাট তুমি তো শুনলে না।এখন তাহলে আমি তোমার প্রতিপক্ষ। আমার কাজ হবে তোমাকে ডিস্ট্র্যাক্ট করা। আর যদি তুমি হেরে যাও তাহলে কিন্তু আমি যা বলব তাই করতে হবে!”
এবার অরার কেমন ভয় ভয় লাগছে। চ্যালেঞ্জটা নিয়ে কি সে বিপদে পড়ল? ধূর, বিপদ কেন হবে? চেষ্টা করলে মানুষ কি-না পারে! সে বলল,” হুম। মনে থাকবে। কিন্তু আপনি আমাকে ডিস্ট্র্যাক্ট করবেন কেন?”
” কারণ এটা একটা চ্যালেঞ্জ!”
সামিরের ঠোঁটে কেমন উদ্ভট হাসি।অরার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল সেই হাসি দেখে। সে এভাবে কেন বলছে?
সামির তার কথা শেষ করে রুম থেকে চলে গেল। যাওয়ার আগে পেছনে তাকিয়ে মুচকি হাসল একবার। অরা ভেবেছিল সামির মজা করছে। কিন্তু পরদিন থেকে সত্যিই সে অরাকে ডিস্ট্রাক্ট করতে লাগল। অরা যাতে কোনোভাবেই পড়াশুনায় মনোযোগ দিতে না পারে সেজন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো শুরু করল।
চলবে