রুপালি মেঘের খামে পর্ব-০৮

0
651

#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz

৮.
পুরো অনুষ্ঠান জুড়েই অরা অন্যমনস্ক হয়ে বসেছিল। কারো সঙ্গে কথা বলছিল না। সে এমনিও বেশ চুপচাপ কিন্তু এখন যেন একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। রূপা অরাকে ধাক্কা মেরে বলল,” তুই হঠাৎ এমন সাইলেন্ট মোডে চলে গেলি কেন? কাহিনী কি দোস্ত? নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। ওই ঘটনার পর থেকেই এমন হ্যাং মেরে আছিস। সত্যি করে বলতো, উনি কি তোকে ঘরে নিয়ে আবার কিস করেছে?”

অরা ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকাল। তেরছা মেজাজ নিয়ে উত্তর দিল,” ফালতু কথা বলবি না একদম।”

” তাহলে তোর হয়েছেটা কি?” রূপা গালে হাত রেখে তাকিয়ে রইল অরার মুখের দিকে৷ তারা স্টেজে বসে আছে। সামির এখানে নেই। সে বোধহয় ইচ্ছাকৃতই অরার থেকে দূরে থাকছে। ছবি তোলার জন্যেও তাদের একত্র করা যাচ্ছে না। সামিরের ভাষ্যমতে যথেষ্ট ফটোশ্যুট হয়েছে। ছবি তুলে সে বিরক্ত। ক্যামেরাম্যানরাও ঝাড়া হাত-পা নিয়ে ঘুরে-বেড়াচ্ছে৷ এই প্রথম কোনো রিসিপশনের বর-বউ দু’জনেই ছবি তুলতে অনাগ্রহী।

অরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রূপা যেই মেয়ে, মুখ থেকে কথা না বের করে ছাড়বে না৷ তাকে ভোলানোর জন্য অরা প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা করল,” আগে বল তোর সমস্যা কি? আমার দেবরকে দেখছি কারণে-অকারণে শুধু তোর দিকে তাকিয়ে আছে। তুইও হুট-হাট উধাও হয়ে যাচ্ছিস। গতকাল থেকে কম কথা বলছিস। এতো শান্ত থাকার মেয়ে তুই না। অবশ্যই কিছু হয়েছে। বলতো ব্যাপারটা কি?”

অরা জেরা করার ভঙ্গিতে তাকাল। রূপা অপ্রস্তুত হয়ে উঠল। ইতি-উতি করে বলল,” ধূর, কি আন্দাজি কথা বলিস? তুই কি মিন করতে চাইছিস? আমার প্রেমে হয়েছে তাও তোর হাবলা দেবরের সাথে? তাও মাত্র একদিনে? ইটস কোয়াইট ইম্পসিবল অরা। হাহ!”

রূপা উঠে যেতে নিচ্ছিল। অরা তার হাত চেপে ধরে বলল,” সত্যি কথা না বলে এখান থেকে কোথাও যেতে পারবি না তুই। যদি না বলিস তাহলে আমি সায়ান ভাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করব। কেন আমার সুন্দরী বান্ধবীর পেছনে সে ঘুর-ঘুর করছে।”

রূপা হেসে ঠাট্টার স্বরে বলল,” তুই এমন কিছুই করতে পারবি না৷ আমি জানি।”

” পারব কি পারব না সেটা দেখবি? এই সায়ান ভাই..”

অরা খুব জোরে ডাকল। সায়ানও সাথে সাথেই ছুটে আসছে। রূপা বিপদগ্রস্ত হয়ে ফিসফিসানো কণ্ঠে বলল,” প্লিজ অরা, এরকম করিস না৷ তুই না ভালো মেয়ে?”

অরা দাঁতে দাঁতে চেপে বলল,” আমি মোটেও ভালো মেয়ে না। সেটা তুই খুব ভালো করে জানিস।”

রূপা এদিক-ওদিক তাকাল। লম্বা একটা শ্বাস টেনে রিল্যাক্স হয়ে বলল,” ঠিকাছে,আমি বলছি। কিন্তু তুই হাসতে পারবি না।”

অরার এখন থেকেই হাসি পাচ্ছে। খুব কষ্টে নিজেকে দমিয়ে বলল,” আচ্ছা বল।”

ফ্ল্যাশবেক-
ইস্টার্ন প্লাজার বাইরে অনেকক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছে সায়ান। পুরো শপিং কমপ্লেক্স ভাজা ভাজা করেও মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ সে ফিরে যাবে কি-না ভাবছিল৷ তবে যাওয়ার আগে অরাকে ফোন করতে হবে। সে মোবাইল হাতে নিল। তখনি হঠাৎ উত্তর দিক থেকে ধেঁয়ে আসতে লাগল রূপা। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল,” ধরুন, ধরুন, ধরুন, আরে চোর যাচ্ছে, ধরুন।”

সায়ান হতবিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করল, ধেঁয়ে আসা মেয়েটি তার দিকেই আসছে।মাথায় নীল রঙের ক্যাপ, গায়ে সাদা টি-শার্ট আর ডেনিম জ্যাকেট, ক্যাপের সাথে মিলিয়ে একই রঙের জিন্স প্যান্ট। পায়ে পাম্প শু। ছবির থেকেও বাস্তবে দেখতে কয়েক গুণ বেশি মিষ্টি এই মেয়েটির দিকে সে হাঁ করে চেয়েই রইল। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা রোগা-পাতলা লোকের সাথে সংঘর্ষ হলো তার।

লোকটির হাত থেকে পার্স পড়ে গেল৷ সায়ান অন্যমনস্ক অবস্থায় ভূমি থেকে পার্সটা তুলে ছেলেটির হাতে দিল। পার্স নিয়ে ছেলেটি আবার প্রাণপণে দৌড় দিল। এদিকে রূপার চোখে-মুখে আগুন জ্বলছে। তেড়ে এসে সায়ানকে ধাক্কা মেরে বলল,” মাথায় কি গোবর? ভ্যাবলা একটা!”

সায়ান জবাব দিল না। সে বিস্ময় নিয়ে রূপাকে দেখছে। ঘর্মাক্ত মুখ, লাল চোখ, তীক্ষ্ণ নাকের ডগায় সে কি তেজ! মেয়ে তো নয় যেন আস্তো নাগা মরিচ। কিছুদূর যেতেই পা পিছলে রাস্তার মাঝখানে পড়ে গেল রূপা। কয়েকজন ছেলে হৈ-হৈ করে দৌড়ে এলো তাকে তুলতে। সায়ানও ছুটে গেল।

দুইহাতে সে রূপাকে ধরে বলল,” বেশি ব্যথা পেয়েছেন ম্যাডাম?”

রূপা কটমট দৃষ্টিতে বলল,” আপনাকে আমি পুলিশে দিব।”

” কিন্তু আমি কি করলাম?”

রূপা উঠে দাঁড়িয়ে আক্রমণাত্মক স্বরে বলল,”পুরো পাঁচহাজার টাকা ছিল আমার পার্সে। পঁচিশ হাজারের ফোনটাও যেতো যদি পকেটে না রাখতাম। সব যেতো, আপনার জন্য!”

রূপা খপ করে সায়ানের গলা চেপে ধরল। সায়ান তার আচরণ দেখে ভয়ে চুপসে গেছে। অপরাধী স্বরে বলল,”স্যরি ম্যাডাম। বুঝিনি যে ওটা চোর ছিল।”

” আপনাকে মেরে আমি ভর্তা বানাব। নিজের হাতে আমার পার্স চোরের হাতে তুলে দিয়েছেন। আমার তো মনে হচ্ছে এই চক্রের সাথে আপনিও জড়িত। আপনিও একটা ছিনতাইকারী!”

সায়ান দ্রুত বলল,” বিশ্বাস করুন এমন কিছুই না। আর আমি কিভাবে বুঝব যে ওটা চোর?”

” কিভাবে বুঝবেন মানে? আমি যখন চোর চোর বলে চেঁচাচ্ছিলাম তখন আপনার কান কই ছিল? শুনতে পাননি?”

রূপা অনেক গর্জন করে কথা বলছে। সায়ানের কান ফেটে যাচ্ছে। কাঁচুমাচু গলায় বলল,” আমি তো খেয়াল করিনি। আপনাকে দেখছিলাম শুধু।”

” শুধু আমাকে দেখছিলেন মানে? আমি কি বাঘ না হাতি যে হাঁ করে দেখতে হবে?”

রূপা খেয়াল করল আশেপাশের সবাই তাদের দেখছে। সে নিজেকে শান্ত করে সায়ানের কলার ছেড়ে দিল।

সায়ান তার মানিব্যাগ বের করে বলল,” স্যরি, আমি ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি। এই নিন আপনার পাঁচহাজার টাকা।”

” আপনার টাকা আমি কেন নিবো? আমাকে ছ্যাঁচরা মনে হয়?

” একদম না, আমি তো শুধু নিজের ভুল শুধরানোর চেষ্টা করছি। আপনি টাকাটা রাখলে আমি খুশিই হবো।”

রূপা গুণে দেখল সত্যি পাঁচহাজার আছে নাকি। তারপর নিচু গলায় বলল,” বরাবর পাঁচহাজার ছিল না৷ এর চেয়ে কিছু কম ছিল আমার ব্যাগে।”

” তাহলে বাকিটা দিয়ে আমাকে কফি অফার করতে পারেন..” সায়ান হাসল। রূপা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাতেই হাসিটা মুছে ফেলল দ্রুত। মলিন মুখে বলল,”আপনাকে নিতে আসা আমার ভুল হয়েছে।এখন মনে হচ্ছে না এলেই ভালো হতো। ওই চোরটাকে ধরতে পারলে কি করতেন আপনি?”

” মেরে বস্তা বানাতাম একদম৷ রূপার জিনিস চুরি করার মজা বুঝিয়ে দিতাম শা’লাকে। বাই দ্যা ওয়ে, আপনাকে কে পাঠিয়েছে?”

” অরা ভাবি।”

রূপা কেমন তাচ্ছিল্য দৃষ্টিতে সায়ানকে উপর-নিচ দেখতে লাগল। সায়ান নিজের অবস্থা দেখে খানিকটা লজ্জা পেল। কুণ্ঠাবোধ নিয়ে বলল,” আসলে দেয়ালে রং লাগাচ্ছিলাম তো, ওইসময় ভাবি এসে বলল আপনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তাড়াহুড়ো করে এভাবেই চলে এসেছি।”

“ও।”

রূপা হাঁটতে হাঁটতে বলল,” কিন্তু এমনভাবে অরাকে ভাবি ডাকছেন, আমি ভাবলাম আপনি তার দেবর!”

সায়ান শব্দ করে হাসল। যেন খুবই মজার কৌতুক শুনেছে। রূপা ভাবল, এই বোকা ধরণের ছেলে অরার দেবর হতে পারে না। যেখানে বড়ভাই এতো স্মার্ট সেখানে ছোট ভাই নিশ্চয়ই এমন লেজে-গোবরে হবে না। রূপা উৎফুল্ল গলায় বলল,” আপনি সায়ান সাহেবকে চেনেন?”

” সায়ান সাহেব? সেটা আবার কে?”

” আরে, আপনার অরা ভাবির দেবর!”

” ও, ছোটভাইয়ার কথা বলছেন? চিনব না কেন? সে তো খুবই ভালোমানুষ। ”

” তাই নাকি? আমি কি ভাবছি জানেন? আপনার ছোটভাইয়াকে পটিয়ে বিয়ে করে ফেলব। তারপর ওই বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা করব। আপনি আমাকে ডাকবেন ছোটভাবি।”

সায়ান এই কথা শুনে বিষম খেল। কাশতে কাশতে বলল,” খুবই ভালো প্ল্যান ম্যাডাম।”

” অরা আর আমি ছোট থেকেই ঠিক করেছিলাম৷ বিয়ে করলে আপন দুইভাইকে করব। যেন সারাজীবন একসাথে থাকতে পারি। আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়? উনি আমাকে দেখে পটবে?”

” অবশ্যই পটবে ম্যাডাম। আপনি এতো সুন্দর! কিন্তু কিভাবে ভাইয়াকে পটাবেন সেটা কি ঠিক করেছেন?”

” যদি তার সঙ্গে আমার দেখা হয় তাহলে ফট করে একটা চুমু দিয়ে বলব, আই লভ ইউ।”

সায়ান চমকে উঠল। রূপা বলল,” আপনি যেমন এখন ভয় পেলেন, সেও ভয় পেয়ে যাবে। তারপর থেকে সারাক্ষণ শুধু আমার কথাই ভাববে। আইডিয়াটা দারুণ না?”

রূপা একচোখ টিপল। সায়ান বহুকষ্টে ঢোক গিলে বলল,” হুম। খুবই দারুণ আইডিয়া। কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে আপনি অরা ভাবির বেস্টফ্রেন্ড।”

” কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?”

” মানে ভাবি এতো লাজুক আর আপনি…”

রূপা খিলখিল করে হেসে উঠল,” এই কথা শুধু আপনি না, সবাই বলে।”

রূপা অরার জন্য খুব সুন্দর একটা ল্যাম্পশেড কিনল। বাকি টাকা সায়ানকে ফিরিয়ে দিল। সায়ান নিতে চাইছিল না। রূপা জোর করে দিল। তার জিনিস ছিনতাই হয়ে গেছে, এটা তার কপালের দোষ। তাই বলে সায়ানের থেকে ক্ষতিপূরণ নিবে না। বাকি টাকাও সে বাড়িতে গিয়ে ফেরত পাঠাবে।

তারা ফেরার পর প্রবেশমুখেই দেখা হয়ে গেল সামিয়ার সাথে। সায়ানকে দেখেই সামিয়া বলল,” ছোটভাইয়া, দ্রুত বাবার ঘরে যাও। তোমাকে ডাকছে।”

রূপা এই কথা শুনে আৎকে উঠল। ছোট ভাইয়া মানে? বিস্ময়ে চোখ দু’টো বড় করে সায়ানের দিকে চাইল সে। অরার মতো তারও শরীর থম মেরে গেল। তারপর থেকে আর একবারও সায়ানের সামনে যেতে পারেনি লজ্জায়।

সব শুনে অরা হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে উঠল। রূপা ক্ষীপ্ত গলায় বলল,” তুই প্রমিস করেছিলি যে হাসবি না।”

” তোর বোকামি দেখে না হেসে পারছি না। এটা আমি করলেও মানাতো। কিন্তু তুই কিভাবে এতোবড় বোকামিটা করলি রূপা?”

রূপা মুখ নিচু করে বসে আছে। সে তো আসল কথা এখনও বলেইনি। লোড শেডিং এর সময় সায়ান তাকে নির্জনে পেয়ে চুমু দিয়েছে। রূপার গাল এখনও চিনচিন করছে। কি বদমাইশ একটা লোক! অবশ্য রূপারও দোষ আছে। সে নিজেই তো প্রথম দেখায় আবোল-তাবোল বকেছিল। এখন খুব অস্বস্তি লাগছে।

রাত তখন এগারোটা বাজে। লিভিংরুমের বেসিনে মুখ ধুঁতে এসেছে রূপা। এখানটায় কেউ নেই। হঠাৎ আয়নার প্রতিবিম্বে সায়ানকে দেখে চমকে উঠল সে। পেছনে ফিরতেই দেখল সায়ান দাঁড়িয়ে আছে।

রূপা দ্রুত চলে যেতে নিল। কিন্তু সায়ান তার পথ আটকে বলল,” ওয়েট, এরকম তো কথা ছিল না। আপনি আমাকে পটাবেন বলেছিলেন। অথচ এখন পটে যাওয়ার পর ইগনোর করছেন?”

রূপা হকচকিয়ে বলল,” দেখুন, আমি জানি এসব আপনি আমাকে লজ্জা দেওয়ার জন্য করছেন। কিন্তু আমি তখন সিরিয়াসলি মজা…”

রূপার কথার মাঝেই সায়ান বলে উঠল,” আপনার লজ্জাও আছে নাকি?”

রূপার শ্যামলা মুখ লালচে হয়ে উঠল মুহূর্তেই। রাগী স্বরে বলল,” আমার সামনে থেকে সরে যান। নাহলে কিন্তু ঘুঁষি মারব।”

সায়ান রূপার নাকের উপর আঙুল রেখে বলল,” কথায় কথায় এমন টমেটোর মতো লাল হয়ে যান কেন? আপনার বুঝি অনেক রাগ!”

” হ্যাঁ। অনেক। আমার রাগ দেখাব?”

রূপা তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে উপরে তুলল। সায়ান তার হাতটা চেপে ধরে বলল,” লভ এট ফার্স্ট সাইটে বিশ্বাস করেন?”

” না, করি না।” রূপা ঝারি মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল।

হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ পেতেই দ্রুত চলে গেল রূপা। সায়ান আয়নার কাছে গিয়ে কালো মার্কার পেন দিয়ে লিখল,” আমি ছাদে যাচ্ছি, আপনিও আসুন। অপেক্ষায় থাকব কিন্তু। I love u at first sight we met.”

অরা রূপাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মেয়েটা কোথায়? এই সময় তার রূপাকেই সবচেয়ে বেশি দরকার। অথচ তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। বেসিনের সামনে এসে অরা থমকে দাঁড়াল। আয়নার মধ্যে লেখাটা দেখে ছলাৎ করে উঠল তার বুক। সামির লিখেছে নাকি এটা? এই কথা চিন্তা করতেই বেসিনের পাশের ওয়াশরুম থেকে বের হলো সামির। তাকে দেখে অরা নিশ্চিত হলো, এটা সে-ই লিখেছে।

সামির অবাক হয়ে বলল,” তুমি কি এখানে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছো? কিছু বলবে?”

অরা দ্রুত মাথা নেড়ে চলে গেল। সামির বেসিনের কাছে যেতেই তার দৃষ্টি আটকে গেল আয়নাতে। লেখাটি দেখে বিস্ময়ে হতভম্ব সে। ধরেই নিল যে এটা অরা লিখেছে। সেজন্যই বুঝি লজ্জা পেয়ে চলে গেল!

সায়ান রূপার অপেক্ষায় ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক বাতাস চারদিকে। পতপত করে উড়ছে তার পাঞ্জাবী। ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজে। সামির বিলম্ব না করে আরও আগে থেকেই ছাদে এসে বসে আছে। সেও অরার অপেক্ষায়। কিন্তু অরা এখনও আসছে না।

হঠাৎ দুইভাই মুখোমুখি হলো। সায়ানকে দেখে সামির ভ্রু কুঁচকাল। অন্যদিকে সামিরকে দেখে সায়ানও অবাক। ভাইয়া এই সময় ছাদে কি করছে? তাকে দেখেই কি রূপা আসছে না? সামিরের মনেও একই প্রশ্ন উদয় হলো। সায়ান কেন ছাদে? সে থাকলে তো অরা আসবে না।

” তুই এখানে কি করছিস?” সামিরের তীক্ষ্ণ কণ্ঠ।

সায়ান ভড়কে তাকাল। সে সামিরকে বেশ ভয় পায়। ছোটভাইরা সাধারণত বড় ভাইয়ের সাথে ফ্রী হয়৷ কিন্তু তাদের সম্পর্কটা একটু ভিন্ন। সায়ান অতটা ফ্রী না৷ সে তার বাবাকেও অতটা ভয় পায় না যতটা সামিরকে পায়। ইতস্তত করে বলল,” ঘরে খুব গরম। তাই ছাদে একটু বাতাস খেতে এসেছিলাম।”

সামির গম্ভীর মুখে বলল,” অনেক বাতাস খাওয়া হয়েছে। এবার নিচে যা।”

” তুমি কেন এখানে ভাইয়া?”

সামির তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই সায়ান মাথা নামিয়ে দ্রুত নিচে চলে গেল। আরও বেশ কিছুক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল সামির। কিন্তু অরা আসছে না। বাধ্য হয়ে সেও নিচে ফিরে গেল।

_______________
সেদিনের মতো আজকে ফুল দিয়ে বিছানা সাজানো হয়নি৷ তবে ঘর খুব পরিপাটিভাবে গুছানো হয়েছে। দেয়ালে মরিচবাতি লাগানো হয়েছে। অন্তি অরাকে শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। খুব সুন্দর ফ্লোরাল প্রিন্টের পাতলা একটা শাড়ি। অফ শোল্ডার গোলাপি ব্লাউজ।

অরা বলল,” আমি শাড়ি পরে ঘুমাতে পারব না আপু। অন্যকিছু পরি?”

অন্তি বলল,” শাড়ি পরে ঘুমাতে হবে কে বলেছে? আজরাতে তোমার এমনিও ঘুম হবে না। তাছাড়া শাড়ি তো খুলেই ফেলা হবে।”

লজ্জায় নির্বাক হয়ে গেল অরা। এই মেয়ের মুখে কিছু আটকায় না। তাকে কড়া করে একটা ধমক দিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু অরা কখনও কারো সাথে রূঢ় আচরণ করতে পারে না। তাছাড়া মেয়েটা তার থেকে বয়সে বড়।

বেশ কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢুকল সামির। তাকে দেখে অকারণেই দাঁড়িয়ে পড়ল অরা। এমন একটা ভাব, যেন এখনি তাকে ছুটে পালাতে হবে। অন্তি হাত ধরে টেনে অরাকে বসিয়ে বলল,” তুমি উঠলে কেন? উঠবো তো আমি।”

সামির বিরক্ত গলায় বলল,” তুই এখানে কি করছিস?রাত সাড়ে বারোটা বাজে।”

অন্তি বলল,” আজ সারারাত এখানে বসে গল্প করব ভাবছি।”

সামির হাত ভাঁজ করে থমথমে কণ্ঠে বলল,” পাঁচ মিনিটের মধ্যে রুম খালি কর।”

অন্তি গালে হাত রেখে বলল,” কেন? আর বুঝি তর সইছে না?”

অরা এই কথায় চরম অপ্রস্তুত। অন্তি শুধু সামিরের ফ্রেন্ড না, কাজিনও হয়। এজন্যই সে এই বাড়িতে সবসময় থাকে। কিন্তু এই মেয়ে থাকলে যে অরাকে এতোটুকু শান্তি দিবে না। সেটা বোঝাই যাচ্ছে।

অন্তি দুইহাতের বাহুডোরে জড়িয়ে ধরল অরাকে। ঢং করে বলল,” তাহলে কি অরাকেও নিয়ে যাবো? তুই তো বললি রুম খালি করতে।”

” ও যাবে না।”

” কিভাবে বুঝলি যাবে না? আমি বললেই ও যাবে।”

সামীর পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো অরার দিকে। প্রশ্ন করল,”তুমি যেতে চাও?”

অরা চমকে উঠল। তৎক্ষণাৎ কি বলবে বুঝতে পারল না। তার ‘হ্যাঁ’ বলতেই ইচ্ছে করছে। অন্তি অতি উৎসাহী হয়ে বলল,” নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ। অরা আমার সাথেই যেতে চায়। তোর কাছে থাকতে চায় না৷ তোকে ভয় পাচ্ছে।”

সামির অরার দিকে তাকিয়ে আছে। অরা জড়সড় হয়ে গেল। সামির শান্ত স্বরে বলল,” সত্যি যেতে চাও?”

অরা কিছু বলল না। অন্তি তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,” থাক, বাবা। আমি ঝামেলায় পড়তে চাই না। নানু শুনলে আমাকে বকবে। তোর বউ তোর কাছেই রেখে গেলাম।”

অন্তি যাওয়ার সময় সামিরের কাছে এসে থামল একটু। ফিসফিসিয়ে বলল,” সাবধানে, হুম?”

সামির ক্রুদ্ধ গলায় বলল,” ভাগ!”

অন্তি হাসতে হাসতে বের হয়ে গেল। সামির ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। অরার কণ্ঠমণি শুকিয়ে আসছে। এতো নার্ভাস লাগছে!ঢোক গিলতেও যুদ্ধ করতে হচ্ছে। ধপ করে বিছানায় বসল সে। সামিরের চোখ ঝলমল করছে। সে নরম গলায় বলল,” ছাদে কেন আসোনি?”

অরা এই প্রশ্নের কি উত্তর দিবে বুঝল না। সে তো ছাদে যেতেই চায়নি। আর এটাও একটা প্রত্যাখ্যান৷ তার এখনও সময় প্রয়োজন।

সামির হঠাৎ অরার কোমর ধরে কাছে আনল। জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে আলতো চু-মু দিল। অরার শরীরে তীক্ষ্ণ একটা স্রোত বয়ে গেল। সামির মৃদু হেসে বলল,”তুমি যেটা করেছো সেটাও আমি এক্সপেক্ট করিনি। কিন্তু আমি কত খুশি হয়েছি বোঝাতে পারব না।”

অরা বুঝতে পারল না। সে কি করেছে? তার গা ঠকঠক করে কাঁপছে। সামির তাকে পাজাকোলায় তুলে নিল।অরা হতবিহ্বল। আচমকা এহেন আক্রমণ মেনে নিতে না পেরে রুদ্ধ স্বরে অনুরোধ করল,” এখন না, প্লিজ।”

সামির নিষেধ শোনার জন্য এতোটুকু প্রস্তুত না। অরাও তাকে ভালোবাসে, এইটুকু সত্যই যথেষ্ট তার জন্য। আজ অরাকে বুঝতে হবে সে কতটা পুড়িয়েছে সামিরকে। তার অপেক্ষায় সামির কত বেশি তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে। ছাড়ার বদলে সামির আরও শক্ত করে চেপে ধরল অরার কোমল শরীর।ঘাড়ের পেছনে হাত রেখে ঠোঁটে দীর্ঘ চুম্বন করল। অরা চোখ দু’টো মেলে আবার বন্ধ করল। সে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলবে বোধ হয় আবারও।

অরা কেবল ছটফট করছিল। শেষে উপায়ন্তর না দেখে করে ফেলল একটি দুঃসাহসিক কাজ। যা কাল হয়ে দাঁড়ালো জীবনে। অরা সামিরের গালে চ-ড় মা-রল। চ-ড়ের ধা-ক্কা সামলাতে না পেরে সামির ছেড়ে দিল অরার ঘাঁড়, তার সম্পূর্ণ শরীর। কিছুমুহূর্ত নীরব কা-টল। অরা যখন বুঝতে পারল যে সে একটা ভুল করেছে তখন যেন খুব দেরি হয়ে গেছে! সামির আচমকা উঠে দাঁড়ালো এবং রুম থেকে বের হয়ে গেল। অরা বার কয়েক উচ্চশব্দে বলতে চাইল,” স্যরি।”

কিন্তু মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করা গেল না। কেবল চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে